দীপংকর গৌতম
সন্তোষ গুপ্ত
কাজের মধ্য দিয়ে যারা বেঁচে থাকেন সন্তোষ গুপ্ত তেমনি, আদর্শের এক বাতিঘর। বহুমাত্রিক প্রতিভাধর এই ব্যক্তিত্বের বিচরণ ছিলো শিল্পকলার প্রান্তরজুড়ে। তাকে নিয়ে বিভিন্নজনের বিভিন্ন সময়ে লেখায় সন্তোষ গুপ্তর বর্ণিল কর্মজীবনের সামগ্রিক পরিচয়। তাঁর জীবন সংগ্রাম, পরিবার, লেখাজোখার পাশাপাশি তার সময় ও প্রতিনিধিত্বশীল সব মানুষদেরও দেখতে পাওয়া যায় তার জীবন ও সময় পাঠ করলে। যার মধ্যে ব্যাপ্ত রয়েছে তার সময় কাল, সংস্কৃতি ও রাজনীতি। আপোসহীন ও সময়ের সঙ্গে লড়ে যাওয়া সন্তোষ গুপ্ত সততা নিষ্ঠা ও মূল্যবোধের দিক থেকে এখনও এক বাতিঘর। তিনি ছিলেন তাঁর কালের এক খ-চিত্র।
খ্যাতিমান সাংবাদিক ও অসম ব্যক্তিত্বের অধিকারী সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে আমার কবে পরিচয় হয়েছিলো ঠিক মনে নেই। তবে প্রথমে দৈনিক সংবাদে গিয়ে যা দুএকটা কথা বলেছিলাম। সন্তোষ গুপ্ত যে টেবিলে বসতেন তার পরিসর ছিলো বিশাল। প্রচুর কাগজে ভরা বললেও ভুল হবে। কাগজের স্তূপের মধ্যে বসে লিখতেন তিনি। এডিট করতেন চিঠিপত্র ও উপসম্পাদকীয় ইত্যাদি। ‘মুক্ত আলোচনা’ নামে সংবাদে একটা পাতা সম্পাদনা করতেন তিনি।
একবার একটা ঘটনা ঘটেছিলো। মুক্ত আলোচনায় আমি সুসং দুর্গাপুর ঘুরে এসে ওখানকার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংগ্রাম এবং আদিবাসী গারোদের জীবন-সংস্কৃতি-রিচুয়াল নিয়ে ধারাবাহিক একটা লেখা লিখলাম। লেখার শিরোনাম ছিলো ‘সুসং-দুর্গাপুর পথ থেকে পথে’। লেখাটার খুব সাড়া পাচ্ছিলাম।
একদিন এক এ্যাডভোকেট একটা চিঠি লিখে একটা তথ্যকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। সন্তোষ গুপ্ত প্রতিটি লেখা ভালো করে এডিট করে ছাড়তেন। ওই ভদ্রলোকের চিঠি পাওয়ার পর তিনি চিঠি ছাপলেন এবং নিচে তার বক্তব্য জুড়ে দিলেন। এভাবে সাত কিস্তি জবাবের পর লেখা যুদ্ধ সাঙ্গ হলো। তার মধ্য দিয়ে সংবাদের নেত্রকোনা অঞ্চলের পাঠকেরা অন্তত জেনেছিলেন যে নেত্রকোনা অঞ্চলের প্রতœতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, ইতিতহাস বিষয়ে সন্তোষ গুপ্তের ধারণা কতো প্রখর।
‘অনিরুদ্ধ’ কলাম লেখা এই মনীষীর কাছে যেতে যেতে একসময় অফিস থেকে বাসায় যাওয়া শুরু হয়। মনের অজান্তেই আমি তার পরিবারের একজন হয়ে উঠি। এমনও সপ্তাহ গেছে যে সপ্তাহে প্রতিদিন গল্প-আড্ডা শেষ করে তার ছোট ছেলে খ্যাতিমান ব্যাংকার প্রিয়তোষ গুপ্তের সঙ্গে খেয়ে দেয়ে বাসায় চলে আসতাম। তার কথা শুনতে শুনতে রাত গভীর হয়ে যেতো। মাঝেমধ্যে বাইরে আসতেন সিগারেট খেতে। সে সময়ও চলতো আড্ডা। তার মধ্যে খেয়াল করতাম তার পড়াশোনার বিস্তৃত ক্ষেত্র- যা সবই তিনি মনে রাখতে পারতেন। তিনি জানতেন না এমন বিষয় নেই। তার কাছে একদিন একটা গল্প শুনেছিলাম। আজ সেটা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। সন্তোষ গুপ্ত চাকরি করতেন জেলে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। মানুষের ধারণাটা এমন পর্যায়ে সরকার প্রচার করেছিলো যাতে মনে হতো কমিউনিস্টরা তক্ষক বা সাপ জাতীয় প্রাণি। এরা দিনে ঘুমায় আর রাতে বের হয়। জেলে কোন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা গেলে তাকে দেখতে লোকের ভিড় জমে যায়। উঁকি দিয়ে সবাই দেখে কমিউনিস্টরা দেখতে কেমন। পরে সাধারণ মানুষ দেখে সবাই হতাশ হতো। অমন সময় সন্তোষ গুপ্ত সরকারি চাকরিরত অবস্থায় গোপন কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। থাকতেন তাঁতী বাজার মাকে নিয়ে। একদিন পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের মিটিংয়ের দিন ধার্য হলো সন্তোষ গুপ্তের বাসায়। গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি জেনে ফেলেছিলো।
ফলে মিটিং শুরু হলেই পুলিশ ঘিরে ফেলে বাসাটি। অন্যান্য নেতার সঙ্গে গ্রেফতার হন সন্তোষ গুপ্ত। তাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলে একদিন খবর গেল জেলার সাহেব কমিউনিস্টদের দেখতে আসবেন। সব কমিউনিস্টদের এক সারিতে দাঁড় করানো হলো। জেলার একে একে সবাইকে দেখে সন্তোষ গুপ্তের সামনে এসেই ভড়কে গেলেন। যে সরকার কমিউনিস্টদের ভয় পায়, ভয়ংকর মনে করে সে সরকারের কর্মচারি কমিউনিস্ট? সন্তোষ গুপ্তের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও সন্তোষ তুমিও কমিউনিস্ট? সন্তোষ গুপ্তর কথা শুনলে প্রথমে যে কারো মনে হতো তিনি বুঝি কাঠখোট্টা। কিন্তু শিশুর মতো সরল ছিলেন বহুমাত্রিক মেধাবী এই মানুষটি। লেখালেখিতে তাঁর খ্যাতি আসে শুধু কবিতায়, প্রথম দিকে।
আধুনিক কবিদের কাব্য বিচারে তাঁর কবিতা অনন্য। কিন্তু পরে প্রবন্ধ সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। সন্তোষ গুপ্তের বই ‘ইতিহাস আমাদের দিকে’, ‘সমাজতন্ত্রের অন্য ইতিহাস’, ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে’ এবং চিত্রকলার সমালোচনাসহ বহুমাত্রিক সাহিত্যচর্চা করেছেন তিনি। আপাত অর্থে ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে দাঁড়ানো এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তা সম্পর্কে তাঁর মতামত অনেকটা বদলে গেলেও অকপটে তিনি তা বলে গেছেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের দ্বিমত থাকবে, এটাই তো বাস্তব। কিন্তু মতপ্রকাশে তিনি কুণ্ঠা করতেন না, যে কারণে একজন জেলখাটা তুখোড় কমিউনিস্টের লেখায় আমরা দেখি ভিন্ন সুর। সন্তোষ গুপ্তের বক্তব্য স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন:
‘অন্যান্য দর্শনের সঙ্গে মার্কসীয় দর্শনের মৌলিক পার্থক্য হলো মার্কস রাজনীতিকে তাঁর দর্শনের অপরিহার্য অংশ করেছেন। লেনিন তাঁর অনুসরণে দৃঢ় সংগঠন ও কঠিন নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োগ করে বলশেভিক পার্টি গড়ে তোলেন। রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় বলশেভিক পার্টি, যা পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত। সমাজ পরিবর্তনের জন্য সর্বহারা একনায়কত্বের ধারণা প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিপরীত। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে কমিউনিজমের পার্থক্য হলো প্রথমটি ভাববাদী ও দ্বিতীয়টি পরলোক নিরীশ্বরবাদী ইহজাগতিক ধর্ম। একেশ্বরবাদের স্থান নিয়েছে মনোলিথিক পার্টি-কাঠামো। গণতন্ত্রের চর্চার অস্বীকৃতির কারণেই মানুষ মুক্তির এই মহৎ আদর্শ ট্র্যাজেডি হয়ে দেখা দিল যুগান্তরের পথ নির্মাণের সাধনার ক্ষেত্রে।’
তাঁর মতে, যেসব দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করেছে, তারা সবাই একটি মডেলই ব্যবহার করেছে। পরম অসহিষ্ণুতা একনায়কত্বের অঙ্গ। আর একনায়কত্ব মানেই স্বেচ্ছাচার। ইতিহাসের এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে মানবমুক্তির মডেল হিসেবে গৃহীত পথটির চরিত্র দেখা গেল কমিউনিস্ট শাসিত সব দেশেই একরকম। এটা যখন প্রমাণিত হলো, তা নিয়ে আমাদের দেশের কোনো কমিউনিস্ট গ্রুপ প্রশ্ন করেনি। আদর্শগত মতান্ধতা, ধর্মীয় মতান্ধতা কিংবা জাতি শ্রেষ্ঠত্বের নামে উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামরিক শক্তি যুক্ত হলে তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। বিশ্বাস তার অঙ্গ, যুক্তি নয়। এই যুক্তিহীন পদ্ধতি প্রলেতারীয় একনায়কত্বের নামে জাতীয় গ-ি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করলেই তার চরিত্র বদলায় না।
সন্তোষ গুপ্ত আরো বলেছেন ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদ ও স্টালিনের শ্রমশিবিরের কথা। তিনি বহু লেখক-শিল্পী নির্যাতনের সূত্র ধরে ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজের অন্য ইতিহাস লিখেছেন। আবার তাঁরই গ্রন্থ স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে আমরা দেখি বাংলাদেশের রাজনীতিরও কট্টর সমালোচনা। এত কিছুর পরও জীবনযাপনে সন্তোষ গুপ্ত যেমন ছিলেন সাধারণ, তেমনি ছিলেন বিরলপ্রজ এক ব্যক্তি, যাঁর সততা ও নিষ্ঠার কাছে সব হেরে যায়। তাঁর ‘অনিরুদ্ধ’ কলামের সঙ্গেও অনেকের দ্বিমত আছে; কিন্তু তাঁর যুক্তিকে ফেলে দেওয়ার পথ নেই। সন্তোষ গুপ্তের লেখায় যুক্তিবাদ যেমন প্রখর ছিল, তেমনি তথ্যের ছিল ব্যাপকতা। তাঁর লেখ্যশৈলীর গতিশীলতা পাঠককে বিমোহিত করত। যে কারণে স্যাটেলাইটের যুগেও ‘অনিরুদ্ধ’কে কেউ ভোলেনি, ভুলবে না।
সন্তোষ গুপ্তের একাধিক বইয়ের কথা এর আগে আলোচনা করা হয়েছে। এবার আরেকটা বইয়ের কথা বলবো। বইটির নাম- ‘অনালোকে আলোকস্তম্ভ’ এ বইতে সন্তোষ গুপ্তের কিছু স্মৃতিময় কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। সেখান থেকে সাংবাদিক সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন সন্তোষ গুপ্ত। শহীদুল্লা কায়সারকে নিয়ে তার একাধিক স্মৃতিচারণ থাকলেও এর আগে চোখে পড়েনি।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
দীপংকর গৌতম
সন্তোষ গুপ্ত
মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
কাজের মধ্য দিয়ে যারা বেঁচে থাকেন সন্তোষ গুপ্ত তেমনি, আদর্শের এক বাতিঘর। বহুমাত্রিক প্রতিভাধর এই ব্যক্তিত্বের বিচরণ ছিলো শিল্পকলার প্রান্তরজুড়ে। তাকে নিয়ে বিভিন্নজনের বিভিন্ন সময়ে লেখায় সন্তোষ গুপ্তর বর্ণিল কর্মজীবনের সামগ্রিক পরিচয়। তাঁর জীবন সংগ্রাম, পরিবার, লেখাজোখার পাশাপাশি তার সময় ও প্রতিনিধিত্বশীল সব মানুষদেরও দেখতে পাওয়া যায় তার জীবন ও সময় পাঠ করলে। যার মধ্যে ব্যাপ্ত রয়েছে তার সময় কাল, সংস্কৃতি ও রাজনীতি। আপোসহীন ও সময়ের সঙ্গে লড়ে যাওয়া সন্তোষ গুপ্ত সততা নিষ্ঠা ও মূল্যবোধের দিক থেকে এখনও এক বাতিঘর। তিনি ছিলেন তাঁর কালের এক খ-চিত্র।
খ্যাতিমান সাংবাদিক ও অসম ব্যক্তিত্বের অধিকারী সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে আমার কবে পরিচয় হয়েছিলো ঠিক মনে নেই। তবে প্রথমে দৈনিক সংবাদে গিয়ে যা দুএকটা কথা বলেছিলাম। সন্তোষ গুপ্ত যে টেবিলে বসতেন তার পরিসর ছিলো বিশাল। প্রচুর কাগজে ভরা বললেও ভুল হবে। কাগজের স্তূপের মধ্যে বসে লিখতেন তিনি। এডিট করতেন চিঠিপত্র ও উপসম্পাদকীয় ইত্যাদি। ‘মুক্ত আলোচনা’ নামে সংবাদে একটা পাতা সম্পাদনা করতেন তিনি।
একবার একটা ঘটনা ঘটেছিলো। মুক্ত আলোচনায় আমি সুসং দুর্গাপুর ঘুরে এসে ওখানকার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংগ্রাম এবং আদিবাসী গারোদের জীবন-সংস্কৃতি-রিচুয়াল নিয়ে ধারাবাহিক একটা লেখা লিখলাম। লেখার শিরোনাম ছিলো ‘সুসং-দুর্গাপুর পথ থেকে পথে’। লেখাটার খুব সাড়া পাচ্ছিলাম।
একদিন এক এ্যাডভোকেট একটা চিঠি লিখে একটা তথ্যকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। সন্তোষ গুপ্ত প্রতিটি লেখা ভালো করে এডিট করে ছাড়তেন। ওই ভদ্রলোকের চিঠি পাওয়ার পর তিনি চিঠি ছাপলেন এবং নিচে তার বক্তব্য জুড়ে দিলেন। এভাবে সাত কিস্তি জবাবের পর লেখা যুদ্ধ সাঙ্গ হলো। তার মধ্য দিয়ে সংবাদের নেত্রকোনা অঞ্চলের পাঠকেরা অন্তত জেনেছিলেন যে নেত্রকোনা অঞ্চলের প্রতœতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, ইতিতহাস বিষয়ে সন্তোষ গুপ্তের ধারণা কতো প্রখর।
‘অনিরুদ্ধ’ কলাম লেখা এই মনীষীর কাছে যেতে যেতে একসময় অফিস থেকে বাসায় যাওয়া শুরু হয়। মনের অজান্তেই আমি তার পরিবারের একজন হয়ে উঠি। এমনও সপ্তাহ গেছে যে সপ্তাহে প্রতিদিন গল্প-আড্ডা শেষ করে তার ছোট ছেলে খ্যাতিমান ব্যাংকার প্রিয়তোষ গুপ্তের সঙ্গে খেয়ে দেয়ে বাসায় চলে আসতাম। তার কথা শুনতে শুনতে রাত গভীর হয়ে যেতো। মাঝেমধ্যে বাইরে আসতেন সিগারেট খেতে। সে সময়ও চলতো আড্ডা। তার মধ্যে খেয়াল করতাম তার পড়াশোনার বিস্তৃত ক্ষেত্র- যা সবই তিনি মনে রাখতে পারতেন। তিনি জানতেন না এমন বিষয় নেই। তার কাছে একদিন একটা গল্প শুনেছিলাম। আজ সেটা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। সন্তোষ গুপ্ত চাকরি করতেন জেলে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। মানুষের ধারণাটা এমন পর্যায়ে সরকার প্রচার করেছিলো যাতে মনে হতো কমিউনিস্টরা তক্ষক বা সাপ জাতীয় প্রাণি। এরা দিনে ঘুমায় আর রাতে বের হয়। জেলে কোন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা গেলে তাকে দেখতে লোকের ভিড় জমে যায়। উঁকি দিয়ে সবাই দেখে কমিউনিস্টরা দেখতে কেমন। পরে সাধারণ মানুষ দেখে সবাই হতাশ হতো। অমন সময় সন্তোষ গুপ্ত সরকারি চাকরিরত অবস্থায় গোপন কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। থাকতেন তাঁতী বাজার মাকে নিয়ে। একদিন পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের মিটিংয়ের দিন ধার্য হলো সন্তোষ গুপ্তের বাসায়। গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি জেনে ফেলেছিলো।
ফলে মিটিং শুরু হলেই পুলিশ ঘিরে ফেলে বাসাটি। অন্যান্য নেতার সঙ্গে গ্রেফতার হন সন্তোষ গুপ্ত। তাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলে একদিন খবর গেল জেলার সাহেব কমিউনিস্টদের দেখতে আসবেন। সব কমিউনিস্টদের এক সারিতে দাঁড় করানো হলো। জেলার একে একে সবাইকে দেখে সন্তোষ গুপ্তের সামনে এসেই ভড়কে গেলেন। যে সরকার কমিউনিস্টদের ভয় পায়, ভয়ংকর মনে করে সে সরকারের কর্মচারি কমিউনিস্ট? সন্তোষ গুপ্তের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও সন্তোষ তুমিও কমিউনিস্ট? সন্তোষ গুপ্তর কথা শুনলে প্রথমে যে কারো মনে হতো তিনি বুঝি কাঠখোট্টা। কিন্তু শিশুর মতো সরল ছিলেন বহুমাত্রিক মেধাবী এই মানুষটি। লেখালেখিতে তাঁর খ্যাতি আসে শুধু কবিতায়, প্রথম দিকে।
আধুনিক কবিদের কাব্য বিচারে তাঁর কবিতা অনন্য। কিন্তু পরে প্রবন্ধ সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। সন্তোষ গুপ্তের বই ‘ইতিহাস আমাদের দিকে’, ‘সমাজতন্ত্রের অন্য ইতিহাস’, ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে’ এবং চিত্রকলার সমালোচনাসহ বহুমাত্রিক সাহিত্যচর্চা করেছেন তিনি। আপাত অর্থে ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে দাঁড়ানো এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তা সম্পর্কে তাঁর মতামত অনেকটা বদলে গেলেও অকপটে তিনি তা বলে গেছেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের দ্বিমত থাকবে, এটাই তো বাস্তব। কিন্তু মতপ্রকাশে তিনি কুণ্ঠা করতেন না, যে কারণে একজন জেলখাটা তুখোড় কমিউনিস্টের লেখায় আমরা দেখি ভিন্ন সুর। সন্তোষ গুপ্তের বক্তব্য স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন:
‘অন্যান্য দর্শনের সঙ্গে মার্কসীয় দর্শনের মৌলিক পার্থক্য হলো মার্কস রাজনীতিকে তাঁর দর্শনের অপরিহার্য অংশ করেছেন। লেনিন তাঁর অনুসরণে দৃঢ় সংগঠন ও কঠিন নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োগ করে বলশেভিক পার্টি গড়ে তোলেন। রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় বলশেভিক পার্টি, যা পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত। সমাজ পরিবর্তনের জন্য সর্বহারা একনায়কত্বের ধারণা প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিপরীত। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে কমিউনিজমের পার্থক্য হলো প্রথমটি ভাববাদী ও দ্বিতীয়টি পরলোক নিরীশ্বরবাদী ইহজাগতিক ধর্ম। একেশ্বরবাদের স্থান নিয়েছে মনোলিথিক পার্টি-কাঠামো। গণতন্ত্রের চর্চার অস্বীকৃতির কারণেই মানুষ মুক্তির এই মহৎ আদর্শ ট্র্যাজেডি হয়ে দেখা দিল যুগান্তরের পথ নির্মাণের সাধনার ক্ষেত্রে।’
তাঁর মতে, যেসব দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করেছে, তারা সবাই একটি মডেলই ব্যবহার করেছে। পরম অসহিষ্ণুতা একনায়কত্বের অঙ্গ। আর একনায়কত্ব মানেই স্বেচ্ছাচার। ইতিহাসের এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে মানবমুক্তির মডেল হিসেবে গৃহীত পথটির চরিত্র দেখা গেল কমিউনিস্ট শাসিত সব দেশেই একরকম। এটা যখন প্রমাণিত হলো, তা নিয়ে আমাদের দেশের কোনো কমিউনিস্ট গ্রুপ প্রশ্ন করেনি। আদর্শগত মতান্ধতা, ধর্মীয় মতান্ধতা কিংবা জাতি শ্রেষ্ঠত্বের নামে উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামরিক শক্তি যুক্ত হলে তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। বিশ্বাস তার অঙ্গ, যুক্তি নয়। এই যুক্তিহীন পদ্ধতি প্রলেতারীয় একনায়কত্বের নামে জাতীয় গ-ি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করলেই তার চরিত্র বদলায় না।
সন্তোষ গুপ্ত আরো বলেছেন ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদ ও স্টালিনের শ্রমশিবিরের কথা। তিনি বহু লেখক-শিল্পী নির্যাতনের সূত্র ধরে ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজের অন্য ইতিহাস লিখেছেন। আবার তাঁরই গ্রন্থ স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে আমরা দেখি বাংলাদেশের রাজনীতিরও কট্টর সমালোচনা। এত কিছুর পরও জীবনযাপনে সন্তোষ গুপ্ত যেমন ছিলেন সাধারণ, তেমনি ছিলেন বিরলপ্রজ এক ব্যক্তি, যাঁর সততা ও নিষ্ঠার কাছে সব হেরে যায়। তাঁর ‘অনিরুদ্ধ’ কলামের সঙ্গেও অনেকের দ্বিমত আছে; কিন্তু তাঁর যুক্তিকে ফেলে দেওয়ার পথ নেই। সন্তোষ গুপ্তের লেখায় যুক্তিবাদ যেমন প্রখর ছিল, তেমনি তথ্যের ছিল ব্যাপকতা। তাঁর লেখ্যশৈলীর গতিশীলতা পাঠককে বিমোহিত করত। যে কারণে স্যাটেলাইটের যুগেও ‘অনিরুদ্ধ’কে কেউ ভোলেনি, ভুলবে না।
সন্তোষ গুপ্তের একাধিক বইয়ের কথা এর আগে আলোচনা করা হয়েছে। এবার আরেকটা বইয়ের কথা বলবো। বইটির নাম- ‘অনালোকে আলোকস্তম্ভ’ এ বইতে সন্তোষ গুপ্তের কিছু স্মৃতিময় কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। সেখান থেকে সাংবাদিক সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন সন্তোষ গুপ্ত। শহীদুল্লা কায়সারকে নিয়ে তার একাধিক স্মৃতিচারণ থাকলেও এর আগে চোখে পড়েনি।