শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী
দু’জনের ভাত
নির্মলেন্দু গুণ
গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে
মনে কি পড়ে না? পড়ে।
ভালো কি বাসি না? বাসি।
শ্লথ টেপ থেকে সারা দিন জল ঝরে,
সেই বেনোজলে এঁটো মুখ ধুয়ে আসি।
গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে
প্রেম কি জাগে না? জাগে।
কিছু কি বলি না? বলি।
তিতাস শিখায় যতটুকু তাপ লাগে,
অনুতাপে আমি তার চেয়ে বেশি গলি।
গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে
আমি কি কাঁদি না? কাঁদি।
কাঁচা কাকরুল ভাজার কবিতা লেখি,
বড়-ডেকচিতে দু’জনের ভাত রাঁধি।
গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে-খেতে
কিছু কি ভাবি না? ভাবি।
ভেবে কি পাই না? পাই।
তবু কি ফুরায় তুমি-তৃষ্ণার দাবী?
ভাত বলে দেয়, তুমি নাই, তুমি নাই।
কেন অন্ধ কেন সে কাঙাল
হাসান হাফিজ
বিভ্রম বলেছি ওকে,ঠারেঠোরে ইঙ্গিতে বলেছি।
ভালোবাসা ভুল করে হুলস্থুল বাধালো কেন যে!
নিভৃতি সে ভালোই বাসে না, ইচ্ছা করে কাছেও আসে না,
প্রকাশিত হয় দ্রুত, নিন্দা হুল বুক পেতে নেয়
বিষও পান করে ফেলে আবেগের উষ্ণতাবশত
কী করে ঠেকাই বলো এরকম অনিদ্র পতন?
নিজে নিজে নিমজ্জিত ম্লান দুরাশায়
ভেসে উঠতে চাইলেও পারছে না,
তার জন্যে শঙ্কা ক্ষোভ আহা উহুঁ নাই
সেও কিন্তু বিভ্রমেরই আলোছায়া, মরীচিকা মায়া
চোরাগোপ্তা টালমাটাল আশনাই-
ভালোবাসা এত বেশি নির্লজ্জ কেন যে
ভালোবাসা এত অন্ধ সর্বনাশা দৈন্যে দেউলিয়া
মতিভ্রষ্ট কাঙালও কেন যে!
নিষিদ্ধ চৌকাঠ
রাহমান ওয়াহিদ
যা ঘটার নিঃশব্দেই ঘটে যাবে।
আকাশে ঝুলছে কালো ওড়না
রুদ্র বৃষ্টি ছাদে একলা পেয়ে অসময়ে
ভিজিয়ে দিলে
আমাকে দোষ দিয়ো না।
ধরে নিয়ো এ তোমার ভবিতব্য।
অনিবার্য সময়টা কাছাকাছি এলেই
কিছু মুহূর্ত কাটাবো শূন্য অনুভবে।
তোমার অর্ধেক জলের গ্লাসে অভ্যস্ত
চুমুক দিতে গেলে
কাচ ভাঙার একটুখানি শব্দ হয় যদি
ভেবো যে তা নৈঃশব্দ্যেরই ঘুমঘোর।
কিছুটা জল মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে
নিষিদ্ধ চৌকাঠ পেরিয়ে গেলে
কুশলী হাতে থামিয়ে দিয়ো।
এ তুমি বেশ পারো।
তারপর দেখবে সবকিছু হিমঠা-া
ঠিক যেমনটি তুমি চেয়েছিলে।
দেয়াল ও পর্দা
আসিফ নূর
দেয়াল আড়াল গড়ে দুপক্ষের মাঝ বরাবর,
কেউ কাউকে দেখে না আর মুখোমুখি প্রতিদিন
হয় না তো হাসিকথা; অপলক ভাব বিনিময়।
পর্দাও আড়ালবাজি জানে, তবে সে কঠিন নয়;
তাই তার এপার-ওপারে চলে সম্ভ্রান্ত সম্প্রীতি-
সম্ভ্রমের ভাষাশিল্পে চোখাচোখি হালকা ফাঁক গলে।
দেয়াল পাষাণ খুব, রড-সিমেন্ট ইট-সুরকির
প্রেমহীন শক্ত দেহ; বোঝে না বিভেদ ছাড়া কিছু।
অথচ হাওয়ার তালে পর্দা দুললেই, গান আর
কবিতারা ফিসফিস কথা শুরু করে সুরে সুরে।
বিশ্বাস
প্রণব মজুমদার
কাউকে বিশ্বাস করো না
তাতে থাকে ভয় ও সংশয়।
মানুষের মাঝে জমে গেছে
প্রতারণার পাহাড়।
আহা! কী সঙের বাহার!
সেরা প্রাণির মুখে মধু; অন্তরে বিষ;
ভর্ৎসনা করে দেয় না তো কেউ শিস?
মমতার মতো বরং নিজকে করো বিশ^াস,
অনুবাদ করো, পাবে সৃষ্টি সুখের আশ^াস
তোমাকে বিশ^াস করে করে হারিয়েছি পথ;
যে প্রান্তরে কাঁটা ছিল মরণ কামড়ের মতো!
সৃজনে সৃজনে দিয়ে তাই দিয়ে যাই নতুনকে ঠিকানা।
এখন বৃষ্টি হোক
জয়নাল আবেদীন শিবু
তুমি দৌড়াচ্ছো- দেখছি, ভাবছি দৌড়ের দৌড়াত্ম্য
কতো! সময় বদলাচ্ছে দ্রুত- কাঁচের টেবিলে
জলের গ্লাস বদলে যাচ্ছে মদে, শরবতে...
তুমি দৌঁড়াচ্ছো- তোমার নিতম্বে, নাভীর গভীরে, জঙ্ঘায়
দেখছি- তুমি আছো এর ভেতর?
তোমার শরীরে দৃষ্টিপাত করলে শীতের চাবুক মারে চোখে
মুহূর্তে যে মূর্তি দেখি- উৎসবের, নাচনের
তোমার নৃত্যে মঞ্চ কাঁপে- দেহের মহড়া চলে
দর্শক দেহের ছবি দেখে- চেয়ে থাকে উরুর
দিকে- উত্তাপ বাড়ায়- দাবানল চোখে...
একের পর এক বদলে নেয়া তোমার জমকালো জামায় দেখি
কুয়াশা ছড়ানো কুসুমযুগল- কোমল কাঁটায় গাঁথছে যুবক;
সহ¯্র সারস- দিকভ্রান্ত, আহত তারা
চারদিকে খরার মাঠে সবুজ হারাচ্ছে সতত
এখন বৃষ্টি হোক বাতাসে সংগীতের সুরে সুরে।
অহং কিংবা ফানাফিল্লাহ
সোহেল মাজহার
আমি বলে কিছু নেই, আছে আমার অহং
পাখি বলি, ফুল বলি সবই হলো ভড়ং।
তবু নদীকে ডেকে বলি ও আমার আকুল
দরিয়ার দিকে তাকাও অতল গহীনে ব্যাকুল।
যদি হও সব ছেড়ে দিনে রাতে সকলে বিলীন
পাবে তুমি আশেকে জিন্দেগী তোমাতে লীন।
আমাকে দ্যাখো, আমি সেই শ্লোক-গণিতবিদ
চোখ বুঝে তসবিহ দানার মতো নিমগ্ন, করো পাঠ
তারকাপুঞ্জে এঁকে দাও ওগো গোপন নকশাবিদ
চুম্বন শুধু নয়, রতি নির্যাতনে উর্বর ফসলের মাঠ।
এভাবেই লিখি নিশীথ-নির্জনে ওগো অধ্যাপিকা
তুমি কেউ নও, আদতে আমার সূক্ষ্ম অহমিকা
পৌঁছুতে চাই ওম... মার্গলোকে সঙ্গীতের মোরাম
তুমি কেউ নও, গূঢ় সাধন ভজনে সাধু ও প্রেমিকের কাম।
নও দূর প্রান্তর, তুমি আমার স্বপ্নে দেখা প্রাসাদকিল্লা
তোমার জপমালা গেয়ে তোমাতেই ফানাফিল্লাহ।
কছিমুদ্দিন
মহসিন খোন্দকার
দাঁড়কাকের দাঁড়িকমা আর ফিঙ্গের ফনেটিকস
দাঁড়িয়ে দেখে গল্পের শরীর আর ঘামের গভীর গুঞ্জন
কাউনের থোঁড়ে ঝুলে থাকে যে রোদ তার
তলপেটে উঁকি দেয় বিভাজনের বাচ্চা, হঠাৎ
ফড়িয়া ফিঙ্গে চুমুক মারে গার্হস্থ্য ঘামকলায়
তখন কছিমুদ্দিনের গল্প উঠে যায়
রাজা-মহারাজাদের খেয়াল খেয়ায়,গল্পের শরীরে সেঁটে
দেয় শূন্য ও পুণ্যের নতুন নামাতা, কছিমুদ্দিন ভুল ব্যাখ্যা
হয়ে ঝুলে থাকে গল্পের গলায়!
শহরের শিশুটি
সৈয়দ নূরুল আলম
এই শহরে একটি শিশু ছিল- আমি তাকে জানি,
শিশুটি ফুল ভালোবাসতো।
সে আমার কানে কানে
এসে বলেছিল, সে পাখিও ভালো বাসে,
প্রতিদিন তার বাগানে একটি করে ফুল ফোটে,
কিছু পাখি তার দরজায় এসে উঁকি দেয়।
একদিন আকাশ থেকে কিছু মেঘ নেমে এসে শিশুটিকে
অবেলায় ভিজিয়ে দেয়, সেই থেকে শিশুটি মেঘ দেখলে
ভয় পায়, অশ্রুসিক্ত নয়নে মেঘেদের অপছন্দের কথা বলে।
শহরে পা দিয়ে, আমি বুঝে ফেলি
‘শিশুটি নেই’
আমি বুঝে ফেলি- সেই
শিশুর অনুপস্থিতিতে এই শহরে মিছিল হয়েছে,
মিছিল শেষে সবাই ভেবেছে, শিশুর হাসিতে
আবার এই শহর আলোময় হোক, ফুল ফুটুক, পাখির গান
ছড়িয়ে পড়ুক
শহরময়-পাড়াময়। হারানো
রোদের মতন। অবুঝ বিকেলের মতন।
কবিতাসঙ্গম
বেনজির শিকদার
আত্মহত্যা পাপ জেনে সরে এসেছি;
একটা তুমির বিনিময়ে
সঙ্গমে মেতেছি কবিতার!
মুছে যাওয়া চিরন্তন মেনে শান্ত হয়েছি
সামান্য শব্দের কাছে চেয়েছি
অসামান্য আশ্রয়ের দ্যোতনা।
অহেতু শব্দের পেছনে ছুটেছি জনমভর।
ধীরে ধীরে বড়ো হয়েছে সীমানা-দেয়াল
চেনা চৌহদ্দি হয়ে গেছে পর।
ঝরে যাওয়া প্রাত্যহিক মেনে
অক্ষয়-অক্ষরে সাজিয়েছি চেতনার কারুকাজ।
দরজায় এঁকেছি ভাব-রসের বিন্যাস;
আলপনায় মেখে দিয়েছি কল্পনার রং
উঠোনে বসেছে এসে- আদুরে সন্ন্যাস!
মরে যাওয়া নির্ধারিত ভেবে
বন্ধ করেছি চোখ, মিছেঘুমের অভিনয়ে
আপন করে নিয়েছি উপমার বৈঠকখানা।
অনুপ্রাসের অনুরণনে গেঁথেছি জন্মজখম;
কেউ এসে বলেনি- মরে যেতে মানা!
সেই থেকে বেঁচে আছি-
মুহূর্তের মাধুর্যে বিলিয়ে দিয়েছি সব;
প্রেমকে সত্য জেনে-
সঞ্চয় করেছি কবিতার কঠিনানুভব।
আগুনে মেলেছি আগুনের পাখা
কবিতা করেছে আমায়- জীবন্ত শব!
প্রস্থ ছাড়া দৈর্ঘ্য..... বিন্দুর সংঘর্ষ
ঋজু রেজওয়ান
অতি দুঃখের লাইন— প্রস্থ ছাড়া দৈর্ঘ্য!
যার— কোনো অংশ নেই!
প্রস্থের নিকট গ্রহেই অপরাপর সংগীত বাজছে।
লাইনের প্রান্তগুলি— বিন্দুর একটি সরল রেখা!
কিন্তু, নিজের উপর-
সমানে... সমান সমগ্রগুলির
যোগ ও বিয়োগ যাই হোক- সমান নশ্বরদিন।
যেখানে তোমার বাস- স্থানাঙ্কগুলিও... সুস্পষ্ট
কবরের কাদামাটি-
অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ জুড়ে... চিরবিশ্রামের ঘর!
লাজুক সময়— আমার শক্তির গর্ভবতী বিশ্বে...
মধ্য রাতের অসুস্থ মাত্রা! খুলির ভেতর কার-
কণার সঠিক বেগ!
স্থানের তরঙ্গ মাখে... অতিরেক ঘনিষ্ঠ সংযোগ।
কৌণিক দূরত্বে... পদার্থের সংঘর্ষের মতোই...
উত্তপ্ত, জ্বলতে থাকে...
হেলা, অবহেলা- হাত বাড়াও... হাত নাড়াও।
আছিয়া ঘুমায়ে গেছে
সানি মহারথী
পরানের গহীনে বিঁধে নতুন জ্বালা
মায়েরা বোনেরা সব কোথায় পালা!
ভায়েরা যত আছে লাঠি হাতে সব
নেমে গেছে রাস্তায় দূর করে মব;
তবেই না ফিরে যাবে আপন ঘরে
মায়েরা বোনেরা তাই সবুর করে।
আছিয়া ঘুমায়ে গেছে জেগে আছে দেশ
যত যাই হয়ে যাক দেখে নেবে শেষ।
প্রত্যয়ে বাঁধা এক জাতির শিকড়
প্রোথিত হয়ে আছে বুকের ভিতর।
এই বুক জানে না লুটিয়ে পড়া।
প্রসারিত দুই হাত উঁচিয়ে ধরা
আমার প্রতিজ্ঞা তাই নতুন দেশের
আলোকিত সমাজ আর নতুন বেশের।
শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী
শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫
দু’জনের ভাত
নির্মলেন্দু গুণ
গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে
মনে কি পড়ে না? পড়ে।
ভালো কি বাসি না? বাসি।
শ্লথ টেপ থেকে সারা দিন জল ঝরে,
সেই বেনোজলে এঁটো মুখ ধুয়ে আসি।
গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে
প্রেম কি জাগে না? জাগে।
কিছু কি বলি না? বলি।
তিতাস শিখায় যতটুকু তাপ লাগে,
অনুতাপে আমি তার চেয়ে বেশি গলি।
গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে
আমি কি কাঁদি না? কাঁদি।
কাঁচা কাকরুল ভাজার কবিতা লেখি,
বড়-ডেকচিতে দু’জনের ভাত রাঁধি।
গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে-খেতে
কিছু কি ভাবি না? ভাবি।
ভেবে কি পাই না? পাই।
তবু কি ফুরায় তুমি-তৃষ্ণার দাবী?
ভাত বলে দেয়, তুমি নাই, তুমি নাই।
কেন অন্ধ কেন সে কাঙাল
হাসান হাফিজ
বিভ্রম বলেছি ওকে,ঠারেঠোরে ইঙ্গিতে বলেছি।
ভালোবাসা ভুল করে হুলস্থুল বাধালো কেন যে!
নিভৃতি সে ভালোই বাসে না, ইচ্ছা করে কাছেও আসে না,
প্রকাশিত হয় দ্রুত, নিন্দা হুল বুক পেতে নেয়
বিষও পান করে ফেলে আবেগের উষ্ণতাবশত
কী করে ঠেকাই বলো এরকম অনিদ্র পতন?
নিজে নিজে নিমজ্জিত ম্লান দুরাশায়
ভেসে উঠতে চাইলেও পারছে না,
তার জন্যে শঙ্কা ক্ষোভ আহা উহুঁ নাই
সেও কিন্তু বিভ্রমেরই আলোছায়া, মরীচিকা মায়া
চোরাগোপ্তা টালমাটাল আশনাই-
ভালোবাসা এত বেশি নির্লজ্জ কেন যে
ভালোবাসা এত অন্ধ সর্বনাশা দৈন্যে দেউলিয়া
মতিভ্রষ্ট কাঙালও কেন যে!
নিষিদ্ধ চৌকাঠ
রাহমান ওয়াহিদ
যা ঘটার নিঃশব্দেই ঘটে যাবে।
আকাশে ঝুলছে কালো ওড়না
রুদ্র বৃষ্টি ছাদে একলা পেয়ে অসময়ে
ভিজিয়ে দিলে
আমাকে দোষ দিয়ো না।
ধরে নিয়ো এ তোমার ভবিতব্য।
অনিবার্য সময়টা কাছাকাছি এলেই
কিছু মুহূর্ত কাটাবো শূন্য অনুভবে।
তোমার অর্ধেক জলের গ্লাসে অভ্যস্ত
চুমুক দিতে গেলে
কাচ ভাঙার একটুখানি শব্দ হয় যদি
ভেবো যে তা নৈঃশব্দ্যেরই ঘুমঘোর।
কিছুটা জল মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে
নিষিদ্ধ চৌকাঠ পেরিয়ে গেলে
কুশলী হাতে থামিয়ে দিয়ো।
এ তুমি বেশ পারো।
তারপর দেখবে সবকিছু হিমঠা-া
ঠিক যেমনটি তুমি চেয়েছিলে।
দেয়াল ও পর্দা
আসিফ নূর
দেয়াল আড়াল গড়ে দুপক্ষের মাঝ বরাবর,
কেউ কাউকে দেখে না আর মুখোমুখি প্রতিদিন
হয় না তো হাসিকথা; অপলক ভাব বিনিময়।
পর্দাও আড়ালবাজি জানে, তবে সে কঠিন নয়;
তাই তার এপার-ওপারে চলে সম্ভ্রান্ত সম্প্রীতি-
সম্ভ্রমের ভাষাশিল্পে চোখাচোখি হালকা ফাঁক গলে।
দেয়াল পাষাণ খুব, রড-সিমেন্ট ইট-সুরকির
প্রেমহীন শক্ত দেহ; বোঝে না বিভেদ ছাড়া কিছু।
অথচ হাওয়ার তালে পর্দা দুললেই, গান আর
কবিতারা ফিসফিস কথা শুরু করে সুরে সুরে।
বিশ্বাস
প্রণব মজুমদার
কাউকে বিশ্বাস করো না
তাতে থাকে ভয় ও সংশয়।
মানুষের মাঝে জমে গেছে
প্রতারণার পাহাড়।
আহা! কী সঙের বাহার!
সেরা প্রাণির মুখে মধু; অন্তরে বিষ;
ভর্ৎসনা করে দেয় না তো কেউ শিস?
মমতার মতো বরং নিজকে করো বিশ^াস,
অনুবাদ করো, পাবে সৃষ্টি সুখের আশ^াস
তোমাকে বিশ^াস করে করে হারিয়েছি পথ;
যে প্রান্তরে কাঁটা ছিল মরণ কামড়ের মতো!
সৃজনে সৃজনে দিয়ে তাই দিয়ে যাই নতুনকে ঠিকানা।
এখন বৃষ্টি হোক
জয়নাল আবেদীন শিবু
তুমি দৌড়াচ্ছো- দেখছি, ভাবছি দৌড়ের দৌড়াত্ম্য
কতো! সময় বদলাচ্ছে দ্রুত- কাঁচের টেবিলে
জলের গ্লাস বদলে যাচ্ছে মদে, শরবতে...
তুমি দৌঁড়াচ্ছো- তোমার নিতম্বে, নাভীর গভীরে, জঙ্ঘায়
দেখছি- তুমি আছো এর ভেতর?
তোমার শরীরে দৃষ্টিপাত করলে শীতের চাবুক মারে চোখে
মুহূর্তে যে মূর্তি দেখি- উৎসবের, নাচনের
তোমার নৃত্যে মঞ্চ কাঁপে- দেহের মহড়া চলে
দর্শক দেহের ছবি দেখে- চেয়ে থাকে উরুর
দিকে- উত্তাপ বাড়ায়- দাবানল চোখে...
একের পর এক বদলে নেয়া তোমার জমকালো জামায় দেখি
কুয়াশা ছড়ানো কুসুমযুগল- কোমল কাঁটায় গাঁথছে যুবক;
সহ¯্র সারস- দিকভ্রান্ত, আহত তারা
চারদিকে খরার মাঠে সবুজ হারাচ্ছে সতত
এখন বৃষ্টি হোক বাতাসে সংগীতের সুরে সুরে।
অহং কিংবা ফানাফিল্লাহ
সোহেল মাজহার
আমি বলে কিছু নেই, আছে আমার অহং
পাখি বলি, ফুল বলি সবই হলো ভড়ং।
তবু নদীকে ডেকে বলি ও আমার আকুল
দরিয়ার দিকে তাকাও অতল গহীনে ব্যাকুল।
যদি হও সব ছেড়ে দিনে রাতে সকলে বিলীন
পাবে তুমি আশেকে জিন্দেগী তোমাতে লীন।
আমাকে দ্যাখো, আমি সেই শ্লোক-গণিতবিদ
চোখ বুঝে তসবিহ দানার মতো নিমগ্ন, করো পাঠ
তারকাপুঞ্জে এঁকে দাও ওগো গোপন নকশাবিদ
চুম্বন শুধু নয়, রতি নির্যাতনে উর্বর ফসলের মাঠ।
এভাবেই লিখি নিশীথ-নির্জনে ওগো অধ্যাপিকা
তুমি কেউ নও, আদতে আমার সূক্ষ্ম অহমিকা
পৌঁছুতে চাই ওম... মার্গলোকে সঙ্গীতের মোরাম
তুমি কেউ নও, গূঢ় সাধন ভজনে সাধু ও প্রেমিকের কাম।
নও দূর প্রান্তর, তুমি আমার স্বপ্নে দেখা প্রাসাদকিল্লা
তোমার জপমালা গেয়ে তোমাতেই ফানাফিল্লাহ।
কছিমুদ্দিন
মহসিন খোন্দকার
দাঁড়কাকের দাঁড়িকমা আর ফিঙ্গের ফনেটিকস
দাঁড়িয়ে দেখে গল্পের শরীর আর ঘামের গভীর গুঞ্জন
কাউনের থোঁড়ে ঝুলে থাকে যে রোদ তার
তলপেটে উঁকি দেয় বিভাজনের বাচ্চা, হঠাৎ
ফড়িয়া ফিঙ্গে চুমুক মারে গার্হস্থ্য ঘামকলায়
তখন কছিমুদ্দিনের গল্প উঠে যায়
রাজা-মহারাজাদের খেয়াল খেয়ায়,গল্পের শরীরে সেঁটে
দেয় শূন্য ও পুণ্যের নতুন নামাতা, কছিমুদ্দিন ভুল ব্যাখ্যা
হয়ে ঝুলে থাকে গল্পের গলায়!
শহরের শিশুটি
সৈয়দ নূরুল আলম
এই শহরে একটি শিশু ছিল- আমি তাকে জানি,
শিশুটি ফুল ভালোবাসতো।
সে আমার কানে কানে
এসে বলেছিল, সে পাখিও ভালো বাসে,
প্রতিদিন তার বাগানে একটি করে ফুল ফোটে,
কিছু পাখি তার দরজায় এসে উঁকি দেয়।
একদিন আকাশ থেকে কিছু মেঘ নেমে এসে শিশুটিকে
অবেলায় ভিজিয়ে দেয়, সেই থেকে শিশুটি মেঘ দেখলে
ভয় পায়, অশ্রুসিক্ত নয়নে মেঘেদের অপছন্দের কথা বলে।
শহরে পা দিয়ে, আমি বুঝে ফেলি
‘শিশুটি নেই’
আমি বুঝে ফেলি- সেই
শিশুর অনুপস্থিতিতে এই শহরে মিছিল হয়েছে,
মিছিল শেষে সবাই ভেবেছে, শিশুর হাসিতে
আবার এই শহর আলোময় হোক, ফুল ফুটুক, পাখির গান
ছড়িয়ে পড়ুক
শহরময়-পাড়াময়। হারানো
রোদের মতন। অবুঝ বিকেলের মতন।
কবিতাসঙ্গম
বেনজির শিকদার
আত্মহত্যা পাপ জেনে সরে এসেছি;
একটা তুমির বিনিময়ে
সঙ্গমে মেতেছি কবিতার!
মুছে যাওয়া চিরন্তন মেনে শান্ত হয়েছি
সামান্য শব্দের কাছে চেয়েছি
অসামান্য আশ্রয়ের দ্যোতনা।
অহেতু শব্দের পেছনে ছুটেছি জনমভর।
ধীরে ধীরে বড়ো হয়েছে সীমানা-দেয়াল
চেনা চৌহদ্দি হয়ে গেছে পর।
ঝরে যাওয়া প্রাত্যহিক মেনে
অক্ষয়-অক্ষরে সাজিয়েছি চেতনার কারুকাজ।
দরজায় এঁকেছি ভাব-রসের বিন্যাস;
আলপনায় মেখে দিয়েছি কল্পনার রং
উঠোনে বসেছে এসে- আদুরে সন্ন্যাস!
মরে যাওয়া নির্ধারিত ভেবে
বন্ধ করেছি চোখ, মিছেঘুমের অভিনয়ে
আপন করে নিয়েছি উপমার বৈঠকখানা।
অনুপ্রাসের অনুরণনে গেঁথেছি জন্মজখম;
কেউ এসে বলেনি- মরে যেতে মানা!
সেই থেকে বেঁচে আছি-
মুহূর্তের মাধুর্যে বিলিয়ে দিয়েছি সব;
প্রেমকে সত্য জেনে-
সঞ্চয় করেছি কবিতার কঠিনানুভব।
আগুনে মেলেছি আগুনের পাখা
কবিতা করেছে আমায়- জীবন্ত শব!
প্রস্থ ছাড়া দৈর্ঘ্য..... বিন্দুর সংঘর্ষ
ঋজু রেজওয়ান
অতি দুঃখের লাইন— প্রস্থ ছাড়া দৈর্ঘ্য!
যার— কোনো অংশ নেই!
প্রস্থের নিকট গ্রহেই অপরাপর সংগীত বাজছে।
লাইনের প্রান্তগুলি— বিন্দুর একটি সরল রেখা!
কিন্তু, নিজের উপর-
সমানে... সমান সমগ্রগুলির
যোগ ও বিয়োগ যাই হোক- সমান নশ্বরদিন।
যেখানে তোমার বাস- স্থানাঙ্কগুলিও... সুস্পষ্ট
কবরের কাদামাটি-
অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ জুড়ে... চিরবিশ্রামের ঘর!
লাজুক সময়— আমার শক্তির গর্ভবতী বিশ্বে...
মধ্য রাতের অসুস্থ মাত্রা! খুলির ভেতর কার-
কণার সঠিক বেগ!
স্থানের তরঙ্গ মাখে... অতিরেক ঘনিষ্ঠ সংযোগ।
কৌণিক দূরত্বে... পদার্থের সংঘর্ষের মতোই...
উত্তপ্ত, জ্বলতে থাকে...
হেলা, অবহেলা- হাত বাড়াও... হাত নাড়াও।
আছিয়া ঘুমায়ে গেছে
সানি মহারথী
পরানের গহীনে বিঁধে নতুন জ্বালা
মায়েরা বোনেরা সব কোথায় পালা!
ভায়েরা যত আছে লাঠি হাতে সব
নেমে গেছে রাস্তায় দূর করে মব;
তবেই না ফিরে যাবে আপন ঘরে
মায়েরা বোনেরা তাই সবুর করে।
আছিয়া ঘুমায়ে গেছে জেগে আছে দেশ
যত যাই হয়ে যাক দেখে নেবে শেষ।
প্রত্যয়ে বাঁধা এক জাতির শিকড়
প্রোথিত হয়ে আছে বুকের ভিতর।
এই বুক জানে না লুটিয়ে পড়া।
প্রসারিত দুই হাত উঁচিয়ে ধরা
আমার প্রতিজ্ঞা তাই নতুন দেশের
আলোকিত সমাজ আর নতুন বেশের।