alt

ঈদ সংখ্যা ২০২৫

পথহীন পথে

শাহনাজ মুন্নী

: শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

পাক্কা তের বছর হইল, চুল দাড়িতে কাঁচি ছোঁয়ানো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে মোজাম্মেল মিয়া। প্রথম প্রথম অনভ্যাসের কারণে খুব উছপিছ লাগতো তার, মাথা ভারী ভারী মনে হইত, কুটকুট করে চুলকাইতো, দুই হাতের দশটা আঙ্গুল সর্বদা ব্যস্ত থাকতো চুলকানি সামাল দিতে। পরে আস্তে আস্তে সবই ঠিক হয়ে গেছে। চুল লম্বা হতে হতে প্রায় কোমর ছাড়িয়েছে, তাতে গাছের শেকড়ের মতো শক্ত জটিল জটা বেঁধেছে, অবিন্যস্ত দাড়িও নেমে এসেছে প্রায় বুকের ওপর। সেই দাড়িও পুরোপুরি কালো নেই, লালচে, তামাটে রঙের মাঝে দুয়েকটা সাদা সহাস্যে ঝিলিক দিচ্ছে। গত তের বছর একবারো নিজের গ্রামে যায় নাই মোজাম্মেল মিয়া। গিয়া কি করবে? যেই গ্রামে মালতি নাই, সেই গ্রাম কি আর গ্রাম আছে? খাঁ খাঁ মরুভূমি হয়ে গেছে না? বৃষ্টিবিরল, শুষ্ক, রুক্ষ, ধু ধু বালিতে ভরা সেই নির্মম গ্রাম মোজাম্মেল মিয়াকে আর টানে না। বরং মালতিবিহীন নিঃস্ব জীবনে এই ছন্নছাড়া পথই ভালো। আর পথের মাঝখানে জায়গায় জায়গায় তাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য যেন অপেক্ষা করেই থাকে পাগল-কামেল-পীর-দরবেশ-অলি-আউলিয়াদের লাল কাপড়ে মোড়ানো মহান আস্তানা। জগতে যার কেউ নাই, তার আল্লাহ আছে। মোজাম্মেল মিয়াও ঠেকে নাই। ক্ষিদায় দুই মুঠা অন্ন, লজ্জা নিবারণের দুই খ- বস্ত্র কীভাবে যেন ঠিকই জুটে গেছে। এক জায়গায় খুব বেশি দিন থাকে না মোজাম্মেল মিয়া। পায়ের তলায় চাক্কা লাগানো গাড়ির মতো খালি ছোটে। পিঠে ডানা লাগানো পাখির মতো খালি উইড়া বেড়ায়। এইখানে তিন মাস তো ওইখানে দুই মাস কোথাও পনের দিন কোথাও হয়তো সাত দিনের মাথায় মন উইঠা যায়। মন এমন দিওয়ানা, এমন উদাস, এমন পেরেশান, এমন বিবাগি- যে, এই মনের পিছনে ছুটতে ছুটতে বেকারার মোজাম্মেল মিয়া স্্েরফ হয়রান হয়ে গেছে।

‘বলি, তুই মনের পিছে ছুটোস ক্যান? মনরে একবার ছোটা’দি তোর পেছন পেছন..’

এক চাঁদনী রাতে বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারের সামনে যে মস্ত দীঘি তাতে ভাসতে থাকা কাছিমগুলোর দিকে তাকিয়ে মোজাম্মেল মিয়াকে একথা বলেছিল বিরাম সাধু।

‘সে কেমন করি হবি?’

আবছা আলোতে সাধুর ঢুলু ঢুলু লাল চোখের অস্তিত্ব খুঁজতে খুঁজতে জানতে চেয়েছিল মোজাম্মেল।

‘মনরে বশ মানা, তার রাশ টাইনে ধর, তালেই হবি। মন তোরে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। শান্তি দেচ্ছে না তো? এবার তুই পাগলা মনটারে বাঁধ। ওরে ধইরে পোষ মানা... অশান্তি কমবে।’

‘কিন্তু কি উপায়ে সেটা সম্ভব? মন তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মন বলে কিছু একটা আছে, বোঝা যায়, কিন্তু তারে তো ধরা যায় না। দেখাও যায় না। তারে বান্দুম ক্যামনে?’

‘কেমনে বানবা তুমি জানো! আমি তার কি জানি? হা হা হা ’

বিরাম সাধু হাসে। পেট কাঁপায়ে, দাড়ি নাড়ায়ে হো হো করে দুলে দুলে হাসে। সেই হাসির শব্দে ভাসমান কাছিমগুলি চমকে গিয়ে দীঘির গভীর জলে ডুব দেয়। ঠিক তখনই চাঁদের ওপর থেকে এক খ- মেঘ সরে গেলে সমস্ত চরাচরও যেন সাধুর সঙ্গে মিলে হাসতে থাকে। মোজাম্মেল মিয়া বিভ্রান্ত হয়ে যায়। বিরাম সাধু দীঘির সিঁড়ি টপকে ওপরে যেতে যেতে দরাজ গলায় সুর করে গান ধরে, ‘মন চলো নিজ নিকেতনে, সংসার বিদেশে বিদেশির বেশে, ভ্রম কেনো অকারণে...’

মোজাম্মেলের তো নিজের নিকেতন বলে কিছু নাই তার কাছে সবই অকারণ! জগত, সংসার, টাকা, পয়সা, দুনিয়াদারি সবই ভ্রম, সবই ধাঁধাঁ। বিরাম সাধু নিজেই আগাগোড়া একটা ধাঁধা। লোকে বলে জি¦ন ভূতের সাথে তার বিশেষ খাতির আছে! সত্য মিথ্যা অবশ্য কেউ জানে না। বিরামের কথার অর্ধেক বোঝা যায় তো বাকি অর্ধেক অবোধ্য। সেও যেন মানুষের মনের মতোই অস্পষ্ট, ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।

ছোটবেলায় শোনা একটা গানের কথা মনে পড়ে মোজাম্মেলের, ‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘোরে আসল ফকির চেনে কয় জনা, প্রেমের বাজারে কত প্রেমিক ঘোরে আসল প্রেমিক বলো কয়জনা।

বাংলাদেশের যত মাজারে সে গেছে সবখানেই, পাগল ফকির আউলা ঝাওলা মানুষের দেখা পাইছে। তাদের কেউ আসল। কেউ আবার নকল, ভেকধারী। সালাম মাস্তান যেমন বলে, ‘বাপু হে, সাধু হও, কিন্তু সাধু সেজো না। কামেলিয়াত হওয়া অত সহজ কাজ নয়।’

মোজাম্মেল মিয়া বোঝে, সে না হতে পেরেছে সাধু, না হতে পেরেছে শয়তান। এই চুল দাড়ি জোব্বা জাব্বার আড়ালে সে এক সাধারণ প্রেম হারা বৈরাগি বিনে আর তো কিছু নয়। অথবা এক যাযাবর সে, যার জীবনের আসলেই কোনো গন্তব্য নাই। বাপ তো ছোটবেলাতেই মরছিল। মালতীর অন্য গ্রামে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, মাস ঘুরতে না ঘুরতেই মা মরল। মোজাম্মেল আর কার টানে ঘরে থাকবে? উপরওয়ালার দেওয়া স্বজন বান্ধবহীন এই ভবঘুরে জীবনটা থাকলেই কী আর না থাকলেই বা কী? মাকে কবর দিয়ে দিশেহারা মন নিয়ে খালি হাতেই একটা ট্রেনে চেপে বসেছিল মোজাম্মেল মিয়া। সেই ট্রেন তাকে নিয়ে ফেলেছিল এক অচিন শহরে। হাঁটতে হাঁটতে সে পৌছে গিয়েছিল কোনো এক অচেনা সমাধি ক্ষেত্রে। মানুষের শেষ ঠিকানায়। ইমারতের গভীরে যেখানে লীন হয়ে গেছে অস্থিমজ্জাসহ প্রাণের সকল চিহ্ন। সেইখানে জীবিতরা মৃতের স্মরণে কোলাহল করে। সেইখানে কেউ কারো পরিচয় জানতে চায় না। ঘৃণায় দূর দূর করে দূরে সরে থাকে না। সকলেই যেন নিজের ভেতরে সমাহিত। সবাই কাতর হয়ে কিছু একটা খুঁজছে। কষ্টের কথা বলে কেঁদে জার জার হচ্ছে। নালিশ জানাচ্ছে উপরওয়ালার দরবারে। আকুল হয়ে আশা পূরণের আবদার করছে। মোজাম্মেল মিয়া এইখানে এসে নিজের ভেতর নিজের একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। বিরাম সাধুর সাথে আবার দেখা হয়েছিল নরসিংদীর শাহ ইরানি মাজারে। মোজাম্মেলের দিকে আঙ্গুল তুলে সে বলেছিল,

‘কিরে, অহনো বাঁইচে আছিস?... মইরে যা! জ্যন্ত থেকে মইরে যা!! ভাব দিয়ে খোল ভাবের তালা! ঘুইচে যাবে মনের ঘোলা!’

কিন্তু মনের ইচ্ছাগুলি না মরলে মোজাম্মেল মরে কীভাবে? মালতীরে আরেকবার দেখার ইচ্ছা যে তার মরে না! শেষ যেবার ভেল্কিবাজির মতো দেখা হইল মালতির সাথে! সেইটা কত বছর আগে, দিন তারিখ সন বার কিছুই মনে করতে পারে না মোজাম্মেল। সেইটা তিন দিন আগে বা তিন মাস বা তিন বছর আগেও হইতে পারে! মদনপুরের শাহ্্ সাহেবের দরবার শরীফে সেই দিন ওরশ ছিল। মানুষের গিজগিজে ভিড়ের ভেতর মোজাম্মেলের চোখ আটকে গেল গোলাপী তাঁতের শাড়ির আঁচলে পেচানো একটা শান্ত শ্যামলা গোলগাল মুখের ওপর, তার মাথায় কপালে জ¦লজ¦ল করছে ল্যাপটানো সিঁদুর! হাজার বছর পরেও মালতির মুখ চিনতে মোজাম্মেলের ভুল হবার কথা নয়। বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধরাস করে উঠলো তার। ছটফট করে উঠলো মন। পায়ের বুড়ো অঙ্গুলে ভর দিয়ে শত শত ভক্ত আশেকানের মাথার উপর দিয়ে ভাল ভাবে নজর করে দেখলো সে। ম্লান কিন্তু মায়াবী চেহারার মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য জ¦লজ¦লে চোখ দুটোতে অগাধ বিশ^াস, অসীম ভক্তি আর থৈ থৈ আশা নিয়ে ‘ইচ্ছাপূরণ’ গাছের প্রাচীন ডালে অতি যতœ করে শাখা পরা হাত দুটো ঘুরিয়ে নিবিড় নিষ্ঠ মনোযোগে এক গোছা লালহলুদ সুতা বেঁধে দিচ্ছে মালতি। পাশে সাদা থান পরা এক বৃদ্ধার ¯েœহপূর্ণ চোখে মালতির প্রতি সমর্থন ঝরে পড়ছে। কোনো কাম্য বস্তু লাভের আকাক্সক্ষায় মালতি এই গাছের ডালে বাঁধছে বিশ^াসের সূতা? কবরে ঘুমিয়ে থাকা পীর সাহেবের উছিলায় নিজের জীবনের কোন মুশকিলের আশান চায় সে?

মোজাম্মেল লোকের ভিড় পেরিয়ে পায়ে পায়ে দুই নারীর পেছনে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়ায়। খুব যতœ নিয়ে সূতা বাধা শেষ করে ঠোটের কোনায় পরিতৃপ্তির একটা হাসি ফোটে মালতির।

‘ও মা চল! বেলা পড়ে আসছে, বাড়ির দিকে যাই এবার!’

সাদা থানের হাত ধরে টান দেয় মালতি। হন্ হন্্ করে সামনে এগোয়, পেছনে পেছনে মোজাম্মেলও হাঁটে। নীরবে। মালতি খেয়াল করে না। বুড়ির হাত ধরে পথের পাশে মোমবাতি, নিমকি, বাতাসার ভাসমান দোকানগুলো পেরিয়ে সে মাথা নিচু করে আনমনে এগিয়ে যায়। মোজাম্মেল বিড়ালের মতো সতর্ক ভঙ্গীতে তাদের অনুসরণ করে। কোলাহল ছাড়িয়ে একটা বাঁক ঘুরে বড় রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায় মালতি। হয়তো চলন্ত বাসের জন্য অপেক্ষা করে। মোজাম্মেলও যেন সমে¥াহিত মানুষের মতো, কী এক অদ্ভুত আকর্ষণে মালতির পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মালতির মাথায় মাখা নারকেল তেলের সুগন্ধি তার নাকে ভেসে আসে। এতক্ষণে বুঝি মোজাম্মেলের গুপ্তচর বৃত্তি বৃদ্ধার ঘোলা চোখে ধরা পড়ে যায়।

‘এ ব্যাডা, এই! তোর মতলবডা কিরে? তখন থেকে দেখতেছি পিছে পিছে ঘুরতেছিস? কে তুই? চাস কী? এ্যাঁ? মুখপোড়ার ঘরের মুখপোড়া! ভাগ্্ এখান থেকে!’

মালতি এবার বৃদ্ধাকে থামায়। ‘ওমা, দেখতিছো না, পাগল ফকির মানুষ! দুটো টাকা থাকলে দিয়ে দেও তো!’

বৃদ্ধা এবার তার আঁচলের খুট খুলে টাকা বের করতে ব্যস্ত হয়। আর মালতি ভুরু কুঁচকে মোজাম্মেলের দিকে এক ঝলক তাকায় তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বৃদ্ধার হাত থেকে দলামোচা হয়ে যাওয়া টাকাটা ধরে মোজাম্মেলের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

‘নাও, এটা রাখো। আর পিছে পিছে এসো না! এটা নিয়ে চুপচাপ বিদায় হও।’

আহা, সূর্যাস্তের এই আবছা আলোয় মালতি রাণী তারে চিনতে পারে নাই। মোজাম্মেল টাকাটা নিতে তার হাত বাড়ায় এবং আরো একবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে শেষবারের মতো মালতির মায়াভরা মিষ্টি মুখটা দেখে নিতে চায়। তখনই যেন বিদ্যুতচমকের মতো মালতির চোখের আলো জ¦লে ওঠে। সে কেমন চমকে ওঠে, ফ্যাকাশে ঠোট দুটি ফাঁক করে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘তুমি কে গো? কেমন জানি চেনা চেনা লাগে!... বাড়ি কই তোমার? কোথা থেকে আইছো? তুমি কি মোজাম্মেল ভাই? কইখালি গেরামের মোজাম্মেল মিয়া তুমি?’

মোজাম্মেলের গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। মালতির স্মৃতিতে নিজেকে আবিষ্কার করার আনন্দে তার চোখ দুটো শুধু ছল ছল করে ওঠে।

মালতি এবার স্থানকালপাত্র বিস্মৃত হয়। সে প্রায় চিৎকার করে ওঠে, ‘ওমা! এ তো আমার দ্যাশের মানুষ! একি অবস্থা হইছে তোমার মোজাম্মেল ভাই! কী চেহারা বানাইছো, তুমি? সবাই কয় তুমি নাকি নিরুদ্দেশ! হায় হায়, একি দশা হইছে তোমার? ’

মালতির সঙ্গের বৃদ্ধার চোখে এবার সন্দেহ ঝরে পড়ে।

‘তোর মাথা ঠিক আছে বউ? কারে কী কচ্ছিস, জানা নেই শোনা নেই, চোর জোচ্চোরের অভাব নাই দ্যাশে! চল্ দিনি, ওই বাস আসতিছে...’

‘মা, আমি এরে ঠিক চিনেছি! আমার ভুল হবার নয়! তুমি বিশ^াস করো!’

‘তা বেশ, আর দুটো টাকা বেশি দিয়ে এবার বাড়ি চল!’ বুড়ি তাড়া দেয়।

‘মা, এরে আমি বাড়ি নিয়ে যাবো! সেবা যতœ করব! তুমি অনুমতি দেও, মা! আইজ রাতটা এরে আমাদের বাড়িতে রাখি! তোমার ছেলে তো আইজ গঞ্জে থাকবে। অসুবিধা হবে না নে! তোমার দুটো পায়ে পড়ি মা, না কইরো না!’

মালতির কণ্ঠে অনুনয় ঝরে পড়ে। বৃদ্ধার চোখে মুখে বিরক্তি, অস্বস্তি, রাগ একসাথে আঁকিবুঁকি কাটে।

‘কী সর্বনাশা অনুরোধ করছিস বউ! পাগল ছাগল নিয়ে বাড়িতে তুলবি! জাত পাতেরও তো ঠিক নাই! ধনঞ্জয় জানতে পারলে আমাদের আস্ত রাখবে? না, না, এ হয় না...’

‘আমার ওপর ভরসা রাখো মা, দয়া করো, হাত জোড় করে মিনতি করি! কিচ্ছুটি হবে না। ওকে আমি ঠিক চিনতে পারিছি, তুমি আর আপত্তি করো না, মা!’

ততক্ষণে বাস এসে গেলে মালতি মোজাম্মেলের হাত ধরে তাকে প্রায় টেনে বাসে ওঠায়। বুড়ি সারা পথ রাগে গজ গজ করে। লক্কড়ঝক্কড় বাসটা বিলবৈঠা গ্রামের বাঁকে যখন ওদের নামিয়ে দিল তখন সন্ধ্যা নেমেছে। মাটির রাস্তা ধরে কিছুপথ এগিয়ে ডানের বাঁশঝাড় আর মজা পুকুর পার হয়ে ধনঞ্জয় সাহার ছিমছাম টিনের বাড়ির গোবর লেপা উঠানের কোনায় জবা ফুল গাছের পাশে মালতি আর তার শাশুড়ির সঙ্গে মোজাম্মেলও এসে দাঁড়ায়।

ঘর থেকে চটজলদি পরিষ্কার ধুতি পাঞ্জাবি আর গামছা নিয়ে আসে মালতি। সঙ্গে একটা বাসনার সাবান। আঙ্গুল তুলে মোজাম্মেলকে ঘরের পেছনের পুকুর দেখিয়ে দেয় মালতি।

‘যাও দিনি, ঘাটে গিয়ে ভাল কইরে গা রগড়ে চান কইরে আসো! আমি ভাত বসাচ্ছি!’

পুকুরের শীতল সবুজ জলে ডুব দিয়ে মোজাম্মেলের মনে হয় সারা জীবন এখানেই ডুবে থাকে! মনে হয় জল থেকে মাথা তুললেই তার এই অতি দুর্লভ স্বপ্ন ভেঙে যাবে। এই মালতি ও তার ঘর বাড়ি সব তখন ভোজবাজির মতো মিলায়ে যাবে! আর সে খুঁজে পাবে না। ঘাটের সিঁড়িতে বসে সারা গায়ে মুখে সাবানের ফেনা তুলে ডলে ডলে নিজের শরীরে বহু দিনের জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে মোজাম্মেল। পরিচ্ছন্নতার একটা পবিত্র আবেশ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

মালতির রান্না হয়ে গিয়েছিল। ধোয়া ওঠা গরম ভাতের সঙ্গে সরিষার তেলে মাখা ঝাল আলু ভর্তা আর একটা ডিম ভাজি সঙ্গে এক বাটি পাতলা ডাল। এই সামান্য আয়োজন যেন অসামান্য লাগল মোজাম্মেলের মুখে। তার মনে হলো কতদিন কেউ এত যতœ করে দুমুঠো ভাত তার সামনে রাখেনি! একটু দূরে বসে মালতির শাশুড়ি চেঁচিয়ে বললো, ‘তোর দ্যাশের লোকরে বলে দে বউ, কাল ভোরের আলো ফোটার আগেই যেন এখান থেকে বিদেয় হয়। পাড়া পড়শির কথার জবাব কলাম আমি দিতে পারব নানে। যত্তোসব আপদ!’

‘যাবে! যাবে! তোমার এখেনে সারাজীবন থাকতে এসেছে নাকি?’

শাশুড়িকে মুখ ঝামটা দিতে ছাড়ে না মালতি। তারপর মোজাম্মেলের দিকে তাকায়, ‘তেমন কিছুই সমাদর করতে পারলাম না। আরেকটু ভাত দেই তোমারে?’

মোজাম্মেল মাথা নাড়ে।

‘তুমি দি কোনো কথাই কচ্ছ না। ইশকুলে পড়ার সময় শামছুন্নাহার মজা করে বলতো, তুমি নাকি আমারে ভালবাসো। কই কোনো দিন তো একটা কথাও বলোনি? খালি দেখতাম আসা যাওয়ার পথে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছো! সত্যি ভালবাসতে?’

মোজাম্মেলের পাতে ডাল তুলে দিতে দিতে জানতে চায় মালতি। মোজাম্মেল কথা বলে না, শুধু পাতের উপর আরো ঝুঁকে পড়ে।

‘তুমি কিন্তু সেইসময় দেখতে ভারি সুন্দর ছিলা...’ মালতি মুখ টিপে হাসে। ‘এখন অবশ্য চুল দাড়িতে তোমারে শিব ঠাকুরের মতো লাগে, হাতে কেবল একটা ত্রিশূল থাকলেই হইতো!’

মাটির মেঝেতে খড় বিছিয়ে তার উপর কাঁথা পেতে বাইরের ঘরে মোজাম্মেলের বিছানা পেতেছে মালতি। সেই বিছানায় ঘরের চালের ফাঁক ফোকড় দিয়ে জোসনার বিন্দু বিন্দু আলো অপার্থিব আলপনা আঁকছে। খাওয়া দাওয়া শেষে এক খিলি পান হাতে মোজাম্মেলের ঘরে আসে মালতি। বিছানায় আসন পেতে বসে মোজাম্মেলের দিকে পানটা এগিয়ে দেয় সে।

‘তুমি কি মৌন ব্রত পালন করিচ্ছো নাকি? মুখে একটাও কথা নেই? নাকি বোবায় ধরিছে?’

‘না, না। তা না। আমার মনে হইতেছে সব স্বপ্ন দেখতেছি। বিশ^াস করতে পারতেছি না!’ মোজাম্মেল ঘোর লাগা গলায় বলে। ‘এইভাবে তোমারে দেখতি পাবো, এত কাছ থেকে, ভাবি নাই কখনো! সব মাওলার ইচ্ছা! তারই কেরামতি! তাঁরে শুকরিয়া! এইবার কওতো মাজারে কেন গেছিলা? কোন ইচ্ছা পূরণে সূতা বানছিলা গাছের ডালে?’

‘সেই দুঃখের কথা তোমারে কী আর কই!’ মালতি একটা দীর্ঘশ^াস ফেলে। ‘বিয়া হইছে চৌদ্দ বছর কিন্তু ঘরে সন্তানাদি নাই! দেখতাছোই তো! স্বামী আছে না থাকার মতোই! শাশুড়ির বিশ^াস মাজারে মানত করলে পীর-মুর্শিদের উছিলায় পেটে বাচ্চা আসবে। তাই গেছিলাম! তিন বছর ধরেই যাই, মানত করি...’

মোজাম্মেলের ভেতরে হঠাৎ কী হয়, সে মালতির শাখাপরা হাত চেপে ধরে।

‘আমার সাথে চলো, চলো আমরা দূরে কোথাও পালায়া যাই! অন্য জেলায়! যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না! ’

মালতি ম্লান হাসে। ‘মোজাম্মেল ভাই, তুমি হইলা পথের মানুষ! আমি ঘরের! ঘর ছেড়ে জাত মান কূল ধর্ম বিসর্জন দিতে পারবো না।’

মোজাম্মেল মালতির হাত ছেড়ে দেয়। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। দুজনের মাঝখানে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক এক লয়ে বাজতে থাকে। মালতি এবার মোজাম্মেলের দিকে ঘন হয়ে চেপে আসে। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

‘তুমি আমারে একটা সন্তান দিয়া যাও মোজাম্মেল ভাই!’

মোজাম্মেল শিউরে ওঠে ঘরের কোনায় ছিটকে পড়ে,

‘এইসব কী বলতিছো মালতি? না, না, তা আমি পারবো না।’ তারপর একটু থেমে লম্বা করে শ^াস টেনে সে শান্ত ভঙ্গীতে বলে, ‘আসলে কি জানো মালতি, আমার মধ্যে এখন আর কাম ভাব জাগে না!’

‘হায়রে মরদ! কাম না জাগুক, প্রেম ভাব তো জাগে!’

মালতি মুচকি হাসে। মোজাম্মেলের হাত দুটো তুলে ধরে নিজের গালে ছোঁয়ায়, হাত দুটো গাল থেকে গলায় নেমে আসে। মোজাম্মেল এবার আচমকা তার শরীরের পরিবর্তন টের পায়। সে বিড়বিড় করে,

‘মালতি, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’

মালতি উঠে গিয়ে ঘরের নড়বড়ে দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দেয়। তারপর শাড়িটা একপাশে খুলে রেখে মোজাম্মেলকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভেবেই বলিছি, আমার ভেতরে তোমার নতুন জন্ম হোক! তুমি তোমার বীজ বুনে দিয়ে যাও!’

তারপর কী যে হয়! মালতির সাজানো গুছানো শরীরে পথ হারায় একজন একাকী বিষণœ ক্ষুধার্ত পাগল! বহুদিনের সুপ্তি ভেঙে রক্তে মাংসে শিরা উপশিরায় অচেনা এক ঘূর্ণি জাগে, মোমের মতো গলে গলে পড়ে হৃদয়! কতখানি বিচ্ছেদ শেষে কতখানি মিলন হলো, কতখানি অপ্রাপ্তির পর কতখানি পাওয়া হলো, পাগল মোজাম্মেল তা বোঝে না। রাত শেষে কখন ভোর এলো, গলা ফুলিয়ে গেরস্ত বাড়ির মোরগ বাগ্্ দিলো, মসজিদে উচ্চস্বরে আজান হলো আর মালতির পায়ের রেখা ধরে যেই পথে এসেছিল সেই একই পথ ধরে মোজাম্মেল পাগলা আবার কীভাবে যেন পথহীন পথে হারিয়ে গেলো!

২.

কিন্তু দুনিয়ার গোলকধাঁধায় যতক্ষণ তুমি বাঁধা পড়ে আছো, ততক্ষণ তো তুমি হারাবা না, কেউ না কেউ তোমারে খুঁজে পাবেই! ফলে বিরাম সাধুর সাথে আবার কোনো এক শুক্কুরবার বিকেলে ফতেহ আলী শাহর ভেঙে গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যাওয়া মাজার প্রাঙ্গণে মোজাম্মেলের দেখা হয়ে যায়।

‘ওরা তো সব মাজার ভেঙে দিচ্ছেরে পাগলা, মজলুম আশেকরা এখন থাকবে কই, বল দেখি?’

ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে বিরাম সাধু তার ঢুলু ঢুলু চোখের তারা নাচিয়ে জানতে চায়। হয়তো কোন উত্তরের আশা না করেই বাতাসে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সে। মোজাম্মেলও আর বলে না যে ওই ভাঙচুরের সময় বাজারের পাশেই একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে ঘাঁপটি মেরে মুখ ঢেকে বসেছিলো সে। অসীম কৌতূহলে দেখছিলো, লাঠিসোটা হাতে মানুষগুলির হিং¯্র নিষ্ঠুর চোখ, তাদের ক্রোধে উন্মত্ত চেহারা। শুনছিলো তাদের নির্দয় চিৎকার, তাদের রাগত কণ্ঠের হৈহল্লা। তারা পাপ, পুণ্য, ধর্ম, অধর্ম, বেদাত, বেশরিয়ত, ভ-ামি, নোংরামি, আচার, অনাচার এসব নিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গীতে আলাপ করছিল। তারা সব কিছু ভেঙে মাটির সাথে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করছিল। মোজাম্মেল তখন কিছুই বলে নাই। অবশ্য বললেই বা কে শুনতো তার কথা? উল্টো ওদের হাতে মার খাওয়ার আশঙ্কা ছিল। মোজাম্মেলের মন শুধু ফিসফিস করে নিজেকে বলছিলো, ‘ওদের কথা শুইনো না। যারা অন্যের দোষ ধরে তারা কখনো নিজের দোষ দেখতে পায় না! আর তুমি তো এমন এক অভিশপ্ত বান্দা, এমন এক নাখাস্তা ফকির, যার কোথাও ঠাঁই নাই, তুমি আসলে পথভ্রষ্ট, অধঃপতিত! তোমার বেহেশত নাই, দোজখও নাই! মাজার ভাঙলেই কী আর অক্ষত থাকলেই কী? পথই তোমার ঠিকানা।’

বিরাম সাধু হাসে! নিজের মনেই বলে, ‘আহারে, সবাই কি এক সুরে খোদারে ডাকে? সবাই কি এক রূপে দুনিয়াতে আসে? যাক্্ এইখানে যখন ঠাই নেই, তখন চল, শাহ সাবের ওরসে যাই! ওইটা বড় লোকের জায়গা, নামী দামী লোকেরা আসেন! ওইখানে ভাঙচুর নাই।’

ওই জায়গাটা মোজাম্মেল সযতনে এড়িয়ে চলে কারণ পুরনো ক্ষতকে সে আর খোঁচাতে চায় না। এই জীবনে মালতির মুখোমুখিও হতেও সে আর চায় না। কিন্তু বিরাম সাধুর আহ্বান উপেক্ষা করার শক্তিও তার নেই। ফলে মোজাম্মেল না চাইলেও হয়তো দেখতে পাবে, ওরসের ভিড়ের মধ্যে আবার সেই শ্যামলা গোলগাল সিঁদুর পরা সাদাসিধে মুখখানা তবে এবার তার সঙ্গে সাদা থানের বৃদ্ধা ছাড়াও আছে এক চঞ্চল উজ্জ্বল দুরন্ত শিশু। মানুষের বদ নজর থেকে নিরাপদ রাখতে শিশুটির কপালে তার মা কাজলের বিরাট এক গোল টিপ এঁকে দিয়েছে। মায়ের আঙ্গুল ধরে টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বড় বড় চোখ মেলে সেই শিশুটি চারপাশ দেখতে থাকবে অসীম বিস্ময়ে। তাদের পথের পাশেই কোনো নিশ্চল জড় বস্তুর মতো মোজাম্মেল হয়তো শুয়ে থাকবে চটের বস্তায় মুখ লুকিয়ে।

শিশুটি সেই বস্তুর দিকে আঙ্গুল তুলে আধো আধো বোলে মায়ের কাছে জানতে চাইবে, ‘ওতা কি?’

মা ত্রস্ত কণ্ঠে ওকে পেরিয়ে যেতে যেতে শিশুটিকে বলবে, ‘ওটা কিছু না! একটা পাগল!’

tab

ঈদ সংখ্যা ২০২৫

পথহীন পথে

শাহনাজ মুন্নী

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

পাক্কা তের বছর হইল, চুল দাড়িতে কাঁচি ছোঁয়ানো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে মোজাম্মেল মিয়া। প্রথম প্রথম অনভ্যাসের কারণে খুব উছপিছ লাগতো তার, মাথা ভারী ভারী মনে হইত, কুটকুট করে চুলকাইতো, দুই হাতের দশটা আঙ্গুল সর্বদা ব্যস্ত থাকতো চুলকানি সামাল দিতে। পরে আস্তে আস্তে সবই ঠিক হয়ে গেছে। চুল লম্বা হতে হতে প্রায় কোমর ছাড়িয়েছে, তাতে গাছের শেকড়ের মতো শক্ত জটিল জটা বেঁধেছে, অবিন্যস্ত দাড়িও নেমে এসেছে প্রায় বুকের ওপর। সেই দাড়িও পুরোপুরি কালো নেই, লালচে, তামাটে রঙের মাঝে দুয়েকটা সাদা সহাস্যে ঝিলিক দিচ্ছে। গত তের বছর একবারো নিজের গ্রামে যায় নাই মোজাম্মেল মিয়া। গিয়া কি করবে? যেই গ্রামে মালতি নাই, সেই গ্রাম কি আর গ্রাম আছে? খাঁ খাঁ মরুভূমি হয়ে গেছে না? বৃষ্টিবিরল, শুষ্ক, রুক্ষ, ধু ধু বালিতে ভরা সেই নির্মম গ্রাম মোজাম্মেল মিয়াকে আর টানে না। বরং মালতিবিহীন নিঃস্ব জীবনে এই ছন্নছাড়া পথই ভালো। আর পথের মাঝখানে জায়গায় জায়গায় তাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য যেন অপেক্ষা করেই থাকে পাগল-কামেল-পীর-দরবেশ-অলি-আউলিয়াদের লাল কাপড়ে মোড়ানো মহান আস্তানা। জগতে যার কেউ নাই, তার আল্লাহ আছে। মোজাম্মেল মিয়াও ঠেকে নাই। ক্ষিদায় দুই মুঠা অন্ন, লজ্জা নিবারণের দুই খ- বস্ত্র কীভাবে যেন ঠিকই জুটে গেছে। এক জায়গায় খুব বেশি দিন থাকে না মোজাম্মেল মিয়া। পায়ের তলায় চাক্কা লাগানো গাড়ির মতো খালি ছোটে। পিঠে ডানা লাগানো পাখির মতো খালি উইড়া বেড়ায়। এইখানে তিন মাস তো ওইখানে দুই মাস কোথাও পনের দিন কোথাও হয়তো সাত দিনের মাথায় মন উইঠা যায়। মন এমন দিওয়ানা, এমন উদাস, এমন পেরেশান, এমন বিবাগি- যে, এই মনের পিছনে ছুটতে ছুটতে বেকারার মোজাম্মেল মিয়া স্্েরফ হয়রান হয়ে গেছে।

‘বলি, তুই মনের পিছে ছুটোস ক্যান? মনরে একবার ছোটা’দি তোর পেছন পেছন..’

এক চাঁদনী রাতে বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারের সামনে যে মস্ত দীঘি তাতে ভাসতে থাকা কাছিমগুলোর দিকে তাকিয়ে মোজাম্মেল মিয়াকে একথা বলেছিল বিরাম সাধু।

‘সে কেমন করি হবি?’

আবছা আলোতে সাধুর ঢুলু ঢুলু লাল চোখের অস্তিত্ব খুঁজতে খুঁজতে জানতে চেয়েছিল মোজাম্মেল।

‘মনরে বশ মানা, তার রাশ টাইনে ধর, তালেই হবি। মন তোরে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। শান্তি দেচ্ছে না তো? এবার তুই পাগলা মনটারে বাঁধ। ওরে ধইরে পোষ মানা... অশান্তি কমবে।’

‘কিন্তু কি উপায়ে সেটা সম্ভব? মন তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মন বলে কিছু একটা আছে, বোঝা যায়, কিন্তু তারে তো ধরা যায় না। দেখাও যায় না। তারে বান্দুম ক্যামনে?’

‘কেমনে বানবা তুমি জানো! আমি তার কি জানি? হা হা হা ’

বিরাম সাধু হাসে। পেট কাঁপায়ে, দাড়ি নাড়ায়ে হো হো করে দুলে দুলে হাসে। সেই হাসির শব্দে ভাসমান কাছিমগুলি চমকে গিয়ে দীঘির গভীর জলে ডুব দেয়। ঠিক তখনই চাঁদের ওপর থেকে এক খ- মেঘ সরে গেলে সমস্ত চরাচরও যেন সাধুর সঙ্গে মিলে হাসতে থাকে। মোজাম্মেল মিয়া বিভ্রান্ত হয়ে যায়। বিরাম সাধু দীঘির সিঁড়ি টপকে ওপরে যেতে যেতে দরাজ গলায় সুর করে গান ধরে, ‘মন চলো নিজ নিকেতনে, সংসার বিদেশে বিদেশির বেশে, ভ্রম কেনো অকারণে...’

মোজাম্মেলের তো নিজের নিকেতন বলে কিছু নাই তার কাছে সবই অকারণ! জগত, সংসার, টাকা, পয়সা, দুনিয়াদারি সবই ভ্রম, সবই ধাঁধাঁ। বিরাম সাধু নিজেই আগাগোড়া একটা ধাঁধা। লোকে বলে জি¦ন ভূতের সাথে তার বিশেষ খাতির আছে! সত্য মিথ্যা অবশ্য কেউ জানে না। বিরামের কথার অর্ধেক বোঝা যায় তো বাকি অর্ধেক অবোধ্য। সেও যেন মানুষের মনের মতোই অস্পষ্ট, ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।

ছোটবেলায় শোনা একটা গানের কথা মনে পড়ে মোজাম্মেলের, ‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘোরে আসল ফকির চেনে কয় জনা, প্রেমের বাজারে কত প্রেমিক ঘোরে আসল প্রেমিক বলো কয়জনা।

বাংলাদেশের যত মাজারে সে গেছে সবখানেই, পাগল ফকির আউলা ঝাওলা মানুষের দেখা পাইছে। তাদের কেউ আসল। কেউ আবার নকল, ভেকধারী। সালাম মাস্তান যেমন বলে, ‘বাপু হে, সাধু হও, কিন্তু সাধু সেজো না। কামেলিয়াত হওয়া অত সহজ কাজ নয়।’

মোজাম্মেল মিয়া বোঝে, সে না হতে পেরেছে সাধু, না হতে পেরেছে শয়তান। এই চুল দাড়ি জোব্বা জাব্বার আড়ালে সে এক সাধারণ প্রেম হারা বৈরাগি বিনে আর তো কিছু নয়। অথবা এক যাযাবর সে, যার জীবনের আসলেই কোনো গন্তব্য নাই। বাপ তো ছোটবেলাতেই মরছিল। মালতীর অন্য গ্রামে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, মাস ঘুরতে না ঘুরতেই মা মরল। মোজাম্মেল আর কার টানে ঘরে থাকবে? উপরওয়ালার দেওয়া স্বজন বান্ধবহীন এই ভবঘুরে জীবনটা থাকলেই কী আর না থাকলেই বা কী? মাকে কবর দিয়ে দিশেহারা মন নিয়ে খালি হাতেই একটা ট্রেনে চেপে বসেছিল মোজাম্মেল মিয়া। সেই ট্রেন তাকে নিয়ে ফেলেছিল এক অচিন শহরে। হাঁটতে হাঁটতে সে পৌছে গিয়েছিল কোনো এক অচেনা সমাধি ক্ষেত্রে। মানুষের শেষ ঠিকানায়। ইমারতের গভীরে যেখানে লীন হয়ে গেছে অস্থিমজ্জাসহ প্রাণের সকল চিহ্ন। সেইখানে জীবিতরা মৃতের স্মরণে কোলাহল করে। সেইখানে কেউ কারো পরিচয় জানতে চায় না। ঘৃণায় দূর দূর করে দূরে সরে থাকে না। সকলেই যেন নিজের ভেতরে সমাহিত। সবাই কাতর হয়ে কিছু একটা খুঁজছে। কষ্টের কথা বলে কেঁদে জার জার হচ্ছে। নালিশ জানাচ্ছে উপরওয়ালার দরবারে। আকুল হয়ে আশা পূরণের আবদার করছে। মোজাম্মেল মিয়া এইখানে এসে নিজের ভেতর নিজের একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। বিরাম সাধুর সাথে আবার দেখা হয়েছিল নরসিংদীর শাহ ইরানি মাজারে। মোজাম্মেলের দিকে আঙ্গুল তুলে সে বলেছিল,

‘কিরে, অহনো বাঁইচে আছিস?... মইরে যা! জ্যন্ত থেকে মইরে যা!! ভাব দিয়ে খোল ভাবের তালা! ঘুইচে যাবে মনের ঘোলা!’

কিন্তু মনের ইচ্ছাগুলি না মরলে মোজাম্মেল মরে কীভাবে? মালতীরে আরেকবার দেখার ইচ্ছা যে তার মরে না! শেষ যেবার ভেল্কিবাজির মতো দেখা হইল মালতির সাথে! সেইটা কত বছর আগে, দিন তারিখ সন বার কিছুই মনে করতে পারে না মোজাম্মেল। সেইটা তিন দিন আগে বা তিন মাস বা তিন বছর আগেও হইতে পারে! মদনপুরের শাহ্্ সাহেবের দরবার শরীফে সেই দিন ওরশ ছিল। মানুষের গিজগিজে ভিড়ের ভেতর মোজাম্মেলের চোখ আটকে গেল গোলাপী তাঁতের শাড়ির আঁচলে পেচানো একটা শান্ত শ্যামলা গোলগাল মুখের ওপর, তার মাথায় কপালে জ¦লজ¦ল করছে ল্যাপটানো সিঁদুর! হাজার বছর পরেও মালতির মুখ চিনতে মোজাম্মেলের ভুল হবার কথা নয়। বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধরাস করে উঠলো তার। ছটফট করে উঠলো মন। পায়ের বুড়ো অঙ্গুলে ভর দিয়ে শত শত ভক্ত আশেকানের মাথার উপর দিয়ে ভাল ভাবে নজর করে দেখলো সে। ম্লান কিন্তু মায়াবী চেহারার মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য জ¦লজ¦লে চোখ দুটোতে অগাধ বিশ^াস, অসীম ভক্তি আর থৈ থৈ আশা নিয়ে ‘ইচ্ছাপূরণ’ গাছের প্রাচীন ডালে অতি যতœ করে শাখা পরা হাত দুটো ঘুরিয়ে নিবিড় নিষ্ঠ মনোযোগে এক গোছা লালহলুদ সুতা বেঁধে দিচ্ছে মালতি। পাশে সাদা থান পরা এক বৃদ্ধার ¯েœহপূর্ণ চোখে মালতির প্রতি সমর্থন ঝরে পড়ছে। কোনো কাম্য বস্তু লাভের আকাক্সক্ষায় মালতি এই গাছের ডালে বাঁধছে বিশ^াসের সূতা? কবরে ঘুমিয়ে থাকা পীর সাহেবের উছিলায় নিজের জীবনের কোন মুশকিলের আশান চায় সে?

মোজাম্মেল লোকের ভিড় পেরিয়ে পায়ে পায়ে দুই নারীর পেছনে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়ায়। খুব যতœ নিয়ে সূতা বাধা শেষ করে ঠোটের কোনায় পরিতৃপ্তির একটা হাসি ফোটে মালতির।

‘ও মা চল! বেলা পড়ে আসছে, বাড়ির দিকে যাই এবার!’

সাদা থানের হাত ধরে টান দেয় মালতি। হন্ হন্্ করে সামনে এগোয়, পেছনে পেছনে মোজাম্মেলও হাঁটে। নীরবে। মালতি খেয়াল করে না। বুড়ির হাত ধরে পথের পাশে মোমবাতি, নিমকি, বাতাসার ভাসমান দোকানগুলো পেরিয়ে সে মাথা নিচু করে আনমনে এগিয়ে যায়। মোজাম্মেল বিড়ালের মতো সতর্ক ভঙ্গীতে তাদের অনুসরণ করে। কোলাহল ছাড়িয়ে একটা বাঁক ঘুরে বড় রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায় মালতি। হয়তো চলন্ত বাসের জন্য অপেক্ষা করে। মোজাম্মেলও যেন সমে¥াহিত মানুষের মতো, কী এক অদ্ভুত আকর্ষণে মালতির পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মালতির মাথায় মাখা নারকেল তেলের সুগন্ধি তার নাকে ভেসে আসে। এতক্ষণে বুঝি মোজাম্মেলের গুপ্তচর বৃত্তি বৃদ্ধার ঘোলা চোখে ধরা পড়ে যায়।

‘এ ব্যাডা, এই! তোর মতলবডা কিরে? তখন থেকে দেখতেছি পিছে পিছে ঘুরতেছিস? কে তুই? চাস কী? এ্যাঁ? মুখপোড়ার ঘরের মুখপোড়া! ভাগ্্ এখান থেকে!’

মালতি এবার বৃদ্ধাকে থামায়। ‘ওমা, দেখতিছো না, পাগল ফকির মানুষ! দুটো টাকা থাকলে দিয়ে দেও তো!’

বৃদ্ধা এবার তার আঁচলের খুট খুলে টাকা বের করতে ব্যস্ত হয়। আর মালতি ভুরু কুঁচকে মোজাম্মেলের দিকে এক ঝলক তাকায় তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বৃদ্ধার হাত থেকে দলামোচা হয়ে যাওয়া টাকাটা ধরে মোজাম্মেলের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

‘নাও, এটা রাখো। আর পিছে পিছে এসো না! এটা নিয়ে চুপচাপ বিদায় হও।’

আহা, সূর্যাস্তের এই আবছা আলোয় মালতি রাণী তারে চিনতে পারে নাই। মোজাম্মেল টাকাটা নিতে তার হাত বাড়ায় এবং আরো একবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে শেষবারের মতো মালতির মায়াভরা মিষ্টি মুখটা দেখে নিতে চায়। তখনই যেন বিদ্যুতচমকের মতো মালতির চোখের আলো জ¦লে ওঠে। সে কেমন চমকে ওঠে, ফ্যাকাশে ঠোট দুটি ফাঁক করে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘তুমি কে গো? কেমন জানি চেনা চেনা লাগে!... বাড়ি কই তোমার? কোথা থেকে আইছো? তুমি কি মোজাম্মেল ভাই? কইখালি গেরামের মোজাম্মেল মিয়া তুমি?’

মোজাম্মেলের গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। মালতির স্মৃতিতে নিজেকে আবিষ্কার করার আনন্দে তার চোখ দুটো শুধু ছল ছল করে ওঠে।

মালতি এবার স্থানকালপাত্র বিস্মৃত হয়। সে প্রায় চিৎকার করে ওঠে, ‘ওমা! এ তো আমার দ্যাশের মানুষ! একি অবস্থা হইছে তোমার মোজাম্মেল ভাই! কী চেহারা বানাইছো, তুমি? সবাই কয় তুমি নাকি নিরুদ্দেশ! হায় হায়, একি দশা হইছে তোমার? ’

মালতির সঙ্গের বৃদ্ধার চোখে এবার সন্দেহ ঝরে পড়ে।

‘তোর মাথা ঠিক আছে বউ? কারে কী কচ্ছিস, জানা নেই শোনা নেই, চোর জোচ্চোরের অভাব নাই দ্যাশে! চল্ দিনি, ওই বাস আসতিছে...’

‘মা, আমি এরে ঠিক চিনেছি! আমার ভুল হবার নয়! তুমি বিশ^াস করো!’

‘তা বেশ, আর দুটো টাকা বেশি দিয়ে এবার বাড়ি চল!’ বুড়ি তাড়া দেয়।

‘মা, এরে আমি বাড়ি নিয়ে যাবো! সেবা যতœ করব! তুমি অনুমতি দেও, মা! আইজ রাতটা এরে আমাদের বাড়িতে রাখি! তোমার ছেলে তো আইজ গঞ্জে থাকবে। অসুবিধা হবে না নে! তোমার দুটো পায়ে পড়ি মা, না কইরো না!’

মালতির কণ্ঠে অনুনয় ঝরে পড়ে। বৃদ্ধার চোখে মুখে বিরক্তি, অস্বস্তি, রাগ একসাথে আঁকিবুঁকি কাটে।

‘কী সর্বনাশা অনুরোধ করছিস বউ! পাগল ছাগল নিয়ে বাড়িতে তুলবি! জাত পাতেরও তো ঠিক নাই! ধনঞ্জয় জানতে পারলে আমাদের আস্ত রাখবে? না, না, এ হয় না...’

‘আমার ওপর ভরসা রাখো মা, দয়া করো, হাত জোড় করে মিনতি করি! কিচ্ছুটি হবে না। ওকে আমি ঠিক চিনতে পারিছি, তুমি আর আপত্তি করো না, মা!’

ততক্ষণে বাস এসে গেলে মালতি মোজাম্মেলের হাত ধরে তাকে প্রায় টেনে বাসে ওঠায়। বুড়ি সারা পথ রাগে গজ গজ করে। লক্কড়ঝক্কড় বাসটা বিলবৈঠা গ্রামের বাঁকে যখন ওদের নামিয়ে দিল তখন সন্ধ্যা নেমেছে। মাটির রাস্তা ধরে কিছুপথ এগিয়ে ডানের বাঁশঝাড় আর মজা পুকুর পার হয়ে ধনঞ্জয় সাহার ছিমছাম টিনের বাড়ির গোবর লেপা উঠানের কোনায় জবা ফুল গাছের পাশে মালতি আর তার শাশুড়ির সঙ্গে মোজাম্মেলও এসে দাঁড়ায়।

ঘর থেকে চটজলদি পরিষ্কার ধুতি পাঞ্জাবি আর গামছা নিয়ে আসে মালতি। সঙ্গে একটা বাসনার সাবান। আঙ্গুল তুলে মোজাম্মেলকে ঘরের পেছনের পুকুর দেখিয়ে দেয় মালতি।

‘যাও দিনি, ঘাটে গিয়ে ভাল কইরে গা রগড়ে চান কইরে আসো! আমি ভাত বসাচ্ছি!’

পুকুরের শীতল সবুজ জলে ডুব দিয়ে মোজাম্মেলের মনে হয় সারা জীবন এখানেই ডুবে থাকে! মনে হয় জল থেকে মাথা তুললেই তার এই অতি দুর্লভ স্বপ্ন ভেঙে যাবে। এই মালতি ও তার ঘর বাড়ি সব তখন ভোজবাজির মতো মিলায়ে যাবে! আর সে খুঁজে পাবে না। ঘাটের সিঁড়িতে বসে সারা গায়ে মুখে সাবানের ফেনা তুলে ডলে ডলে নিজের শরীরে বহু দিনের জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে মোজাম্মেল। পরিচ্ছন্নতার একটা পবিত্র আবেশ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

মালতির রান্না হয়ে গিয়েছিল। ধোয়া ওঠা গরম ভাতের সঙ্গে সরিষার তেলে মাখা ঝাল আলু ভর্তা আর একটা ডিম ভাজি সঙ্গে এক বাটি পাতলা ডাল। এই সামান্য আয়োজন যেন অসামান্য লাগল মোজাম্মেলের মুখে। তার মনে হলো কতদিন কেউ এত যতœ করে দুমুঠো ভাত তার সামনে রাখেনি! একটু দূরে বসে মালতির শাশুড়ি চেঁচিয়ে বললো, ‘তোর দ্যাশের লোকরে বলে দে বউ, কাল ভোরের আলো ফোটার আগেই যেন এখান থেকে বিদেয় হয়। পাড়া পড়শির কথার জবাব কলাম আমি দিতে পারব নানে। যত্তোসব আপদ!’

‘যাবে! যাবে! তোমার এখেনে সারাজীবন থাকতে এসেছে নাকি?’

শাশুড়িকে মুখ ঝামটা দিতে ছাড়ে না মালতি। তারপর মোজাম্মেলের দিকে তাকায়, ‘তেমন কিছুই সমাদর করতে পারলাম না। আরেকটু ভাত দেই তোমারে?’

মোজাম্মেল মাথা নাড়ে।

‘তুমি দি কোনো কথাই কচ্ছ না। ইশকুলে পড়ার সময় শামছুন্নাহার মজা করে বলতো, তুমি নাকি আমারে ভালবাসো। কই কোনো দিন তো একটা কথাও বলোনি? খালি দেখতাম আসা যাওয়ার পথে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছো! সত্যি ভালবাসতে?’

মোজাম্মেলের পাতে ডাল তুলে দিতে দিতে জানতে চায় মালতি। মোজাম্মেল কথা বলে না, শুধু পাতের উপর আরো ঝুঁকে পড়ে।

‘তুমি কিন্তু সেইসময় দেখতে ভারি সুন্দর ছিলা...’ মালতি মুখ টিপে হাসে। ‘এখন অবশ্য চুল দাড়িতে তোমারে শিব ঠাকুরের মতো লাগে, হাতে কেবল একটা ত্রিশূল থাকলেই হইতো!’

মাটির মেঝেতে খড় বিছিয়ে তার উপর কাঁথা পেতে বাইরের ঘরে মোজাম্মেলের বিছানা পেতেছে মালতি। সেই বিছানায় ঘরের চালের ফাঁক ফোকড় দিয়ে জোসনার বিন্দু বিন্দু আলো অপার্থিব আলপনা আঁকছে। খাওয়া দাওয়া শেষে এক খিলি পান হাতে মোজাম্মেলের ঘরে আসে মালতি। বিছানায় আসন পেতে বসে মোজাম্মেলের দিকে পানটা এগিয়ে দেয় সে।

‘তুমি কি মৌন ব্রত পালন করিচ্ছো নাকি? মুখে একটাও কথা নেই? নাকি বোবায় ধরিছে?’

‘না, না। তা না। আমার মনে হইতেছে সব স্বপ্ন দেখতেছি। বিশ^াস করতে পারতেছি না!’ মোজাম্মেল ঘোর লাগা গলায় বলে। ‘এইভাবে তোমারে দেখতি পাবো, এত কাছ থেকে, ভাবি নাই কখনো! সব মাওলার ইচ্ছা! তারই কেরামতি! তাঁরে শুকরিয়া! এইবার কওতো মাজারে কেন গেছিলা? কোন ইচ্ছা পূরণে সূতা বানছিলা গাছের ডালে?’

‘সেই দুঃখের কথা তোমারে কী আর কই!’ মালতি একটা দীর্ঘশ^াস ফেলে। ‘বিয়া হইছে চৌদ্দ বছর কিন্তু ঘরে সন্তানাদি নাই! দেখতাছোই তো! স্বামী আছে না থাকার মতোই! শাশুড়ির বিশ^াস মাজারে মানত করলে পীর-মুর্শিদের উছিলায় পেটে বাচ্চা আসবে। তাই গেছিলাম! তিন বছর ধরেই যাই, মানত করি...’

মোজাম্মেলের ভেতরে হঠাৎ কী হয়, সে মালতির শাখাপরা হাত চেপে ধরে।

‘আমার সাথে চলো, চলো আমরা দূরে কোথাও পালায়া যাই! অন্য জেলায়! যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না! ’

মালতি ম্লান হাসে। ‘মোজাম্মেল ভাই, তুমি হইলা পথের মানুষ! আমি ঘরের! ঘর ছেড়ে জাত মান কূল ধর্ম বিসর্জন দিতে পারবো না।’

মোজাম্মেল মালতির হাত ছেড়ে দেয়। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। দুজনের মাঝখানে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক এক লয়ে বাজতে থাকে। মালতি এবার মোজাম্মেলের দিকে ঘন হয়ে চেপে আসে। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

‘তুমি আমারে একটা সন্তান দিয়া যাও মোজাম্মেল ভাই!’

মোজাম্মেল শিউরে ওঠে ঘরের কোনায় ছিটকে পড়ে,

‘এইসব কী বলতিছো মালতি? না, না, তা আমি পারবো না।’ তারপর একটু থেমে লম্বা করে শ^াস টেনে সে শান্ত ভঙ্গীতে বলে, ‘আসলে কি জানো মালতি, আমার মধ্যে এখন আর কাম ভাব জাগে না!’

‘হায়রে মরদ! কাম না জাগুক, প্রেম ভাব তো জাগে!’

মালতি মুচকি হাসে। মোজাম্মেলের হাত দুটো তুলে ধরে নিজের গালে ছোঁয়ায়, হাত দুটো গাল থেকে গলায় নেমে আসে। মোজাম্মেল এবার আচমকা তার শরীরের পরিবর্তন টের পায়। সে বিড়বিড় করে,

‘মালতি, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’

মালতি উঠে গিয়ে ঘরের নড়বড়ে দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দেয়। তারপর শাড়িটা একপাশে খুলে রেখে মোজাম্মেলকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভেবেই বলিছি, আমার ভেতরে তোমার নতুন জন্ম হোক! তুমি তোমার বীজ বুনে দিয়ে যাও!’

তারপর কী যে হয়! মালতির সাজানো গুছানো শরীরে পথ হারায় একজন একাকী বিষণœ ক্ষুধার্ত পাগল! বহুদিনের সুপ্তি ভেঙে রক্তে মাংসে শিরা উপশিরায় অচেনা এক ঘূর্ণি জাগে, মোমের মতো গলে গলে পড়ে হৃদয়! কতখানি বিচ্ছেদ শেষে কতখানি মিলন হলো, কতখানি অপ্রাপ্তির পর কতখানি পাওয়া হলো, পাগল মোজাম্মেল তা বোঝে না। রাত শেষে কখন ভোর এলো, গলা ফুলিয়ে গেরস্ত বাড়ির মোরগ বাগ্্ দিলো, মসজিদে উচ্চস্বরে আজান হলো আর মালতির পায়ের রেখা ধরে যেই পথে এসেছিল সেই একই পথ ধরে মোজাম্মেল পাগলা আবার কীভাবে যেন পথহীন পথে হারিয়ে গেলো!

২.

কিন্তু দুনিয়ার গোলকধাঁধায় যতক্ষণ তুমি বাঁধা পড়ে আছো, ততক্ষণ তো তুমি হারাবা না, কেউ না কেউ তোমারে খুঁজে পাবেই! ফলে বিরাম সাধুর সাথে আবার কোনো এক শুক্কুরবার বিকেলে ফতেহ আলী শাহর ভেঙে গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যাওয়া মাজার প্রাঙ্গণে মোজাম্মেলের দেখা হয়ে যায়।

‘ওরা তো সব মাজার ভেঙে দিচ্ছেরে পাগলা, মজলুম আশেকরা এখন থাকবে কই, বল দেখি?’

ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে বিরাম সাধু তার ঢুলু ঢুলু চোখের তারা নাচিয়ে জানতে চায়। হয়তো কোন উত্তরের আশা না করেই বাতাসে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সে। মোজাম্মেলও আর বলে না যে ওই ভাঙচুরের সময় বাজারের পাশেই একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে ঘাঁপটি মেরে মুখ ঢেকে বসেছিলো সে। অসীম কৌতূহলে দেখছিলো, লাঠিসোটা হাতে মানুষগুলির হিং¯্র নিষ্ঠুর চোখ, তাদের ক্রোধে উন্মত্ত চেহারা। শুনছিলো তাদের নির্দয় চিৎকার, তাদের রাগত কণ্ঠের হৈহল্লা। তারা পাপ, পুণ্য, ধর্ম, অধর্ম, বেদাত, বেশরিয়ত, ভ-ামি, নোংরামি, আচার, অনাচার এসব নিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গীতে আলাপ করছিল। তারা সব কিছু ভেঙে মাটির সাথে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করছিল। মোজাম্মেল তখন কিছুই বলে নাই। অবশ্য বললেই বা কে শুনতো তার কথা? উল্টো ওদের হাতে মার খাওয়ার আশঙ্কা ছিল। মোজাম্মেলের মন শুধু ফিসফিস করে নিজেকে বলছিলো, ‘ওদের কথা শুইনো না। যারা অন্যের দোষ ধরে তারা কখনো নিজের দোষ দেখতে পায় না! আর তুমি তো এমন এক অভিশপ্ত বান্দা, এমন এক নাখাস্তা ফকির, যার কোথাও ঠাঁই নাই, তুমি আসলে পথভ্রষ্ট, অধঃপতিত! তোমার বেহেশত নাই, দোজখও নাই! মাজার ভাঙলেই কী আর অক্ষত থাকলেই কী? পথই তোমার ঠিকানা।’

বিরাম সাধু হাসে! নিজের মনেই বলে, ‘আহারে, সবাই কি এক সুরে খোদারে ডাকে? সবাই কি এক রূপে দুনিয়াতে আসে? যাক্্ এইখানে যখন ঠাই নেই, তখন চল, শাহ সাবের ওরসে যাই! ওইটা বড় লোকের জায়গা, নামী দামী লোকেরা আসেন! ওইখানে ভাঙচুর নাই।’

ওই জায়গাটা মোজাম্মেল সযতনে এড়িয়ে চলে কারণ পুরনো ক্ষতকে সে আর খোঁচাতে চায় না। এই জীবনে মালতির মুখোমুখিও হতেও সে আর চায় না। কিন্তু বিরাম সাধুর আহ্বান উপেক্ষা করার শক্তিও তার নেই। ফলে মোজাম্মেল না চাইলেও হয়তো দেখতে পাবে, ওরসের ভিড়ের মধ্যে আবার সেই শ্যামলা গোলগাল সিঁদুর পরা সাদাসিধে মুখখানা তবে এবার তার সঙ্গে সাদা থানের বৃদ্ধা ছাড়াও আছে এক চঞ্চল উজ্জ্বল দুরন্ত শিশু। মানুষের বদ নজর থেকে নিরাপদ রাখতে শিশুটির কপালে তার মা কাজলের বিরাট এক গোল টিপ এঁকে দিয়েছে। মায়ের আঙ্গুল ধরে টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বড় বড় চোখ মেলে সেই শিশুটি চারপাশ দেখতে থাকবে অসীম বিস্ময়ে। তাদের পথের পাশেই কোনো নিশ্চল জড় বস্তুর মতো মোজাম্মেল হয়তো শুয়ে থাকবে চটের বস্তায় মুখ লুকিয়ে।

শিশুটি সেই বস্তুর দিকে আঙ্গুল তুলে আধো আধো বোলে মায়ের কাছে জানতে চাইবে, ‘ওতা কি?’

মা ত্রস্ত কণ্ঠে ওকে পেরিয়ে যেতে যেতে শিশুটিকে বলবে, ‘ওটা কিছু না! একটা পাগল!’

back to top