alt

ঈদ সংখ্যা ২০২৫

ঈদ পদাবলি

: শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের বৃন্ত ছিঁড়ে
নাসির আহমেদ

একদিন স্বপ্নের ভিতরে ছিল দুঃস্বপ্নের সাপ!

স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল,

তাই এসেছিল জাগরণ :বাহান্ন ও একাত্তর,

মুক্তিযুদ্ধ-রক্তপাত- কালোর ভিতর থেকে আলো।

সভ্যতার ইতিহাসে বারবার আলোর বিরুদ্ধে অন্ধকার,

বারবার মানুষের জাগরণ আর আত্মত্যাগ

বুকের গভীরে যত ব্যথা ব্যক্তিগত

ততোধিক অনুভব যদি হয় দেশ- তবেই মানুষ তুমি।

আকাশকে দেখো আর দেখো তার নীল বিশালতা

দিনরাত আলো-অন্ধকারে বিবর্তন।

বিজয়ের গান গেয়ে মানুষ মিছিলে যায় তাই

রণধ্বনি মিশে থাকে রক্তের ভিতরে।

কে তাকে থামায় বলো গতি যার দুরন্ত দুর্বার

দুঃস্বপ্নের কালসাপ ফণা তোলে বার বার!

ছোবল এড়িয়ে বাঁচে মানব সভ্যতা।

মেঘের সকাল
সোহরাব পাশা

এখানে এখনও ভোরগুলি ঢেকে যায়

জন্মান্ধ রাত্রির কুয়াশায়

শূন্যতার বিরুদ্ধে স্বস্তির কথা বলে না কেউ

‘সত্য বাবু বাড়ি নেই’

যেই ডাক দেই বলে কেউ-

“সঙ্গে গেছে শুভ দা” -বিনয়

কখন যে হঠাৎ কী হয়

বড়ো বুনো ভয়

মধ্যরাত গত হলো- এখনও ফেরেনি।

কীভাবে যে কী হয়

দীর্ঘ রাত্রি গেলো ঘুমের মধ্যেই

রোদ ভাঙেনি এখনও মেঘের সকাল।

আত্মপক্ষ
রাজা হাসান

একা মানুষ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নিচে

জলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তার খুব গভীরেও ঢেউ ভাঙে।

ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ছায়া জলের ওপর,

যেন ঐখানে সরোজিনী শুয়ে আছে।

দেয়াল লিখনগুলো দেয়াল ও জীবন থেকে

অস্পষ্ট হয়ে গেছে। স্মরণে মলিনতা।

আর কিছু নয়। ঘুড়ি আকাশে শূন্যতা অভিমুখে ওড়ে।

নিসর্গের সব ছবিই ছেঁড়া-

লতাগুল্মময় নীরবতা অন্তহীন।

আর কেউ নয়, নিজেকেই মৌন সঙ্গী মনে হয়।

অবলোকন
মিহির মুসাকী

কাকে খুঁজতে গিয়ে এ কাকে খুঁজে আনলো

আমার চোখ!

আমি তাকে খুঁজে আনতে বলি

আমার হারানো শৈশব, উদ্দাম কৈশোর

খুঁজে আনতে বলি তারুণ্যের

জয়ভরা দিন,

সে শুধু খুঁজে আনে

শুকনো মরিচের মতো ঝাঁজালো রোদ

বৃষ্টিভেজা রাত,

মরা ঘাস,

সমুদ্র না-খুঁজে

খুঁজে আনে অক্টোপাস।

এ চোখ কি সেই চোখ!

যে এক দিন রূপ দেখে মুগ্ধ হতো

হতো বিরহকাতর, বিষণœ আলোয়

হীরকের দ্যুতি দেখে

নেচে উঠত স্বর্গনর্তকীর মতো!

চোখ,

দৃশ্যেরা তার বোন

শুধু দেখে দেখে

কেটে গেল তার সারাটা জীবন

হলো না অন্তর্ময় অবলোকন!

মেয়েটি জানতো
মাহফুজ আল-হোসেন

মেয়েটি জানতো

পলায়নপর ছেলেটা যতই সাঁতার জানুক

শত চেষ্টাতেও সে

অযুতবর্ষের রক্তদাগ মুছতে পারবেনা

বশংবদ জলধারায়;

মেয়েটা ডুবে যাওয়ার আগমুহূর্তে

কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেছিলো

অস্ফুট স্বরে;

সে হয়তো ভেবেছিলো,

ঐসব উৎপ্রেক্ষাহীন ধ্বনিসমুচ্চয়

ব্যক্তিগত বোধের নির্মিতি হিসেবে

জীবন্মৃতদের জাগিয়ে তুলবে

আরোপিত অনালোকে;

মেয়েটি কি জানতো-

আর কতো রক্ত,

আর কতো নিমজ্জন,

আর কতো ধ্বনিসমুচ্চয় সরব হলে-

বহতা ¯্রােতস্বিনীর গতিপথ পাল্টে যাবে,

মুকবধির মুক্তধারায়!

মেয়েটি জানতো...

প্রত্যয়
মঈনউদ্দিন মুনশী

শহীদ মিনারের রাস্তা ধরে যখন হেঁটে যাই,

বাতাসের হাত ধরি, যাতে ধুলো না ওড়ে।

মিনার থেকে জীবনের আলো উঠছে, দ্যাখো

আকাশ কি যে মধুর, তার আস্বাদ মনে লাগছে!

শহীদদের ফুটো হৃদয় বড় একাকী মনে হলো।

একটু পরে রাস্তার বাতিগুলো জীবন্ত হবে, টেলিভিশনে

আলোকিত হয়ে উঠবে নীল। চলে যেওনা যেন,

যে পর্যন্ত আকাশ রয়েছে সোনালি!

এই মই ধর যাতে আমি বেয়ে উপরে উঠতে পারি এবং

সবচেয়ে উঁচু ধাপ থেকে আলোর কণাগুলো হাতে নিয়ে

মিনারের চারদিকে মালার মতো পরাতে পারি।

দ্যাখো, এক একাকী নক্ষত্র প্রেমে ও নিঃসঙ্গতায়;

একাকী আমার দেশ: রক্তিম, উষ্ণ ও উজ্জ্বল।

প্রতিধ্বনি
শফিক ইমতিয়াজ

উইলিয়াম ব্লেক, আমি মুগ্ধ হয়ে পাঠ করি তোমার ‘নার্সেস সং’

সন্ধ্যা হয়েছে বলে নার্স ক্রীড়ারত শিশুদের বাড়ি ফিরতে বললে

তোমার শিশুরা বলে,

“No, no, let us play, fo it is yet day,...

Besides, in the sky the little birds fly...”

নার্স সহাস্যে ওদের খেলা চালিয়ে যেতে বললে শিশুদের কী উল্লাস-

“The little ones leaped and shouted and laughed,

And all the hills echoed”

ব্লেক, আমি পাঠক্লান্ত এক শিশুজন্ম তাকিয়ে দেখছি

অধরা ব্যাঙ্গচিত্র ও মায়াবী খেলায় নিমজ্জিত

ওরা বিকেল বা প্রায়সন্ধ্যা পাখি-কিচির চেনে না

খোলা প্রাঙ্গনে দেখেনি পশুবিচরণ

অসূয়া মারণাস্ত্রের কবলে কোথাও কী করুণ শিশুর জীবন!

আমি তো এমন কোনো পাহাড়গাত্র দেখি না

যাতে জলঢল শিশুদের আনন্দ প্রতিধ্বনিত হয়!

কোন দিকে যাই
আহমেদ ফরিদ

এসো সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে

আমাকে ডাকছে ¯্রষ্টার এক প্রতিনিধি

আমি মহান ¯্রষ্টার ডাকে সাড়া না দিয়ে

দাঁড়িয়ে আছি টিকাটুলির ভাঙা ব্রিজে

আমার এক পা ডানে যেতে চায় তো এক পা বামে

বামে তুমি রয়েছো, ডানে তাঁর ঘর

আমার দুপায়ের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে

ডান-বাম, বাম ডান

ধারালো সিাঁড়টিতে আমার পা কেটে রক্তাক্ত

আমি কোন দিকে যাব?

প্রার্থনালয়ের দিকে নাকি তোমার দিকে?

প্রথম, প্রথমতম
বায়েদ আকাশ

সারাংশ খুঁজে দেখি

পৃথিবীতে তোমার অনুপস্থিতি বলে কিছু নেই

আছে যা তা আপাত সত্য হাহাকার

এই সব হাহাকার নিয়ে

কত দিন বেঁচে থাকে মানুষ!

অথচ দেখো

তুমি আমি বেঁচে আছি মা

পৃথিবীর প্রথম প্রথমতম দীর্ঘ নিঃশ^াস

দূর শহরের কবিতা
মুজিব ইরম

ফুটেছে ম্যাগনোলিয়া বাগানে বাগানে

পরের শহরে...

ড্যাফোডিল এসেই যেন বলে গেলো যাই...

কাঠগোলাপের দিনে

চেরিফুল ফুটিবার দিনে

আমারে পাঠিও ডাক শিমুলে পলাশে...

তোমার শহরে আমি ফিরে যাবো একদিন

জারুল ফোটার দিনে

গেন্ডা ফুল ফুটিবার দিনে...

তুমিও থাকিও ভালা এই আমি বিনে

আমারে পাইবা তুমি পুষ্প ফোটা দিনে...

রক্তস্রোত
জুনান নাশিত

আমি তো ঘুমুতে চাই

হৃদয় কেন জেগে থাকে দিনরাত?

শঙ্খদিন ভেঙে ভেঙে যে

আড়ালটুকু চেয়েছে দু’হাত

সে কি পেয়েছে?

রক্ত ছাড়া মুক্তি নেই অথবা যুদ্ধজয়

ইতিহাস নড়ে ওঠে

লেখা হয় পুনর্বার

আমরাই লিখি

আবার হারাই

তাই রক্ত¯্রােত ফিরে আসে

জনপদে বারবার।

কোনো কোনো মরণ
রকিবুল হাসান

প্রমত্ত নদীও মরে যায় একদিন

একদিন এই দেহ মাটিতেই পচে যায়

পোকামাকড়েও খেয়ে যায়-

কিন্তু অন্ধকার ভেঙে আলোর গানের জন্ম

রক্তগঙ্গার গোঙানি

কোনোকালে এ সবের মরণ হয় না

এসব তো মরে গেলে জন্মহীন হয়ে ওঠে আত্মার স্মারক

গান-কবিতা থাকে না। থাকে না লালন।

রোদের মতোন চিকচিক করা মাঠভর্তি স্বপ্নও থাকে না

মাথা উঁচু করে নীল আকাশ দেখাও হয় না।

রাত্রির তীব্র যন্ত্রণা-মেরুদ- ভেঙে যাওয়া

ভয়াবহ বেদনায় কাতরানো সেই

রক্ত জবার মতোন জননীমুখশ্রী

বৃক্ষের ভরাট বুক থেকে ছিঁড়ে যায়

মাটির গভীরে গাঁথা নিজের শেকড়-

যেখানে তোমার শক্তি-

ওই টুকুনা থাকলে পাহাড় থাকে না

তুমিও থাকো না-ঝড় ওঠে ঝড় থামে-

মরণ খেলার পৃথিবীতে কখনো কখনো মৃত্যুও মরে না।

পুনর্জন্ম
মালেক মুস্তাকিম

প্রার্থনায় নত হলে তোমাকে পাই,

পাপে ও তাপে,

অর্দ্রতার কিনারে পাই ঘামের পালঙ্ক- অনিদ্রাসূচকে।

বাতাসে উড়ছে ভুল- বারান্দার ঝুল- গন্ধম সময়-

ধ্যান ভাঙলে একদিন ঈশ্বরের সাথে বদলে নেব

ঘুমের সেফটিপিন, জামার বোতাম-

পুনর্জন্ম হলে একবার প্রেমিক হবো-

হাওয়া বদলে গেলে যেমন

জোছনায় চোখ রেখে ঘুমঘোরে জেগে ওঠে কুমারী নদী,

মৃতের শহরে দেবদারু গাছ হয়ে ওঠে

প্রিয়তম পুরুষ।

কালপুরুষের ঘুম
সঞ্জয় দেওয়ান

হাওয়ার শরীরে বিষাদের শিস দেয় কামজ চড়–ই

হংসমিথুনের পরাবাস্তব গল্প লিখে দস্যু বাতাস

যাযাবর মন ভুলে যায় আগুনের নদী,

ঘাঁটের পুরাণ, মোহনার ঘূর্ণি।

পরিযায়ী রাতের ওম কেড়ে নেয়

আরটামিস এর সুখনিদ্রা!

ভোরের এলার্ম ভুলে যায় নিশিরাত;

কালপুরুষ ঘুমায় আজও বসন্তের স্বপ্ন ভুলে।

রাইন-আইজেল জলধারা
যাকিয়া সুমি সেতু

দেখ চেয়ে নবোদিত সূর্যের সোনারঙ ঘরে

আমি ধ্যানমগ্ন মর্মরিত ধ্রুপদী সুরের মোহনা

রাইন-আইজেলে যুগল ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস

আমি জলধারায় কুড়িয়েছি নীল

মুক্তো লবঙফুল কুঁড়িতে স্বতঃশ্চল ভালোবাসা

অরণ্য, পাহাড়ে সবুজ ফসল শিল্পকলা

নীল পাতার সিঁড়ি ভেঙে, গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ পেরিয়ে

-মেঘপুঞ্জের স্বপ্নে তুমি উঠে এসো

আরও উপরে শীর্ষ চূঁড়ায়- আরও একটু

যেখানে বিশ্বাসের শেকড় গভীর অতলান্ত

যেখানে গীতার সর্বজনবিদিত প্রতিধ্বনি:

“ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে”

এখানে কালের প্রবাহ আগ্নেয়গিরির ফুল

অপরাজিতায়-সূর্যাস্তের শতরূপ নিষ্কিঞ্চন

তুমি ওঠে এসো এখনি পৃথিবীর এই শিল্পে

এখানে শিশির বেদনা, চিরদিন হেমন্তে-

সমগ্র শক্তি, সমগ্রপ্রগতি প্রগাঢ় বিস্ময়ে

আকাশও জলের বৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে

দাঁড়িয়ে থাকে অনুনয় চাষাবাদে রূপকথা

অন্তর্লীন আঁচলে রাইন-আইজেল জলধারা

আমি মুছে দিয়েছি দ্বিধাবিভক্ত সব বিভাজন

মুছে দিয়েছি তোমার চোখে ব্রাত্য মেঘের রঙ

গ্রিমেলস ব্রেমেনে আজ পূর্ণিমা জল সারারাত

রাইন-আইজেলের শান্ত ঢেউও নক্ষত্র শিল্প

চলে এসো তুমি, চলে এসো এই আষাঢ় বুকে

আমি কোটি বছরের সূর্যপথ বসে আছি একা

বসে আছি নীলপাতার সিঁড়িতে ইকারুসের মতো...

রাফখাতা
মতিন রায়হান

মন এক রাফখাতা

যখন যা খুশি লিখে ফেলি, এঁকে ফেলি

সারাক্ষণ কাটাকুটি

কখন যে এঁকে ফেলি ঝুরিনামা বট

কখনোবা ভাসমান নৌকাটাকে তুলে দিই চরে

আবার নামিয়ে আনি থইথই জলে

জোয়ার আসুক বা না-আসুক!

ও প্রেম, তুমিও কি রাফখাতা?

ক্ষণে ক্ষণে আঁকিবুঁকি, মোছামুছি?

ও জীবন, তুমিও কি!

রোদ ও রাতের আখ্যান
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

রোদ ও রাতের বৈরিতা পর্বত ও পবনের চেয়ে কঠিন।

রোদে উবে যায় রাত আর রাতের বিস্তারে রোদ নির্বাসিত

তবু রোদ ও রাত জীবনকে যাপনের অনিবার্য অনুষঙ্গ

প্রাণ ও পৃথিবী রোদ ও রাতের মতোই প্রতিবাস্তব কুশীলব

প্রাণহীন পৃথিবী অকল্পনীয় আর প্রাণপ্রাচুর্যে পৃথিবী মরণাপন্ন

কল্প্য-অকল্প্য অগণন প্রতিবাস্তবতায় জীবন এগিয়ে যায় এভাবেই

এগিয়ে যাওয়াই সমৃদ্ধি আর জীবনের এগিয়ে যাওয়া মানে পরকালের নৈকট্য

প্রতিবাস্তবতাই অমোঘ জীবন, জীবন মানে প্রতিবাস্তবতা।

আজ যার কাছে অরুচিকর সে প্রতীক্ষায় থাকে আগামীর

অথচ আগামীকে কাছে পেলে আজকের কদর বেড়ে যায় আফসোসে

যেমন রোদতৃপ্ত মানুষ রাতের কুহকে পড়ে রোদকে নির্বাসিত করে

পরিণত রেণুকণা, তুমিও আজ প্রতিবাস্তবতার এক নির্মম শিকার।

ডুবমিলন
অরবিন্দ চক্রবর্তী

ঢেকে দেয়। জেগে ওঠে। স্বভাব এমন চাঁদমতো।

চাঁদ তবু সংযোগসূত্র; হাঁস ও গালগল্পের।

পুকুরের পক্ষে থাকি, পুকুর থাকে বিম্বের।

হাঁস যায় হাঁসের দিকে। হাঁসপাল স্মৃতি করে

শামুক। অর্থাৎ, জলের পর প্রতিবিম্ব।

হতে পারে খাচ্ছে; সে আসলে তিনিকে

পাহাড়-বৃক্ষ ছল্লিবল্লি কিংবা মাউথ অর্গান

তিনটি নদী। ইদানীং ওই তিনেক্কে এপিসোড

একটি কপাল কাটা দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে

সাদা পৃষ্ঠার আগ-পরে।

চৈতার বৌ গো
পিয়াস মজিদ

ভারী নাচ মাথায় জমেছে

নামাতে পারছি না কোনওমতে

জে কে রাউলিং দ্বীপ কিনে নিয়ে

পটারের পর পটার চলেছে লিখে

দুর্গম প্রেমে পা হড়কে

সহজে কিছু হলো না আমার

সোনার পদতলে

কুসুমের রক্ত ঢেলে

সমুদ্রের জীবনী

¯্রােতও জানে না জানি

সব তো চেনা শয়তানি

গানবিরহিত আমি;

তোমাকে ভেবেছি

ঘৃণায় গঠিত

অচিন রাগিণী

টুকরো কবিতা
মুশাররাত

হরিণের মতো

পিছন ফিরে চলতে গিয়ে

গন্তব্য ছোঁয়া হয়না চরণে আর

শেষ হয়না বাকি পথ

যেন ক্লান্তি নিয়ে প্রতি কদমে

টানছি বিষাদ পাহাড়।

ব্যস্ততার আগ্রাসনে

মৃত অভিমান

প্রতিশোধের প্রতিরোধও

এখন নিষ্প্রাণ।

মায়ার ঘ্রাণ একটু বেশিই ক্ষণস্থায়ী;

কাঠগোলাপও সারাটারাত গন্ধ ছড়ায়।

হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে লাস্যময়ী

যেমন মনে কাব্যরসের ছন্দ ঝরায়।

বেলা অবেলার গান
আহমদ জামাল জাফরী

আমাকে গ্রহণ করো ভরিয়ে দাও তৃষ্ণার এ ধূলিময় জীবন

অধিকারহীন ভগ্নাবশেষ তবু ফিরে এসো প্রাণপণ,

নিঃসঙ্গ বেদনাগুলো বাজে নিত্য সন্ধ্যা-রাত্রি, ভোরে;

সারা দিনমান উষ্ণ হাহাকার ডাকে ব্যাকুল স্বরে।

তুমি শুধু মিলাও দূরে ধূসর শূন্যের পথে

এই বিফলতা জীর্ণ করে অনন্ত বধির রথে,

সময়ের উত্তাপে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে অনন্ত বিষাদ

কোলাহল ও বিভ্রমে জেগে ওঠে কোমল নিষাদ,

করুণ অশ্বের মতো বেলা অবেলার এই ছায়া-প্রচ্ছায়ায়

শূন্যতা থেকে অনন্ত শূন্যতায় দিগি¦দিক মিশে যায়,

শূন্যপথে মিশে যাওয়া নিঃসঙ্গ হৃদয়ের এই গানে

অপেক্ষার সংরাগ বাজে দূরবর্তী আলোর প্রাণে,

অগ্নি ও দহনের প্রক্ষেপ নিয়ে আমার সকাল রাত্রি

হেঁটে যায় তোমার দিকেই বিষণœ পথের যাত্রী।

ব্যবচ্ছেদ
রওশন রুবী

কেন চলে যায় যারা এসেছিল রাত্রিকে ব্যবচ্ছেদ করতে!

সবে যে হয়েছে সাঁঝ, বাতির ওম রাত্রির দিকে খুব ধীর...

অসংখ্য বীণা, উদ্ধত অস্ত্র আর শাস্ত্রের সুর বিগলিত সময়,

অপেক্ষার দীর্ঘ-পথ গতিময়। একটাও পাতা খসে না,

পালক নড়ে না, সময় ছুটে যায়,

যারা এসেছিল এখন তাদের ছায়া গণআন্দোলনমুখী...

গ্যালাক্সিতে
তরুন ইউসুফ

এক সকালে আমার শিশুকন্যার সাধের পৃথিবীটা ভেঙে গেল।

আরেক সকালে আমরা ভাঙ্গা পৃথিবী ঠিক করব বলে এক অভিযানে বের হলাম

বেরিয়ে দেখি রাস্তা ফাঁকা। যারা পৃথিবী ঠিক করবে বলে কথা দিয়েছিল

তারা যেন বেমালুম উবে গেছে অথবা তাদের ঘুম এখনো ভাঙে নাই।

সেকথা আমার শিশুকন্যাকে জানাতেই বিষণœমুখে সে আমাকে বলল-

“বাবা তাহলে আমরা কীভাবে পৃথিবী ঠিক করব?”

আমি নিরুত্তর থেকে মনে মনে আওড়াই সে উত্তর আমার জানা নাই।

আমারা পৃথিবী না ঠিক করেই ফিরছি নতমুখে

আমাদের এক হাতে ভাঙা পৃথিবী আরেক হাতে শূন্যতা।

চিরন্তন মা-কে
বিপাশা মন্ডল

চুলার আগুনে রক্তিমাভ মুখ দেখে

পুনর্বার ভুল করে গেছি,

সাধারণেতর ঘামে কাঁচা মাটি ঘ্রাণ

হাঁটুতে ওঠানো শাড়ি বিস্ত্রস্ত আঁচল

পুরনো দৃশ্য প্রতিদিন একঘেয়ে ক্লান্তিকর

কলপাড়ে স্তূপীকৃত কাচা কাপড়ের ভিড়ে

এলোচুলে অসহ্য ধোপানি রাধিকা

অবজ্ঞায় প্রতিরাতে পাশ ফিরে শুই

অফিসফেরত কল্লোলিনী স্বরে থমকে দাঁড়াই

উঠানের কোনে শিশুকে দেখাও

নীড়ে ফেরা পাখি ডোবা সূর্য-তারা

হ্যাংলা যুবকদল গলিতে হেলানো

সাইকেল দেখে তোমাকে

আমিও তোমাকে দেখি অপ্সরা অনন্যা

লীলাহাস্য সুমধুরা চিরন্তণ মা-কে

শিক্ষক
মাশরুরা লাকী

আমার শিক্ষক আমারই বইগুলো

সে-ই সব লেখকও যে ছিলো গুরু

বই-জগতের পথচারী দূরগামী

সহজ নয় তো অনুসরণের ধারা

কোনো বইয়ে হর্ষিত হবে মন

ধরে রাখে রেশ কড়া চুম্বকে

সব পুঁথি ছাপ ফেলে না পাথরে

ভুলে গেছি বটে অসংখ্য বই-নাম

বয়সের ভাঁজে ভাঁজে

তবুও বই মাতৃদুগ্ধ বৈ নয়

পান করি প্রত্যহ মহাস্বাদে!

কেন অন্ধ কেন সে কাঙাল
হাসান হাফিজ

বিভ্রম বলেছি ওকে,ঠারেঠোরে ইঙ্গিতে বলেছি।

ভালোবাসা ভুল করে হুলস্থুল বাধালো কেন যে!

নিভৃতি সে ভালোই বাসে না, ইচ্ছা করে কাছেও আসে না,

প্রকাশিত হয় দ্রুত, নিন্দা হুল বুক পেতে নেয়

বিষও পান করে ফেলে আবেগের উষ্ণতাবশত

কী করে ঠেকাই বলো এরকম অনিদ্র পতন?

নিজে নিজে নিমজ্জিত ম্লান দুরাশায়

ভেসে উঠতে চাইলেও পারছে না,

তার জন্যে শঙ্কা ক্ষোভ আহা উহুঁ নাই

সেও কিন্তু বিভ্রমেরই আলোছায়া, মরীচিকা মায়া

চোরাগোপ্তা টালমাটাল আশনাই-

ভালোবাসা এত বেশি নির্লজ্জ কেন যে

ভালোবাসা এত অন্ধ সর্বনাশা দৈন্যে দেউলিয়া

মতিভ্রষ্ট কাঙালও কেন যে!

tab

ঈদ সংখ্যা ২০২৫

ঈদ পদাবলি

শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের বৃন্ত ছিঁড়ে
নাসির আহমেদ

একদিন স্বপ্নের ভিতরে ছিল দুঃস্বপ্নের সাপ!

স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল,

তাই এসেছিল জাগরণ :বাহান্ন ও একাত্তর,

মুক্তিযুদ্ধ-রক্তপাত- কালোর ভিতর থেকে আলো।

সভ্যতার ইতিহাসে বারবার আলোর বিরুদ্ধে অন্ধকার,

বারবার মানুষের জাগরণ আর আত্মত্যাগ

বুকের গভীরে যত ব্যথা ব্যক্তিগত

ততোধিক অনুভব যদি হয় দেশ- তবেই মানুষ তুমি।

আকাশকে দেখো আর দেখো তার নীল বিশালতা

দিনরাত আলো-অন্ধকারে বিবর্তন।

বিজয়ের গান গেয়ে মানুষ মিছিলে যায় তাই

রণধ্বনি মিশে থাকে রক্তের ভিতরে।

কে তাকে থামায় বলো গতি যার দুরন্ত দুর্বার

দুঃস্বপ্নের কালসাপ ফণা তোলে বার বার!

ছোবল এড়িয়ে বাঁচে মানব সভ্যতা।

মেঘের সকাল
সোহরাব পাশা

এখানে এখনও ভোরগুলি ঢেকে যায়

জন্মান্ধ রাত্রির কুয়াশায়

শূন্যতার বিরুদ্ধে স্বস্তির কথা বলে না কেউ

‘সত্য বাবু বাড়ি নেই’

যেই ডাক দেই বলে কেউ-

“সঙ্গে গেছে শুভ দা” -বিনয়

কখন যে হঠাৎ কী হয়

বড়ো বুনো ভয়

মধ্যরাত গত হলো- এখনও ফেরেনি।

কীভাবে যে কী হয়

দীর্ঘ রাত্রি গেলো ঘুমের মধ্যেই

রোদ ভাঙেনি এখনও মেঘের সকাল।

আত্মপক্ষ
রাজা হাসান

একা মানুষ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নিচে

জলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তার খুব গভীরেও ঢেউ ভাঙে।

ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ছায়া জলের ওপর,

যেন ঐখানে সরোজিনী শুয়ে আছে।

দেয়াল লিখনগুলো দেয়াল ও জীবন থেকে

অস্পষ্ট হয়ে গেছে। স্মরণে মলিনতা।

আর কিছু নয়। ঘুড়ি আকাশে শূন্যতা অভিমুখে ওড়ে।

নিসর্গের সব ছবিই ছেঁড়া-

লতাগুল্মময় নীরবতা অন্তহীন।

আর কেউ নয়, নিজেকেই মৌন সঙ্গী মনে হয়।

অবলোকন
মিহির মুসাকী

কাকে খুঁজতে গিয়ে এ কাকে খুঁজে আনলো

আমার চোখ!

আমি তাকে খুঁজে আনতে বলি

আমার হারানো শৈশব, উদ্দাম কৈশোর

খুঁজে আনতে বলি তারুণ্যের

জয়ভরা দিন,

সে শুধু খুঁজে আনে

শুকনো মরিচের মতো ঝাঁজালো রোদ

বৃষ্টিভেজা রাত,

মরা ঘাস,

সমুদ্র না-খুঁজে

খুঁজে আনে অক্টোপাস।

এ চোখ কি সেই চোখ!

যে এক দিন রূপ দেখে মুগ্ধ হতো

হতো বিরহকাতর, বিষণœ আলোয়

হীরকের দ্যুতি দেখে

নেচে উঠত স্বর্গনর্তকীর মতো!

চোখ,

দৃশ্যেরা তার বোন

শুধু দেখে দেখে

কেটে গেল তার সারাটা জীবন

হলো না অন্তর্ময় অবলোকন!

মেয়েটি জানতো
মাহফুজ আল-হোসেন

মেয়েটি জানতো

পলায়নপর ছেলেটা যতই সাঁতার জানুক

শত চেষ্টাতেও সে

অযুতবর্ষের রক্তদাগ মুছতে পারবেনা

বশংবদ জলধারায়;

মেয়েটা ডুবে যাওয়ার আগমুহূর্তে

কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেছিলো

অস্ফুট স্বরে;

সে হয়তো ভেবেছিলো,

ঐসব উৎপ্রেক্ষাহীন ধ্বনিসমুচ্চয়

ব্যক্তিগত বোধের নির্মিতি হিসেবে

জীবন্মৃতদের জাগিয়ে তুলবে

আরোপিত অনালোকে;

মেয়েটি কি জানতো-

আর কতো রক্ত,

আর কতো নিমজ্জন,

আর কতো ধ্বনিসমুচ্চয় সরব হলে-

বহতা ¯্রােতস্বিনীর গতিপথ পাল্টে যাবে,

মুকবধির মুক্তধারায়!

মেয়েটি জানতো...

প্রত্যয়
মঈনউদ্দিন মুনশী

শহীদ মিনারের রাস্তা ধরে যখন হেঁটে যাই,

বাতাসের হাত ধরি, যাতে ধুলো না ওড়ে।

মিনার থেকে জীবনের আলো উঠছে, দ্যাখো

আকাশ কি যে মধুর, তার আস্বাদ মনে লাগছে!

শহীদদের ফুটো হৃদয় বড় একাকী মনে হলো।

একটু পরে রাস্তার বাতিগুলো জীবন্ত হবে, টেলিভিশনে

আলোকিত হয়ে উঠবে নীল। চলে যেওনা যেন,

যে পর্যন্ত আকাশ রয়েছে সোনালি!

এই মই ধর যাতে আমি বেয়ে উপরে উঠতে পারি এবং

সবচেয়ে উঁচু ধাপ থেকে আলোর কণাগুলো হাতে নিয়ে

মিনারের চারদিকে মালার মতো পরাতে পারি।

দ্যাখো, এক একাকী নক্ষত্র প্রেমে ও নিঃসঙ্গতায়;

একাকী আমার দেশ: রক্তিম, উষ্ণ ও উজ্জ্বল।

প্রতিধ্বনি
শফিক ইমতিয়াজ

উইলিয়াম ব্লেক, আমি মুগ্ধ হয়ে পাঠ করি তোমার ‘নার্সেস সং’

সন্ধ্যা হয়েছে বলে নার্স ক্রীড়ারত শিশুদের বাড়ি ফিরতে বললে

তোমার শিশুরা বলে,

“No, no, let us play, fo it is yet day,...

Besides, in the sky the little birds fly...”

নার্স সহাস্যে ওদের খেলা চালিয়ে যেতে বললে শিশুদের কী উল্লাস-

“The little ones leaped and shouted and laughed,

And all the hills echoed”

ব্লেক, আমি পাঠক্লান্ত এক শিশুজন্ম তাকিয়ে দেখছি

অধরা ব্যাঙ্গচিত্র ও মায়াবী খেলায় নিমজ্জিত

ওরা বিকেল বা প্রায়সন্ধ্যা পাখি-কিচির চেনে না

খোলা প্রাঙ্গনে দেখেনি পশুবিচরণ

অসূয়া মারণাস্ত্রের কবলে কোথাও কী করুণ শিশুর জীবন!

আমি তো এমন কোনো পাহাড়গাত্র দেখি না

যাতে জলঢল শিশুদের আনন্দ প্রতিধ্বনিত হয়!

কোন দিকে যাই
আহমেদ ফরিদ

এসো সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে

আমাকে ডাকছে ¯্রষ্টার এক প্রতিনিধি

আমি মহান ¯্রষ্টার ডাকে সাড়া না দিয়ে

দাঁড়িয়ে আছি টিকাটুলির ভাঙা ব্রিজে

আমার এক পা ডানে যেতে চায় তো এক পা বামে

বামে তুমি রয়েছো, ডানে তাঁর ঘর

আমার দুপায়ের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে

ডান-বাম, বাম ডান

ধারালো সিাঁড়টিতে আমার পা কেটে রক্তাক্ত

আমি কোন দিকে যাব?

প্রার্থনালয়ের দিকে নাকি তোমার দিকে?

প্রথম, প্রথমতম
বায়েদ আকাশ

সারাংশ খুঁজে দেখি

পৃথিবীতে তোমার অনুপস্থিতি বলে কিছু নেই

আছে যা তা আপাত সত্য হাহাকার

এই সব হাহাকার নিয়ে

কত দিন বেঁচে থাকে মানুষ!

অথচ দেখো

তুমি আমি বেঁচে আছি মা

পৃথিবীর প্রথম প্রথমতম দীর্ঘ নিঃশ^াস

দূর শহরের কবিতা
মুজিব ইরম

ফুটেছে ম্যাগনোলিয়া বাগানে বাগানে

পরের শহরে...

ড্যাফোডিল এসেই যেন বলে গেলো যাই...

কাঠগোলাপের দিনে

চেরিফুল ফুটিবার দিনে

আমারে পাঠিও ডাক শিমুলে পলাশে...

তোমার শহরে আমি ফিরে যাবো একদিন

জারুল ফোটার দিনে

গেন্ডা ফুল ফুটিবার দিনে...

তুমিও থাকিও ভালা এই আমি বিনে

আমারে পাইবা তুমি পুষ্প ফোটা দিনে...

রক্তস্রোত
জুনান নাশিত

আমি তো ঘুমুতে চাই

হৃদয় কেন জেগে থাকে দিনরাত?

শঙ্খদিন ভেঙে ভেঙে যে

আড়ালটুকু চেয়েছে দু’হাত

সে কি পেয়েছে?

রক্ত ছাড়া মুক্তি নেই অথবা যুদ্ধজয়

ইতিহাস নড়ে ওঠে

লেখা হয় পুনর্বার

আমরাই লিখি

আবার হারাই

তাই রক্ত¯্রােত ফিরে আসে

জনপদে বারবার।

কোনো কোনো মরণ
রকিবুল হাসান

প্রমত্ত নদীও মরে যায় একদিন

একদিন এই দেহ মাটিতেই পচে যায়

পোকামাকড়েও খেয়ে যায়-

কিন্তু অন্ধকার ভেঙে আলোর গানের জন্ম

রক্তগঙ্গার গোঙানি

কোনোকালে এ সবের মরণ হয় না

এসব তো মরে গেলে জন্মহীন হয়ে ওঠে আত্মার স্মারক

গান-কবিতা থাকে না। থাকে না লালন।

রোদের মতোন চিকচিক করা মাঠভর্তি স্বপ্নও থাকে না

মাথা উঁচু করে নীল আকাশ দেখাও হয় না।

রাত্রির তীব্র যন্ত্রণা-মেরুদ- ভেঙে যাওয়া

ভয়াবহ বেদনায় কাতরানো সেই

রক্ত জবার মতোন জননীমুখশ্রী

বৃক্ষের ভরাট বুক থেকে ছিঁড়ে যায়

মাটির গভীরে গাঁথা নিজের শেকড়-

যেখানে তোমার শক্তি-

ওই টুকুনা থাকলে পাহাড় থাকে না

তুমিও থাকো না-ঝড় ওঠে ঝড় থামে-

মরণ খেলার পৃথিবীতে কখনো কখনো মৃত্যুও মরে না।

পুনর্জন্ম
মালেক মুস্তাকিম

প্রার্থনায় নত হলে তোমাকে পাই,

পাপে ও তাপে,

অর্দ্রতার কিনারে পাই ঘামের পালঙ্ক- অনিদ্রাসূচকে।

বাতাসে উড়ছে ভুল- বারান্দার ঝুল- গন্ধম সময়-

ধ্যান ভাঙলে একদিন ঈশ্বরের সাথে বদলে নেব

ঘুমের সেফটিপিন, জামার বোতাম-

পুনর্জন্ম হলে একবার প্রেমিক হবো-

হাওয়া বদলে গেলে যেমন

জোছনায় চোখ রেখে ঘুমঘোরে জেগে ওঠে কুমারী নদী,

মৃতের শহরে দেবদারু গাছ হয়ে ওঠে

প্রিয়তম পুরুষ।

কালপুরুষের ঘুম
সঞ্জয় দেওয়ান

হাওয়ার শরীরে বিষাদের শিস দেয় কামজ চড়–ই

হংসমিথুনের পরাবাস্তব গল্প লিখে দস্যু বাতাস

যাযাবর মন ভুলে যায় আগুনের নদী,

ঘাঁটের পুরাণ, মোহনার ঘূর্ণি।

পরিযায়ী রাতের ওম কেড়ে নেয়

আরটামিস এর সুখনিদ্রা!

ভোরের এলার্ম ভুলে যায় নিশিরাত;

কালপুরুষ ঘুমায় আজও বসন্তের স্বপ্ন ভুলে।

রাইন-আইজেল জলধারা
যাকিয়া সুমি সেতু

দেখ চেয়ে নবোদিত সূর্যের সোনারঙ ঘরে

আমি ধ্যানমগ্ন মর্মরিত ধ্রুপদী সুরের মোহনা

রাইন-আইজেলে যুগল ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস

আমি জলধারায় কুড়িয়েছি নীল

মুক্তো লবঙফুল কুঁড়িতে স্বতঃশ্চল ভালোবাসা

অরণ্য, পাহাড়ে সবুজ ফসল শিল্পকলা

নীল পাতার সিঁড়ি ভেঙে, গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ পেরিয়ে

-মেঘপুঞ্জের স্বপ্নে তুমি উঠে এসো

আরও উপরে শীর্ষ চূঁড়ায়- আরও একটু

যেখানে বিশ্বাসের শেকড় গভীর অতলান্ত

যেখানে গীতার সর্বজনবিদিত প্রতিধ্বনি:

“ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে”

এখানে কালের প্রবাহ আগ্নেয়গিরির ফুল

অপরাজিতায়-সূর্যাস্তের শতরূপ নিষ্কিঞ্চন

তুমি ওঠে এসো এখনি পৃথিবীর এই শিল্পে

এখানে শিশির বেদনা, চিরদিন হেমন্তে-

সমগ্র শক্তি, সমগ্রপ্রগতি প্রগাঢ় বিস্ময়ে

আকাশও জলের বৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে

দাঁড়িয়ে থাকে অনুনয় চাষাবাদে রূপকথা

অন্তর্লীন আঁচলে রাইন-আইজেল জলধারা

আমি মুছে দিয়েছি দ্বিধাবিভক্ত সব বিভাজন

মুছে দিয়েছি তোমার চোখে ব্রাত্য মেঘের রঙ

গ্রিমেলস ব্রেমেনে আজ পূর্ণিমা জল সারারাত

রাইন-আইজেলের শান্ত ঢেউও নক্ষত্র শিল্প

চলে এসো তুমি, চলে এসো এই আষাঢ় বুকে

আমি কোটি বছরের সূর্যপথ বসে আছি একা

বসে আছি নীলপাতার সিঁড়িতে ইকারুসের মতো...

রাফখাতা
মতিন রায়হান

মন এক রাফখাতা

যখন যা খুশি লিখে ফেলি, এঁকে ফেলি

সারাক্ষণ কাটাকুটি

কখন যে এঁকে ফেলি ঝুরিনামা বট

কখনোবা ভাসমান নৌকাটাকে তুলে দিই চরে

আবার নামিয়ে আনি থইথই জলে

জোয়ার আসুক বা না-আসুক!

ও প্রেম, তুমিও কি রাফখাতা?

ক্ষণে ক্ষণে আঁকিবুঁকি, মোছামুছি?

ও জীবন, তুমিও কি!

রোদ ও রাতের আখ্যান
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

রোদ ও রাতের বৈরিতা পর্বত ও পবনের চেয়ে কঠিন।

রোদে উবে যায় রাত আর রাতের বিস্তারে রোদ নির্বাসিত

তবু রোদ ও রাত জীবনকে যাপনের অনিবার্য অনুষঙ্গ

প্রাণ ও পৃথিবী রোদ ও রাতের মতোই প্রতিবাস্তব কুশীলব

প্রাণহীন পৃথিবী অকল্পনীয় আর প্রাণপ্রাচুর্যে পৃথিবী মরণাপন্ন

কল্প্য-অকল্প্য অগণন প্রতিবাস্তবতায় জীবন এগিয়ে যায় এভাবেই

এগিয়ে যাওয়াই সমৃদ্ধি আর জীবনের এগিয়ে যাওয়া মানে পরকালের নৈকট্য

প্রতিবাস্তবতাই অমোঘ জীবন, জীবন মানে প্রতিবাস্তবতা।

আজ যার কাছে অরুচিকর সে প্রতীক্ষায় থাকে আগামীর

অথচ আগামীকে কাছে পেলে আজকের কদর বেড়ে যায় আফসোসে

যেমন রোদতৃপ্ত মানুষ রাতের কুহকে পড়ে রোদকে নির্বাসিত করে

পরিণত রেণুকণা, তুমিও আজ প্রতিবাস্তবতার এক নির্মম শিকার।

ডুবমিলন
অরবিন্দ চক্রবর্তী

ঢেকে দেয়। জেগে ওঠে। স্বভাব এমন চাঁদমতো।

চাঁদ তবু সংযোগসূত্র; হাঁস ও গালগল্পের।

পুকুরের পক্ষে থাকি, পুকুর থাকে বিম্বের।

হাঁস যায় হাঁসের দিকে। হাঁসপাল স্মৃতি করে

শামুক। অর্থাৎ, জলের পর প্রতিবিম্ব।

হতে পারে খাচ্ছে; সে আসলে তিনিকে

পাহাড়-বৃক্ষ ছল্লিবল্লি কিংবা মাউথ অর্গান

তিনটি নদী। ইদানীং ওই তিনেক্কে এপিসোড

একটি কপাল কাটা দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে

সাদা পৃষ্ঠার আগ-পরে।

চৈতার বৌ গো
পিয়াস মজিদ

ভারী নাচ মাথায় জমেছে

নামাতে পারছি না কোনওমতে

জে কে রাউলিং দ্বীপ কিনে নিয়ে

পটারের পর পটার চলেছে লিখে

দুর্গম প্রেমে পা হড়কে

সহজে কিছু হলো না আমার

সোনার পদতলে

কুসুমের রক্ত ঢেলে

সমুদ্রের জীবনী

¯্রােতও জানে না জানি

সব তো চেনা শয়তানি

গানবিরহিত আমি;

তোমাকে ভেবেছি

ঘৃণায় গঠিত

অচিন রাগিণী

টুকরো কবিতা
মুশাররাত

হরিণের মতো

পিছন ফিরে চলতে গিয়ে

গন্তব্য ছোঁয়া হয়না চরণে আর

শেষ হয়না বাকি পথ

যেন ক্লান্তি নিয়ে প্রতি কদমে

টানছি বিষাদ পাহাড়।

ব্যস্ততার আগ্রাসনে

মৃত অভিমান

প্রতিশোধের প্রতিরোধও

এখন নিষ্প্রাণ।

মায়ার ঘ্রাণ একটু বেশিই ক্ষণস্থায়ী;

কাঠগোলাপও সারাটারাত গন্ধ ছড়ায়।

হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে লাস্যময়ী

যেমন মনে কাব্যরসের ছন্দ ঝরায়।

বেলা অবেলার গান
আহমদ জামাল জাফরী

আমাকে গ্রহণ করো ভরিয়ে দাও তৃষ্ণার এ ধূলিময় জীবন

অধিকারহীন ভগ্নাবশেষ তবু ফিরে এসো প্রাণপণ,

নিঃসঙ্গ বেদনাগুলো বাজে নিত্য সন্ধ্যা-রাত্রি, ভোরে;

সারা দিনমান উষ্ণ হাহাকার ডাকে ব্যাকুল স্বরে।

তুমি শুধু মিলাও দূরে ধূসর শূন্যের পথে

এই বিফলতা জীর্ণ করে অনন্ত বধির রথে,

সময়ের উত্তাপে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে অনন্ত বিষাদ

কোলাহল ও বিভ্রমে জেগে ওঠে কোমল নিষাদ,

করুণ অশ্বের মতো বেলা অবেলার এই ছায়া-প্রচ্ছায়ায়

শূন্যতা থেকে অনন্ত শূন্যতায় দিগি¦দিক মিশে যায়,

শূন্যপথে মিশে যাওয়া নিঃসঙ্গ হৃদয়ের এই গানে

অপেক্ষার সংরাগ বাজে দূরবর্তী আলোর প্রাণে,

অগ্নি ও দহনের প্রক্ষেপ নিয়ে আমার সকাল রাত্রি

হেঁটে যায় তোমার দিকেই বিষণœ পথের যাত্রী।

ব্যবচ্ছেদ
রওশন রুবী

কেন চলে যায় যারা এসেছিল রাত্রিকে ব্যবচ্ছেদ করতে!

সবে যে হয়েছে সাঁঝ, বাতির ওম রাত্রির দিকে খুব ধীর...

অসংখ্য বীণা, উদ্ধত অস্ত্র আর শাস্ত্রের সুর বিগলিত সময়,

অপেক্ষার দীর্ঘ-পথ গতিময়। একটাও পাতা খসে না,

পালক নড়ে না, সময় ছুটে যায়,

যারা এসেছিল এখন তাদের ছায়া গণআন্দোলনমুখী...

গ্যালাক্সিতে
তরুন ইউসুফ

এক সকালে আমার শিশুকন্যার সাধের পৃথিবীটা ভেঙে গেল।

আরেক সকালে আমরা ভাঙ্গা পৃথিবী ঠিক করব বলে এক অভিযানে বের হলাম

বেরিয়ে দেখি রাস্তা ফাঁকা। যারা পৃথিবী ঠিক করবে বলে কথা দিয়েছিল

তারা যেন বেমালুম উবে গেছে অথবা তাদের ঘুম এখনো ভাঙে নাই।

সেকথা আমার শিশুকন্যাকে জানাতেই বিষণœমুখে সে আমাকে বলল-

“বাবা তাহলে আমরা কীভাবে পৃথিবী ঠিক করব?”

আমি নিরুত্তর থেকে মনে মনে আওড়াই সে উত্তর আমার জানা নাই।

আমারা পৃথিবী না ঠিক করেই ফিরছি নতমুখে

আমাদের এক হাতে ভাঙা পৃথিবী আরেক হাতে শূন্যতা।

চিরন্তন মা-কে
বিপাশা মন্ডল

চুলার আগুনে রক্তিমাভ মুখ দেখে

পুনর্বার ভুল করে গেছি,

সাধারণেতর ঘামে কাঁচা মাটি ঘ্রাণ

হাঁটুতে ওঠানো শাড়ি বিস্ত্রস্ত আঁচল

পুরনো দৃশ্য প্রতিদিন একঘেয়ে ক্লান্তিকর

কলপাড়ে স্তূপীকৃত কাচা কাপড়ের ভিড়ে

এলোচুলে অসহ্য ধোপানি রাধিকা

অবজ্ঞায় প্রতিরাতে পাশ ফিরে শুই

অফিসফেরত কল্লোলিনী স্বরে থমকে দাঁড়াই

উঠানের কোনে শিশুকে দেখাও

নীড়ে ফেরা পাখি ডোবা সূর্য-তারা

হ্যাংলা যুবকদল গলিতে হেলানো

সাইকেল দেখে তোমাকে

আমিও তোমাকে দেখি অপ্সরা অনন্যা

লীলাহাস্য সুমধুরা চিরন্তণ মা-কে

শিক্ষক
মাশরুরা লাকী

আমার শিক্ষক আমারই বইগুলো

সে-ই সব লেখকও যে ছিলো গুরু

বই-জগতের পথচারী দূরগামী

সহজ নয় তো অনুসরণের ধারা

কোনো বইয়ে হর্ষিত হবে মন

ধরে রাখে রেশ কড়া চুম্বকে

সব পুঁথি ছাপ ফেলে না পাথরে

ভুলে গেছি বটে অসংখ্য বই-নাম

বয়সের ভাঁজে ভাঁজে

তবুও বই মাতৃদুগ্ধ বৈ নয়

পান করি প্রত্যহ মহাস্বাদে!

কেন অন্ধ কেন সে কাঙাল
হাসান হাফিজ

বিভ্রম বলেছি ওকে,ঠারেঠোরে ইঙ্গিতে বলেছি।

ভালোবাসা ভুল করে হুলস্থুল বাধালো কেন যে!

নিভৃতি সে ভালোই বাসে না, ইচ্ছা করে কাছেও আসে না,

প্রকাশিত হয় দ্রুত, নিন্দা হুল বুক পেতে নেয়

বিষও পান করে ফেলে আবেগের উষ্ণতাবশত

কী করে ঠেকাই বলো এরকম অনিদ্র পতন?

নিজে নিজে নিমজ্জিত ম্লান দুরাশায়

ভেসে উঠতে চাইলেও পারছে না,

তার জন্যে শঙ্কা ক্ষোভ আহা উহুঁ নাই

সেও কিন্তু বিভ্রমেরই আলোছায়া, মরীচিকা মায়া

চোরাগোপ্তা টালমাটাল আশনাই-

ভালোবাসা এত বেশি নির্লজ্জ কেন যে

ভালোবাসা এত অন্ধ সর্বনাশা দৈন্যে দেউলিয়া

মতিভ্রষ্ট কাঙালও কেন যে!

back to top