alt

ঈদ সংখ্যা ২০২৫

অন্তরীণ

মামুন মুস্তাফা

: শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

সবকিছু মুষড়ে পড়েছে। দিনের আলো যথেষ্ট। তবু অন্ধকার করে আসছে চারদিকে। অস্থিরতায় ভুগছেন লেখক শমসের কাহার। ‘কাহার’ শব্দটি কীভাবে এলো? আবার এই গবেষণা। নাম তো শমসের আলী। লেখক নামে একটু বৈচিত্র্য আনতেই ‘শমসের কাহার’। তবে এমনিতেই আসে নি। পূর্বপুরুষের পাঁচ/ছয় পূর্বতন স্তরে গিয়ে খোঁজ পাওয়া যায় একজন ‘কাহার’-এর। একেই পুঁজি করেছেন শমসের। কিন্তু এতে কি তার পাঠকপ্রিয়তা বেড়েছে খুব? কিংবা বইয়ের কাটতি...! এখন অন্য এক অস্থিরতা পেয়ে বসেছে শমসের কাহারকে।

চতুর্দিকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস। একদিকে বেগমপাড়া তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি- বাজারদর সাধারণের নাগালের বাইরে। এই তো সেদিন এক পাবলিশিং হাউজে কর্মরত সামান্য সহযোগী সম্পাদক বলছিলেন, এতদিন টেনেহিঁচড়ে চালাতাম। এখন আর পারছি না। বাড়তি আয়েরও কোনো সুযোগ হয়ে উঠছে না। এতসব অন্ধকারের ভেতরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে নাগরিক জীবন। কথিত ফাইভ-জির ইন্টারনেট ডাউন হতে হতে এখন অচল প্রায়। কী হচ্ছে দেশে এসব?

শমসের কাহার নতুন গল্পের সূচনা করতে গিয়েও ধুঁকছেন। হঠাৎই কলিংবেলের শব্দ। ঘড়ির দিকে তাকান শমসের কাহার। বেলা ১২টায় আবার কে এলো? অনেকটাই বিরক্ত সহকারে দরজা খোলেন শমসের। লাউ-চিংড়ি আর কালিজিরা ভর্তা নিয়ে এসেছেন প্রতিবেশী মোমেনা বেগম।

- ভাই, ভাবি নাই, আপনি কি খাচ্ছেন, কিছু বলেনও না। দুপুরে খাবেন। কথাগুলো বলতে বলতে নিজেই ডাইনিং টেবিলে তরকারির বাটি রাখেন। আবারও বলেন, ভাবি আসবেন কবে?

কথা বলতে ভালো লাগছে না শমসের কাহারের। মাথার ভেতরে নতুন গল্পের প্লট গুবলেট পাকাচ্ছে। তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে হয়, কিছুদিন দেরি হবে। ওর বাবার খুব অসুখ। হাসপাতালে আছেন।

মোমেনা বেগম শমসের কাহারের লেখার ভক্ত। শমসেরের সব বই মোমেনার সংগ্রহে আছে। এক একটি গল্পের বই পড়েন আর তা নিয়ে আলোচনা করতে মাঝে মাঝেই চলে আসেন শমসের কাহারের কাছে। যাবার সময় মোমেনা বলেন, ভাই আজ সন্ধ্যায় কিন্তু আসছি। আপনার ‘কুড়াল’ গল্প নিয়ে কথা আছে।

- সন্ধ্যায় থাকব কিনা বলতে পারছি না। মিথ্যাই বললো শমসের। কোথাও তার যাবার ইচ্ছা নেই। আবার এই মহিলার সঙ্গে পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটতেও মন সায় দিচ্ছে না।

মোমেনা বলে, ঠিক আছে, আপনি বাইরে থেকে এলেই না হয় আসবো।

মোমেনার চলে যাবার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শমসের কাহার। দরজা আটকাতে যেন ভুলেই গেছেন তিনি। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পান। দরজা লাগিয়ে আবার নতুন গল্পের ভেতরে বুঁদ হতে চাইলেন। কিছুতেই মেলাতে পারছেন না শেষ এবং শুরুটা। শুরুটা ঠিক করলে শেষটা যুৎসই হচ্ছে না। আবার শেষটা মনমতো হলে শুরুটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

শমসের কাহারের এমনটা হয়নি কখনো। আজ নতুন উৎপাত দেখা দিয়েছে সমস্ত চিন্তাজুড়ে। আরও বেশি বিগড়ে গেছে ১ পোয়া কাঁচামরিচ যখন ১০০ টাকা দিয়ে কিনতে হলো। সামান্য লতির কেজি ৮০ টাকা! যা বাংলার খালপাড়, মাঠেঘাটে এমনিতেই হয়ে থাকে। তবু একদল বলছে উন্নয়ন, আর সামষ্টিকের জীবন-জগতজুড়ে নামছে অদ্ভুত অন্ধকার। লেখকরা প্রেমের গল্প লিখছেন। কীভাবে? ভেবে পান না শমসের কাহার।

লেখক শমসের তোমার দৌড় কতদূর...? আজ জানা হয়ে গেল। খুব বড়াই করতে তুমি জীবনের গল্প লেখো। নি¤œবিত্তের হাহাকার, যন্ত্রণা। কই, এখন তো পারছ না। গল্পের সূত্রপাতই ঘটাতে পারলে না এখনো!

মনে মনে ধিক্কার জানান শমসের নিজেকে। মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে অদিতি। শমসের কাহারের বউ। এখন সে পঞ্চগড়ে, শেষ সীমানায়, তেঁতুলিয়া। বাবার অসুখের খবর শুনে গিয়েছেন। নিঃসন্তান ৪৫ বছরের শমসের কাহার এখন একা ঢাকা নগরীতে। বউকে খুশি করতেই হাসিমুখে কথা বলেন শমসের। অথচ এই হাসিমুখ সম্পূর্ণই ছিল মেকি। মানুষ, প্রাণি, প্রকৃতি- সবকিছু এখন তার কাছে অসহ্য। জীবনটা কেমন জড় হয়ে উঠছে তার। কলমের নিব ভেঙে যাচ্ছে, আঙুলের নখ ছিঁড়ে নিচ্ছে দাঁতে; তবু নতুন গল্পের অক্ষর ওলটপালট- সাজানো যাচ্ছে না কিছুতেই।

পরক্ষণেই ভাবেন শমসের কাহার। মোমেনা বেগমকে তিনি মিথ্যা বলেছেন, সন্ধ্যায় থাকবেন না বাসায়। আবার স্ত্রী অদিতির সঙ্গে মিথ্যে আনন্দের ভান নিয়ে কথা বললেন- স্ত্রীকে খুশি করতে। এসব মিথ্যার ওপরেই তো জীবন গড়া। এই যে মিথ্যার ছলচাতুরি ব্যক্তি থেকে দেশ, দেশ থেকে সমগ্র ধরাধামে। এভাবেই শুরু করা যাক তার নতুন গল্পের সূচনা। শমসের কাহারের চোখ চিকচিক করে ওঠে নতুন গল্পের অভিমুখে।

খুব সাধ্য-সাধনা আর কসরতের পরে এক পাতা লিখতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মোমেনা বেগমের লাউ-চিংড়ি আর কালিজিরা ভর্তা খাওয়া হয়ে ওঠেনি। সারাদিনের ধকল দূর করতে শমসের শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢোকেন। প্রায় ৪৫ মিনিট বাথরুমে কাটিয়ে খাবার টেবিলে বসেন। মোমেনা বেগমের খাবার খেতে খেতে অনুভব করেন ভদ্রমহিলা ভালোই রাঁধেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অদিতির থেকেও ভালো। কিন্তু একথা অদিতিকে বলা যাবে না। নিঃসন্তান জীবনের অগ্নি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পরিণত হবে।

আবারও দরজায় কলিংবেল। তিন-চারবার কলিংবেলের পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজা খোলেন শমসের কাহার। সামনে দাঁড়িয়ে মোমেনা বেগম। তার হাতে ‘মাটির গল্প’- শমসের কাহারের গল্পের বই। শুকনো কাষ্ঠ হাসি দেয় শমসের, বলেন, এইমাত্র দুপুরের খাবার খেলাম, তাই বাইরের প্রোগ্রামটা বাতিল করতে হলো।

ঘরে প্রবেশ করে মোমেনা বেগম বলেন, ভালোই হলো। প্রিয় লেখকের সান্নিধ্য আমার বড়ো প্রাপ্তি। মুখোমুখি বসে তার গল্পের আলোচনা শোনার সৌভাগ্য কতজন পাঠক পায় বলুন তো?

প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেন না মোমেনা। সোজা রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে থাকেন। বলেন, আপনি বসুন। দু-কাপ চা বানিয়ে আনি। নিশ্চয়ই ভাবি আপনাকে চা খাওয়াত এ-সময়।

মোমেনার দৃষ্টিতে কৌতুকপূর্ণ হাসি। ইতস্তত বোধ করেন শমসের। মোমেনা কি খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন? দেশ-বিদেশের গল্পে লেখক-পাঠিকার নানা মিথস্ক্রিয়া দেখেছেন শমসের কাহার। তার এই মধ্য-জীবনে তারুণ্য পেরুনো যৌবনদীপ্ত মহিলা মোমেনার এই সাগ্রহ কোনো পরকীয়ার জন্ম দিচ্ছে না তো? একটা ঘোরলাগা সময়ের মধ্যে বন্দি হয়ে যান শমসের। এখানে আসা অবধি শমসের মোমেনার স্বামীকে দেখেন নি। এখানে মানে এই তরুলতা বাড়িটির ৪র্থ তলার তিনটি ফ্ল্যাটের একটিতে থাকেন শমসের কাহার। আরেকটিতে মোমেনা বেগম। অন্যটিতে একজন ব্যাংকার, সুভদ্র সেন। এরা তিনজনই এই তিনটি ফ্ল্যাটের মালিক।

ক্লাস সিক্সে পড়া ১১/১২ বছরের এক ছেলেকে নিয়ে মোমেনার সংসার। মোমেনা একটি মাল্টি ন্যাশনাল এনজিওতে কাজ করেন। প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর। বিশেষত নারীদের সামাজিক অবস্থা ও অবস্থানকে সুসংহত করতে তাকে সমাজের নানা স্তরে এডভোকেসি কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয়। শমসের এখানে আসার পর থেকে প্রিয় লেখকের সান্নিধ্যে আসার একটা উন্মাদনা কাজ করে যেন মোমেনার ভেতরে। লক্ষ করেন শমসের কাহার। অবশ্য এটি প্রথম টের পান শমসেরের স্ত্রী অদিতি। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে খুনসুটিও হয় বেশ। তবে নিঃসঙ্গ জীবনেও নিঃসন্তান অদিতির স্বামীর প্রতি রয়েছে অগাধ আস্থা। শমসের নিজের ভেতরেই কুণ্ঠিত হন। অদিতির আস্থার সুযোগ নিচ্ছে না তো সে!

চায়ের কাপে চিনি গুলানোর শব্দে ঘোর কাটে শমসেরের। দু-কাপ নিয়ে দুজনে বসেন মুখোমুখি। মোমেনাই নীরবতা ভাঙেন, আপনার মাটির গল্পের সবকটিতেই এক অসহায় জীবনের ক্রন্দন ধ্বনিত হয়েছে। ধুঁকে ধুঁকে যাদের জীবন চলে- সেইসব মানুষদের রেসে পাওয়া জীবনচক্র আপনি ঘেঁটেছেন খুব। কেন?

- আপনি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন?

- সাক্ষাৎকার না, জানার আগ্রহ থেকে জিজ্ঞাসা।

- ওইসব রেসে পাওয়া জীবনের আমিও তো একজন। বলেন শমসের কাহার।

- উহুঁ... উহুঁ...। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উচ্চারণ করেন মোমেনা বেগম। বলে চলেন, ‘কুড়াল’ গল্পের ভেতরে- “গাছের গুড়ি দ্বিখ-িত করতে করতে রহমত আবিষ্কার করে তার জীবনও গাছের গুঁড়ির মতনই ভঙ্গুর। যেন সে কুড়াল দিয়ে তার বক্ষই বিদীর্ণ করছে। ঘরে বউয়ের অসুখ, পাঠশালায় বকেয়া বেতনের কারণে মেয়ে জরিনার যাওয়া বন্ধ। ১৩/১৪ বছরের ছেলে আব্দুল্লাহকে রাজমিস্ত্রির জোগালে পাঠাতে হয় বাড়তি আয়ের কারণে। কুড়ালের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে প্রহর ভাগ হতে হতে যে নতুন সকালের আলো ফোটে; সেই রক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে রহমতের ঘরদোর। তবে কী আরও এক সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে রহমতকে...”। আপনার এই যে বয়ান- হৃদয় ছোঁয়, কিন্তু সমাধান দেয় না। ‘লাল বাক্স’, ‘নিশানা’- এসব গল্পে নিচুতলার মানুষগুলোর সমাধান আপনি দিতে পারেন নি। অথচ তাদের জীবচক্রকে তুলে এনেছেন খুব গভীরভাবে। এখানেই আপনার কৃতিত্ব।

মুখ টিপে হাসতে থাকেন শমসের কাহার। বলেন, আপনি লিখুন। সমালোচনা সাহিত্য খুব ভালো লিখবেন। আমি কাগজে ছাপিয়ে দিব।

- আপনি কিন্তু আমার জিজ্ঞাসাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন।

- মোটেই না। ওটুকুই আমার সামর্থ্য।

- কিন্তু ওই মানুষগুলোরও তো প্রেম আছে। সেই প্রেমকে আপনি উপেক্ষা করছেন কেন?

- প্রেম! আশ্চর্য হয় শমসের কাহার।

- হ্যাঁ প্রেম। একটু থেমে আবারও বলেন মোমেনা, ব্যক্তি মানুষের প্রেমের ভেতরেই যাপিত জীবনের যন্ত্রণা বহুগুণ তার পরিপাশর্^কে ছোঁয়, তার মনস্তত্ত্বকে ছোঁয়। কেন আপনি শুধু মানুষের আর্থসামাজিক আর রাজনীতিটাকে বড় করে দেখছেন?

শমসের নিরুত্তর। মাথা নিচু করে ঠা-া চায়েই চুমুক দেয়। এরপর মাথা তুলে মোমেনার চোখের দিকে তাকায়। ওই চোখের ভাষা পড়তে চায় সে। কোন প্রেমের কথা বলতে চায় মোমেনা?

মোমেনা বলে চলে, কোনো এক অপূর্ণতার মধ্য দিয়ে ক্রমশ গড়ে ওঠা অবিশ^াস একটি সুখময় দাম্পত্যকে পতনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারে, আপনি জানেন?

হতচকিত হন লেখক শমসের কাহার। এই সুভদ্র, স্মার্ট পাঠিকা কী বলতে চায়? এর পরে মোমেনা বেগম যা বললেন তার জন্যে শমসের প্রস্তুত ছিলেন না।

- আপনি নিঃসন্তান। একটা খেদ তো মনের ভেতরে আছেই- আপনার, ভাবির। অস্বীকার করা তো যাবে না। তার ভেতরে যদি কোনো তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ হয়, ধরুন এই আমি। লেখকের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে তার এত কাছে আসা। ভাবির অনুপস্থিতিতে দুপুরের খাবার দেয়া, সন্ধ্যার চা- সন্দেহ হবে না জনে জনে। পাঁচজনের কানাঘুষা সন্দেহের বীজ বপন করবে না ভাবির মনে? তখনই তো দাম্পত্যর টানাপোড়েন।

কেমন অস্বস্তি বোধ করেন শমসের কাহার। মুখম-লে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মেয়েরা যত সহজে ঘটনার গভীর অনুসন্ধান করতে পারে, ছেলেরা বোধ হয় পিছিয়েই থাকে। এমন করে তো ভাবেননি কখনো লেখক শমসের। মোমেনা বেগম, কতই-বা বয়স- ৩৬/৩৭, এর বেশি নয়। জীবনকে দেখছে খুব নিবিড় করে। শমসেরের লেখার শক্তি হয়ে উঠছে সে ক্রমশ। শমসের কি তবে মোমেনা বেগমের কাছে গল্পের উৎস সন্ধান করবে? ধরা দেবে তার নিবিড় সান্নিধ্যে? মোমেনা বেগম বলে চলেন...

-ধরুন না কেন, একজন শিক্ষিত রমণী যে কিনা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। বেসরকারি চাকরির প্রতিদিনের নানা ঝক্কি সামলিয়ে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। তবু সেই রাতে ফিরে এক হাতে সংসারের সব ঝামেলা মিটানো। অথচ সন্দেহপ্রবণ স্বামী দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। স্ত্রীকে অবিশ^াস করতে থাকে। তারপর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ডিভোর্স নয়, সেপারেশন। কী মর্মান্তিক, না?

কোনো কথা সরে না লেখক শমসেরের মুখে। মোমেনা তার নিজের জীবনের গল্প বলে গেলেন সুচতুরভাবে। শমসের কাহার নিজের জীবনের সঙ্গে মোমেনাকে মেলাতে থাকে। মোমেনার দুঃখ খুব কি বেশি? সন্তান না থাকার যন্ত্রণা থেকেও? উত্তরগুলো এলোমেলো হয়ে যায়।

মোমেনা আবারও বলেন, এইসব মধ্যবিত্তের ছোটোখাটো দুঃখকথা কেন লিখছেন না। আপনার লেখনীশক্তি একঘেয়ে হয়ে উঠছে শমসের কাহার। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র- সবক্ষেত্রেই মধ্যবিত্তের যন্ত্রণা বড় বেশি মর্মভেদী। আপনি লিখুন সেই কথা। মধ্যবিত্তের এক অন্তরীণ জীবনের কথা।

শমসের হঠাৎ মাথা দোলায়। এরপরই বাঁ চোখ ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে কচলাতে থাকে। মোমেনা বলে, কী হলো?

- চোখে কিছু পড়েছে বোধ হয়।

- দেখি, দেখি। বলে মোমেনা এলইডি টিউবলাইটের দিকে শমসেরের বাঁ চোখ নিয়ে খুব গভীর মনোনিবেশ করেন। আর ডান চোখে মোমেনাকে দেখতে থাকেন শমসের কাহার। এক সন্তানের জননী, ভরা যৌবন। সৌন্দর্য এখনও অটুট। ¯িœগ্ধ কোমল এক কান্তিময় দ্যুতি ছড়াচ্ছে মোমেনার শরীর। অবশেষে কিছু না পেয়ে মোমেনা মুখ গোল করে ফুঁ দেন শমসেরের বাঁ চোখে। এই ফুঁয়ের ভেতরেই শমসের নিজেকে মোমেনার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বেসিনে গিয়ে চোখে পানির ঝাপটা দেয়। মোমেনাকে কিছুতেই সে অদিতি হতে দেবে না। ঘোর ভাঙে দুজনেরই।

- কিছু মনে করবেন না। অমন কাতরাচ্ছিলেন, তাই...

মোমেনার কথা কেড়ে নিয়ে শমসের কাহার বলেন, না, অদিতিকে আমি হারতে দিতে পারি না। আমার নিঃস্ব জীবনে সেই আমার লেখার শক্তি। আর মোমেনা বেগম তুমি আমার অনুরক্ত পাঠিকামাত্র, যে নতুন ভাবনার গল্প নিয়ে হাজির হয় বারবার।

মোমেনা হেসে দেয়। আপনার কণ্ঠে ‘তুমি’ ডাকটা অনেক মধুর লাগল। হতচকিত শমসের অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, মাফ করবেন।

- থাক না ‘তুমি’ সম্বোধন। এই দুই অক্ষরের শব্দ দিয়েই যশস্বী গল্পকার শমসের কাহার লিখল না হয় মোমেনা বেগমের মতো অসহায় মধ্যবিত্তের সংগ্রামরত জীবনের অন্তরীণ কথা।

মোমেনা চলে যাবার পর ঘরে অদিতির স্পর্শ অনুভব করেন শমশের কাহার। সে ছিল সময়ের ঘোরলাগা চমক। কিন্তু এরপর থেকে মোমেনার আর দেখা নেই। শমসের কাহারও আর খোঁজেননি তাকে। কিন্তু অদিতির মধ্যে মাঝে মাঝেই যেন মোমেনা উঁকি দেয়। তাকে প্রশ্রয় দেয় না শমসের কাহার। কেননা তার জীবনে অদিতিকে সে হারতে দেবে না কখনো। শূন্য শমসের আলীকে লেখক শমসের কাহারে পরিণত করতে অদিতির আত্মত্যাগ তো কম নয়! অথচ যে গল্পের সূচনা তিনি সারাদিন ধরে করেছিলেন, মোমেনা তার সমাপ্তির গতিপথ তৈরি করে দিয়েছে। মধ্যবিত্তের দাম্পত্যজীবনের মিঠেকড়া- সেই প্রেমের উপাখ্যান। শমসের কাহারের সামনে এখন এক নতুন লেখক।

tab

ঈদ সংখ্যা ২০২৫

অন্তরীণ

মামুন মুস্তাফা

শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

সবকিছু মুষড়ে পড়েছে। দিনের আলো যথেষ্ট। তবু অন্ধকার করে আসছে চারদিকে। অস্থিরতায় ভুগছেন লেখক শমসের কাহার। ‘কাহার’ শব্দটি কীভাবে এলো? আবার এই গবেষণা। নাম তো শমসের আলী। লেখক নামে একটু বৈচিত্র্য আনতেই ‘শমসের কাহার’। তবে এমনিতেই আসে নি। পূর্বপুরুষের পাঁচ/ছয় পূর্বতন স্তরে গিয়ে খোঁজ পাওয়া যায় একজন ‘কাহার’-এর। একেই পুঁজি করেছেন শমসের। কিন্তু এতে কি তার পাঠকপ্রিয়তা বেড়েছে খুব? কিংবা বইয়ের কাটতি...! এখন অন্য এক অস্থিরতা পেয়ে বসেছে শমসের কাহারকে।

চতুর্দিকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস। একদিকে বেগমপাড়া তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি- বাজারদর সাধারণের নাগালের বাইরে। এই তো সেদিন এক পাবলিশিং হাউজে কর্মরত সামান্য সহযোগী সম্পাদক বলছিলেন, এতদিন টেনেহিঁচড়ে চালাতাম। এখন আর পারছি না। বাড়তি আয়েরও কোনো সুযোগ হয়ে উঠছে না। এতসব অন্ধকারের ভেতরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে নাগরিক জীবন। কথিত ফাইভ-জির ইন্টারনেট ডাউন হতে হতে এখন অচল প্রায়। কী হচ্ছে দেশে এসব?

শমসের কাহার নতুন গল্পের সূচনা করতে গিয়েও ধুঁকছেন। হঠাৎই কলিংবেলের শব্দ। ঘড়ির দিকে তাকান শমসের কাহার। বেলা ১২টায় আবার কে এলো? অনেকটাই বিরক্ত সহকারে দরজা খোলেন শমসের। লাউ-চিংড়ি আর কালিজিরা ভর্তা নিয়ে এসেছেন প্রতিবেশী মোমেনা বেগম।

- ভাই, ভাবি নাই, আপনি কি খাচ্ছেন, কিছু বলেনও না। দুপুরে খাবেন। কথাগুলো বলতে বলতে নিজেই ডাইনিং টেবিলে তরকারির বাটি রাখেন। আবারও বলেন, ভাবি আসবেন কবে?

কথা বলতে ভালো লাগছে না শমসের কাহারের। মাথার ভেতরে নতুন গল্পের প্লট গুবলেট পাকাচ্ছে। তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে হয়, কিছুদিন দেরি হবে। ওর বাবার খুব অসুখ। হাসপাতালে আছেন।

মোমেনা বেগম শমসের কাহারের লেখার ভক্ত। শমসেরের সব বই মোমেনার সংগ্রহে আছে। এক একটি গল্পের বই পড়েন আর তা নিয়ে আলোচনা করতে মাঝে মাঝেই চলে আসেন শমসের কাহারের কাছে। যাবার সময় মোমেনা বলেন, ভাই আজ সন্ধ্যায় কিন্তু আসছি। আপনার ‘কুড়াল’ গল্প নিয়ে কথা আছে।

- সন্ধ্যায় থাকব কিনা বলতে পারছি না। মিথ্যাই বললো শমসের। কোথাও তার যাবার ইচ্ছা নেই। আবার এই মহিলার সঙ্গে পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটতেও মন সায় দিচ্ছে না।

মোমেনা বলে, ঠিক আছে, আপনি বাইরে থেকে এলেই না হয় আসবো।

মোমেনার চলে যাবার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শমসের কাহার। দরজা আটকাতে যেন ভুলেই গেছেন তিনি। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পান। দরজা লাগিয়ে আবার নতুন গল্পের ভেতরে বুঁদ হতে চাইলেন। কিছুতেই মেলাতে পারছেন না শেষ এবং শুরুটা। শুরুটা ঠিক করলে শেষটা যুৎসই হচ্ছে না। আবার শেষটা মনমতো হলে শুরুটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

শমসের কাহারের এমনটা হয়নি কখনো। আজ নতুন উৎপাত দেখা দিয়েছে সমস্ত চিন্তাজুড়ে। আরও বেশি বিগড়ে গেছে ১ পোয়া কাঁচামরিচ যখন ১০০ টাকা দিয়ে কিনতে হলো। সামান্য লতির কেজি ৮০ টাকা! যা বাংলার খালপাড়, মাঠেঘাটে এমনিতেই হয়ে থাকে। তবু একদল বলছে উন্নয়ন, আর সামষ্টিকের জীবন-জগতজুড়ে নামছে অদ্ভুত অন্ধকার। লেখকরা প্রেমের গল্প লিখছেন। কীভাবে? ভেবে পান না শমসের কাহার।

লেখক শমসের তোমার দৌড় কতদূর...? আজ জানা হয়ে গেল। খুব বড়াই করতে তুমি জীবনের গল্প লেখো। নি¤œবিত্তের হাহাকার, যন্ত্রণা। কই, এখন তো পারছ না। গল্পের সূত্রপাতই ঘটাতে পারলে না এখনো!

মনে মনে ধিক্কার জানান শমসের নিজেকে। মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে অদিতি। শমসের কাহারের বউ। এখন সে পঞ্চগড়ে, শেষ সীমানায়, তেঁতুলিয়া। বাবার অসুখের খবর শুনে গিয়েছেন। নিঃসন্তান ৪৫ বছরের শমসের কাহার এখন একা ঢাকা নগরীতে। বউকে খুশি করতেই হাসিমুখে কথা বলেন শমসের। অথচ এই হাসিমুখ সম্পূর্ণই ছিল মেকি। মানুষ, প্রাণি, প্রকৃতি- সবকিছু এখন তার কাছে অসহ্য। জীবনটা কেমন জড় হয়ে উঠছে তার। কলমের নিব ভেঙে যাচ্ছে, আঙুলের নখ ছিঁড়ে নিচ্ছে দাঁতে; তবু নতুন গল্পের অক্ষর ওলটপালট- সাজানো যাচ্ছে না কিছুতেই।

পরক্ষণেই ভাবেন শমসের কাহার। মোমেনা বেগমকে তিনি মিথ্যা বলেছেন, সন্ধ্যায় থাকবেন না বাসায়। আবার স্ত্রী অদিতির সঙ্গে মিথ্যে আনন্দের ভান নিয়ে কথা বললেন- স্ত্রীকে খুশি করতে। এসব মিথ্যার ওপরেই তো জীবন গড়া। এই যে মিথ্যার ছলচাতুরি ব্যক্তি থেকে দেশ, দেশ থেকে সমগ্র ধরাধামে। এভাবেই শুরু করা যাক তার নতুন গল্পের সূচনা। শমসের কাহারের চোখ চিকচিক করে ওঠে নতুন গল্পের অভিমুখে।

খুব সাধ্য-সাধনা আর কসরতের পরে এক পাতা লিখতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মোমেনা বেগমের লাউ-চিংড়ি আর কালিজিরা ভর্তা খাওয়া হয়ে ওঠেনি। সারাদিনের ধকল দূর করতে শমসের শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢোকেন। প্রায় ৪৫ মিনিট বাথরুমে কাটিয়ে খাবার টেবিলে বসেন। মোমেনা বেগমের খাবার খেতে খেতে অনুভব করেন ভদ্রমহিলা ভালোই রাঁধেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অদিতির থেকেও ভালো। কিন্তু একথা অদিতিকে বলা যাবে না। নিঃসন্তান জীবনের অগ্নি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পরিণত হবে।

আবারও দরজায় কলিংবেল। তিন-চারবার কলিংবেলের পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজা খোলেন শমসের কাহার। সামনে দাঁড়িয়ে মোমেনা বেগম। তার হাতে ‘মাটির গল্প’- শমসের কাহারের গল্পের বই। শুকনো কাষ্ঠ হাসি দেয় শমসের, বলেন, এইমাত্র দুপুরের খাবার খেলাম, তাই বাইরের প্রোগ্রামটা বাতিল করতে হলো।

ঘরে প্রবেশ করে মোমেনা বেগম বলেন, ভালোই হলো। প্রিয় লেখকের সান্নিধ্য আমার বড়ো প্রাপ্তি। মুখোমুখি বসে তার গল্পের আলোচনা শোনার সৌভাগ্য কতজন পাঠক পায় বলুন তো?

প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেন না মোমেনা। সোজা রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে থাকেন। বলেন, আপনি বসুন। দু-কাপ চা বানিয়ে আনি। নিশ্চয়ই ভাবি আপনাকে চা খাওয়াত এ-সময়।

মোমেনার দৃষ্টিতে কৌতুকপূর্ণ হাসি। ইতস্তত বোধ করেন শমসের। মোমেনা কি খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন? দেশ-বিদেশের গল্পে লেখক-পাঠিকার নানা মিথস্ক্রিয়া দেখেছেন শমসের কাহার। তার এই মধ্য-জীবনে তারুণ্য পেরুনো যৌবনদীপ্ত মহিলা মোমেনার এই সাগ্রহ কোনো পরকীয়ার জন্ম দিচ্ছে না তো? একটা ঘোরলাগা সময়ের মধ্যে বন্দি হয়ে যান শমসের। এখানে আসা অবধি শমসের মোমেনার স্বামীকে দেখেন নি। এখানে মানে এই তরুলতা বাড়িটির ৪র্থ তলার তিনটি ফ্ল্যাটের একটিতে থাকেন শমসের কাহার। আরেকটিতে মোমেনা বেগম। অন্যটিতে একজন ব্যাংকার, সুভদ্র সেন। এরা তিনজনই এই তিনটি ফ্ল্যাটের মালিক।

ক্লাস সিক্সে পড়া ১১/১২ বছরের এক ছেলেকে নিয়ে মোমেনার সংসার। মোমেনা একটি মাল্টি ন্যাশনাল এনজিওতে কাজ করেন। প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর। বিশেষত নারীদের সামাজিক অবস্থা ও অবস্থানকে সুসংহত করতে তাকে সমাজের নানা স্তরে এডভোকেসি কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয়। শমসের এখানে আসার পর থেকে প্রিয় লেখকের সান্নিধ্যে আসার একটা উন্মাদনা কাজ করে যেন মোমেনার ভেতরে। লক্ষ করেন শমসের কাহার। অবশ্য এটি প্রথম টের পান শমসেরের স্ত্রী অদিতি। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে খুনসুটিও হয় বেশ। তবে নিঃসঙ্গ জীবনেও নিঃসন্তান অদিতির স্বামীর প্রতি রয়েছে অগাধ আস্থা। শমসের নিজের ভেতরেই কুণ্ঠিত হন। অদিতির আস্থার সুযোগ নিচ্ছে না তো সে!

চায়ের কাপে চিনি গুলানোর শব্দে ঘোর কাটে শমসেরের। দু-কাপ নিয়ে দুজনে বসেন মুখোমুখি। মোমেনাই নীরবতা ভাঙেন, আপনার মাটির গল্পের সবকটিতেই এক অসহায় জীবনের ক্রন্দন ধ্বনিত হয়েছে। ধুঁকে ধুঁকে যাদের জীবন চলে- সেইসব মানুষদের রেসে পাওয়া জীবনচক্র আপনি ঘেঁটেছেন খুব। কেন?

- আপনি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন?

- সাক্ষাৎকার না, জানার আগ্রহ থেকে জিজ্ঞাসা।

- ওইসব রেসে পাওয়া জীবনের আমিও তো একজন। বলেন শমসের কাহার।

- উহুঁ... উহুঁ...। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উচ্চারণ করেন মোমেনা বেগম। বলে চলেন, ‘কুড়াল’ গল্পের ভেতরে- “গাছের গুড়ি দ্বিখ-িত করতে করতে রহমত আবিষ্কার করে তার জীবনও গাছের গুঁড়ির মতনই ভঙ্গুর। যেন সে কুড়াল দিয়ে তার বক্ষই বিদীর্ণ করছে। ঘরে বউয়ের অসুখ, পাঠশালায় বকেয়া বেতনের কারণে মেয়ে জরিনার যাওয়া বন্ধ। ১৩/১৪ বছরের ছেলে আব্দুল্লাহকে রাজমিস্ত্রির জোগালে পাঠাতে হয় বাড়তি আয়ের কারণে। কুড়ালের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে প্রহর ভাগ হতে হতে যে নতুন সকালের আলো ফোটে; সেই রক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে রহমতের ঘরদোর। তবে কী আরও এক সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে রহমতকে...”। আপনার এই যে বয়ান- হৃদয় ছোঁয়, কিন্তু সমাধান দেয় না। ‘লাল বাক্স’, ‘নিশানা’- এসব গল্পে নিচুতলার মানুষগুলোর সমাধান আপনি দিতে পারেন নি। অথচ তাদের জীবচক্রকে তুলে এনেছেন খুব গভীরভাবে। এখানেই আপনার কৃতিত্ব।

মুখ টিপে হাসতে থাকেন শমসের কাহার। বলেন, আপনি লিখুন। সমালোচনা সাহিত্য খুব ভালো লিখবেন। আমি কাগজে ছাপিয়ে দিব।

- আপনি কিন্তু আমার জিজ্ঞাসাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন।

- মোটেই না। ওটুকুই আমার সামর্থ্য।

- কিন্তু ওই মানুষগুলোরও তো প্রেম আছে। সেই প্রেমকে আপনি উপেক্ষা করছেন কেন?

- প্রেম! আশ্চর্য হয় শমসের কাহার।

- হ্যাঁ প্রেম। একটু থেমে আবারও বলেন মোমেনা, ব্যক্তি মানুষের প্রেমের ভেতরেই যাপিত জীবনের যন্ত্রণা বহুগুণ তার পরিপাশর্^কে ছোঁয়, তার মনস্তত্ত্বকে ছোঁয়। কেন আপনি শুধু মানুষের আর্থসামাজিক আর রাজনীতিটাকে বড় করে দেখছেন?

শমসের নিরুত্তর। মাথা নিচু করে ঠা-া চায়েই চুমুক দেয়। এরপর মাথা তুলে মোমেনার চোখের দিকে তাকায়। ওই চোখের ভাষা পড়তে চায় সে। কোন প্রেমের কথা বলতে চায় মোমেনা?

মোমেনা বলে চলে, কোনো এক অপূর্ণতার মধ্য দিয়ে ক্রমশ গড়ে ওঠা অবিশ^াস একটি সুখময় দাম্পত্যকে পতনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারে, আপনি জানেন?

হতচকিত হন লেখক শমসের কাহার। এই সুভদ্র, স্মার্ট পাঠিকা কী বলতে চায়? এর পরে মোমেনা বেগম যা বললেন তার জন্যে শমসের প্রস্তুত ছিলেন না।

- আপনি নিঃসন্তান। একটা খেদ তো মনের ভেতরে আছেই- আপনার, ভাবির। অস্বীকার করা তো যাবে না। তার ভেতরে যদি কোনো তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ হয়, ধরুন এই আমি। লেখকের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে তার এত কাছে আসা। ভাবির অনুপস্থিতিতে দুপুরের খাবার দেয়া, সন্ধ্যার চা- সন্দেহ হবে না জনে জনে। পাঁচজনের কানাঘুষা সন্দেহের বীজ বপন করবে না ভাবির মনে? তখনই তো দাম্পত্যর টানাপোড়েন।

কেমন অস্বস্তি বোধ করেন শমসের কাহার। মুখম-লে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মেয়েরা যত সহজে ঘটনার গভীর অনুসন্ধান করতে পারে, ছেলেরা বোধ হয় পিছিয়েই থাকে। এমন করে তো ভাবেননি কখনো লেখক শমসের। মোমেনা বেগম, কতই-বা বয়স- ৩৬/৩৭, এর বেশি নয়। জীবনকে দেখছে খুব নিবিড় করে। শমসেরের লেখার শক্তি হয়ে উঠছে সে ক্রমশ। শমসের কি তবে মোমেনা বেগমের কাছে গল্পের উৎস সন্ধান করবে? ধরা দেবে তার নিবিড় সান্নিধ্যে? মোমেনা বেগম বলে চলেন...

-ধরুন না কেন, একজন শিক্ষিত রমণী যে কিনা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। বেসরকারি চাকরির প্রতিদিনের নানা ঝক্কি সামলিয়ে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। তবু সেই রাতে ফিরে এক হাতে সংসারের সব ঝামেলা মিটানো। অথচ সন্দেহপ্রবণ স্বামী দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। স্ত্রীকে অবিশ^াস করতে থাকে। তারপর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ডিভোর্স নয়, সেপারেশন। কী মর্মান্তিক, না?

কোনো কথা সরে না লেখক শমসেরের মুখে। মোমেনা তার নিজের জীবনের গল্প বলে গেলেন সুচতুরভাবে। শমসের কাহার নিজের জীবনের সঙ্গে মোমেনাকে মেলাতে থাকে। মোমেনার দুঃখ খুব কি বেশি? সন্তান না থাকার যন্ত্রণা থেকেও? উত্তরগুলো এলোমেলো হয়ে যায়।

মোমেনা আবারও বলেন, এইসব মধ্যবিত্তের ছোটোখাটো দুঃখকথা কেন লিখছেন না। আপনার লেখনীশক্তি একঘেয়ে হয়ে উঠছে শমসের কাহার। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র- সবক্ষেত্রেই মধ্যবিত্তের যন্ত্রণা বড় বেশি মর্মভেদী। আপনি লিখুন সেই কথা। মধ্যবিত্তের এক অন্তরীণ জীবনের কথা।

শমসের হঠাৎ মাথা দোলায়। এরপরই বাঁ চোখ ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে কচলাতে থাকে। মোমেনা বলে, কী হলো?

- চোখে কিছু পড়েছে বোধ হয়।

- দেখি, দেখি। বলে মোমেনা এলইডি টিউবলাইটের দিকে শমসেরের বাঁ চোখ নিয়ে খুব গভীর মনোনিবেশ করেন। আর ডান চোখে মোমেনাকে দেখতে থাকেন শমসের কাহার। এক সন্তানের জননী, ভরা যৌবন। সৌন্দর্য এখনও অটুট। ¯িœগ্ধ কোমল এক কান্তিময় দ্যুতি ছড়াচ্ছে মোমেনার শরীর। অবশেষে কিছু না পেয়ে মোমেনা মুখ গোল করে ফুঁ দেন শমসেরের বাঁ চোখে। এই ফুঁয়ের ভেতরেই শমসের নিজেকে মোমেনার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বেসিনে গিয়ে চোখে পানির ঝাপটা দেয়। মোমেনাকে কিছুতেই সে অদিতি হতে দেবে না। ঘোর ভাঙে দুজনেরই।

- কিছু মনে করবেন না। অমন কাতরাচ্ছিলেন, তাই...

মোমেনার কথা কেড়ে নিয়ে শমসের কাহার বলেন, না, অদিতিকে আমি হারতে দিতে পারি না। আমার নিঃস্ব জীবনে সেই আমার লেখার শক্তি। আর মোমেনা বেগম তুমি আমার অনুরক্ত পাঠিকামাত্র, যে নতুন ভাবনার গল্প নিয়ে হাজির হয় বারবার।

মোমেনা হেসে দেয়। আপনার কণ্ঠে ‘তুমি’ ডাকটা অনেক মধুর লাগল। হতচকিত শমসের অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, মাফ করবেন।

- থাক না ‘তুমি’ সম্বোধন। এই দুই অক্ষরের শব্দ দিয়েই যশস্বী গল্পকার শমসের কাহার লিখল না হয় মোমেনা বেগমের মতো অসহায় মধ্যবিত্তের সংগ্রামরত জীবনের অন্তরীণ কথা।

মোমেনা চলে যাবার পর ঘরে অদিতির স্পর্শ অনুভব করেন শমশের কাহার। সে ছিল সময়ের ঘোরলাগা চমক। কিন্তু এরপর থেকে মোমেনার আর দেখা নেই। শমসের কাহারও আর খোঁজেননি তাকে। কিন্তু অদিতির মধ্যে মাঝে মাঝেই যেন মোমেনা উঁকি দেয়। তাকে প্রশ্রয় দেয় না শমসের কাহার। কেননা তার জীবনে অদিতিকে সে হারতে দেবে না কখনো। শূন্য শমসের আলীকে লেখক শমসের কাহারে পরিণত করতে অদিতির আত্মত্যাগ তো কম নয়! অথচ যে গল্পের সূচনা তিনি সারাদিন ধরে করেছিলেন, মোমেনা তার সমাপ্তির গতিপথ তৈরি করে দিয়েছে। মধ্যবিত্তের দাম্পত্যজীবনের মিঠেকড়া- সেই প্রেমের উপাখ্যান। শমসের কাহারের সামনে এখন এক নতুন লেখক।

back to top