alt

ঈদ সংখ্যা ২০২৫

বরুন গাছ কিংবা নীলখামে চিঠি

ফাইজুস সালেহীন

: শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

ঘুম ভাঙলে মেহেরুন্নেসা কপালে আঙুলের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করেন। কেউ একজন সিথানে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খুব চেনা এই স্পর্শ। অচেনা হয়ে গিয়েছিলো প্রায়। মাঝখানে যেনো কংক্রিটের একটা দেয়াল ছিলো। এখন কি তাহলে সেই দেয়াল ধসে পড়েছে! ভালো করে বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। দুর্বল কণ্ঠে মেহেরুন্নেসা জানতে চান, কে? উত্তর আসে,

এখন কি একটু ভাল লাগছে?

দেয়ালটা তাহলে সত্যিই নেই!

ও! তুমি!

রায়হান জবাব না দিয়ে অন্য কথা বলেন।

একটু গ্লুকোজ গুলিয়ে দিই! গলাটা ভিজিয়ে নেবে!

আবু রায়হান সামান্য ঝুঁকে জানতে চান।

মেহেরুন্নেসা কোনো কথা বলেন না। থুতনিটা সমান্য নেড়ে সম্মতি জানালেন। আবু রায়হান ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বললেন, একটু অপেক্ষা করো। এখনই বানিয়ে দিচ্ছি। আবু রায়হানের এই ব্যস্ততার মধ্যে বসন্ত-বাতাসে দুলতে থাকা নতুন পাতার আনন্দ ছিলো। বিষয়টি লক্ষ্য করার মতো তৃতীয় কেউ সেখানে ছিলো না। মেহেরুন্নেসা তাকিয়ে আকুল হয়ে দেখে, রায়হান খুব যতœ করে গ্লাসটি ধুয়ে নিচ্ছেন। আগে থেকে পরিষ্কার গ্লাসটির ভেতর ও বাইরে এমনভাবে কচলে পরিষ্কার করছেন যাতে একটুও জীবাণু না থাকে। ঝকমকে কাচের গ্লাসে বোতলের টাটকা পানি ঢেলে খুব যতœ করে গ্লুকোজ গুলিয়ে সিথানে এলে মেহেরুন্নেসা হাত বাড়িয়ে বলেন, দাও!

রায়হান বলেন, না! না!। এত দুর্বল শরীরে নিজে নিজে খেতে পারবে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। বলে মেহেরুন্নেসাকে ধরে একটু তুলে পিঠের নিচে দুটো বালিশ দিয়ে বাম হাতে ধরে রাখলেন এবং ডান হাতে গ্লাসটা মুখের সামনে এনে বলেন, আস্তেধীরে চুমুক দাও। কোনো তাড়া নেই, আমি ধরে আছি।

মেহেরুন্নেসা গ্লাসে চুমুক না দিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলেন আবু রায়হানের দিকে। তার চোখে জল টলমল করে। এখনই গড়িয়ে পড়বে পানি। আবু রায়হান বুঝতে পারেন, মেহের খুব খুশি হয়েছে। খুশিতে ওর কান্না পাচ্ছে। আবু রায়হানের চোখের পাতাও ভিজে উঠেছে। বয়স তো কম হলো না, মেহেরকে বহুদিন হলোএতো খুশি হতে দেখেননি আবু রায়হান।

এই দৃশ্যটি তৈরি হয়েছিলো মৃত্যুর গুহা থেকে মেহেরুন্নেসার ফিরে আসারও এক ঘুম পরে। শেষ বিকেলে জ্ঞান ফেরার পর মেহেরুন্নেসা আবার ঘুমিয়ে পড়লে বাড়ির সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। বুঝি জ্ঞান হারালেন আবারও। ডাক্তার এসে প্রেশার মাপলেন। ঘড়ি ধরে পালস দেখলেন। তাপমাত্রা পরীক্ষা করলেন। টেথিসকোপ লাগিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরীক্ষা করলেন। এবং বললেন, ভয়ের কিছু নেই। আলহামদুলিল্লাহ। বিপদ কেটে গেছে। জ্ঞান ফিরে এসছে। শরীর খুব দুর্বল তাই আবারও ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখন আর ডাকাডাকির দরকার নেই। আপনিই জেগে উঠবেন। বাড়ির লোক একজন কেউ অবশ্যই পাশে থাকবেন। ঘুম থেকে জেগে কাউকে পাশে দেখতে নাপেলে ভয় পেয়ে যেতে পারেন। জাগলে পরে পুষ্টিকর কিছু অবশ্যই খেতে দেবেন। গ্লুকোজ পানি দেবেন। সাথে দুয়েকটি বিস্কুটও দিতে পারেন।

বাড়ির সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গেলো, কোন রাতে ঘুম ভাঙবে কে জানে! সবারই বাড়ি যাওয়ার তাড়া। পেশেন্টের পাশে কে থাকবে! তারা ভাবনায় পড়ে গেলো। মেহেরুন্নেসার ছেলেদের কেউ একজন থাকতে পারতো। কিন্তু ওদের তো সকালেই আবার অফিস। বউদেরও কেউ রাতে থাকতে পারবে না। সকালে ছেলেমেয়েদের স্কুল। কাকডাকা ভোরে উঠে ওদের তৈরি করতে হয়। স্কুলে দিয়েও আসতে হয়। দুই বউয়ের কারো পক্ষেই শাশুড়ি মায়ের পাশে বসে রাতজাগা কোনোভাবেই সম্ভব না। বড় বৌমা রিনির দিকে তাকিয়ে বলে, আন্টি আপনিই থেকে যান না; প্লিজ! রিনি বলে, আমি তো থাকতেই চাই। মায়ের পেটের বোন সবাই ফেলে দিলেও বোন তো ছাড়তে পারে না। রিনি মায়াভরে এই কথাটি বলবার সময় আড় চোখে তাকালো আবু রায়হানের দিকে। রায়হানের কানে পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। মোবাইলে সময় দেখে রিনি বললো, ইয়া আল্লাহ! দেখতে দেখতে সাতটা বেজে গেলো! রিভুর বাবা বাসায় এলো বলে! উনি এসেই চা নাশতা চাইবেন! এসে যখন দেখবেন আমি নেই তখন একাএকা গজ গজ করবেন। রেগেমেগে রিভুকে ডাকাডাকি শুরু করবেন। রিভুর আবার ইয়ার ফাইনাল। এই সময়ে মেয়েটা কি পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠতে পারে; বলো! আমি বরং যাই। ফোন করে খবর নেবো। বলে রিনি বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ালো।

কেবিনের এক কোনায় সোফায় ভাবলেশহীন জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিলেন আবু রায়হান। তিনি বসেছিলেন গালে হাত দিয়ে। বাড়ির কারো মনে হলো না যে এই লোকটিরও কিছু বলবার থাকতে পারে। পরিবারের সবচেয়ে মূল্যহীন মানুষ এই কপর্দকহীন লোকটা। আবু রায়হান পরিবার নিয়ে টিনশেডের যে বাড়িতে থাকেন সেটির নামও মেহেরুন্নেসা। গ্রামের বাড়ির কিছু জায়গাজমি বিক্রি করে আবু রায়হানই মেহেরকে বাড়িটি করে দিয়েছেন। বৌয়ের সেই বাড়িতে রায়হান থাকেন। ছেলেরা বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে। দুই ছেলে মাসে মাসে কিছু টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়ে দুজনের ওষুধ ও বাজার খরচা চলে তো চলে না। মাসের মাঝখানে ওষুধ কেনার টাকা না থাকলে ছেলেদের কাছে হাত পাতেন। তখন ওরা কথা শোনাতে ছাড়ে না। আবু রায়হানের তাতে মন খারাপ হয় না। সামান্য কষ্ট পেলেও ধুলোবালির মতো ঝেড়ে ফেলে দেন। জীর্ণ কোটে এক-আধটু ধুলো লাগলেও বোঝা যায় না। চাকরি ছেড়ে আসার পরে আবু রায়হান ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলেন। আর এখন তো একেবারেই বদলে গেছেন। তিনি এখন একজন বোকাসোকা মানুষ। কথায়, কাজে ও পোশাকে মোস্ট আনইমপ্রেসিভ। বুড়ো বয়সেরও একটা সৌন্দর্য থাকে, এই লোকটির তাও নেই। ভালবাসবার মতো, সম্মান করবার মতো কোনো গুণ তার নেই। কোনো কালে ছিলো বলে মনেও হয় না। তবুও বেহায়া অতীত উঁকি মারে।

তিনি একটা বড় কোম্পানির হেড অফ দ্য বিজনেস প্রমোশন ছিলেন, প্রফেশনে অনেকে তাকে শিক্ষক জ্ঞান করতো। কোম্পানিতে তিনি অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন; এসব কথা কেউ এখন বিশ্বাস করে না। আবু রায়হান এসব নিয়ে ভাবেনও না। পাস্ট ইজ ডাস্ট। অপবাদ, অবজ্ঞা, অসম্মাান ও তিরস্কারের ধূলি জমেছে স্তরে স্তরে জীবনের খেরোখাতায়। তার ব্যক্তিত্বের মজবুত চৌচালা ঘরের কড়ি বরগা ঘুণে খেয়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে ঝুরঝুর করে। নিজের অজান্তে একচিলতে শব্দহীন নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেলো আবু রায়হানের বুকের গভীর থেকে।

তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন। রাতে পেশেন্টের কাছে কে থাকবে না থাকবে এ নিয়ে দুই ছেলের বউ ও রিনির দুশ্চিন্তা এখনও কাটেনি।

আবু রায়হানের মনে হলো, এখন কিছু বলে ওদের আশ্বস্ত করা তার কর্তব্য। তিনি গলায় একটু জোর এনে বললেন, তোমরা অত ভাবছো কেন, আমি তো আছি! এ কথা শুনে আপনজনেরা হতচকিত হলো। তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। হুট করে তারা মনেহয় একটা উটকো চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলো। রিনির চিন্তা আরেকটুখানি বেশি। ও বলে, দুলাভাই আপনি একা থাকতে পারবেন! কেউ আসবে কি! কথা হয়েছে!

রিনির কথাগুলো শুনে আবু রায়হানের কান গরম হয়ে গেলো। মেহেরুন্নেসার এই বোনের চাবুকমারা কথার অনুবাদ করতে আবু রায়হানের এক মুহূর্তও বিলম্ব হলো না। এগুলো তার কাছে নতুন নয়। কুড়ি বছর ধরে শুনে আসছেন এইসব। মেহেরুন্নেসা কুড়িটি বছর ওই এক ছায়ার সাথে লড়াই করে করে এখন ক্লান্ত। অনেক দিন পর রিনির কণ্ঠে যখন সেই ভাষা, সেই সুর, তখন আবু রায়হানের মনে হলো কালো ক্রীতদাসের পিঠে সাদা চামড়ার মনিব শপাং শপাং করে কয়েক ঘা চাবুক বসিয়ে দিলো এইমাত্র। কিন্তু রায়হান কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না। তিনি মৃদু হেসে বললেন, তোমরা যাও। আমি আছি। চিন্তা করো না!

ওরা তিনজন কিছুটা সরে গেলো। ছোট বৌমা ফিসফিস করে বলে, মা জেগে উঠে বাবাকে দেখে যদি রেগে যান, তাহলে কী হবে! রিনি বলে, আমিও তাই ভাবছি। বড় বৌমা বলে, কিন্তু আমরা কী করবো! আমাদেরও তো কোনো অপশন নেই।

কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বড় বৌমা বলে,বাবা দেখবেন; মা জেগে উঠে যাতে রেগে না যান। রেগে গেলে কী থেকে কী হয়ে যায়! মায়ের রেগে যাওয়ার মতো কিছু করবেন না যেনো! পুত্রবধূর এ রকম উপদেশ কোনো শ্বশুরের ভালো লাগবার কথা নয়। কিন্তু , আবু রায়হানের এসব গায়ে লাগে না।

আবু রায়হান হাসলেন। ঋজু কণ্ঠে বললেন, চিন্তা করো না! তোমরা এসো!

ওরা চলে যাবার পর আবু রায়হান একটা চেয়ার টেনে ঘুমিয়ে থাকা মেহেরুন্নেসার সিথানের কাছে বসলেন। কপালে হাত রাখলেন। ঘুমন্ত স্ত্রীর চুলে বিলি কাটেন আলতো করে, থেমে থেমে।

তিনি ভাবেন মেহের জেগে উঠে বদলোকটাকে দেখে রেগে গেলে তিনি কী করবেন! ওরা ভুল তো বলেনি কিছু। ও রেগে যেতেই পারে। গত কুড়ি বছরের মধ্যে, আবু রায়হানের মনে পড়ে না; তার কোনো একটি কাজ বা কথায় মেহের খুশি হয়েছে। রায়হানের মাথায় যে সবসময় বীনা নামের খারাপ মেয়েটির চিন্তাই কিলবিল করে, তাতে মেহেরের কোনোই সন্দেহ নেই।

অফিস থেকে বাসায় ফিরতে দেরি হয় কেন? নিজের কাজে মনোযোগ নেই, অফিস করে বাসায় না এসে বীনার রূপ চাটতে যাওয়া, লাঞ্চ টাইমে হুট করে বেরিয়ে যাওয়া কেন! মেহের কি অত বোকা যে কিছু বুঝবে না! এ তো জানা কথা, বীনা খাবার নিয়ে বসে থাকে তার পীড়িতের লোক এলে একসাথে লাঞ্চ করবে বলে! কী নিলর্জ্জ, কী বেহায়া মেয়ে মানুষরে বাবা! জলজ্যান্ত একটা জামাই থাকতে পরেরটা নিয়ে মাতামাতি। অবশ্য ওই মেয়ের কী দোষ! খবিশ তো আসলে এই মিরমিইরা শয়তান লোকটা!

বাসায় ফিরতে দেরি হলে মেহের এগুলো বলতে থাকে মুখস্থ কবিতার মতো। আর বাসায় ফিরতে দেরি তে আবু রায়হানেরা হয়েই যায়। ডিপার্টমেন্টের কাজ গুছিয়ে উঠতে দেরি হয় প্রায় প্রতিদিনই। দায়িত্বশীল পদে যারা থাকেন, ঘড়ি ধরে তাদের কাজ চলে না। মেহেরুন্নেসাও এই ব্যাপারটি বুঝতেন, বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাসের সেই ভিত চুরমার করে দিয়েছে বীনা নামের মহিলাটি।

কিন্তু আবু রায়হান অসহায়। জবাব দেওয়ার কোনো অবকাশ তিনি পাননি। মেহেরুন্নেসা কোনোদিন রায়হানের জবানবন্দী চাননি।

গভীর রাতে মেহেরুন্নেসার ঘুম ভাঙলো। কিন্তু তিনি রাগ করলেন না। অচেনা হয়ে যাওয়া চেনা আঙুলের স্পর্শে তিনি অনুভব করেন গভীর এক প্রেমময়তা , যা ফিরে এলো বহু বছর পরে, বহুদূর হতে। কয়েক ঢোক গ্লুকোজপানি খেয়ে আর না; বলে মেহেরুন্নেসা আস্তে করে রায়হানের হাতটা ঠেলে দিলেন।

রায়হান জোর করলেন না।

মেহেরুন্নেসা কোনো কথা বলেন না।

আবু রায়হান মেহেরের একটা হাত টেনে নিয়ে হাতের তালু, আঙুলের প্রতিটি ডগা নরম করে টিপে দিতে থাকেন। আরামে মেহেরুন্নেসার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। চোখ না খুলেই মেহের ডাকেন,

রায়হান!

হু!

সেই বরুন গাছটার কথা তোমার মনে আছে?

বরুন গাছের কথা ভোলা কি যায়! কিংবা নীল খামে সেই চিঠি! ভোলা কি যায়!

-যায় না! কেন যায় না!

-বরুন গাছটার কথা ভুলে গেলে সেই সোনালি বালিকার কী হবে!

-সোনালি না ছাই! সেই কালো মেয়েটি তোমার জীবন বিষিয়েছে।

আবু রায়হান নিশ্চুপ। এ কথার কী উত্তর দেবেন তিনি! তার চোখে পানি টলমল করছিলো তখন। মেহেরুন্নেসা খেয়াল করেননি।

ঢোক গিলে উথলে ওঠা কান্না চেপে রায়হান বলতে থাকেন,

স্কুল ছুটি হলে নদীর কোল ঘেঁষে চলে-যাওয়া পথে বালিকা বাড়ি যায়।

জবাবে মেহেরুন্নেসা বলেন,

একটি দুরন্ত বালক দাঁড়িয়ে থাকে বরুন গাছের তলায়। বালকের বুক পকেটে একটি নীল খামে একটি চিঠি।

রায়হান বলেন,

নীল খাম উড়ে এসে পড়ে বালিকার পথে।

-তারপর!

মেহেরের মুগ্ধ প্রশ্ন।

-নীলখামে চিঠি আসে। চিঠি যায়।

মেহেরুন্নেসার হাতের ওপর টুপ করে পড়ে এক ফোঁটা তপ্ত জল। আবু রায়হানের চোখের কোল উপচে পড়ে অবাধ্য পানি।

মেহেরুন্নেসার চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি শক্ত করে ধরলেন আবু রায়হানের হাত।

tab

ঈদ সংখ্যা ২০২৫

বরুন গাছ কিংবা নীলখামে চিঠি

ফাইজুস সালেহীন

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

ঘুম ভাঙলে মেহেরুন্নেসা কপালে আঙুলের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করেন। কেউ একজন সিথানে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খুব চেনা এই স্পর্শ। অচেনা হয়ে গিয়েছিলো প্রায়। মাঝখানে যেনো কংক্রিটের একটা দেয়াল ছিলো। এখন কি তাহলে সেই দেয়াল ধসে পড়েছে! ভালো করে বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। দুর্বল কণ্ঠে মেহেরুন্নেসা জানতে চান, কে? উত্তর আসে,

এখন কি একটু ভাল লাগছে?

দেয়ালটা তাহলে সত্যিই নেই!

ও! তুমি!

রায়হান জবাব না দিয়ে অন্য কথা বলেন।

একটু গ্লুকোজ গুলিয়ে দিই! গলাটা ভিজিয়ে নেবে!

আবু রায়হান সামান্য ঝুঁকে জানতে চান।

মেহেরুন্নেসা কোনো কথা বলেন না। থুতনিটা সমান্য নেড়ে সম্মতি জানালেন। আবু রায়হান ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বললেন, একটু অপেক্ষা করো। এখনই বানিয়ে দিচ্ছি। আবু রায়হানের এই ব্যস্ততার মধ্যে বসন্ত-বাতাসে দুলতে থাকা নতুন পাতার আনন্দ ছিলো। বিষয়টি লক্ষ্য করার মতো তৃতীয় কেউ সেখানে ছিলো না। মেহেরুন্নেসা তাকিয়ে আকুল হয়ে দেখে, রায়হান খুব যতœ করে গ্লাসটি ধুয়ে নিচ্ছেন। আগে থেকে পরিষ্কার গ্লাসটির ভেতর ও বাইরে এমনভাবে কচলে পরিষ্কার করছেন যাতে একটুও জীবাণু না থাকে। ঝকমকে কাচের গ্লাসে বোতলের টাটকা পানি ঢেলে খুব যতœ করে গ্লুকোজ গুলিয়ে সিথানে এলে মেহেরুন্নেসা হাত বাড়িয়ে বলেন, দাও!

রায়হান বলেন, না! না!। এত দুর্বল শরীরে নিজে নিজে খেতে পারবে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। বলে মেহেরুন্নেসাকে ধরে একটু তুলে পিঠের নিচে দুটো বালিশ দিয়ে বাম হাতে ধরে রাখলেন এবং ডান হাতে গ্লাসটা মুখের সামনে এনে বলেন, আস্তেধীরে চুমুক দাও। কোনো তাড়া নেই, আমি ধরে আছি।

মেহেরুন্নেসা গ্লাসে চুমুক না দিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলেন আবু রায়হানের দিকে। তার চোখে জল টলমল করে। এখনই গড়িয়ে পড়বে পানি। আবু রায়হান বুঝতে পারেন, মেহের খুব খুশি হয়েছে। খুশিতে ওর কান্না পাচ্ছে। আবু রায়হানের চোখের পাতাও ভিজে উঠেছে। বয়স তো কম হলো না, মেহেরকে বহুদিন হলোএতো খুশি হতে দেখেননি আবু রায়হান।

এই দৃশ্যটি তৈরি হয়েছিলো মৃত্যুর গুহা থেকে মেহেরুন্নেসার ফিরে আসারও এক ঘুম পরে। শেষ বিকেলে জ্ঞান ফেরার পর মেহেরুন্নেসা আবার ঘুমিয়ে পড়লে বাড়ির সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। বুঝি জ্ঞান হারালেন আবারও। ডাক্তার এসে প্রেশার মাপলেন। ঘড়ি ধরে পালস দেখলেন। তাপমাত্রা পরীক্ষা করলেন। টেথিসকোপ লাগিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরীক্ষা করলেন। এবং বললেন, ভয়ের কিছু নেই। আলহামদুলিল্লাহ। বিপদ কেটে গেছে। জ্ঞান ফিরে এসছে। শরীর খুব দুর্বল তাই আবারও ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখন আর ডাকাডাকির দরকার নেই। আপনিই জেগে উঠবেন। বাড়ির লোক একজন কেউ অবশ্যই পাশে থাকবেন। ঘুম থেকে জেগে কাউকে পাশে দেখতে নাপেলে ভয় পেয়ে যেতে পারেন। জাগলে পরে পুষ্টিকর কিছু অবশ্যই খেতে দেবেন। গ্লুকোজ পানি দেবেন। সাথে দুয়েকটি বিস্কুটও দিতে পারেন।

বাড়ির সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গেলো, কোন রাতে ঘুম ভাঙবে কে জানে! সবারই বাড়ি যাওয়ার তাড়া। পেশেন্টের পাশে কে থাকবে! তারা ভাবনায় পড়ে গেলো। মেহেরুন্নেসার ছেলেদের কেউ একজন থাকতে পারতো। কিন্তু ওদের তো সকালেই আবার অফিস। বউদেরও কেউ রাতে থাকতে পারবে না। সকালে ছেলেমেয়েদের স্কুল। কাকডাকা ভোরে উঠে ওদের তৈরি করতে হয়। স্কুলে দিয়েও আসতে হয়। দুই বউয়ের কারো পক্ষেই শাশুড়ি মায়ের পাশে বসে রাতজাগা কোনোভাবেই সম্ভব না। বড় বৌমা রিনির দিকে তাকিয়ে বলে, আন্টি আপনিই থেকে যান না; প্লিজ! রিনি বলে, আমি তো থাকতেই চাই। মায়ের পেটের বোন সবাই ফেলে দিলেও বোন তো ছাড়তে পারে না। রিনি মায়াভরে এই কথাটি বলবার সময় আড় চোখে তাকালো আবু রায়হানের দিকে। রায়হানের কানে পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। মোবাইলে সময় দেখে রিনি বললো, ইয়া আল্লাহ! দেখতে দেখতে সাতটা বেজে গেলো! রিভুর বাবা বাসায় এলো বলে! উনি এসেই চা নাশতা চাইবেন! এসে যখন দেখবেন আমি নেই তখন একাএকা গজ গজ করবেন। রেগেমেগে রিভুকে ডাকাডাকি শুরু করবেন। রিভুর আবার ইয়ার ফাইনাল। এই সময়ে মেয়েটা কি পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠতে পারে; বলো! আমি বরং যাই। ফোন করে খবর নেবো। বলে রিনি বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ালো।

কেবিনের এক কোনায় সোফায় ভাবলেশহীন জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিলেন আবু রায়হান। তিনি বসেছিলেন গালে হাত দিয়ে। বাড়ির কারো মনে হলো না যে এই লোকটিরও কিছু বলবার থাকতে পারে। পরিবারের সবচেয়ে মূল্যহীন মানুষ এই কপর্দকহীন লোকটা। আবু রায়হান পরিবার নিয়ে টিনশেডের যে বাড়িতে থাকেন সেটির নামও মেহেরুন্নেসা। গ্রামের বাড়ির কিছু জায়গাজমি বিক্রি করে আবু রায়হানই মেহেরকে বাড়িটি করে দিয়েছেন। বৌয়ের সেই বাড়িতে রায়হান থাকেন। ছেলেরা বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে। দুই ছেলে মাসে মাসে কিছু টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়ে দুজনের ওষুধ ও বাজার খরচা চলে তো চলে না। মাসের মাঝখানে ওষুধ কেনার টাকা না থাকলে ছেলেদের কাছে হাত পাতেন। তখন ওরা কথা শোনাতে ছাড়ে না। আবু রায়হানের তাতে মন খারাপ হয় না। সামান্য কষ্ট পেলেও ধুলোবালির মতো ঝেড়ে ফেলে দেন। জীর্ণ কোটে এক-আধটু ধুলো লাগলেও বোঝা যায় না। চাকরি ছেড়ে আসার পরে আবু রায়হান ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলেন। আর এখন তো একেবারেই বদলে গেছেন। তিনি এখন একজন বোকাসোকা মানুষ। কথায়, কাজে ও পোশাকে মোস্ট আনইমপ্রেসিভ। বুড়ো বয়সেরও একটা সৌন্দর্য থাকে, এই লোকটির তাও নেই। ভালবাসবার মতো, সম্মান করবার মতো কোনো গুণ তার নেই। কোনো কালে ছিলো বলে মনেও হয় না। তবুও বেহায়া অতীত উঁকি মারে।

তিনি একটা বড় কোম্পানির হেড অফ দ্য বিজনেস প্রমোশন ছিলেন, প্রফেশনে অনেকে তাকে শিক্ষক জ্ঞান করতো। কোম্পানিতে তিনি অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন; এসব কথা কেউ এখন বিশ্বাস করে না। আবু রায়হান এসব নিয়ে ভাবেনও না। পাস্ট ইজ ডাস্ট। অপবাদ, অবজ্ঞা, অসম্মাান ও তিরস্কারের ধূলি জমেছে স্তরে স্তরে জীবনের খেরোখাতায়। তার ব্যক্তিত্বের মজবুত চৌচালা ঘরের কড়ি বরগা ঘুণে খেয়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে ঝুরঝুর করে। নিজের অজান্তে একচিলতে শব্দহীন নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেলো আবু রায়হানের বুকের গভীর থেকে।

তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন। রাতে পেশেন্টের কাছে কে থাকবে না থাকবে এ নিয়ে দুই ছেলের বউ ও রিনির দুশ্চিন্তা এখনও কাটেনি।

আবু রায়হানের মনে হলো, এখন কিছু বলে ওদের আশ্বস্ত করা তার কর্তব্য। তিনি গলায় একটু জোর এনে বললেন, তোমরা অত ভাবছো কেন, আমি তো আছি! এ কথা শুনে আপনজনেরা হতচকিত হলো। তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। হুট করে তারা মনেহয় একটা উটকো চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলো। রিনির চিন্তা আরেকটুখানি বেশি। ও বলে, দুলাভাই আপনি একা থাকতে পারবেন! কেউ আসবে কি! কথা হয়েছে!

রিনির কথাগুলো শুনে আবু রায়হানের কান গরম হয়ে গেলো। মেহেরুন্নেসার এই বোনের চাবুকমারা কথার অনুবাদ করতে আবু রায়হানের এক মুহূর্তও বিলম্ব হলো না। এগুলো তার কাছে নতুন নয়। কুড়ি বছর ধরে শুনে আসছেন এইসব। মেহেরুন্নেসা কুড়িটি বছর ওই এক ছায়ার সাথে লড়াই করে করে এখন ক্লান্ত। অনেক দিন পর রিনির কণ্ঠে যখন সেই ভাষা, সেই সুর, তখন আবু রায়হানের মনে হলো কালো ক্রীতদাসের পিঠে সাদা চামড়ার মনিব শপাং শপাং করে কয়েক ঘা চাবুক বসিয়ে দিলো এইমাত্র। কিন্তু রায়হান কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না। তিনি মৃদু হেসে বললেন, তোমরা যাও। আমি আছি। চিন্তা করো না!

ওরা তিনজন কিছুটা সরে গেলো। ছোট বৌমা ফিসফিস করে বলে, মা জেগে উঠে বাবাকে দেখে যদি রেগে যান, তাহলে কী হবে! রিনি বলে, আমিও তাই ভাবছি। বড় বৌমা বলে, কিন্তু আমরা কী করবো! আমাদেরও তো কোনো অপশন নেই।

কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বড় বৌমা বলে,বাবা দেখবেন; মা জেগে উঠে যাতে রেগে না যান। রেগে গেলে কী থেকে কী হয়ে যায়! মায়ের রেগে যাওয়ার মতো কিছু করবেন না যেনো! পুত্রবধূর এ রকম উপদেশ কোনো শ্বশুরের ভালো লাগবার কথা নয়। কিন্তু , আবু রায়হানের এসব গায়ে লাগে না।

আবু রায়হান হাসলেন। ঋজু কণ্ঠে বললেন, চিন্তা করো না! তোমরা এসো!

ওরা চলে যাবার পর আবু রায়হান একটা চেয়ার টেনে ঘুমিয়ে থাকা মেহেরুন্নেসার সিথানের কাছে বসলেন। কপালে হাত রাখলেন। ঘুমন্ত স্ত্রীর চুলে বিলি কাটেন আলতো করে, থেমে থেমে।

তিনি ভাবেন মেহের জেগে উঠে বদলোকটাকে দেখে রেগে গেলে তিনি কী করবেন! ওরা ভুল তো বলেনি কিছু। ও রেগে যেতেই পারে। গত কুড়ি বছরের মধ্যে, আবু রায়হানের মনে পড়ে না; তার কোনো একটি কাজ বা কথায় মেহের খুশি হয়েছে। রায়হানের মাথায় যে সবসময় বীনা নামের খারাপ মেয়েটির চিন্তাই কিলবিল করে, তাতে মেহেরের কোনোই সন্দেহ নেই।

অফিস থেকে বাসায় ফিরতে দেরি হয় কেন? নিজের কাজে মনোযোগ নেই, অফিস করে বাসায় না এসে বীনার রূপ চাটতে যাওয়া, লাঞ্চ টাইমে হুট করে বেরিয়ে যাওয়া কেন! মেহের কি অত বোকা যে কিছু বুঝবে না! এ তো জানা কথা, বীনা খাবার নিয়ে বসে থাকে তার পীড়িতের লোক এলে একসাথে লাঞ্চ করবে বলে! কী নিলর্জ্জ, কী বেহায়া মেয়ে মানুষরে বাবা! জলজ্যান্ত একটা জামাই থাকতে পরেরটা নিয়ে মাতামাতি। অবশ্য ওই মেয়ের কী দোষ! খবিশ তো আসলে এই মিরমিইরা শয়তান লোকটা!

বাসায় ফিরতে দেরি হলে মেহের এগুলো বলতে থাকে মুখস্থ কবিতার মতো। আর বাসায় ফিরতে দেরি তে আবু রায়হানেরা হয়েই যায়। ডিপার্টমেন্টের কাজ গুছিয়ে উঠতে দেরি হয় প্রায় প্রতিদিনই। দায়িত্বশীল পদে যারা থাকেন, ঘড়ি ধরে তাদের কাজ চলে না। মেহেরুন্নেসাও এই ব্যাপারটি বুঝতেন, বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাসের সেই ভিত চুরমার করে দিয়েছে বীনা নামের মহিলাটি।

কিন্তু আবু রায়হান অসহায়। জবাব দেওয়ার কোনো অবকাশ তিনি পাননি। মেহেরুন্নেসা কোনোদিন রায়হানের জবানবন্দী চাননি।

গভীর রাতে মেহেরুন্নেসার ঘুম ভাঙলো। কিন্তু তিনি রাগ করলেন না। অচেনা হয়ে যাওয়া চেনা আঙুলের স্পর্শে তিনি অনুভব করেন গভীর এক প্রেমময়তা , যা ফিরে এলো বহু বছর পরে, বহুদূর হতে। কয়েক ঢোক গ্লুকোজপানি খেয়ে আর না; বলে মেহেরুন্নেসা আস্তে করে রায়হানের হাতটা ঠেলে দিলেন।

রায়হান জোর করলেন না।

মেহেরুন্নেসা কোনো কথা বলেন না।

আবু রায়হান মেহেরের একটা হাত টেনে নিয়ে হাতের তালু, আঙুলের প্রতিটি ডগা নরম করে টিপে দিতে থাকেন। আরামে মেহেরুন্নেসার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। চোখ না খুলেই মেহের ডাকেন,

রায়হান!

হু!

সেই বরুন গাছটার কথা তোমার মনে আছে?

বরুন গাছের কথা ভোলা কি যায়! কিংবা নীল খামে সেই চিঠি! ভোলা কি যায়!

-যায় না! কেন যায় না!

-বরুন গাছটার কথা ভুলে গেলে সেই সোনালি বালিকার কী হবে!

-সোনালি না ছাই! সেই কালো মেয়েটি তোমার জীবন বিষিয়েছে।

আবু রায়হান নিশ্চুপ। এ কথার কী উত্তর দেবেন তিনি! তার চোখে পানি টলমল করছিলো তখন। মেহেরুন্নেসা খেয়াল করেননি।

ঢোক গিলে উথলে ওঠা কান্না চেপে রায়হান বলতে থাকেন,

স্কুল ছুটি হলে নদীর কোল ঘেঁষে চলে-যাওয়া পথে বালিকা বাড়ি যায়।

জবাবে মেহেরুন্নেসা বলেন,

একটি দুরন্ত বালক দাঁড়িয়ে থাকে বরুন গাছের তলায়। বালকের বুক পকেটে একটি নীল খামে একটি চিঠি।

রায়হান বলেন,

নীল খাম উড়ে এসে পড়ে বালিকার পথে।

-তারপর!

মেহেরের মুগ্ধ প্রশ্ন।

-নীলখামে চিঠি আসে। চিঠি যায়।

মেহেরুন্নেসার হাতের ওপর টুপ করে পড়ে এক ফোঁটা তপ্ত জল। আবু রায়হানের চোখের কোল উপচে পড়ে অবাধ্য পানি।

মেহেরুন্নেসার চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি শক্ত করে ধরলেন আবু রায়হানের হাত।

back to top