alt

উপ-সম্পাদকীয়

আড়িপাতায় বিপর্যস্ত হেফাজতে ইসলাম এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২১

বাংলাদেশে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক সম্প্রতি এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকায় অবস্থিত রয়েল রিসোর্টে উঠে একটি রুম ভাড়া নেন। স্থানীয় কিছু সাংবাদিক এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা মামুনুল হককে কয়েক ঘণ্টা সেখানে অবরুদ্ধ করে তার সঙ্গে ভদ্রমহিলার পরিচয় জানতে চান। মামুনুল হক বলেছেন যে, তার সঙ্গে অবস্থানকারী ভদ্রমহিলা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিলেও মামুনুল হক তার নাম বলেছেন আমেনা তৈয়বা, তার প্রথম স্ত্রীর নাম। রিসোর্টের রেজিস্টারেও তিনি তার প্রথমা স্ত্রীর নাম লিখেছেন। রিসোর্টে নিলেন জান্নাত আরা ঝর্ণাকে, নাম লিখলেন আমেনা তৈয়বা।

প্রথম বউ আমেনা তৈয়বাকে মামুনুল হক ফোনে আশ্বস্ত করে বলেছেন, রিসোর্টের ভদ্রমহিলা ‘শহীদুল ভাইয়ের স্ত্রী’, তার স্ত্রী নয়। মামুনুল হকের বোনও আমেনা তৈয়বাকে একই কথা বলেছেন। ভিডিওতে ঘটনাটি প্রচারিত হওয়ায় মামুনুলের বোনও তার ভাইকে বাঁচাতে প্রথম স্ত্রী আমেনা তৈয়বাকে অনুরোধ করেছেন; বোন আমেনা তৈয়বাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ঝর্ণা মামুনুলের বউ নয়, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে যে, ঝর্ণা যে মামুনুলের বউ তিনি তা আগে থেকেই জানেন। বউ না হওয়া সত্ত্বেও বউ বলতে হবে, মামুনুল হকও তাই বলে যাচ্ছেন। বউ বউ খেলা নিয়ে যে সত্য-মিথ্যার জালবিস্তার তা জাস্টিফাই করতে মামুনুল হক বলেছেন, স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য, খুশি করবার জন্য প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে সত্যকে গোপন করার অবকাশ রয়েছে। ঠিকই বলেছেন, হাদিস অনুযায়ী বউকে খুশি রাখার জন্য মিথ্যা বলার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়ালো জান্নাত আরা ঝর্ণার ডাইরি। ডাইরিতে ঝর্ণা উল্লেখ করেছেন, মামুনুল হকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি, বিয়ের প্রলোভন দিয়ে মামুনুল হক সাহেব তার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বান্ধবীকে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার পথে রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মামুনুল হকের মতো বিপদে পড়েছিলেন। সঙ্গে বান্ধবী থাকায় দুর্ঘটনাস্থলে নিজেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে পরিচয় দেননি, ফলে হেনস্তায় পড়তে হয়। কক্সবাজার গিয়ে মামুনুল হক সাহেবের মতো হোটেলে ভুয়া নাম লিখে দ্বিতীয়বার বিপদে পড়েন। তিনি কক্সবাজার রওনা দেয়ার আগে ওখানকার বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক ম্যানেজারকে পরদিন তার হোটেলে গাড়ি পাঠাতে অনুরোধ করেন, পরদিন ড্রাইভার গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে আর খুঁজে পান না; হোটেলের রেজিস্টারে কর্মকর্তার নাম নেই। অথচ ম্যানেজার সাহেব ফোন করে নিশ্চিত হন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ওই হোটেলেই আছেন, তবে ভিন্ন নামে।

বিয়ে রেজিস্ট্রি না করে মামুনুল হক সাহেব শরিয়তবিরোধী কোন কাজ করেননি; কারণ ইসলামে বিয়ে রেজিস্ট্রি করার কোন বিধান নেই, এটা মনুষ্য সৃষ্ট বিধান। কবিননামা যারা চেয়েছেন তাদের জানা উচিত, বিয়ে রেজিস্ট্রি হলেও কেউ কাবিননামা নিয়ে রাস্তায় বের হন না। আমরা যারা আইন মেনে বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছি তারাও কাবিনানামার খোঁজ রাখি না। তবে ধর্ম অনুযায়ী সাক্ষী থাকতে হবে। অভিভাবকের অগোচরে গোপনে বিয়ে করা সম্পর্কে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারি বলেছেন, গোপনে বিয়ে করা বা বিয়ে গোপন রাখা ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী কঠিন অপরাধ, তা বিয়ে নয়, জেনার সামিল। দুই বছর বিয়ে গোপন রেখে মামুনুল হক কোন মাত্রার অপরাধ করেছেন তা আজহারি সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী আলমগণ নিরূপণ করতে পারেন।

জান্নাত আরা ঝর্ণা এবং মামুনুল হককে নিয়ে যাবতীয় ফোনালাপ, ভিডিও ইত্যাদি বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে তার সমর্থকরা প্রচার করছেন। তবুও সবাই যা জানতে পেরেছে তা হলো, জান্নাত আরা ঝর্ণার প্রথম স্বামী হাফেজ জাফর শহীদুল মামুনুল হকের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু; ঝর্ণার সঙ্গে তার স্বামী শহীদুলের মনোমালিন্য সৃষ্টিতে মামুনুল হক ইন্ধন জুগিয়েছেন। হাফেজ শহীদুল ঝর্ণাকে তালাক দেয়ার পর তার অসহায়ত্বের সুযোগে মামুনুল হক ঝর্ণার ঘনিষ্ঠ হন। এই অবস্থায় মামুনুল হক বেগানা নারী ঝর্ণাকে বিয়ে করে বৈধ করে নেন। কিন্তু বৈধ করার আগে বেগানা নারীর সঙ্গে কথাবার্তা বলা, মেলামেশা করা, বিপদে-আপদে সহায়তা করার মধ্যে শরিয়তের বরখেলাপ হয়েছে কী না তা আলেম সমাজ ভালো বুঝবেন।

পাশ্চাত্য সমাজে এই সব ঝামেলা নেই। বরিস জনসন এবং তার বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডস হচ্ছেন ব্রিটেনের ডাউনিং স্ট্রিটের প্রথম অবিবাহিত যুগল। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বিয়ে না করেই বসবাস করছেন তার বান্ধবীর সঙ্গে, সম্প্রতি তাদের একটি সন্তানও হয়েছে এবং ব্রিটেনবাসী নবজাতককে শুভেচ্ছাও জানিয়েছে। কেউ শিশুটিকে আমাদের মতো জারজ বলছে না, বিয়ে না করে বেগানা নারীর সঙ্গে একই বিছানায় থাকার জন্য জনসনকে ইংল্যান্ডবাসী ভোট কম দেয়নি। অনেক মুসলমানও তাকে ভোট দিয়েছেন, জনসনের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনায় মুসলমানরা অংশ নিচ্ছেন। এমন কি দারুল হারব দেশ ব্রিটেনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে মুসলমানেরা স্থায়ী বসতি স্থাপনের জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দিচ্ছে। বিশ্বের সেরা ফুটবলার আর্জেন্টিনার দিয়েগো মেরাডোনা তার চার চারটি সন্তান হওয়ার পর সন্তানের মাকে বিয়ে করেন। অথচ এই মেরাডোনার প্রতি এদেশের মুসলমানরা কত উচ্চকিত। তাহলে মামুনুল হকের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মামুনুল হক তো বরিস জনসন বা মেরাডোনার চেয়ে বেশি অপরাধ করেননি। ক্ষোভের কারণ, মামুনুল হক সারা জীবন বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্কের লোকগুলোকে মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারতে চেয়েছেন।

হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হকের এই ঘটনায় পক্ষ-বিপক্ষের সব মুসলিম আহত হয়েছেন। যারা তার পক্ষের লোক তাদের দৃঢ় বিশ্বাস রিসোর্টের ঘটনাটি ষড়যন্ত্র; এরা মনে করেন মামুনুল হককে এভাবে অপমান করে গোটা মুসলিম জনতাকে অপমান করা হয়েছে। অন্যদিকে যারা মামুনুল হকের বিপক্ষের তারাও মনে করেন যে, মামুনুল হকের এমন আচরণে ইসলামের মূল্যবোধের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস হ্রাস পাবে। দুই পক্ষই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব, মত প্রকাশে কেউ কারও প্রতি সামান্যতম সম্মানও দেখাচ্ছেন না।

রিসোর্টে মামুনুল হককে ঘেরাও দেয়া এবং ফোনালাপের তথ্য ফাঁস করা গর্হিত অপরাধ। কারও ব্যক্তিগত জীবনে দলবেঁধে চড়াও হওয়া আমাদের মতো পশ্চাৎপদ সমাজেই শুধু সম্ভব। ওঁৎপেতে কারও ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে হয়রানি করার অধিকার কারও থাকার কথা নয়, ব্যক্তিগত জীবনে এমনতর হস্তক্ষেপ কোন সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্যও নয়। এক্ষেত্রে মামুনুল হকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। আমাদের মতো অতি ঔৎসুক্য সমাজেই শুধু এমন অভব্য, অশালীন আচরণ সমর্থন করা হয়। সমাজ সমর্থন করে বলেই বহু বছর পূর্বে এক নব দম্পতিকে আশুলিয়ায় চাঁদাবাজ মাস্তানদের পিটুনিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে- তাদের অপরাধ বিয়ের কাবিন নিয়ে তারা ঘুরতে যায়নি।

পাশ্চাত্যে পরস্পরের সম্মতিতে বিবাহবহির্ভূত নারী-পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে আইনগত বা সামাজিক বাধা-বিপত্তি নেই। কিন্তু বিবাহবহির্ভূত মিলনে বড় অপরাধ হচ্ছে মিথ্যে বলা। মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কিন্তু বিচার হয়নি, বিচারে নিরূপণ করা হয়েছে ক্লিনটন কতটুকু মিথ্যে বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭৪ সনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আফিসে আড়িপাতার ঘটনার জন্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন; তিনি অপরাধ করেছিলেন মিথ্যে বলে; তিনি বলেছিলেন যে, আড়িপাতার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। মামুনুল হকও মিথ্যা বলেছেন। সত্য বা মিথ্যা যারই জয় হোক না কেন, মামুনুল হকদের ডিফেন্ড করার জন্য সমর্থক এবং ভক্তদের কখনও ঘাটতি হবে না। হেফাজতের নেতারা যেভাবে তাকে ব্যাকাপ দিচ্ছেন তাতে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মের চেয়ে রাজনীতি বড়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন হারালেও আওয়ামী বিরোধীরা এখন বিনাশর্তে হেফাজতিদের সাহস ও সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে এবং এভাবে অন্যের হাত দিয়েই হেফাজতের খেলাফত প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সবার অজান্তে নিরবেই এগুচ্ছে। খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক, মামুনুল হকের এই ঘটনায় সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে- এখন ইসলামপন্থিরা বলা শুরু করেছে যে, মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় ও দোষ গোপন রাখতে হবে এবং ব্যক্তি জীবনের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের কথা এখন হেফাজতে ইসলামেরও স্লোগান।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আড়িপাতায় বিপর্যস্ত হেফাজতে ইসলাম এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২১

বাংলাদেশে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক সম্প্রতি এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকায় অবস্থিত রয়েল রিসোর্টে উঠে একটি রুম ভাড়া নেন। স্থানীয় কিছু সাংবাদিক এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা মামুনুল হককে কয়েক ঘণ্টা সেখানে অবরুদ্ধ করে তার সঙ্গে ভদ্রমহিলার পরিচয় জানতে চান। মামুনুল হক বলেছেন যে, তার সঙ্গে অবস্থানকারী ভদ্রমহিলা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিলেও মামুনুল হক তার নাম বলেছেন আমেনা তৈয়বা, তার প্রথম স্ত্রীর নাম। রিসোর্টের রেজিস্টারেও তিনি তার প্রথমা স্ত্রীর নাম লিখেছেন। রিসোর্টে নিলেন জান্নাত আরা ঝর্ণাকে, নাম লিখলেন আমেনা তৈয়বা।

প্রথম বউ আমেনা তৈয়বাকে মামুনুল হক ফোনে আশ্বস্ত করে বলেছেন, রিসোর্টের ভদ্রমহিলা ‘শহীদুল ভাইয়ের স্ত্রী’, তার স্ত্রী নয়। মামুনুল হকের বোনও আমেনা তৈয়বাকে একই কথা বলেছেন। ভিডিওতে ঘটনাটি প্রচারিত হওয়ায় মামুনুলের বোনও তার ভাইকে বাঁচাতে প্রথম স্ত্রী আমেনা তৈয়বাকে অনুরোধ করেছেন; বোন আমেনা তৈয়বাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ঝর্ণা মামুনুলের বউ নয়, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে যে, ঝর্ণা যে মামুনুলের বউ তিনি তা আগে থেকেই জানেন। বউ না হওয়া সত্ত্বেও বউ বলতে হবে, মামুনুল হকও তাই বলে যাচ্ছেন। বউ বউ খেলা নিয়ে যে সত্য-মিথ্যার জালবিস্তার তা জাস্টিফাই করতে মামুনুল হক বলেছেন, স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য, খুশি করবার জন্য প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে সত্যকে গোপন করার অবকাশ রয়েছে। ঠিকই বলেছেন, হাদিস অনুযায়ী বউকে খুশি রাখার জন্য মিথ্যা বলার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়ালো জান্নাত আরা ঝর্ণার ডাইরি। ডাইরিতে ঝর্ণা উল্লেখ করেছেন, মামুনুল হকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি, বিয়ের প্রলোভন দিয়ে মামুনুল হক সাহেব তার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বান্ধবীকে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার পথে রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মামুনুল হকের মতো বিপদে পড়েছিলেন। সঙ্গে বান্ধবী থাকায় দুর্ঘটনাস্থলে নিজেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে পরিচয় দেননি, ফলে হেনস্তায় পড়তে হয়। কক্সবাজার গিয়ে মামুনুল হক সাহেবের মতো হোটেলে ভুয়া নাম লিখে দ্বিতীয়বার বিপদে পড়েন। তিনি কক্সবাজার রওনা দেয়ার আগে ওখানকার বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক ম্যানেজারকে পরদিন তার হোটেলে গাড়ি পাঠাতে অনুরোধ করেন, পরদিন ড্রাইভার গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে আর খুঁজে পান না; হোটেলের রেজিস্টারে কর্মকর্তার নাম নেই। অথচ ম্যানেজার সাহেব ফোন করে নিশ্চিত হন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ওই হোটেলেই আছেন, তবে ভিন্ন নামে।

বিয়ে রেজিস্ট্রি না করে মামুনুল হক সাহেব শরিয়তবিরোধী কোন কাজ করেননি; কারণ ইসলামে বিয়ে রেজিস্ট্রি করার কোন বিধান নেই, এটা মনুষ্য সৃষ্ট বিধান। কবিননামা যারা চেয়েছেন তাদের জানা উচিত, বিয়ে রেজিস্ট্রি হলেও কেউ কাবিননামা নিয়ে রাস্তায় বের হন না। আমরা যারা আইন মেনে বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছি তারাও কাবিনানামার খোঁজ রাখি না। তবে ধর্ম অনুযায়ী সাক্ষী থাকতে হবে। অভিভাবকের অগোচরে গোপনে বিয়ে করা সম্পর্কে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারি বলেছেন, গোপনে বিয়ে করা বা বিয়ে গোপন রাখা ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী কঠিন অপরাধ, তা বিয়ে নয়, জেনার সামিল। দুই বছর বিয়ে গোপন রেখে মামুনুল হক কোন মাত্রার অপরাধ করেছেন তা আজহারি সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী আলমগণ নিরূপণ করতে পারেন।

জান্নাত আরা ঝর্ণা এবং মামুনুল হককে নিয়ে যাবতীয় ফোনালাপ, ভিডিও ইত্যাদি বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে তার সমর্থকরা প্রচার করছেন। তবুও সবাই যা জানতে পেরেছে তা হলো, জান্নাত আরা ঝর্ণার প্রথম স্বামী হাফেজ জাফর শহীদুল মামুনুল হকের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু; ঝর্ণার সঙ্গে তার স্বামী শহীদুলের মনোমালিন্য সৃষ্টিতে মামুনুল হক ইন্ধন জুগিয়েছেন। হাফেজ শহীদুল ঝর্ণাকে তালাক দেয়ার পর তার অসহায়ত্বের সুযোগে মামুনুল হক ঝর্ণার ঘনিষ্ঠ হন। এই অবস্থায় মামুনুল হক বেগানা নারী ঝর্ণাকে বিয়ে করে বৈধ করে নেন। কিন্তু বৈধ করার আগে বেগানা নারীর সঙ্গে কথাবার্তা বলা, মেলামেশা করা, বিপদে-আপদে সহায়তা করার মধ্যে শরিয়তের বরখেলাপ হয়েছে কী না তা আলেম সমাজ ভালো বুঝবেন।

পাশ্চাত্য সমাজে এই সব ঝামেলা নেই। বরিস জনসন এবং তার বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডস হচ্ছেন ব্রিটেনের ডাউনিং স্ট্রিটের প্রথম অবিবাহিত যুগল। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বিয়ে না করেই বসবাস করছেন তার বান্ধবীর সঙ্গে, সম্প্রতি তাদের একটি সন্তানও হয়েছে এবং ব্রিটেনবাসী নবজাতককে শুভেচ্ছাও জানিয়েছে। কেউ শিশুটিকে আমাদের মতো জারজ বলছে না, বিয়ে না করে বেগানা নারীর সঙ্গে একই বিছানায় থাকার জন্য জনসনকে ইংল্যান্ডবাসী ভোট কম দেয়নি। অনেক মুসলমানও তাকে ভোট দিয়েছেন, জনসনের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনায় মুসলমানরা অংশ নিচ্ছেন। এমন কি দারুল হারব দেশ ব্রিটেনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে মুসলমানেরা স্থায়ী বসতি স্থাপনের জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দিচ্ছে। বিশ্বের সেরা ফুটবলার আর্জেন্টিনার দিয়েগো মেরাডোনা তার চার চারটি সন্তান হওয়ার পর সন্তানের মাকে বিয়ে করেন। অথচ এই মেরাডোনার প্রতি এদেশের মুসলমানরা কত উচ্চকিত। তাহলে মামুনুল হকের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মামুনুল হক তো বরিস জনসন বা মেরাডোনার চেয়ে বেশি অপরাধ করেননি। ক্ষোভের কারণ, মামুনুল হক সারা জীবন বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্কের লোকগুলোকে মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারতে চেয়েছেন।

হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হকের এই ঘটনায় পক্ষ-বিপক্ষের সব মুসলিম আহত হয়েছেন। যারা তার পক্ষের লোক তাদের দৃঢ় বিশ্বাস রিসোর্টের ঘটনাটি ষড়যন্ত্র; এরা মনে করেন মামুনুল হককে এভাবে অপমান করে গোটা মুসলিম জনতাকে অপমান করা হয়েছে। অন্যদিকে যারা মামুনুল হকের বিপক্ষের তারাও মনে করেন যে, মামুনুল হকের এমন আচরণে ইসলামের মূল্যবোধের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস হ্রাস পাবে। দুই পক্ষই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব, মত প্রকাশে কেউ কারও প্রতি সামান্যতম সম্মানও দেখাচ্ছেন না।

রিসোর্টে মামুনুল হককে ঘেরাও দেয়া এবং ফোনালাপের তথ্য ফাঁস করা গর্হিত অপরাধ। কারও ব্যক্তিগত জীবনে দলবেঁধে চড়াও হওয়া আমাদের মতো পশ্চাৎপদ সমাজেই শুধু সম্ভব। ওঁৎপেতে কারও ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে হয়রানি করার অধিকার কারও থাকার কথা নয়, ব্যক্তিগত জীবনে এমনতর হস্তক্ষেপ কোন সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্যও নয়। এক্ষেত্রে মামুনুল হকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। আমাদের মতো অতি ঔৎসুক্য সমাজেই শুধু এমন অভব্য, অশালীন আচরণ সমর্থন করা হয়। সমাজ সমর্থন করে বলেই বহু বছর পূর্বে এক নব দম্পতিকে আশুলিয়ায় চাঁদাবাজ মাস্তানদের পিটুনিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে- তাদের অপরাধ বিয়ের কাবিন নিয়ে তারা ঘুরতে যায়নি।

পাশ্চাত্যে পরস্পরের সম্মতিতে বিবাহবহির্ভূত নারী-পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে আইনগত বা সামাজিক বাধা-বিপত্তি নেই। কিন্তু বিবাহবহির্ভূত মিলনে বড় অপরাধ হচ্ছে মিথ্যে বলা। মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কিন্তু বিচার হয়নি, বিচারে নিরূপণ করা হয়েছে ক্লিনটন কতটুকু মিথ্যে বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭৪ সনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আফিসে আড়িপাতার ঘটনার জন্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন; তিনি অপরাধ করেছিলেন মিথ্যে বলে; তিনি বলেছিলেন যে, আড়িপাতার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। মামুনুল হকও মিথ্যা বলেছেন। সত্য বা মিথ্যা যারই জয় হোক না কেন, মামুনুল হকদের ডিফেন্ড করার জন্য সমর্থক এবং ভক্তদের কখনও ঘাটতি হবে না। হেফাজতের নেতারা যেভাবে তাকে ব্যাকাপ দিচ্ছেন তাতে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মের চেয়ে রাজনীতি বড়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন হারালেও আওয়ামী বিরোধীরা এখন বিনাশর্তে হেফাজতিদের সাহস ও সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে এবং এভাবে অন্যের হাত দিয়েই হেফাজতের খেলাফত প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সবার অজান্তে নিরবেই এগুচ্ছে। খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক, মামুনুল হকের এই ঘটনায় সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে- এখন ইসলামপন্থিরা বলা শুরু করেছে যে, মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় ও দোষ গোপন রাখতে হবে এবং ব্যক্তি জীবনের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের কথা এখন হেফাজতে ইসলামেরও স্লোগান।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

back to top