alt

উপ-সম্পাদকীয়

স্মরণ : বোধিপাল মহাথেরো

বিপ্লব বড়ুয়া

: সোমবার, ২৬ জুলাই ২০২১
image

বোধিপাল মহাথেরো

বৌদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির কালজয়ী পুরুষ গবেষক ড. বোধিপাল মহাথেরো। ২০২০ সালের এই দিনে পরলোকের পথে অন্তিম যাত্রা করেন। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। স্মরণে-আবরণে, শোক-শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বিনম্র চিত্তে। পৃথিবীতে কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে যাদের প্রজ্ঞায় দশদিক আলোকিত হয়। তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব সদ্ধর্মসারথি পণ্ডিত বৌদ্ধ ভিক্ষু বোধিপাল মহাথেরো। চেনাজগতের শতসহস্র মানুষের ভিড়ে তিনি ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের একজন মানুষ। ব্যক্তি জীবন ছিল অতি সাধারণ। কর্মকুশলতায়, সদ্ধর্মচর্চা-আধুনিক বিজ্ঞান ভাবনায়, প্রজ্ঞা-মেধার বিচ্ছুরণে, সাহিত্যচর্চা-গবেষণায়, যুক্তি, বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী লেখা-বক্তৃতায়, সাংগঠনিক দক্ষতায়, সৃজনশীল ও মননশীলতায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়ে যুগে যুগে কালে কালে আদর্শিক বাতিঘর হিসেবে বিরাজ করবে এত কোন সন্দেহ নেই। ছিলেন সংস্কার অভিলাষী, অন্ধকার থেকে আলোতে উত্তরণের দৃঢ় প্রত্যয়ী এক সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব। অনন্য প্রতিভার অধিকারী পণ্ডিত ড. বোধিপাল মহাথেরো ভোগ বিলাসিতার ঊর্ধ্বে উঠে অতি সাদামাটা জীবন প্রতিপালনে অভ্যস্ত ছিলেন। শরীরে অঙ্গসৌষ্টব্য, সৌম্যসুশ্রী অনিন্দ্য সুন্দর সদাহাস্যময় মুখাবয়ব অবলোকন করলেই যে কোন কারও মনে হতো তিনি একজন রাজপুত্র!

তার পৈত্রিক জন্মভূমি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলাস্থ বীর পটিয়ার পুণ্যস্থান ঊনাইনপুরা গ্রামে। বংশানুক্রমে তিনি ছিলেন বৌদ্ধ পণ্ডিতদের বংশধর। বোধিপাল মহাথেরোর পিতার নাম প্রদীপ রঞ্জন বড়–য়া, মাতার নাম কুমকুম বড়–য়া। ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম জাগরণের অগ্রদূত বৌদ্ধ ইতিহাসের প্রাচীনতম নন্দিত প্রতিষ্ঠান কলকাতা বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহার ও ধর্মাঙ্কুর সভার (বেঙ্গল বুড্ডিস্ট অ্যাসোসিয়েশন) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির ছিলেন তার বংশেরই পরম উত্তরসূরি এবং দাদু। তাই বোধিপালের অবিরত চিন্তা চেতনায় ছিল মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা শ্রদ্ধা সম্মান এবং দুঃখ মুক্তির অগনন প্রচেষ্টা।

তার জন্ম ২০ ডিসেম্বর ১৯৬৮ ইংরেজি। ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে এক মহাসন্ধিক ক্ষণে কলকাতা ধর্মাঙ্কুর বিহারে প্রব্যজ্যা নিয়ে শ্রামন্য জীবন শুরু করেন। একই বছর ২২ জুন শিলংয়ের ভদন্ত জিনরতন মহাথেরো, ভদন্ত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো সহ অন্যান্য পণ্ডিত ভিক্ষুদের উপস্থিতিতে কর্মবীর ধর্মপাল মহাথেরোর নিকট উপসম্পদা লাভ করেন। বৌদ্ধ সন্যাসী হিসেবে জীবন ধারণের পর বৌদ্ধধর্ম চর্চা, গবেষণা আচরণে নিবিষ্ট থেকে মানবমুক্তির দুঃখ লাগবের চেষ্টায় নেমে পড়েন অসাধ্য সাধনে। ধর্ম আহরণ ও বিতরণে ভারত বর্ষের নানা প্রান্তে ঘুরেছেন। যেমনি ঘুরেছিলেন কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির থেকে সংঘনায়ক কর্মবীর ধর্মপাল মহাথের, বাবাসাহেব আম্বেদকর, বিদকুাচার্য রাষ্ট্রপাল মহাথেরো’র ন্যায়। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নবরূপে, নবসাজে বৌদ্ধধর্মে বীজ বপন করছিলেন। ভিক্ষু হওয়ার কিছুদিন পর বুদ্ধগয়া রাষ্ট্রপাল মহাথেরো প্রতিষ্ঠিত ইন্টার ন্যাশনাল মেডিটেশন সেন্টার বুদ্ধগয়ায় অবস্থান করে রাষ্ট্রপাল মহাথেরোর কাছ থেকে ধর্ম বিনয়চর্চা শিক্ষার ওপর নানাবিধ জ্ঞান অর্জন করেন এবং সেখানে থেকেই “মগদ বিশ^বিদ্যালয়” থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। শিলংয়ের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিদ্যাপীঠ “সেন্ট পিটার্স স্কুল” এ শৈশবের শিক্ষাপাঠ নিয়েছেন। এরপর “ব্রুকসাইড অ্যাডভেন্টিস্ট স্কুল” থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। “রেইড ল্যাবেন” কলেজ থেকে বাণিজ্য বিষয়ে নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে বিহার প্রদেশে অবস্থিত “মগধ বিশ^বিদ্যালয়” থেকে বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিষয়ের ওপর স্বর্ণপদক নিয়ে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। এমএ’তে অসাধারণ ফলাফল করার কারণে সেই বিশ^দ্যিালয়ে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি একই বিষয়ের ওপর পিএইচডি (ডক্টরেট) ডিগ্রি অর্জন করেন।

সাহিত্য, সৃজনশীলতায় ড. বোধিপাল অনন্য স্বাক্ষর রেখেছেন। এই অনন্য প্রতিভাধর দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থান এবং বিভিন্ন জার্নাল, স্যুভেনিরে তার বহু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেছেন স্মারক গ্রন্থও। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বুদ্ধগয়ার প্রধান টেম্পল থেকে প্রকাশিত “প্রজ্ঞা”সহ একাধিক প্রকাশনা, ভারতীয় সংঘরাজ রাষ্ট্রপাল মহাথেরো স্মারক প্রকাশনা “ধম্মপভা”, ভারতে বড়ুয়া সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রকাশনা, বেঙ্গল বুড্ডিস্ট অ্যাসোসিয়েশন কলকাতার নিউজ লেটার “ধর্মাঙ্কুর”এবং ‘‘জগজ্জ্যোতি”সহ একাধিক প্রকাশনার সদস্য ও সম্পাদক ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ সংস্কৃতির পুনর্জন্ম পাওয়া ফুল চন্দ্র বড়–য়া, স্যার এডুইন আর্নল্ড, অনাগারিক ধর্মপাল এবং কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবিরকে নিয়ে তার একটি গ্রন্থ রয়েছে। “বুদ্ধ বন্দনা” নামের অপর একটি গ্রন্থ যেটি বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল।

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ২০০০ সালে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত “ওয়ার্ল্ড পিস সামিট”, ২০০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অব বুড্ডিস্ট, ২০১৬ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত “ভেসাক ডে”, সীতাগু ইন্টারন্যাশনাল বুড্ডিস্ট একাডেমি, মায়ানমারে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সম্মেলন ছাড়াও বহুদেশে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

এই বৌদ্ধ ব্যক্তিত্ব দেশি-বেদেশি বিভিন্ন সংগঠন থেকে অসংখ্য সংবর্ধনা-সম্মাননা লাভ করেন। ভিক্ষু করুনাশাস্ত্রী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “আন্তর্জাতিক ব্রাদারহুড মিশন” ডিব্রুগড় আসাম থেকে “ধম্মনিধি” সম্মাননা, ওয়ার্ল্ড বুড্ডিস্ট ফেলোশিপ কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে “ওয়ার্ল্ড বুড্ডিস্ট আউট স্ট্যান্ডিং লিডার অ্যাওয়ার্ড”, থাইল্যান্ডের বুড্ডিস্ট সুপ্রিম সংঘ কাউন্সিল থেকে রাজকীয় সম্মাননা, ড. বুদ্ধপ্রিয় মহাথেরো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “সিদ্ধার্থ ইউনাইটেড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার মিশন” কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সমাজসেবা পুরস্কার, “সংঘরাজ পুর্ণাচার ভিক্ষু সংসদ” পটিয়া চট্টগ্রাম কর্তৃক সম্মাননা, “বুদ্ধভারতী” শিলিগুড়ি থেকে “পিস অ্যাওয়ার্ড।

২০২০ সালের শুরুতে করোনা যখন প্রকোপ আকার ধারণ করে একই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় “আম্পান” এর শক্তিশালী আঘাতে সাধারণ মানুষ বাড়িঘর হারা হয়ে যায় তখন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণসামগ্রী দিয়ে হাজার হাজার অসচ্ছল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ কাভার দিয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রায় ৬০টিরও বেশি বৌদ্ধ বিহার ও অসংখ্য হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশে তার হয়ে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন তরুণ সাংঘিক ব্যক্তিত্ব ভদন্ত অক্ষয়ানন্দ ভিক্ষু। এসময় দেশে প্রবল বন্যা দেখা দেয়। একদিকে করোনার প্রবল প্রতাপ অন্যদিকে বন্যা ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজ কাঁধে বহন করে বিহার থেকে বিহারে ভিক্ষুদের জন্য খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছিলেন এই ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে তখন অনেকের বিবেক নাড়া দিয়েছিল। এযেন আরেক কর্মবীরের সাহসী পদক্ষেপের অংশবিশেষ স্বচোক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম। এই কর্মবীরের প্রতি স্যালুট জানাই।

মানবতাবাদী ড. বোধিপাল একজন সাধারণ বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে লাখ লাখ টাকার ত্রাণ দেয়ার নজরকারা এক ইতিহাস সৃষ্টি করে গেলেন। এছাড়া ভারত-বাংলাদেশের বহু বিহারে তিনি লাখ লাখ টাকা দান দিয়ে বিহার নির্মাণে সহায়তা করেছেন, যা নমস্য ও স্মরণীয়।

২০২০ সালের ২৭ জুলাই বিশ্বব্যাপী লাখো-কোটি ভক্ত অনুরাগীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে মাত্র ৫১ বছর বয়সে কলকাতার “আমরি” হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

স্মরণ : বোধিপাল মহাথেরো

বিপ্লব বড়ুয়া

image

বোধিপাল মহাথেরো

সোমবার, ২৬ জুলাই ২০২১

বৌদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির কালজয়ী পুরুষ গবেষক ড. বোধিপাল মহাথেরো। ২০২০ সালের এই দিনে পরলোকের পথে অন্তিম যাত্রা করেন। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। স্মরণে-আবরণে, শোক-শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বিনম্র চিত্তে। পৃথিবীতে কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে যাদের প্রজ্ঞায় দশদিক আলোকিত হয়। তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব সদ্ধর্মসারথি পণ্ডিত বৌদ্ধ ভিক্ষু বোধিপাল মহাথেরো। চেনাজগতের শতসহস্র মানুষের ভিড়ে তিনি ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের একজন মানুষ। ব্যক্তি জীবন ছিল অতি সাধারণ। কর্মকুশলতায়, সদ্ধর্মচর্চা-আধুনিক বিজ্ঞান ভাবনায়, প্রজ্ঞা-মেধার বিচ্ছুরণে, সাহিত্যচর্চা-গবেষণায়, যুক্তি, বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী লেখা-বক্তৃতায়, সাংগঠনিক দক্ষতায়, সৃজনশীল ও মননশীলতায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়ে যুগে যুগে কালে কালে আদর্শিক বাতিঘর হিসেবে বিরাজ করবে এত কোন সন্দেহ নেই। ছিলেন সংস্কার অভিলাষী, অন্ধকার থেকে আলোতে উত্তরণের দৃঢ় প্রত্যয়ী এক সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব। অনন্য প্রতিভার অধিকারী পণ্ডিত ড. বোধিপাল মহাথেরো ভোগ বিলাসিতার ঊর্ধ্বে উঠে অতি সাদামাটা জীবন প্রতিপালনে অভ্যস্ত ছিলেন। শরীরে অঙ্গসৌষ্টব্য, সৌম্যসুশ্রী অনিন্দ্য সুন্দর সদাহাস্যময় মুখাবয়ব অবলোকন করলেই যে কোন কারও মনে হতো তিনি একজন রাজপুত্র!

তার পৈত্রিক জন্মভূমি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলাস্থ বীর পটিয়ার পুণ্যস্থান ঊনাইনপুরা গ্রামে। বংশানুক্রমে তিনি ছিলেন বৌদ্ধ পণ্ডিতদের বংশধর। বোধিপাল মহাথেরোর পিতার নাম প্রদীপ রঞ্জন বড়–য়া, মাতার নাম কুমকুম বড়–য়া। ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম জাগরণের অগ্রদূত বৌদ্ধ ইতিহাসের প্রাচীনতম নন্দিত প্রতিষ্ঠান কলকাতা বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহার ও ধর্মাঙ্কুর সভার (বেঙ্গল বুড্ডিস্ট অ্যাসোসিয়েশন) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির ছিলেন তার বংশেরই পরম উত্তরসূরি এবং দাদু। তাই বোধিপালের অবিরত চিন্তা চেতনায় ছিল মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা শ্রদ্ধা সম্মান এবং দুঃখ মুক্তির অগনন প্রচেষ্টা।

তার জন্ম ২০ ডিসেম্বর ১৯৬৮ ইংরেজি। ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে এক মহাসন্ধিক ক্ষণে কলকাতা ধর্মাঙ্কুর বিহারে প্রব্যজ্যা নিয়ে শ্রামন্য জীবন শুরু করেন। একই বছর ২২ জুন শিলংয়ের ভদন্ত জিনরতন মহাথেরো, ভদন্ত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো সহ অন্যান্য পণ্ডিত ভিক্ষুদের উপস্থিতিতে কর্মবীর ধর্মপাল মহাথেরোর নিকট উপসম্পদা লাভ করেন। বৌদ্ধ সন্যাসী হিসেবে জীবন ধারণের পর বৌদ্ধধর্ম চর্চা, গবেষণা আচরণে নিবিষ্ট থেকে মানবমুক্তির দুঃখ লাগবের চেষ্টায় নেমে পড়েন অসাধ্য সাধনে। ধর্ম আহরণ ও বিতরণে ভারত বর্ষের নানা প্রান্তে ঘুরেছেন। যেমনি ঘুরেছিলেন কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির থেকে সংঘনায়ক কর্মবীর ধর্মপাল মহাথের, বাবাসাহেব আম্বেদকর, বিদকুাচার্য রাষ্ট্রপাল মহাথেরো’র ন্যায়। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নবরূপে, নবসাজে বৌদ্ধধর্মে বীজ বপন করছিলেন। ভিক্ষু হওয়ার কিছুদিন পর বুদ্ধগয়া রাষ্ট্রপাল মহাথেরো প্রতিষ্ঠিত ইন্টার ন্যাশনাল মেডিটেশন সেন্টার বুদ্ধগয়ায় অবস্থান করে রাষ্ট্রপাল মহাথেরোর কাছ থেকে ধর্ম বিনয়চর্চা শিক্ষার ওপর নানাবিধ জ্ঞান অর্জন করেন এবং সেখানে থেকেই “মগদ বিশ^বিদ্যালয়” থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। শিলংয়ের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিদ্যাপীঠ “সেন্ট পিটার্স স্কুল” এ শৈশবের শিক্ষাপাঠ নিয়েছেন। এরপর “ব্রুকসাইড অ্যাডভেন্টিস্ট স্কুল” থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। “রেইড ল্যাবেন” কলেজ থেকে বাণিজ্য বিষয়ে নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে বিহার প্রদেশে অবস্থিত “মগধ বিশ^বিদ্যালয়” থেকে বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিষয়ের ওপর স্বর্ণপদক নিয়ে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। এমএ’তে অসাধারণ ফলাফল করার কারণে সেই বিশ^দ্যিালয়ে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি একই বিষয়ের ওপর পিএইচডি (ডক্টরেট) ডিগ্রি অর্জন করেন।

সাহিত্য, সৃজনশীলতায় ড. বোধিপাল অনন্য স্বাক্ষর রেখেছেন। এই অনন্য প্রতিভাধর দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থান এবং বিভিন্ন জার্নাল, স্যুভেনিরে তার বহু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেছেন স্মারক গ্রন্থও। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বুদ্ধগয়ার প্রধান টেম্পল থেকে প্রকাশিত “প্রজ্ঞা”সহ একাধিক প্রকাশনা, ভারতীয় সংঘরাজ রাষ্ট্রপাল মহাথেরো স্মারক প্রকাশনা “ধম্মপভা”, ভারতে বড়ুয়া সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রকাশনা, বেঙ্গল বুড্ডিস্ট অ্যাসোসিয়েশন কলকাতার নিউজ লেটার “ধর্মাঙ্কুর”এবং ‘‘জগজ্জ্যোতি”সহ একাধিক প্রকাশনার সদস্য ও সম্পাদক ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ সংস্কৃতির পুনর্জন্ম পাওয়া ফুল চন্দ্র বড়–য়া, স্যার এডুইন আর্নল্ড, অনাগারিক ধর্মপাল এবং কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবিরকে নিয়ে তার একটি গ্রন্থ রয়েছে। “বুদ্ধ বন্দনা” নামের অপর একটি গ্রন্থ যেটি বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল।

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ২০০০ সালে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত “ওয়ার্ল্ড পিস সামিট”, ২০০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অব বুড্ডিস্ট, ২০১৬ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত “ভেসাক ডে”, সীতাগু ইন্টারন্যাশনাল বুড্ডিস্ট একাডেমি, মায়ানমারে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সম্মেলন ছাড়াও বহুদেশে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

এই বৌদ্ধ ব্যক্তিত্ব দেশি-বেদেশি বিভিন্ন সংগঠন থেকে অসংখ্য সংবর্ধনা-সম্মাননা লাভ করেন। ভিক্ষু করুনাশাস্ত্রী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “আন্তর্জাতিক ব্রাদারহুড মিশন” ডিব্রুগড় আসাম থেকে “ধম্মনিধি” সম্মাননা, ওয়ার্ল্ড বুড্ডিস্ট ফেলোশিপ কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে “ওয়ার্ল্ড বুড্ডিস্ট আউট স্ট্যান্ডিং লিডার অ্যাওয়ার্ড”, থাইল্যান্ডের বুড্ডিস্ট সুপ্রিম সংঘ কাউন্সিল থেকে রাজকীয় সম্মাননা, ড. বুদ্ধপ্রিয় মহাথেরো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “সিদ্ধার্থ ইউনাইটেড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার মিশন” কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সমাজসেবা পুরস্কার, “সংঘরাজ পুর্ণাচার ভিক্ষু সংসদ” পটিয়া চট্টগ্রাম কর্তৃক সম্মাননা, “বুদ্ধভারতী” শিলিগুড়ি থেকে “পিস অ্যাওয়ার্ড।

২০২০ সালের শুরুতে করোনা যখন প্রকোপ আকার ধারণ করে একই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় “আম্পান” এর শক্তিশালী আঘাতে সাধারণ মানুষ বাড়িঘর হারা হয়ে যায় তখন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণসামগ্রী দিয়ে হাজার হাজার অসচ্ছল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ কাভার দিয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রায় ৬০টিরও বেশি বৌদ্ধ বিহার ও অসংখ্য হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশে তার হয়ে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন তরুণ সাংঘিক ব্যক্তিত্ব ভদন্ত অক্ষয়ানন্দ ভিক্ষু। এসময় দেশে প্রবল বন্যা দেখা দেয়। একদিকে করোনার প্রবল প্রতাপ অন্যদিকে বন্যা ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজ কাঁধে বহন করে বিহার থেকে বিহারে ভিক্ষুদের জন্য খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছিলেন এই ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে তখন অনেকের বিবেক নাড়া দিয়েছিল। এযেন আরেক কর্মবীরের সাহসী পদক্ষেপের অংশবিশেষ স্বচোক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম। এই কর্মবীরের প্রতি স্যালুট জানাই।

মানবতাবাদী ড. বোধিপাল একজন সাধারণ বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে লাখ লাখ টাকার ত্রাণ দেয়ার নজরকারা এক ইতিহাস সৃষ্টি করে গেলেন। এছাড়া ভারত-বাংলাদেশের বহু বিহারে তিনি লাখ লাখ টাকা দান দিয়ে বিহার নির্মাণে সহায়তা করেছেন, যা নমস্য ও স্মরণীয়।

২০২০ সালের ২৭ জুলাই বিশ্বব্যাপী লাখো-কোটি ভক্ত অনুরাগীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে মাত্র ৫১ বছর বয়সে কলকাতার “আমরি” হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top