শেখর ভট্টাচার্য
দেশের প্রতিটি মানুষ করোনা অতিমারির কারণে বিষণ্ন মনে দিনযাপন করছেন, এ রকম যারা ভাবছেন তারা কিছুটা ভুল ভাবছেন। লকডাউন যখন শুরু হলো, বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, কিছু কিছু মানুষের মনে উৎসবের ভাব। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান বা ভারতের ক্রিকেট সূচি নির্ধারিত হওয়ার পর যেমন আকুল আগ্রহ নিয়ে খেলা পাগল মানুষ অপেক্ষা করে খেলা শুরুর দিনের জন্য, ঠিক একই রকম তারা অপেক্ষা করেছিলেন লকডাউন শুরুর দিনের জন্য। উপভোগ করবেন, লকডাউন বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করবেন। এ রকম দুজন, লকডাউন দর্শকের কথোপকথন শুনুন:
একজন বলছেন, ‘আমি তো লকডাউন দেখতে বাইর হইছি, তা’ আপনি কোন জরুরি কাজে বের হইছেন ভাই? দ্বিতীয় জন উত্তর দিচ্ছেন, খুবই জরুরি কাজ ভাই। বউ শখ করেছে হালকা পেঁয়াজ কালারের শাড়ি লাগবে তার। সঙ্গে আবার ম্যাচ করা ব্লাউজ। রেডিমেড পাওয়া না গেলে পেঁয়াজ কালারের ব্লাউজের কাপড় হলে চলবে। ভাই, শাড়ি, ব্লাউজ নিয়ে না গেলে, সংসারে অশান্তি হবে। “প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে সমর্থন করে বলছেন, সত্যিই তো ভাই। করোনা হউক আর যাই হউক সংসার তো টিকাইয়া রাখতে হবে।”
এই কথোপকথন ঢাকার একটি সংবাদপত্র থেকে সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুর দিকে। আমার এক জ্যেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ভাইকে এই কথোপকথনগুলো শুনিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনে, ভারি কণ্ঠে তার মতামত জানালেন, বাঙালি বীর, রসিক, কৌতূহল প্রবণ এবং স্ত্রীভক্ত জাতি। আমি বাঙালি সম্পর্কে এতোগুলো ব্যাখ্যা জেনে আর তাকে ঘাটাতে চাইনি। আমাদের আগ্রহ, কৌতূহল, উৎসাহ সীমাহীন। রাস্তার পাশে দুটি পক্ষে তুচ্ছ্ব কারণে যখন ঝগড়া কিংবা মারামারি করতে থাকেন, অফিস টাইম কিংবা হাসপাতালে রোগী দেখার পরিকল্পনা থাকলেও বাঙালি নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে ঝগড়া উপভোগ করে অপার আনন্দ পায়। খুব কম মানুষ, ঝগড়া থামানোর উদ্যোগ নিতে অগ্রসর হন, অধিকাংশ একটু বড় কা- ঘটার অপেক্ষায় থাকেন। দেখা, জানা এবং বোঝার জন্য আমাদের আগ্রহ অপরিসীম। প্রত্যেক বাঙালি এক একজন সক্রেটিস কিংবা কান্টের মতো দার্শনিক। জগত সংসারের বিশেষ করে আশেপাশের সব কিছু তাদের অন্তরঙ্গম (!) করতে হবে। লিখতে লিখতে মনে হলো, এক্ষেত্রে হৃদয়ঙ্গম থেকে অন্তরঙ্গম শব্দটি বেশি প্রযোজ্য! তবে সক্রেটিসের মূল কথাটিকে বাঙালি তেমন পাত্তা দেয় না। তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, “নিজেকে জানো” বা নো দাইসেলফ। নিজেকে বাঙালি এতো ভালো জানে যে নিজের ব্যাপারে জানতে গিয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় বাঙালির হাতে খুব কম।
আর একটি উদাহরণ দেই দ্বিতীয় ঢেউ যখন প্রথম পর্যায়ে ভারতীয় সীমান্ত থেকে দ্রুতগতিতে দেশের দশ দিকে (ঊর্ধ্ব, অধঃসহ, এই দুই দিককে বড় অবহেলা আমাদের!) ছড়াচ্ছে এবং প্রতিদিন মৃত্যু এবং সংক্রমণের রেকর্ড ভাঙছে তখন সীমিত লকডাউন, কঠোর বিধিনিষেধ, কঠোর লকডাউন, শাটডাউন এসব নানা নামে লকডাউন বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু হলো। জুনের ২৮ তারিখে বিচিত্র সীমিত নামে এ পর্যায়ের লকডাউনের সূচনা ঘটে। এ সময় সরকার সিদ্ধান্ত নিলো, যারা বাড়ি থেকে বের হবেন তারা যথাযথ কারন দেখিয়ে মুভমেন্ট কার্ড নিয়ে বের হবেন। মুভমেন্ট কার্ড বাঙালিকে স্বর্গারোহনের সুযোগ করে দিল। মানুষ হামলে পড়লো মুভমেন্ট কার্ড সংগ্রহের জন্য।
ভেবে দেখুন, ৩৩ ঘণ্টায় লকডাউন ছাড়াও কি ৭ কোটি মানুষের পক্ষে মুভ করা সম্ভব? সম্ভব না হলেও সব সম্ভবের এই দেশে তা-ই ঘটেছিল। কারণ আমাদের অভ্যাস হলো থানার পাশ দিয়েই যখন যাচ্ছি তখন একটা মামলা ঠুকে যাই না কেন! মুভমেন্টের দরকার থাক কিংবা না থাক নিয়ে রাখি, তা না হলে পরে শেষ হয়ে যেতে পারে। এমন চিন্তা থেকেও হয়তো অনেকে হিট করেছেন। আবার কিছু মানুষ হিট করেছেন অন্যজনকে দেখে। কিন্তু যেভাবেই হোক মুভমেন্ট পাশ মানুষকে বেশ আকর্ষণ করতে পেরেছে। তাই জরুরি প্রয়োজনের এ পাশের জন্য মানুষ বিনা প্রয়োজনেই আবেদন করেছেন। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে শিং মাছ কেনার জন্য উত্তরা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের মালিবাগ বাজারে আসতে মুভমেন্ট পাসের ব্যবহার! ডি এল রায়ের নাটক চন্দ্রগুপ্তে মহাবীর আলেকজান্ডারের সেই যুগোত্তীর্ণ বহুল ব্যবহৃত সংলাপে বিস্ময় প্রকাশ করতে হয়, ‘সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ।
এতটুকু লেখার পর মনে হলো, পাঠকেরা হয়তো, আমাকে ভুল বুঝবেন। অনুভুতিহীন, নির্দয় বলেও চিহ্নিত করতে পারেন। প্রতিদিন যখন গড়ে ২০০ মানুষ মারা যাচ্ছেন, ১০ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন এই অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে তখন, এ ধরনের হালকা চালের কথা কিংবা লেখা নিশ্চয় কোন দায়িত্বশীল কিংবা সংবেদনশীল মানুষের কাজ নয়। মহামতি শেক্সপিয়র তার ম্যাকবেথ নাটকে একটি সংলাপ ব্যবহার করেছিলেন, নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র সেনাপতি ম্যাকবেথের মুখ দিয়ে। কৃতকর্মের জটিলতায় অসহায়, অস্থির ম্যাকবেথ বলছেন, “জীবন একটি অর্থ হীন বোকার বানানো গল্প”। মহামারির অস্থির এ সময়ে আমাদের অনেকেরই মানসিক বিপর্যয় ঘটছে। বিশেষ করে আশপাশের মানুষের কা-জ্ঞানহীন আচরণের জন্যে, তা ঘটা খুব স্বাভাবিক। আপনি যখন শুনবেন এবং দেখবেন, সংক্রমণের এই ভয়াবহ সময়ে “ফেরিতে, নৌকায়, লঞ্চে “তিল ঠাঁই আর নাহিরে” তখন দুঃখের মধ্যেও আপনি দিশাহারা হয়ে পড়বেন। আমরা জানি, সারা দেশের বড় বড় হাসপাতালের শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। যশোর হাসপাতালের মতো কিছু হাসপাতালে রাস্তায়, গাছের নিচে রোগীকে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এ রকম সময়ে সামান্য কা-জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ নিজেকে বাঁচানোর জন্য হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে এটাই আমরা আশা করি। জেনে শুনে বিষ পান করে কোন বুদ্ধিমান মানুষ? করোনা ভ্যাকসিনের পাইপলাইনে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন আছে, তা’ দেশে শিগগিরই পৌঁছার কোন সম্ভাবনা নেই। তাহলে আমরা কেন, আমাদের দেশীয় আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার সেই মহান বাণী, “চাচা আপন প্রাণ বাচাকে” অনুসরন করব না? আপনি সুরক্ষিত থাকলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে শুধু আপনারই উপকার করলেন না, আপনি যতই আত্মকেন্দ্রিক হোন, নিজে যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, অগোচরে আপনি আপনার সমাজ এবং দেশেরও কিছুটা উপকার করতে পারেন। পরের জন্য কস্মিনকালেও যদি কিছু না’ও করে থাকেন, তবে এই সুযোগে আপনি সমাজসেবক কিংবা দেশ সেবক হয়ে যেতে পারেন খুব সহজে।
লকডাউনের এ পর্যায়ে আমাদের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত যারা বিভিন্ন কারণে আয় রোজগারের পথ হারাচ্ছেন কিন্তু বাড়ি ভাড়াসহ যাবতীয় নির্ধারিত ব্যয় করে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের জীবনের গল্প আমরা তেমন জানতে পারছি না। তারা কোন প্রণোদনার আওতাতে নাই আবার প্রাণ গেলেও হাত পাতবেন না। তারা তাদের গল্প বলেও বেড়াচ্ছেন না লোকসমাজে। ঢাকা সহ বড় বড় শহরে অনেক বিপন্ন মানুষের গল্প আছে যা একটু চোখ মেলে তাকালে কিংবা কান পেতে থাকলে শুনতে পাওয়া যায়। আয় রোজগারহীন বিপন্ন এ সময়ে, অভিজাত এলাকা থেকে কেউ কেউ তুলনামুলক কম ভাড়ার অঞ্চলে চলে যাচ্ছেন অনেকে। কম ভাড়ার অঞ্চলে যখন টিকতে পারছেন না, তখন নিজেদের কিছু মূল্যবান গেরস্থালি জিনিসপত্র বিক্রি করে নীরবে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, গ্রামের বাড়িতে অথবা অনিশ্চিতের পথে। ছেলে, মেয়ের স্কুল, নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্নকে এই শহরে নীরবে ফেলে দিয়ে কোটি মানুষের ভিড়ে ঠিকানাহীন হয়ে যাচ্ছেন তারা অনেকেই। যাপিত জীবন যখন খুব স্বভাবিক ছিল, স্বপ্ন যখন শাখা, প্রশাখা বিস্তার করা শুরু করেছিল, এ রকম সময়ে স্বপ্নকে বিসর্জন দেয়া যে কত বড় মানসিক ধাক্কা তা শুধু তারাই জানেন যারা এই মহামারীকালে প্রাইভেট কোম্পানি কিংবা একান্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিহারা হয়ে নিজেদের কর্মস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন, শুধু তারা। আমাদের সংবাদ মাধ্যমে কেন জানি এ রকম হাজারো গল্পের কোনটিকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা একটি বড় প্রশ্ন বোধক চিহ্ন হয়ে থাকলো এই ক্রান্তি কালে, এই ক্ষতটি থেকে যাবে মহামারী উত্তরকালেও যখন মানুষ বিপন্ন সময় থেকে শিক্ষা নিতে চাইবে তখনও।
উন্নয়ন অধ্যয়নে একটি কথা বলা হয়, মানুষকে কখনও সচেতন করা যায় না। সচেতন করার নানা প্রচেষ্টা হয়তো আপনি গ্রহণ করতে পারেন কিন্তু ব্যক্তি মানুষকে তার পারিপার্শ্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকেই নিজে সচেতন করে তুলতে হবে। আমরা জানি জীবিকা হারানো বিপন্ন মানুষের কাছে সচেতন হওয়ার আহ্বান নিয়ে যেতে হলে তাকে প্রণোদনা দিতে হবে। সুরক্ষিত করার জন্য ভ্যাকসিন দিতে হবে। গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষ করোনার উপসর্গ নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। আমরা জানি করোনাভাইরাসের যেহেতু কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে, তাই নতুন নতুন ঢেউ আসতেই থাকবে। পরবর্তী প্রস্তুতি কী? মানুষকে যেমন সচেতন হতে হবে, পরিকল্পিত মাঠ হাসপাতালের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। চিকিৎসকদের চূড়ান্ত পর্যায়ের চিকিৎসা প্রদানের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। সম্ভাব্য বিপর্যয়ের নানা কল্পিত চিত্র ভেবে আগে থেকেই বের হওয়ার পথ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। আর এসব কিছুকে দক্ষভাবে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সব পর্যায়ে সবার সুসমন্বয়। সুসমন্বয় কীভাবে হবে তার জন্য চাই একটি মহাপরিকল্পনা বা মাস্টাপ্ল্যান। সব অংশীজন যখন সমন্বিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাবেন তখন আমরা সহজেই পাড়ি দিতে পারবো দুর্যোগের এই দুর্গম পথ। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে বিশেষ করে আমাদের তরুণদের। নজরুলের মতো সাহসী কণ্ঠে আমাদের নেতাদের ডাক দিতে হবে: ‘কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ/এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার”। এ তরী আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তরী।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
শেখর ভট্টাচার্য
বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১
দেশের প্রতিটি মানুষ করোনা অতিমারির কারণে বিষণ্ন মনে দিনযাপন করছেন, এ রকম যারা ভাবছেন তারা কিছুটা ভুল ভাবছেন। লকডাউন যখন শুরু হলো, বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, কিছু কিছু মানুষের মনে উৎসবের ভাব। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান বা ভারতের ক্রিকেট সূচি নির্ধারিত হওয়ার পর যেমন আকুল আগ্রহ নিয়ে খেলা পাগল মানুষ অপেক্ষা করে খেলা শুরুর দিনের জন্য, ঠিক একই রকম তারা অপেক্ষা করেছিলেন লকডাউন শুরুর দিনের জন্য। উপভোগ করবেন, লকডাউন বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করবেন। এ রকম দুজন, লকডাউন দর্শকের কথোপকথন শুনুন:
একজন বলছেন, ‘আমি তো লকডাউন দেখতে বাইর হইছি, তা’ আপনি কোন জরুরি কাজে বের হইছেন ভাই? দ্বিতীয় জন উত্তর দিচ্ছেন, খুবই জরুরি কাজ ভাই। বউ শখ করেছে হালকা পেঁয়াজ কালারের শাড়ি লাগবে তার। সঙ্গে আবার ম্যাচ করা ব্লাউজ। রেডিমেড পাওয়া না গেলে পেঁয়াজ কালারের ব্লাউজের কাপড় হলে চলবে। ভাই, শাড়ি, ব্লাউজ নিয়ে না গেলে, সংসারে অশান্তি হবে। “প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে সমর্থন করে বলছেন, সত্যিই তো ভাই। করোনা হউক আর যাই হউক সংসার তো টিকাইয়া রাখতে হবে।”
এই কথোপকথন ঢাকার একটি সংবাদপত্র থেকে সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুর দিকে। আমার এক জ্যেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ভাইকে এই কথোপকথনগুলো শুনিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনে, ভারি কণ্ঠে তার মতামত জানালেন, বাঙালি বীর, রসিক, কৌতূহল প্রবণ এবং স্ত্রীভক্ত জাতি। আমি বাঙালি সম্পর্কে এতোগুলো ব্যাখ্যা জেনে আর তাকে ঘাটাতে চাইনি। আমাদের আগ্রহ, কৌতূহল, উৎসাহ সীমাহীন। রাস্তার পাশে দুটি পক্ষে তুচ্ছ্ব কারণে যখন ঝগড়া কিংবা মারামারি করতে থাকেন, অফিস টাইম কিংবা হাসপাতালে রোগী দেখার পরিকল্পনা থাকলেও বাঙালি নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে ঝগড়া উপভোগ করে অপার আনন্দ পায়। খুব কম মানুষ, ঝগড়া থামানোর উদ্যোগ নিতে অগ্রসর হন, অধিকাংশ একটু বড় কা- ঘটার অপেক্ষায় থাকেন। দেখা, জানা এবং বোঝার জন্য আমাদের আগ্রহ অপরিসীম। প্রত্যেক বাঙালি এক একজন সক্রেটিস কিংবা কান্টের মতো দার্শনিক। জগত সংসারের বিশেষ করে আশেপাশের সব কিছু তাদের অন্তরঙ্গম (!) করতে হবে। লিখতে লিখতে মনে হলো, এক্ষেত্রে হৃদয়ঙ্গম থেকে অন্তরঙ্গম শব্দটি বেশি প্রযোজ্য! তবে সক্রেটিসের মূল কথাটিকে বাঙালি তেমন পাত্তা দেয় না। তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, “নিজেকে জানো” বা নো দাইসেলফ। নিজেকে বাঙালি এতো ভালো জানে যে নিজের ব্যাপারে জানতে গিয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় বাঙালির হাতে খুব কম।
আর একটি উদাহরণ দেই দ্বিতীয় ঢেউ যখন প্রথম পর্যায়ে ভারতীয় সীমান্ত থেকে দ্রুতগতিতে দেশের দশ দিকে (ঊর্ধ্ব, অধঃসহ, এই দুই দিককে বড় অবহেলা আমাদের!) ছড়াচ্ছে এবং প্রতিদিন মৃত্যু এবং সংক্রমণের রেকর্ড ভাঙছে তখন সীমিত লকডাউন, কঠোর বিধিনিষেধ, কঠোর লকডাউন, শাটডাউন এসব নানা নামে লকডাউন বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু হলো। জুনের ২৮ তারিখে বিচিত্র সীমিত নামে এ পর্যায়ের লকডাউনের সূচনা ঘটে। এ সময় সরকার সিদ্ধান্ত নিলো, যারা বাড়ি থেকে বের হবেন তারা যথাযথ কারন দেখিয়ে মুভমেন্ট কার্ড নিয়ে বের হবেন। মুভমেন্ট কার্ড বাঙালিকে স্বর্গারোহনের সুযোগ করে দিল। মানুষ হামলে পড়লো মুভমেন্ট কার্ড সংগ্রহের জন্য।
ভেবে দেখুন, ৩৩ ঘণ্টায় লকডাউন ছাড়াও কি ৭ কোটি মানুষের পক্ষে মুভ করা সম্ভব? সম্ভব না হলেও সব সম্ভবের এই দেশে তা-ই ঘটেছিল। কারণ আমাদের অভ্যাস হলো থানার পাশ দিয়েই যখন যাচ্ছি তখন একটা মামলা ঠুকে যাই না কেন! মুভমেন্টের দরকার থাক কিংবা না থাক নিয়ে রাখি, তা না হলে পরে শেষ হয়ে যেতে পারে। এমন চিন্তা থেকেও হয়তো অনেকে হিট করেছেন। আবার কিছু মানুষ হিট করেছেন অন্যজনকে দেখে। কিন্তু যেভাবেই হোক মুভমেন্ট পাশ মানুষকে বেশ আকর্ষণ করতে পেরেছে। তাই জরুরি প্রয়োজনের এ পাশের জন্য মানুষ বিনা প্রয়োজনেই আবেদন করেছেন। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে শিং মাছ কেনার জন্য উত্তরা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের মালিবাগ বাজারে আসতে মুভমেন্ট পাসের ব্যবহার! ডি এল রায়ের নাটক চন্দ্রগুপ্তে মহাবীর আলেকজান্ডারের সেই যুগোত্তীর্ণ বহুল ব্যবহৃত সংলাপে বিস্ময় প্রকাশ করতে হয়, ‘সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ।
এতটুকু লেখার পর মনে হলো, পাঠকেরা হয়তো, আমাকে ভুল বুঝবেন। অনুভুতিহীন, নির্দয় বলেও চিহ্নিত করতে পারেন। প্রতিদিন যখন গড়ে ২০০ মানুষ মারা যাচ্ছেন, ১০ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন এই অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে তখন, এ ধরনের হালকা চালের কথা কিংবা লেখা নিশ্চয় কোন দায়িত্বশীল কিংবা সংবেদনশীল মানুষের কাজ নয়। মহামতি শেক্সপিয়র তার ম্যাকবেথ নাটকে একটি সংলাপ ব্যবহার করেছিলেন, নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র সেনাপতি ম্যাকবেথের মুখ দিয়ে। কৃতকর্মের জটিলতায় অসহায়, অস্থির ম্যাকবেথ বলছেন, “জীবন একটি অর্থ হীন বোকার বানানো গল্প”। মহামারির অস্থির এ সময়ে আমাদের অনেকেরই মানসিক বিপর্যয় ঘটছে। বিশেষ করে আশপাশের মানুষের কা-জ্ঞানহীন আচরণের জন্যে, তা ঘটা খুব স্বাভাবিক। আপনি যখন শুনবেন এবং দেখবেন, সংক্রমণের এই ভয়াবহ সময়ে “ফেরিতে, নৌকায়, লঞ্চে “তিল ঠাঁই আর নাহিরে” তখন দুঃখের মধ্যেও আপনি দিশাহারা হয়ে পড়বেন। আমরা জানি, সারা দেশের বড় বড় হাসপাতালের শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। যশোর হাসপাতালের মতো কিছু হাসপাতালে রাস্তায়, গাছের নিচে রোগীকে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এ রকম সময়ে সামান্য কা-জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ নিজেকে বাঁচানোর জন্য হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে এটাই আমরা আশা করি। জেনে শুনে বিষ পান করে কোন বুদ্ধিমান মানুষ? করোনা ভ্যাকসিনের পাইপলাইনে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন আছে, তা’ দেশে শিগগিরই পৌঁছার কোন সম্ভাবনা নেই। তাহলে আমরা কেন, আমাদের দেশীয় আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার সেই মহান বাণী, “চাচা আপন প্রাণ বাচাকে” অনুসরন করব না? আপনি সুরক্ষিত থাকলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে শুধু আপনারই উপকার করলেন না, আপনি যতই আত্মকেন্দ্রিক হোন, নিজে যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, অগোচরে আপনি আপনার সমাজ এবং দেশেরও কিছুটা উপকার করতে পারেন। পরের জন্য কস্মিনকালেও যদি কিছু না’ও করে থাকেন, তবে এই সুযোগে আপনি সমাজসেবক কিংবা দেশ সেবক হয়ে যেতে পারেন খুব সহজে।
লকডাউনের এ পর্যায়ে আমাদের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত যারা বিভিন্ন কারণে আয় রোজগারের পথ হারাচ্ছেন কিন্তু বাড়ি ভাড়াসহ যাবতীয় নির্ধারিত ব্যয় করে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের জীবনের গল্প আমরা তেমন জানতে পারছি না। তারা কোন প্রণোদনার আওতাতে নাই আবার প্রাণ গেলেও হাত পাতবেন না। তারা তাদের গল্প বলেও বেড়াচ্ছেন না লোকসমাজে। ঢাকা সহ বড় বড় শহরে অনেক বিপন্ন মানুষের গল্প আছে যা একটু চোখ মেলে তাকালে কিংবা কান পেতে থাকলে শুনতে পাওয়া যায়। আয় রোজগারহীন বিপন্ন এ সময়ে, অভিজাত এলাকা থেকে কেউ কেউ তুলনামুলক কম ভাড়ার অঞ্চলে চলে যাচ্ছেন অনেকে। কম ভাড়ার অঞ্চলে যখন টিকতে পারছেন না, তখন নিজেদের কিছু মূল্যবান গেরস্থালি জিনিসপত্র বিক্রি করে নীরবে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, গ্রামের বাড়িতে অথবা অনিশ্চিতের পথে। ছেলে, মেয়ের স্কুল, নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্নকে এই শহরে নীরবে ফেলে দিয়ে কোটি মানুষের ভিড়ে ঠিকানাহীন হয়ে যাচ্ছেন তারা অনেকেই। যাপিত জীবন যখন খুব স্বভাবিক ছিল, স্বপ্ন যখন শাখা, প্রশাখা বিস্তার করা শুরু করেছিল, এ রকম সময়ে স্বপ্নকে বিসর্জন দেয়া যে কত বড় মানসিক ধাক্কা তা শুধু তারাই জানেন যারা এই মহামারীকালে প্রাইভেট কোম্পানি কিংবা একান্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিহারা হয়ে নিজেদের কর্মস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন, শুধু তারা। আমাদের সংবাদ মাধ্যমে কেন জানি এ রকম হাজারো গল্পের কোনটিকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা একটি বড় প্রশ্ন বোধক চিহ্ন হয়ে থাকলো এই ক্রান্তি কালে, এই ক্ষতটি থেকে যাবে মহামারী উত্তরকালেও যখন মানুষ বিপন্ন সময় থেকে শিক্ষা নিতে চাইবে তখনও।
উন্নয়ন অধ্যয়নে একটি কথা বলা হয়, মানুষকে কখনও সচেতন করা যায় না। সচেতন করার নানা প্রচেষ্টা হয়তো আপনি গ্রহণ করতে পারেন কিন্তু ব্যক্তি মানুষকে তার পারিপার্শ্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকেই নিজে সচেতন করে তুলতে হবে। আমরা জানি জীবিকা হারানো বিপন্ন মানুষের কাছে সচেতন হওয়ার আহ্বান নিয়ে যেতে হলে তাকে প্রণোদনা দিতে হবে। সুরক্ষিত করার জন্য ভ্যাকসিন দিতে হবে। গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষ করোনার উপসর্গ নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। আমরা জানি করোনাভাইরাসের যেহেতু কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে, তাই নতুন নতুন ঢেউ আসতেই থাকবে। পরবর্তী প্রস্তুতি কী? মানুষকে যেমন সচেতন হতে হবে, পরিকল্পিত মাঠ হাসপাতালের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। চিকিৎসকদের চূড়ান্ত পর্যায়ের চিকিৎসা প্রদানের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। সম্ভাব্য বিপর্যয়ের নানা কল্পিত চিত্র ভেবে আগে থেকেই বের হওয়ার পথ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। আর এসব কিছুকে দক্ষভাবে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সব পর্যায়ে সবার সুসমন্বয়। সুসমন্বয় কীভাবে হবে তার জন্য চাই একটি মহাপরিকল্পনা বা মাস্টাপ্ল্যান। সব অংশীজন যখন সমন্বিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাবেন তখন আমরা সহজেই পাড়ি দিতে পারবো দুর্যোগের এই দুর্গম পথ। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে বিশেষ করে আমাদের তরুণদের। নজরুলের মতো সাহসী কণ্ঠে আমাদের নেতাদের ডাক দিতে হবে: ‘কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ/এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার”। এ তরী আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তরী।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]