এম আর খায়রুল উমাম
করোনা মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ রসিকতা করে বলতো লকডাউন না বাঁশের নিচে হেডডাউন। সরকার লকডাউন ঘোষণা করলেই পাড়ার রাস্তায় আড়াআড়ি বাঁশ বেঁধে দেয়া হতো আর মানুষ বাঁশের নিচ দিয়ে যাতায়াত করতো। প্রথম ২-১ দিন লকডাউন মোটামুটিভাবে মানা হলেও তারপর আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেত। সিংহভাগ মানুষ লকডাউনের বিধিনিষেধ মান্য করতো না। এভাবে উপেক্ষার পরও মহামারির প্রথম ঢেউ দেশে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ দিনে দিনে নিয়ন্ত্রহীণ হয়ে পড়ছে বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়ার পর থেকে। মহামারি নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আনসার বাহিনী, র্যারের সঙ্গে এবার সেনাবাহিনীকে মাঠপর্যায়ে নামিয়ে প্রচেষ্টারত সরকার। তারপরও প্রতিদিন নতুন শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটা ক্ষেত্র থেকে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচারিত বার্তাগুলো মহামারির ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে যাতে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তার জন্য কাজ করে চলেছে। সরকারের প্রচারমুখী রাজনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন নিজেদের সামর্থ্য বৃদ্ধি করে পীড়িতদের চিকিৎসা সেবা এবং অনাহারি মানুষদের খাদ্য সহায়তা নিয়ে দ্বারে দ্বারে ফিরছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুধু নয় বিদেশে অবস্থান করা স্বজনরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই কঠোর লকডাউন পেয়ে গিয়েছিল ঈদের ছুটি।
দিনরাত এক করে ছুটে চলা মানবিক মানুষগুলো হঠাৎ ঈদের ছুটির পর কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন তা বর্তমান অবস্থায় অনুমান করতে ভীত হই। প্রায় সবকিছু স্বাভাবিক চলার ফলে একটা ছন্দপতন ঘটেছে তা বলাই বাহুল্য। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা না করে লকডাউনকে ঈদের ছুটি দেয়া যদি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের চাপে হয়ে থাকে তাহলে সরকার কোনভাবেই দায় এড়াতে পারবে না। প্রতিদিনকার মহামারীর পরিস্থিতির যে অবনতি হচ্ছে তারপর এমন ছুটি কি সত্যিই কাম্য ছিল। দেশে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করে চলেছে। তারপরও গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্লেষণে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতাই প্রকট হয়ে উঠছে। সরকার করোনা মোকাবেলায় জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দেবে তা নির্ধারণে ব্যর্থ হওয়ায় লকডাউন এখনো পর্যন্ত কার্যত কঠোরভাবে পালন করা যায়নি। সাধারণ মানুষের অসচেতনতার ঘাড়ে বন্দুক রেখে দায়িত্ববানরা নিজেদের মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হয়েছে। সরকার শক্তিশালী সব গোষ্ঠীর চাপে পর্যায়ক্রমিকভাবে লকডাউন শিথিল করেছে। এ সময়কালে সামর্থের বাইরে এসে লকডাউন সফল করার জন্য যেসব সহায়তার ব্যবস্থা সরকার করেছিলো তাও যথাযথ বিতরণ করা যায়নি। বিতরণ ব্যবস্থা নিষ্কন্টক রাখতে ধমকের আস্ফালন দেখিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে প্রাথমিকভাবে জীবন রক্ষায় প্রাধান্য দৃশ্যমান হয় আবার পরক্ষণে তা পরিবর্তন হয়ে জীবিকা রক্ষায় প্রাধান্য ফুটে ওঠে। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জীবন ও জীবিকা কোনটাকেই অবহেলা করা যায় না। করোনা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিজেদের পৃথক রেখেই সমস্যার কিছুটা সমাধান করা গিয়েছে। অথচ দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহ বিস্তার নিয়ন্ত্রণে যে কঠোরতা আশা করা গিয়েছিল তা পূরণ হয়নি। শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, জরুরি পরিষেবা ইত্যাদি খোলা রেখে, বিভিন্ন ধরনের সরকারি পাওনা পরিশোধের চাপ রেখে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিলে লাভ যা হতে পারে তাই হয়েছে। প্রয়োজনে মানুষ বেশি ঘরের বাইরে এসেছে। গার্মেন্টসে যত লক্ষ শ্রমিক আছে তারা যদি রাজধানীর এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটাহাঁটি করে তবে সড়কের অবস্থা আর কী হবে। অফিস-আদালত আছে, কল-কারখানা আছে, নেই গণপরিবহন চিত্রটা কেমন হবে? সরকারর নির্দেশ ছিল সবাই নিজ নিজ শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিবহনের ব্যবস্থা করবেন। রাজধানীর মানুষ পরিবহন বলতে সরকারি ও ব্যক্তিগত গাড়ি দেখেছে যেখানে কোনো শ্রমিক-কর্মচারীর স্থান ছিল না। জরুরি সেবায় নিয়োজিত কর্মচারীদেরও তাদের সংস্থা কর্তৃক পরিবহন করতে দেখা যায়নি। এমনকি বড়কর্তার পরিবার-পরিজন যেসব সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন তাও এ ক্রান্তিকালে কর্মচারী পরিবহনে ব্যবহৃত হয়নি। ফলে যে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণ কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। রিকশা-ভ্যান বের হয়েছে, চা-পানের দোকান খুলেছে, মেরামতের দোকান খুলেছে এভাবেই পরস্পর সম্পর্কিত মানুষ ঘরের বাইরে চলে এসেছে।
বেশ কিছুদিন আগের কথা এক গ্রামে আর্থ-সামাজিক অবস্থার সমীক্ষা প্রতিবেদন দেখেছিলাম। গ্রামের একটা বড় অংশ ব্যবসা করে অথচ তারা খুবই দরিদ্র। ব্যবসার ধরণ খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যায় কেউ বাদাম বিক্রি করে, কেউ সামান্য সবজি বিক্রি করে, কেউ সারাদিন লোহার হাতা-খুনতি বানিয়ে সন্ধ্যায় বিক্রি করে, কেউ বাঁশের চুপড়ি বানিয়ে বিক্রি করে ইত্যাদি। সারাদিনের শ্রমে যে আয় হয় তা দিয়ে আগামীদিনের কাঁচামাল কিনে বাকি অর্থে খাদ্য ক্রয় করে। এলাকার মহিলারাও কাজ করে কিন্তু তারপরও তিনবেলা খাবার জোটে না। দেশে এখনো এরকম বহুব্যবসায়ী আছে যারা স্থানীয় বাজার থেকে মালামাল ক্রয় করে ক্রেতার শ্রম আর সময়কে পুঁজি করে সামান্য লাভে মালামাল বিক্রি করে ব্যবসা করে। এমন সব ব্যবসায়ীদের পুঁজি কত আর সঞ্চয়ই বা কত? কতদিন ব্যবসা বন্ধ রেখে এরা পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে সক্ষম? রাজধানী থেকে জেলা-উপজেলার মানুষের হাটে প্রতিদিন সকালে যে মানুষগুলো শ্রম বিক্রির জন্য জড়ো হতো তাদের অবস্থা কী? এরা কেউ ভিক্ষা করতো না কিন্তু করোনাকালে এসব আত্মমর্যাদাবান মানুষগুলো ভিখারি হয়ে গিয়েছে। জনকল্যাণের সরকারের কাছে এসব মানুষের কোনো হিসাব নেই। তাইতো সরকারি নির্দেশে যখনই ঘরের বাইরে আসা যায় তখন যারা হাত পাততে পারেন না তারা জীবিকার সন্ধানে বের হয়ে আসে। ধারণা করি দেশে করোনাকালে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তারাই এসব মানুষ। এ মানুষগুলো কোনো ভাবনার মধ্যে আছে বলে মনে হয় না।
লকডাইনের ঈদের ছুটি শেষ হলে আরো কঠোরভাবে এসেছে। এবারে শিল্প-কলকারখানা এবং গার্মেন্টসও বন্ধের নির্দেশনা ছিল। নির্দেশনার পর গার্মেন্টস মালিকরা ছোটাছুটি শুরু করে তাদের শিল্পকারখানা খোলা রাখার জন্য। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের চাপে তা লকডাউন শেষ হওয়ার আগেই খুলে দেওয়া হল। অতীতেও এমনটা ঘটতে দেখা গেছে। তাই কঠোর লকডাউনের চিন্তা না করে দেশে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোসহ গ্রামপর্যায়ে করোনার বিস্তার রোধে নতুন ভাবনায়, নতুন চিন্তায় কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি। সরকারের পক্ষ থকে মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব দিয়ে গ্রামের মানুষদের সচেতন করা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের দাবি সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সহযোগিতা করুক। খাদ্য নিরাপত্তা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক। আবহাওয়ার কারণে বর্তমান সময়ে জ্বর, সর্দি, কাশি হয়ে থাকে যা করোনারও উপসর্গ। অনেকেই জ্বর সর্দিকে সাধারণ রোগ বিবেচনায় টোটকা চিকিৎসা করে এবং করোণা হলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বলে নিজে বেঁচে যায়, কিন্তু সংস্পর্শে আসা অন্যদের মেরে ফেলে। ফলে যে কোন উপসর্গ দেখা দিলেও আইসোলেশনে রাখা এবং টেস্টের ব্যবস্থার তদারকি জোরদার করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। গ্রামের সাধারণ জনগণকে রক্ষা করা যাবে।
কিছুদিন আগে হঠাৎ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছে বলে প্রচার করা হয়। সরকারিভাবে এ প্রচারের কারণে শিল্প-কারখানা খোলা রাখতে আর কোনো সমস্যা নেই। শ্রমিকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্য অংশের চেয়ে বেশি বলে ক্ষতির শঙ্কা কম। এটাও প্রমাণ করা হয়েছে যে শিল্প-কারখানা খোলা রাখার কারণে দেশ লাভবানই হয়েছে, শিল্প-কারখানা থেকে করোনার বিস্তার ঘটেনি। সরকারের পক্ষ থেকে এমন পরিবেশ দৃশ্যমান করার ফল হিসেবে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা এসেছে। তাই কঠোর লকডাউন কঠোরভাবে পালন প্রয়োজন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে বাধ্য করা প্রয়োজন। লকডাউন যেন শুধু বাঁশের নিচে হেডডাউনে সীমাবদ্ধ না থাকে।
[লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)]
khairulumam1950@gmail.com
এম আর খায়রুল উমাম
রোববার, ০১ আগস্ট ২০২১
করোনা মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ রসিকতা করে বলতো লকডাউন না বাঁশের নিচে হেডডাউন। সরকার লকডাউন ঘোষণা করলেই পাড়ার রাস্তায় আড়াআড়ি বাঁশ বেঁধে দেয়া হতো আর মানুষ বাঁশের নিচ দিয়ে যাতায়াত করতো। প্রথম ২-১ দিন লকডাউন মোটামুটিভাবে মানা হলেও তারপর আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেত। সিংহভাগ মানুষ লকডাউনের বিধিনিষেধ মান্য করতো না। এভাবে উপেক্ষার পরও মহামারির প্রথম ঢেউ দেশে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ দিনে দিনে নিয়ন্ত্রহীণ হয়ে পড়ছে বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়ার পর থেকে। মহামারি নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আনসার বাহিনী, র্যারের সঙ্গে এবার সেনাবাহিনীকে মাঠপর্যায়ে নামিয়ে প্রচেষ্টারত সরকার। তারপরও প্রতিদিন নতুন শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটা ক্ষেত্র থেকে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচারিত বার্তাগুলো মহামারির ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে যাতে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তার জন্য কাজ করে চলেছে। সরকারের প্রচারমুখী রাজনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন নিজেদের সামর্থ্য বৃদ্ধি করে পীড়িতদের চিকিৎসা সেবা এবং অনাহারি মানুষদের খাদ্য সহায়তা নিয়ে দ্বারে দ্বারে ফিরছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুধু নয় বিদেশে অবস্থান করা স্বজনরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই কঠোর লকডাউন পেয়ে গিয়েছিল ঈদের ছুটি।
দিনরাত এক করে ছুটে চলা মানবিক মানুষগুলো হঠাৎ ঈদের ছুটির পর কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন তা বর্তমান অবস্থায় অনুমান করতে ভীত হই। প্রায় সবকিছু স্বাভাবিক চলার ফলে একটা ছন্দপতন ঘটেছে তা বলাই বাহুল্য। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা না করে লকডাউনকে ঈদের ছুটি দেয়া যদি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের চাপে হয়ে থাকে তাহলে সরকার কোনভাবেই দায় এড়াতে পারবে না। প্রতিদিনকার মহামারীর পরিস্থিতির যে অবনতি হচ্ছে তারপর এমন ছুটি কি সত্যিই কাম্য ছিল। দেশে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করে চলেছে। তারপরও গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্লেষণে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতাই প্রকট হয়ে উঠছে। সরকার করোনা মোকাবেলায় জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দেবে তা নির্ধারণে ব্যর্থ হওয়ায় লকডাউন এখনো পর্যন্ত কার্যত কঠোরভাবে পালন করা যায়নি। সাধারণ মানুষের অসচেতনতার ঘাড়ে বন্দুক রেখে দায়িত্ববানরা নিজেদের মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হয়েছে। সরকার শক্তিশালী সব গোষ্ঠীর চাপে পর্যায়ক্রমিকভাবে লকডাউন শিথিল করেছে। এ সময়কালে সামর্থের বাইরে এসে লকডাউন সফল করার জন্য যেসব সহায়তার ব্যবস্থা সরকার করেছিলো তাও যথাযথ বিতরণ করা যায়নি। বিতরণ ব্যবস্থা নিষ্কন্টক রাখতে ধমকের আস্ফালন দেখিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে প্রাথমিকভাবে জীবন রক্ষায় প্রাধান্য দৃশ্যমান হয় আবার পরক্ষণে তা পরিবর্তন হয়ে জীবিকা রক্ষায় প্রাধান্য ফুটে ওঠে। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জীবন ও জীবিকা কোনটাকেই অবহেলা করা যায় না। করোনা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিজেদের পৃথক রেখেই সমস্যার কিছুটা সমাধান করা গিয়েছে। অথচ দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহ বিস্তার নিয়ন্ত্রণে যে কঠোরতা আশা করা গিয়েছিল তা পূরণ হয়নি। শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, জরুরি পরিষেবা ইত্যাদি খোলা রেখে, বিভিন্ন ধরনের সরকারি পাওনা পরিশোধের চাপ রেখে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিলে লাভ যা হতে পারে তাই হয়েছে। প্রয়োজনে মানুষ বেশি ঘরের বাইরে এসেছে। গার্মেন্টসে যত লক্ষ শ্রমিক আছে তারা যদি রাজধানীর এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটাহাঁটি করে তবে সড়কের অবস্থা আর কী হবে। অফিস-আদালত আছে, কল-কারখানা আছে, নেই গণপরিবহন চিত্রটা কেমন হবে? সরকারর নির্দেশ ছিল সবাই নিজ নিজ শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিবহনের ব্যবস্থা করবেন। রাজধানীর মানুষ পরিবহন বলতে সরকারি ও ব্যক্তিগত গাড়ি দেখেছে যেখানে কোনো শ্রমিক-কর্মচারীর স্থান ছিল না। জরুরি সেবায় নিয়োজিত কর্মচারীদেরও তাদের সংস্থা কর্তৃক পরিবহন করতে দেখা যায়নি। এমনকি বড়কর্তার পরিবার-পরিজন যেসব সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন তাও এ ক্রান্তিকালে কর্মচারী পরিবহনে ব্যবহৃত হয়নি। ফলে যে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণ কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। রিকশা-ভ্যান বের হয়েছে, চা-পানের দোকান খুলেছে, মেরামতের দোকান খুলেছে এভাবেই পরস্পর সম্পর্কিত মানুষ ঘরের বাইরে চলে এসেছে।
বেশ কিছুদিন আগের কথা এক গ্রামে আর্থ-সামাজিক অবস্থার সমীক্ষা প্রতিবেদন দেখেছিলাম। গ্রামের একটা বড় অংশ ব্যবসা করে অথচ তারা খুবই দরিদ্র। ব্যবসার ধরণ খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যায় কেউ বাদাম বিক্রি করে, কেউ সামান্য সবজি বিক্রি করে, কেউ সারাদিন লোহার হাতা-খুনতি বানিয়ে সন্ধ্যায় বিক্রি করে, কেউ বাঁশের চুপড়ি বানিয়ে বিক্রি করে ইত্যাদি। সারাদিনের শ্রমে যে আয় হয় তা দিয়ে আগামীদিনের কাঁচামাল কিনে বাকি অর্থে খাদ্য ক্রয় করে। এলাকার মহিলারাও কাজ করে কিন্তু তারপরও তিনবেলা খাবার জোটে না। দেশে এখনো এরকম বহুব্যবসায়ী আছে যারা স্থানীয় বাজার থেকে মালামাল ক্রয় করে ক্রেতার শ্রম আর সময়কে পুঁজি করে সামান্য লাভে মালামাল বিক্রি করে ব্যবসা করে। এমন সব ব্যবসায়ীদের পুঁজি কত আর সঞ্চয়ই বা কত? কতদিন ব্যবসা বন্ধ রেখে এরা পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে সক্ষম? রাজধানী থেকে জেলা-উপজেলার মানুষের হাটে প্রতিদিন সকালে যে মানুষগুলো শ্রম বিক্রির জন্য জড়ো হতো তাদের অবস্থা কী? এরা কেউ ভিক্ষা করতো না কিন্তু করোনাকালে এসব আত্মমর্যাদাবান মানুষগুলো ভিখারি হয়ে গিয়েছে। জনকল্যাণের সরকারের কাছে এসব মানুষের কোনো হিসাব নেই। তাইতো সরকারি নির্দেশে যখনই ঘরের বাইরে আসা যায় তখন যারা হাত পাততে পারেন না তারা জীবিকার সন্ধানে বের হয়ে আসে। ধারণা করি দেশে করোনাকালে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তারাই এসব মানুষ। এ মানুষগুলো কোনো ভাবনার মধ্যে আছে বলে মনে হয় না।
লকডাইনের ঈদের ছুটি শেষ হলে আরো কঠোরভাবে এসেছে। এবারে শিল্প-কলকারখানা এবং গার্মেন্টসও বন্ধের নির্দেশনা ছিল। নির্দেশনার পর গার্মেন্টস মালিকরা ছোটাছুটি শুরু করে তাদের শিল্পকারখানা খোলা রাখার জন্য। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের চাপে তা লকডাউন শেষ হওয়ার আগেই খুলে দেওয়া হল। অতীতেও এমনটা ঘটতে দেখা গেছে। তাই কঠোর লকডাউনের চিন্তা না করে দেশে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোসহ গ্রামপর্যায়ে করোনার বিস্তার রোধে নতুন ভাবনায়, নতুন চিন্তায় কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি। সরকারের পক্ষ থকে মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব দিয়ে গ্রামের মানুষদের সচেতন করা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের দাবি সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সহযোগিতা করুক। খাদ্য নিরাপত্তা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক। আবহাওয়ার কারণে বর্তমান সময়ে জ্বর, সর্দি, কাশি হয়ে থাকে যা করোনারও উপসর্গ। অনেকেই জ্বর সর্দিকে সাধারণ রোগ বিবেচনায় টোটকা চিকিৎসা করে এবং করোণা হলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বলে নিজে বেঁচে যায়, কিন্তু সংস্পর্শে আসা অন্যদের মেরে ফেলে। ফলে যে কোন উপসর্গ দেখা দিলেও আইসোলেশনে রাখা এবং টেস্টের ব্যবস্থার তদারকি জোরদার করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। গ্রামের সাধারণ জনগণকে রক্ষা করা যাবে।
কিছুদিন আগে হঠাৎ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছে বলে প্রচার করা হয়। সরকারিভাবে এ প্রচারের কারণে শিল্প-কারখানা খোলা রাখতে আর কোনো সমস্যা নেই। শ্রমিকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্য অংশের চেয়ে বেশি বলে ক্ষতির শঙ্কা কম। এটাও প্রমাণ করা হয়েছে যে শিল্প-কারখানা খোলা রাখার কারণে দেশ লাভবানই হয়েছে, শিল্প-কারখানা থেকে করোনার বিস্তার ঘটেনি। সরকারের পক্ষ থেকে এমন পরিবেশ দৃশ্যমান করার ফল হিসেবে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা এসেছে। তাই কঠোর লকডাউন কঠোরভাবে পালন প্রয়োজন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে বাধ্য করা প্রয়োজন। লকডাউন যেন শুধু বাঁশের নিচে হেডডাউনে সীমাবদ্ধ না থাকে।
[লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)]
khairulumam1950@gmail.com