alt

opinion » post-editorial

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

সজীব ওয়াফি

: শুক্রবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরো পৃথিবীতে জোরেশোরে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। কোথাও বন্যা, কোথাও ঘূর্ণিঝড়, আবার কোথাও দাবানলে দাউ দাউ করে পুড়েছে বিস্তীর্ণ বনভূমি। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পাহাড় ধস, মরুকরণ, খরার ব্যাপকতা বেড়েছে বহুগুণে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশেও। ছয় ঋতুর দেশে গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত বাদে বাকিগুলো বিলুপ্ত হয়েছে চোখের অগোচরে। সিডর, আইলা, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত দক্ষিণাঞ্চল। সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণ পানিতে বিপর্যস্ত উপকূল। প্রতিবছর ঢলের পানিতে বারবার তলিয়ে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চল। বন্যার কবলে পরে ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার কিলোমিটার ভূমি, বসতবাড়ি, ক্ষেতখামার।

জলবায়ুর পরিবর্তনের একমাত্র কারণ বাতাসে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড। অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে পর্যাপ্ত গাছের অনুপস্থিতি। একটি দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি প্রয়োজন। আমাদের আছে মাত্র ১৭ ভাগেরও অনেক কম; যা আছে সেগুলোও আবার চলে নির্বিচারে কর্তন। অন্যদিকে কলকারখানা ধোঁয়া, রান্নাবান্না, গাড়ির ধোয়া, এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, ইত্যাদি নিয়মিত কার্বন ছেড়ে পরিবেশ দূষিত করছে হরহামেশাই। বিপরীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে ভুটানের ন্যায় সবুজায়ন করতে উদাসীনতা লক্ষণীয়। বাতাসে আরো অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। কিন্তু নিঃসরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা তারা করছে না। শীতপ্রধান রাষ্ট্রগুলো ব্যবহার করে গ্রিনহাউস প্রক্রিয়া। গ্রিনহাউস প্রক্রিয়া বলতে- কাঁচের তৈরি ঘর। অতিরিক্ত শীতে গাছপালা মারা যায়; যার কারনে কাঁচের তৈরি ঘর ব্যবহার করা। এ পদ্ধতি দিনের সূর্যের আলোর গরম রাতেও ধরে রাখতে সক্ষম হয়। পরিণামে পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। গলতে শুরু করেছে হিমালয় পর্বতসহ বেশকিছু পর্বতের বরফখন্ড। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায়- বর্ষায় ভারতের অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং হিমালয়ের গলিত বরফ পানি তুফান হয়ে ভেসে আসে সমুদ্র উপকূলের দিকে।

গত কয়েক দিন ধরে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। শুধুমাত্র অবনতি বললে ভুল হয়। কারণ এবারের বন্যায় ভাঙন পরিস্থিতি আগের তুলনায় উৎকণ্ঠার, উদ্বেগজনক। তিস্তার বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, মসজিদ, ক্লিনিক। বিপন্ন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে উঁচু জায়গায়, বাঁধের উপর এবং আশ্রয় কেন্দ্রে। ঘরবাড়ি-গরু-ছাগল স্রোতের পানিতে একাকার। আঘাত এসেছে জীবন-জীবিকায়। বন্যার পানিতে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, ভরে উঠেছে খানাখন্দে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরার মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত; বৃষ্টিপাতের সেই পানি উজানের ঢলেই কাল হয়েছে নদীপাড়ের মানুষদের। শেষ সম্বল ভিটেটুকু হারিয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে পড়েছেন কেউ কেউ।

আমাদের প্রধান প্রধান নদীগুলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হয়ে নেমে এসেছে। নদীর উপর তারা নির্মাণ করেছে বাঁধ। বিশেষ করে পদ্মার উপরে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় তিস্তা বাঁধ এবং টিপাইমুখী বাঁধ নির্মাণ করেছে ব্রহ্মপুত্রের উজানে। অন্যান্য সময়ে আটকে রাখা হয় এই বাঁধগুলো। কেবলমাত্র বর্ষার সময়ে যখন ঢলের পানিতে চাপ পরে, তখনই ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলাফলে হঠাৎ করে ব্যাপক পানির তোরে ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। প্লাবিত হয় অধিকাংশ অঞ্চল। পানির স্রোতের সাথে ভেঙে ভেসে যায় বসতবাড়ি। বাঁধের কারণে নদীগুলোতে নাব্যতা নেই। দীর্ঘদিন পানি না থাকায় মরে গেছে অনেক নদীর তলদেশ। শুকিয়ে যাওয়ায় ছোট-বড় নদী, এমনকি খালের অধিকাংশ জায়গা দখল হয়েছে দখলদার কর্তৃক। পানি ধারণ ক্ষমতার মাধ্যম যদি মরে যায় বা দখল হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঢলের পানি নামবে কোথা থেকে? নদীর মুমূর্ষু সংকটে লোকালয় থেকেই তো নামবে। শুকিয়ে যাওয়া নদী হঠাৎ বিপদসীমার উপরে নাব্যতা পেলে ভাঙন তৈরি হবে স্বাভাবিক। বাঁধগুলো যদি না থাকতো অথবা পানির নির্দিষ্ট চাপ পরার আগেই খুলে দেওয়া সম্ভব হতো; তবে কিন্তু দারিদ্র্য মানুষগুলোকে প্রতি বছর এভাবে দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয় না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে- বিগত চার দশকে প্রায় একলক্ষ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণ আরো ঢের বেশি। মোটকথা ভাঙনের কবলে পরে প্রায় ছোটখাটো একটা জেলা পরিমাণ ভূমি হারিয়েছে বাংলাদেশ। ভাঙতে ভাঙতে মনপুরার মতো দ্বীপগুলো ছোট হয়ে গেছে। মানুষ হয়েছে উদ্বাস্তু। হয়েছে দিশেহারা। ভাঙনে ভুক্তভোগী অনেক পরিবার এনজিওর ঋণে হয়েছে নাস্তানাবুদ। সব হারিয়ে সামাজিক কলহ যেমন বেড়েছে তেমন বেড়েছে নারী নির্যাতন। বন্যাকবলিত এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা তো আছেই। অথচ এই নদীকে আমরা গলাটিপে হত্যা করেছি কখনো ব্যক্তি মালিকানায়, কখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায়।

নদী হচ্ছে জাতীয় জীবন্ত সত্তা। নদী বাঁচলেই নগর বাঁচবে, বাঁচবে সভ্যতা। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে নগর-বন্দর; নচেৎ নয়। নদী না বাঁচলে সেখানে তেলাপোকাও টিকে না। বরং রূপান্তরিত ঘটে মরুপ্রান্তরে। অথচ আমাদের যৎসামান্য কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। দীর্ঘদিন থেকে নদীর তলদেশে ড্রেজিং হচ্ছে না। শুকিয়ে যাওয়ায় যে যেরকম পারছে দখল করে ব্যবহার করেছে। ভাঙন রোধে উপর্যুক্ত সময়ে নেওয়া হয়নি কোন কার্যকরী ব্যবস্থা। তাৎক্ষণিক ফেলা হচ্ছে জিও ব্যাগ। বর্তমান প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের যুগে একটু সচেতনভাবে কাজ করা যেতো। নদীর পাশাপাশি রক্ষা করা যেতো নদী ভাঙ্গা হাজারো মানুষের পোড়া কপাল। গালিচার মতো আচ্ছাদন বা কভার নদী তীরবর্তী ভূমিকে প্রবল ঢেউ থেকে রক্ষায় বিশ্ব স্বীকৃত পন্থা। কিন্তু আমরা সে পথে কখনই হাঁটিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফলতি এবং ভাঙন রোধে বাজেট পাশ হতে হতে ভাঙন আরো বিস্তৃত হয়। আমরা হেঁটেছি অসংখ্য ক্ষুদ্র বস্তুর আচ্ছাদনের দিকে, যেমন- প্রচুর পাথর, কংক্রিটের ব্লক ও বালিভর্তি জিও ব্যাগ। টাকা খরচ হয়েছে বিপুল অঙ্কের, কিন্তু কাজের কাজ হয়নি মোটেই। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক কূটনীতিক ব্যর্থতা ছিলো সব সরকারের আমলেই। ১৯৭৪ সালের ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ ভারত যৌথ নদী কমিশন গঠন করলেও বিগত সরকারগুলোর আমলে এ কমিশনের গতিশীলতা হারায়। মাঝি-মাল্লারা হারিয়েছে মনের সুখ, হারিয়েছে নিদারুণ প্রাণচাঞ্চল্য ভাটিয়ালি গান।

আমাদের সক্ষমতায় ঘাটতি আছে এটা সত্য। তবে সক্ষমতা যতটুকু আছে ততটুকুও যথাযথ প্রয়োগ অনুপস্থিত। ভাঙনের পর নদীতে জমি জেগে উঠলে শুরু হয় প্রতিযোগিতার অসম দৌড়। ইদানীং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এই কোন্দলে জড়িয়েছে। নদীর পাড় ভাঙ্গলেই জমি খাস, তবে কি এই আইনের জন্যই নদীভাঙন রোধের অবহেলা? নাকি পানি উন্নয়ন বোর্ডের লাগামহীন দুর্নীতি? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন ধারণা নয়, এখন বাস্তব। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সাথে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন ভাইরাসে। আক্রান্ত হচ্ছে পঙ্গপালের মতো বিধ্বস্তকারী কীট-পতঙ্গে। পৃথিবীর দিকে বিপদের চরম মাত্রা ধেয়ে আসছে ক্রমাগত। অথচ পরিবেশ বিপর্যয় আমরা ঠেকাতে পারছি না। জলবায়ু পরিবর্তনের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে বাঁধের কারণে শুকিয়ে যাওয়া পলি মাটি হঠাৎ পানি পেলে নরম হবে স্বাভাবিক। তখন তীব্র স্রোতে ভাঙবে না তো ভাঙবে কী? নদীর গতিপথে আমরা কেন হুমকি হয়ে উঠেছি!

আমাদের সক্ষমতায় ঘাটতি আছে এটা সত্য। তবে সক্ষমতা যতটুকু আছে ততটুকুও যথাযথ প্রয়োগ অনুপস্থিত

করোনাকালীন প্রকৃতি পৃথিবীকে তার দখল নিতে মানুষকে ঘরবন্দী করেছে। অতঃপর আমরা দেখলাম তরতর করে পরিবেশ কীভাবে সতেজ হলো। কি দাপট দেখালো ঢাকার শহরের ঝিমিয়ে পরা মৃত প্রায় গাছগুলোও! শুশুক থেকে শুরু করে তিমি পর্যন্ত উপকূলে তৈরি করেছিলো তাদের চলাচলের অভয়ারণ্য। এর অর্থ দাঁড়াল- মানুষ যখন পরিবেশের ওপর আগ্রাসী ভূমিকা বলবৎ রাখবে, তখন প্রকৃতি মারমুখী হয়ে প্রয়োজনে মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে তার আপন পরিবেশে ফিরবেই। কিন্তু আমাদের সমস্ত কাজ, সমস্ত উন্নয়ন প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই। পরিবেশ-প্রতিবেশের বিপক্ষে কেন আমরা যুদ্ধে নামছি? বরং পরিবেশের সাথে ভারসাম্য রেখে সারা পৃথিবীতে মানব সভ্যতার উন্নয়নে তো কোন বাধা নেই।

পৃথিবী যখন পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, জলবায়ু যখন উত্তাল হয়ে উঠেছে; সেই সময়টাতেই আমরা সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেষ্টনকারী বন ধ্বংস করে চলেছি। ধ্বংস করে চলেছি চট্টগ্রামে সিআরবি এলাকার বনজ প্রকৃতি। মধুপুর এবং পার্বত্য বনের গাছ নিয়মিত চুরি হয়ে যাচ্ছে বনদস্যুদের কবলে। নদী, বায়ু, পানি তার চিরাচরিত প্রবাহে বহমান। বাঁধ দিয়ে তাকে আটকানো অসম্ভব; দরকার হলে সে তার গতিপথ পরিবর্তন করে হলেও সামনের দিকে ধাবিত হবে। জলবায়ুর এ পরিবর্তন ঠেকানো এখনই সময়ের দাবি। নতুবা বন্যা-ভাঙনের চেয়েও বৃহৎ কোন বিপর্যয় আমাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

tab

opinion » post-editorial

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

সজীব ওয়াফি

শুক্রবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরো পৃথিবীতে জোরেশোরে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। কোথাও বন্যা, কোথাও ঘূর্ণিঝড়, আবার কোথাও দাবানলে দাউ দাউ করে পুড়েছে বিস্তীর্ণ বনভূমি। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পাহাড় ধস, মরুকরণ, খরার ব্যাপকতা বেড়েছে বহুগুণে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশেও। ছয় ঋতুর দেশে গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত বাদে বাকিগুলো বিলুপ্ত হয়েছে চোখের অগোচরে। সিডর, আইলা, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত দক্ষিণাঞ্চল। সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণ পানিতে বিপর্যস্ত উপকূল। প্রতিবছর ঢলের পানিতে বারবার তলিয়ে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চল। বন্যার কবলে পরে ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার কিলোমিটার ভূমি, বসতবাড়ি, ক্ষেতখামার।

জলবায়ুর পরিবর্তনের একমাত্র কারণ বাতাসে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড। অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে পর্যাপ্ত গাছের অনুপস্থিতি। একটি দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি প্রয়োজন। আমাদের আছে মাত্র ১৭ ভাগেরও অনেক কম; যা আছে সেগুলোও আবার চলে নির্বিচারে কর্তন। অন্যদিকে কলকারখানা ধোঁয়া, রান্নাবান্না, গাড়ির ধোয়া, এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, ইত্যাদি নিয়মিত কার্বন ছেড়ে পরিবেশ দূষিত করছে হরহামেশাই। বিপরীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে ভুটানের ন্যায় সবুজায়ন করতে উদাসীনতা লক্ষণীয়। বাতাসে আরো অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। কিন্তু নিঃসরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা তারা করছে না। শীতপ্রধান রাষ্ট্রগুলো ব্যবহার করে গ্রিনহাউস প্রক্রিয়া। গ্রিনহাউস প্রক্রিয়া বলতে- কাঁচের তৈরি ঘর। অতিরিক্ত শীতে গাছপালা মারা যায়; যার কারনে কাঁচের তৈরি ঘর ব্যবহার করা। এ পদ্ধতি দিনের সূর্যের আলোর গরম রাতেও ধরে রাখতে সক্ষম হয়। পরিণামে পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। গলতে শুরু করেছে হিমালয় পর্বতসহ বেশকিছু পর্বতের বরফখন্ড। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায়- বর্ষায় ভারতের অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং হিমালয়ের গলিত বরফ পানি তুফান হয়ে ভেসে আসে সমুদ্র উপকূলের দিকে।

গত কয়েক দিন ধরে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। শুধুমাত্র অবনতি বললে ভুল হয়। কারণ এবারের বন্যায় ভাঙন পরিস্থিতি আগের তুলনায় উৎকণ্ঠার, উদ্বেগজনক। তিস্তার বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, মসজিদ, ক্লিনিক। বিপন্ন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে উঁচু জায়গায়, বাঁধের উপর এবং আশ্রয় কেন্দ্রে। ঘরবাড়ি-গরু-ছাগল স্রোতের পানিতে একাকার। আঘাত এসেছে জীবন-জীবিকায়। বন্যার পানিতে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, ভরে উঠেছে খানাখন্দে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরার মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত; বৃষ্টিপাতের সেই পানি উজানের ঢলেই কাল হয়েছে নদীপাড়ের মানুষদের। শেষ সম্বল ভিটেটুকু হারিয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে পড়েছেন কেউ কেউ।

আমাদের প্রধান প্রধান নদীগুলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হয়ে নেমে এসেছে। নদীর উপর তারা নির্মাণ করেছে বাঁধ। বিশেষ করে পদ্মার উপরে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় তিস্তা বাঁধ এবং টিপাইমুখী বাঁধ নির্মাণ করেছে ব্রহ্মপুত্রের উজানে। অন্যান্য সময়ে আটকে রাখা হয় এই বাঁধগুলো। কেবলমাত্র বর্ষার সময়ে যখন ঢলের পানিতে চাপ পরে, তখনই ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলাফলে হঠাৎ করে ব্যাপক পানির তোরে ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। প্লাবিত হয় অধিকাংশ অঞ্চল। পানির স্রোতের সাথে ভেঙে ভেসে যায় বসতবাড়ি। বাঁধের কারণে নদীগুলোতে নাব্যতা নেই। দীর্ঘদিন পানি না থাকায় মরে গেছে অনেক নদীর তলদেশ। শুকিয়ে যাওয়ায় ছোট-বড় নদী, এমনকি খালের অধিকাংশ জায়গা দখল হয়েছে দখলদার কর্তৃক। পানি ধারণ ক্ষমতার মাধ্যম যদি মরে যায় বা দখল হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঢলের পানি নামবে কোথা থেকে? নদীর মুমূর্ষু সংকটে লোকালয় থেকেই তো নামবে। শুকিয়ে যাওয়া নদী হঠাৎ বিপদসীমার উপরে নাব্যতা পেলে ভাঙন তৈরি হবে স্বাভাবিক। বাঁধগুলো যদি না থাকতো অথবা পানির নির্দিষ্ট চাপ পরার আগেই খুলে দেওয়া সম্ভব হতো; তবে কিন্তু দারিদ্র্য মানুষগুলোকে প্রতি বছর এভাবে দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয় না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে- বিগত চার দশকে প্রায় একলক্ষ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণ আরো ঢের বেশি। মোটকথা ভাঙনের কবলে পরে প্রায় ছোটখাটো একটা জেলা পরিমাণ ভূমি হারিয়েছে বাংলাদেশ। ভাঙতে ভাঙতে মনপুরার মতো দ্বীপগুলো ছোট হয়ে গেছে। মানুষ হয়েছে উদ্বাস্তু। হয়েছে দিশেহারা। ভাঙনে ভুক্তভোগী অনেক পরিবার এনজিওর ঋণে হয়েছে নাস্তানাবুদ। সব হারিয়ে সামাজিক কলহ যেমন বেড়েছে তেমন বেড়েছে নারী নির্যাতন। বন্যাকবলিত এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা তো আছেই। অথচ এই নদীকে আমরা গলাটিপে হত্যা করেছি কখনো ব্যক্তি মালিকানায়, কখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায়।

নদী হচ্ছে জাতীয় জীবন্ত সত্তা। নদী বাঁচলেই নগর বাঁচবে, বাঁচবে সভ্যতা। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে নগর-বন্দর; নচেৎ নয়। নদী না বাঁচলে সেখানে তেলাপোকাও টিকে না। বরং রূপান্তরিত ঘটে মরুপ্রান্তরে। অথচ আমাদের যৎসামান্য কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। দীর্ঘদিন থেকে নদীর তলদেশে ড্রেজিং হচ্ছে না। শুকিয়ে যাওয়ায় যে যেরকম পারছে দখল করে ব্যবহার করেছে। ভাঙন রোধে উপর্যুক্ত সময়ে নেওয়া হয়নি কোন কার্যকরী ব্যবস্থা। তাৎক্ষণিক ফেলা হচ্ছে জিও ব্যাগ। বর্তমান প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের যুগে একটু সচেতনভাবে কাজ করা যেতো। নদীর পাশাপাশি রক্ষা করা যেতো নদী ভাঙ্গা হাজারো মানুষের পোড়া কপাল। গালিচার মতো আচ্ছাদন বা কভার নদী তীরবর্তী ভূমিকে প্রবল ঢেউ থেকে রক্ষায় বিশ্ব স্বীকৃত পন্থা। কিন্তু আমরা সে পথে কখনই হাঁটিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফলতি এবং ভাঙন রোধে বাজেট পাশ হতে হতে ভাঙন আরো বিস্তৃত হয়। আমরা হেঁটেছি অসংখ্য ক্ষুদ্র বস্তুর আচ্ছাদনের দিকে, যেমন- প্রচুর পাথর, কংক্রিটের ব্লক ও বালিভর্তি জিও ব্যাগ। টাকা খরচ হয়েছে বিপুল অঙ্কের, কিন্তু কাজের কাজ হয়নি মোটেই। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক কূটনীতিক ব্যর্থতা ছিলো সব সরকারের আমলেই। ১৯৭৪ সালের ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ ভারত যৌথ নদী কমিশন গঠন করলেও বিগত সরকারগুলোর আমলে এ কমিশনের গতিশীলতা হারায়। মাঝি-মাল্লারা হারিয়েছে মনের সুখ, হারিয়েছে নিদারুণ প্রাণচাঞ্চল্য ভাটিয়ালি গান।

আমাদের সক্ষমতায় ঘাটতি আছে এটা সত্য। তবে সক্ষমতা যতটুকু আছে ততটুকুও যথাযথ প্রয়োগ অনুপস্থিত। ভাঙনের পর নদীতে জমি জেগে উঠলে শুরু হয় প্রতিযোগিতার অসম দৌড়। ইদানীং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এই কোন্দলে জড়িয়েছে। নদীর পাড় ভাঙ্গলেই জমি খাস, তবে কি এই আইনের জন্যই নদীভাঙন রোধের অবহেলা? নাকি পানি উন্নয়ন বোর্ডের লাগামহীন দুর্নীতি? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন ধারণা নয়, এখন বাস্তব। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সাথে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন ভাইরাসে। আক্রান্ত হচ্ছে পঙ্গপালের মতো বিধ্বস্তকারী কীট-পতঙ্গে। পৃথিবীর দিকে বিপদের চরম মাত্রা ধেয়ে আসছে ক্রমাগত। অথচ পরিবেশ বিপর্যয় আমরা ঠেকাতে পারছি না। জলবায়ু পরিবর্তনের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে বাঁধের কারণে শুকিয়ে যাওয়া পলি মাটি হঠাৎ পানি পেলে নরম হবে স্বাভাবিক। তখন তীব্র স্রোতে ভাঙবে না তো ভাঙবে কী? নদীর গতিপথে আমরা কেন হুমকি হয়ে উঠেছি!

আমাদের সক্ষমতায় ঘাটতি আছে এটা সত্য। তবে সক্ষমতা যতটুকু আছে ততটুকুও যথাযথ প্রয়োগ অনুপস্থিত

করোনাকালীন প্রকৃতি পৃথিবীকে তার দখল নিতে মানুষকে ঘরবন্দী করেছে। অতঃপর আমরা দেখলাম তরতর করে পরিবেশ কীভাবে সতেজ হলো। কি দাপট দেখালো ঢাকার শহরের ঝিমিয়ে পরা মৃত প্রায় গাছগুলোও! শুশুক থেকে শুরু করে তিমি পর্যন্ত উপকূলে তৈরি করেছিলো তাদের চলাচলের অভয়ারণ্য। এর অর্থ দাঁড়াল- মানুষ যখন পরিবেশের ওপর আগ্রাসী ভূমিকা বলবৎ রাখবে, তখন প্রকৃতি মারমুখী হয়ে প্রয়োজনে মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে তার আপন পরিবেশে ফিরবেই। কিন্তু আমাদের সমস্ত কাজ, সমস্ত উন্নয়ন প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই। পরিবেশ-প্রতিবেশের বিপক্ষে কেন আমরা যুদ্ধে নামছি? বরং পরিবেশের সাথে ভারসাম্য রেখে সারা পৃথিবীতে মানব সভ্যতার উন্নয়নে তো কোন বাধা নেই।

পৃথিবী যখন পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, জলবায়ু যখন উত্তাল হয়ে উঠেছে; সেই সময়টাতেই আমরা সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেষ্টনকারী বন ধ্বংস করে চলেছি। ধ্বংস করে চলেছি চট্টগ্রামে সিআরবি এলাকার বনজ প্রকৃতি। মধুপুর এবং পার্বত্য বনের গাছ নিয়মিত চুরি হয়ে যাচ্ছে বনদস্যুদের কবলে। নদী, বায়ু, পানি তার চিরাচরিত প্রবাহে বহমান। বাঁধ দিয়ে তাকে আটকানো অসম্ভব; দরকার হলে সে তার গতিপথ পরিবর্তন করে হলেও সামনের দিকে ধাবিত হবে। জলবায়ুর এ পরিবর্তন ঠেকানো এখনই সময়ের দাবি। নতুবা বন্যা-ভাঙনের চেয়েও বৃহৎ কোন বিপর্যয় আমাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক

back to top