alt

উপ-সম্পাদকীয়

আফগানিস্তানে তালেবান ও ভূলুণ্ঠিত মানবাধিকার

সজীব ওয়াফি

: শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

আফগানিস্তানে পুনরায় তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। সেখানে ঘটছে নানা ঘটনা প্রবাহ। এর ভেতরে নারী অধিকার নিয়ে সেখানকার নারীরা সোচ্চার হয়েছেন। এত দ্রুত বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে কেউ প্রতিবাদ করতেছেন এটা ইতিবাচক সংবাদ। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে তালেবানরা সরকার গঠনের কয়েকদিনের মাথায় নারী অধিকারে যারা আন্দোলন করেছেন, তাদের আন্দোলনের খবর প্রচার করার জন্য সেখানকার দুজন সাংবাদিককে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের অর্ধ-উলঙ্গ করে ব্যাপক মারধর করা হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত হলেও এ পর্যন্ত ঠিক ছিল, কারণ বিষয়টা একান্তই আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ এবং সেখানকার নাগরিকেরাই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন; কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আমাদের করার তেমন কিছু নেই। অসুবিধাটা হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে তালেবানদের উগ্র-রক্ষণশীল ঘটনার খবর প্রকাশ পাওয়ার পরপর অনেকের ভেতরে পুলকিত ভাব দেখা যাচ্ছে; এমনকি সাংবাদিক নির্যাতনের খবরে উৎফুল্লতা প্রকাশ পেল। আগে বুঝতাম এই ধরনের অপ্রত্যাশিত কাজগুলো প্রপাগান্ডা ছড়াতে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বলয় কাজ করে। হঠাৎ করে দেখতেছি পরিচিত কোন কোন মুখ এবং মিউচুয়াল বন্ধুরা এ রকমের নেতিবাচক কাজে যুক্ত। এটা হচ্ছে এই গৌরচন্দ্রিকার ক্ষোভ।

১৯৭৮ সাল। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে পিডিপিএ (পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান)। পরবর্তীতে সরকারের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং বিদ্রোহীদের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কমিউনিস্ট সরকার রক্ষা করতে শুরু হয় সোভিয়েত আগ্রাসন। অতঃপর মার্কিনি অর্থায়নে সোভিয়েতবিরোধী লড়াই চলে ১৯৭৯-৮৯ সাল পর্যন্ত। সোভিয়েত বাহিনী হটাতে ১৯৮৯ সালে উগ্র তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতায়। মার্কিন জোটের হাতে পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পৃথিবী তাদের ইসলামী আমিরাতের উগ্র ভয়াল রূপ দেখেছে।

বছর কুড়ি আগে ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টুইন টাওয়ারে সোজা বিমান ঢুকিয়ে হামলা চালায় আল কায়েদা সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শুরু হয় আমেরিকার যুদ্ধ। তালেবানদের সঙ্গে আল কায়েদার যোগসূত্র থাকায় মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানে আসে। পতন ঘটে তালেবান শাসনের। এরপর ২০০১ সালে কাবুলে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় সরকার। প্রতিষ্ঠা হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের। তবে এটা সত্য যে মার্কিনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সরকার গঠন হয়েছে এবং মার্কিন অনুগতরা সরকারে ছিলেন। জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছিল যথাসময়েই। আফগান নারীরাও প্রথমবারের মতো নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, ক্রিকেট ফুটবল এবং অলিম্পিকসহ এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে নারীদের পদচারণা পৌঁছায়নি।

তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানের অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর। ছিল না কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবারে দখলের পূর্বে যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি আছে বেসরকারি ব্যাংক। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অন্যান্য আর্থিক পরিষেবামূলক প্রতিষ্ঠান। পূর্বে তালেবানরা ধ্বংস করেছিল তাদের নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা। ধ্বংস করা স্কুল কলেজগুলো আবার নতুন করে দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই তালেবান গোষ্ঠী তাদের বিজয় দেখেছে। যদিও শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো সেনারা আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। রাষ্ট্র দখলের পরপরই প্রথমে যে কাজটা তালেবান করল সেটা হচ্ছে- দেয়াল থেকে নারীদের ছবি মুছে দেয়া, সংস্কৃতি মুছে দেয়া!

তালেবানি আক্রমণ থেকে জীবন বাঁচাতে কয়েক হাজার সেনাসদস্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছে। রক্তপাত এড়াতে সরকার ভেঙে দিয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। বিশ্ব দেখেছে সাধারণ আফগান নাগরিকেরা কীভাবে ভয় অনিশ্চয়তা নিয়ে দেশ ছেড়েছে। মার্কিন সরকারপক্ষ থেকে বাংলাদেশেও কিছু আফগান নাগরিকদের সাময়িক আশ্রয়ের কথা বলা হয়েছিল। বিভিন্ন সংকটে বাংলাদেশের মার্কিন অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলন করে সব বিরোধীদের ক্ষমা এসব মিডিয়া ও নারী স্বাধীনতা দেয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালেবান। জানানো হয়েছিল নারী এবং সংবাদমাধ্যমকে সম্মান করা হবে। অনেকের মনে হয়েছিল তালেবান আগের তুলনায় বদলে গেছে, তাদের নীতিগত পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে নারীদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে।

তালেবানের নতুন সরকার গঠনের পরপর নেতৃত্বরা নারীদের হেয় করে কথাবার্তা বলেছেন। উচ্চশিক্ষা পিএইচডি ডিগ্রিকে মূল্যহীন বলেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী। নারীদের কাটা তরমুজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কাবুল এবং হেরাতে নিজেদের অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন দেশটির অনেক নারী। বহু নারীর করা এ বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করেছে তালেবান। হেঁটে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের দিকে যাওয়া চেষ্টা করলে তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস এবং পেপার স্প্রে ছোড়া হয়। তালেবানবিরোধী আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশ করায় বেশ কয়েকজন আফগানিস্তান সাংবাদিককে বেধড়ক মারধর করেছে তালেবান সদস্যরা। কারও কারও ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়েছেও।

রাষ্ট্র দখলের পরপরই প্রথমে যে কাজটা তালেবান করল সেটা হচ্ছে- দেয়াল থেকে নারীদের ছবি মুছে দেয়া, সংস্কৃতি মুছে দেয়া!

আফগানিস্তানের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট রুহুল্লাহ আজিজীকে হত্যার পর মৃতদেহ দাফন না করতে চাপ প্রয়োগের মতো অমানবিক কাজে জড়িত হয়েছে তালেবানিরা। তার শরীর পচা উচিত বলেও দুর্ব্যবহার করেছে। গুঁড়িয়ে দিয়েছে আহমদ শাহ মাসুদের সমাধি। অথচ মাসুদকে সেখানে ‘জাতীয় নায়ক’ বিবেচনা করা হয়। তালেবানদের ভয়ে পোশাক বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন স্থানীয় মানুষ; কাবুলে জিন্স, স্যুট, টি-শার্ট কেনার লোক নেই। যৌনকর্মীদের তালিকা করা হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে তালিকায় নাম থাকা যৌনকর্মীদের খুঁজে বের করে তাদের মেরে ফেলা হতে পারে। শিরচ্ছেদ, পাথর নিক্ষেপ বা ঝুলিয়ে মারার আগে নারীদের সন্ত্রাসীদের দিয়ে গণধর্ষণ করানো হতে পারে অথবা তাদের তৈরি করতে পারে ক্রীতদাসে। নারীদের কর্মস্থলে আসতে করা হয়েছে নিরুৎসাহিত। তালেবানের সর্বোচ্চ কতৃপক্ষ বলেছে নারীদের কাজ সন্তান ধারণ করা। সরকারের ভেতরেও তারা একেছে নারী শূন্যতার রূপরেখা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণীকক্ষের ভেতরে ছেলেমেয়েদের মাঝে পর্দা ব্যবহার করতে হচ্ছে। নারীকে তারা চার দেয়ালের ভেতরে বদ্ধ করার পাঁয়তারায় লিপ্ত। মোটকথা তালেবানিরা আফগানিস্তানে শরিয়াহ্্ আইন বাস্তবায়নের ধোঁয়া তুলে পৌঁছে গেছে জাহেলিয়াতের যুগে।

পূর্বের দিনগুলোতে তালেবান নারীদের স্কুলে যেতে বাধা দিয়েছিল। এবারেও তারা একেই পথে হাঁটছে। সঙ্গে পুরুষ আত্মীয় ছাড়া নারীদের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ। পরিবহন শ্রমিকদের মারধর করা হয়েছে পুরুষ আত্মীয় ছাড়া একজন নারীকে বহন করার জন্য। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনা ঘটছে তার আত্মীয়-স্বজনদের সামনেই। অভিযোগ আছে ধর্ষণ করতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মেয়েদের খোঁজার। ধর্ষণ থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার চিন্তা করেছেন সেখানকার নারীরা। প্রতিশোধ নিতে ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে এবং ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনও দেখছে তালেবান। ফলাফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাগজপত্র-অর্জন পুড়িয়ে ফেলেছেন অনেকে। পছন্দের বইপত্র লুকিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ। উপরন্তু তালেবান মুখপাত্র আফগান নারীদের অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে নাক না গলানোর মতো বাক্যবাণ দিয়ে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।

আফগানিস্তানে সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট তীব্র এবং গুরুতর। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সেখানে পুরোদমে ধসে পরেছে। একরকম পরিস্থিতিতে সে বিষয়ে উৎফুল্লতা প্রকাশ করা অথবা বেগম রোকেয়ার দুঃসময়ের দিকে পশ্চাৎপদ আকাক্সিক্ষতরা আদতে সংকীর্ণনা। তাদের ঘরে মা-বোন আছেন এটা তারা কি করে ভুলে যান! সবচেয়ে বড় কথা সাংবাদিকতা পেশাদারিত্ব, সাংবাদিকেরা চাকরি করেন। নিজ দেশে নারীদের অধিকারের জন্য লড়ে যেতে তাদের লাঞ্ছিত হওয়া দেখে আনন্দিত হওয়ারা মানসিক বিকলাঙ্গ। তালেবানরা নিজ ভূখন্ড দখলদার মুক্ত করার জন্য যোদ্ধা হতে পারেন, বীর হতে পারেন; কিন্তু তারা যে পথে হাঁটছেন সেটা অন্ধকার যুগ, যা তাদের আরও কয়েকশ’ বছর পিছিয়ে দিবে। তাদের নিজস্ব আদর্শ বাস্তবায়নে ইসলামি শরীয়াহ সামনে আনলেও, তারা বরং ইসলামেরই ক্ষতি করেছেন। আমাদের দেশীয় তালেবানবাদীদের রোধ করা জরুরি। বাঙালি সাংস্কৃতিক জাগরণে তালেবানি ভাবধারা এবং এই অসুস্থ নেতিবাচক মানসিকতা প্রতিহত করার একমাত্র উপায়।

আমেরিকার দখলদারিত্বের একটা অধ্যায় আফগানিস্তানে সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু দোর্দ- প্রতাপে তালেবান যে পথে হাঁটছে এটা শুভঙ্কর নয়। সাংবাদিক নির্যাতন, সমাধি গুঁড়িয়ে দেয়া, দেশ ত্যাগে জড়ো হওয়াদের ওপর গুলি, নারীদের কাজে যোগ দিতে না দেয়া, নারীদের মাথায় রাইফেলের ম্যাগাজিন দিয়ে আঘাত-রক্তাক্ত করা, ঘর থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া এবং হত্যা-ধর্ষণে আফগানিস্তানে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। দীর্ঘ নির্বাসনের পর শুধু তালেবাদের সমালোচনা না করে, কীভাবে তালেবানকে পরিবর্তন করা যায়; কীভাবে সেখানে একটা গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন সম্ভব হয় বিশ্ববাসীকে সে পথেই হাঁটা যুক্তিসঙ্গত। তালেবানদেরও মধ্যযুগীয় অন্ধকার যুগে পৌঁছানো, রক্তপাত ও সহিংসতা পরিহার কর্তব্য; নতুবা এ বিজয় বুমেরাং, দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি অনিবার্য।

[লেখক : প্রাবন্ধিক

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আফগানিস্তানে তালেবান ও ভূলুণ্ঠিত মানবাধিকার

সজীব ওয়াফি

শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

আফগানিস্তানে পুনরায় তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। সেখানে ঘটছে নানা ঘটনা প্রবাহ। এর ভেতরে নারী অধিকার নিয়ে সেখানকার নারীরা সোচ্চার হয়েছেন। এত দ্রুত বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে কেউ প্রতিবাদ করতেছেন এটা ইতিবাচক সংবাদ। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে তালেবানরা সরকার গঠনের কয়েকদিনের মাথায় নারী অধিকারে যারা আন্দোলন করেছেন, তাদের আন্দোলনের খবর প্রচার করার জন্য সেখানকার দুজন সাংবাদিককে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের অর্ধ-উলঙ্গ করে ব্যাপক মারধর করা হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত হলেও এ পর্যন্ত ঠিক ছিল, কারণ বিষয়টা একান্তই আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ এবং সেখানকার নাগরিকেরাই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন; কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আমাদের করার তেমন কিছু নেই। অসুবিধাটা হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে তালেবানদের উগ্র-রক্ষণশীল ঘটনার খবর প্রকাশ পাওয়ার পরপর অনেকের ভেতরে পুলকিত ভাব দেখা যাচ্ছে; এমনকি সাংবাদিক নির্যাতনের খবরে উৎফুল্লতা প্রকাশ পেল। আগে বুঝতাম এই ধরনের অপ্রত্যাশিত কাজগুলো প্রপাগান্ডা ছড়াতে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বলয় কাজ করে। হঠাৎ করে দেখতেছি পরিচিত কোন কোন মুখ এবং মিউচুয়াল বন্ধুরা এ রকমের নেতিবাচক কাজে যুক্ত। এটা হচ্ছে এই গৌরচন্দ্রিকার ক্ষোভ।

১৯৭৮ সাল। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে পিডিপিএ (পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান)। পরবর্তীতে সরকারের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং বিদ্রোহীদের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কমিউনিস্ট সরকার রক্ষা করতে শুরু হয় সোভিয়েত আগ্রাসন। অতঃপর মার্কিনি অর্থায়নে সোভিয়েতবিরোধী লড়াই চলে ১৯৭৯-৮৯ সাল পর্যন্ত। সোভিয়েত বাহিনী হটাতে ১৯৮৯ সালে উগ্র তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতায়। মার্কিন জোটের হাতে পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পৃথিবী তাদের ইসলামী আমিরাতের উগ্র ভয়াল রূপ দেখেছে।

বছর কুড়ি আগে ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টুইন টাওয়ারে সোজা বিমান ঢুকিয়ে হামলা চালায় আল কায়েদা সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শুরু হয় আমেরিকার যুদ্ধ। তালেবানদের সঙ্গে আল কায়েদার যোগসূত্র থাকায় মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানে আসে। পতন ঘটে তালেবান শাসনের। এরপর ২০০১ সালে কাবুলে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় সরকার। প্রতিষ্ঠা হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের। তবে এটা সত্য যে মার্কিনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সরকার গঠন হয়েছে এবং মার্কিন অনুগতরা সরকারে ছিলেন। জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছিল যথাসময়েই। আফগান নারীরাও প্রথমবারের মতো নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, ক্রিকেট ফুটবল এবং অলিম্পিকসহ এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে নারীদের পদচারণা পৌঁছায়নি।

তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানের অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর। ছিল না কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবারে দখলের পূর্বে যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি আছে বেসরকারি ব্যাংক। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অন্যান্য আর্থিক পরিষেবামূলক প্রতিষ্ঠান। পূর্বে তালেবানরা ধ্বংস করেছিল তাদের নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা। ধ্বংস করা স্কুল কলেজগুলো আবার নতুন করে দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই তালেবান গোষ্ঠী তাদের বিজয় দেখেছে। যদিও শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো সেনারা আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। রাষ্ট্র দখলের পরপরই প্রথমে যে কাজটা তালেবান করল সেটা হচ্ছে- দেয়াল থেকে নারীদের ছবি মুছে দেয়া, সংস্কৃতি মুছে দেয়া!

তালেবানি আক্রমণ থেকে জীবন বাঁচাতে কয়েক হাজার সেনাসদস্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছে। রক্তপাত এড়াতে সরকার ভেঙে দিয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। বিশ্ব দেখেছে সাধারণ আফগান নাগরিকেরা কীভাবে ভয় অনিশ্চয়তা নিয়ে দেশ ছেড়েছে। মার্কিন সরকারপক্ষ থেকে বাংলাদেশেও কিছু আফগান নাগরিকদের সাময়িক আশ্রয়ের কথা বলা হয়েছিল। বিভিন্ন সংকটে বাংলাদেশের মার্কিন অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলন করে সব বিরোধীদের ক্ষমা এসব মিডিয়া ও নারী স্বাধীনতা দেয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালেবান। জানানো হয়েছিল নারী এবং সংবাদমাধ্যমকে সম্মান করা হবে। অনেকের মনে হয়েছিল তালেবান আগের তুলনায় বদলে গেছে, তাদের নীতিগত পরিবর্তন এসেছে, বিশেষ করে নারীদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে।

তালেবানের নতুন সরকার গঠনের পরপর নেতৃত্বরা নারীদের হেয় করে কথাবার্তা বলেছেন। উচ্চশিক্ষা পিএইচডি ডিগ্রিকে মূল্যহীন বলেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী। নারীদের কাটা তরমুজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কাবুল এবং হেরাতে নিজেদের অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন দেশটির অনেক নারী। বহু নারীর করা এ বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করেছে তালেবান। হেঁটে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের দিকে যাওয়া চেষ্টা করলে তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস এবং পেপার স্প্রে ছোড়া হয়। তালেবানবিরোধী আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশ করায় বেশ কয়েকজন আফগানিস্তান সাংবাদিককে বেধড়ক মারধর করেছে তালেবান সদস্যরা। কারও কারও ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়েছেও।

রাষ্ট্র দখলের পরপরই প্রথমে যে কাজটা তালেবান করল সেটা হচ্ছে- দেয়াল থেকে নারীদের ছবি মুছে দেয়া, সংস্কৃতি মুছে দেয়া!

আফগানিস্তানের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট রুহুল্লাহ আজিজীকে হত্যার পর মৃতদেহ দাফন না করতে চাপ প্রয়োগের মতো অমানবিক কাজে জড়িত হয়েছে তালেবানিরা। তার শরীর পচা উচিত বলেও দুর্ব্যবহার করেছে। গুঁড়িয়ে দিয়েছে আহমদ শাহ মাসুদের সমাধি। অথচ মাসুদকে সেখানে ‘জাতীয় নায়ক’ বিবেচনা করা হয়। তালেবানদের ভয়ে পোশাক বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন স্থানীয় মানুষ; কাবুলে জিন্স, স্যুট, টি-শার্ট কেনার লোক নেই। যৌনকর্মীদের তালিকা করা হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে তালিকায় নাম থাকা যৌনকর্মীদের খুঁজে বের করে তাদের মেরে ফেলা হতে পারে। শিরচ্ছেদ, পাথর নিক্ষেপ বা ঝুলিয়ে মারার আগে নারীদের সন্ত্রাসীদের দিয়ে গণধর্ষণ করানো হতে পারে অথবা তাদের তৈরি করতে পারে ক্রীতদাসে। নারীদের কর্মস্থলে আসতে করা হয়েছে নিরুৎসাহিত। তালেবানের সর্বোচ্চ কতৃপক্ষ বলেছে নারীদের কাজ সন্তান ধারণ করা। সরকারের ভেতরেও তারা একেছে নারী শূন্যতার রূপরেখা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণীকক্ষের ভেতরে ছেলেমেয়েদের মাঝে পর্দা ব্যবহার করতে হচ্ছে। নারীকে তারা চার দেয়ালের ভেতরে বদ্ধ করার পাঁয়তারায় লিপ্ত। মোটকথা তালেবানিরা আফগানিস্তানে শরিয়াহ্্ আইন বাস্তবায়নের ধোঁয়া তুলে পৌঁছে গেছে জাহেলিয়াতের যুগে।

পূর্বের দিনগুলোতে তালেবান নারীদের স্কুলে যেতে বাধা দিয়েছিল। এবারেও তারা একেই পথে হাঁটছে। সঙ্গে পুরুষ আত্মীয় ছাড়া নারীদের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ। পরিবহন শ্রমিকদের মারধর করা হয়েছে পুরুষ আত্মীয় ছাড়া একজন নারীকে বহন করার জন্য। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনা ঘটছে তার আত্মীয়-স্বজনদের সামনেই। অভিযোগ আছে ধর্ষণ করতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মেয়েদের খোঁজার। ধর্ষণ থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার চিন্তা করেছেন সেখানকার নারীরা। প্রতিশোধ নিতে ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে এবং ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনও দেখছে তালেবান। ফলাফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাগজপত্র-অর্জন পুড়িয়ে ফেলেছেন অনেকে। পছন্দের বইপত্র লুকিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ। উপরন্তু তালেবান মুখপাত্র আফগান নারীদের অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে নাক না গলানোর মতো বাক্যবাণ দিয়ে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।

আফগানিস্তানে সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট তীব্র এবং গুরুতর। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সেখানে পুরোদমে ধসে পরেছে। একরকম পরিস্থিতিতে সে বিষয়ে উৎফুল্লতা প্রকাশ করা অথবা বেগম রোকেয়ার দুঃসময়ের দিকে পশ্চাৎপদ আকাক্সিক্ষতরা আদতে সংকীর্ণনা। তাদের ঘরে মা-বোন আছেন এটা তারা কি করে ভুলে যান! সবচেয়ে বড় কথা সাংবাদিকতা পেশাদারিত্ব, সাংবাদিকেরা চাকরি করেন। নিজ দেশে নারীদের অধিকারের জন্য লড়ে যেতে তাদের লাঞ্ছিত হওয়া দেখে আনন্দিত হওয়ারা মানসিক বিকলাঙ্গ। তালেবানরা নিজ ভূখন্ড দখলদার মুক্ত করার জন্য যোদ্ধা হতে পারেন, বীর হতে পারেন; কিন্তু তারা যে পথে হাঁটছেন সেটা অন্ধকার যুগ, যা তাদের আরও কয়েকশ’ বছর পিছিয়ে দিবে। তাদের নিজস্ব আদর্শ বাস্তবায়নে ইসলামি শরীয়াহ সামনে আনলেও, তারা বরং ইসলামেরই ক্ষতি করেছেন। আমাদের দেশীয় তালেবানবাদীদের রোধ করা জরুরি। বাঙালি সাংস্কৃতিক জাগরণে তালেবানি ভাবধারা এবং এই অসুস্থ নেতিবাচক মানসিকতা প্রতিহত করার একমাত্র উপায়।

আমেরিকার দখলদারিত্বের একটা অধ্যায় আফগানিস্তানে সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু দোর্দ- প্রতাপে তালেবান যে পথে হাঁটছে এটা শুভঙ্কর নয়। সাংবাদিক নির্যাতন, সমাধি গুঁড়িয়ে দেয়া, দেশ ত্যাগে জড়ো হওয়াদের ওপর গুলি, নারীদের কাজে যোগ দিতে না দেয়া, নারীদের মাথায় রাইফেলের ম্যাগাজিন দিয়ে আঘাত-রক্তাক্ত করা, ঘর থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া এবং হত্যা-ধর্ষণে আফগানিস্তানে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। দীর্ঘ নির্বাসনের পর শুধু তালেবাদের সমালোচনা না করে, কীভাবে তালেবানকে পরিবর্তন করা যায়; কীভাবে সেখানে একটা গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন সম্ভব হয় বিশ্ববাসীকে সে পথেই হাঁটা যুক্তিসঙ্গত। তালেবানদেরও মধ্যযুগীয় অন্ধকার যুগে পৌঁছানো, রক্তপাত ও সহিংসতা পরিহার কর্তব্য; নতুবা এ বিজয় বুমেরাং, দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি অনিবার্য।

[লেখক : প্রাবন্ধিক

back to top