সিরাজুল হক
বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন অনেক দিন যাবত চলে আসা একটি আখভিত্তিক চিনিশিল্প সংস্থা। দেশের অন্যান্য করপোরেশন বা সংস্থার চেয়ে এটি একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রতিষ্ঠান। আখভিত্তিক চিনিশিল্প সরাসরি গ্রাম বাংলার লাখ লাখ চাষির ভাগ্য উন্নয়নের সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে নানা কারণে শিল্পটি আজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছে। তৃণমূলের চাষিদের ভাগ্যোন্নয়নের স্বার্থে, সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধকরণের জন্য সরকার এই শিল্পের প্রতি বিশেষ নজর দেয়ার যথার্থ প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে- এটাই কাঙ্খিত। আখভিত্তিক চিনিশিল্পের উদ্ধারকল্পে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে উল্লেখ করা হলো।
মিলে চিনি আহরণের হার বা রিকভারী কমপক্ষে ৮.৫ হতে ৯.০ পারসেন্ট হওয়ার মতো (অর্থাৎ আখে সুগার কনটেন্ট হতে হবে কমপক্ষে ১১.৫ +) উন্নত জাতের আখের জাত আবিষ্কার করতেই হবে। আখের উন্নতমানের জাত আবিষ্কারের সোল দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশ সুগার কেইন রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী যা বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন। এই ইনস্টিটিউটটি যখন সুগার করপোরেশনের অধীনে ছিল তখন তাদের পারফরম্যান্স অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। ইনস্টিটিউটটি আগামীতে কার অধীনে থাকা উচিত অথবা কীভাবে তাদের পারফরম্যান্স উন্নত করা যায় অথবা উন্নত মানের আখের জাত উদ্ভাবনে আলাদাভাবে বিদেশি বিজ্ঞানীদের সাহায্য নেয়া যায় কি না সেসব বিষয়ে নতুন করে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাহোক, তাদের কমপক্ষে ১১.৫+ পার্সেন্ট সুগার কন্টেন্ট বিশিষ্ট ও উচ্চ ফলনশীল আখের জাত উদ্ভাবন করতেই হবে। আর প্রত্যেকটি মিলের ইক্ষু বিভাগ দক্ষতার সঙ্গে সেসব উন্নত গুণাবলির আখের উৎপাদন মাঠপর্যায়ে নিশ্চিত করবেন মিল জোনের আখ চাষিদের একান্ত সহযোগিতায়। প্রতি বছরেই মিলের চাহিদা মতো আখ উৎপাদন অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে। এই সব টার্গেট যথাযথভাবে পূরণ করতে হলে আখচাষি নির্যাতন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমচাষিদের সঙ্গে সদাচরণ করা, যথাসময়ে আখ চাষের জন্য ইনপুট সরবরাহ এবং আখ ক্রয়ের জন্য পূর্ণমূল্য পরিশোধ করে আখচাষিদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
অপ্রয়োজনীয় এবং কাজ করে না এমন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবশ্যই বাদ দিতে হবে। সুগার মিলসমূহে অবসোলেট জনবলের অভাব নাই। আবার কারখানায় দক্ষ ও পর্যাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার এবং কেমিস্টের অভাব প্রকট। সুষ্ঠুভাবে কারখানা চালাতে হলে দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই।
কারখানায় প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতেই হবে এবং তাদের নিয়েই দক্ষতার সঙ্গে মিলগুলোকে চালাতে হবে। সদর দপ্তর এবং মিল কারখানায় সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন জনবলের বিকল্প নেই।
গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাদের ইউনিয়নের নেতা, পাতি নেতা, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের সাক্ষাৎকার দিতে দিতেই আর আপ্যায়ন করতে করতেই দিনের অধিকাংশ সময় কেটে যায়। তারা কাজ করবেন কখন? আর ইউনিয়নের প্রায় সব নেতাই কোনরূপ কাজকর্ম করে না। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে এইসব পরিস্থিতি বিরাজমান নেই। যেসব কর্মকর্তা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো করতে পারেন না তারাই আবার প্রাইভেট কোম্পানিতে অনেক ভালো করে থাকেন। কারণ সেখানে ইউনিয়নের এবং রাজনৈতিক দলের কোন পাত্তা নেই। সামান্য কিছু থাকলেও তা মালিক স্বয়ং নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
এমতাবস্থায় করপোরেশন সদর দপ্তর এবং মিলগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। ইউনিয়ন কার্যক্রম অবশ্যই বাতিল করতে হবে অথবা খুবই সীমিত করতে হবে।
এই সব সুনিশ্চিত করতে পারলে এমন কি বর্তমানের পুরোনো মিলগুলো দিয়েই লাভজনকভাবে চালানো সম্ভব।
তারপর পর্যায়ক্রমে মিলগুলোকে উচ্চক্ষমতা ও দক্ষতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে। সঙ্গে সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কিছু মিলকে রিফাইনারিতেও পরিণত করতে হবে। উপজাতভিত্তিক পাওয়ার এলকোহল যা বায়ুদূষণ রোধকারী একটি অমূল্য ফুয়েল তার জন্য ডিস্টিলারি কারখানা স্থাপন করতে হবে। কো জেনারেশন পাওয়ার প্লান্টসহ আরও অনেক প্লান্ট স্থাপনের সম্ভাবনা বিবেচনায় আনতে হবে।
উক্ত বিষয় সমূহের বাস্তবায়নের জন্য প্রথম পর্যায় থেকেই অভিজ্ঞতা ও প্রমাণিত দক্ষতা সম্পন্ন স্থানীয় বিশেষজ্ঞের মতামত ও সার্ভিস অবশ্যই নিতে হবে।
শুধু বিদেশিদের পরামর্শে স্থাপিত ব্যয়বহুল চিনি কারখানাগুলো দিয়ে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নতি সাধন করা সম্ভব হবে না। কারণ তারা আমাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে একদম পরিচিত নয়। শুনা যাচ্ছে, বিদেশিদের পরামর্শ ও সুপারিশে অতি উচ্চ মূল্যে বড় বড় সাইজের নতুন সুগার মিল স্থাপনে সরকারের নিকট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। আখের অভাবে বর্তমানের মিলগুলোকেই চালানো যাচ্ছে না। বিদেশিদের স্থাপিত নতুন মিলগুলো কী দিয়ে চলবে? যদিও তারা আখ উন্নয়নের কাজ করবেন বলে জানা গেছে। আখ উন্নয়ন কার্যক্রম মিল সমূহের চাহিদা অনুযায়ী অব্যাহতভাবে সম্পন্ন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যাই হোক, আখ উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে কমপক্ষে ৪/৫ বছর সময় লাগবে। তবুও তা যথাযথভাবে প্রতি বছরই সুসম্পন্ন করা যাবে কি না তাতে অনেক সন্দেহ আছে। তাহলে নতুন মিলগুলোর আখের অভাব দূর হবে কী করে? আখচাষের উন্নয়ন সুনিশ্চিত না করে এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তদসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সুরাহা না করে একইসঙ্গে ৩/৪টি নতুন বড় বড় মিল স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হবে ভয়াবহ! সার্থক হতে হলে সঙ্গে আরও অনেক সংযোজন/বিয়োজনের বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তারজন্যই প্রমাণিত দক্ষতা সম্পন্ন স্থানীয় বিশেষজ্ঞের মতামত নেয়া অত্যাবশ্যক বলে মনে করি।
এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যাতে সুচিন্তিতভাবে যথাযথ সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় হস্তক্ষেপ কামনা করা যাচ্ছে। প্রয়োজনে আমি এই বিষয়ে যথার্থ সুপারিশ ও পরামর্শ দিতে প্রস্তুত আছি যাতে সরকারের সদিচ্ছা শতভাগ ফলপ্রসূ হতে পারে।
তাছাড়া, সর্ব বিষয়ে সব ধরনের দুর্নীতির পাগলা ঘোড়াকে অবশ্যই থামাতে হবে।
করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও বোর্ডের সদস্যদের অবশ্যই সুদক্ষ, দৃঢ মনোবল ও যোগ্যতা সম্পন্ন হতেই হবে যাদের নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মন্ত্রিমহোদয় এবং মন্ত্রণালয়ের যোগ্যতাপূর্ণ দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা করপোরেশনের কার্যক্রমে সাধারণত অধিকতর গতিশীলতা আনয়ন করে থাকে। এই বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করতে হবে।
দেশে প্রায় সব পর্যায়ে অতি শাসন এবং অতি তোষণের সংস্কৃতি বিদ্যমান। এই কালচার দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবেশে আরও বেশি কার্যকর হয়ে থাকে। এসব অপসংস্কৃতি মানুষের স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সামর্থ্যকে ম্লান করে দেয়। সুতরাং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উল্লেখিত অপসংস্কৃতি হতে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। এসব হতে মুক্তির ব্যবস্থাপনার আহ্বান আসতে হবে মূলত ওপর থেকে নিচের দিকে। সম্মানজনক, হৃদ্যতাপূর্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মস্পৃহা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সহায়ক ভূমিকা হিসাবে উপরিউক্ত সুপারিশ ও পরামর্শ মতে সরকার ও করপোরেশন যদি সততা, দৃঢ মনোবল ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করে, স্থানীয় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের বাস্তবসম্মত সুপারিশ গ্রহণ করে প্রকৃত প্রজেক্ট স্থিরকৃত করা হয় এবং প্রতিযোগিতা মূল্যে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে সাফল্য অর্জন করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
[লেখক : সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন]
                                        
                                        
                                        
                        ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                           	                                            সিরাজুল হক
বুধবার, ১৩ অক্টোবর ২০২১
বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন অনেক দিন যাবত চলে আসা একটি আখভিত্তিক চিনিশিল্প সংস্থা। দেশের অন্যান্য করপোরেশন বা সংস্থার চেয়ে এটি একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রতিষ্ঠান। আখভিত্তিক চিনিশিল্প সরাসরি গ্রাম বাংলার লাখ লাখ চাষির ভাগ্য উন্নয়নের সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে নানা কারণে শিল্পটি আজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছে। তৃণমূলের চাষিদের ভাগ্যোন্নয়নের স্বার্থে, সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধকরণের জন্য সরকার এই শিল্পের প্রতি বিশেষ নজর দেয়ার যথার্থ প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে- এটাই কাঙ্খিত। আখভিত্তিক চিনিশিল্পের উদ্ধারকল্পে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে উল্লেখ করা হলো।
মিলে চিনি আহরণের হার বা রিকভারী কমপক্ষে ৮.৫ হতে ৯.০ পারসেন্ট হওয়ার মতো (অর্থাৎ আখে সুগার কনটেন্ট হতে হবে কমপক্ষে ১১.৫ +) উন্নত জাতের আখের জাত আবিষ্কার করতেই হবে। আখের উন্নতমানের জাত আবিষ্কারের সোল দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশ সুগার কেইন রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী যা বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন। এই ইনস্টিটিউটটি যখন সুগার করপোরেশনের অধীনে ছিল তখন তাদের পারফরম্যান্স অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। ইনস্টিটিউটটি আগামীতে কার অধীনে থাকা উচিত অথবা কীভাবে তাদের পারফরম্যান্স উন্নত করা যায় অথবা উন্নত মানের আখের জাত উদ্ভাবনে আলাদাভাবে বিদেশি বিজ্ঞানীদের সাহায্য নেয়া যায় কি না সেসব বিষয়ে নতুন করে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাহোক, তাদের কমপক্ষে ১১.৫+ পার্সেন্ট সুগার কন্টেন্ট বিশিষ্ট ও উচ্চ ফলনশীল আখের জাত উদ্ভাবন করতেই হবে। আর প্রত্যেকটি মিলের ইক্ষু বিভাগ দক্ষতার সঙ্গে সেসব উন্নত গুণাবলির আখের উৎপাদন মাঠপর্যায়ে নিশ্চিত করবেন মিল জোনের আখ চাষিদের একান্ত সহযোগিতায়। প্রতি বছরেই মিলের চাহিদা মতো আখ উৎপাদন অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে। এই সব টার্গেট যথাযথভাবে পূরণ করতে হলে আখচাষি নির্যাতন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমচাষিদের সঙ্গে সদাচরণ করা, যথাসময়ে আখ চাষের জন্য ইনপুট সরবরাহ এবং আখ ক্রয়ের জন্য পূর্ণমূল্য পরিশোধ করে আখচাষিদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
অপ্রয়োজনীয় এবং কাজ করে না এমন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবশ্যই বাদ দিতে হবে। সুগার মিলসমূহে অবসোলেট জনবলের অভাব নাই। আবার কারখানায় দক্ষ ও পর্যাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার এবং কেমিস্টের অভাব প্রকট। সুষ্ঠুভাবে কারখানা চালাতে হলে দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই।
কারখানায় প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতেই হবে এবং তাদের নিয়েই দক্ষতার সঙ্গে মিলগুলোকে চালাতে হবে। সদর দপ্তর এবং মিল কারখানায় সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন জনবলের বিকল্প নেই।
গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাদের ইউনিয়নের নেতা, পাতি নেতা, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের সাক্ষাৎকার দিতে দিতেই আর আপ্যায়ন করতে করতেই দিনের অধিকাংশ সময় কেটে যায়। তারা কাজ করবেন কখন? আর ইউনিয়নের প্রায় সব নেতাই কোনরূপ কাজকর্ম করে না। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে এইসব পরিস্থিতি বিরাজমান নেই। যেসব কর্মকর্তা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো করতে পারেন না তারাই আবার প্রাইভেট কোম্পানিতে অনেক ভালো করে থাকেন। কারণ সেখানে ইউনিয়নের এবং রাজনৈতিক দলের কোন পাত্তা নেই। সামান্য কিছু থাকলেও তা মালিক স্বয়ং নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
এমতাবস্থায় করপোরেশন সদর দপ্তর এবং মিলগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। ইউনিয়ন কার্যক্রম অবশ্যই বাতিল করতে হবে অথবা খুবই সীমিত করতে হবে।
এই সব সুনিশ্চিত করতে পারলে এমন কি বর্তমানের পুরোনো মিলগুলো দিয়েই লাভজনকভাবে চালানো সম্ভব।
তারপর পর্যায়ক্রমে মিলগুলোকে উচ্চক্ষমতা ও দক্ষতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে। সঙ্গে সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কিছু মিলকে রিফাইনারিতেও পরিণত করতে হবে। উপজাতভিত্তিক পাওয়ার এলকোহল যা বায়ুদূষণ রোধকারী একটি অমূল্য ফুয়েল তার জন্য ডিস্টিলারি কারখানা স্থাপন করতে হবে। কো জেনারেশন পাওয়ার প্লান্টসহ আরও অনেক প্লান্ট স্থাপনের সম্ভাবনা বিবেচনায় আনতে হবে।
উক্ত বিষয় সমূহের বাস্তবায়নের জন্য প্রথম পর্যায় থেকেই অভিজ্ঞতা ও প্রমাণিত দক্ষতা সম্পন্ন স্থানীয় বিশেষজ্ঞের মতামত ও সার্ভিস অবশ্যই নিতে হবে।
শুধু বিদেশিদের পরামর্শে স্থাপিত ব্যয়বহুল চিনি কারখানাগুলো দিয়ে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নতি সাধন করা সম্ভব হবে না। কারণ তারা আমাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে একদম পরিচিত নয়। শুনা যাচ্ছে, বিদেশিদের পরামর্শ ও সুপারিশে অতি উচ্চ মূল্যে বড় বড় সাইজের নতুন সুগার মিল স্থাপনে সরকারের নিকট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। আখের অভাবে বর্তমানের মিলগুলোকেই চালানো যাচ্ছে না। বিদেশিদের স্থাপিত নতুন মিলগুলো কী দিয়ে চলবে? যদিও তারা আখ উন্নয়নের কাজ করবেন বলে জানা গেছে। আখ উন্নয়ন কার্যক্রম মিল সমূহের চাহিদা অনুযায়ী অব্যাহতভাবে সম্পন্ন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যাই হোক, আখ উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে কমপক্ষে ৪/৫ বছর সময় লাগবে। তবুও তা যথাযথভাবে প্রতি বছরই সুসম্পন্ন করা যাবে কি না তাতে অনেক সন্দেহ আছে। তাহলে নতুন মিলগুলোর আখের অভাব দূর হবে কী করে? আখচাষের উন্নয়ন সুনিশ্চিত না করে এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তদসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সুরাহা না করে একইসঙ্গে ৩/৪টি নতুন বড় বড় মিল স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হবে ভয়াবহ! সার্থক হতে হলে সঙ্গে আরও অনেক সংযোজন/বিয়োজনের বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তারজন্যই প্রমাণিত দক্ষতা সম্পন্ন স্থানীয় বিশেষজ্ঞের মতামত নেয়া অত্যাবশ্যক বলে মনে করি।
এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যাতে সুচিন্তিতভাবে যথাযথ সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় হস্তক্ষেপ কামনা করা যাচ্ছে। প্রয়োজনে আমি এই বিষয়ে যথার্থ সুপারিশ ও পরামর্শ দিতে প্রস্তুত আছি যাতে সরকারের সদিচ্ছা শতভাগ ফলপ্রসূ হতে পারে।
তাছাড়া, সর্ব বিষয়ে সব ধরনের দুর্নীতির পাগলা ঘোড়াকে অবশ্যই থামাতে হবে।
করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও বোর্ডের সদস্যদের অবশ্যই সুদক্ষ, দৃঢ মনোবল ও যোগ্যতা সম্পন্ন হতেই হবে যাদের নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মন্ত্রিমহোদয় এবং মন্ত্রণালয়ের যোগ্যতাপূর্ণ দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা করপোরেশনের কার্যক্রমে সাধারণত অধিকতর গতিশীলতা আনয়ন করে থাকে। এই বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করতে হবে।
দেশে প্রায় সব পর্যায়ে অতি শাসন এবং অতি তোষণের সংস্কৃতি বিদ্যমান। এই কালচার দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবেশে আরও বেশি কার্যকর হয়ে থাকে। এসব অপসংস্কৃতি মানুষের স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সামর্থ্যকে ম্লান করে দেয়। সুতরাং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উল্লেখিত অপসংস্কৃতি হতে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। এসব হতে মুক্তির ব্যবস্থাপনার আহ্বান আসতে হবে মূলত ওপর থেকে নিচের দিকে। সম্মানজনক, হৃদ্যতাপূর্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মস্পৃহা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সহায়ক ভূমিকা হিসাবে উপরিউক্ত সুপারিশ ও পরামর্শ মতে সরকার ও করপোরেশন যদি সততা, দৃঢ মনোবল ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করে, স্থানীয় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের বাস্তবসম্মত সুপারিশ গ্রহণ করে প্রকৃত প্রজেক্ট স্থিরকৃত করা হয় এবং প্রতিযোগিতা মূল্যে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে সাফল্য অর্জন করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
[লেখক : সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন]