রাজিব শর্মা
সময়টা ১৭৪২-১৭৫১। সুবে বাংলার নবাব তখন আলিবর্দী খাঁ। সেই সময় উড়িষ্যা আর রাঢ় বাংলা কেঁপে ওঠে ভয়াবহ বর্গী হামলায়। পরিস্থিতি এতোটাই প্রতিকূল হয়ে ওঠে যে উড়িষ্যা কার্যত নবাবের শাষণের বাইরে চলে যায় আর বাংলা, বিশেষত রাঢ় বাংলায় নবাবী সেনা-বর্গী বাহিনীর প্রতিস্পর্ধায় রণভূমি হয়ে ওঠে। বর্গী হামলায় কত যে কতো হত্যা, ধর্ষণ, সম্পদ লুণ্ঠন হয়েছে তা হিসাবের বাইরে।
দেশভাগের সময় যে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গের দিকে ম্যাস মাইগ্রেশন হয়েছিলো, তার বিপরীতমুখী মাইগ্রেশান হয়েছিলো সেই সময় রাঢ়বঙ্গ থেকে গাঙ্গেয় বদ্বীপের তথা পূর্ববঙ্গের দিকে ধর্ম নির্বিশেষে। অসংখ্য প্রাচীন জনপদ জনশূন্য হয়ে পড়ে, সপ্তগ্রামের মতন প্রায় দেড় হাজার বছরের বন্দর শহরের পতন ত্বরান্বিত হয় ভয়াবহ বর্গী হামলায়। মারাঠা বর্গীদের দাবি ছিলো চৌথ (চার ভাগের এক ভাগ ট্যাক্স) চাই, নবাবেরও জেদ যে চৌথ দেবো না... মারাঠাদের অন্য গোষ্ঠীপতি সদাশিবকে সেই সময়কার মূল্যের ২২ লাখ টাকা দিলেও বর্গীদের সাথে দ্বন্দ্বটা একপর্যায়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে এসে পড়ে।
মূর্শিদাবাদ বাঁচাতে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে নবাবী সৈন্য যে, রাঢ় বঙ্গ হয়ে ওঠে বর্গী অত্যাচারের মুক্তাঞ্চল। আজও লোকমুখে ছড়ায় বেঁচে আছে সেই স্মৃতি।
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/বর্গী এলো দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/খাজনা দেবো কিসে।
মারাঠা বর্গীদের দশ বছর ধরে হওয়া অত্যাচার একসাথে হয়নি। হয়েছিলো চার বারের আক্রমণে। তার মধ্যে তিনবার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বর্গী সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত। বাংলার ইতিহাসের কুখ্যাত এক নাম।
সময়টা ১৭৪২। সে বছর সেপ্টেম্বরে দুর্গাপূজা পড়েছে। ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে তখন চলছে প্রথমবারের ভয়াবহ বর্গীহানা। কাটোয়ার কাছে দাঁইহাট বলে একটা জায়গা আছে। সেই অঞ্চলটি তখন কার্যত বর্গী সেনাদের প্রধান শিবির। স্থানটির ভৌগোলিক সুবিধা হলো উত্তরে অজয় নদী আর পূর্বে ভাগীরথী। তার মুর্শিদাবাদে থাকা নবাবী সেনাদের জন্য দুর্গম্য।
ভাস্কর পন্ডিতের বাংলায় এসে ইচ্ছা জাগলো দুর্গাপূজা করার। সেই মতন স্থানীয় জমিদার বাড়িতে আয়োজন করলেন দুর্গাপূজা। জমিদার ও স্থানীয় মানুষদের না করবার উপায় নেই। অথবা সাক্ষাৎ মৃত্যু। ভয় ভক্তিতে আয়োজন হলো দুর্গাপূজা। সেই প্রাচীন জমিদার বাড়ির দুর্গাদালানের এখনো একটা দেয়াল টিকে আছে।
সেবার সেপ্টেম্বরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে পূজার সময়। নবাব দেখলেন এই সেরা সুযোগ। কারণ বাংলার কাদামাটিতে বর্গী সেনা অতোটা সক্ষম নয়। একবার ভাস্কর পন্ডিতকে হত্যা করতে পারলে সব সমস্যার সমাধান। তাই ঠিক করলেন পূজার সময়ই আক্রমণ করবেন বর্গী ক্যাম্প।
সপ্তমী তিথি। ভয়ে ভক্তিতে সেই অঞ্চলের জমিদাররা দলে দলে ভাস্কর পন্ডিতের পূজাতে। প্রচুর ছাগ বলির আয়োজন। বসেছে বাইজি নাচের আসরও। এদিকে ভাগিরথী পেরিয়ে সন্তর্পণে আসার চেষ্টা করলো নবাবের বাহিনী। মারাঠা দেওয়ান মীর হাবিব ছিলেন বর্গী সেনার নেতা। ভেঙে দিলেন গঙ্গার ওপর নৌকা দিয়ে বানানো সেতু। কামানের আঘাতে অনেক ক্ষতি হলো নবাবী সেনার।
নবাব এবার পরিকল্পনা পাল্টালেন। অজয় আর ভাগীরথীর সঙ্গমস্থলের কাছ দিয়ে বড় বড় নৌকা আর কাঠের পাটাতন বেঁধে নদী পারের চেষ্টা করলেন সন্তর্পণে। এদিকে চলছে সন্ধীপূজার আয়োজন। আর বর্গীরাও আশা করেনি যে ওই দূর্গম নদী পথ পেরিয়ে আক্রমণ হতে পারে। কিন্তু দুর্নিবার অজয়ের স্রোতে ভেঙে গেলো সেই সেতু। প্রায় ১৫০০ সেনার সলিল সমাধি হলো। সমরাস্ত্র, ঘোড়াসহ অনেক ক্ষতি হলো নবাবের। তবুও তিনি দমবার পাত্র নন। আবার নতুন করে সেতু বাঁধলেন। এবার সফল হলেন। অষ্টমীর রাতের অন্ধকারে বিশাল সৈন্য এসে লুকিয়ে রইলেন বিভিন্ন প্রান্তরে।
নবমীর সকালেই পূজাস্থলের চারদিক থেকে অতর্কিত আক্রমণের কবলে পড়লো বর্গী বাহিনী। পূজা প্রাঙ্গণে যেনো বর্গীসেনার বলির আয়োজন। রক্তস্নাত দুর্গাদালান।
ভাস্কর পন্ডিত বিপদ বুঝে পলায়ন করলো দক্ষিণের পথ ধরে। কথিত আছে, তার কাছে এক স্বর্ণদুর্গাপ্রতিমা ছিলো। যাওয়ার আগে নবমী তিথিতেই তিনি সেটা ভাগীরথীর জলে বিসর্জন দিয়ে যান। আর প্রতিজ্ঞা করে যান আর কোনো দিনও দাইহাঁটাতে দুর্গাপূজা করবেন না। তবে তিনি ফিরে আসবেন। ফিরে আসবেন রক্তের হোলি খেলতে বাংলার বুকে।
[লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট]
রাজিব শর্মা
বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১
সময়টা ১৭৪২-১৭৫১। সুবে বাংলার নবাব তখন আলিবর্দী খাঁ। সেই সময় উড়িষ্যা আর রাঢ় বাংলা কেঁপে ওঠে ভয়াবহ বর্গী হামলায়। পরিস্থিতি এতোটাই প্রতিকূল হয়ে ওঠে যে উড়িষ্যা কার্যত নবাবের শাষণের বাইরে চলে যায় আর বাংলা, বিশেষত রাঢ় বাংলায় নবাবী সেনা-বর্গী বাহিনীর প্রতিস্পর্ধায় রণভূমি হয়ে ওঠে। বর্গী হামলায় কত যে কতো হত্যা, ধর্ষণ, সম্পদ লুণ্ঠন হয়েছে তা হিসাবের বাইরে।
দেশভাগের সময় যে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গের দিকে ম্যাস মাইগ্রেশন হয়েছিলো, তার বিপরীতমুখী মাইগ্রেশান হয়েছিলো সেই সময় রাঢ়বঙ্গ থেকে গাঙ্গেয় বদ্বীপের তথা পূর্ববঙ্গের দিকে ধর্ম নির্বিশেষে। অসংখ্য প্রাচীন জনপদ জনশূন্য হয়ে পড়ে, সপ্তগ্রামের মতন প্রায় দেড় হাজার বছরের বন্দর শহরের পতন ত্বরান্বিত হয় ভয়াবহ বর্গী হামলায়। মারাঠা বর্গীদের দাবি ছিলো চৌথ (চার ভাগের এক ভাগ ট্যাক্স) চাই, নবাবেরও জেদ যে চৌথ দেবো না... মারাঠাদের অন্য গোষ্ঠীপতি সদাশিবকে সেই সময়কার মূল্যের ২২ লাখ টাকা দিলেও বর্গীদের সাথে দ্বন্দ্বটা একপর্যায়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে এসে পড়ে।
মূর্শিদাবাদ বাঁচাতে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে নবাবী সৈন্য যে, রাঢ় বঙ্গ হয়ে ওঠে বর্গী অত্যাচারের মুক্তাঞ্চল। আজও লোকমুখে ছড়ায় বেঁচে আছে সেই স্মৃতি।
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/বর্গী এলো দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/খাজনা দেবো কিসে।
মারাঠা বর্গীদের দশ বছর ধরে হওয়া অত্যাচার একসাথে হয়নি। হয়েছিলো চার বারের আক্রমণে। তার মধ্যে তিনবার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বর্গী সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত। বাংলার ইতিহাসের কুখ্যাত এক নাম।
সময়টা ১৭৪২। সে বছর সেপ্টেম্বরে দুর্গাপূজা পড়েছে। ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে তখন চলছে প্রথমবারের ভয়াবহ বর্গীহানা। কাটোয়ার কাছে দাঁইহাট বলে একটা জায়গা আছে। সেই অঞ্চলটি তখন কার্যত বর্গী সেনাদের প্রধান শিবির। স্থানটির ভৌগোলিক সুবিধা হলো উত্তরে অজয় নদী আর পূর্বে ভাগীরথী। তার মুর্শিদাবাদে থাকা নবাবী সেনাদের জন্য দুর্গম্য।
ভাস্কর পন্ডিতের বাংলায় এসে ইচ্ছা জাগলো দুর্গাপূজা করার। সেই মতন স্থানীয় জমিদার বাড়িতে আয়োজন করলেন দুর্গাপূজা। জমিদার ও স্থানীয় মানুষদের না করবার উপায় নেই। অথবা সাক্ষাৎ মৃত্যু। ভয় ভক্তিতে আয়োজন হলো দুর্গাপূজা। সেই প্রাচীন জমিদার বাড়ির দুর্গাদালানের এখনো একটা দেয়াল টিকে আছে।
সেবার সেপ্টেম্বরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে পূজার সময়। নবাব দেখলেন এই সেরা সুযোগ। কারণ বাংলার কাদামাটিতে বর্গী সেনা অতোটা সক্ষম নয়। একবার ভাস্কর পন্ডিতকে হত্যা করতে পারলে সব সমস্যার সমাধান। তাই ঠিক করলেন পূজার সময়ই আক্রমণ করবেন বর্গী ক্যাম্প।
সপ্তমী তিথি। ভয়ে ভক্তিতে সেই অঞ্চলের জমিদাররা দলে দলে ভাস্কর পন্ডিতের পূজাতে। প্রচুর ছাগ বলির আয়োজন। বসেছে বাইজি নাচের আসরও। এদিকে ভাগিরথী পেরিয়ে সন্তর্পণে আসার চেষ্টা করলো নবাবের বাহিনী। মারাঠা দেওয়ান মীর হাবিব ছিলেন বর্গী সেনার নেতা। ভেঙে দিলেন গঙ্গার ওপর নৌকা দিয়ে বানানো সেতু। কামানের আঘাতে অনেক ক্ষতি হলো নবাবী সেনার।
নবাব এবার পরিকল্পনা পাল্টালেন। অজয় আর ভাগীরথীর সঙ্গমস্থলের কাছ দিয়ে বড় বড় নৌকা আর কাঠের পাটাতন বেঁধে নদী পারের চেষ্টা করলেন সন্তর্পণে। এদিকে চলছে সন্ধীপূজার আয়োজন। আর বর্গীরাও আশা করেনি যে ওই দূর্গম নদী পথ পেরিয়ে আক্রমণ হতে পারে। কিন্তু দুর্নিবার অজয়ের স্রোতে ভেঙে গেলো সেই সেতু। প্রায় ১৫০০ সেনার সলিল সমাধি হলো। সমরাস্ত্র, ঘোড়াসহ অনেক ক্ষতি হলো নবাবের। তবুও তিনি দমবার পাত্র নন। আবার নতুন করে সেতু বাঁধলেন। এবার সফল হলেন। অষ্টমীর রাতের অন্ধকারে বিশাল সৈন্য এসে লুকিয়ে রইলেন বিভিন্ন প্রান্তরে।
নবমীর সকালেই পূজাস্থলের চারদিক থেকে অতর্কিত আক্রমণের কবলে পড়লো বর্গী বাহিনী। পূজা প্রাঙ্গণে যেনো বর্গীসেনার বলির আয়োজন। রক্তস্নাত দুর্গাদালান।
ভাস্কর পন্ডিত বিপদ বুঝে পলায়ন করলো দক্ষিণের পথ ধরে। কথিত আছে, তার কাছে এক স্বর্ণদুর্গাপ্রতিমা ছিলো। যাওয়ার আগে নবমী তিথিতেই তিনি সেটা ভাগীরথীর জলে বিসর্জন দিয়ে যান। আর প্রতিজ্ঞা করে যান আর কোনো দিনও দাইহাঁটাতে দুর্গাপূজা করবেন না। তবে তিনি ফিরে আসবেন। ফিরে আসবেন রক্তের হোলি খেলতে বাংলার বুকে।
[লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট]