সাদ কামালী
প্রত্যেকটি জীবনেরই গল্প থাকে। সত্যি কি থাকে! জীবনে গল্প প্রবহমান। জীবন গল্পে নামে, গল্প জীবনে নামে। এসবই কথার বিলাসিতা, সার বস্তু কম। একমাত্র মৃতজনই জানে জীবনে গল্পের পথে থাকে, স্মৃতির রেখা থাকে। স্বপ্ন ও মায়া থাকে, গল্পের আবহ সুর ফোটে, গল্প শুধু থাকে মৃতজনের। অবসর থাকে গল্প বলার। জীবিতজন বলে, বেঁচে আছি গল্প বলার জন্য। সেই আবার কথার হেঁয়ালি, বেঁচে থাকা মানুষ গল্প তৈরিতে বেঁচে থাকে, তার বেঁচে থাকা গল্পের উপাদান, কাঁচামাল, গল্প নয়। কাদামাটি যেমন মূর্তি নয়, মূর্তি গড়ার রসদ। এই সত্য শুধু মৃত হয়েই উপলব্ধি করার। মৃত্যুর পর দেখি জীবনটা ছিল ছোট ছোট গল্পের সম্ভাবনাময় স্তবকের সমাহার। সেই স্তবকগুলো এক একটি ফুলÑ তাজা ফুল, শুকনো ফুল, পোকায় কাটা ফুল, গন্ধফুল, নির্গন্ধ ফুল, কলি, ফুলের স্তূপ। জীবন সেসব ফুল দিয়ে গল্পের মালা গেঁথে উঠতে পারে না। জীবনের পথে প্রতিদিন বিচিত্র ফুলের আবির্ভাব ঘটতেই থাকে, গল্পের মালা কখন সে গাঁথবে!
মৃতদের জীবনে একটা মীমাংসা হয়ে যায়। তার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আজ মেঘে এমনিতেই জলের কণা কম ছিল, শুধু হালকা আর্দ্রতা। কিন্তু জলের কণা বেশি হলেই বা কী! মৃতজন শুকনো বা ভিজে যাওয়ার উর্ধে, আলো বা অন্ধকারের উর্ধে। তাপ বা শীতলতার উর্ধে। শরীর বা অশরীর উর্ধে। মৃতজন শুধু একটি উপলব্ধি মাত্র। সে এমন এক সত্তা, যে অস্তিত্বহীন সে এমন এক দৃশ্য যে দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। সে এমন এক শক্তি ও গতি যে স্থানু ও অচল, অর্থাৎ একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না, সত্য ও মিথ্যা, বাস্তব ও স্বপ্ন, আসক্তি ও নিরাসক্তি। তাহলে সে এমন এক দ্বান্দ্বিক সত্তা যে প্রকৃতই গল্প বলার অধিকারী। কারণ সে আবেগ ও নিরাবেগ নিরপেক্ষ, সুখ ও দুঃখ নিরপেক্ষ, আপন ও পর নিরপেক্ষ, প্রেম ও অপ্রেম নিরপেক্ষ, জাত নিরপেক্ষ স্বজাতি বা পরজাতি। এমন সত্তাই গল্পকে সত্য ও মহাকালে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে।
আয়না ছিল আমার ভালবাসা, ওর দিকে তাকালেই অনুভব হয় হৃদয়ের সকল প্রেম, সুখ, অদ্ভুত শিহরন। এই ভালবাসার প্রাণটির নাম কাম, কাম তাড়নায় সবই মধুর, সুপেয়। মাকেও তো খুব ভালবাসি। ভাইবোনদেরও। সেই বোধ এমন বিহ্বলতা এবং বিভ্রম জড়ানো নয়। তাহলে প্রেম ছিল কামের শর্ত। এখন মরার পর বুঝতে পারি গল্পটা সত্য হয়ে অবয়ব তৈরি করল। আয়নাকে দেখার সময় ওর রূপ ও ভালবাসা কিছুই দেখিনি। দেখেছি আমাকে, আমার কাম তাড়নার ছবিই ওর অবয়ব আয়নায়। আয়না কি জানত! বুঝতে পারত এই ভালবাসা, মাথায় তুলে রাখা কোনো কিছুই আয়না মানুষটির জন্য নয়, শুধু রতিইচ্ছায় শরীরকে শরীরে জড়িয়ে নেয়া। জীবিত আমি কি তখন বুঝেছি আয়নাকে যে ভালবাসি তা আসলে আমার শরীরের চাহিদা মেটানোর বাসনা। আয়নার ক্ষেত্রেও একই সত্য। দেখা গেছে গভীর সুখ আলিঙ্গন শেষে দুজনই ছোট, তুচ্ছ বিষয়ে বিরক্ত হয়ে উঠছি। তাই বলি জীবিত লোক জানেই না পথে পথে, সময়ে সময়ে যত রকম ফুল, তা শুধু খ- খ- গল্পের উপাদান, গল্প নয়। মৃত্যুর পর সেই নানা রকমের ফুল দিয়ে জীবনের গল্প নির্মাণ করায়। আসলে মৃতজনই গল্প লেখে, মৃতজনের জীবনে গল্প আছে, গল্পের কাঁচামাল জীবন থেকে নিয়ে মৃতজন গল্প লেখে।
একটা গল্প বলি, গল্প নয়, গল্পের আঁশ, কাঁটা, লেজ মাথা। মাছের আঁশ যেমন মাছ নয়, তেমনি এই গল্পও বানানো নয়, প্রাকৃত গল্পের স্মৃতি, অতি পুরাতন অথবা গল্প পুরাতনী, যে পুরাতনের আবির্ভাব ঘটে নিত্য, যেমন মৃত্যু, জন্ম, সূর্য...।
সুদর্শনচক্র দিয়ে যখন শ্রীকৃষ্ণ চেদিরাজ শিশুপালের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে দিলেন তখনই শিশুপালের গল্প তৈরি হলো। এর আগে এই গল্পের আয়োজন চলতে থাকে, কিন্তু গল্প সম্পন্ন হয় শিশুপালের মৃত্যুর পর। দম ঘোষ শিশুপালের বাবা, তিনি চেদি দেশের রাজা, তার স্ত্রী বাসুদেব ভগিনী শ্রুতশ্রোবা। এই দম্পতির ঘরে জন্ম হয় শিশুপালের। জন্মের সময় তার ছিল চার হাত, তিন চোখ এবং জন্মের পরই গাঁধার মতো চিৎকার করতে থাকে। এই কিম্ভূত অশুভ লক্ষণযুক্ত শিশুপালকে দম ঘোষ ত্যাগ করতে চেয়েছিল। তখন দৈববাণীর নির্দেশ আসে রাজা যেন পুত্রকে ত্যাগ না করে। কারণ এই শিশুর মৃত্যুর কাল এখনো অনাগত। তখন মা দৈববাণীর কাছে জানতে চায় কে এই পুত্রের মৃত্যুর কারণ হবেন। দৈব জানায়, সেই পুরুষের জন্ম হয়েছে। তাঁকে চিনবো কী করে! মায়ের কণ্ঠে আকুলতা। দৈব জানায়, যার কোলে উঠলে এই শিশুর অতিরিক্ত দুই হাত খসে পড়বে, অতিরিক্ত চোখটিও মিলিয়ে যাবে তার হাতেই শিশুপালের মৃত্যু ঘটবে। বহু বছর বহুজন বহু রাজার কোলে চড়েও শিশুপালের কোনো পরিবর্তন হলো না। কার হাতে মৃত্যু হবে সেও অজানা থেকে যাচ্ছে। অবশেষে একদিন বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ ভগিনী দর্শনে চেদিরাজের বাড়ি আসেন। রাণী তখন শিশুপালকে শ্রীকৃষ্ণের কোলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে শিশু পালের দুই হাত খসে পড়ে, অতিরিক্ত চোখটিও মিলিয়ে যায়। ভগিনী বিস্ময়ে দেখে শ্রীকৃষ্ণের হাতে ওর মৃত্যু ঘটবে। ভগিনী অনুরোধ করে, ওর সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবার জন্য। শ্রীকৃষ্ণল বললেন, আমার দ্বারা এই পুত্র বধ্য হলেও শিশুপালের একশটি অপরাধ আমি ক্ষমা করে দিব। শিশুপাল কালে চেদি দেশের রাজা হয়ে বিস্তর সব অপরাধ, অন্যায় করতে থাকে। অন্যকে অপমান, মিথ্যাচার, অত্যাচারে উগ্র থেকে উগ্র হয়ে উঠতে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ কথামতো একের পর এক অপরাধ ক্ষমা করে দিচ্ছিলেন। শিশুপাল যখন জানত এই শ্রীকৃষ্ণের হাতেই তার মৃত্যু লেখা আছে তাই সে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিই বেশি বিদ্বেষ পোষণ করে আসছে। শিশুপালের উগ্রতা, ঔদ্ধত্য আচরণ, প্রতিহিংসা পরায়ণতা দিনে দিনেই বেড়ে চলে। রাজ্যের মানুষ নির্বাক অথবা শিশুপালের আজ্ঞাবহ। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিরোধের একটি নতুন মাত্রা যোগ হয় যখন শিশুপাল অন্যায় জোরে বিদর্ভরাজের কন্যা রুক্সিনীকে বিয়ে করতে যায়। তখন শ্রীকৃষ্ণ নিজে রুক্সিনীকে উদ্ধার করে বিয়ে করে নেন। তখন পর্যন্ত শিশুপালের অপরাধ একশ অতিক্রম করেনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পা-বদের ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী অভিষেকের যজ্ঞানুষ্ঠান। পা-বদের ্্এই রাজসূয় যজ্ঞের অর্ঘ্য কাকে প্রথম নিবেদন করা হবে যুধিষ্ঠিরের এই সংশয়ে ভীষ্ম বলেন, এখানে উপস্থিত শ্রীকৃষ্ণই প্রথম অর্ঘ্যইে অধিকারী। ভীষ্মের এই সমাধানে ক্ষিপ্ত শিশুপাল প্রথমে ভীষ্মকে পরে শ্রীকৃষ্ণকে অমার্জনীয় ভাষায় অনর্গল অপমান করতে থাকে। এক পর্যায়ে অধৈর্য শ্রীকৃষ্ণ সহ্যের সীমা অতিক্রমী নিষ্ঠুর শিশুপালের মস্তক ছিন্ন করে দেন সুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করে। কারণ এতদিন শিশুপাল একশটি অপরাধের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। এইভাবে মৃত শিশুপাল একটি গল্প রচনা করল। সে গল্প হয়ে উঠল কিংবদন্তি। কেউ বলে পৌরাণিক, কেউ বলে পুরাণ ইতিহাস। এক কবি বললেন, এই হলো জনগণের শাশ^ত ইতিহাস। গল্প এমনি হয়। মৃতজনই গল্প রচনা করে। মৃতজনের জীবনে গল্প আছে, আর বেঁচে থাকা মানুষ ওই গল্প রচনার রসদ ধীরে সংগ্রহ করে চলে।
মৃত্যুর পরে আমিও আমার গল্পটি পাই। জীবনভর এই গল্পের বৃক্ষে আলো বাতাস খাদ্য যুগিয়েছি। আগে যেমন বলেছি, আয়না আসলে আমারই প্রতিবিম্ব দেখায়, আমি আমাকেই দেখি। নিজেকে চিনতে পারি। ঠিক চেনা নয়, আমার জানা স্বরূপটি বাস্তবে কেমন তাই দেখি আয়নার চোখে, শরীরে, ভাষায়।
মৃত্যুর পরে যেভাবে গল্পটা সম্পূর্ণ হলো সেই দুপুরে আয়না আর আমি ছাদে যেয়ে উঠি, আয়নাই আমার হাত ধরে নিয়ে আসে, আরও বিস্তৃত করে সমস্ত কোলাহল, শোরগোল, বিকট শব্দ, চিৎকার আর্তনাদ দেখার জন্য। রাস্তা তখন মানুষের পায়ের নিচে, কেউ চেষ্টা করেও এক ইঞ্চি পিচঢালা পথ দেখতে পাবে না। মানুষের চঞ্চল, ক্ষিপ্ত, দীপ্ত, অস্থির পলায়নপর পায়ের ভিড়ে রাস্তা নিশ্চিহ্ন। তখনই হঠাৎ বজ্রপাতের মতো আকাশ থেকে বজ্রের পতন ঘটতে থাকে। একটা উড়াল জাহাজ এই কোলাহলকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করতে থাকে বজ্রশেল। উড়াল জাহাজের কোনো নিশ্চিত টার্গেট ন্ইে। অর্থাৎ টার্গেট নিশ্চিত থাকছে না উড়াল ধাবমানতায়। যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিদ্ধ হচ্ছে এক একটি বজ্রশেল। হয়তো তারই একটি বা দুটি বিদ্ধ করে আমার মাথা। আমি লুটিয়ে পড়ার আগে দেখি আয়ানার চোখে উজ্জ্বল আলো। সে দ্রুত দেখছে ছাদের অন্য প্রান্তের কাউকে। আমাকে না ধরে দৌড়ে সেই প্রান্তের দিকে যায়। আমি কোনো প্রান্ত দেখতে পাই না। শুধু সব বোধ, শক্তি, প্রাণ নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার আগে টের পাই সিঁড়ি বেয়ে একাধিক জনের দ্রুত নেমে পড়ার আওয়াজ।
মৃত্যু হলো। আমার গল্পটিও এখন সম্পূর্ণ হওয়ার পথে। মৃতজন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। এই ত্রিকালের মধ্যে সে কোনো সীমানা চিহ্নিত করতে পারে না। অর্থাৎ মৃতজন কাল নিরপেক্ষ এক অনুভব। এই অনুভবে প্রথম দেখতে পাই কোনো উড়াল জাহাজ শুধু নয়, সমান্তরাল জায়গা থেকেও, ছাদের অন্য প্রান্ত থেকেও মাথা বিদীর্ণ করে দেওয়া যায়। আয়নায় আমাকে দেখেছি, আমার স্বরূপ জানতে পেরেছি আয়নার দিকে তাকিয়ে। সেই জীবিত আমি কখনো বুঝিনি আমিও আয়নার আয়না। আমার ভিতরেও সে তাকে দেখেছে! আয়নার অপর পিঠ স্বচ্ছ নয়, কিন্তু আয়না ব্যক্তি বস্তু নিরপেক্ষ। সব কিছুরই প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্ব আয়নায় ফোটে। আর গল্প সেখানেই জেগে ওঠে।
সাদ কামালী
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
প্রত্যেকটি জীবনেরই গল্প থাকে। সত্যি কি থাকে! জীবনে গল্প প্রবহমান। জীবন গল্পে নামে, গল্প জীবনে নামে। এসবই কথার বিলাসিতা, সার বস্তু কম। একমাত্র মৃতজনই জানে জীবনে গল্পের পথে থাকে, স্মৃতির রেখা থাকে। স্বপ্ন ও মায়া থাকে, গল্পের আবহ সুর ফোটে, গল্প শুধু থাকে মৃতজনের। অবসর থাকে গল্প বলার। জীবিতজন বলে, বেঁচে আছি গল্প বলার জন্য। সেই আবার কথার হেঁয়ালি, বেঁচে থাকা মানুষ গল্প তৈরিতে বেঁচে থাকে, তার বেঁচে থাকা গল্পের উপাদান, কাঁচামাল, গল্প নয়। কাদামাটি যেমন মূর্তি নয়, মূর্তি গড়ার রসদ। এই সত্য শুধু মৃত হয়েই উপলব্ধি করার। মৃত্যুর পর দেখি জীবনটা ছিল ছোট ছোট গল্পের সম্ভাবনাময় স্তবকের সমাহার। সেই স্তবকগুলো এক একটি ফুলÑ তাজা ফুল, শুকনো ফুল, পোকায় কাটা ফুল, গন্ধফুল, নির্গন্ধ ফুল, কলি, ফুলের স্তূপ। জীবন সেসব ফুল দিয়ে গল্পের মালা গেঁথে উঠতে পারে না। জীবনের পথে প্রতিদিন বিচিত্র ফুলের আবির্ভাব ঘটতেই থাকে, গল্পের মালা কখন সে গাঁথবে!
মৃতদের জীবনে একটা মীমাংসা হয়ে যায়। তার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আজ মেঘে এমনিতেই জলের কণা কম ছিল, শুধু হালকা আর্দ্রতা। কিন্তু জলের কণা বেশি হলেই বা কী! মৃতজন শুকনো বা ভিজে যাওয়ার উর্ধে, আলো বা অন্ধকারের উর্ধে। তাপ বা শীতলতার উর্ধে। শরীর বা অশরীর উর্ধে। মৃতজন শুধু একটি উপলব্ধি মাত্র। সে এমন এক সত্তা, যে অস্তিত্বহীন সে এমন এক দৃশ্য যে দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। সে এমন এক শক্তি ও গতি যে স্থানু ও অচল, অর্থাৎ একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না, সত্য ও মিথ্যা, বাস্তব ও স্বপ্ন, আসক্তি ও নিরাসক্তি। তাহলে সে এমন এক দ্বান্দ্বিক সত্তা যে প্রকৃতই গল্প বলার অধিকারী। কারণ সে আবেগ ও নিরাবেগ নিরপেক্ষ, সুখ ও দুঃখ নিরপেক্ষ, আপন ও পর নিরপেক্ষ, প্রেম ও অপ্রেম নিরপেক্ষ, জাত নিরপেক্ষ স্বজাতি বা পরজাতি। এমন সত্তাই গল্পকে সত্য ও মহাকালে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে।
আয়না ছিল আমার ভালবাসা, ওর দিকে তাকালেই অনুভব হয় হৃদয়ের সকল প্রেম, সুখ, অদ্ভুত শিহরন। এই ভালবাসার প্রাণটির নাম কাম, কাম তাড়নায় সবই মধুর, সুপেয়। মাকেও তো খুব ভালবাসি। ভাইবোনদেরও। সেই বোধ এমন বিহ্বলতা এবং বিভ্রম জড়ানো নয়। তাহলে প্রেম ছিল কামের শর্ত। এখন মরার পর বুঝতে পারি গল্পটা সত্য হয়ে অবয়ব তৈরি করল। আয়নাকে দেখার সময় ওর রূপ ও ভালবাসা কিছুই দেখিনি। দেখেছি আমাকে, আমার কাম তাড়নার ছবিই ওর অবয়ব আয়নায়। আয়না কি জানত! বুঝতে পারত এই ভালবাসা, মাথায় তুলে রাখা কোনো কিছুই আয়না মানুষটির জন্য নয়, শুধু রতিইচ্ছায় শরীরকে শরীরে জড়িয়ে নেয়া। জীবিত আমি কি তখন বুঝেছি আয়নাকে যে ভালবাসি তা আসলে আমার শরীরের চাহিদা মেটানোর বাসনা। আয়নার ক্ষেত্রেও একই সত্য। দেখা গেছে গভীর সুখ আলিঙ্গন শেষে দুজনই ছোট, তুচ্ছ বিষয়ে বিরক্ত হয়ে উঠছি। তাই বলি জীবিত লোক জানেই না পথে পথে, সময়ে সময়ে যত রকম ফুল, তা শুধু খ- খ- গল্পের উপাদান, গল্প নয়। মৃত্যুর পর সেই নানা রকমের ফুল দিয়ে জীবনের গল্প নির্মাণ করায়। আসলে মৃতজনই গল্প লেখে, মৃতজনের জীবনে গল্প আছে, গল্পের কাঁচামাল জীবন থেকে নিয়ে মৃতজন গল্প লেখে।
একটা গল্প বলি, গল্প নয়, গল্পের আঁশ, কাঁটা, লেজ মাথা। মাছের আঁশ যেমন মাছ নয়, তেমনি এই গল্পও বানানো নয়, প্রাকৃত গল্পের স্মৃতি, অতি পুরাতন অথবা গল্প পুরাতনী, যে পুরাতনের আবির্ভাব ঘটে নিত্য, যেমন মৃত্যু, জন্ম, সূর্য...।
সুদর্শনচক্র দিয়ে যখন শ্রীকৃষ্ণ চেদিরাজ শিশুপালের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে দিলেন তখনই শিশুপালের গল্প তৈরি হলো। এর আগে এই গল্পের আয়োজন চলতে থাকে, কিন্তু গল্প সম্পন্ন হয় শিশুপালের মৃত্যুর পর। দম ঘোষ শিশুপালের বাবা, তিনি চেদি দেশের রাজা, তার স্ত্রী বাসুদেব ভগিনী শ্রুতশ্রোবা। এই দম্পতির ঘরে জন্ম হয় শিশুপালের। জন্মের সময় তার ছিল চার হাত, তিন চোখ এবং জন্মের পরই গাঁধার মতো চিৎকার করতে থাকে। এই কিম্ভূত অশুভ লক্ষণযুক্ত শিশুপালকে দম ঘোষ ত্যাগ করতে চেয়েছিল। তখন দৈববাণীর নির্দেশ আসে রাজা যেন পুত্রকে ত্যাগ না করে। কারণ এই শিশুর মৃত্যুর কাল এখনো অনাগত। তখন মা দৈববাণীর কাছে জানতে চায় কে এই পুত্রের মৃত্যুর কারণ হবেন। দৈব জানায়, সেই পুরুষের জন্ম হয়েছে। তাঁকে চিনবো কী করে! মায়ের কণ্ঠে আকুলতা। দৈব জানায়, যার কোলে উঠলে এই শিশুর অতিরিক্ত দুই হাত খসে পড়বে, অতিরিক্ত চোখটিও মিলিয়ে যাবে তার হাতেই শিশুপালের মৃত্যু ঘটবে। বহু বছর বহুজন বহু রাজার কোলে চড়েও শিশুপালের কোনো পরিবর্তন হলো না। কার হাতে মৃত্যু হবে সেও অজানা থেকে যাচ্ছে। অবশেষে একদিন বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ ভগিনী দর্শনে চেদিরাজের বাড়ি আসেন। রাণী তখন শিশুপালকে শ্রীকৃষ্ণের কোলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে শিশু পালের দুই হাত খসে পড়ে, অতিরিক্ত চোখটিও মিলিয়ে যায়। ভগিনী বিস্ময়ে দেখে শ্রীকৃষ্ণের হাতে ওর মৃত্যু ঘটবে। ভগিনী অনুরোধ করে, ওর সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবার জন্য। শ্রীকৃষ্ণল বললেন, আমার দ্বারা এই পুত্র বধ্য হলেও শিশুপালের একশটি অপরাধ আমি ক্ষমা করে দিব। শিশুপাল কালে চেদি দেশের রাজা হয়ে বিস্তর সব অপরাধ, অন্যায় করতে থাকে। অন্যকে অপমান, মিথ্যাচার, অত্যাচারে উগ্র থেকে উগ্র হয়ে উঠতে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ কথামতো একের পর এক অপরাধ ক্ষমা করে দিচ্ছিলেন। শিশুপাল যখন জানত এই শ্রীকৃষ্ণের হাতেই তার মৃত্যু লেখা আছে তাই সে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিই বেশি বিদ্বেষ পোষণ করে আসছে। শিশুপালের উগ্রতা, ঔদ্ধত্য আচরণ, প্রতিহিংসা পরায়ণতা দিনে দিনেই বেড়ে চলে। রাজ্যের মানুষ নির্বাক অথবা শিশুপালের আজ্ঞাবহ। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিরোধের একটি নতুন মাত্রা যোগ হয় যখন শিশুপাল অন্যায় জোরে বিদর্ভরাজের কন্যা রুক্সিনীকে বিয়ে করতে যায়। তখন শ্রীকৃষ্ণ নিজে রুক্সিনীকে উদ্ধার করে বিয়ে করে নেন। তখন পর্যন্ত শিশুপালের অপরাধ একশ অতিক্রম করেনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পা-বদের ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী অভিষেকের যজ্ঞানুষ্ঠান। পা-বদের ্্এই রাজসূয় যজ্ঞের অর্ঘ্য কাকে প্রথম নিবেদন করা হবে যুধিষ্ঠিরের এই সংশয়ে ভীষ্ম বলেন, এখানে উপস্থিত শ্রীকৃষ্ণই প্রথম অর্ঘ্যইে অধিকারী। ভীষ্মের এই সমাধানে ক্ষিপ্ত শিশুপাল প্রথমে ভীষ্মকে পরে শ্রীকৃষ্ণকে অমার্জনীয় ভাষায় অনর্গল অপমান করতে থাকে। এক পর্যায়ে অধৈর্য শ্রীকৃষ্ণ সহ্যের সীমা অতিক্রমী নিষ্ঠুর শিশুপালের মস্তক ছিন্ন করে দেন সুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করে। কারণ এতদিন শিশুপাল একশটি অপরাধের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। এইভাবে মৃত শিশুপাল একটি গল্প রচনা করল। সে গল্প হয়ে উঠল কিংবদন্তি। কেউ বলে পৌরাণিক, কেউ বলে পুরাণ ইতিহাস। এক কবি বললেন, এই হলো জনগণের শাশ^ত ইতিহাস। গল্প এমনি হয়। মৃতজনই গল্প রচনা করে। মৃতজনের জীবনে গল্প আছে, আর বেঁচে থাকা মানুষ ওই গল্প রচনার রসদ ধীরে সংগ্রহ করে চলে।
মৃত্যুর পরে আমিও আমার গল্পটি পাই। জীবনভর এই গল্পের বৃক্ষে আলো বাতাস খাদ্য যুগিয়েছি। আগে যেমন বলেছি, আয়না আসলে আমারই প্রতিবিম্ব দেখায়, আমি আমাকেই দেখি। নিজেকে চিনতে পারি। ঠিক চেনা নয়, আমার জানা স্বরূপটি বাস্তবে কেমন তাই দেখি আয়নার চোখে, শরীরে, ভাষায়।
মৃত্যুর পরে যেভাবে গল্পটা সম্পূর্ণ হলো সেই দুপুরে আয়না আর আমি ছাদে যেয়ে উঠি, আয়নাই আমার হাত ধরে নিয়ে আসে, আরও বিস্তৃত করে সমস্ত কোলাহল, শোরগোল, বিকট শব্দ, চিৎকার আর্তনাদ দেখার জন্য। রাস্তা তখন মানুষের পায়ের নিচে, কেউ চেষ্টা করেও এক ইঞ্চি পিচঢালা পথ দেখতে পাবে না। মানুষের চঞ্চল, ক্ষিপ্ত, দীপ্ত, অস্থির পলায়নপর পায়ের ভিড়ে রাস্তা নিশ্চিহ্ন। তখনই হঠাৎ বজ্রপাতের মতো আকাশ থেকে বজ্রের পতন ঘটতে থাকে। একটা উড়াল জাহাজ এই কোলাহলকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করতে থাকে বজ্রশেল। উড়াল জাহাজের কোনো নিশ্চিত টার্গেট ন্ইে। অর্থাৎ টার্গেট নিশ্চিত থাকছে না উড়াল ধাবমানতায়। যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিদ্ধ হচ্ছে এক একটি বজ্রশেল। হয়তো তারই একটি বা দুটি বিদ্ধ করে আমার মাথা। আমি লুটিয়ে পড়ার আগে দেখি আয়ানার চোখে উজ্জ্বল আলো। সে দ্রুত দেখছে ছাদের অন্য প্রান্তের কাউকে। আমাকে না ধরে দৌড়ে সেই প্রান্তের দিকে যায়। আমি কোনো প্রান্ত দেখতে পাই না। শুধু সব বোধ, শক্তি, প্রাণ নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার আগে টের পাই সিঁড়ি বেয়ে একাধিক জনের দ্রুত নেমে পড়ার আওয়াজ।
মৃত্যু হলো। আমার গল্পটিও এখন সম্পূর্ণ হওয়ার পথে। মৃতজন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। এই ত্রিকালের মধ্যে সে কোনো সীমানা চিহ্নিত করতে পারে না। অর্থাৎ মৃতজন কাল নিরপেক্ষ এক অনুভব। এই অনুভবে প্রথম দেখতে পাই কোনো উড়াল জাহাজ শুধু নয়, সমান্তরাল জায়গা থেকেও, ছাদের অন্য প্রান্ত থেকেও মাথা বিদীর্ণ করে দেওয়া যায়। আয়নায় আমাকে দেখেছি, আমার স্বরূপ জানতে পেরেছি আয়নার দিকে তাকিয়ে। সেই জীবিত আমি কখনো বুঝিনি আমিও আয়নার আয়না। আমার ভিতরেও সে তাকে দেখেছে! আয়নার অপর পিঠ স্বচ্ছ নয়, কিন্তু আয়না ব্যক্তি বস্তু নিরপেক্ষ। সব কিছুরই প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্ব আয়নায় ফোটে। আর গল্প সেখানেই জেগে ওঠে।