alt

সাময়িকী

১১ই জ্যৈষ্ঠ নজরুল জন্মজয়ন্তী স্মরণে

স্বাধীনতার কবি নজরুল

মো. জেহাদ উদ্দিন

: বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

সপরিবারে কবি কাজী নজরুল ইসলাম

নজরুল স্বাধীনতার কবি, সব ধরনের পরাধীনতা থেকে সর্বসাধারণকে মুক্ত করে মানুষকে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার কবি। স্বাধীনতার পক্ষে এত বলিষ্ঠ, এত নিখাদ আর এত শৈল্পিক উচ্চারণ বিশ্ববাসী আর কারও সাহিত্যে অবলোকন করেনি, যেমনটি করেছে নজরুল সাহিত্যে। নজরুল এক্ষেত্রে অনন্য, অসাধারণ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ময়দান থেকে নজরুল-প্রেরিত যে কবিতাটি প্রথম ১৩২৬ শ্রাবণের ‘বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য পত্রিকা’য় ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় তার নাম ‘মুক্তি’। একেবারে ছোট সময় লেটো দলের জন্যে নজরুল যে সকল গান লিখেছেন সেগুলোর মধ্যেও মানবাত্মার মুক্তির বিষয়টি অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর লেটো জীবনের রচনা ‘চাষ কর দেহ জমিতে’ পড়লে আমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করি যে, এত ছোটবেলার রচনায়ও নজরুল মানবাত্মার মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছেন অসাধারণ গভীরতা ও কুশলতার মাধ্যমে।

সর্বসাধারণের কাছে নজরুলের সবচেয়ে বড় পরিচয় বিদ্রোহী কবি হিসেবে। যিনি নজরুল সম্পর্কে অতশত কিছু জানেন না, তিনিও অন্তত এটুকু জানেন যে, নজরুল বিদ্রোহের কবি। আর বিদ্রোহ মানে হলো সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, কোনো অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার না করা ইত্যাদি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছেও এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, নজরুল এমন একজন কবি যিনি তাঁর সাহিত্যে বা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ন্যায়নিষ্ঠ থেকেছেন, কোনো অন্যায়ের কাছে জীবনে কখনও মাথানত করেননি।

নজরুল তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় আমিত্বের জয়গান গেয়েছেন মর্মে আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হয় তা মূলত নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীনতারই বলিষ্ঠ উচ্চারণ। স্বাধীনতার ধারণা ও চেতনা বিদ্রোহী কবিতায় যে সর্বব্যাপী রূপ পরিগ্রহ করেছে বিশ্বসাহিত্যে এর তুল্য দ্বিতীয়টি আর নেই। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বহু আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা যেমন চিরন্তন, তেমনি চিরন্তন নজরুলের বিদ্রোহীর আবেদনও। বিদ্রোহীর প্রয়োজন কখন ফুরাবে তা ‘বিদ্রোহী’ থেকেই আমরা দেখে নিতে পারি-

মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত,

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত!

উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল থেমে গেলে, অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ বন্ধ হলে নজরুলীয় বিদ্রোহের আর প্রয়োজন হবে না বলে কবি নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন। নজরুলের অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ সর্বকালে সকল মানুষকে আত্মমর্যাদাশীল হতে শিখাবে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে শেখাবে, স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখাবে।

বিদ্রোহী ব্রিটিশ শাসিত একটি পরাধীন জাতিকে জাগিয়ে দিল, বিশ্বের সকল পরাধীন শৃঙ্খলিত নির্যাতিত নিপীড়িত জাতির মুক্তির ভাষা হিসেবে প্রকাশিত হলো, কাঁপন ধরিয়ে দিল সকল সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসী অত্যাচারী অপশক্তির। পলাশী ট্রাজেডির পর ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের পদলেহন করাকেই যখন কেউ কেউ জীবনের পরম সার্থকতা হিসেবে বেছে নিল এবং ফলশ্রুতিতে পরাধীনতার জিঞ্জিরে ওরা যখন পুরো ভারতবর্ষকে বন্দি করে ফেলল, তখন আমাদের সাহিত্যে ‘ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি’র গান হয়েছে ঢের, কিন্তু মেরুদ- সোজা করার দাওয়াই পাইনি বললেই চলে। বরং ব্রিটিশ রাজের বন্দনা করা কবি-সাহিত্যিকদেরও যেন কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। কথায় বলে, রাত্রির অন্ধকার যত গভীর হয়, ভোরের পদধ্বনি ততই নিকটতর হয়। পরাধীন ভারতের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটল না। ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ-তুর্য’ নিয়ে ভারতবর্ষে আবির্ভূত হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সাহিত্যের সর্বোচ্চ মার্গে আরোহণ করে তাঁর পুরো সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে পরাধীন ভারতের সর্বসাধারণকে জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় জাগিয়েছেন। বঙ্গবাণী ১৩২৮ চৈত্র সংখ্যায় লিখেছিল-“আমাদের সাহিত্য যদি একা রবীন্দ্রনাথের কীর্তিতেই সমৃদ্ধ হইত, তবে আনন্দের মধ্যে বিষাদ অনুভব করিতাম। রবীন্দ্রনাথের মত কবি সকল দেশেই অল্প জন্মে; আমরা ভাল কবির রচনায় তৃপ্তি পাই, ইহা জাতীয় সাহিত্যের গৌরবের বিষয়। গত দু’এক মাসের মধ্যে যে সকল প্রাণস্পর্শী সুন্দর কবিতা পড়িয়াছি তাহার মধ্যে দুইটি কবিতার নাম বলিব। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রে প্রকাশিত কবি নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ অতি উচ্চ শ্রেণীর কবিতা; কবিতাটি পড়িতে পড়িতে পাঠকের বুক ফুলিয়া উঠে, মাথা উঁচু হয়। শেষের দিকের কিয়দংশ পড়িলে সুইন্বার্ণ রচিত Hertha মনে পড়ে। কিন্তু ঐ ‘হার্থা’ অপেক্ষা ‘বিদ্রোহী’ অনেক উচ্চে।”

অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার লিখেছিলেন-

When Habilder Kazi Nazrul Islam has contributed to the monthly Moslem Bharat (1921), an ode entitled VIDROHI (The Rebel) ringing as it does, with the refrain:

ÔSay, Hero!

Say Erect is my head!

Seeing my head that Himalayan peak

Bends low in shame.Õ

One feels that Bengal is now on the eve of a great literary out-burst an abandon in self-expression and lyrical enthusiasm which we have sought in vain during the last decade.

স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। স্বাধীনতার আভিধানিক অর্থ হলো নিজের অধীনতা। যেমনটি নজরুল লিখেছেন, ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।’ কিন্তু সেই ‘আমি’কে ক’জনই বা খুঁজে পায়? ইসলাম বলে, যে নিজেকে জানতে পেরেছে সে আল্লাহকে জেনেছে। সক্রেটিসের কথা : Know thyself- ‘নিজেকে জান’। আর নজরুলের বলিষ্ঠ উচ্চারণ-

আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি একি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!

আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!

কিংবা

‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!’

নজরুল নিজেকে চিনেছিলেন বলেই তার অসির ঝংকারে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে আমিত্বের জয়গান, মানবের জয়গান, মানবাত্মার জয়গান। নজরুল যে ‘আমি’কে আবিষ্কার করেছেন, সেই ‘আমি’ আর কিছু নয়। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার খলিফা বা প্রতিনিধি, যে ‘আমি’ কারোর পরাধীনতা স্বীকার করে না, যে ‘আমি’ সকল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যে ‘আমি’ সব ধরনের কুসংস্কারকে অস্বীকার করে, যে ‘আমি’ কেবল স্বাধীনতার কথা বলে।

নজরুল স্বাধীন চিন্তার কবি, স্বাধীনতার কবি। তিনি বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের অগ্রপথিক, তুর্যবাদক। তিনি স্বাধীনতার কথা বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি তথা পৃথিবীর সকল আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা লড়াই করেছেন। অন্যায়ের সাথে তিনি আপোস করেননি। পরাধীনতার শিকল পায়ে পরিধান করেননি। ব্রিটিশ রাজশক্তি যখন অকুতোভয় এই মহান স্বাধীনতা যোদ্ধাকে বার বার জেলে অন্তরীণ করেছে, তাঁর পায়ে শিকল পরিয়েছে, তখনও তিনি দমে যাননি; বরং দ্বিগুণ উৎসাহ আর কর্মতৎপরতায় ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, অন্যদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি শিকল পরা অবস্থায় গেয়েছেন-

‘এই শিকল পরা ছল

মোদের এই শিকল পরা ছল

এই শিকল পরেই শিকল তোদের

করব রে বিকল।’

কী অসাধারণ কবিতা! কী অমিত তেজ আর শক্তি একজন স্বাধীনতা যোদ্ধার!

নজরুল তাঁর সমস্ত কর্ম-সাধনার মাধ্যমে স্বাধীনতার জয়গান গেয়েছেন। পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে সকলকে বেরিয়ে আসার অমোঘ মন্ত্র দান করেছেন। যেমন, শিশু-কিশোরদের তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন এভাবে-

‘আমরা যদি না জাগি মা

কেমনে সকাল হবে

তোমার ছেলে উঠলে গো মা

রাত পোহাবে তবে।’

ছাত্রদের মুখে তিনি ভাষা দিয়েছেন এভাবে-

‘ঐ দারুণ উপপ্লবের দিনে আমরা দানি শির

মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে বিংশ শতাব্দীর।’

ঠিক এইভাবে তিনি সকল শ্রেণি পেশার নর-নারীকে স্বাধীনতার ভাষা দিয়েছেন, সবাইকে চাঙ্গা রেখেছেন নানাভাবে। যেমন-

‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’

কিংবা

‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর

উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’

কিংবা

‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান

আসি অলক্ষে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন্ বলীদান!’

নজরুল সাহিত্য থেকে স্বাধীনতার এমন অসংখ্য অমোঘ বাণী পেশ করা যাবে যেগুলোর তুলনা বিশ্বসাহিত্যে নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, তিনিই প্রথম নিজের সম্পাদিত পত্রিকায় লিখিতভাবে তৎকালীন পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। (ধূমকেতু, ১৩ অক্টোবর, ১৯২২)

নজরুল পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের মুখে ভাষা ও অন্তরে স্বাধীনতার প্রেরণা যুগিয়েছেন। তিনি লিখেই ক্ষান্ত হননি, বরং ‘আজন্ম সৈনিক’ এ মহান কবি নিজে মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি যা বলেছেন তা করেছেনও। তিনি স্বাধীনতার এক বিশুদ্ধ কবি।

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কাব্যগ্রন্থে নীলদ্রোহের রেখাপাত

ছবি

নার্গিস-নজরুলের স্মৃতিধন্য দৌলতপুরে একদিন

ছবি

যেভাবে ভেঙেছিল এক মৌনতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

নজরুল সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষিত

ছবি

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রতিভা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

আলবেয়ার কামুর গল্পে অস্তিত্বের নিষ্ঠুরতা

ছবি

উপন্যাসের জন্মবীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

মুখ

ছবি

বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি

ছবি

অগ্রজ দাউদ হায়দারের মহাপ্রয়াণ

ছবি

নারী যখন পাঠক নারী যখন লেখক

সাময়িকী কবিতা

মিত্র

ছবি

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

tab

সাময়িকী

১১ই জ্যৈষ্ঠ নজরুল জন্মজয়ন্তী স্মরণে

স্বাধীনতার কবি নজরুল

মো. জেহাদ উদ্দিন

সপরিবারে কবি কাজী নজরুল ইসলাম

বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

নজরুল স্বাধীনতার কবি, সব ধরনের পরাধীনতা থেকে সর্বসাধারণকে মুক্ত করে মানুষকে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার কবি। স্বাধীনতার পক্ষে এত বলিষ্ঠ, এত নিখাদ আর এত শৈল্পিক উচ্চারণ বিশ্ববাসী আর কারও সাহিত্যে অবলোকন করেনি, যেমনটি করেছে নজরুল সাহিত্যে। নজরুল এক্ষেত্রে অনন্য, অসাধারণ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ময়দান থেকে নজরুল-প্রেরিত যে কবিতাটি প্রথম ১৩২৬ শ্রাবণের ‘বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য পত্রিকা’য় ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় তার নাম ‘মুক্তি’। একেবারে ছোট সময় লেটো দলের জন্যে নজরুল যে সকল গান লিখেছেন সেগুলোর মধ্যেও মানবাত্মার মুক্তির বিষয়টি অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর লেটো জীবনের রচনা ‘চাষ কর দেহ জমিতে’ পড়লে আমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করি যে, এত ছোটবেলার রচনায়ও নজরুল মানবাত্মার মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছেন অসাধারণ গভীরতা ও কুশলতার মাধ্যমে।

সর্বসাধারণের কাছে নজরুলের সবচেয়ে বড় পরিচয় বিদ্রোহী কবি হিসেবে। যিনি নজরুল সম্পর্কে অতশত কিছু জানেন না, তিনিও অন্তত এটুকু জানেন যে, নজরুল বিদ্রোহের কবি। আর বিদ্রোহ মানে হলো সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, কোনো অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার না করা ইত্যাদি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছেও এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, নজরুল এমন একজন কবি যিনি তাঁর সাহিত্যে বা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ন্যায়নিষ্ঠ থেকেছেন, কোনো অন্যায়ের কাছে জীবনে কখনও মাথানত করেননি।

নজরুল তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় আমিত্বের জয়গান গেয়েছেন মর্মে আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হয় তা মূলত নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীনতারই বলিষ্ঠ উচ্চারণ। স্বাধীনতার ধারণা ও চেতনা বিদ্রোহী কবিতায় যে সর্বব্যাপী রূপ পরিগ্রহ করেছে বিশ্বসাহিত্যে এর তুল্য দ্বিতীয়টি আর নেই। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বহু আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা যেমন চিরন্তন, তেমনি চিরন্তন নজরুলের বিদ্রোহীর আবেদনও। বিদ্রোহীর প্রয়োজন কখন ফুরাবে তা ‘বিদ্রোহী’ থেকেই আমরা দেখে নিতে পারি-

মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত,

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত!

উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল থেমে গেলে, অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ বন্ধ হলে নজরুলীয় বিদ্রোহের আর প্রয়োজন হবে না বলে কবি নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন। নজরুলের অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ সর্বকালে সকল মানুষকে আত্মমর্যাদাশীল হতে শিখাবে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে শেখাবে, স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখাবে।

বিদ্রোহী ব্রিটিশ শাসিত একটি পরাধীন জাতিকে জাগিয়ে দিল, বিশ্বের সকল পরাধীন শৃঙ্খলিত নির্যাতিত নিপীড়িত জাতির মুক্তির ভাষা হিসেবে প্রকাশিত হলো, কাঁপন ধরিয়ে দিল সকল সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসী অত্যাচারী অপশক্তির। পলাশী ট্রাজেডির পর ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের পদলেহন করাকেই যখন কেউ কেউ জীবনের পরম সার্থকতা হিসেবে বেছে নিল এবং ফলশ্রুতিতে পরাধীনতার জিঞ্জিরে ওরা যখন পুরো ভারতবর্ষকে বন্দি করে ফেলল, তখন আমাদের সাহিত্যে ‘ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি’র গান হয়েছে ঢের, কিন্তু মেরুদ- সোজা করার দাওয়াই পাইনি বললেই চলে। বরং ব্রিটিশ রাজের বন্দনা করা কবি-সাহিত্যিকদেরও যেন কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। কথায় বলে, রাত্রির অন্ধকার যত গভীর হয়, ভোরের পদধ্বনি ততই নিকটতর হয়। পরাধীন ভারতের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটল না। ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ-তুর্য’ নিয়ে ভারতবর্ষে আবির্ভূত হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সাহিত্যের সর্বোচ্চ মার্গে আরোহণ করে তাঁর পুরো সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে পরাধীন ভারতের সর্বসাধারণকে জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় জাগিয়েছেন। বঙ্গবাণী ১৩২৮ চৈত্র সংখ্যায় লিখেছিল-“আমাদের সাহিত্য যদি একা রবীন্দ্রনাথের কীর্তিতেই সমৃদ্ধ হইত, তবে আনন্দের মধ্যে বিষাদ অনুভব করিতাম। রবীন্দ্রনাথের মত কবি সকল দেশেই অল্প জন্মে; আমরা ভাল কবির রচনায় তৃপ্তি পাই, ইহা জাতীয় সাহিত্যের গৌরবের বিষয়। গত দু’এক মাসের মধ্যে যে সকল প্রাণস্পর্শী সুন্দর কবিতা পড়িয়াছি তাহার মধ্যে দুইটি কবিতার নাম বলিব। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রে প্রকাশিত কবি নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ অতি উচ্চ শ্রেণীর কবিতা; কবিতাটি পড়িতে পড়িতে পাঠকের বুক ফুলিয়া উঠে, মাথা উঁচু হয়। শেষের দিকের কিয়দংশ পড়িলে সুইন্বার্ণ রচিত Hertha মনে পড়ে। কিন্তু ঐ ‘হার্থা’ অপেক্ষা ‘বিদ্রোহী’ অনেক উচ্চে।”

অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার লিখেছিলেন-

When Habilder Kazi Nazrul Islam has contributed to the monthly Moslem Bharat (1921), an ode entitled VIDROHI (The Rebel) ringing as it does, with the refrain:

ÔSay, Hero!

Say Erect is my head!

Seeing my head that Himalayan peak

Bends low in shame.Õ

One feels that Bengal is now on the eve of a great literary out-burst an abandon in self-expression and lyrical enthusiasm which we have sought in vain during the last decade.

স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। স্বাধীনতার আভিধানিক অর্থ হলো নিজের অধীনতা। যেমনটি নজরুল লিখেছেন, ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।’ কিন্তু সেই ‘আমি’কে ক’জনই বা খুঁজে পায়? ইসলাম বলে, যে নিজেকে জানতে পেরেছে সে আল্লাহকে জেনেছে। সক্রেটিসের কথা : Know thyself- ‘নিজেকে জান’। আর নজরুলের বলিষ্ঠ উচ্চারণ-

আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি একি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!

আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!

কিংবা

‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!’

নজরুল নিজেকে চিনেছিলেন বলেই তার অসির ঝংকারে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে আমিত্বের জয়গান, মানবের জয়গান, মানবাত্মার জয়গান। নজরুল যে ‘আমি’কে আবিষ্কার করেছেন, সেই ‘আমি’ আর কিছু নয়। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার খলিফা বা প্রতিনিধি, যে ‘আমি’ কারোর পরাধীনতা স্বীকার করে না, যে ‘আমি’ সকল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যে ‘আমি’ সব ধরনের কুসংস্কারকে অস্বীকার করে, যে ‘আমি’ কেবল স্বাধীনতার কথা বলে।

নজরুল স্বাধীন চিন্তার কবি, স্বাধীনতার কবি। তিনি বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের অগ্রপথিক, তুর্যবাদক। তিনি স্বাধীনতার কথা বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি তথা পৃথিবীর সকল আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা লড়াই করেছেন। অন্যায়ের সাথে তিনি আপোস করেননি। পরাধীনতার শিকল পায়ে পরিধান করেননি। ব্রিটিশ রাজশক্তি যখন অকুতোভয় এই মহান স্বাধীনতা যোদ্ধাকে বার বার জেলে অন্তরীণ করেছে, তাঁর পায়ে শিকল পরিয়েছে, তখনও তিনি দমে যাননি; বরং দ্বিগুণ উৎসাহ আর কর্মতৎপরতায় ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, অন্যদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি শিকল পরা অবস্থায় গেয়েছেন-

‘এই শিকল পরা ছল

মোদের এই শিকল পরা ছল

এই শিকল পরেই শিকল তোদের

করব রে বিকল।’

কী অসাধারণ কবিতা! কী অমিত তেজ আর শক্তি একজন স্বাধীনতা যোদ্ধার!

নজরুল তাঁর সমস্ত কর্ম-সাধনার মাধ্যমে স্বাধীনতার জয়গান গেয়েছেন। পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে সকলকে বেরিয়ে আসার অমোঘ মন্ত্র দান করেছেন। যেমন, শিশু-কিশোরদের তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন এভাবে-

‘আমরা যদি না জাগি মা

কেমনে সকাল হবে

তোমার ছেলে উঠলে গো মা

রাত পোহাবে তবে।’

ছাত্রদের মুখে তিনি ভাষা দিয়েছেন এভাবে-

‘ঐ দারুণ উপপ্লবের দিনে আমরা দানি শির

মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে বিংশ শতাব্দীর।’

ঠিক এইভাবে তিনি সকল শ্রেণি পেশার নর-নারীকে স্বাধীনতার ভাষা দিয়েছেন, সবাইকে চাঙ্গা রেখেছেন নানাভাবে। যেমন-

‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’

কিংবা

‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর

উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’

কিংবা

‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান

আসি অলক্ষে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন্ বলীদান!’

নজরুল সাহিত্য থেকে স্বাধীনতার এমন অসংখ্য অমোঘ বাণী পেশ করা যাবে যেগুলোর তুলনা বিশ্বসাহিত্যে নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, তিনিই প্রথম নিজের সম্পাদিত পত্রিকায় লিখিতভাবে তৎকালীন পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। (ধূমকেতু, ১৩ অক্টোবর, ১৯২২)

নজরুল পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের মুখে ভাষা ও অন্তরে স্বাধীনতার প্রেরণা যুগিয়েছেন। তিনি লিখেই ক্ষান্ত হননি, বরং ‘আজন্ম সৈনিক’ এ মহান কবি নিজে মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি যা বলেছেন তা করেছেনও। তিনি স্বাধীনতার এক বিশুদ্ধ কবি।

back to top