ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৭
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
মুজেও কুয়েবাছ দেল সেক্রোমন্তে থেকে বের হয়ে দেখি, সূর্য তার বিদায় বেলার সোনালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে, সে আভায়- সেক্রোমন্তে, আলবাইসিন, আল হাম্বরা, সিয়েরা নেভাদা হয়ে উঠেছে স্বপ্নলোক। একটু থেমে, দাঁড়িয়ে, আমরা সে স্বপ্নিল দৃশ্য দেখতে লাগলাম। সূর্য ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতেই পাহাড়ের গায়ে গায়ে গুহার বাতিগুলি জ্বলে উঠেছে, শুরু হলো যেন বনের মাঝে জোনাকিদের মেলা। বিভিন্ন চত্বরে লোকজনের জমায়েত বাড়ছে। ফ্লেমেনকো ড্যান্স স্টুডিওগুলির সামনেই বেশি জটলা। স্পেনে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ এই ফ্লেমেনকো। তাই এসব স্টুডিওতে তাদের ভিড়ই বেশি।
নাবিল ও নাতাশাকে বললাম- ফ্লেমেনকো ড্যান্স দেখা ছাড়া জিপসিদের জানা সম্পূর্ণ হবেনা। তোমরা কি এই ড্যান্স দেখতে চাও? সাথে সাথেই তারা রাজি হয়ে গেল। এটি যেহেতু ড্যান্স, সাথে থাকবে গান- তাই তারা অতি উৎসাহী; বিশেষ করে নাতাশা, কারণ সে নিজেও নাচে, তাই তার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি।
ফ্লেমেনকো স্টুডিওগুলি বলা যায় দোতলা গুহা। রাস্তার সমতলে একটি রুম- অর্ভ্যথনা, টিকেট কাটা, অপেক্ষা- বলা যায় অফিস এলাকা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মাটির নিচে গুহা- ঐখানেই হয় নাচ-গান।
টিকেট কেটে ঢুকলাম কুয়েবা লা রোচিও-তে, যা সেক্রোমন্তে-র অনেক পুরনো এক ফ্লেমেনকো স্টুডিও। চটপটে সুন্দরী তরুণী মারিয়া আমাদেরকে নিয়ে বসাল ওয়েটিং রুমে, শো শুরু হবে রাত ন’টায়, এখনো ঘণ্টাখানেক সময় আছে। আমাদেরকে খেতে দিল স্পেনের ঐতিহ্যবাহী তাপাস আর সাথে ডালিমের রস। হাতে অনেক সময়, তাই আমরা আলাপ শুরু করলাম। ছেলে মেয়ে দু’জনের ফ্লেমেনকো নিয়ে আগ্রহ দেখে মারিয়ার খুব ভাল লাগল। আর আমরা সুদূর আমেরিকা থেকে এসেছি জেনে সে একটু বেশি খাতির করল। তবে সে ভাল ইংরেজি বলতে পারে না। স্পেনে লোকজন ইংরেজি খুব একটা বলতে পারে না, বা বলে না। আমার স্প্যানিশ ভাষার দৌড়- হাই, কেমন আছো... ভালো... দুঃখিত... ধন্যবাদ... এরকম মাত্র ১০টির মতো শব্দ। আমাদের মধ্যে নাতাশা স্প্যানিশ ভাষায় ভালো। সব জায়গায় কথা বলে সে কাজ চালিয়ে নেয়। এখানেও সে মারিয়ার সাথে কথা বলছে, আর মাঝে মধ্যে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে মারিয়া বলল, তোমরা যদি আমাদের শিল্পীদের সাথে আলাপ করতে চাও, করতে পার, শো শুরু হওয়ার আগে এখনো কিছু সময় আছে। আমরা সবাই প্রায় চিৎকার করে বললাম ‘ইয়েস’।
মারিয়ার সাথে ভেতরের এক রুমে ঢুকে দেখলাম ৪ জন শিল্পী, আয়েশ করে পান করছেন স্পেনীয় পানীয় তেকিলা। এটি তাঁদের বিশ্রামের সময়, তাই ভাবলাম চলে আসব কিনা! মারিয়া বলল কোনো অসুবিধে নেই, তারা বিশ্রামের ফাঁকে কথা বলতে পারবে। সে ফ্লেমেনকো দলের সাথে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
এদের দলপতি ডমিনগাজ, বেশ সুঠাম সুন্দর চেহারার একজন জিপসি। তিনি ইংরেজি বেশ ভাল বলেন। আমরা জিপসি আর ফ্লেমেনকো নিয়ে উৎসাহী জেনে খুব খুশি হলেন। আরো বেশি খুশি হলেন শুনে- নাবিল গিটার বাজাতে পারে, নাতাশা পারে নাচতে ও পিয়ানো বাজাতে। বললেন, আমার গান, নাতাশার নাচ, নাবিলের গিটার মিলে হলো ফ্লেমেনকো। আমাদের ভাষায় গান হলো কান্তে, নাচ হলো বাইলে, গিটার হলো তোকে। একে আরো মজাদার করার জন্য যোগ করতে পার- পা ঠোকা- যাকে আমরা বলি ছাপাতেয়ার, যা করবে তোমাদের মা, আর সবচেয়ে সোজা, হাততালি, বা পালমাছ, দেবে তোমাদের বাবা। হয়েই গেল একটি ফ্লেমেনকো দল- বলেই ডমিনগাজ হো হো করে হাসতে লাগল। ডমিনগাজ-র কথা শুনে হাসিতে যোগ দিল দলের সবাই। দলে আছে নর্তকী অচোয়া, গায়িকা জালিয়া, গিটার বাদক অন্তেভেরোজ। আর দলপতি ডমিনগাজ দ্বিতীয় নর্তক। একটু থেমে আবার শুরু করলেন তিনি। বললেন, এখন ফ্লেমেনকোর ইতিহাসে তোমাদের একটু ঘুরিয়ে আনি। এর জন্ম জিপসিদের পূর্বপুরুষ রোমানিদের হাত ধরে, যারা ভারতবর্ষের রাজস্থান থেকে দেশান্তরী হয়ে স্পেনে আসে- নবম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। তারা সাথে নিয়ে আসে তাদের বাদ্যযন্ত্র- তাম্বুরা, করতাল, ঘণ্টা ইত্যাদি। আরো নিয়ে আসে অনেক গান ও নাচ। ধীরে ধীরে আদি ফ্লেমেনকোর সাথে মিশতে থাকে স্থানীয় স্পেনীয়, আরব ও ইহুদীদের সঙ্গীত। ফ্লেমেনকোর বিভিন্ন ধরন আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো হলো কান্তে হোন্ডো, যার মানে গভীর গান- এটি তুলে ধরে গভীর আবেগ- যেমন মৃত্যু, হতাশা, যন্ত্রণা। এ বলে ডমিনগাজ বললেন, বাকিটা তোমরা একটু পরে দেখবে স্টুডিওতে, সেখানে তোমাদের সাথে দেখা হবে। সবাই উঠে পড়ল, একটু পরে শো শুরু হবে।
কান্তে হোন্ডো- শব্দ দু’টি মনে পড়ে গেল। আন্দালুসিয়ার লোকগীতির ব্যাপার যখন, তা নিশ্চয়ই লোরকার কথাই হবে। হ্যাঁ, লোরকার কথাই। জিপসিদের জীবন সংস্কৃতির আলোকে লোরকা ১৯২১ সালে রচনা করেনপোয়েমাস দ্য কান্তে হনদো (গভীর গানের কবিতা)। এর মূলে রয়েছে জিপসিদের নৃত্য-গীত ফ্লেমেনকো, যার বিশুদ্ধতম রূপ হচ্ছে কান্তে হনদো বা গভীর গান।
লোরকার কবিতায় দেখি জিপসি নাচের ছবি:
মঞ্চ ভাসিয়ে নেওয়া আলোয়
পারালা নামের নর্তকী
মৃত্যুর সাথে
সংলাপে মেতে গেল
সে ফ্লোরে ডেকে নিচ্ছে তাকে।১
জিপসিদের কবিতা থেকে এবার তাদের ফ্লেমেনকোতে ফিরে আসি। নাচ-গান দেখার জন্য সবাই সিঁড়ি দিয়ে নিচে গুহার ভেতরে নেমে যার যার আসনে গিয়ে বসলাম। আমাদের সামনের ডান পাশে শিল্পীরা বসে আছেন- গিটার হাতে অন্তেভেরোজ, গায়িকা জালিয়া, আর নর্তকী অচোয়া। ডমিনগাজ পরে নাচে যোগ দেবেন।
গিটারিস্ট অন্তেভেরোজ গিটারের তারে হাত বুলাতেই গায়িকা জালিয়া মেলায়েম কণ্ঠে শুরু করল গান, সে গানের সুর ও আবেগে নর্তকী অচোয়া তার বিশাল ঘেরের রঙিন স্কার্ট দোলাতে লাগল ছন্দে ছন্দে, আর জুতো দিয়ে কাঠের ফ্লোরে তুলল সুন্দর এক ঠকঠকানির শব্দ, সাথে থাকল পায়ের জটিল কাজ এবং চোখ-হাত-নিতম্বের সূক্ষ্ম ভঙ্গিমা। গায়িকা জালিয়া গানের সাথে হাততালি দিতে লাগল। শেষ পর্যায়ে দ্বিতীয় নর্তক, ডমিনগাজ যোগ দিল অচোয়া-র সাথে। নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ যৌথ নৃত্য শুরু হল। আস্তে আস্তে সবার তাল, ছন্দ বাড়তে লাগল। শুরু হলো তীব্র ও উচ্চ স্কেলের সঙ্গীত। এ পর্যায়ে গায়িকা ও নর্তকী চলে গেল দুয়েন্দে পর্বে- এক গভীর আবেগ দুজনকে উদ্বেলিত করে তোলে। আর তা সঞ্চারিত হয় দর্শকদের মাঝে। ‘ওলে’ ‘ওলে’ ধ্বনি ও হাততালি দিয়ে দর্শকরা প্রকাশ করে তাদের প্রশংসা। ঘণ্টাখানেক পর শেষ হলো ফ্লেমেনকোর নৃত্য-গীত। নাচ-গান-গিটার ছড়িয়ে দিল তীব্র আনন্দ, তবুও তার মাঝে যেন মিশে ছিল এক সূক্ষ্ম বেদনা। তার কথাই যেন বলল গায়িকা জালিয়া- আমাদের জীবনে অনেক দুঃখ আছে, তা তুলে ধরি ফ্লেমেনকোতে, তা ভুলেও থাকি ফ্লেমেনকো দিয়ে।
এক বুক আনন্দ ও কিছু দুঃখ নিয়ে ফ্লেমেনকো স্টুডিও থেকে বের হলাম। দিগন্তে স্বাগত জানাল আলহাম্বরা- তার উঁচু, গর্বিত মাথায় চাঁদ বসে আছে। চাঁদের ¯িœগ্ধ আলোয় তাকে দেখাচ্ছে করুণ, মায়াবী। গ্রানাদার মতোই যেন রহস্য ও বিষাদ লুকিয়ে আছে আলহাম্বরায়, তাকে মনে হলো গর্বিত অতীত আর বিষণœ বর্তমানের এক মিলিত রূপ। এ কথাই কি তাঁর প্রিয় আলহাম্বরাকে নিয়ে বলেছেন লোরকা:
Alhambra, jesmine of sorrow where the moon rests.
আলহাম্বরা, দুঃখের এক জেসমিন ফুল, যেখানে বিশ্রাম নেয় চাঁদ।
ফ্লেমেনকোর তীর্থন্থান সেক্রোমন্তে হতে হেঁটে হোটেলে ফেরার পথে দু’পাশের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। রাস্তায় অনেক লোক, সবাই সেক্রোমন্তের পাহাড় থেকে দেখছে আলহাম্বরা ও গ্রানাদা শহরকে। জিপসিদের নৃত্য-গীত পথের মোড়ে মোড়ে, সাথে দর্শকদের হাততালি, এ দৃশ্য অনন্য। লোরকা, সিয়ারা নেভাদা, আলহাম্বরা ও ফ্লেমেনকো- গ্রানাদার সত্তার সাথে মিশে আছে নিবিড়ভাবে।
হোটেলে ফিরে সবাই প্রতিদিনের মতো বসলাম পরের দিনের পরিকল্পনায়। নাতাশা ও নাবিল খুঁজছে ‘ফান’, আমি খুঁজছি ইতিহাস, আর ফারজানা অতীত-বর্তমান দু’টিই। তারা একটি স্পট বের করল, যেখানে যেয়ে সবাই যার যার পছন্দমতো জিনিস খুঁজে পেলাম। একই জায়গা, যার যার দৃষ্টিকোণে তা ভিন্ন হয়ে গেল। সবাই জিতল, সবাই আনন্দিত।
পরদিন ভোরে এসে পৌঁছলাম প্লাজা দে বিব-রেম্বলা, আমাদের ‘ফান’ এর জায়গায়। এটি ছিল মুসলিম আমলে গ্রানাডার প্রধান কেন্দ্র। বিব-রেম্বলা একটি আরবি শব্দ, যার মানে ‘বালির ফটক’। একসময় এখানে ছিল ‘বিব-রেম্বলা ফটক’, দেয়াল-ঘেরা শহরে ঢোকার অন্যতম প্রবেশ গথ। এ ফটকটি পরে আল হাম্বরার বাগানের প্রবেশ পথে বসানো হয়। নাসরীয় আমলে (১২৩৮-১৪৯২) প্লাজা দে বিব-রেম্বলা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা, উৎসব ইত্যাদির কেন্দ্র। এর পাশে ছিল গ্রানাদার বড় মসজিদ। এখনো আছে আংশিক মাদ্রাসা দে গ্রানাদা, আন্দালুসিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। স্পেনীয় ইনকুইসিছিঁও এর উন্মত্ততায় মাদ্রাসা দে গ্রানাদার লাইব্রেরির সমৃদ্ধ সংগ্রহের প্রায় পুরোটা প্লাজা দ্য বিব-রেম্বলার চত্বরে এনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
ইনকুইসিছিঁও-র ভয়াবহতা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৫৫০ সালে, আর এর অধীনে ধর্মদ্রোহী, প্রটেস্ট্যান্ট, মুসলিম, ইহুদী ও জিপসিদের উপর চলে বহু নির্যাতন।
লোরকা তাঁর মাতৃভূমিতে সংঘটিত এসব নির্যাতন নিয়ে বলেছেন: ‘গ্রানাদায় জন্ম বলেই আমার এক সহানুভূতিশীল উপলদ্ধি রয়েছে, যারা নির্যাতিত হয়েছেন তাদের জন্য- জিপসি, কালো, ইহুদী, মুর- গ্রানাদার সবাই তা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে’।
এই প্লাজা দে বিব-রেম্বলাকে লোরকা বেছে নিয়েছেন তাঁর নাটক মারিয়ানা পিনেদার সেট হিসেবে। কারণটিও স্পষ্ট- এই প্লাজাতে অনেককে ফাঁসি দেয়া হয়েছে প্রকাশ্যে, সেরকম পরিণতি নাটকের প্রধান চরিত্র মারিয়ানা পিনেদার জীবনেও ঘটেছে। এই নারীর করুণ ও সাহসী জীবনের ঘটনা নিয়ে নাটকটি রচিত। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের এক পর্যায়ে মারিয়ানা জড়িয়ে পড়েন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্পেনের উদারপন্থী আন্দোলনে। ১৮৩১ সালের একদিন মারিয়ানা পিনেদার বাসা তল্লাশি করে পুলিশ একটি পতাকা খুঁজে পায়, যার উপর সূচি-কর্মে লেখা ছিল তিনটি শব্দ- সাম্য, মুক্তি, আইন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ১৮৩১ সালের ২৬ শে মে গ্রানাদার ক্যাম্পো দেল থ্রিয়ানফোর প্রকাশ্য চত্বরে গ্যারট দিয়ে মারিয়ানা পিনেদার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়, আর তাঁর সামনেই পুড়িয়ে দেয়া হয় সেই পতাকা, সাথে পুড়ে গেল তার ওপরের শব্দগুলোও। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬ বছর। এরপর মারিয়ানা পিনেদা হয়ে যান সারা স্পেনের এক বীরাঙ্গনা, আর লোরকার নাটকের এক ট্র্যাজিক চরিত্র।
লোরকা ১৯১৭ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত পরিবারের সাথে থাকতেন গ্রানাডার ৩১ এসেরা দেল ক্যাসিনোর ফ্লাটে। মারিয়ানা পিনেদার ভাষ্কর্য বসানো তাঁর বাসার সামনের প্লাজা দ্য মারিয়ানা পিনেদাতে , তা তিনি প্রতিদিন আসা যাওয়ার পথে দেখতেন। নিঃসন্দেহে মারিয়ানা পিনেদার করুণ, সাহসী জীবন লোরকাকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি কি তখন জানতেন- আরেক ফ্যাসিস্ট শক্তি এক উন্মুক্ত প্রান্তরে তাঁকেই হত্যা করবে, শুধুমাত্র তাঁর লেখনীর কারণে, যখন তাঁর বয়স হবে ৩৮ বছর?
গ্রানাদার অলি-গলি পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে এ রকম হাজারো ইতিহাস।
ইতিহাস থেকে এখন আসা যাক বর্তমানে। প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া ও বই পোড়ানোর চত্বর, প্লাজা দ্য বিব-রেম্বলা, ইতিহাসের বিবর্তনে এখন হয়েছে ‘ফান’-এর জায়গা- সবদিকে আমোদ প্রমোদের আয়োজন। এখানে এসে নাবিল নাতাশা খুব খুশি। অবশ্য এ চত্বরের ইতিহাস তাদেরকে বলিনি, বললেও তারা শুনবে না। তারা বাস করে বর্তমানে, অতীতে -। এখন তারা স্টলে স্টলে সাজানো ফুলের ঘ্রাণে, ফুলের রঙে মাতোয়ারা। ফুলও কিনল- একজনের হাতে পেনজি, আরেকজনের হাতে ভায়োলাস। ফলের দোকান থেকে নিল গ্রানাদার ফল- ডালিম ও কমলা। এরপর তারা স্যুভেনির শপে ঘুরে ঘুরে স্যুভেনির দেখতে লাগল। কিনলোও কিছু। এরপর পাশের ক্যাফেতে গেল হট চকোলেট আর প্রেটজেলের জন্য- এগুলোর ঘ্রাণে সবদিক ভরে আছে। এ হট চকোলেট একটু অন্যরকম মনে হলো- এটি বিটারসুইট চকোলেট দিয়ে তৈরি, একটু ঘন ক্রিমের পানীয়। স্পেনীয়দের কাছে খুবই প্রিয় হট চকোলেট। ইউরোপে একটি কথা আছে: ‘Chocolate is to the Spanish what tea is to the English’.
চকোলেট-স্যুভেনির-ফুলে-ফলে নাবিল নাতাশার মুড বেশ ভাল, তাই মারিয়ানা পিনেদার জীবন কাহিনী তাদেরকে বললাম। শুনে নাবিল বলল- এখানে নিশ্চয়ই তাঁর নামে কোনো প্লাজা আছে, নাতাশা বলল- প্লাজার সেন্টারে অবশ্যই তাঁর স্ট্যাচু থাকবে। প্রশ্ন দু’টি কি পরিহাস করে করা, না আগ্রহ নিয়ে বলা, ঠিক ধরতে পারলাম না। বললাম, হ্যাঁ, তোমাদের দু’জনের অনুমানই ঠিক। এর মধ্যেই তারা ফোনে গুগল ম্যাপে বের করল- প্লাজা দে মারিয়ানা পিনেদা বেশি দূরে -, হোটেলে যাওয়ার পথেই পড়বে।
অল্প সময়েই আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। ওক, পাইন, লেমন ও ম্যাগনোলিয়ার সারি ঘিরে রেখেছে প্লাজাকে, ঠিক মাঝখানের এক স্মৃতিস্তম্ভে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছেন মারিয়ানা পিনেদা। পতাকা আচ্ছাদিত এক স্তম্ভের উপর তাঁর ডান হাত, পতাকায় লেখা ‘স্বদেশ, আইন, মুক্তি’। ঘাড় থেকে বুকের দিকে ঝুলে থাকা এক ক্রসের নিচে তাঁর বাম হাত। স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিতে এক ফোয়ারা, আর চারপাশে রঙবেরঙের ফুলের গাছ। নগরের হাজারো ব্যস্ততা এখানে যেন থমকে আছে। সব মিলিয়ে এক শান্ত, পবিত্র পরিবেশ। এখানে ইতিহাস মিশে আছে নিসর্গে। আমরাও নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। এ মহিয়সী নারীর প্রতি মন থেকে শ্রদ্ধা জাগল । নাতাশা তার হাতের পেনজির গোছার কয়েকটি ফুল স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিতে রেখে দিল। নাবিলও তাই করল তার ফুল দিয়ে। গ্রানাদার লোকজন একটি বিশেষ দিনে এখানে ফুল দিতে আসে- সেদিনটি ২৬ মে, মারিয়ানা পিনেদার মৃত্যুদ- কার্যকরী করার দিন- গ্রানাডার সাধারণ ছুটির দিন। সে মহিয়সী নারীর জন্য লোরকার নিবেদন:
কী এক দুঃখের দিন গ্রানাদায়
পাথরগুলো কান্না শুরু করেছে
মারিয়ানার মৃত্যু দেখে
সে যে আর কথা বলবে না।২
কাছের ৩১এসেরা দেল ক্যাসিনো ঠিকানায় আগ্রহ ভরে গেলাম, যেখানে ২য় ও ৩য় তলার ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে লোরকা বাস করেছেন দীর্ঘদিন- ১৯১৭ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত। হতাশ হতে হলো, কারণ লোরকার সময়ের ফ্ল্যাটগুলি ১৯৭০-এর দিকে ভেঙ্গে ফেলে নতুন ভবন করা হয়েছে। নাগরিকরাও এর তেমন প্রতিবাদ করেনি। কারণ তখন ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্রের শাসন, লোরকা সে সময় স্পেনে নিযিদ্ধ। শুধুমাত্র ১৯৫৩ সালে তাঁর সম্পূর্ণ সাহিত্যকর্মের কপি ছাপা হয়েছিল, তাও সেন্সরড কপি। ২০ নভেম্বর ১৯৭৫ এ ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর লোরকার সৃষ্টিসমূহ স্পেনে উন্মুক্ত করা হয়।
হোসুয়া-র কাছ থেকে পাওয়া লোরকার আর একটি স্মৃতিস্থানের কথা মনে পড়ে গেল। এখনসেখানে যাওয়া যেতে পারে।
একটু হেঁটে পেয়ে গেলাম রেস্টোরেন্টে চিকিতো। আগে যখন এটি ছিল ক্যাফে আলামাদা, তখন লোরকা এখানে প্রায়ই আসতেন, আর আসতেন তাঁর আল রিকনসিয়ো দলের সদস্যরা। তাঁরা আলমাদার এক কোণায় সিঁড়ির নিচে মিলিত হতেন, তাই আল রিকনসিয়ো বা ছোট্ট কোণ নামে তারা পরিচিত ছিলো। এটি ছিল উদীয়মান শিল্পী সাহিত্যিকদের একটি সমাবেশ। তাঁদের অনেকে পরে মাদ্রিদ ও প্যারিসে যেয়ে অনেক খ্যাতি অর্জন করেন।
রেস্টোরেন্টে চিকিতোতে ঢুকে লোরকাকে খোঁজ করলাম। একজন খুব আন্তরিকভাবে নিয়ে গেল ভেতরের কোনায় সিঁড়ির নিচে এক টেবিলে, যেখানে কবি তাঁর শিল্পী সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেন। সেখানে লোরকার একটি ভাস্কর্য রাখা আছে, হাতে একটি পেন্সিল, কিছু লিখছেন, নিশ্চয়ই কবিতা। এখানে আমরা সবাই লোরকার সাথে ছবি তুললাম।
লোরকা যেখানে বসতেন আমরা তার পাশের টেবিলে বসলাম। স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবির টেবিলের পাশে বসে স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার পাইয়া অর্ডার দিলাম। আমি ও নাবিল নিলাম চিকেন পাইয়া, ফারজানা ও নাতাশা সি ফুড। এর মধ্যে দেখি তারা আমাদের জন্য তাপাস নিয়ে আসল, সাথে ডালিমের রস, যদিও আমরা অর্ডার দিইনি। তারা বলল এটি আমাদের জন্য সৌজন্যমূলক খাবার। স্পেনের অনেক রেস্টুরেন্টে ড্রিংকসের সাথে তাপাস এমনি দেয়া হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর আমাদের অর্ডার আসল। পাইয়া খেয়ে আমাদের সবার ভালই লাগল। হোটেলের লোকজন লোরকার প্রতি আমাদের আগ্রহ দেখে খুব খুশি হলো। তারা বলল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন আসে লোরকার স্মৃতি-বিজড়িত এ স্থানটি দেখতে। রাত দশটায়ও রেস্টুরেন্টটি কানায় কানায় পূর্ণ।
গ্রানাদার পার্কে, প্লাজায়, সড়কের পাশে প্রতিদিন দেখি কমলা গাছের সারি। অনেকদিন ভেবেছি একটি কমলা নেব স্মৃতি হিসেবে রাখার জন্য, কিন্তু ইতস্তত করেছি। রেস্টোরেন্টে চিকিতো-র সামনেই দেখি গাছজুড়ে ঝুলে আছে থোকা থোকা পাকা কমলা। হাত বাড়িয়ে একটি কমলা ছিড়ে নিলাম। তা দেখেই নাবিল ও নাতাশা বলল, বাবা, ইটস নট ফেয়ার। তুমি কমলা ছিঁড়তে পার না। আমি বললাম, দেখ, এখানে হাজার হাজার কমলা। একটি কমলা ছিঁড়লে কী আসে যায়? ওরা বলল, এটি এখানকার নিয়ম, কেউ এসব ফল ছিঁড়তে পারেনা। আমি দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, এসব ফল গাছেই বেশি সুন্দর।
নাতাশা গুগলে বের করল, কাছের এসেরা দেল ক্যাসিনো রাস্তাতে, ১৭ নাম্বারে, রয়েছে বিখ্যাত বেকারী ও পেস্ট্রি শপ পুয়ের্তা বারনিনা। নতুন নতুন কেক ও পেস্ট্রির স্বাদ নেয়া তার বড় শখ। এখানে এসে দেখলাম হরেক রকমের কেক ও পেস্ট্রি- অনেকগুলি দেখতে চেনা চেনা লাগে, নাম শুধু ভিন্ন। আর অনেকগুলি সম্পূর্ণ নতুন। আমাদের আগ্রহ, এখানকার বিশেষ কিছুর স্বাদ পরীক্ষা করে দেখা। নাতাশা গুগলে আগেই দেখে নিয়েছে- পিওননো, গ্রানাডার ঐতিহ্যবাহী ছোট পেস্ট্রি, যা ১৮৯৭ সাল থেকে তৈরী হয়ে আসছে। আর একটি স্পেনের উত্তর-পশ্চিম এলাকা গ্যালিসিয়ায় মধ্যযুগ থেকে তৈরি হয়ে আসছে- মূলত ‘পাই’- তারতা দে সান্টিয়াগো। আমরা দু’টিই অর্ডার দিলাম। কেক, পেস্ট্রি ও কফির ঘ্রাণে পুরো এলাকা ভরে আছে। তার সাথে মিশে যাচ্ছে কারো মিষ্টি পারফিউমের সুগন্ধ। এর মধ্যেই চলে আসল আমাদের পেস্ট্রি ও পাই। সবাই মজা করে খেয়ে সোডা হাতে বের হয়ে গেলাম। স্পেনীয় পেস্ট্রির স্বাদ পেয়ে নাতাশা খুবই খুশি হয়ে আছে।
হোটেলে ফিরে সবাই বসলাম কালকের পরিকল্পনায়। আমার মনে অনেকদিন ধরে গেঁথে আছে আরনেস্ট হেমিংওয়ে লিখিত উপন্যাস ‘The Sun Also Rises’, যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে পিরেনিস পর্বতমালার পাদদেশে স্পেনের পেমপ্লোনা শহরে অনুষ্ঠিত সান ফারমিন ফেস্টিভাল। এর অংশ হচ্ছে এনসিয়ারো (ষাঁড়দের দৌড়), করিডাস (ষাঁড়ের লড়াই), নাচ-গান-বাদ্য-বাজনা-পানাহার তো আছেই। বুলফাইট বা ষাঁড়ের লড়াই স্পেনীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক বিশিষ্ট অংশ। এটি না দেখে স্পেন দেখা অসম্পূর্ণ থাকবে। তাই আমি প্রস্তাব দিলাম একদিন ষাঁড়ের লড়াই দেখতে যাব। নাবিল ও নাতাশা দু’জনেই একসাথে বলে উঠল, ইটস এ ক্রুয়েল গেম। ইট শুড বি ব্যানড। ভেবে দেখলাম তাদের কথায় যুক্তি আছে, তাই এটি শিরোধার্য। আমার ষাঁড়ের লড়াই দেখার স্বপ্ন অপূর্ণই থাকল।
পরে জানলাম, এখন বুলফাইট সিজন -, মার্চ থেকে অক্টোবর হলো সিজন। তবে স্পেনের বিভিন্ন শহরে বুলফাইট মিউজিয়ম আছে, সেখানে যাওয়া যেত। তবে নাবিল ও নাতাশার মনোভাব দেখে তার আর সাহস হলো না।
হোটেলে ফিরে ডিনারের পর আমাদের নিয়মিত মিটিং হলো; চিরাচরিত আলোচ্য বিষয়- আজকের অভিজ্ঞতা ও কালকের পরিকল্পনা। আমাদের ট্যুর গাইড নাতাশা কিছুক্ষণ তার ফোনে সার্চ করে খুঁজে পেল এক গন্তব্য- সমুদ্র সৈকত পুয়ের্তা দেল মার- গ্রানাদা শহর থেকে পৌঁছতে লাগবে ১ ঘণ্টা, ধরে যেতে হবে এ-৪৪ হাইওয়ে। গ্রানাডার কাছের সিয়ারা নেভাদা, সবুজ উপত্যকা, জলপাই বাগান দেখে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম ভূমধ্যসাগর এখান থেকে বেশি দূরে -। আমি নাতাশাকে বললাম, দেখ, এভাবে দু’চার ঘণ্টার জন্য সমুদ্র সৈকত দেখে ভাল লাগবে না। বরং পরে আমরা আরো বড়, আরো বিখ্যাত সমুদ্র সৈকতে যাব, রাতে সেখানে থাকব। নাতাশা বলল, জায়গাটির নাম কী? আমি বললাম, মালাগা। সে মেনে নিল।
মালাগার সমুদ্র সৈকতের আলাপ করতে করতে, তার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।
Ref:
১. Café cantante, কাফে ক্যাবারেট, অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ
২. Mariana Pineda,মারিয়ানা পিনাদা
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৭
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫
মুজেও কুয়েবাছ দেল সেক্রোমন্তে থেকে বের হয়ে দেখি, সূর্য তার বিদায় বেলার সোনালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে, সে আভায়- সেক্রোমন্তে, আলবাইসিন, আল হাম্বরা, সিয়েরা নেভাদা হয়ে উঠেছে স্বপ্নলোক। একটু থেমে, দাঁড়িয়ে, আমরা সে স্বপ্নিল দৃশ্য দেখতে লাগলাম। সূর্য ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতেই পাহাড়ের গায়ে গায়ে গুহার বাতিগুলি জ্বলে উঠেছে, শুরু হলো যেন বনের মাঝে জোনাকিদের মেলা। বিভিন্ন চত্বরে লোকজনের জমায়েত বাড়ছে। ফ্লেমেনকো ড্যান্স স্টুডিওগুলির সামনেই বেশি জটলা। স্পেনে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ এই ফ্লেমেনকো। তাই এসব স্টুডিওতে তাদের ভিড়ই বেশি।
নাবিল ও নাতাশাকে বললাম- ফ্লেমেনকো ড্যান্স দেখা ছাড়া জিপসিদের জানা সম্পূর্ণ হবেনা। তোমরা কি এই ড্যান্স দেখতে চাও? সাথে সাথেই তারা রাজি হয়ে গেল। এটি যেহেতু ড্যান্স, সাথে থাকবে গান- তাই তারা অতি উৎসাহী; বিশেষ করে নাতাশা, কারণ সে নিজেও নাচে, তাই তার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি।
ফ্লেমেনকো স্টুডিওগুলি বলা যায় দোতলা গুহা। রাস্তার সমতলে একটি রুম- অর্ভ্যথনা, টিকেট কাটা, অপেক্ষা- বলা যায় অফিস এলাকা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মাটির নিচে গুহা- ঐখানেই হয় নাচ-গান।
টিকেট কেটে ঢুকলাম কুয়েবা লা রোচিও-তে, যা সেক্রোমন্তে-র অনেক পুরনো এক ফ্লেমেনকো স্টুডিও। চটপটে সুন্দরী তরুণী মারিয়া আমাদেরকে নিয়ে বসাল ওয়েটিং রুমে, শো শুরু হবে রাত ন’টায়, এখনো ঘণ্টাখানেক সময় আছে। আমাদেরকে খেতে দিল স্পেনের ঐতিহ্যবাহী তাপাস আর সাথে ডালিমের রস। হাতে অনেক সময়, তাই আমরা আলাপ শুরু করলাম। ছেলে মেয়ে দু’জনের ফ্লেমেনকো নিয়ে আগ্রহ দেখে মারিয়ার খুব ভাল লাগল। আর আমরা সুদূর আমেরিকা থেকে এসেছি জেনে সে একটু বেশি খাতির করল। তবে সে ভাল ইংরেজি বলতে পারে না। স্পেনে লোকজন ইংরেজি খুব একটা বলতে পারে না, বা বলে না। আমার স্প্যানিশ ভাষার দৌড়- হাই, কেমন আছো... ভালো... দুঃখিত... ধন্যবাদ... এরকম মাত্র ১০টির মতো শব্দ। আমাদের মধ্যে নাতাশা স্প্যানিশ ভাষায় ভালো। সব জায়গায় কথা বলে সে কাজ চালিয়ে নেয়। এখানেও সে মারিয়ার সাথে কথা বলছে, আর মাঝে মধ্যে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে মারিয়া বলল, তোমরা যদি আমাদের শিল্পীদের সাথে আলাপ করতে চাও, করতে পার, শো শুরু হওয়ার আগে এখনো কিছু সময় আছে। আমরা সবাই প্রায় চিৎকার করে বললাম ‘ইয়েস’।
মারিয়ার সাথে ভেতরের এক রুমে ঢুকে দেখলাম ৪ জন শিল্পী, আয়েশ করে পান করছেন স্পেনীয় পানীয় তেকিলা। এটি তাঁদের বিশ্রামের সময়, তাই ভাবলাম চলে আসব কিনা! মারিয়া বলল কোনো অসুবিধে নেই, তারা বিশ্রামের ফাঁকে কথা বলতে পারবে। সে ফ্লেমেনকো দলের সাথে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
এদের দলপতি ডমিনগাজ, বেশ সুঠাম সুন্দর চেহারার একজন জিপসি। তিনি ইংরেজি বেশ ভাল বলেন। আমরা জিপসি আর ফ্লেমেনকো নিয়ে উৎসাহী জেনে খুব খুশি হলেন। আরো বেশি খুশি হলেন শুনে- নাবিল গিটার বাজাতে পারে, নাতাশা পারে নাচতে ও পিয়ানো বাজাতে। বললেন, আমার গান, নাতাশার নাচ, নাবিলের গিটার মিলে হলো ফ্লেমেনকো। আমাদের ভাষায় গান হলো কান্তে, নাচ হলো বাইলে, গিটার হলো তোকে। একে আরো মজাদার করার জন্য যোগ করতে পার- পা ঠোকা- যাকে আমরা বলি ছাপাতেয়ার, যা করবে তোমাদের মা, আর সবচেয়ে সোজা, হাততালি, বা পালমাছ, দেবে তোমাদের বাবা। হয়েই গেল একটি ফ্লেমেনকো দল- বলেই ডমিনগাজ হো হো করে হাসতে লাগল। ডমিনগাজ-র কথা শুনে হাসিতে যোগ দিল দলের সবাই। দলে আছে নর্তকী অচোয়া, গায়িকা জালিয়া, গিটার বাদক অন্তেভেরোজ। আর দলপতি ডমিনগাজ দ্বিতীয় নর্তক। একটু থেমে আবার শুরু করলেন তিনি। বললেন, এখন ফ্লেমেনকোর ইতিহাসে তোমাদের একটু ঘুরিয়ে আনি। এর জন্ম জিপসিদের পূর্বপুরুষ রোমানিদের হাত ধরে, যারা ভারতবর্ষের রাজস্থান থেকে দেশান্তরী হয়ে স্পেনে আসে- নবম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। তারা সাথে নিয়ে আসে তাদের বাদ্যযন্ত্র- তাম্বুরা, করতাল, ঘণ্টা ইত্যাদি। আরো নিয়ে আসে অনেক গান ও নাচ। ধীরে ধীরে আদি ফ্লেমেনকোর সাথে মিশতে থাকে স্থানীয় স্পেনীয়, আরব ও ইহুদীদের সঙ্গীত। ফ্লেমেনকোর বিভিন্ন ধরন আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো হলো কান্তে হোন্ডো, যার মানে গভীর গান- এটি তুলে ধরে গভীর আবেগ- যেমন মৃত্যু, হতাশা, যন্ত্রণা। এ বলে ডমিনগাজ বললেন, বাকিটা তোমরা একটু পরে দেখবে স্টুডিওতে, সেখানে তোমাদের সাথে দেখা হবে। সবাই উঠে পড়ল, একটু পরে শো শুরু হবে।
কান্তে হোন্ডো- শব্দ দু’টি মনে পড়ে গেল। আন্দালুসিয়ার লোকগীতির ব্যাপার যখন, তা নিশ্চয়ই লোরকার কথাই হবে। হ্যাঁ, লোরকার কথাই। জিপসিদের জীবন সংস্কৃতির আলোকে লোরকা ১৯২১ সালে রচনা করেনপোয়েমাস দ্য কান্তে হনদো (গভীর গানের কবিতা)। এর মূলে রয়েছে জিপসিদের নৃত্য-গীত ফ্লেমেনকো, যার বিশুদ্ধতম রূপ হচ্ছে কান্তে হনদো বা গভীর গান।
লোরকার কবিতায় দেখি জিপসি নাচের ছবি:
মঞ্চ ভাসিয়ে নেওয়া আলোয়
পারালা নামের নর্তকী
মৃত্যুর সাথে
সংলাপে মেতে গেল
সে ফ্লোরে ডেকে নিচ্ছে তাকে।১
জিপসিদের কবিতা থেকে এবার তাদের ফ্লেমেনকোতে ফিরে আসি। নাচ-গান দেখার জন্য সবাই সিঁড়ি দিয়ে নিচে গুহার ভেতরে নেমে যার যার আসনে গিয়ে বসলাম। আমাদের সামনের ডান পাশে শিল্পীরা বসে আছেন- গিটার হাতে অন্তেভেরোজ, গায়িকা জালিয়া, আর নর্তকী অচোয়া। ডমিনগাজ পরে নাচে যোগ দেবেন।
গিটারিস্ট অন্তেভেরোজ গিটারের তারে হাত বুলাতেই গায়িকা জালিয়া মেলায়েম কণ্ঠে শুরু করল গান, সে গানের সুর ও আবেগে নর্তকী অচোয়া তার বিশাল ঘেরের রঙিন স্কার্ট দোলাতে লাগল ছন্দে ছন্দে, আর জুতো দিয়ে কাঠের ফ্লোরে তুলল সুন্দর এক ঠকঠকানির শব্দ, সাথে থাকল পায়ের জটিল কাজ এবং চোখ-হাত-নিতম্বের সূক্ষ্ম ভঙ্গিমা। গায়িকা জালিয়া গানের সাথে হাততালি দিতে লাগল। শেষ পর্যায়ে দ্বিতীয় নর্তক, ডমিনগাজ যোগ দিল অচোয়া-র সাথে। নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ যৌথ নৃত্য শুরু হল। আস্তে আস্তে সবার তাল, ছন্দ বাড়তে লাগল। শুরু হলো তীব্র ও উচ্চ স্কেলের সঙ্গীত। এ পর্যায়ে গায়িকা ও নর্তকী চলে গেল দুয়েন্দে পর্বে- এক গভীর আবেগ দুজনকে উদ্বেলিত করে তোলে। আর তা সঞ্চারিত হয় দর্শকদের মাঝে। ‘ওলে’ ‘ওলে’ ধ্বনি ও হাততালি দিয়ে দর্শকরা প্রকাশ করে তাদের প্রশংসা। ঘণ্টাখানেক পর শেষ হলো ফ্লেমেনকোর নৃত্য-গীত। নাচ-গান-গিটার ছড়িয়ে দিল তীব্র আনন্দ, তবুও তার মাঝে যেন মিশে ছিল এক সূক্ষ্ম বেদনা। তার কথাই যেন বলল গায়িকা জালিয়া- আমাদের জীবনে অনেক দুঃখ আছে, তা তুলে ধরি ফ্লেমেনকোতে, তা ভুলেও থাকি ফ্লেমেনকো দিয়ে।
এক বুক আনন্দ ও কিছু দুঃখ নিয়ে ফ্লেমেনকো স্টুডিও থেকে বের হলাম। দিগন্তে স্বাগত জানাল আলহাম্বরা- তার উঁচু, গর্বিত মাথায় চাঁদ বসে আছে। চাঁদের ¯িœগ্ধ আলোয় তাকে দেখাচ্ছে করুণ, মায়াবী। গ্রানাদার মতোই যেন রহস্য ও বিষাদ লুকিয়ে আছে আলহাম্বরায়, তাকে মনে হলো গর্বিত অতীত আর বিষণœ বর্তমানের এক মিলিত রূপ। এ কথাই কি তাঁর প্রিয় আলহাম্বরাকে নিয়ে বলেছেন লোরকা:
Alhambra, jesmine of sorrow where the moon rests.
আলহাম্বরা, দুঃখের এক জেসমিন ফুল, যেখানে বিশ্রাম নেয় চাঁদ।
ফ্লেমেনকোর তীর্থন্থান সেক্রোমন্তে হতে হেঁটে হোটেলে ফেরার পথে দু’পাশের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। রাস্তায় অনেক লোক, সবাই সেক্রোমন্তের পাহাড় থেকে দেখছে আলহাম্বরা ও গ্রানাদা শহরকে। জিপসিদের নৃত্য-গীত পথের মোড়ে মোড়ে, সাথে দর্শকদের হাততালি, এ দৃশ্য অনন্য। লোরকা, সিয়ারা নেভাদা, আলহাম্বরা ও ফ্লেমেনকো- গ্রানাদার সত্তার সাথে মিশে আছে নিবিড়ভাবে।
হোটেলে ফিরে সবাই প্রতিদিনের মতো বসলাম পরের দিনের পরিকল্পনায়। নাতাশা ও নাবিল খুঁজছে ‘ফান’, আমি খুঁজছি ইতিহাস, আর ফারজানা অতীত-বর্তমান দু’টিই। তারা একটি স্পট বের করল, যেখানে যেয়ে সবাই যার যার পছন্দমতো জিনিস খুঁজে পেলাম। একই জায়গা, যার যার দৃষ্টিকোণে তা ভিন্ন হয়ে গেল। সবাই জিতল, সবাই আনন্দিত।
পরদিন ভোরে এসে পৌঁছলাম প্লাজা দে বিব-রেম্বলা, আমাদের ‘ফান’ এর জায়গায়। এটি ছিল মুসলিম আমলে গ্রানাডার প্রধান কেন্দ্র। বিব-রেম্বলা একটি আরবি শব্দ, যার মানে ‘বালির ফটক’। একসময় এখানে ছিল ‘বিব-রেম্বলা ফটক’, দেয়াল-ঘেরা শহরে ঢোকার অন্যতম প্রবেশ গথ। এ ফটকটি পরে আল হাম্বরার বাগানের প্রবেশ পথে বসানো হয়। নাসরীয় আমলে (১২৩৮-১৪৯২) প্লাজা দে বিব-রেম্বলা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা, উৎসব ইত্যাদির কেন্দ্র। এর পাশে ছিল গ্রানাদার বড় মসজিদ। এখনো আছে আংশিক মাদ্রাসা দে গ্রানাদা, আন্দালুসিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। স্পেনীয় ইনকুইসিছিঁও এর উন্মত্ততায় মাদ্রাসা দে গ্রানাদার লাইব্রেরির সমৃদ্ধ সংগ্রহের প্রায় পুরোটা প্লাজা দ্য বিব-রেম্বলার চত্বরে এনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
ইনকুইসিছিঁও-র ভয়াবহতা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৫৫০ সালে, আর এর অধীনে ধর্মদ্রোহী, প্রটেস্ট্যান্ট, মুসলিম, ইহুদী ও জিপসিদের উপর চলে বহু নির্যাতন।
লোরকা তাঁর মাতৃভূমিতে সংঘটিত এসব নির্যাতন নিয়ে বলেছেন: ‘গ্রানাদায় জন্ম বলেই আমার এক সহানুভূতিশীল উপলদ্ধি রয়েছে, যারা নির্যাতিত হয়েছেন তাদের জন্য- জিপসি, কালো, ইহুদী, মুর- গ্রানাদার সবাই তা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে’।
এই প্লাজা দে বিব-রেম্বলাকে লোরকা বেছে নিয়েছেন তাঁর নাটক মারিয়ানা পিনেদার সেট হিসেবে। কারণটিও স্পষ্ট- এই প্লাজাতে অনেককে ফাঁসি দেয়া হয়েছে প্রকাশ্যে, সেরকম পরিণতি নাটকের প্রধান চরিত্র মারিয়ানা পিনেদার জীবনেও ঘটেছে। এই নারীর করুণ ও সাহসী জীবনের ঘটনা নিয়ে নাটকটি রচিত। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের এক পর্যায়ে মারিয়ানা জড়িয়ে পড়েন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্পেনের উদারপন্থী আন্দোলনে। ১৮৩১ সালের একদিন মারিয়ানা পিনেদার বাসা তল্লাশি করে পুলিশ একটি পতাকা খুঁজে পায়, যার উপর সূচি-কর্মে লেখা ছিল তিনটি শব্দ- সাম্য, মুক্তি, আইন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ১৮৩১ সালের ২৬ শে মে গ্রানাদার ক্যাম্পো দেল থ্রিয়ানফোর প্রকাশ্য চত্বরে গ্যারট দিয়ে মারিয়ানা পিনেদার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়, আর তাঁর সামনেই পুড়িয়ে দেয়া হয় সেই পতাকা, সাথে পুড়ে গেল তার ওপরের শব্দগুলোও। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬ বছর। এরপর মারিয়ানা পিনেদা হয়ে যান সারা স্পেনের এক বীরাঙ্গনা, আর লোরকার নাটকের এক ট্র্যাজিক চরিত্র।
লোরকা ১৯১৭ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত পরিবারের সাথে থাকতেন গ্রানাডার ৩১ এসেরা দেল ক্যাসিনোর ফ্লাটে। মারিয়ানা পিনেদার ভাষ্কর্য বসানো তাঁর বাসার সামনের প্লাজা দ্য মারিয়ানা পিনেদাতে , তা তিনি প্রতিদিন আসা যাওয়ার পথে দেখতেন। নিঃসন্দেহে মারিয়ানা পিনেদার করুণ, সাহসী জীবন লোরকাকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি কি তখন জানতেন- আরেক ফ্যাসিস্ট শক্তি এক উন্মুক্ত প্রান্তরে তাঁকেই হত্যা করবে, শুধুমাত্র তাঁর লেখনীর কারণে, যখন তাঁর বয়স হবে ৩৮ বছর?
গ্রানাদার অলি-গলি পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে এ রকম হাজারো ইতিহাস।
ইতিহাস থেকে এখন আসা যাক বর্তমানে। প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া ও বই পোড়ানোর চত্বর, প্লাজা দ্য বিব-রেম্বলা, ইতিহাসের বিবর্তনে এখন হয়েছে ‘ফান’-এর জায়গা- সবদিকে আমোদ প্রমোদের আয়োজন। এখানে এসে নাবিল নাতাশা খুব খুশি। অবশ্য এ চত্বরের ইতিহাস তাদেরকে বলিনি, বললেও তারা শুনবে না। তারা বাস করে বর্তমানে, অতীতে -। এখন তারা স্টলে স্টলে সাজানো ফুলের ঘ্রাণে, ফুলের রঙে মাতোয়ারা। ফুলও কিনল- একজনের হাতে পেনজি, আরেকজনের হাতে ভায়োলাস। ফলের দোকান থেকে নিল গ্রানাদার ফল- ডালিম ও কমলা। এরপর তারা স্যুভেনির শপে ঘুরে ঘুরে স্যুভেনির দেখতে লাগল। কিনলোও কিছু। এরপর পাশের ক্যাফেতে গেল হট চকোলেট আর প্রেটজেলের জন্য- এগুলোর ঘ্রাণে সবদিক ভরে আছে। এ হট চকোলেট একটু অন্যরকম মনে হলো- এটি বিটারসুইট চকোলেট দিয়ে তৈরি, একটু ঘন ক্রিমের পানীয়। স্পেনীয়দের কাছে খুবই প্রিয় হট চকোলেট। ইউরোপে একটি কথা আছে: ‘Chocolate is to the Spanish what tea is to the English’.
চকোলেট-স্যুভেনির-ফুলে-ফলে নাবিল নাতাশার মুড বেশ ভাল, তাই মারিয়ানা পিনেদার জীবন কাহিনী তাদেরকে বললাম। শুনে নাবিল বলল- এখানে নিশ্চয়ই তাঁর নামে কোনো প্লাজা আছে, নাতাশা বলল- প্লাজার সেন্টারে অবশ্যই তাঁর স্ট্যাচু থাকবে। প্রশ্ন দু’টি কি পরিহাস করে করা, না আগ্রহ নিয়ে বলা, ঠিক ধরতে পারলাম না। বললাম, হ্যাঁ, তোমাদের দু’জনের অনুমানই ঠিক। এর মধ্যেই তারা ফোনে গুগল ম্যাপে বের করল- প্লাজা দে মারিয়ানা পিনেদা বেশি দূরে -, হোটেলে যাওয়ার পথেই পড়বে।
অল্প সময়েই আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। ওক, পাইন, লেমন ও ম্যাগনোলিয়ার সারি ঘিরে রেখেছে প্লাজাকে, ঠিক মাঝখানের এক স্মৃতিস্তম্ভে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছেন মারিয়ানা পিনেদা। পতাকা আচ্ছাদিত এক স্তম্ভের উপর তাঁর ডান হাত, পতাকায় লেখা ‘স্বদেশ, আইন, মুক্তি’। ঘাড় থেকে বুকের দিকে ঝুলে থাকা এক ক্রসের নিচে তাঁর বাম হাত। স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিতে এক ফোয়ারা, আর চারপাশে রঙবেরঙের ফুলের গাছ। নগরের হাজারো ব্যস্ততা এখানে যেন থমকে আছে। সব মিলিয়ে এক শান্ত, পবিত্র পরিবেশ। এখানে ইতিহাস মিশে আছে নিসর্গে। আমরাও নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। এ মহিয়সী নারীর প্রতি মন থেকে শ্রদ্ধা জাগল । নাতাশা তার হাতের পেনজির গোছার কয়েকটি ফুল স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিতে রেখে দিল। নাবিলও তাই করল তার ফুল দিয়ে। গ্রানাদার লোকজন একটি বিশেষ দিনে এখানে ফুল দিতে আসে- সেদিনটি ২৬ মে, মারিয়ানা পিনেদার মৃত্যুদ- কার্যকরী করার দিন- গ্রানাডার সাধারণ ছুটির দিন। সে মহিয়সী নারীর জন্য লোরকার নিবেদন:
কী এক দুঃখের দিন গ্রানাদায়
পাথরগুলো কান্না শুরু করেছে
মারিয়ানার মৃত্যু দেখে
সে যে আর কথা বলবে না।২
কাছের ৩১এসেরা দেল ক্যাসিনো ঠিকানায় আগ্রহ ভরে গেলাম, যেখানে ২য় ও ৩য় তলার ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে লোরকা বাস করেছেন দীর্ঘদিন- ১৯১৭ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত। হতাশ হতে হলো, কারণ লোরকার সময়ের ফ্ল্যাটগুলি ১৯৭০-এর দিকে ভেঙ্গে ফেলে নতুন ভবন করা হয়েছে। নাগরিকরাও এর তেমন প্রতিবাদ করেনি। কারণ তখন ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্রের শাসন, লোরকা সে সময় স্পেনে নিযিদ্ধ। শুধুমাত্র ১৯৫৩ সালে তাঁর সম্পূর্ণ সাহিত্যকর্মের কপি ছাপা হয়েছিল, তাও সেন্সরড কপি। ২০ নভেম্বর ১৯৭৫ এ ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর লোরকার সৃষ্টিসমূহ স্পেনে উন্মুক্ত করা হয়।
হোসুয়া-র কাছ থেকে পাওয়া লোরকার আর একটি স্মৃতিস্থানের কথা মনে পড়ে গেল। এখনসেখানে যাওয়া যেতে পারে।
একটু হেঁটে পেয়ে গেলাম রেস্টোরেন্টে চিকিতো। আগে যখন এটি ছিল ক্যাফে আলামাদা, তখন লোরকা এখানে প্রায়ই আসতেন, আর আসতেন তাঁর আল রিকনসিয়ো দলের সদস্যরা। তাঁরা আলমাদার এক কোণায় সিঁড়ির নিচে মিলিত হতেন, তাই আল রিকনসিয়ো বা ছোট্ট কোণ নামে তারা পরিচিত ছিলো। এটি ছিল উদীয়মান শিল্পী সাহিত্যিকদের একটি সমাবেশ। তাঁদের অনেকে পরে মাদ্রিদ ও প্যারিসে যেয়ে অনেক খ্যাতি অর্জন করেন।
রেস্টোরেন্টে চিকিতোতে ঢুকে লোরকাকে খোঁজ করলাম। একজন খুব আন্তরিকভাবে নিয়ে গেল ভেতরের কোনায় সিঁড়ির নিচে এক টেবিলে, যেখানে কবি তাঁর শিল্পী সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেন। সেখানে লোরকার একটি ভাস্কর্য রাখা আছে, হাতে একটি পেন্সিল, কিছু লিখছেন, নিশ্চয়ই কবিতা। এখানে আমরা সবাই লোরকার সাথে ছবি তুললাম।
লোরকা যেখানে বসতেন আমরা তার পাশের টেবিলে বসলাম। স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবির টেবিলের পাশে বসে স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার পাইয়া অর্ডার দিলাম। আমি ও নাবিল নিলাম চিকেন পাইয়া, ফারজানা ও নাতাশা সি ফুড। এর মধ্যে দেখি তারা আমাদের জন্য তাপাস নিয়ে আসল, সাথে ডালিমের রস, যদিও আমরা অর্ডার দিইনি। তারা বলল এটি আমাদের জন্য সৌজন্যমূলক খাবার। স্পেনের অনেক রেস্টুরেন্টে ড্রিংকসের সাথে তাপাস এমনি দেয়া হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর আমাদের অর্ডার আসল। পাইয়া খেয়ে আমাদের সবার ভালই লাগল। হোটেলের লোকজন লোরকার প্রতি আমাদের আগ্রহ দেখে খুব খুশি হলো। তারা বলল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন আসে লোরকার স্মৃতি-বিজড়িত এ স্থানটি দেখতে। রাত দশটায়ও রেস্টুরেন্টটি কানায় কানায় পূর্ণ।
গ্রানাদার পার্কে, প্লাজায়, সড়কের পাশে প্রতিদিন দেখি কমলা গাছের সারি। অনেকদিন ভেবেছি একটি কমলা নেব স্মৃতি হিসেবে রাখার জন্য, কিন্তু ইতস্তত করেছি। রেস্টোরেন্টে চিকিতো-র সামনেই দেখি গাছজুড়ে ঝুলে আছে থোকা থোকা পাকা কমলা। হাত বাড়িয়ে একটি কমলা ছিড়ে নিলাম। তা দেখেই নাবিল ও নাতাশা বলল, বাবা, ইটস নট ফেয়ার। তুমি কমলা ছিঁড়তে পার না। আমি বললাম, দেখ, এখানে হাজার হাজার কমলা। একটি কমলা ছিঁড়লে কী আসে যায়? ওরা বলল, এটি এখানকার নিয়ম, কেউ এসব ফল ছিঁড়তে পারেনা। আমি দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, এসব ফল গাছেই বেশি সুন্দর।
নাতাশা গুগলে বের করল, কাছের এসেরা দেল ক্যাসিনো রাস্তাতে, ১৭ নাম্বারে, রয়েছে বিখ্যাত বেকারী ও পেস্ট্রি শপ পুয়ের্তা বারনিনা। নতুন নতুন কেক ও পেস্ট্রির স্বাদ নেয়া তার বড় শখ। এখানে এসে দেখলাম হরেক রকমের কেক ও পেস্ট্রি- অনেকগুলি দেখতে চেনা চেনা লাগে, নাম শুধু ভিন্ন। আর অনেকগুলি সম্পূর্ণ নতুন। আমাদের আগ্রহ, এখানকার বিশেষ কিছুর স্বাদ পরীক্ষা করে দেখা। নাতাশা গুগলে আগেই দেখে নিয়েছে- পিওননো, গ্রানাডার ঐতিহ্যবাহী ছোট পেস্ট্রি, যা ১৮৯৭ সাল থেকে তৈরী হয়ে আসছে। আর একটি স্পেনের উত্তর-পশ্চিম এলাকা গ্যালিসিয়ায় মধ্যযুগ থেকে তৈরি হয়ে আসছে- মূলত ‘পাই’- তারতা দে সান্টিয়াগো। আমরা দু’টিই অর্ডার দিলাম। কেক, পেস্ট্রি ও কফির ঘ্রাণে পুরো এলাকা ভরে আছে। তার সাথে মিশে যাচ্ছে কারো মিষ্টি পারফিউমের সুগন্ধ। এর মধ্যেই চলে আসল আমাদের পেস্ট্রি ও পাই। সবাই মজা করে খেয়ে সোডা হাতে বের হয়ে গেলাম। স্পেনীয় পেস্ট্রির স্বাদ পেয়ে নাতাশা খুবই খুশি হয়ে আছে।
হোটেলে ফিরে সবাই বসলাম কালকের পরিকল্পনায়। আমার মনে অনেকদিন ধরে গেঁথে আছে আরনেস্ট হেমিংওয়ে লিখিত উপন্যাস ‘The Sun Also Rises’, যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে পিরেনিস পর্বতমালার পাদদেশে স্পেনের পেমপ্লোনা শহরে অনুষ্ঠিত সান ফারমিন ফেস্টিভাল। এর অংশ হচ্ছে এনসিয়ারো (ষাঁড়দের দৌড়), করিডাস (ষাঁড়ের লড়াই), নাচ-গান-বাদ্য-বাজনা-পানাহার তো আছেই। বুলফাইট বা ষাঁড়ের লড়াই স্পেনীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক বিশিষ্ট অংশ। এটি না দেখে স্পেন দেখা অসম্পূর্ণ থাকবে। তাই আমি প্রস্তাব দিলাম একদিন ষাঁড়ের লড়াই দেখতে যাব। নাবিল ও নাতাশা দু’জনেই একসাথে বলে উঠল, ইটস এ ক্রুয়েল গেম। ইট শুড বি ব্যানড। ভেবে দেখলাম তাদের কথায় যুক্তি আছে, তাই এটি শিরোধার্য। আমার ষাঁড়ের লড়াই দেখার স্বপ্ন অপূর্ণই থাকল।
পরে জানলাম, এখন বুলফাইট সিজন -, মার্চ থেকে অক্টোবর হলো সিজন। তবে স্পেনের বিভিন্ন শহরে বুলফাইট মিউজিয়ম আছে, সেখানে যাওয়া যেত। তবে নাবিল ও নাতাশার মনোভাব দেখে তার আর সাহস হলো না।
হোটেলে ফিরে ডিনারের পর আমাদের নিয়মিত মিটিং হলো; চিরাচরিত আলোচ্য বিষয়- আজকের অভিজ্ঞতা ও কালকের পরিকল্পনা। আমাদের ট্যুর গাইড নাতাশা কিছুক্ষণ তার ফোনে সার্চ করে খুঁজে পেল এক গন্তব্য- সমুদ্র সৈকত পুয়ের্তা দেল মার- গ্রানাদা শহর থেকে পৌঁছতে লাগবে ১ ঘণ্টা, ধরে যেতে হবে এ-৪৪ হাইওয়ে। গ্রানাডার কাছের সিয়ারা নেভাদা, সবুজ উপত্যকা, জলপাই বাগান দেখে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম ভূমধ্যসাগর এখান থেকে বেশি দূরে -। আমি নাতাশাকে বললাম, দেখ, এভাবে দু’চার ঘণ্টার জন্য সমুদ্র সৈকত দেখে ভাল লাগবে না। বরং পরে আমরা আরো বড়, আরো বিখ্যাত সমুদ্র সৈকতে যাব, রাতে সেখানে থাকব। নাতাশা বলল, জায়গাটির নাম কী? আমি বললাম, মালাগা। সে মেনে নিল।
মালাগার সমুদ্র সৈকতের আলাপ করতে করতে, তার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।
Ref:
১. Café cantante, কাফে ক্যাবারেট, অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ
২. Mariana Pineda,মারিয়ানা পিনাদা