বাসার তাসাউফ
কাজী নজরুল ইসলাম প্রতিকৃতি : এম. এ কুদ্দুস
দু-পাশে কড়াই ও মেহগনি গাছের সারি, মাঝখানে ঘন-কালো পিচঢালা পথ। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের সোনালি আলো ও ছায়া। এমন আলো-ছায়া ও মায়াময় পথ ধরে এগিয়ে চলেছি তীর্থে। তীর্থে মানে- কবিতীর্থে। সময়টা মধ্যাহ্ন। জ্যৈষ্ঠের সূর্যতাপ আগুনের ফুলকির মতো এসে শরীরের বিঁধছে যেন। কিন্তু তাতে আমাদের কোনও খেয়াল নেই। আমরা উদ্গ্রিব, কৌতূহলী ও উচ্ছ্বাসী চিত্তে ছুটে চলেছি সিনএজিতে চড়ে।
কোম্পানীগঞ্জ থেকে উত্তর দিকে নবীনগর রোডের পূর্বপাশে দৌলতপুর গ্রাম। আদতে নার্গিসের গ্রাম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমনের কারণে গ্রামের আগে যোগ হয়েছে কবিতীর্থ। সিএনজিতে চড়ে কয়েক কিলোমিটার পথ চলার পর এই কবিতীর্থ দৌলতপুরে পৌঁছালাম।
কবিতীর্থে প্রবেশের শুরুতেই আছে দুটো তোরণ। পথের দুধারে নির্মিত এই তোরণদ্বয়ের নাম রাখা হয়েছে কবি নজরুল তোরণ। তোরণ দুটোর সামনে বিখ্যাত কিছু কবিতার চরণ খোদাই করে লিখে রাখা আছে-
‘নার্গিস! নার্গিস!
কেন ফুটলে আমার
ফুল-বাগিচায়
আনলে মদির সূরভি
কেন গাইলে গজল শিরীন-সুর
কাঁদলো সাঁঝের পূরবি।’
তোরণ পেরিয়ে গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছি যখন মনের আয়নায় ভেসে উঠছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঝাঁকরা চুলের’ মুখচ্ছবিটা। মনে হলো, কবি নজরুল এই গ্রামে এসে বৃক্ষের সবুজে যে দোল দিয়েছিলেন, পাখির কণ্ঠে যে গানের সুর তুলে দিয়েছিলেন, সেই দোল এখনও ললিত ছন্দে দোল খাচ্ছে, গ্রামীণ অকৃপণ প্রকৃতি আর অনাবরণ সৌন্দর্যের মধ্যে আরণ্যক আদিম সুরে এখনও কোকিল, ঘুঘু, পাপিয়ার কণ্ঠে রুদ্র-মধুর ঐকতান বেজে চলেছে।
মূল সড়ক থেকে গ্রামের ভেতরের এই পথটা সদ্য ইট-পাথ-সুরকিতে পাকা করা হয়েছে। পথ ধরে কিছুক্ষণ চলার পর হাতের ডান দিকে একটা বিশাল মাঠ দেখা গেল। শুধু মাঠ না, পাকা একটা মঞ্চও দেখতে পেলাম মাঠের এক পাশে। মঞ্চের সামনের দেয়ালে টাইলসে খোদাই করে ‘নজরুল মঞ্চ’ লেখা দেখে ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি থামাতে। গাড়ি থেকে নেমে মাঠের মাঝখান দিয়ে হেঁটে নজরুল মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রতি বছর ১১ই জ্যৈষ্ঠ নজরুলের জন্মদিনে এই মাঠেই মেলা হয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় এই মঞ্চে।
মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে স্মৃতি ধরে রাখতে ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ উত্তর দিকে- রাস্তার অপর প্রান্তে চোখ যেতেই আনন্দে উদ্বেল হলাম আলী আকবর খানের সেই বিখ্যাত দোতলা বাড়িটি দেখে। এতক্ষণ ধরে মনে মনে এই বাড়িটাই খুঁজছিলাম। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল, ২৩ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দে এই বাড়িতেই কাজী নজরুল ইসলাম এসে উঠেছিলেন। এই বাড়িতেই নজরুল-নার্গিসের বিয়ে ও বাসর রাত হয়েছিল উদ্যাপিত। সেটা ছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন মোতাবেক ১৩২৮ সনের ৩ আষাঢ়, শুক্রবার। কিন্তু আজীবন পরাধীনতা বিরুদ্ধে গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লেখা মানুষটা কোনও নারীর কারণে পরাধীনতার শেকলে বাঁধা পড়তে চাননি বলে বিয়ের রাতেই দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লার কান্দিরপাড় চলে গিয়েছিলেন। যাবার আগে কুমিল্লা থেকে নার্গিসের মামা আলী আকবর খানকে ‘বাবা শ্বশুর’ সম্বোধন করে তিনি চিঠি লিখেছিলেন, ‘বাবা শ্বশুর! আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার ক’রে এ’সে যা কিছু কসুুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে...। ...আমি সাধ ক’রে পথের ভিখারী সেজেছি ব’লে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র-আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙে দিয়েছে...।’
কাজী নজরুল ইসলাম যখন আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুর এসেছিলেন তখন কি তিনি ঘুনাক্ষরেও ভেবেছিলেন পাড়া-গাঁয়ের এই অখ্যাত গ্রামটিতে তার জীবনে একসঙ্গে সবচেয়ে আনন্দময় ও বেদনাময় ঘটনা ঘটবে? তিনি দৌলতপুর এসেছিলেন মূূলত আলী আকবর খানের সঙ্গে বেড়াতে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নজরুল পাকিস্তানের করাচিতে থাকতেন। তখন আলী আকবর খানও থাকতেন সেখানে।আলী আকবর খান ছিলেন ক্যাপটেন আর নজরুল ছিলেন হাবিলদার। সেই সূত্রে তাদের পরিচয় হয়েছিল। শুধু পরিচয় হয়েই থেমে থাকেনি। দুজনের মাঝে হƒদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। অবশ্য স্কুলের পাঠ্যপুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সাহিত্য সমিতির বাড়িতেই। নজরুল তার পাঠ্যপুস্তকের জন্য ‘লিচু চোর’ এবং আরও অনেক কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। আলী আকবর খান নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নিজের গ্রামের বাড়ি দৌলতপুরে আসতে। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে সাড়া দিলেও নজরুল সরাসরি দৌলতপুরে আসেননি। প্রথমে এসেছিলেন কুমিল্লা শহরে। এখানে আসার পথে চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনে বসে তিনি ‘নীলপরী’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
ঐ সর্ষে ফুলে লুটালো কার হলুদ-রাঙা উত্তরী।
উত্তরী-বায় গো-
ঐ আকাশ-গাঙে পাল তুলে যায় নীল সে পরীর দূর-তরী॥
তার অবুঝ বীণার সবুজ সুরে
মাঠের নাটে পুলক পুরে,
ঐ গহন বনের পথটি ঘু’রে- আসছে দূরে কচিপাতা দূত্ ওরি॥
মাঠ-ঘাট তার উদাস চাওয়ায় হুতাশ কাঁদে গগন মগন
বেণুর বনে কাঁপ্?চে গো তার দীঘল শ্বাসের রেশটি সঘন॥
তার বেতস-লতায় লুটায় তনু
দিগ্বিলয়ে ভুরুর ধনু,
সে পাকা ধানের হীরক-রেণু
নীল নলিনীর নীলিম-অণু-মেখেছে মুখ-বুক্-ভরি॥
(ছায়ানট)
কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে এসে আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুল ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে উঠেছিলেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত আর আলী আকবর খান একসঙ্গে কুমিল্লা জেলা স্কুলে পড়ার সুবাধে সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। সেই কারণে আগে থেকেই ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে যাতায়াত ছিল আলী আকবর খানের। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী বিরাজসুন্দরী দেবী বেশ মমতাময়ী নারী ছিলেন। আলী আকবর খান তাকে মা ডাকতেন। তাই নজরুলও তাকে মা ডেকেছিলেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বড় ভাইয়ের স্ত্রীর গিরিবালা দেবীর একমাত্র মেয়ের নাম আশলতা বা প্রমীলা- যাকে পরবর্তীতে কাজী নজরুল ইসলাম বিয়ে করেছিলেন।
কান্দিরপাড়ে দুই দিন থাকার পর ৬ এপ্রিল, ২৩ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দে আলী আকবর খানের সঙ্গে এসেছিলেন দৌলতপুরে। এখানে কবির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কিছু সময় কেটেছিল। এখানকার নারীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা তার বিদ্রোহী মানসপটে প্রেমিক কবির বিমূর্ত ছবি এঁেক দিয়েছিল। কুমিল্লায় ও দৌলতপুরে না এলে নজরুলের কবিজীবন ও প্রেমিকজীবন হয়তো পরিপূর্ণ হতো না। দৌলতপুর আসার কারণে নজরুলের জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, তার সাহিত্য চর্চায় যোগ হয়েছিল নতুন মাত্রা। এখানে এসেই বিদ্রোহী কবি হয়ে উঠেছিলেন প্রেমের কবি। এই গ্রামের সৈয়দা খাতুন (কবির দেওয়া নাম নার্গিস) নামের এক তরুণী তার জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।
আলী আকবর খানের ভাগনী সৈয়দা খাতুন বা নার্গিস আরা খানমের সঙ্গে কবি নজরুলের প্রথম দেখা হয়েছিল খান বাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। নার্গিসের বাড়ির ছিল আলী আকবর খানের পাশের বাড়িতেই। বাল্যকালে নার্গিসের বাবা-মা মারা গিয়েছিল। তাই সে বেশিরভাগ সময় মামার বাড়িতে থাকত। নার্গিসকে প্রথম দেখার পরই বিদ্রোহী কবির মাঝে যে প্রেমিক কবি হয়ে উঠেছিলেন তার নিদর্শন পাওয়া যায় কবির বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে। কবি লিখেছেন- ‘এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে হয়নি...।’
নজরুলের চিঠি পেয়ে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন, ‘তোর বয়েস আমাদের চেয়ে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, ফিলিংস-এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশি। কাজেই ভয় হয় যে, হয়তো বা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়।’
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের এ আশংকা পরবর্তীতে বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। নজরুল যে নার্গিসকে বিয়ে করতে যাচ্ছে এ সংবাদ সংবলিত পত্র পেয়ে মুজফ্ফর আহমেদ, আব্দুল গফুর আলী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীও এ রকম আশংকা করেছিলেন।
নজরুল-নার্গিসের বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ৩ রা আষাঢ় ১৩২৮ বঙ্গাব্দ। বিয়ে উপলক্ষে আলী আকবর খান একটি নিমন্ত্রণপত্র ছেপে বিভিন্ন জায়গায় প্রেরণ করেছিলেন। নিমন্ত্রণপত্রটি ছিল এ রকম :
বিনয় সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন-
‘জগতের পুরোহিত তুমি, তোমার এ জগৎ মাঝারে,
এক চায় একেরে পাইতে, দুই চায় এক হইবারে।’
রবীন্দ্রনাথ
এ বিশ^ নিখিলের সকল শুভ কাজে যাঁর প্রসন্ন কল্যাণ আঁখি অনিমিখ হয়ে জেগে রয়েছে...তাঁর ঐ মহাকাশের মহাসিংহাসনের নীচে আমার মাথা নত করে আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে, আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নী নার্গিস আসার খানমের বিয়ে বর্ধমান জেলার ইতিহাস-প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশবিখ্যাত পরমপুরুষ, আভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলভী কাজী ফকির আহ্মদ সাহেবেরদেশবিশ্রুত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’ কবি সৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের সাথে।
...আমার এ গৌরব, আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে আনন্দ করে আমার এ কুটিরখানি পূর্ণ আনন্দ দিয়ে ভরাট করে তুলুন, তাই এ আমন্ত্রণ।... বিয়ের দিন আগামী ৩রা আষাঢ়, শুক্রবার নিশীথ রাতে।
- আরজ
বিনীত
আলী আকবর খান
দৌলতপুর, ত্রিপুরা
২৮ শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৮ বাং
নজরুলের বিয়েতে আলী আকবর খান কুমিল্লা থেকে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পরিবারের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন। সব আয়োজন ঠিকঠাক হলেও নজরুলের বিয়ে হয়নি। এ বিষয়ে রফিকুল ইসলামের লেখা ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃজন’ বইয়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় কাজী ‘নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ের সূত্র উল্লেখ করেন, ‘কোনো কোনো লেখক অবশ্য প্রমাণ করতে চেয়েছেন, নজরুল ও নার্গিসের বিবাহ যথারীতি সম্পন্ন হয়েছিল, কিন্তু আসল কথা এই যে নজরুল বিয়ের রাতেই দৌলতপুর ছেড়ে পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় চলে গিয়েছিলেন এবং আর কোনো দিন নার্গিসকে গ্রহণ করেননি।’
নজরুল কী কারণে প্রেয়সী নার্গিসকে ফেলে অমন করে চলে গিয়েছিলেন? ড. মাহবুবুল হকের ‘নজরুল তারিখ অভিধান’ বইয়ের ৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘১৭ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ বা ৩ রা আষাঢ় ১৩২৮ বঙ্গাব্দ শুক্রবার দিবাগত গভীর রাতে নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের আক্দ (বিয়েতে বর ও কনের সম্মতিসূচক চুক্তি অনুষ্ঠান) হয়। আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন নার্গিসের বড় ভাই আব্দুল জব্বার মুনশি। নার্গিসের পক্ষে উকিল ছিলেন নার্গিসের বড় মামা আলতাফ আলী খান। নজরুলের আত্মীয় বর্গ কেউই আক্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। কলকাতা থেকেও তাঁর কোনো বন্ধু বিয়েতে উপস্থি হয়নি।... নজরুলের পক্ষে সাক্ষী হন সাদাত আলী মাস্টার এবং নার্গিসের পক্ষে সাক্ষী হন সৈয়দ আলী মাস্টার। বিয়েতে দেনমোহর ধার্য করা হয়েছিল পঁচিশ হাজার টাকা। বিয়ের কাবিন নামায় অন্যতম শর্ত ছিল নজরুল নার্গিসকে দৌলতপুর ছেড়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। আলী আকবর খানের জবরদস্তিমূলক অন্যায় বৈবাহিক শর্তে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুল কনেকে গ্রহণ না করে ভোর হওয়ার আগেই চিরদিনের জন্য দৌলতপুর ছেড়ে আসেন এবং বীরেন্দ্রের সঙ্গে হেঁটে কুমিল্লায় পৌঁছেন। নার্গিসের মামা আলী আকবরের চালিয়াতি ও বাড়াবাড়িতে বিয়ে ভেঙে গেলেও এর জন্য নজরুল কখনই নার্গিসকে দায়ী করেননি।’
নজরুল চলে যাওয়ার পর নার্গিস সুদীর্ঘ ষোলো বছর তার অপেক্ষায় ছিলেন। তারপর তিনি আজিজুল হাকিম নামের একজন অখ্যাত কবিকে বিয়ে করেছিলেন। আজিজুল হাকিম ও সৈয়দা খাতুনের (নার্গিস) সংসারে দুটি সন্তান হয়েছিল। তারা দুজন ইংল্যান্ডে থাকে এখন। নার্গিসের বর্তমান বাড়িতে এসে তারই ভাইয়ের ছেলে আব্দুর রউফ মুন্সির কাছ থেকে এসব কথা জেনেছি।
দৌলতপুরে নার্গিসের বসত বাড়িটা এখন আর নেই। তবে আলী আকবর খানের সেই বাড়িটা আছে। রাজ প্রাসাদের মতো কারুকার্যময় দ্বিতল ভবন। বাড়িটার সামনে আছে পুরনো আমালের একটা পুকুর। এই পুকুরেই নজরুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতেন। একবার পুকুরে নামলে উঠবার নামও নিতেন না। সাবানের পর সাবান মেখে ফেনা তুলে পুকুরের ফেনিল জলে ছোট শিশুদের সঙ্গে লাই খেলতেন। ডুব দিয়ে তাদের কলের গান শোনাতেন।
আলী আকবর খানের এক বোন ছিল, নাম ইফতেখারুন্নেছা। নজরুল তাকে মা ডাকতেন। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটা আমগাছ ছিল। সেটা এখন নেই। ইফতেখারুন্নেছা এই আমগাছের তলায় খাবার নিয়ে এসে নজরুলকে ডাকতেন ‘আয় নুরু, খেতে আয়!’
তখন নজরুল ভদ্র ছেলের মতো গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন। এই আম গাছের নিচে বসেই নজরুল রাত দুপুরে মনভোলানো উদাস সুরে বাঁশি বাজাতেন। দুপুরে শীতল পাটিতে বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন। আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙা, কামিনী, কাঁঠাল গাছের সারি। এখানে তিনি খান বাড়ি ও দৌলতপুর গ্রামের ছেলে-মেয়েদের নাচ, গান, বাদ্য শেখাতেন। যদিও গাছগুলো এখন আর নেই। কয়েক বছর আগে মারা গেছে। তবে আম গাছের গোড়া এখনো পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছটা ছাড়াও তখন খান বাড়িতে বারোটা কামরাঙা গাছ ছিল। কবির শোবার ঘরের সামনে ছিল একটি কামরাঙা গাছ, যা তার অনেক কবিতা গানে, হাসি-কান্না, মান অভিমান এবং মিলন-বিরহের নীরব ?সাক্ষী। এই গাছকে নিয়েই তিনি লিখেছেন-
‘কামরাঙা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে
ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের
তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে
হায় কে দেবে দাম...।’
কাজী নজরুল মাঝেমধ্যে দুপুরবেলায় এই গাছের শীতল ছায়ায় বসে আপন মনে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন। সেই গাছটা এখনো আছে। নজরুল স্মৃতি ধরে রাখতে গাছটাতে ফলক বানানো হয়েছে। নজরুল যখন বিকেল বেলায় এই গাছের ছায়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে কবিতা ও গান লিখতেন তখন নানা কাজের ছলে এখানে ছুটে আসতেন নার্গিস। আর তখনই নজরুল-নার্র্গিসের মন দেয়া নেয়া ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম ৭৩ দিন ছিলেন দৌলতপুরে। সেই সময়ে তিনি ১৬০টা গান ও ১২০টা কবিতা লিখেছিলেন। ‘পাঁপড়িখোলা’ নামের বিখ্যাত কবিতাটাও লিখেছিলেন এখানে বসে। এছাড়াও ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায়-বেলায়’, ‘হারমানা-হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক প্রিয়া’ কবিতাগুলো লিখেছিলেন।
রাতে বাজাতেন বাঁশি আর দিনের বেলা পুকুরের শান্ত জলে নেমে খেলতেন জলকেলি। গ্রামের বউ-ঝিয়েরা কলসি ভরতে পুকুরে এলে তিনি তাদের সঙ্গে ছেলেমানুষি করতেন। এজন্য নজরুল ঘুম থেকে ওঠার আগেই কলসি ভরে নিত গ্রামের মেয়েরা। আলী আকবর খানের বাড়িতে এসে তারই নাতি শাকিল আলী খানের কাছ থেকে এসব কথা জেনে নিয়ে মানসচক্ষে কবিকে অবলোকন করতে করতে বাড়ি ফিরে এসেছি।
তথ্যসূত্র :
নজরুল তারিখ অভিধান, লেখক ড. মাহবুবুল হক (কথাপ্রকাশ সংস্করণ জুন ২০১৯)
কাজী নজরুল ইসলাম : সৃজন ও জীবন, লেখক রফিকুল ইসলাম (কবি নজরুল ইনস্টিউিট)
নজরুল জীবনী, লেখক অরুণকুমার বসু (প্রথম আনন্দ সংস্করণ ২০১৫)
নজরুল অজনা কথা, লেখক জিয়াদ আলী (মাওলা ব্রাদার্স ২০০২)
সরেজমিনে দৌলতপুর গ্রামে গমন করে, সেই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রইফ মুন্সী ও শাকিল আলি খানের মুখ থেকে শোনা।
বাসার তাসাউফ
কাজী নজরুল ইসলাম প্রতিকৃতি : এম. এ কুদ্দুস
বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫
দু-পাশে কড়াই ও মেহগনি গাছের সারি, মাঝখানে ঘন-কালো পিচঢালা পথ। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের সোনালি আলো ও ছায়া। এমন আলো-ছায়া ও মায়াময় পথ ধরে এগিয়ে চলেছি তীর্থে। তীর্থে মানে- কবিতীর্থে। সময়টা মধ্যাহ্ন। জ্যৈষ্ঠের সূর্যতাপ আগুনের ফুলকির মতো এসে শরীরের বিঁধছে যেন। কিন্তু তাতে আমাদের কোনও খেয়াল নেই। আমরা উদ্গ্রিব, কৌতূহলী ও উচ্ছ্বাসী চিত্তে ছুটে চলেছি সিনএজিতে চড়ে।
কোম্পানীগঞ্জ থেকে উত্তর দিকে নবীনগর রোডের পূর্বপাশে দৌলতপুর গ্রাম। আদতে নার্গিসের গ্রাম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমনের কারণে গ্রামের আগে যোগ হয়েছে কবিতীর্থ। সিএনজিতে চড়ে কয়েক কিলোমিটার পথ চলার পর এই কবিতীর্থ দৌলতপুরে পৌঁছালাম।
কবিতীর্থে প্রবেশের শুরুতেই আছে দুটো তোরণ। পথের দুধারে নির্মিত এই তোরণদ্বয়ের নাম রাখা হয়েছে কবি নজরুল তোরণ। তোরণ দুটোর সামনে বিখ্যাত কিছু কবিতার চরণ খোদাই করে লিখে রাখা আছে-
‘নার্গিস! নার্গিস!
কেন ফুটলে আমার
ফুল-বাগিচায়
আনলে মদির সূরভি
কেন গাইলে গজল শিরীন-সুর
কাঁদলো সাঁঝের পূরবি।’
তোরণ পেরিয়ে গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছি যখন মনের আয়নায় ভেসে উঠছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঝাঁকরা চুলের’ মুখচ্ছবিটা। মনে হলো, কবি নজরুল এই গ্রামে এসে বৃক্ষের সবুজে যে দোল দিয়েছিলেন, পাখির কণ্ঠে যে গানের সুর তুলে দিয়েছিলেন, সেই দোল এখনও ললিত ছন্দে দোল খাচ্ছে, গ্রামীণ অকৃপণ প্রকৃতি আর অনাবরণ সৌন্দর্যের মধ্যে আরণ্যক আদিম সুরে এখনও কোকিল, ঘুঘু, পাপিয়ার কণ্ঠে রুদ্র-মধুর ঐকতান বেজে চলেছে।
মূল সড়ক থেকে গ্রামের ভেতরের এই পথটা সদ্য ইট-পাথ-সুরকিতে পাকা করা হয়েছে। পথ ধরে কিছুক্ষণ চলার পর হাতের ডান দিকে একটা বিশাল মাঠ দেখা গেল। শুধু মাঠ না, পাকা একটা মঞ্চও দেখতে পেলাম মাঠের এক পাশে। মঞ্চের সামনের দেয়ালে টাইলসে খোদাই করে ‘নজরুল মঞ্চ’ লেখা দেখে ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি থামাতে। গাড়ি থেকে নেমে মাঠের মাঝখান দিয়ে হেঁটে নজরুল মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রতি বছর ১১ই জ্যৈষ্ঠ নজরুলের জন্মদিনে এই মাঠেই মেলা হয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় এই মঞ্চে।
মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে স্মৃতি ধরে রাখতে ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ উত্তর দিকে- রাস্তার অপর প্রান্তে চোখ যেতেই আনন্দে উদ্বেল হলাম আলী আকবর খানের সেই বিখ্যাত দোতলা বাড়িটি দেখে। এতক্ষণ ধরে মনে মনে এই বাড়িটাই খুঁজছিলাম। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল, ২৩ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দে এই বাড়িতেই কাজী নজরুল ইসলাম এসে উঠেছিলেন। এই বাড়িতেই নজরুল-নার্গিসের বিয়ে ও বাসর রাত হয়েছিল উদ্যাপিত। সেটা ছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন মোতাবেক ১৩২৮ সনের ৩ আষাঢ়, শুক্রবার। কিন্তু আজীবন পরাধীনতা বিরুদ্ধে গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লেখা মানুষটা কোনও নারীর কারণে পরাধীনতার শেকলে বাঁধা পড়তে চাননি বলে বিয়ের রাতেই দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লার কান্দিরপাড় চলে গিয়েছিলেন। যাবার আগে কুমিল্লা থেকে নার্গিসের মামা আলী আকবর খানকে ‘বাবা শ্বশুর’ সম্বোধন করে তিনি চিঠি লিখেছিলেন, ‘বাবা শ্বশুর! আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার ক’রে এ’সে যা কিছু কসুুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে...। ...আমি সাধ ক’রে পথের ভিখারী সেজেছি ব’লে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র-আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙে দিয়েছে...।’
কাজী নজরুল ইসলাম যখন আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুর এসেছিলেন তখন কি তিনি ঘুনাক্ষরেও ভেবেছিলেন পাড়া-গাঁয়ের এই অখ্যাত গ্রামটিতে তার জীবনে একসঙ্গে সবচেয়ে আনন্দময় ও বেদনাময় ঘটনা ঘটবে? তিনি দৌলতপুর এসেছিলেন মূূলত আলী আকবর খানের সঙ্গে বেড়াতে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নজরুল পাকিস্তানের করাচিতে থাকতেন। তখন আলী আকবর খানও থাকতেন সেখানে।আলী আকবর খান ছিলেন ক্যাপটেন আর নজরুল ছিলেন হাবিলদার। সেই সূত্রে তাদের পরিচয় হয়েছিল। শুধু পরিচয় হয়েই থেমে থাকেনি। দুজনের মাঝে হƒদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। অবশ্য স্কুলের পাঠ্যপুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সাহিত্য সমিতির বাড়িতেই। নজরুল তার পাঠ্যপুস্তকের জন্য ‘লিচু চোর’ এবং আরও অনেক কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। আলী আকবর খান নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নিজের গ্রামের বাড়ি দৌলতপুরে আসতে। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে সাড়া দিলেও নজরুল সরাসরি দৌলতপুরে আসেননি। প্রথমে এসেছিলেন কুমিল্লা শহরে। এখানে আসার পথে চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনে বসে তিনি ‘নীলপরী’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
ঐ সর্ষে ফুলে লুটালো কার হলুদ-রাঙা উত্তরী।
উত্তরী-বায় গো-
ঐ আকাশ-গাঙে পাল তুলে যায় নীল সে পরীর দূর-তরী॥
তার অবুঝ বীণার সবুজ সুরে
মাঠের নাটে পুলক পুরে,
ঐ গহন বনের পথটি ঘু’রে- আসছে দূরে কচিপাতা দূত্ ওরি॥
মাঠ-ঘাট তার উদাস চাওয়ায় হুতাশ কাঁদে গগন মগন
বেণুর বনে কাঁপ্?চে গো তার দীঘল শ্বাসের রেশটি সঘন॥
তার বেতস-লতায় লুটায় তনু
দিগ্বিলয়ে ভুরুর ধনু,
সে পাকা ধানের হীরক-রেণু
নীল নলিনীর নীলিম-অণু-মেখেছে মুখ-বুক্-ভরি॥
(ছায়ানট)
কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে এসে আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুল ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে উঠেছিলেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত আর আলী আকবর খান একসঙ্গে কুমিল্লা জেলা স্কুলে পড়ার সুবাধে সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। সেই কারণে আগে থেকেই ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে যাতায়াত ছিল আলী আকবর খানের। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী বিরাজসুন্দরী দেবী বেশ মমতাময়ী নারী ছিলেন। আলী আকবর খান তাকে মা ডাকতেন। তাই নজরুলও তাকে মা ডেকেছিলেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বড় ভাইয়ের স্ত্রীর গিরিবালা দেবীর একমাত্র মেয়ের নাম আশলতা বা প্রমীলা- যাকে পরবর্তীতে কাজী নজরুল ইসলাম বিয়ে করেছিলেন।
কান্দিরপাড়ে দুই দিন থাকার পর ৬ এপ্রিল, ২৩ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দে আলী আকবর খানের সঙ্গে এসেছিলেন দৌলতপুরে। এখানে কবির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কিছু সময় কেটেছিল। এখানকার নারীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা তার বিদ্রোহী মানসপটে প্রেমিক কবির বিমূর্ত ছবি এঁেক দিয়েছিল। কুমিল্লায় ও দৌলতপুরে না এলে নজরুলের কবিজীবন ও প্রেমিকজীবন হয়তো পরিপূর্ণ হতো না। দৌলতপুর আসার কারণে নজরুলের জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, তার সাহিত্য চর্চায় যোগ হয়েছিল নতুন মাত্রা। এখানে এসেই বিদ্রোহী কবি হয়ে উঠেছিলেন প্রেমের কবি। এই গ্রামের সৈয়দা খাতুন (কবির দেওয়া নাম নার্গিস) নামের এক তরুণী তার জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।
আলী আকবর খানের ভাগনী সৈয়দা খাতুন বা নার্গিস আরা খানমের সঙ্গে কবি নজরুলের প্রথম দেখা হয়েছিল খান বাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। নার্গিসের বাড়ির ছিল আলী আকবর খানের পাশের বাড়িতেই। বাল্যকালে নার্গিসের বাবা-মা মারা গিয়েছিল। তাই সে বেশিরভাগ সময় মামার বাড়িতে থাকত। নার্গিসকে প্রথম দেখার পরই বিদ্রোহী কবির মাঝে যে প্রেমিক কবি হয়ে উঠেছিলেন তার নিদর্শন পাওয়া যায় কবির বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে। কবি লিখেছেন- ‘এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে হয়নি...।’
নজরুলের চিঠি পেয়ে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন, ‘তোর বয়েস আমাদের চেয়ে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, ফিলিংস-এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশি। কাজেই ভয় হয় যে, হয়তো বা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়।’
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের এ আশংকা পরবর্তীতে বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। নজরুল যে নার্গিসকে বিয়ে করতে যাচ্ছে এ সংবাদ সংবলিত পত্র পেয়ে মুজফ্ফর আহমেদ, আব্দুল গফুর আলী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীও এ রকম আশংকা করেছিলেন।
নজরুল-নার্গিসের বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ৩ রা আষাঢ় ১৩২৮ বঙ্গাব্দ। বিয়ে উপলক্ষে আলী আকবর খান একটি নিমন্ত্রণপত্র ছেপে বিভিন্ন জায়গায় প্রেরণ করেছিলেন। নিমন্ত্রণপত্রটি ছিল এ রকম :
বিনয় সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন-
‘জগতের পুরোহিত তুমি, তোমার এ জগৎ মাঝারে,
এক চায় একেরে পাইতে, দুই চায় এক হইবারে।’
রবীন্দ্রনাথ
এ বিশ^ নিখিলের সকল শুভ কাজে যাঁর প্রসন্ন কল্যাণ আঁখি অনিমিখ হয়ে জেগে রয়েছে...তাঁর ঐ মহাকাশের মহাসিংহাসনের নীচে আমার মাথা নত করে আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে, আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নী নার্গিস আসার খানমের বিয়ে বর্ধমান জেলার ইতিহাস-প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশবিখ্যাত পরমপুরুষ, আভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলভী কাজী ফকির আহ্মদ সাহেবেরদেশবিশ্রুত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’ কবি সৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের সাথে।
...আমার এ গৌরব, আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে আনন্দ করে আমার এ কুটিরখানি পূর্ণ আনন্দ দিয়ে ভরাট করে তুলুন, তাই এ আমন্ত্রণ।... বিয়ের দিন আগামী ৩রা আষাঢ়, শুক্রবার নিশীথ রাতে।
- আরজ
বিনীত
আলী আকবর খান
দৌলতপুর, ত্রিপুরা
২৮ শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৮ বাং
নজরুলের বিয়েতে আলী আকবর খান কুমিল্লা থেকে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পরিবারের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন। সব আয়োজন ঠিকঠাক হলেও নজরুলের বিয়ে হয়নি। এ বিষয়ে রফিকুল ইসলামের লেখা ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃজন’ বইয়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় কাজী ‘নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ের সূত্র উল্লেখ করেন, ‘কোনো কোনো লেখক অবশ্য প্রমাণ করতে চেয়েছেন, নজরুল ও নার্গিসের বিবাহ যথারীতি সম্পন্ন হয়েছিল, কিন্তু আসল কথা এই যে নজরুল বিয়ের রাতেই দৌলতপুর ছেড়ে পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় চলে গিয়েছিলেন এবং আর কোনো দিন নার্গিসকে গ্রহণ করেননি।’
নজরুল কী কারণে প্রেয়সী নার্গিসকে ফেলে অমন করে চলে গিয়েছিলেন? ড. মাহবুবুল হকের ‘নজরুল তারিখ অভিধান’ বইয়ের ৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘১৭ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ বা ৩ রা আষাঢ় ১৩২৮ বঙ্গাব্দ শুক্রবার দিবাগত গভীর রাতে নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের আক্দ (বিয়েতে বর ও কনের সম্মতিসূচক চুক্তি অনুষ্ঠান) হয়। আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন নার্গিসের বড় ভাই আব্দুল জব্বার মুনশি। নার্গিসের পক্ষে উকিল ছিলেন নার্গিসের বড় মামা আলতাফ আলী খান। নজরুলের আত্মীয় বর্গ কেউই আক্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। কলকাতা থেকেও তাঁর কোনো বন্ধু বিয়েতে উপস্থি হয়নি।... নজরুলের পক্ষে সাক্ষী হন সাদাত আলী মাস্টার এবং নার্গিসের পক্ষে সাক্ষী হন সৈয়দ আলী মাস্টার। বিয়েতে দেনমোহর ধার্য করা হয়েছিল পঁচিশ হাজার টাকা। বিয়ের কাবিন নামায় অন্যতম শর্ত ছিল নজরুল নার্গিসকে দৌলতপুর ছেড়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। আলী আকবর খানের জবরদস্তিমূলক অন্যায় বৈবাহিক শর্তে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুল কনেকে গ্রহণ না করে ভোর হওয়ার আগেই চিরদিনের জন্য দৌলতপুর ছেড়ে আসেন এবং বীরেন্দ্রের সঙ্গে হেঁটে কুমিল্লায় পৌঁছেন। নার্গিসের মামা আলী আকবরের চালিয়াতি ও বাড়াবাড়িতে বিয়ে ভেঙে গেলেও এর জন্য নজরুল কখনই নার্গিসকে দায়ী করেননি।’
নজরুল চলে যাওয়ার পর নার্গিস সুদীর্ঘ ষোলো বছর তার অপেক্ষায় ছিলেন। তারপর তিনি আজিজুল হাকিম নামের একজন অখ্যাত কবিকে বিয়ে করেছিলেন। আজিজুল হাকিম ও সৈয়দা খাতুনের (নার্গিস) সংসারে দুটি সন্তান হয়েছিল। তারা দুজন ইংল্যান্ডে থাকে এখন। নার্গিসের বর্তমান বাড়িতে এসে তারই ভাইয়ের ছেলে আব্দুর রউফ মুন্সির কাছ থেকে এসব কথা জেনেছি।
দৌলতপুরে নার্গিসের বসত বাড়িটা এখন আর নেই। তবে আলী আকবর খানের সেই বাড়িটা আছে। রাজ প্রাসাদের মতো কারুকার্যময় দ্বিতল ভবন। বাড়িটার সামনে আছে পুরনো আমালের একটা পুকুর। এই পুকুরেই নজরুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতেন। একবার পুকুরে নামলে উঠবার নামও নিতেন না। সাবানের পর সাবান মেখে ফেনা তুলে পুকুরের ফেনিল জলে ছোট শিশুদের সঙ্গে লাই খেলতেন। ডুব দিয়ে তাদের কলের গান শোনাতেন।
আলী আকবর খানের এক বোন ছিল, নাম ইফতেখারুন্নেছা। নজরুল তাকে মা ডাকতেন। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটা আমগাছ ছিল। সেটা এখন নেই। ইফতেখারুন্নেছা এই আমগাছের তলায় খাবার নিয়ে এসে নজরুলকে ডাকতেন ‘আয় নুরু, খেতে আয়!’
তখন নজরুল ভদ্র ছেলের মতো গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন। এই আম গাছের নিচে বসেই নজরুল রাত দুপুরে মনভোলানো উদাস সুরে বাঁশি বাজাতেন। দুপুরে শীতল পাটিতে বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন। আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙা, কামিনী, কাঁঠাল গাছের সারি। এখানে তিনি খান বাড়ি ও দৌলতপুর গ্রামের ছেলে-মেয়েদের নাচ, গান, বাদ্য শেখাতেন। যদিও গাছগুলো এখন আর নেই। কয়েক বছর আগে মারা গেছে। তবে আম গাছের গোড়া এখনো পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছটা ছাড়াও তখন খান বাড়িতে বারোটা কামরাঙা গাছ ছিল। কবির শোবার ঘরের সামনে ছিল একটি কামরাঙা গাছ, যা তার অনেক কবিতা গানে, হাসি-কান্না, মান অভিমান এবং মিলন-বিরহের নীরব ?সাক্ষী। এই গাছকে নিয়েই তিনি লিখেছেন-
‘কামরাঙা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে
ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের
তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে
হায় কে দেবে দাম...।’
কাজী নজরুল মাঝেমধ্যে দুপুরবেলায় এই গাছের শীতল ছায়ায় বসে আপন মনে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন। সেই গাছটা এখনো আছে। নজরুল স্মৃতি ধরে রাখতে গাছটাতে ফলক বানানো হয়েছে। নজরুল যখন বিকেল বেলায় এই গাছের ছায়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে কবিতা ও গান লিখতেন তখন নানা কাজের ছলে এখানে ছুটে আসতেন নার্গিস। আর তখনই নজরুল-নার্র্গিসের মন দেয়া নেয়া ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম ৭৩ দিন ছিলেন দৌলতপুরে। সেই সময়ে তিনি ১৬০টা গান ও ১২০টা কবিতা লিখেছিলেন। ‘পাঁপড়িখোলা’ নামের বিখ্যাত কবিতাটাও লিখেছিলেন এখানে বসে। এছাড়াও ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায়-বেলায়’, ‘হারমানা-হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক প্রিয়া’ কবিতাগুলো লিখেছিলেন।
রাতে বাজাতেন বাঁশি আর দিনের বেলা পুকুরের শান্ত জলে নেমে খেলতেন জলকেলি। গ্রামের বউ-ঝিয়েরা কলসি ভরতে পুকুরে এলে তিনি তাদের সঙ্গে ছেলেমানুষি করতেন। এজন্য নজরুল ঘুম থেকে ওঠার আগেই কলসি ভরে নিত গ্রামের মেয়েরা। আলী আকবর খানের বাড়িতে এসে তারই নাতি শাকিল আলী খানের কাছ থেকে এসব কথা জেনে নিয়ে মানসচক্ষে কবিকে অবলোকন করতে করতে বাড়ি ফিরে এসেছি।
তথ্যসূত্র :
নজরুল তারিখ অভিধান, লেখক ড. মাহবুবুল হক (কথাপ্রকাশ সংস্করণ জুন ২০১৯)
কাজী নজরুল ইসলাম : সৃজন ও জীবন, লেখক রফিকুল ইসলাম (কবি নজরুল ইনস্টিউিট)
নজরুল জীবনী, লেখক অরুণকুমার বসু (প্রথম আনন্দ সংস্করণ ২০১৫)
নজরুল অজনা কথা, লেখক জিয়াদ আলী (মাওলা ব্রাদার্স ২০০২)
সরেজমিনে দৌলতপুর গ্রামে গমন করে, সেই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রইফ মুন্সী ও শাকিল আলি খানের মুখ থেকে শোনা।