জামশেদ উদ্দীন
‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কবি শিহাব শাহরিয়ারের ১৭তম কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থে ৬টি পর্ব বা সিরিজে ১০৩টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘মন’ সিরিজে ৪৪টি, ‘শ্বাস’ সিরিজে ১০টি, ‘চিঠি’ সিরিজে ৫টি, ‘ঘ্রাণ’ সিরিজে ১৫টি ও ‘দ্রোহ’ সিরিজে ৬টি কবিতা রয়েছে।
শিহাব শাহরিয়ারের কবিতা প্রেম, দ্রোহ ও প্রকৃতি ছুঁয়ে যায়। ‘হারিয়ে গেছে ময়ূরাক্ষী নদী অথবা এক হওয়া সহজ কথা নয়’ কবিতায় কবি এভাবে স্ফুটিত:
‘সরিষার হলুদে হারিয়ে গেছে ময়ূরাক্ষী নদী
গেছে প্রেম, ঔষধি গাছের ঘুম
চলে গেছে, নিঃসঙ্গ মাঠের ছায়ারও
তুমিও গেছো বাতাবিলেবুর ঘ্রাণ থেকে...’
‘জাহাঙ্গীর গেটে পা পিছলে পড়ে যাবে তুমি’ কবিতায় গ্লানিকতারও ব্যবহৃত হয়। গদ্য আঙ্গিকে লেখা এসব কবিতায় বিরহ-বিচ্ছেদ ও ঘটনাবহুল জীবনরে চিত্র ফুটে ওঠে।
‘তুমি কেরোসিন+কুপি+সলতে=সন্ধ্যাবাতি
এবং দোলনা+মশারি+বাসর=নাবিকের চোখ বোঝনি
সুতরাং তুমি ব্যাকরণের ভেতরে পাণিনিকে খুঁজে পাবে না
ডেনফোর্থ থেকে অভিশাপ দিচ্ছি
জাহাঙ্গীর গেটে পা পিছনে পড়ে যাবে তুমি...’
আহা, কী যে কষ্ট! হৃদয়ের ক্ষরণ! সচরাচর উত্তর আধুনিক কবিতায় এ ধরনের প্রয়োগ দেখা যায় না। কবি এ জায়গায় সার্থকতার সাথে নতুন পথে পরিচালিত। যেমন আরেকটি কবিতায়:
‘স্কুলগামী তোমার প্রাইভেট কার
সব সময় সবুজ বাতি খোঁজে...’
‘শ্বাস’ সিরিজে, সব কয়টি কবিতা গদ্য আঙ্গিকে। ‘খোলা পথ’ শিরোনাম কবিতার কয়েকটি পংক্তি- ‘কলঙ্ক ছিল আঁচলে/ আঁচলটি উড়ে উড়ে যাচ্ছিল হেমন্তে/ হেমন্ত শুয়ে থাকে ঘুম/ ঘুমের গহ্বর পেরিয়ে আমরা ধাবমান...’। একই সিরিজে ‘খোলা ঘুম’ কবিতা- ‘চোখের পাতায় খেলা করে খোলা ঘুম/ একটি চোখ একটি পাতা একটি ঘুম বিলীন হয়’। ‘খোলা চিঠি’- ‘ও’পিঠ মুদ্রার/ ও’চোখ দোয়েলের/ ও’সবুজ বৃক্ষের/ একটি শালিক কখনো এনে দেয়নি তোমায় ও’নদীর স্বর’।
কবি শিহাব শাহরিয়ারের ‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ গ্রন্থে স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করেছেন। বাংলা কবিতার কালপুরুষ কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক বা নির্মলেন্দু গুণ-এর কাব্যভাবনাকেও ছুঁয়ে যায়। ‘চিঠি’ সিরিজও কাব্যিকতা এবং উপমার ঊর্ণাজাল- অথৈ-আদি’র চিঠি: ‘কুয়াশার এই সন্ধ্যায়- তোমাকে লিখতে গিয়ে আমার চোখেও কুয়াশাসম শাদা অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। এই চোখের জল আমার নিয়তি। আমি ভাগ্যাহত এক মেয়ে; যার দুঃখকথাও কাউকে বলার নেই...মন ভিজে! হায় মেঘ, তুমি কবে সুভলং পাহাড় স্পর্শ করবে’? শিহাবের কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ, লালন, রবীন্দ্রনাথ ও কাঙাল হরিনাথের উপস্থিতি দেখা যায়। ‘হায় মাধবী, কবিতার এই উদ্যান থেকে তুমি একদিন ছিটকে পড়লে, আমাদের বকুলতলাকে কানা করে প্রথমে আমার কানে দিলে ট্রেনের ঝিকঝিক আওয়াজ, তারপর দেখালে আটলান্টিক পাড়ি দিবার দীর্ঘ-দূর আকাশ...’। যেমন জীবনানন্দ দাশের কবিতা- ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে’! অথবা রবীন্দ্রনাথের- ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...’ অথবা ‘কাঙাল হরিনাথের- ‘হরি দিন যে গেল, সন্ধ্যা হলো / পার করো আমারে...’।
কবির ‘ঘ্রাণ’ সিরিজও অভিনব। এ পর্বে কবির মানসচিত্র ফুটে উঠেছে অন্য মাত্রায়। মানুষ যে সর্বদা স্পর্শী তাও না:
‘ব্রহ্মপুত্র-গান্ধিগাও তোমার নাকের মতো...
চলো হাতে হাতে একটি রেখা তৈরি করি-
তুমি যখনই এসে আমার সামনে বসো
আমি তোমার চোখের দিকে চোখ রাখি
কেমন করে জানি আমাদের রং এক হয়
কেমন করে জানি চোখেরা শঙ্খচিল হয়’।
‘দ্রোহ’ সিরিজেও ৭১-এর চিঠি; ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি...পূর্ণিমা দীক্ষা দাও সমতার’ -মাওলানা ভাসানী, মুজিব, ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, মাহাথির, মাদার তেরেসা, মাও, মার্কস তার কবিতার দ্রোহের ভেতর জায়গা পেয়েছে। আরেকটি কবিতা: ‘বটেশ্বর গ্রামে রোদেরা ঘুমিয়ে পড়েছে / গাভীর ওলান ধরে কাঁদছে মেয়ে শিশুরা’।
‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’কাব্যগ্রন্থটি অনন্যা প্রকাশনী থেকে ২০২৫ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়।তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে প্রবন্ধগ্রন্থ ১টি, গল্পগ্রন্থ ১টি, স্মৃতিগ্রন্থ ১টি, ফোকলোর গবেষণাগ্রন্থ ৪টি, ভ্রমণগ্রন্থ ২টি, সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ১টি ও সম্পাদিতগ্রন্থ ৩টি। ‘বৈঠা’ নামে একটি লিটলম্যাগও সম্পাদনা করেন কবি।
জামশেদ উদ্দীন
বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫
‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ কবি শিহাব শাহরিয়ারের ১৭তম কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থে ৬টি পর্ব বা সিরিজে ১০৩টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘মন’ সিরিজে ৪৪টি, ‘শ্বাস’ সিরিজে ১০টি, ‘চিঠি’ সিরিজে ৫টি, ‘ঘ্রাণ’ সিরিজে ১৫টি ও ‘দ্রোহ’ সিরিজে ৬টি কবিতা রয়েছে।
শিহাব শাহরিয়ারের কবিতা প্রেম, দ্রোহ ও প্রকৃতি ছুঁয়ে যায়। ‘হারিয়ে গেছে ময়ূরাক্ষী নদী অথবা এক হওয়া সহজ কথা নয়’ কবিতায় কবি এভাবে স্ফুটিত:
‘সরিষার হলুদে হারিয়ে গেছে ময়ূরাক্ষী নদী
গেছে প্রেম, ঔষধি গাছের ঘুম
চলে গেছে, নিঃসঙ্গ মাঠের ছায়ারও
তুমিও গেছো বাতাবিলেবুর ঘ্রাণ থেকে...’
‘জাহাঙ্গীর গেটে পা পিছলে পড়ে যাবে তুমি’ কবিতায় গ্লানিকতারও ব্যবহৃত হয়। গদ্য আঙ্গিকে লেখা এসব কবিতায় বিরহ-বিচ্ছেদ ও ঘটনাবহুল জীবনরে চিত্র ফুটে ওঠে।
‘তুমি কেরোসিন+কুপি+সলতে=সন্ধ্যাবাতি
এবং দোলনা+মশারি+বাসর=নাবিকের চোখ বোঝনি
সুতরাং তুমি ব্যাকরণের ভেতরে পাণিনিকে খুঁজে পাবে না
ডেনফোর্থ থেকে অভিশাপ দিচ্ছি
জাহাঙ্গীর গেটে পা পিছনে পড়ে যাবে তুমি...’
আহা, কী যে কষ্ট! হৃদয়ের ক্ষরণ! সচরাচর উত্তর আধুনিক কবিতায় এ ধরনের প্রয়োগ দেখা যায় না। কবি এ জায়গায় সার্থকতার সাথে নতুন পথে পরিচালিত। যেমন আরেকটি কবিতায়:
‘স্কুলগামী তোমার প্রাইভেট কার
সব সময় সবুজ বাতি খোঁজে...’
‘শ্বাস’ সিরিজে, সব কয়টি কবিতা গদ্য আঙ্গিকে। ‘খোলা পথ’ শিরোনাম কবিতার কয়েকটি পংক্তি- ‘কলঙ্ক ছিল আঁচলে/ আঁচলটি উড়ে উড়ে যাচ্ছিল হেমন্তে/ হেমন্ত শুয়ে থাকে ঘুম/ ঘুমের গহ্বর পেরিয়ে আমরা ধাবমান...’। একই সিরিজে ‘খোলা ঘুম’ কবিতা- ‘চোখের পাতায় খেলা করে খোলা ঘুম/ একটি চোখ একটি পাতা একটি ঘুম বিলীন হয়’। ‘খোলা চিঠি’- ‘ও’পিঠ মুদ্রার/ ও’চোখ দোয়েলের/ ও’সবুজ বৃক্ষের/ একটি শালিক কখনো এনে দেয়নি তোমায় ও’নদীর স্বর’।
কবি শিহাব শাহরিয়ারের ‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’ গ্রন্থে স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করেছেন। বাংলা কবিতার কালপুরুষ কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক বা নির্মলেন্দু গুণ-এর কাব্যভাবনাকেও ছুঁয়ে যায়। ‘চিঠি’ সিরিজও কাব্যিকতা এবং উপমার ঊর্ণাজাল- অথৈ-আদি’র চিঠি: ‘কুয়াশার এই সন্ধ্যায়- তোমাকে লিখতে গিয়ে আমার চোখেও কুয়াশাসম শাদা অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। এই চোখের জল আমার নিয়তি। আমি ভাগ্যাহত এক মেয়ে; যার দুঃখকথাও কাউকে বলার নেই...মন ভিজে! হায় মেঘ, তুমি কবে সুভলং পাহাড় স্পর্শ করবে’? শিহাবের কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ, লালন, রবীন্দ্রনাথ ও কাঙাল হরিনাথের উপস্থিতি দেখা যায়। ‘হায় মাধবী, কবিতার এই উদ্যান থেকে তুমি একদিন ছিটকে পড়লে, আমাদের বকুলতলাকে কানা করে প্রথমে আমার কানে দিলে ট্রেনের ঝিকঝিক আওয়াজ, তারপর দেখালে আটলান্টিক পাড়ি দিবার দীর্ঘ-দূর আকাশ...’। যেমন জীবনানন্দ দাশের কবিতা- ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে’! অথবা রবীন্দ্রনাথের- ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...’ অথবা ‘কাঙাল হরিনাথের- ‘হরি দিন যে গেল, সন্ধ্যা হলো / পার করো আমারে...’।
কবির ‘ঘ্রাণ’ সিরিজও অভিনব। এ পর্বে কবির মানসচিত্র ফুটে উঠেছে অন্য মাত্রায়। মানুষ যে সর্বদা স্পর্শী তাও না:
‘ব্রহ্মপুত্র-গান্ধিগাও তোমার নাকের মতো...
চলো হাতে হাতে একটি রেখা তৈরি করি-
তুমি যখনই এসে আমার সামনে বসো
আমি তোমার চোখের দিকে চোখ রাখি
কেমন করে জানি আমাদের রং এক হয়
কেমন করে জানি চোখেরা শঙ্খচিল হয়’।
‘দ্রোহ’ সিরিজেও ৭১-এর চিঠি; ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি...পূর্ণিমা দীক্ষা দাও সমতার’ -মাওলানা ভাসানী, মুজিব, ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, মাহাথির, মাদার তেরেসা, মাও, মার্কস তার কবিতার দ্রোহের ভেতর জায়গা পেয়েছে। আরেকটি কবিতা: ‘বটেশ্বর গ্রামে রোদেরা ঘুমিয়ে পড়েছে / গাভীর ওলান ধরে কাঁদছে মেয়ে শিশুরা’।
‘ব্রহ্মপুত্র দাঁড়াও’কাব্যগ্রন্থটি অনন্যা প্রকাশনী থেকে ২০২৫ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়।তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে প্রবন্ধগ্রন্থ ১টি, গল্পগ্রন্থ ১টি, স্মৃতিগ্রন্থ ১টি, ফোকলোর গবেষণাগ্রন্থ ৪টি, ভ্রমণগ্রন্থ ২টি, সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ১টি ও সম্পাদিতগ্রন্থ ৩টি। ‘বৈঠা’ নামে একটি লিটলম্যাগও সম্পাদনা করেন কবি।