ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১৮
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ভোরের আলোয় আমি চোখ মেলতেই নাবিল ও নাতাশা ‘গুড মর্নিং, হ্যাপি নিউ ইয়ার, বাবা’ বলে ঘোষণা দিল, ‘আজ তোমাকে একটি সারপ্রাইজ দেবো।’ সারপ্রাইজটি কাল রাতের নববর্ষের উৎসবে জমা অবসাদ দূর করবে, সে আশা করছি।
ট্যাক্সি ডেকে ড্রাইভারকে তারা চুপি চুপি ঠিকানা দিল। নববর্ষে আজ সব বন্ধ। তাহলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রেস্তোরাঁ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না!
আলকাছারের কাছে ট্যাক্সি গতি কমাতেই দেখি পাশে এক রেস্তোরাঁ, এল পিনটন। সুদৃশ্য সিংহ দরজার সামনে স্যুট- টাই পরা একজন দাঁড়িয়ে অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে। আমার ধারণাই ঠিক, তাহলে রেস্তোরাঁতেই নিয়ে আসল। না, তা হলো না। ট্যাক্সি তার গতি বাড়িয়ে চলল অন্য গন্তব্যে- তা কী হতে পারে ভাবতে লাগলাম।
একটু পরে সামনে পড়ল সেভিয়া-র সবচেয়ে নামকরা শপিং কমপ্লেক্স ‘নারভিয়ন প্লাজা’। বেশ ভিড়, নতুন বছরের শুরুতে সবাই প্রিয়জনদের জন্য কেনাকাটা করছে। ভাবলাম, এখান থেকে আমার পছন্দের কিছু কেনা হবে,তারা নিজেরাও কিছু কিনবে। না, এখানেও কেউ নামল না।
এরপর সামনে এল ফ্লেমেনকো নাচ-গানের এক থিয়েটার-‘তেয়াত্রো ফ্লেমেনকো’। তবে এদের শো শুরু হয় রাতে, আজ বন্ধও হতে পারে। তাই এখানেও নয়, হাল ছেড়ে দিলাম। যেখানে নিয়ে যায়, যাব!
ট্যাক্সি অবশেষে থামল সেভিয়ার ঐতিহাসিক এলাকায় এক পার্কের সামনে, নাম‘পার্কে দে ক্রিস্টিনা’- শহরের ধূসর রঙের মাঝে এক নিবিড় সবুজ। চমৎকার এক নির্বাচন নাবিল ও নাতাশার। জন¯্রােত আর উৎসবের উত্তাপ পেরিয়ে গেলে প্রত্যাশা জাগে এক প্রশান্তির। সবুজ নিসর্গ তখন ডাকে হাতছানি দিয়ে তার ছায়ায় আশ্রয় নিতে, যাতে শোনা যায় পাখির গান আর ফোয়ারার জলসঙ্গীত। সবই আছে এখানে, যা মনে ছুঁয়ে দিল শান্তির অনুভব।
পার্কটির একপাশে গুয়াদালকিবির নদী, অন্যপাশে অভিজাত হোটেল আলফনসো ঢওওও ও সান থেলমো প্রাসাদ। এ মনোরম দৃশ্যপটে সবুজের ফাঁকে ফাঁকে ফোয়ারা, জলাধার ও মনুমেন্ট একে করে তুলেছে আরো সুদৃশ্য।
ঢুকতেই এক সুন্দর মনুমেন্ট ‘মনুমেন্তো এমিলিও কেস্তেলা’- স্পেনের প্রথম প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট স্মরণে নির্মিত। পার্কে অলসভাবে হেঁটে যাচ্ছি, আর অনুভব করছি প্রকৃতিকে।
এরপর আরো কয়েকটি মনুমেন্ট ও ফোয়ারা পার হয়ে চোখে পড়ল এক শিলাস্তম্ভ, যা কবি পেদ্রো সালিনাস-এর স্মরণে নির্মিত। তিনি ছিলেন ‘জেনারেসিওন দেল ২৭’ অর্থাৎ, ‘জেনারেশান ২৭’-এর অন্যতম কবি। ১৯২৭-এর মাঝামাঝি সময়ে কবি ‘লিউইস দে গঙ্গোরা’-এর ত্রিশততম মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলিত হয়েছিলেন এই সেভিয়া শহরে কিছু কবি ও শিল্পী, যার মাঝে ছিলেন লোরকা, দালি ও বুনুয়েল। এ ছিল এক নতুন কাব্য আন্দোলনের সূচনাপর্ব।
‘পার্কে দে ক্রিস্টিনা’ ১৮৩০ সালে নির্মিত হয় মারিয়া ক্রিস্টিনা-র১ স্মরণে। ২০১১ সালের সংস্কারের পর পার্কটি‘জেনারেশান ২৭’-এর নামে উৎসর্গ করা হয়।
পার্কেহাঁটতে হাঁটতে দেখি- সবুজের নিবিড়তায় বসে আছে আরেক শিলাস্তম্ভ। ভাবলাম, তা এমন কিছু নয়। অন্যদিকে যেতেই নাবিল ও নাতাশা বলল, ‘দেখ কী আছে এতে’। কাছে যেয়ে দেখি পাথরের গায়ে কিছু লেখা- এ তো লোরকার নাম! সাথে তাঁর এক কবিতার ক’টি লাইন, অবশ্যই স্পেনীয় ভাষায়। আনন্দে-বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম!
কবিতাটির বাংলা অনুবাদ আমার সংগ্রহে ছিল:
সেভিলার বরাবর চলে গেছে
পাল তোলা নৌকার সড়ক;
গ্রানাদার জলে জলে বৈঠা আছাড় দিয়ে চলে
দীর্ঘ নিঃশ্বাস।’২
পার্কের মাঝে লোরকার এ কবিতাই তাহলে আমার জন্য নাবিল ও নাতাশার সারপ্রাইজ! তারা আগেই সার্চ করে এ জায়গাটি আবিষ্কার করে রেখেছিল। এ মুহূর্তটি আমার জন্য নিয়ে এলো এক অনন্য অনুভূতি।
এ রকম এক অনুভূতির কথাই বলেছেন কিটস- চ্যাপম্যানের হোমার পড়ে যখন তিনি পেয়েছিলেন গভীর এক আনন্দ, যার সাথে তুলনা করেছেন স্পেনীয় বীর কর্টেজ-এর আবিষ্কারের আনন্দের, যখন তিনি পাহাড় চূড়া থেকে প্রথম দেখেন প্রশান্ত মহাসাগর।
নাবিল ও নাতাশা সার্চ করে বের করেছে কাছেই আরেকটি পার্ক-‘পার্কে দে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’। সেভিয়ায় একই দিনে লোরকার দুটি স্মৃতি দেখা- তা সারপ্রাইজই। তারা গ্রানাদা সফরে বুঝে গেছে লোরকা ও তাঁর স্মৃতি আমার কাছে কত প্রিয়।
বেগুনি ও সাদা রঙের ডালি দিয়ে, পার্কে আমাদের স্বাগত জানালো, দুই সারি বোগেনভিলিয়া ও ম্যাগনোলিয়া। রঙের এ ছোট কুঞ্জ পার হয়ে আসলাম আরেকটি বড় কুঞ্জবনে, যেখানে অনেকগুলি রাস্তা পরস্পরের সাথে সমকোণে মিলিত হয়েছে। রাস্তাগুলোর দু’পাশ শোভিত করে রেখেছে ওক, সিল্ক ফ্লস ট্রি, ল্যান্টানা ও কমলা গাছের সারি।
এরপর সামনে এল এক গোলাকার চত্বর, যাকে ঘিরে রেখেছে তুজা ও কমলা গাছ। এটি পার হয়ে এসে বসলাম এক শিশু উদ্যানে। সেখানে নাগরদোলা, স্লাইড, দোলনা ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে শোভা পাচ্ছে অলিয়েন্ডার, পিস লিলি ও সেইজ গাছ। পাশের গুয়াদিলকিভির থেকে বয়ে আসা ঝিরি ঝিরি বাতাস আমাদের মন জুড়িয়ে দিচ্ছে. আর সাথে দোল দিচ্ছে গাছের পাতাদের- তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে দোল খাচ্ছে শিশুরা রঙিন দোলনায়। শিশুদের আনন্দ, সাথে নিসর্গের প্রশান্তি- এ এক চমৎকার অনুভব।
পার্কের বাইরের বলয়ে রয়েছে আরেক সারি গাছ- চায়না বেরি ও কমলা গাছ- তারা যেন পার্কটিকে আড়াল করে রেখেছে শহরের কোলাহল থেকে।
কখন যে নিসর্গের কোলে এত সময় কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি। খিদে পাওয়ার পর মনে হলো এবার নিসর্গ ছেড়ে নগরে যেতে হবে কিছু খাওয়ার জন্য।
কাছের এক রেস্তোরাঁ ‘এসথ্রাপেরলোতে’ বছর শুরুর লাঞ্চ খেতে ঢুকেছি। নববর্ষ উপলক্ষে আজ এখানে বেশ ভিড়। নাবিল ও নাতাশা গতকালই বুকিং দিয়ে রেখেছিল, আমাকে না জানিয়েই। সবাই যেয়ে বসলাম সামনের চাঁদোয়া-তে, শীতের দুপুরের হালকা রোদ ভালোই লাগছে।
সবাই বেছে নিলাম আন্দালুসিয়ার খাবার। প্রথমে পরিবেশন করা হলো‘সালমোরেহো’- ঠা-া টমেটো স্যুপ। এরপর এলনাতাশার পছন্দের খাবার-‘আলবনডিগাছ’- চিকেন মিট বল। নাবিল বরাবরই পছন্দ করে স্টেক, এবারও তাই নিল, যার স্পেনীয় নাম ‘এনথ্রেকথ’। আমি ও ফারজানা নিলাম ‘এসপিনাকাছ কন গারবানছোছ’- পালং শাক ও ছোলা। ডেজার্ট এল ‘সেভিল অরেঞ্জ এন্ড এলমন্ড কেক’, যা বানানো হয় সেভিয়ার বিখ্যাত কমলা, এলমন্ড ও ডিম দিয়ে। সবাই খুব পছন্দ করল এ কেক। নাবিল নাতাশা নিল স্পেনীয়দের পছন্দের ‘চুরো কন চকোলাত’- হট চকোলেট এর সাথে চুরো। এখানকার ময়দার ভাজা পেস্ট্রিকে বলে চুরো। তবে আমার ভালো লাগল এখানকার মোকা কফি। ফারজানা নিল গ্রিনটি।
আজ হলো নাবিল ও নাতাশার দিন। তারাই ঠিক করবে এরপর কোথায় যাবে। ভাবলাম কোন সিনেমা হলে যাবে ছবি দেখতে।
তবে তারা ঠিক করল, যাবে ‘পার্কে দে মারিয়া লুইজা’-তে। আবারও পার্ক। আজকের দিনটি লোরকাময়, সাথে পার্কময়। এত সুন্দর মেলবন্ধন আর কি হতে পারে? ইতিহাস, স্থাপত্য, ঘোড়ার গাড়ি, জাহাজ, ফ্লেমেনকো আর জন প্রবাহ- সব ছেড়ে দিয়ে আবারও আশ্রয় নিই নিসর্গের কোলে। চাই গভীর নীরবতা, আর অবিরাম স্বস্তি। কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়:
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর।’
গুয়াদিলকিভির নদীর তীরে ‘পার্কে দে মারিয়া লুইজা’- সেভিয়া-র সবচেয়ে বড় পার্ক। সান থেলমো প্রাসাদের বাগানকে আরো সুন্দর ও প্রশস্ত করে ১৯১১ সালে এ পার্কটির কাজ শুরু করেন ফরাসি ডিজাইনার ফরেস্টিয়ার। মুরদের উদ্যান ও আন্দালুসিয়ার প্রকৃতি তাঁকে করেছিল গভীরভাবে প্রভাবিত। সেই প্রভাবে তিনি নির্মাণ করেন জমকালো এক বাগান, যাতে আছে টালিযুক্ত ফোয়ারা, জলপ্রপাত ও জলাধার, নিকুঞ্জ, চাঁদোয়া, দ্রাক্ষালতা, ম-প- তার ফাঁকে ফাঁকে গাছের, লতার, ফুলের বৈচিত্র্যের সমাবেশ। পাম গাছ, সাইপ্রেস, বোগেনভিলিয়া, গোলাপ, কমলা গাছের সারি, অনেক রঙের লতা-পাতা, জলাশয়ে হাঁসের ভেসে বেড়ানো, আর সবুজের অবারিত সমারোহ- সব মিলিয়ে অনুপম এক উদ্যান ‘পার্কে দে মারিয়া লুইজা’।
পার্কে হাঁটতে হাঁটতে নাবিল ও নাতাশার চোখে পড়ল ‘লা ফুয়েন্টে দে লাস রানাস’- অর্থাৎ, ব্যাঙের ফোয়ারা। এটি বৃত্তাকার এক ফোয়ারা, যেখানে এক বাটির বাইরের বৃত্ত থেকে চীনামাটির ৮টি ব্যাঙ তাদের মুখ থেকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে কেন্দ্রের এক হাঁসের গায়ে, আর হাঁসটি পানি নির্গত করছে ওপরের দিকে। পুরো বৃত্তটি সুন্দর নকশা করা টালি দিয়ে সাজানো। ফোয়ারাটির চারপাশে বৃত্তাকার এক চত্বর, যাতে আছে টালিযুক্ত বেঞ্চ, আর গাছপালা, লতাপাতা। এখানে বসে হাঁসটির ওপর ব্যাঙদের পানি ছিটানো দেখলাম অনেকক্ষণ।
ব্যাঙদের ফোয়ারা থেকে এরপর আসলাম হাঁসদের ফোয়ারায় নয়, তাদের হৃদে, নাম-‘ইসলা দে লস পেথোস’, অর্থাৎ হাঁসদের হৃদ। চীনামাটির নয়, এগুলো আসল হাঁস, ভাসছে পানির ওপরে দলে দলে, কখনো বা একাকী, কতো রঙের, কতো আকৃতির। তাদের হঠাৎ হঠাৎ ঢেকে ওঠা সবুজের নীরবতায় নিয়ে আসছে হালকা এক ঝংকার।
একটু এগোতেই চোখে পড়ল মনোরম এক ঝর্না ‘এসতানকোয়ে দে লস লোটস’- অর্থাৎ শাপলা পুকুর। আয়তাকার এ জলাশয়ের পাড়গুলো নকশা করা টালি দিয়ে সাজানো, পাশে পাশে রয়েছে ছায়াময় লতাবিতান। এ জলাশয়ে ভাসছে অগণন শাপলা- সাদা, বেগুনী, গোলাপী রঙের- তাদের ওপর পড়েছে পড়ন্ত বিকেলের হালকা রোদ। মন ছুঁয়ে-যাওয়া এক দৃশ্য। চারদিক শান্ত নিরিবিলি। এর মাঝে একটা শালিক নীরবে উড়ে এসে বসল এক শাপলার বুকে। হৃদয় ছেয়ে গেছে নীরব, নির্মল এক প্রশান্তিতে।
লোরকা যেন এ অনুভবের কথাই বলেছেন এ কবিতায়:
শীতল ঝর্ণার ধারে বসে দুদ- বিশ্রাম নেয় আমার হৃদয়।
(তোমার জালে আঁজলা ভরে নাও,
বিস্মৃতির মাকড়সা।)
ঝর্নার জল তাকে তার গান শুনিয়েছিল।
(তোমার জালে আঁজলা ভরে নাও,
বিস্মৃতির মাকড়সা।)
আমার জাগরিত হৃদয় তার ভালোবাসার গান শুনিয়েছিল।
(নিস্তব্ধতার মাকড়সা,
তোমার রহস্যের জাল বিছাও।)’৩
শীতল ঝর্নার ধারে বসে দু’দণ্ড বিশ্রাম নিয়ে আমরা ফিরলাম জাগরিত হৃদয়ে ভালোবাসার গান গেয়ে, নীরবে।
জবভ:
মারিয়া ক্রিস্টিনা ছিলেন রাজা ৭ম ফার্ডিনান্দ এর ২য় স্ত্রী, যিনি ১৮২৯ থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত স্পেনের রাণী ছিলেন।
২. Baladilla de los res rios, তিন নদীর বালাদিকা: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. Sueno: স্বপ্ন: অনুবাদ: রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১৮
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ভোরের আলোয় আমি চোখ মেলতেই নাবিল ও নাতাশা ‘গুড মর্নিং, হ্যাপি নিউ ইয়ার, বাবা’ বলে ঘোষণা দিল, ‘আজ তোমাকে একটি সারপ্রাইজ দেবো।’ সারপ্রাইজটি কাল রাতের নববর্ষের উৎসবে জমা অবসাদ দূর করবে, সে আশা করছি।
ট্যাক্সি ডেকে ড্রাইভারকে তারা চুপি চুপি ঠিকানা দিল। নববর্ষে আজ সব বন্ধ। তাহলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রেস্তোরাঁ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না!
আলকাছারের কাছে ট্যাক্সি গতি কমাতেই দেখি পাশে এক রেস্তোরাঁ, এল পিনটন। সুদৃশ্য সিংহ দরজার সামনে স্যুট- টাই পরা একজন দাঁড়িয়ে অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে। আমার ধারণাই ঠিক, তাহলে রেস্তোরাঁতেই নিয়ে আসল। না, তা হলো না। ট্যাক্সি তার গতি বাড়িয়ে চলল অন্য গন্তব্যে- তা কী হতে পারে ভাবতে লাগলাম।
একটু পরে সামনে পড়ল সেভিয়া-র সবচেয়ে নামকরা শপিং কমপ্লেক্স ‘নারভিয়ন প্লাজা’। বেশ ভিড়, নতুন বছরের শুরুতে সবাই প্রিয়জনদের জন্য কেনাকাটা করছে। ভাবলাম, এখান থেকে আমার পছন্দের কিছু কেনা হবে,তারা নিজেরাও কিছু কিনবে। না, এখানেও কেউ নামল না।
এরপর সামনে এল ফ্লেমেনকো নাচ-গানের এক থিয়েটার-‘তেয়াত্রো ফ্লেমেনকো’। তবে এদের শো শুরু হয় রাতে, আজ বন্ধও হতে পারে। তাই এখানেও নয়, হাল ছেড়ে দিলাম। যেখানে নিয়ে যায়, যাব!
ট্যাক্সি অবশেষে থামল সেভিয়ার ঐতিহাসিক এলাকায় এক পার্কের সামনে, নাম‘পার্কে দে ক্রিস্টিনা’- শহরের ধূসর রঙের মাঝে এক নিবিড় সবুজ। চমৎকার এক নির্বাচন নাবিল ও নাতাশার। জন¯্রােত আর উৎসবের উত্তাপ পেরিয়ে গেলে প্রত্যাশা জাগে এক প্রশান্তির। সবুজ নিসর্গ তখন ডাকে হাতছানি দিয়ে তার ছায়ায় আশ্রয় নিতে, যাতে শোনা যায় পাখির গান আর ফোয়ারার জলসঙ্গীত। সবই আছে এখানে, যা মনে ছুঁয়ে দিল শান্তির অনুভব।
পার্কটির একপাশে গুয়াদালকিবির নদী, অন্যপাশে অভিজাত হোটেল আলফনসো ঢওওও ও সান থেলমো প্রাসাদ। এ মনোরম দৃশ্যপটে সবুজের ফাঁকে ফাঁকে ফোয়ারা, জলাধার ও মনুমেন্ট একে করে তুলেছে আরো সুদৃশ্য।
ঢুকতেই এক সুন্দর মনুমেন্ট ‘মনুমেন্তো এমিলিও কেস্তেলা’- স্পেনের প্রথম প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট স্মরণে নির্মিত। পার্কে অলসভাবে হেঁটে যাচ্ছি, আর অনুভব করছি প্রকৃতিকে।
এরপর আরো কয়েকটি মনুমেন্ট ও ফোয়ারা পার হয়ে চোখে পড়ল এক শিলাস্তম্ভ, যা কবি পেদ্রো সালিনাস-এর স্মরণে নির্মিত। তিনি ছিলেন ‘জেনারেসিওন দেল ২৭’ অর্থাৎ, ‘জেনারেশান ২৭’-এর অন্যতম কবি। ১৯২৭-এর মাঝামাঝি সময়ে কবি ‘লিউইস দে গঙ্গোরা’-এর ত্রিশততম মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলিত হয়েছিলেন এই সেভিয়া শহরে কিছু কবি ও শিল্পী, যার মাঝে ছিলেন লোরকা, দালি ও বুনুয়েল। এ ছিল এক নতুন কাব্য আন্দোলনের সূচনাপর্ব।
‘পার্কে দে ক্রিস্টিনা’ ১৮৩০ সালে নির্মিত হয় মারিয়া ক্রিস্টিনা-র১ স্মরণে। ২০১১ সালের সংস্কারের পর পার্কটি‘জেনারেশান ২৭’-এর নামে উৎসর্গ করা হয়।
পার্কেহাঁটতে হাঁটতে দেখি- সবুজের নিবিড়তায় বসে আছে আরেক শিলাস্তম্ভ। ভাবলাম, তা এমন কিছু নয়। অন্যদিকে যেতেই নাবিল ও নাতাশা বলল, ‘দেখ কী আছে এতে’। কাছে যেয়ে দেখি পাথরের গায়ে কিছু লেখা- এ তো লোরকার নাম! সাথে তাঁর এক কবিতার ক’টি লাইন, অবশ্যই স্পেনীয় ভাষায়। আনন্দে-বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম!
কবিতাটির বাংলা অনুবাদ আমার সংগ্রহে ছিল:
সেভিলার বরাবর চলে গেছে
পাল তোলা নৌকার সড়ক;
গ্রানাদার জলে জলে বৈঠা আছাড় দিয়ে চলে
দীর্ঘ নিঃশ্বাস।’২
পার্কের মাঝে লোরকার এ কবিতাই তাহলে আমার জন্য নাবিল ও নাতাশার সারপ্রাইজ! তারা আগেই সার্চ করে এ জায়গাটি আবিষ্কার করে রেখেছিল। এ মুহূর্তটি আমার জন্য নিয়ে এলো এক অনন্য অনুভূতি।
এ রকম এক অনুভূতির কথাই বলেছেন কিটস- চ্যাপম্যানের হোমার পড়ে যখন তিনি পেয়েছিলেন গভীর এক আনন্দ, যার সাথে তুলনা করেছেন স্পেনীয় বীর কর্টেজ-এর আবিষ্কারের আনন্দের, যখন তিনি পাহাড় চূড়া থেকে প্রথম দেখেন প্রশান্ত মহাসাগর।
নাবিল ও নাতাশা সার্চ করে বের করেছে কাছেই আরেকটি পার্ক-‘পার্কে দে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’। সেভিয়ায় একই দিনে লোরকার দুটি স্মৃতি দেখা- তা সারপ্রাইজই। তারা গ্রানাদা সফরে বুঝে গেছে লোরকা ও তাঁর স্মৃতি আমার কাছে কত প্রিয়।
বেগুনি ও সাদা রঙের ডালি দিয়ে, পার্কে আমাদের স্বাগত জানালো, দুই সারি বোগেনভিলিয়া ও ম্যাগনোলিয়া। রঙের এ ছোট কুঞ্জ পার হয়ে আসলাম আরেকটি বড় কুঞ্জবনে, যেখানে অনেকগুলি রাস্তা পরস্পরের সাথে সমকোণে মিলিত হয়েছে। রাস্তাগুলোর দু’পাশ শোভিত করে রেখেছে ওক, সিল্ক ফ্লস ট্রি, ল্যান্টানা ও কমলা গাছের সারি।
এরপর সামনে এল এক গোলাকার চত্বর, যাকে ঘিরে রেখেছে তুজা ও কমলা গাছ। এটি পার হয়ে এসে বসলাম এক শিশু উদ্যানে। সেখানে নাগরদোলা, স্লাইড, দোলনা ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে শোভা পাচ্ছে অলিয়েন্ডার, পিস লিলি ও সেইজ গাছ। পাশের গুয়াদিলকিভির থেকে বয়ে আসা ঝিরি ঝিরি বাতাস আমাদের মন জুড়িয়ে দিচ্ছে. আর সাথে দোল দিচ্ছে গাছের পাতাদের- তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে দোল খাচ্ছে শিশুরা রঙিন দোলনায়। শিশুদের আনন্দ, সাথে নিসর্গের প্রশান্তি- এ এক চমৎকার অনুভব।
পার্কের বাইরের বলয়ে রয়েছে আরেক সারি গাছ- চায়না বেরি ও কমলা গাছ- তারা যেন পার্কটিকে আড়াল করে রেখেছে শহরের কোলাহল থেকে।
কখন যে নিসর্গের কোলে এত সময় কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি। খিদে পাওয়ার পর মনে হলো এবার নিসর্গ ছেড়ে নগরে যেতে হবে কিছু খাওয়ার জন্য।
কাছের এক রেস্তোরাঁ ‘এসথ্রাপেরলোতে’ বছর শুরুর লাঞ্চ খেতে ঢুকেছি। নববর্ষ উপলক্ষে আজ এখানে বেশ ভিড়। নাবিল ও নাতাশা গতকালই বুকিং দিয়ে রেখেছিল, আমাকে না জানিয়েই। সবাই যেয়ে বসলাম সামনের চাঁদোয়া-তে, শীতের দুপুরের হালকা রোদ ভালোই লাগছে।
সবাই বেছে নিলাম আন্দালুসিয়ার খাবার। প্রথমে পরিবেশন করা হলো‘সালমোরেহো’- ঠা-া টমেটো স্যুপ। এরপর এলনাতাশার পছন্দের খাবার-‘আলবনডিগাছ’- চিকেন মিট বল। নাবিল বরাবরই পছন্দ করে স্টেক, এবারও তাই নিল, যার স্পেনীয় নাম ‘এনথ্রেকথ’। আমি ও ফারজানা নিলাম ‘এসপিনাকাছ কন গারবানছোছ’- পালং শাক ও ছোলা। ডেজার্ট এল ‘সেভিল অরেঞ্জ এন্ড এলমন্ড কেক’, যা বানানো হয় সেভিয়ার বিখ্যাত কমলা, এলমন্ড ও ডিম দিয়ে। সবাই খুব পছন্দ করল এ কেক। নাবিল নাতাশা নিল স্পেনীয়দের পছন্দের ‘চুরো কন চকোলাত’- হট চকোলেট এর সাথে চুরো। এখানকার ময়দার ভাজা পেস্ট্রিকে বলে চুরো। তবে আমার ভালো লাগল এখানকার মোকা কফি। ফারজানা নিল গ্রিনটি।
আজ হলো নাবিল ও নাতাশার দিন। তারাই ঠিক করবে এরপর কোথায় যাবে। ভাবলাম কোন সিনেমা হলে যাবে ছবি দেখতে।
তবে তারা ঠিক করল, যাবে ‘পার্কে দে মারিয়া লুইজা’-তে। আবারও পার্ক। আজকের দিনটি লোরকাময়, সাথে পার্কময়। এত সুন্দর মেলবন্ধন আর কি হতে পারে? ইতিহাস, স্থাপত্য, ঘোড়ার গাড়ি, জাহাজ, ফ্লেমেনকো আর জন প্রবাহ- সব ছেড়ে দিয়ে আবারও আশ্রয় নিই নিসর্গের কোলে। চাই গভীর নীরবতা, আর অবিরাম স্বস্তি। কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়:
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর।’
গুয়াদিলকিভির নদীর তীরে ‘পার্কে দে মারিয়া লুইজা’- সেভিয়া-র সবচেয়ে বড় পার্ক। সান থেলমো প্রাসাদের বাগানকে আরো সুন্দর ও প্রশস্ত করে ১৯১১ সালে এ পার্কটির কাজ শুরু করেন ফরাসি ডিজাইনার ফরেস্টিয়ার। মুরদের উদ্যান ও আন্দালুসিয়ার প্রকৃতি তাঁকে করেছিল গভীরভাবে প্রভাবিত। সেই প্রভাবে তিনি নির্মাণ করেন জমকালো এক বাগান, যাতে আছে টালিযুক্ত ফোয়ারা, জলপ্রপাত ও জলাধার, নিকুঞ্জ, চাঁদোয়া, দ্রাক্ষালতা, ম-প- তার ফাঁকে ফাঁকে গাছের, লতার, ফুলের বৈচিত্র্যের সমাবেশ। পাম গাছ, সাইপ্রেস, বোগেনভিলিয়া, গোলাপ, কমলা গাছের সারি, অনেক রঙের লতা-পাতা, জলাশয়ে হাঁসের ভেসে বেড়ানো, আর সবুজের অবারিত সমারোহ- সব মিলিয়ে অনুপম এক উদ্যান ‘পার্কে দে মারিয়া লুইজা’।
পার্কে হাঁটতে হাঁটতে নাবিল ও নাতাশার চোখে পড়ল ‘লা ফুয়েন্টে দে লাস রানাস’- অর্থাৎ, ব্যাঙের ফোয়ারা। এটি বৃত্তাকার এক ফোয়ারা, যেখানে এক বাটির বাইরের বৃত্ত থেকে চীনামাটির ৮টি ব্যাঙ তাদের মুখ থেকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে কেন্দ্রের এক হাঁসের গায়ে, আর হাঁসটি পানি নির্গত করছে ওপরের দিকে। পুরো বৃত্তটি সুন্দর নকশা করা টালি দিয়ে সাজানো। ফোয়ারাটির চারপাশে বৃত্তাকার এক চত্বর, যাতে আছে টালিযুক্ত বেঞ্চ, আর গাছপালা, লতাপাতা। এখানে বসে হাঁসটির ওপর ব্যাঙদের পানি ছিটানো দেখলাম অনেকক্ষণ।
ব্যাঙদের ফোয়ারা থেকে এরপর আসলাম হাঁসদের ফোয়ারায় নয়, তাদের হৃদে, নাম-‘ইসলা দে লস পেথোস’, অর্থাৎ হাঁসদের হৃদ। চীনামাটির নয়, এগুলো আসল হাঁস, ভাসছে পানির ওপরে দলে দলে, কখনো বা একাকী, কতো রঙের, কতো আকৃতির। তাদের হঠাৎ হঠাৎ ঢেকে ওঠা সবুজের নীরবতায় নিয়ে আসছে হালকা এক ঝংকার।
একটু এগোতেই চোখে পড়ল মনোরম এক ঝর্না ‘এসতানকোয়ে দে লস লোটস’- অর্থাৎ শাপলা পুকুর। আয়তাকার এ জলাশয়ের পাড়গুলো নকশা করা টালি দিয়ে সাজানো, পাশে পাশে রয়েছে ছায়াময় লতাবিতান। এ জলাশয়ে ভাসছে অগণন শাপলা- সাদা, বেগুনী, গোলাপী রঙের- তাদের ওপর পড়েছে পড়ন্ত বিকেলের হালকা রোদ। মন ছুঁয়ে-যাওয়া এক দৃশ্য। চারদিক শান্ত নিরিবিলি। এর মাঝে একটা শালিক নীরবে উড়ে এসে বসল এক শাপলার বুকে। হৃদয় ছেয়ে গেছে নীরব, নির্মল এক প্রশান্তিতে।
লোরকা যেন এ অনুভবের কথাই বলেছেন এ কবিতায়:
শীতল ঝর্ণার ধারে বসে দুদ- বিশ্রাম নেয় আমার হৃদয়।
(তোমার জালে আঁজলা ভরে নাও,
বিস্মৃতির মাকড়সা।)
ঝর্নার জল তাকে তার গান শুনিয়েছিল।
(তোমার জালে আঁজলা ভরে নাও,
বিস্মৃতির মাকড়সা।)
আমার জাগরিত হৃদয় তার ভালোবাসার গান শুনিয়েছিল।
(নিস্তব্ধতার মাকড়সা,
তোমার রহস্যের জাল বিছাও।)’৩
শীতল ঝর্নার ধারে বসে দু’দণ্ড বিশ্রাম নিয়ে আমরা ফিরলাম জাগরিত হৃদয়ে ভালোবাসার গান গেয়ে, নীরবে।
জবভ:
মারিয়া ক্রিস্টিনা ছিলেন রাজা ৭ম ফার্ডিনান্দ এর ২য় স্ত্রী, যিনি ১৮২৯ থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত স্পেনের রাণী ছিলেন।
২. Baladilla de los res rios, তিন নদীর বালাদিকা: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. Sueno: স্বপ্ন: অনুবাদ: রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী