alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : তিন

শিকিবু

আবুল কাসেম

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

চার.

উৎসবের পরপর একটি ভালো সংবাদ এলো মুরাসাকিদের পরিবারে। উৎসব অনুষ্ঠান খুব সুন্দর হয়েছে। সম্রাট খুবই খুশি। এই খুশিতে সম্রাট মুরাসাকির বাবা তামেতোকিকে চার বছরের জন্য ইচিঝেন প্রদেশের গভর্নর করে দিয়েছেন।

ইঝোমির বাবা ছিলেন এই প্রদেশের গভর্নর। তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগে। ইঝোমির তাতে মন খারাপ হয়েছে। বাবা একটি গৌরবজনক পদ হারালেন। তার চেয়ে বড় কথা তিনি এখন কিয়োটোতে টেরামাচি লেনের বাড়িতে অবস্থান করবেন। তাই তার স্বাধীন বেপরোয়া জীবনের বুঝি ইতি হতে চলেছে।

তার বাবা একটা প্রাদেশিক গভর্নরের ক্ষমতা ও অর্থ বানাবার পদটি হারালেন বটে, কিন্তু সম্রাটের প্রাসাদে কেন্দ্রীয় অমাত্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ফিরে এলেন এ সন্তুষ্টি নিয়ে যে, এখানে তার পরিবারের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্মাণে তা সহায়ক হবে। এছাড়া সম্রাটের প্রাসাদে এ পদটির গুরুত্ব তো রয়েছেই।

মুরাসাকিদের বাবার গভর্নর হবার আনন্দের মধ্যে একটু সমস্যা দেখা দিল, মুরাসাকি এবং তার ভাই বাবার সঙ্গে ইচিঝেন যাবে না কিয়োটোর টেরামাসি লেনে থাকবে। ইঝোমিরা এখানেই থেকেছে।

মুরাসাকি বলল, নোবুনোরি তো যাচ্ছেই। আমি একা কী করব?

বাবা বললেন, চাইলে নানা বাড়ি যাও বোনের মতো ওটা তো তোমার মায়ের বাড়িও।

না, আমি আপনার সঙ্গেই যাব, বাবা।

বেশ চলো। তবে আমি আগে যাব। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করব। সব সামলে নিয়ে তোমাদের নিয়ে যাব।

একটি প্রদেশের গভর্নরের বাড়িঘর এবং প্রদেশে অবস্থানের সকল সুযোগসুবিধা করাই থাকে। তবুও প্রশাসন গোছাতে সময় নিচ্ছেন তামেতোকি। ইঝোমির বাবা বেশ অগোছালো করে রেখে গেছেন প্রদেশটিকে।

বাবা রাজধানীর কিয়োটোতে এসেছিলেন সরকারি কাজে। সম্ভ্রান্ত নারীর প্রথাগত রীতিনীতিকে লঙ্ঘন করে মুরাসাকি পাঁচ দিনের এক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে বাবার সঙ্গে ইচিঝেনে হাজির হলেন।

এখানে তার নতুন জীবন। রাজধানীর বাইরে মফস্বলী হাওয়া। গভর্নরর মেয়ে বলে অনেক গুরুত্ব আর সম্মান। রাজধানীর বহুজনঋদ্ধ পরিবেশে তা বোঝা যায়নি। সেখানে তার বাবার অধীনে এক বিশাল সামুরাই সেনাবাহিনী রয়েছে। প্রদেশের সেনাপ্রধান এসে গভর্নরকে স্যালুট করে দাঁড়ান। প্রদেশের রাজস্ব বিভাগের প্রধান গভর্নরের অধীনস্থ কর্মকর্তা। প্রধান কেয়াং বা শ্রাইমসহ সকল মন্দিরের পুরোহিতরা সম্রাটের মতোই তার বাবাকে সমীহ করেন। হেইয়ান সাম্রাজ্যের অভিজাত লোকজন যখন বাবাকে সম্মান-শ্রদ্ধা করেন তখন বুঝে নিতে হবে এখন তার বাবার অবস্থান কোথায়। তারা ফুজিওয়ারা গোত্রের। তাই অন্য গোত্রের গভর্নরদের চাইতে তার বাবার গুরুত্ব বেশি। উল্লেখ্য, হেইয়ান সাম্রাজ্যে প্রভাবশালী গোত্র তিনটি। ফুজিওয়ারা, তাইকা এবং মিনামাতো। সম্রাটের প্রাসাদে যে ক্ষমতাকাঠামো একে যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার প্রভাব পড়ে প্রদেশগুলোতেও। ফুজিওয়ারা নো তামেতোকির প্রভাব ও গুরুত্ব বেশি এবং অবস্থান শক্ত। কিন্তু কন্যার যেন বন্দিজীবন।

জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে জাপান সাগর তীরে পাহাড়-পর্বতময় ইচিঝেন প্রদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। কিয়োটো সুন্দর। ইচিঝেন পাগল করে দেয়ার মত সুন্দর। এ সৌন্দর্য বিখ্যাত দুজন কবির জন্ম দিয়েছে। নারা সম্রাটদের আমলে কবি নাকাতোমি নো ইয়াকামোরি এখানে নির্বাসনকালে তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলো লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে ছিল প্রেয়সী সানুনো ওতাগামি নো ওতোমিকে কবিতায় লেখা প্রেমপত্রগুলো।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কবির নির্বাসিত জীবনকে একাকিত্ব আর প্রিয় বিরহের বেদনায় বড় বেশি কাতর করে তুলতো। মুরাসাকি সেসব কবিতা পড়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছে। কবি পিতার সংগ্রহকৃত কবিতাগুলো তাকে ইচিঝেনের সৌন্দর্য আত্মা আর এক বিরল মহিমার সাগর আকাশ ও পার্বত্য বৈচিত্র্যে অবগাহনের সুযোগ এসে দিয়েছে। কবিতার পাখায় ভর করে উদাস হয়ে যাওয়া মন যেন সাগর, আকাশ এবং পাহাড় পর্বতের সখ্য ও উদারতায় আশ্রয় খুঁজে পায়।

গভর্নরের মেয়ে। আভিজাত্য তাকে পিতা আর ভাই ছাড়া অন্য সকল পুরুষ থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সাজপোশাক করে শুধু বসে থাকা। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে খুনসুঁটি করা। বাবা দপ্তর থেকে ফিরে এলে তার কাছ থেকে প্রতিদিন গল্প শোনা। এভাবেই কাটছে দিনকাল।

একদিন বিকেলে বাবা দপ্তর থেকে ফেরার সময় ইচিঝেনের ওপর লেখা চমকপ্রদ সব কবিতার কিছু পা-ুলিপি নিয়ে এলেন। অষ্টম শতকের কবি। নারা সম্রাটদের সময়ের। তার রয়েছে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা। তিন তিনটি প্রদেশের গভর্নর ছিলেন তিনি। বাবা বললেন, শুধু ওয়াকা কবিতায় নয়, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা এবং আমলাতান্ত্রিক অবস্থানেও সমান কৃতিত্বের অধিকারী।

মুরাসাকি বলল, তার নামটা কিন্তু বলেননি বাবা।

হ্যাঁ, তার নাম ইয়াকামোচি। ইতচো প্রদেশে গভর্নর থাকাকালে লেখা তার এই ২২০টি ওয়াকা কবিতা। অনুলিপি পেলাম দপ্তরের পাণ্ডুলিপি শাখায়। এগুলো পাঠ করে তোমার সময় ভালোই কাটবে।

ভেতরে অলংকরণগুলো বেশ সুন্দর।

বেশিরভাগই ইচিঝেন প্রদেশের নৈসর্গিক ছবি।

তাইতো দেখছি। হাতের লেখাও সুন্দর।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটাও হয়নি তার।

ক্যালিগ্রাফি আর অলংকরণ বা ইলাস্ট্রেশনের প্রতি দৃষ্টি যায় প্রথমে মুরাসাকির। তার কারণ অস্বাভাবিক কিছু নয়- যা সাধারণ পাঠকের বেলায় ঘটে। মুরাসাকি ক্যালিওগ্রাফি, চিত্রাংকন এবং সঙ্গীতে পাঠ গ্রহণ করেছে। ক্যালিওগ্রাফি বা ইলাস্ট্রেশনের প্রতি আগ্রহ সে কারণে। চোখ বুলিয়েই বলল, বাহ্ চমৎকার। বন্ধুবান্ধব খুব একটা না থাকলেও কিয়োটোতে ইমন এবং ইঝোমিরা মাঝেমধ্যে সঙ্গ দিত। ইমনের সঙ্গে ভালোই মিল ছিল। ইঝোমির সঙ্গে তর্কবিতর্ক করে মনের মিল না থাকলেও সময় ভালোই কেটে যেতো। এখানে এসে তাই একরকম নিঃসঙ্গতায় হাঁপিয়ে ওঠে। কবিতার পাণ্ডুলিপিগুলো পাবার পর ভালো লাগতে শুরু করেছে।

ইমন ‘কাগেরো নিক্কি’ দিতে পারেননি। উৎসবের আগেই স্বামীর সঙ্গে ওসাকায় বেড়াতে চলে যান। ফিরে এসে জানতে পারেন মুরাসাকিরা নেই, ইচিঝেনে চলে গেছে। খুব কষ্ট হয় তার, ফেরার পথে ইজোমির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ইঝোমিকে বেশ খুশি মনে হলো। ইমন তাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। কিন্তু তা প্রকাশও করেন না। ইঝোমিকে উদ্দেশ্য করে হেসে দিয়ে বলেন, তাকাকু চলে যাওয়ায় কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে টেরামাচি লেনটা। তোমার সঙ্গে কি যাবার আগে সাক্ষাৎ হয়েছিল?

হয়েছিল আপু, ওটাই তার জন্য ঠিক জায়গায়।

কেন?

কবি ইয়াকামোরি একসময় সেখানে নির্বাসনে ছিলেন। সে সময় তার হাতে অসংখ্য কবিতার জন্ম হয়েছে। তাকাকু যেমন চুপ-চাপ আর নির্লিপ্ত থাকে, সেখানে সে নির্জনতার কবি হয়ে উঠতে পারবে।

তুমি মজা করছো?

তাকে তো যেতে বেশ খুশিই মনে হলো।

আমার কষ্ট হয় কারেগো নিক্কি দিতে পারিনি বলে।

ওসব বিষাদ আর হা-পিত্যেশের কথা আমাদের না পড়াই ভালো।

তুমি পড়েছ?

না, শুনেছি এতে কী আছে।

তুমি যখন আমার মতো বড় হবে তখন এর মর্ম বুঝবে।

তা হলে তাকাকুকে কেন পড়তে দিচ্ছেন, সে তো আমার বয়সী, নয় কি?

মানসিক বয়স ওর তোমার চেয়ে বেশি।

বলতে যাচ্ছিলেন তোমার বয়স অন্য ক্ষেত্রে বেশি, কিন্তু বললেন না।

তা ঠিক। বলল ইঝোমি। যোগ করল দেখবেন সে বয়সের আগে বুড়ো হয়ে গেছে।

একে বুড়ো বলে না, ‘ঋদ্ধ হওয়া’ বলে।

আমার কাছে বুড়ে হওয়াই। প্রসঙ্গান্তরে বলল, আচ্ছা আপু, সম্রাটের প্রাসাদে কাজ করে কি খুব মজা?

এ প্রশ্ন কেন?

বাবা বলছেন ছোট সম্রাজ্ঞীর সহচরীর চাকরি নিতে।

মন্দ কী, আমি তো ওর মায়ের সঙ্গে আছি।

তিনি তো পূর্ণবয়স্কা মহিলা। কিন্তু একটা বালিকার সঙ্গে-

তোমার বয়সও তো সে রকমই। মানিয়ে নেবে ভালো।

তা যুক্তির কথা বটে। তবে আমার বয়স বিশ।

যদি চাও তবে শোশির শাশুড়ির সঙ্গে ভাব করিয়ে দিতে পারি। তুমি তার সঙ্গে কাজ করে ভবিষ্যতে কেউকেটা কেউ হয়ে উঠতে পারবে।

কেন?

সম্রাটের মাতা বড় বিদগ্ধ রমণী, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আনাগোনা সব সময়ই লেগে থাকে। (ক্রমশ...)

ছবি

আড়াই লেনের কৃষ্ণচূড়া

ছবি

গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক ইতিহাস ও দেশপ্রেম

ছবি

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

ছবি

বইমেলায় আসছে নতুন বই

ছবি

সরল প্রাণের সোপান

ছবি

হাসান আজিজুল হকের দর্শনচিন্তা

ছবি

শীতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য মানবতারই জয়গান

ছবি

বইতরণী সাহিত্য পুরস্কার পেলেন শুক্লা গাঙ্গুলী

ছবি

‘শব্দঘর’ আহমদ রফিক সংখ্যা ও তাঁকে সম্মাননা প্রদান

ছবি

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

ছবি

ঈশ্বরের সত্য দর্শন

ছবি

মঞ্চে প্রবেশ

ছবি

আমি মাকারিও নই

ছবি

মৃতজন গল্প রচনা করে

ছবি

সম্পত্তি বিতর্ক: কেন পদত্যাগ করতে হলো টিউলিপ সিদ্দিককে

ছবি

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ফেব্রুয়ারিতে

ছবি

মধুসূদনের সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদ

ছবি

বিদূষী নবনীতা বনাম মানুষ নবনীতা

ছবি

দুটি অণুগল্প

ছবি

উপমা-চিত্রে দ্যোতনার সঞ্চারণ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রয়োজনে ডাক দিও

ছবি

মাকারিও

ছবি

আমার সহযাত্রী

ছবি

নাগিব মাহফুজের নির্বাচিত ১০ স্বপ্ন

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাদশা আকবর

ছবি

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

ছবি

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

ছবি

হৃদয় প্রক্ষালক কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ছবি

বহুবাচনিকতা ও শিল্পের নন্দন

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : তিন

শিকিবু

আবুল কাসেম

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

চার.

উৎসবের পরপর একটি ভালো সংবাদ এলো মুরাসাকিদের পরিবারে। উৎসব অনুষ্ঠান খুব সুন্দর হয়েছে। সম্রাট খুবই খুশি। এই খুশিতে সম্রাট মুরাসাকির বাবা তামেতোকিকে চার বছরের জন্য ইচিঝেন প্রদেশের গভর্নর করে দিয়েছেন।

ইঝোমির বাবা ছিলেন এই প্রদেশের গভর্নর। তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগে। ইঝোমির তাতে মন খারাপ হয়েছে। বাবা একটি গৌরবজনক পদ হারালেন। তার চেয়ে বড় কথা তিনি এখন কিয়োটোতে টেরামাচি লেনের বাড়িতে অবস্থান করবেন। তাই তার স্বাধীন বেপরোয়া জীবনের বুঝি ইতি হতে চলেছে।

তার বাবা একটা প্রাদেশিক গভর্নরের ক্ষমতা ও অর্থ বানাবার পদটি হারালেন বটে, কিন্তু সম্রাটের প্রাসাদে কেন্দ্রীয় অমাত্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ফিরে এলেন এ সন্তুষ্টি নিয়ে যে, এখানে তার পরিবারের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্মাণে তা সহায়ক হবে। এছাড়া সম্রাটের প্রাসাদে এ পদটির গুরুত্ব তো রয়েছেই।

মুরাসাকিদের বাবার গভর্নর হবার আনন্দের মধ্যে একটু সমস্যা দেখা দিল, মুরাসাকি এবং তার ভাই বাবার সঙ্গে ইচিঝেন যাবে না কিয়োটোর টেরামাসি লেনে থাকবে। ইঝোমিরা এখানেই থেকেছে।

মুরাসাকি বলল, নোবুনোরি তো যাচ্ছেই। আমি একা কী করব?

বাবা বললেন, চাইলে নানা বাড়ি যাও বোনের মতো ওটা তো তোমার মায়ের বাড়িও।

না, আমি আপনার সঙ্গেই যাব, বাবা।

বেশ চলো। তবে আমি আগে যাব। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করব। সব সামলে নিয়ে তোমাদের নিয়ে যাব।

একটি প্রদেশের গভর্নরের বাড়িঘর এবং প্রদেশে অবস্থানের সকল সুযোগসুবিধা করাই থাকে। তবুও প্রশাসন গোছাতে সময় নিচ্ছেন তামেতোকি। ইঝোমির বাবা বেশ অগোছালো করে রেখে গেছেন প্রদেশটিকে।

বাবা রাজধানীর কিয়োটোতে এসেছিলেন সরকারি কাজে। সম্ভ্রান্ত নারীর প্রথাগত রীতিনীতিকে লঙ্ঘন করে মুরাসাকি পাঁচ দিনের এক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে বাবার সঙ্গে ইচিঝেনে হাজির হলেন।

এখানে তার নতুন জীবন। রাজধানীর বাইরে মফস্বলী হাওয়া। গভর্নরর মেয়ে বলে অনেক গুরুত্ব আর সম্মান। রাজধানীর বহুজনঋদ্ধ পরিবেশে তা বোঝা যায়নি। সেখানে তার বাবার অধীনে এক বিশাল সামুরাই সেনাবাহিনী রয়েছে। প্রদেশের সেনাপ্রধান এসে গভর্নরকে স্যালুট করে দাঁড়ান। প্রদেশের রাজস্ব বিভাগের প্রধান গভর্নরের অধীনস্থ কর্মকর্তা। প্রধান কেয়াং বা শ্রাইমসহ সকল মন্দিরের পুরোহিতরা সম্রাটের মতোই তার বাবাকে সমীহ করেন। হেইয়ান সাম্রাজ্যের অভিজাত লোকজন যখন বাবাকে সম্মান-শ্রদ্ধা করেন তখন বুঝে নিতে হবে এখন তার বাবার অবস্থান কোথায়। তারা ফুজিওয়ারা গোত্রের। তাই অন্য গোত্রের গভর্নরদের চাইতে তার বাবার গুরুত্ব বেশি। উল্লেখ্য, হেইয়ান সাম্রাজ্যে প্রভাবশালী গোত্র তিনটি। ফুজিওয়ারা, তাইকা এবং মিনামাতো। সম্রাটের প্রাসাদে যে ক্ষমতাকাঠামো একে যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার প্রভাব পড়ে প্রদেশগুলোতেও। ফুজিওয়ারা নো তামেতোকির প্রভাব ও গুরুত্ব বেশি এবং অবস্থান শক্ত। কিন্তু কন্যার যেন বন্দিজীবন।

জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে জাপান সাগর তীরে পাহাড়-পর্বতময় ইচিঝেন প্রদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। কিয়োটো সুন্দর। ইচিঝেন পাগল করে দেয়ার মত সুন্দর। এ সৌন্দর্য বিখ্যাত দুজন কবির জন্ম দিয়েছে। নারা সম্রাটদের আমলে কবি নাকাতোমি নো ইয়াকামোরি এখানে নির্বাসনকালে তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলো লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে ছিল প্রেয়সী সানুনো ওতাগামি নো ওতোমিকে কবিতায় লেখা প্রেমপত্রগুলো।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কবির নির্বাসিত জীবনকে একাকিত্ব আর প্রিয় বিরহের বেদনায় বড় বেশি কাতর করে তুলতো। মুরাসাকি সেসব কবিতা পড়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছে। কবি পিতার সংগ্রহকৃত কবিতাগুলো তাকে ইচিঝেনের সৌন্দর্য আত্মা আর এক বিরল মহিমার সাগর আকাশ ও পার্বত্য বৈচিত্র্যে অবগাহনের সুযোগ এসে দিয়েছে। কবিতার পাখায় ভর করে উদাস হয়ে যাওয়া মন যেন সাগর, আকাশ এবং পাহাড় পর্বতের সখ্য ও উদারতায় আশ্রয় খুঁজে পায়।

গভর্নরের মেয়ে। আভিজাত্য তাকে পিতা আর ভাই ছাড়া অন্য সকল পুরুষ থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সাজপোশাক করে শুধু বসে থাকা। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে খুনসুঁটি করা। বাবা দপ্তর থেকে ফিরে এলে তার কাছ থেকে প্রতিদিন গল্প শোনা। এভাবেই কাটছে দিনকাল।

একদিন বিকেলে বাবা দপ্তর থেকে ফেরার সময় ইচিঝেনের ওপর লেখা চমকপ্রদ সব কবিতার কিছু পা-ুলিপি নিয়ে এলেন। অষ্টম শতকের কবি। নারা সম্রাটদের সময়ের। তার রয়েছে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা। তিন তিনটি প্রদেশের গভর্নর ছিলেন তিনি। বাবা বললেন, শুধু ওয়াকা কবিতায় নয়, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা এবং আমলাতান্ত্রিক অবস্থানেও সমান কৃতিত্বের অধিকারী।

মুরাসাকি বলল, তার নামটা কিন্তু বলেননি বাবা।

হ্যাঁ, তার নাম ইয়াকামোচি। ইতচো প্রদেশে গভর্নর থাকাকালে লেখা তার এই ২২০টি ওয়াকা কবিতা। অনুলিপি পেলাম দপ্তরের পাণ্ডুলিপি শাখায়। এগুলো পাঠ করে তোমার সময় ভালোই কাটবে।

ভেতরে অলংকরণগুলো বেশ সুন্দর।

বেশিরভাগই ইচিঝেন প্রদেশের নৈসর্গিক ছবি।

তাইতো দেখছি। হাতের লেখাও সুন্দর।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটাও হয়নি তার।

ক্যালিগ্রাফি আর অলংকরণ বা ইলাস্ট্রেশনের প্রতি দৃষ্টি যায় প্রথমে মুরাসাকির। তার কারণ অস্বাভাবিক কিছু নয়- যা সাধারণ পাঠকের বেলায় ঘটে। মুরাসাকি ক্যালিওগ্রাফি, চিত্রাংকন এবং সঙ্গীতে পাঠ গ্রহণ করেছে। ক্যালিওগ্রাফি বা ইলাস্ট্রেশনের প্রতি আগ্রহ সে কারণে। চোখ বুলিয়েই বলল, বাহ্ চমৎকার। বন্ধুবান্ধব খুব একটা না থাকলেও কিয়োটোতে ইমন এবং ইঝোমিরা মাঝেমধ্যে সঙ্গ দিত। ইমনের সঙ্গে ভালোই মিল ছিল। ইঝোমির সঙ্গে তর্কবিতর্ক করে মনের মিল না থাকলেও সময় ভালোই কেটে যেতো। এখানে এসে তাই একরকম নিঃসঙ্গতায় হাঁপিয়ে ওঠে। কবিতার পাণ্ডুলিপিগুলো পাবার পর ভালো লাগতে শুরু করেছে।

ইমন ‘কাগেরো নিক্কি’ দিতে পারেননি। উৎসবের আগেই স্বামীর সঙ্গে ওসাকায় বেড়াতে চলে যান। ফিরে এসে জানতে পারেন মুরাসাকিরা নেই, ইচিঝেনে চলে গেছে। খুব কষ্ট হয় তার, ফেরার পথে ইজোমির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ইঝোমিকে বেশ খুশি মনে হলো। ইমন তাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। কিন্তু তা প্রকাশও করেন না। ইঝোমিকে উদ্দেশ্য করে হেসে দিয়ে বলেন, তাকাকু চলে যাওয়ায় কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে টেরামাচি লেনটা। তোমার সঙ্গে কি যাবার আগে সাক্ষাৎ হয়েছিল?

হয়েছিল আপু, ওটাই তার জন্য ঠিক জায়গায়।

কেন?

কবি ইয়াকামোরি একসময় সেখানে নির্বাসনে ছিলেন। সে সময় তার হাতে অসংখ্য কবিতার জন্ম হয়েছে। তাকাকু যেমন চুপ-চাপ আর নির্লিপ্ত থাকে, সেখানে সে নির্জনতার কবি হয়ে উঠতে পারবে।

তুমি মজা করছো?

তাকে তো যেতে বেশ খুশিই মনে হলো।

আমার কষ্ট হয় কারেগো নিক্কি দিতে পারিনি বলে।

ওসব বিষাদ আর হা-পিত্যেশের কথা আমাদের না পড়াই ভালো।

তুমি পড়েছ?

না, শুনেছি এতে কী আছে।

তুমি যখন আমার মতো বড় হবে তখন এর মর্ম বুঝবে।

তা হলে তাকাকুকে কেন পড়তে দিচ্ছেন, সে তো আমার বয়সী, নয় কি?

মানসিক বয়স ওর তোমার চেয়ে বেশি।

বলতে যাচ্ছিলেন তোমার বয়স অন্য ক্ষেত্রে বেশি, কিন্তু বললেন না।

তা ঠিক। বলল ইঝোমি। যোগ করল দেখবেন সে বয়সের আগে বুড়ো হয়ে গেছে।

একে বুড়ো বলে না, ‘ঋদ্ধ হওয়া’ বলে।

আমার কাছে বুড়ে হওয়াই। প্রসঙ্গান্তরে বলল, আচ্ছা আপু, সম্রাটের প্রাসাদে কাজ করে কি খুব মজা?

এ প্রশ্ন কেন?

বাবা বলছেন ছোট সম্রাজ্ঞীর সহচরীর চাকরি নিতে।

মন্দ কী, আমি তো ওর মায়ের সঙ্গে আছি।

তিনি তো পূর্ণবয়স্কা মহিলা। কিন্তু একটা বালিকার সঙ্গে-

তোমার বয়সও তো সে রকমই। মানিয়ে নেবে ভালো।

তা যুক্তির কথা বটে। তবে আমার বয়স বিশ।

যদি চাও তবে শোশির শাশুড়ির সঙ্গে ভাব করিয়ে দিতে পারি। তুমি তার সঙ্গে কাজ করে ভবিষ্যতে কেউকেটা কেউ হয়ে উঠতে পারবে।

কেন?

সম্রাটের মাতা বড় বিদগ্ধ রমণী, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আনাগোনা সব সময়ই লেগে থাকে। (ক্রমশ...)

back to top