ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে রাজধানীর মিরপুরের অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের লাশ শনাক্ত ও হস্তান্তরের অপেক্ষায় স্বজনরা -সংবাদ
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে মিরপুরের শিয়ালবাড়ির পোশাক কারখানার কাজে যোগ দিয়েছিলেন নার্গিস আক্তার (১৯)। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরে ওই কারখানার লাইনম্যানের কাছ থেকে ফোন পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে যান। রাতে বাবার সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলে এসে পায়ের নূপুর ও মাথার খোঁপা দেখে তাকে শনাক্ত করেন ছোট বোন মৌসুমি আক্তার।
নিহতদের লাশের খোঁজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বজনরা
১০ জনের লাশ শনাক্তের দাবি স্বজনদের
ছাদের দরজায় তালা, রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়ায় অজ্ঞান শ্রমিকরা: ফায়ার সার্ভিস
গত ২৮ ঘণ্টার চেষ্টায় রূপনগরের আগুন নিয়ন্ত্রণে
মর্গের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে মৌসুমি জানান, গত বছর নার্গিস আক্তার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। তার বাবা ওয়াজিউল্লাহ ফলের আড়তে কাজ করেন। তারা চার বোন। নার্গিস ছিলেন দ্বিতীয়। বাবার একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে কারণে নার্গিস পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন। তার কোনো মুঠোফোন নেই।
রাতে তাদের জানানো হয়, পরদিন (বুধবার) লাশ দেয়া হবে। রাত ১টার দিকে তারা ফিরে যান। তার মা অসুস্থ, মেয়ের মৃত্যুতে আরও ভেঙে পড়েছেন। বাবা পুলিশ রিপোর্ট আনতে গেছেন। আর মর্গের সামনে বসে বসে বোনের শোকে কাঁদছিলেন মৌসুমি।
রূপনগরের ৯ নম্বর সড়কে মাহিরা আক্তার (১৪) ও সানজিদা আক্তারকে (১৫) নিয়ে থাকেন মা ফাতেমা বেগম। গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। স্বামী ফারুক হোসেন প্রয়াত। তিনি নিজেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। কাজের সামর্থ্য নেই। দুই মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করে। তাদের আয়েই চলে সংসার। ছোট মেয়ে মাহিরা কাজ করতো শিয়ালবাড়ির অগ্নিকা-কবলিত কারখানার তৃতীয় তলায়। মেয়েকে হারিয়ে মর্গের সামনে বিলাপ করছিলেন ফাতেমা বেগম। কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। আত্মীয়রা তাকে সান্তনা দিচ্ছিলেন। পাশে বসা বড় বোন সানজিদা আক্তার জানালো, সে অন্য একটি কারখানায় কাজ করে। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে মামা শফিকুল ইসলামকে নিয়ে রাতেই তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসে পোশাক দেখে বোনের মরদেহ শনাক্ত করেন তিনি।
আর বিদেশ যাওয়া হলো না তোফায়েলের বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন ২১ বছরের তরুণ তোফায়েল আহমদ। একটি জনশক্তি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানে টাকাও জমা দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার হয়েছিল। অপেক্ষায় ছিলেন কাগজপত্র পাওয়ার। এ অপেক্ষার সময়টুকু বেকার বসে না থেকে যোগ দিয়েছিলেন মিরপুরের শিয়ালবাড়ির ওই পোশাক কারখানায়, যেখানে গতকাল মঙ্গলবার অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন তিনি।
বুধবার,(১৫ অক্টোবর ২০২৫) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মুঠোফোনে তোফায়েল আহমদের পুড়ে যাওয়া মৃতদেহের ছবি নিয়ে মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন তার চাচাতো ভাই শরাফাত হোসেন।
তোফায়েল আহমদের চাচাতো ভাই শরাফত হোসেন জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। তোফায়েল আহমদেরা দুই ভাই-বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। তার বাবা জজ মিয়া কৃষক। তোফায়েল এসএসসি পাস করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কয়েক মাস আগে তিনি ঢাকায় এসে রূপনগরের একটি মেসে থাকতেন। অপেক্ষার সময়টুকু পোশাক কারখানায় যোগ দিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে শেষ হলো তার বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন। রাতেই তারা মর্গে তোফায়েলের মরদেহের পোশাক দেখে শনাক্ত করেছেন। বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। এখানে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজ চলছে। লাশ তিনিই বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলে জানালেন শরাফত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে মিরপুর শিয়ালবাড়ি অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১৬ জনের মরদেহ রাখা হয়েছে। রাতেই মরদেহগুলো এখানে আনা হয়। আগুনে পুড়ে সেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। রাত থাকেই নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনেরা এখানে আসেন। মধ্যরাত পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করেন। কেউ কেউ মৃতদের পোশাক-আশাক বা কোনো বিশেষ নিদর্শন দেখে শনাক্ত করেন। তবে রাতে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়নি। সকাল থেকে আবার স্বজনেরা মর্গের সামনে ফিরে আসেন মৃতদেহ পাওয়ার জন্য।
তাদের মধ্যে পুড়ে যাওয়া ভবনের আশপাশে বন্ধু সারোয়ারের ছবি হাতে গতকাল মঙ্গলবার থেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন আমানুল্লাহ। সারোয়ার মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে পুড়ে যাওয়া একটি পোশাক কারখানায় ‘হেলপার’ হিসেবে কাজ করতেন। বুধবার সারোয়ারকে ঢাকা মেডিকেল মর্গে পাওয়ার কথা বলেছেন আমানুল্লাহ। তার মুখসহ পুরো শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। বাম হাতের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে জোড়া লাগানো আরেকটি আঙুল দেখেই তাকে শনাক্ত করা হয়েছে। যে ১০ জনের লাশ শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে একটি সারোয়ারের। তার বন্ধু আমানুল্লাহ বলেন,‘ওর বাঁ হাতের বুড়া আঙুলে আরেকটা জমজ আঙুল আছে। শরীরের কিছু বোঝা যায় না, মুখের আকৃতিও বোঝা যায় না। ওই আঙুল দেখে সারোয়ারকে ওর ভাই শনাক্ত করেছে।’
# স্বামীর খোঁজে দুই ছেলেকে নিয়ে মর্গে
অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নজরুল ইসলামের (৪০) কোনো খোঁজ পাচ্ছে না তার পরিবার। বুধবার সকালে মর্গের সামনে স্ত্রী নার্গিস ইসলাম দুই ছেলে মিরাজুল ইসলাম (২০) ও ইয়াসিন আরাফাতকে (১৬) নিয়ে মর্গের সমনে অপেক্ষা করছিলেন। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে থাকেন বলে জানান তারা। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া। নজরুল ইসলাম ওই ভবনের তৃতীয় তলায় পোশাক কারখানার কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই তার মুঠোফোনটি বন্ধ রয়েছে। মর্গে ১৬ জনের মরদেহ আছে। তার মরদেহ দেখার সুযোগ পাননি। রাতে যারা মর্গে এসেছিলেন, তাদের কেউ কেউ মরদেহ শনাক্ত করতে পেরেছেন। অপেক্ষা করছিলেন পুলিশের অনুমতি নিয়ে মরদেহ দেখার জন্য।
# অনেকের স্বজন এখনও নিখোঁজ
অগ্নিকাণ্ডের পর বুধবার দুপুর পর্যন্ত অনেকের স্বজন নিখোঁজ রয়েছেন। স্বজনের সন্ধানে ছবি নিয়ে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন রিকশাচালক আবদুল মান্নান। তার মেয়ে মৌসুমি আক্তার (২০) অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ। রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৬ নম্বর সড়কে তিনি থাকেন। তার তিন মেয়ের মধ্যে মৌসুমি দ্বিতীয়। আগে মৌসুমি অন্য একটি কারখানায় কাজ করতেন, এ মাসের শুরুতে এখানে যোগ দিয়েছেন। মৌসুমি আক্তারের কাছে মুঠোফোন ছিল, কিন্তু সেটি এখন বন্ধ।
মুক্তা বেগমের (২০) খোঁজে মর্গে এসেছিলেন তার মামা আবুল দেয়ান। তিনি জানালেন, মুক্তা শিয়ালবাড়ির ২ নম্বর সড়কে তার খালা রিনা বেগমের সঙ্গে থাকতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ায়। মা-বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
# প্রত্যেকটি লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করার পর হস্তান্তর
অগ্নিকাণ্ডে মরদেহ গ্রহণের জন্য স্বজনহারা আত্মীয়রা সকাল থেকেই ভিড় করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে। মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান তার দপ্তরে সাংবাদিকদের জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পুলিশ তদন্ত করছে। এটি পুলিশ কেস। সে কারণে জেলা প্রশাসন বা পুলিশের অনুমোদন ছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরদেহ হস্তান্তর করতে পারে না। মর্গে ১৬টি মরদেহ এসেছে। প্রতিটি মরদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হবে। সব লাশের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। এরমধ্যে ৯ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী। তাদের মধ্যে ১০ জনের মরদেহ আত্মীয়রা শনাক্ত করতে পেরেছেন বলে তাকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ যাচাই করে রিপোর্ট দেবে। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের অনুমোদন পেলেই আত্মীয়দের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে শিয়ালবাড়ি এলাকায় কসমিক ফার্মা নামের একটি টিন শেড রাসায়নিকের গুদাম এবং পাশের ভবনে থাকা পোশাক কারখানায় আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। পর্যায়ক্রমে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট সেখানে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। সেদিন রাত পর্যন্ত ১৬টি পোড়া লাশ উদ্ধারের তথ্য দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সব লাশ উদ্ধার হয়েছে পোশাক কারখানা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যে ১৬ জনের লাশ মিলেছে, তাদের সবার চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের পরেই লাশগুলো হস্তান্তর করা হবে।
রূপনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, লাশ শনাক্ত করার দাবি নিয়ে স্বজনেরা পুলিশের কাছে আসছেন। তবে প্রত্যেকটি লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করার পর হস্তান্তরের কার্যক্রম শুরু হবে। পাশাপাশি স্বজনদেরও ডিএনএ নমুনা এখনই নিয়ে রাখা হবে।
## কেমিক্যালের ধোঁয়ায় বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে
বুধবার দুপুরে আগুনের ঘটনাস্থলে ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, গোডাউনে থাকা বিভিন্ন কেমিক্যালের ধোঁয়া থেকে টক্সিক গ্যাস তৈরি হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে। এছাড়া ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়েছে, যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, ফুসফুস, হার্ট ও ত্বকের সমস্যা হতে পারে। যা ঘনবসতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, যে কেমিক্যাল রয়েছে তা অপারেশন করতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। বুয়েট থেকে বিকেলে একটি বিশেষজ্ঞ টিম আসবে, তারা দেখে পরামর্শ দেবেন। এরপর সিদ্ধান্ত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। গার্মেন্টসের আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে কিন্তু কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগবে। কেমিক্যাল গোডাউনের ভেতরে এখনও প্রচুর সাদা ধোঁয়া আছে। কেমিক্যালের আগুন বিপজ্জনক উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী গুদামজাত না করা হলে কেমিক্যাল একসঙ্গে হয়ে বড় ধরনের বিস্ফোরণ-বিক্রিয়া হতে পারে। যে কারণে এখানে সময় লাগছে।
ছাদের দরজায় তালা, রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়ায় অজ্ঞান শ্রমিকরা
রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগার পর চারদিকে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দ্রুত আক্রান্ত হন ঠিক পাশের চার তলা পোশাক কারখানার ভবনটির কর্মীরা। কারখানা দুটির আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কাজের সময় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, পাশের কারখানার আগুন দ্রুত সরু গলির ওপারের পোশাক কারখানার ভবনের নিচে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে পোশাক কারখানার কর্মীরা নিচে নামতে পারেননি। আবার ছাদের দরজায় তালা থাকায় ধোঁয়া থেকে বাঁচতে ওপরেও যেতে পারেননি।
উদ্ধারকারী কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এ কারণে কর্মস্থলেই বিষাক্ত ধোঁয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন পোশাক কারখানাটির ওপর তলায় থাকা কর্মীরা। পরে সেই ভবনের ওপরের দিকে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়লে পুড়ে অঙ্গার হতে হয় তাদের। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৬টি লাশ উদ্ধারের তথ্য দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সব লাশ উদ্ধার হয়েছে পোশাক কারখানা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে বলেন, ‘চার তলা পোশাক কারখানার ওপরে ছাদ টিনের। ছাদে যাওয়ার জন্য সেখানে একটি গ্রিলের দরজা রয়েছে। সেটি তালা মারা ছিল। এ কারণে তারা ওপরের দিকে যেতে পারেননি। ‘আপনারা জানেন যে পরিমাণ কেমিক্যাল বিস্ফোরণ, সেটার ফ্ল্যাশওভারে টক্সিক গ্যাসের কারণে আকস্মিকভাবে ওনারা অজ্ঞান হয়েছেন। পরে তারা সরতে পারেননি। ওপরে যেতে পারেননি, নিচেও যেতে পারেননি।’
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল বলেন, পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামের কোনটিরই অনুমোদন ছিল না। কোনো ধরনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না। তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, ‘মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে যে কারখানায় আগুন লেগেছে, তা বিজিএমইএ এর সদস্যভুক্ত কোনো পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি ওয়াশিং কারখানা।’ এটির নাম শাহ আলী ওয়াশিং লিমিটেড বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য দিয়েছে সংগঠনটি।
প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদার ইয়াসিন আলিফ নামে একজন বলেন, ‘কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন লাগার পর একটা ব্লাস্ট হইছে। তখনই গুদামের সামনে যেই বিল্ডিংয়ে গার্মেন্টস ওইটার নিচ তলায় আগুন লাইগা যায়। কেমিক্যাল গোডাউনের টিনের ফাঁক দিয়া আগুন বাহির হইতেছিল যেন কেউ ওয়েল্ডিং টর্চ জ্বালাইছে।’ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গোডাউনের সামনে একটি ছোট কাভার্ডভ্যান ছিল, সেইটাতেও আগুন লাইগা যায়। তখনো কয়েকটা ব্লাস্ট হয়, এরপর গার্মেন্টসের পুরা বিল্ডিংটাতে আগুন লাগে।’
# গত ২৮ ঘণ্টার চেষ্টায় রূপনগরের আগুন নিয়ন্ত্রণে
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন প্রায় ২৮ ঘণ্টা চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট সর্বশেষ কাজ করে ঘটনাস্থলে। ভয়াবহ এ আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন্য নিহত হয়েছে। বুধবার বিকেলে ৪টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম। তিনি বলেন, বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সর্বশেষ আমাদের ৫টি ইউনিট কাজ করছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অক্সিজেন ট্যাংক নিয়ে, গ্যাস মাস্ক পড়ে সেখানে কাজ করছেন। এদিন দুপুরে অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে বুয়েটের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে রাজধানীর মিরপুরের অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের লাশ শনাক্ত ও হস্তান্তরের অপেক্ষায় স্বজনরা -সংবাদ
বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে মিরপুরের শিয়ালবাড়ির পোশাক কারখানার কাজে যোগ দিয়েছিলেন নার্গিস আক্তার (১৯)। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরে ওই কারখানার লাইনম্যানের কাছ থেকে ফোন পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে যান। রাতে বাবার সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলে এসে পায়ের নূপুর ও মাথার খোঁপা দেখে তাকে শনাক্ত করেন ছোট বোন মৌসুমি আক্তার।
নিহতদের লাশের খোঁজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বজনরা
১০ জনের লাশ শনাক্তের দাবি স্বজনদের
ছাদের দরজায় তালা, রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়ায় অজ্ঞান শ্রমিকরা: ফায়ার সার্ভিস
গত ২৮ ঘণ্টার চেষ্টায় রূপনগরের আগুন নিয়ন্ত্রণে
মর্গের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে মৌসুমি জানান, গত বছর নার্গিস আক্তার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। তার বাবা ওয়াজিউল্লাহ ফলের আড়তে কাজ করেন। তারা চার বোন। নার্গিস ছিলেন দ্বিতীয়। বাবার একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে কারণে নার্গিস পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন। তার কোনো মুঠোফোন নেই।
রাতে তাদের জানানো হয়, পরদিন (বুধবার) লাশ দেয়া হবে। রাত ১টার দিকে তারা ফিরে যান। তার মা অসুস্থ, মেয়ের মৃত্যুতে আরও ভেঙে পড়েছেন। বাবা পুলিশ রিপোর্ট আনতে গেছেন। আর মর্গের সামনে বসে বসে বোনের শোকে কাঁদছিলেন মৌসুমি।
রূপনগরের ৯ নম্বর সড়কে মাহিরা আক্তার (১৪) ও সানজিদা আক্তারকে (১৫) নিয়ে থাকেন মা ফাতেমা বেগম। গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। স্বামী ফারুক হোসেন প্রয়াত। তিনি নিজেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। কাজের সামর্থ্য নেই। দুই মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করে। তাদের আয়েই চলে সংসার। ছোট মেয়ে মাহিরা কাজ করতো শিয়ালবাড়ির অগ্নিকা-কবলিত কারখানার তৃতীয় তলায়। মেয়েকে হারিয়ে মর্গের সামনে বিলাপ করছিলেন ফাতেমা বেগম। কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। আত্মীয়রা তাকে সান্তনা দিচ্ছিলেন। পাশে বসা বড় বোন সানজিদা আক্তার জানালো, সে অন্য একটি কারখানায় কাজ করে। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে মামা শফিকুল ইসলামকে নিয়ে রাতেই তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসে পোশাক দেখে বোনের মরদেহ শনাক্ত করেন তিনি।
আর বিদেশ যাওয়া হলো না তোফায়েলের বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন ২১ বছরের তরুণ তোফায়েল আহমদ। একটি জনশক্তি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানে টাকাও জমা দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার হয়েছিল। অপেক্ষায় ছিলেন কাগজপত্র পাওয়ার। এ অপেক্ষার সময়টুকু বেকার বসে না থেকে যোগ দিয়েছিলেন মিরপুরের শিয়ালবাড়ির ওই পোশাক কারখানায়, যেখানে গতকাল মঙ্গলবার অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন তিনি।
বুধবার,(১৫ অক্টোবর ২০২৫) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মুঠোফোনে তোফায়েল আহমদের পুড়ে যাওয়া মৃতদেহের ছবি নিয়ে মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন তার চাচাতো ভাই শরাফাত হোসেন।
তোফায়েল আহমদের চাচাতো ভাই শরাফত হোসেন জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। তোফায়েল আহমদেরা দুই ভাই-বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। তার বাবা জজ মিয়া কৃষক। তোফায়েল এসএসসি পাস করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কয়েক মাস আগে তিনি ঢাকায় এসে রূপনগরের একটি মেসে থাকতেন। অপেক্ষার সময়টুকু পোশাক কারখানায় যোগ দিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে শেষ হলো তার বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন। রাতেই তারা মর্গে তোফায়েলের মরদেহের পোশাক দেখে শনাক্ত করেছেন। বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। এখানে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজ চলছে। লাশ তিনিই বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলে জানালেন শরাফত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে মিরপুর শিয়ালবাড়ি অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১৬ জনের মরদেহ রাখা হয়েছে। রাতেই মরদেহগুলো এখানে আনা হয়। আগুনে পুড়ে সেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। রাত থাকেই নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনেরা এখানে আসেন। মধ্যরাত পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করেন। কেউ কেউ মৃতদের পোশাক-আশাক বা কোনো বিশেষ নিদর্শন দেখে শনাক্ত করেন। তবে রাতে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়নি। সকাল থেকে আবার স্বজনেরা মর্গের সামনে ফিরে আসেন মৃতদেহ পাওয়ার জন্য।
তাদের মধ্যে পুড়ে যাওয়া ভবনের আশপাশে বন্ধু সারোয়ারের ছবি হাতে গতকাল মঙ্গলবার থেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন আমানুল্লাহ। সারোয়ার মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে পুড়ে যাওয়া একটি পোশাক কারখানায় ‘হেলপার’ হিসেবে কাজ করতেন। বুধবার সারোয়ারকে ঢাকা মেডিকেল মর্গে পাওয়ার কথা বলেছেন আমানুল্লাহ। তার মুখসহ পুরো শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। বাম হাতের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে জোড়া লাগানো আরেকটি আঙুল দেখেই তাকে শনাক্ত করা হয়েছে। যে ১০ জনের লাশ শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে একটি সারোয়ারের। তার বন্ধু আমানুল্লাহ বলেন,‘ওর বাঁ হাতের বুড়া আঙুলে আরেকটা জমজ আঙুল আছে। শরীরের কিছু বোঝা যায় না, মুখের আকৃতিও বোঝা যায় না। ওই আঙুল দেখে সারোয়ারকে ওর ভাই শনাক্ত করেছে।’
# স্বামীর খোঁজে দুই ছেলেকে নিয়ে মর্গে
অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নজরুল ইসলামের (৪০) কোনো খোঁজ পাচ্ছে না তার পরিবার। বুধবার সকালে মর্গের সামনে স্ত্রী নার্গিস ইসলাম দুই ছেলে মিরাজুল ইসলাম (২০) ও ইয়াসিন আরাফাতকে (১৬) নিয়ে মর্গের সমনে অপেক্ষা করছিলেন। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে থাকেন বলে জানান তারা। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া। নজরুল ইসলাম ওই ভবনের তৃতীয় তলায় পোশাক কারখানার কাজ করতেন। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই তার মুঠোফোনটি বন্ধ রয়েছে। মর্গে ১৬ জনের মরদেহ আছে। তার মরদেহ দেখার সুযোগ পাননি। রাতে যারা মর্গে এসেছিলেন, তাদের কেউ কেউ মরদেহ শনাক্ত করতে পেরেছেন। অপেক্ষা করছিলেন পুলিশের অনুমতি নিয়ে মরদেহ দেখার জন্য।
# অনেকের স্বজন এখনও নিখোঁজ
অগ্নিকাণ্ডের পর বুধবার দুপুর পর্যন্ত অনেকের স্বজন নিখোঁজ রয়েছেন। স্বজনের সন্ধানে ছবি নিয়ে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন রিকশাচালক আবদুল মান্নান। তার মেয়ে মৌসুমি আক্তার (২০) অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ। রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৬ নম্বর সড়কে তিনি থাকেন। তার তিন মেয়ের মধ্যে মৌসুমি দ্বিতীয়। আগে মৌসুমি অন্য একটি কারখানায় কাজ করতেন, এ মাসের শুরুতে এখানে যোগ দিয়েছেন। মৌসুমি আক্তারের কাছে মুঠোফোন ছিল, কিন্তু সেটি এখন বন্ধ।
মুক্তা বেগমের (২০) খোঁজে মর্গে এসেছিলেন তার মামা আবুল দেয়ান। তিনি জানালেন, মুক্তা শিয়ালবাড়ির ২ নম্বর সড়কে তার খালা রিনা বেগমের সঙ্গে থাকতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ায়। মা-বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
# প্রত্যেকটি লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করার পর হস্তান্তর
অগ্নিকাণ্ডে মরদেহ গ্রহণের জন্য স্বজনহারা আত্মীয়রা সকাল থেকেই ভিড় করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে। মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান তার দপ্তরে সাংবাদিকদের জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পুলিশ তদন্ত করছে। এটি পুলিশ কেস। সে কারণে জেলা প্রশাসন বা পুলিশের অনুমোদন ছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরদেহ হস্তান্তর করতে পারে না। মর্গে ১৬টি মরদেহ এসেছে। প্রতিটি মরদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হবে। সব লাশের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। এরমধ্যে ৯ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী। তাদের মধ্যে ১০ জনের মরদেহ আত্মীয়রা শনাক্ত করতে পেরেছেন বলে তাকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ যাচাই করে রিপোর্ট দেবে। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের অনুমোদন পেলেই আত্মীয়দের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে শিয়ালবাড়ি এলাকায় কসমিক ফার্মা নামের একটি টিন শেড রাসায়নিকের গুদাম এবং পাশের ভবনে থাকা পোশাক কারখানায় আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। পর্যায়ক্রমে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট সেখানে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। সেদিন রাত পর্যন্ত ১৬টি পোড়া লাশ উদ্ধারের তথ্য দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সব লাশ উদ্ধার হয়েছে পোশাক কারখানা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যে ১৬ জনের লাশ মিলেছে, তাদের সবার চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের পরেই লাশগুলো হস্তান্তর করা হবে।
রূপনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, লাশ শনাক্ত করার দাবি নিয়ে স্বজনেরা পুলিশের কাছে আসছেন। তবে প্রত্যেকটি লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করার পর হস্তান্তরের কার্যক্রম শুরু হবে। পাশাপাশি স্বজনদেরও ডিএনএ নমুনা এখনই নিয়ে রাখা হবে।
## কেমিক্যালের ধোঁয়ায় বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে
বুধবার দুপুরে আগুনের ঘটনাস্থলে ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, গোডাউনে থাকা বিভিন্ন কেমিক্যালের ধোঁয়া থেকে টক্সিক গ্যাস তৈরি হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে। এছাড়া ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়েছে, যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, ফুসফুস, হার্ট ও ত্বকের সমস্যা হতে পারে। যা ঘনবসতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, যে কেমিক্যাল রয়েছে তা অপারেশন করতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। বুয়েট থেকে বিকেলে একটি বিশেষজ্ঞ টিম আসবে, তারা দেখে পরামর্শ দেবেন। এরপর সিদ্ধান্ত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। গার্মেন্টসের আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে কিন্তু কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগবে। কেমিক্যাল গোডাউনের ভেতরে এখনও প্রচুর সাদা ধোঁয়া আছে। কেমিক্যালের আগুন বিপজ্জনক উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী গুদামজাত না করা হলে কেমিক্যাল একসঙ্গে হয়ে বড় ধরনের বিস্ফোরণ-বিক্রিয়া হতে পারে। যে কারণে এখানে সময় লাগছে।
ছাদের দরজায় তালা, রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়ায় অজ্ঞান শ্রমিকরা
রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগার পর চারদিকে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দ্রুত আক্রান্ত হন ঠিক পাশের চার তলা পোশাক কারখানার ভবনটির কর্মীরা। কারখানা দুটির আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কাজের সময় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, পাশের কারখানার আগুন দ্রুত সরু গলির ওপারের পোশাক কারখানার ভবনের নিচে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে পোশাক কারখানার কর্মীরা নিচে নামতে পারেননি। আবার ছাদের দরজায় তালা থাকায় ধোঁয়া থেকে বাঁচতে ওপরেও যেতে পারেননি।
উদ্ধারকারী কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এ কারণে কর্মস্থলেই বিষাক্ত ধোঁয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন পোশাক কারখানাটির ওপর তলায় থাকা কর্মীরা। পরে সেই ভবনের ওপরের দিকে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়লে পুড়ে অঙ্গার হতে হয় তাদের। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৬টি লাশ উদ্ধারের তথ্য দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সব লাশ উদ্ধার হয়েছে পোশাক কারখানা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে বলেন, ‘চার তলা পোশাক কারখানার ওপরে ছাদ টিনের। ছাদে যাওয়ার জন্য সেখানে একটি গ্রিলের দরজা রয়েছে। সেটি তালা মারা ছিল। এ কারণে তারা ওপরের দিকে যেতে পারেননি। ‘আপনারা জানেন যে পরিমাণ কেমিক্যাল বিস্ফোরণ, সেটার ফ্ল্যাশওভারে টক্সিক গ্যাসের কারণে আকস্মিকভাবে ওনারা অজ্ঞান হয়েছেন। পরে তারা সরতে পারেননি। ওপরে যেতে পারেননি, নিচেও যেতে পারেননি।’
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল বলেন, পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামের কোনটিরই অনুমোদন ছিল না। কোনো ধরনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না। তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, ‘মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে যে কারখানায় আগুন লেগেছে, তা বিজিএমইএ এর সদস্যভুক্ত কোনো পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি ওয়াশিং কারখানা।’ এটির নাম শাহ আলী ওয়াশিং লিমিটেড বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য দিয়েছে সংগঠনটি।
প্রত্যক্ষদর্শী দাবিদার ইয়াসিন আলিফ নামে একজন বলেন, ‘কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন লাগার পর একটা ব্লাস্ট হইছে। তখনই গুদামের সামনে যেই বিল্ডিংয়ে গার্মেন্টস ওইটার নিচ তলায় আগুন লাইগা যায়। কেমিক্যাল গোডাউনের টিনের ফাঁক দিয়া আগুন বাহির হইতেছিল যেন কেউ ওয়েল্ডিং টর্চ জ্বালাইছে।’ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গোডাউনের সামনে একটি ছোট কাভার্ডভ্যান ছিল, সেইটাতেও আগুন লাইগা যায়। তখনো কয়েকটা ব্লাস্ট হয়, এরপর গার্মেন্টসের পুরা বিল্ডিংটাতে আগুন লাগে।’
# গত ২৮ ঘণ্টার চেষ্টায় রূপনগরের আগুন নিয়ন্ত্রণে
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন প্রায় ২৮ ঘণ্টা চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট সর্বশেষ কাজ করে ঘটনাস্থলে। ভয়াবহ এ আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন্য নিহত হয়েছে। বুধবার বিকেলে ৪টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম। তিনি বলেন, বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সর্বশেষ আমাদের ৫টি ইউনিট কাজ করছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অক্সিজেন ট্যাংক নিয়ে, গ্যাস মাস্ক পড়ে সেখানে কাজ করছেন। এদিন দুপুরে অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে বুয়েটের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।