alt

কৃষির ইতিহাস নওগাঁর ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর’

জেলা বার্তা পরিবেশক, নওগাঁ : বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে কৃষি জাদুঘর -সংবাদ

সকালের রোদ তখন কৃষিজমির ঘাসে ঝলমল করছে। দূরে গরুর ঘণ্টার শব্দ, কাকের ডাক আর হালচাষে ব্যস্ত কৃষকের হুঁকো টানার বিরাম। রাজশাহী থেকে নওগাঁর পথে যতই এগুনো যায়, ততই বদলে যায় দৃশ্যপট। ধীরে ধীরে পিচঢালা রাস্তাগুলো হারিয়ে যায় কাঁচা মাটির ঘ্রাণে, আর তারই মাঝে নীরব এক গ্রাম- কালীগ্রাম, মান্দা উপজেলার দক্ষিণে।

দেশের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিগত কৃষি জাদুঘর এটি

প্রায় দেড় হাজার প্রাচীন কৃষি সামগ্রী বা উপকরণ রয়েছে

একই ছাদের নিচে একসঙ্গে পাঠাগার, শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র

এ গ্রামেই, কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের কৃষির অতীত ও ঐতিহ্যের জীবন্ত স্মারক ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর।’ দেশের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিগত কৃষি জাদুঘর এটি, প্রতিষ্ঠাতা রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ।

মাটির টানে গড়ে তোলা এক স্বপ্ন

‘আমার শৈশব কেটেছে ধানের গোলার পাশে, লাঙল আর জোয়ালের সঙ্গেই বড় হয়েছি,’ বললেন জাহাঙ্গীর আলম শাহ। তিনি যোগ করেন, ‘আজকের প্রজন্ম জানে না কীভাবে কৃষি আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিল। আমি চেয়েছি সেই ইতিহাসটুকু বাঁচিয়ে রাখতে।’

২০০৮ সালে নিতান্ত শখেই কৃষিবিষয়ক বই সংগ্রহ শুরু করেন তিনি। পরে নিজের পৈতৃক সম্পত্তির তিন একর জমিতে গড়ে তোলেন পাঠাগার, ধীরে ধীরে কৃষি উপকরণ, যন্ত্রপাতি, ও কৃষকের ব্যবহার্য সামগ্রী জড়ো করে তোলেন কৃষি জাদুঘরটি।

কৃষির ইতিহাসের নিদর্শন

জাদুঘরে প্রবেশ করলেই মনে হয়, যেন সময় থমকে আছে। ছাদের সঙ্গে ঝুলছে মাথাল, লাঙল, জোয়াল, গরুর গাড়ির ছই, সেচের যন্ত্র, ঢেঁকি, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, মাছ ধরার চাঁই-পলই, ফসল মাড়াইয়ের গাদন কাঠি- সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার প্রাচীন কৃষিপণ্য।

নয়টি ঘরে সাজানো এসব সামগ্রী দেখলে মনে হয়, এটি শুধু সংগ্রহ নয়, এক জীবন্ত পাঠশালা। দেয়ালজুড়ে ‘শাহ কৃষি পঞ্জিকা’ যেখানে বারো মাসের কৃষিকাজ, বীজ নির্বাচন, রোগবালাই দমন, আবহাওয়ার নির্দেশনা সব একসঙ্গে লেখা।

পাঠাগার, শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র

‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার’- রয়েছে শত শত কৃষিবিষয়ক বই, ম্যাগাজিন, পুস্তক ও গবেষণাপত্র। এখানে প্রতিদিন স্থানীয় কৃষক, কৃষি শিক্ষার্থী ও গবেষকরা এসে সময় কাটান। বিকেলে বসে শিশুদের পাঠশালা যেখানে দরিদ্র শিশুরা বিনা খরচে বই পড়ে ও গল্প শোনে। স্থানীয় কৃষক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমার ধানে পোকা ধরেছিল। এখানকার বই পড়ে বুঝেছি কীভাবে ওষুধ দিতে হয়। আমাদের গ্রামের জন্য এই জায়গাটা এখন আশীর্বাদ।’

একই উপজেলার সতীহাট জিএস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর কৃষি শিক্ষার্থী ফারিহা হোসেন কৃপা বলেন, ‘আমরা কৃষি প্রযুক্তি পড়ি, কিন্তু অনেক পুরোন যন্ত্র দেখি না। এখানে এসে সেই ইতিহাস দেখা যায়, মনে হয় বইয়ের বিষয়গুলো চোখের সামনে জীবন্ত।’

দর্শনার্থীর চোখে কৃষি জাদুঘর কালীগ্রামের প্রবেশপথেই দেখা মেলে দৃষ্টিনন্দন এক বোর্ডে লেখা ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর’। ফুলে ঘেরা প্রাঙ্গণ, পাখির কলরব আর খোলা মাঠের হাওয়া দর্শনার্থীদের মনে অন্যরকম প্রশান্তি এনে দেয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী ইরিন জামান কথা বলেন, ‘শুধু কৃষি নয়, এটি বাংলার ইতিহাস দেখায়। আমি প্রথমবার এসে বুঝলাম, আমাদের কৃষি কত বৈচিত্র্যময় ছিল।’

স্থানীয় পর্যটক মো. রফিকুল ইসলাম সরদার বলেন, ‘শুধু বইয়ে নয়, হাতে-কলমে কৃষির ইতিহাস শেখার জায়গা এটি। আমি আমার সন্তানদের এখানে এনেছি যেন তারা জানে তাদের শিকড় কোথায়।’

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও প্রশংসা

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেক্স স্টার করপোরেশনের পরিচালক ও কিডনি বিশেষজ্ঞ ড. স্টিভেন গেস্ট এ জাদুঘর পরিদর্শনে এসে বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের মাটির গন্ধমাখা ইতিহাস যা যেকোনো দেশের জন্য অনুপ্রেরণার।’

পরের বছর জাপানের চিকিৎসক ড. কাতাসু হিরো ইয়ামাশিতা ও তার স্ত্রী সেইকো ইয়ামাশিতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মল্লিকা ব্যানার্জি এখানে ঘুরে গিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।

জাদুঘরের কেয়ারটেকার হজরত আলী জানান, ‘দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে। কেউ বই দেয়, কেউ পুরোন কৃষিযন্ত্র দান করে যান। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি সবার জন্য খোলা থাকে।’

কৃষি, সংস্কৃতি ও মানবিকতার সংযোগ

শুধু যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী নয়, এই জাদুঘর এখন এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় কৃষি উৎসব, যেখানে কৃষকরা তাদের ঐতিহ্যবাহী উপকরণ ও বীজ প্রদর্শন করেন।

জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, ‘আমি চাই, কৃষক যেন নিজের কাজের গর্ব অনুভব করে। এই জাদুঘর তাদেরই গল্প বলে যারা ঘাম ঝরিয়ে আমাদের আহার যোগায়।’

স্থানীয় শিক্ষক কালীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রতন প্রসাদ ফনি বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রায়ই এখানে আসি। এটি ইতিহাস শেখায়, শ্রদ্ধা শেখায়, মাটির প্রতি ভালোবাসা শেখায়।’

সবুজে গড়া গর্ব

আজ ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর’ শুধু একটি সংগ্রহশালা নয়; এটি একটি চেতনার কেন্দ্র। কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিকতার সেতুবন্ধ ঘটিয়েছে এই স্থাপনা।

রাজশাহীর এই শিক্ষক নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন এমন এক নিদর্শন, যা প্রমাণ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও একাগ্রতা, জ্ঞান ও ভালোবাসা দিয়ে কীভাবে ইতিহাস সংরক্ষণ করা যায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হুমায়রা ম-ল বলেন, ‘আমাদের কৃষি শুধু উৎপাদনের গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি সংস্কৃতি। কালীগ্রামের এই ‘শাহ কৃষি জাদুঘর’ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ের। এখানে যেমন কৃষি ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে, তেমনি নতুন প্রজন্মের শেখার জন্য এটি এক জীবন্ত পাঠাগার। জাহাঙ্গীর আলম শাহের এই প্রয়াস আমাদের কৃষিকে নতুনভাবে দেখার অনুপ্রেরণা জোগাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি যেমন অপরিহার্য, তেমনি কৃষির শিকড় জানা দরকার। এই জাদুঘর সেই শিকড়কে স্পর্শ করার সুযোগ দিচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও আমরা চাই, এ ধরনের উদ্যোগগুলো আরও ছড়িয়ে পড়ুক এবং স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি-সংস্কৃতি সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক।’

নওগাঁর কালীগ্রামের এই জাদুঘর এখন বাংলাদেশের কৃষি ঐতিহ্যের মুকুটমণি। এটি যেমন অতীতের দলিল, তেমনি ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা।

ছবি

‘ঢাকা লকডাউন’, বিভিন্ন জায়গায় যানবাহনে আগুন, আতঙ্ক জনমনে

৭ দিনে নদী থেকে ৭ লাশ উদ্ধার: নৌ-পুলিশ

বরাট ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র এখন মাদকসেবীদের দখলে

ছবি

সোনারগাঁয়ে আওয়ামী লীগের লকডাউন, বিএনপির অবস্থান কর্মসূচী, মহাসড়কে চলেনি দূরপাল্লার বাহন

ছবি

রাজশাহীতে বিচারকের ছেলে সুমন খুন, স্ত্রী গুরুতর আহত

ছবি

বিলুপ্তির পথে লালপুরের ঐতিহ্যবাহী চাকা শিল্প

ছবি

চাটখিলে গাঁজাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার

ছবি

অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন মামলায় বন কর্মকর্তা কারাগারে

ছবি

সিরাজদিখানে সরকারি জায়গা দখলের চেষ্টায় জরিমানা

ছবি

কালিয়াকৈরে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ

ছবি

মোংলায় ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যানসহ আটক ২

ছবি

গোয়ালন্দে জুট মিলে অগ্নিকাণ্ড

ছবি

মহেশপুরে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে মতবিনিময়

ছবি

ডিমলায় ৭ দিনেও উদ্ধার হয়নি অপহৃত মাদ্রাসা ছাত্রী

ছবি

দশমিনায় নবান্ন উৎসবের আমেজ বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে পাকা ধান

ছবি

বোয়ালখালীতে বেশি লাভের আশায় আগাম শীতকালীন সবজি চাষ

ছবি

লালমনিরহাটে ভেজাল বীজ বিক্রির দায়ে ৪ ব্যবসায়ীকে জরিমানা

নবীগঞ্জে ফিশারি থেকে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার

ছবি

লালপুরে আমনের বাম্পার ফলনে কৃষকের হাসি

ছবি

তাহিরপুরে সাবেক যুবলীগ সভাপতি আটক

ছবি

জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

গৌরীপুরে বিদ্যুৎপৃষ্টে দিনমজুরে মৃত্যু

ছবি

কাজিপুরে শীতকালীন সবজিতে স্বস্তি ফিরছে বাজারে

ছবি

নবাবগঞ্জে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু

ডিমলায় ৫ খাদ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

ছবি

শ্রীপুরের দক্ষিণ বেড়াইদেরচালা-বেলতলি সড়কের এক’শ ফুট অংশে বছর জুড়েই পানি, দুর্ভোগে এলাকাবাসী

ছবি

নবীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই নেতা আটক

ছবি

রাণীশংকৈলে সরকারি সার বরাদ্দে অনিয়ম, ডিলারকে জরিমানা

ছবি

ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় সাত যানবাহনে আগুন

ছবি

চাটমোহরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ২০ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি

ছবি

দুমকিতে কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী তালগাছ

ছবি

ঝালকাঠিতে আমনের বাম্পার ফলনের আশা ধান কর্তন শুরু

ছবি

মতলবে ২৩ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলছে পাঠদান

ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গভীর রাতে রেললাইনে আগুন, সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল ট্রেন চলাচল

পদ্মা সেতুর সামনে অবরোধ, ট্রাকে আগুন

ছবি

গোপালগঞ্জে শিশুকে ধর্ষণচেষ্টা, চড়-থাপ্পড় দিয়েই ‘মীমাংসা’ করলেন মাতবররা

tab

কৃষির ইতিহাস নওগাঁর ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর’

জেলা বার্তা পরিবেশক, নওগাঁ

মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে কৃষি জাদুঘর -সংবাদ

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

সকালের রোদ তখন কৃষিজমির ঘাসে ঝলমল করছে। দূরে গরুর ঘণ্টার শব্দ, কাকের ডাক আর হালচাষে ব্যস্ত কৃষকের হুঁকো টানার বিরাম। রাজশাহী থেকে নওগাঁর পথে যতই এগুনো যায়, ততই বদলে যায় দৃশ্যপট। ধীরে ধীরে পিচঢালা রাস্তাগুলো হারিয়ে যায় কাঁচা মাটির ঘ্রাণে, আর তারই মাঝে নীরব এক গ্রাম- কালীগ্রাম, মান্দা উপজেলার দক্ষিণে।

দেশের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিগত কৃষি জাদুঘর এটি

প্রায় দেড় হাজার প্রাচীন কৃষি সামগ্রী বা উপকরণ রয়েছে

একই ছাদের নিচে একসঙ্গে পাঠাগার, শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র

এ গ্রামেই, কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের কৃষির অতীত ও ঐতিহ্যের জীবন্ত স্মারক ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর।’ দেশের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিগত কৃষি জাদুঘর এটি, প্রতিষ্ঠাতা রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ।

মাটির টানে গড়ে তোলা এক স্বপ্ন

‘আমার শৈশব কেটেছে ধানের গোলার পাশে, লাঙল আর জোয়ালের সঙ্গেই বড় হয়েছি,’ বললেন জাহাঙ্গীর আলম শাহ। তিনি যোগ করেন, ‘আজকের প্রজন্ম জানে না কীভাবে কৃষি আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিল। আমি চেয়েছি সেই ইতিহাসটুকু বাঁচিয়ে রাখতে।’

২০০৮ সালে নিতান্ত শখেই কৃষিবিষয়ক বই সংগ্রহ শুরু করেন তিনি। পরে নিজের পৈতৃক সম্পত্তির তিন একর জমিতে গড়ে তোলেন পাঠাগার, ধীরে ধীরে কৃষি উপকরণ, যন্ত্রপাতি, ও কৃষকের ব্যবহার্য সামগ্রী জড়ো করে তোলেন কৃষি জাদুঘরটি।

কৃষির ইতিহাসের নিদর্শন

জাদুঘরে প্রবেশ করলেই মনে হয়, যেন সময় থমকে আছে। ছাদের সঙ্গে ঝুলছে মাথাল, লাঙল, জোয়াল, গরুর গাড়ির ছই, সেচের যন্ত্র, ঢেঁকি, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, মাছ ধরার চাঁই-পলই, ফসল মাড়াইয়ের গাদন কাঠি- সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার প্রাচীন কৃষিপণ্য।

নয়টি ঘরে সাজানো এসব সামগ্রী দেখলে মনে হয়, এটি শুধু সংগ্রহ নয়, এক জীবন্ত পাঠশালা। দেয়ালজুড়ে ‘শাহ কৃষি পঞ্জিকা’ যেখানে বারো মাসের কৃষিকাজ, বীজ নির্বাচন, রোগবালাই দমন, আবহাওয়ার নির্দেশনা সব একসঙ্গে লেখা।

পাঠাগার, শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র

‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার’- রয়েছে শত শত কৃষিবিষয়ক বই, ম্যাগাজিন, পুস্তক ও গবেষণাপত্র। এখানে প্রতিদিন স্থানীয় কৃষক, কৃষি শিক্ষার্থী ও গবেষকরা এসে সময় কাটান। বিকেলে বসে শিশুদের পাঠশালা যেখানে দরিদ্র শিশুরা বিনা খরচে বই পড়ে ও গল্প শোনে। স্থানীয় কৃষক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমার ধানে পোকা ধরেছিল। এখানকার বই পড়ে বুঝেছি কীভাবে ওষুধ দিতে হয়। আমাদের গ্রামের জন্য এই জায়গাটা এখন আশীর্বাদ।’

একই উপজেলার সতীহাট জিএস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর কৃষি শিক্ষার্থী ফারিহা হোসেন কৃপা বলেন, ‘আমরা কৃষি প্রযুক্তি পড়ি, কিন্তু অনেক পুরোন যন্ত্র দেখি না। এখানে এসে সেই ইতিহাস দেখা যায়, মনে হয় বইয়ের বিষয়গুলো চোখের সামনে জীবন্ত।’

দর্শনার্থীর চোখে কৃষি জাদুঘর কালীগ্রামের প্রবেশপথেই দেখা মেলে দৃষ্টিনন্দন এক বোর্ডে লেখা ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর’। ফুলে ঘেরা প্রাঙ্গণ, পাখির কলরব আর খোলা মাঠের হাওয়া দর্শনার্থীদের মনে অন্যরকম প্রশান্তি এনে দেয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী ইরিন জামান কথা বলেন, ‘শুধু কৃষি নয়, এটি বাংলার ইতিহাস দেখায়। আমি প্রথমবার এসে বুঝলাম, আমাদের কৃষি কত বৈচিত্র্যময় ছিল।’

স্থানীয় পর্যটক মো. রফিকুল ইসলাম সরদার বলেন, ‘শুধু বইয়ে নয়, হাতে-কলমে কৃষির ইতিহাস শেখার জায়গা এটি। আমি আমার সন্তানদের এখানে এনেছি যেন তারা জানে তাদের শিকড় কোথায়।’

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও প্রশংসা

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেক্স স্টার করপোরেশনের পরিচালক ও কিডনি বিশেষজ্ঞ ড. স্টিভেন গেস্ট এ জাদুঘর পরিদর্শনে এসে বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের মাটির গন্ধমাখা ইতিহাস যা যেকোনো দেশের জন্য অনুপ্রেরণার।’

পরের বছর জাপানের চিকিৎসক ড. কাতাসু হিরো ইয়ামাশিতা ও তার স্ত্রী সেইকো ইয়ামাশিতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মল্লিকা ব্যানার্জি এখানে ঘুরে গিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন।

জাদুঘরের কেয়ারটেকার হজরত আলী জানান, ‘দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে। কেউ বই দেয়, কেউ পুরোন কৃষিযন্ত্র দান করে যান। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি সবার জন্য খোলা থাকে।’

কৃষি, সংস্কৃতি ও মানবিকতার সংযোগ

শুধু যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী নয়, এই জাদুঘর এখন এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় কৃষি উৎসব, যেখানে কৃষকরা তাদের ঐতিহ্যবাহী উপকরণ ও বীজ প্রদর্শন করেন।

জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, ‘আমি চাই, কৃষক যেন নিজের কাজের গর্ব অনুভব করে। এই জাদুঘর তাদেরই গল্প বলে যারা ঘাম ঝরিয়ে আমাদের আহার যোগায়।’

স্থানীয় শিক্ষক কালীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রতন প্রসাদ ফনি বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রায়ই এখানে আসি। এটি ইতিহাস শেখায়, শ্রদ্ধা শেখায়, মাটির প্রতি ভালোবাসা শেখায়।’

সবুজে গড়া গর্ব

আজ ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর’ শুধু একটি সংগ্রহশালা নয়; এটি একটি চেতনার কেন্দ্র। কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিকতার সেতুবন্ধ ঘটিয়েছে এই স্থাপনা।

রাজশাহীর এই শিক্ষক নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন এমন এক নিদর্শন, যা প্রমাণ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও একাগ্রতা, জ্ঞান ও ভালোবাসা দিয়ে কীভাবে ইতিহাস সংরক্ষণ করা যায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হুমায়রা ম-ল বলেন, ‘আমাদের কৃষি শুধু উৎপাদনের গল্প নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি সংস্কৃতি। কালীগ্রামের এই ‘শাহ কৃষি জাদুঘর’ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ের। এখানে যেমন কৃষি ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে, তেমনি নতুন প্রজন্মের শেখার জন্য এটি এক জীবন্ত পাঠাগার। জাহাঙ্গীর আলম শাহের এই প্রয়াস আমাদের কৃষিকে নতুনভাবে দেখার অনুপ্রেরণা জোগাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি যেমন অপরিহার্য, তেমনি কৃষির শিকড় জানা দরকার। এই জাদুঘর সেই শিকড়কে স্পর্শ করার সুযোগ দিচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও আমরা চাই, এ ধরনের উদ্যোগগুলো আরও ছড়িয়ে পড়ুক এবং স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি-সংস্কৃতি সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক।’

নওগাঁর কালীগ্রামের এই জাদুঘর এখন বাংলাদেশের কৃষি ঐতিহ্যের মুকুটমণি। এটি যেমন অতীতের দলিল, তেমনি ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা।

back to top