alt

বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক : মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছেই; টানা সাত মাস ধরে কমে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের প্রবৃদ্ধি ফেব্রুয়ারিতে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে এসেছে। এই প্রবৃদ্ধি ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির পরে আর কখনও এতটা কম হয়নি বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি।

বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের নিম্নমুখী এই ধারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০২২ সালের নভেম্বরে শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে তা আরও কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের নিম্নমুখী এই ধারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০২২ সালের নভেম্বরে শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে তা আরও কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনতিবিদ ও ব্যাংকাররা

বাংলাদেশ ব্যাংক গত রোববার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অষ্টম মাস এবং নতুন বছরের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়েছে।

আগের মাস জানুয়ারিতে এই হার ছিল ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। তার আগে নভেম্বরে ৭ দশমিক ৬৬, অক্টোবরে ৮ দশমিক ৩০, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ২০, আগস্টে ৯ দশমিক ৮৬, জুলাইয়ে ১০ দশমিক ১৩ এবং জুনে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। এ হিসাবেই ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা আছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। সে হিসাবে ফেব্রুয়ারিতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৯৮ শতাংশীয় পয়েন্ট কম হয়েছে প্রবৃদ্ধি।

বিনিয়োগ মানেই অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য, বিনিয়োগ মানেই নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে দেয় স্বস্তি। এই সূত্রে বাংলাদেশ এখন আছে অস্বস্তিতে। শুধু তাই নয়, নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানিও আশঙ্কাজনভাবে কমছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মূল্যধনী যন্তপাতি আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে ৩০ দশমিক ১০ শতাংশ।

এই আট মাসে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য ১১৫ কোটি ৪০ লাখ (১.১৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ১৬৫ কোটি ১০ লাখ (১.৬৫ বিলিয়ন) ডলার। সব মিলিয়ে দেশে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা নিয়ে চিন্তায় আছেন উদ্যোক্তারা।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। সেই খাতে ঋণপ্রবাহ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ার অর্থ হলো বিনিয়োগ থমকে যাওয়া। আর বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে না। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

আগের চেয়ে বিনিয়োগ এখন অনেক বেশি দামি হয়ে গেছে। একদিকে বেড়েছে ডলারের দাম, অন্যদিকে ব্যাংক সুদহারও চড়া। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ করতে গেলে আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বাজারে পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের জন্য এ সময়টাকে মোটেই অনুকূল মনে করছেন না ব্যবসায়ীরা।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসার পরিবেশে অনিশ্চয়তা আর ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহারের প্রভাবে গত কয়েক মাস বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়িয়েই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। উঠেছে ১০ শতাংশে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের আট মাস পার হয়েছে। এখনও দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি।

তবে মূল্যস্ফীতি নিম্মমুখী হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, নতুন বছরের তৃতীয় মাস মার্চে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। চার মাস পর গত জানুয়ারিতে এই সূচক এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট), ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নামে।

অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মানে হলো ব্যবসা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাবে। সেই সঙ্গে কমবে নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণের গতি। অবধারিতভাবে তার প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শুরু থেকেই অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশ উত্তাল হতে শুরু করে। একপর্যায়ে ছাত্রদের আন্দোলনে সহিংস ঘটনায় দেশে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর সেই অস্থিরতা আরও বাড়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। সেই পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই। ২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। করোনা মহামারির ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।

ছবি

পাঁচ বেসরকারি শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করার প্রথম ধাপে প্রশাসক বসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক

ছবি

কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ পেছানোর বিরোধিতা করছে

ছবি

শেয়ারবাজারে লেনদেন নামলো ৬শ’ কোটি টাকার ঘরে

ছবি

ব্যবসা মাঝে মন্থর ছিল, এখন একটু ভালো: অর্থ উপদেষ্টা.

ছবি

অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরে আশাবাদী জাপানি রাষ্ট্রদূত

ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংকে সভা: একীভূত হচ্ছে পাঁচ ব্যাংক, বসছে প্রশাসক

ছবি

বিজিএমইএ–মার্কিন প্রতিনিধিদল বৈঠক: শুল্ক কমাতে আহ্বান

ছবি

জুলাই-আগস্টে এডিপি বাস্তবায়ন ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ

ছবি

বিবিএসের নাম পরিবর্তন ও তদারক পরিষদ রাখার সুপারিশ

ছবি

শ্রম আইন সংশোধন দ্রুত শেষ করার তাগিদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের

ছবি

নগদ অর্থের ব্যবহার কমাতে আসছে একীভূত পেমেন্ট সিস্টেম: গভর্নর

ছবি

আড়াই মাসে ১৩৯ কোটি ডলার কিনলো বাংলাদেশ ব্যাংক

ছবি

ডিজিটাল ব্যাংক খুলতে আবেদনের সময় বাড়লো ২ নভেম্বর পর্যন্ত

ছবি

পুঁজিবাজারে সূচকের নামমাত্র উত্থান, লেনদেন আরও তলানিতে

ছবি

চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে খরচ বাড়লো ৪১ শতাংশ

ছবি

বাংলাদেশের বাজারে লেনোভো ভি সিরিজের নতুন ল্যাপটপ

ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরও কমতে পারে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

ছবি

বাজারে গিগাবাইট এআই টপ ১০০ জেড৮৯০ পিসি

ছবি

কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা

ছবি

শেয়ারবাজারে বড় পতন, এক মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন

ছবি

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমার সফটওয়্যার চালু করলো এনবিআর

ছবি

ট্রাস্ট ব্যাংকের এটিএম ও ডেবিট কার্ডসেবা সাময়িক বন্ধ থাকবে

ছবি

বেপজার ইপিজেডগুলোতে শ্রমিকদের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ প্রদান শুরু

ছবি

বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিসে আরও ৫ সেবা যুক্ত

ছবি

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পেছাতে ব্যবসায়ীদের সক্রিয় হওয়ার আহ্বান

ছবি

আড়াইগুণ প্রতিষ্ঠানের দরপতনে বাজার মূলধন কমলো ৩ হাজার কোটি টাকা

ছবি

পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনা করতে পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনা করতে রোববার ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল

ছবি

বাংলাদেশে ব্লুটুথ হেডফোন ও ডেটা কেবল তৈরির কারখানা করবে চীন

ছবি

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমার প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার নিয়ম

ছবি

বাংলাদেশের বাজারে অপো এ৫ এর নতুন ভ্যারিয়েন্ট

ছবি

নিত্যপণ্যের বাজারে সবজির সঙ্গে বেড়েছে চাল ও মুরগির দামও

ছবি

ডিসেম্বরের মধ্যে এনবিআরের কার্যক্রম দুই ভাগ হয়ে যাবে

ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৭ মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২২ শতাংশ

ছবি

শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর আমানত এক মাসে বেড়েছে ৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা

ছবি

বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ৩০০ শতাংশ বেড়েছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

ছবি

সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানিতে মূসক অব্যাহতি

tab

বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছেই; টানা সাত মাস ধরে কমে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের প্রবৃদ্ধি ফেব্রুয়ারিতে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে এসেছে। এই প্রবৃদ্ধি ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির পরে আর কখনও এতটা কম হয়নি বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি।

বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের নিম্নমুখী এই ধারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০২২ সালের নভেম্বরে শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে তা আরও কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের নিম্নমুখী এই ধারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০২২ সালের নভেম্বরে শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে তা আরও কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনতিবিদ ও ব্যাংকাররা

বাংলাদেশ ব্যাংক গত রোববার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অষ্টম মাস এবং নতুন বছরের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়েছে।

আগের মাস জানুয়ারিতে এই হার ছিল ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। তার আগে নভেম্বরে ৭ দশমিক ৬৬, অক্টোবরে ৮ দশমিক ৩০, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ২০, আগস্টে ৯ দশমিক ৮৬, জুলাইয়ে ১০ দশমিক ১৩ এবং জুনে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। এ হিসাবেই ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা আছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। সে হিসাবে ফেব্রুয়ারিতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৯৮ শতাংশীয় পয়েন্ট কম হয়েছে প্রবৃদ্ধি।

বিনিয়োগ মানেই অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য, বিনিয়োগ মানেই নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে দেয় স্বস্তি। এই সূত্রে বাংলাদেশ এখন আছে অস্বস্তিতে। শুধু তাই নয়, নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানিও আশঙ্কাজনভাবে কমছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মূল্যধনী যন্তপাতি আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে ৩০ দশমিক ১০ শতাংশ।

এই আট মাসে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য ১১৫ কোটি ৪০ লাখ (১.১৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ১৬৫ কোটি ১০ লাখ (১.৬৫ বিলিয়ন) ডলার। সব মিলিয়ে দেশে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা নিয়ে চিন্তায় আছেন উদ্যোক্তারা।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। সেই খাতে ঋণপ্রবাহ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ার অর্থ হলো বিনিয়োগ থমকে যাওয়া। আর বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে না। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

আগের চেয়ে বিনিয়োগ এখন অনেক বেশি দামি হয়ে গেছে। একদিকে বেড়েছে ডলারের দাম, অন্যদিকে ব্যাংক সুদহারও চড়া। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ করতে গেলে আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বাজারে পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের জন্য এ সময়টাকে মোটেই অনুকূল মনে করছেন না ব্যবসায়ীরা।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসার পরিবেশে অনিশ্চয়তা আর ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহারের প্রভাবে গত কয়েক মাস বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়িয়েই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। উঠেছে ১০ শতাংশে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের আট মাস পার হয়েছে। এখনও দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসেনি।

তবে মূল্যস্ফীতি নিম্মমুখী হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, নতুন বছরের তৃতীয় মাস মার্চে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। চার মাস পর গত জানুয়ারিতে এই সূচক এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট), ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নামে।

অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মানে হলো ব্যবসা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাবে। সেই সঙ্গে কমবে নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণের গতি। অবধারিতভাবে তার প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শুরু থেকেই অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশ উত্তাল হতে শুরু করে। একপর্যায়ে ছাত্রদের আন্দোলনে সহিংস ঘটনায় দেশে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর সেই অস্থিরতা আরও বাড়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। সেই পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই। ২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। করোনা মহামারির ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।

back to top