চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো। সোমবার, (১৭ নভেম্বর ২০২৫) ঢাকার একটি হোটেলে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টেইন ভ্যান ডোঙ্গেন চুক্তি সই করেন।

এটি দেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প এবং এককভাবে সর্ববৃহৎ ইউরোপীয় বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) হিসেবে বিবেচিত।

নৌ-উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, পিপিপি কর্তৃপক্ষ ও বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, ডেনমার্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বিষয়ক স্টেট সেক্রেটারি লিনা গেন্ডলস হেনসেন এবং ঢাকায় ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টিয়ান ব্রিক্স মুলার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেন, ‘এ চুক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জন্য বড় অবদান। যাদের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ ছিল, আশা করি আজ তা দূর হবে।’

চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, ‘লালদিয়া দেখিয়ে দিয়েছে পিপিপি শুধু তত্ত্বে নয়, বাস্তবেও কার্যকর। ভবিষ্যতেও আমরা বাস্তবায়নকেন্দ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নেই মনোযোগ দেব।

এপি মুলারের মূল কোম্পানি মেয়ার্স্কের চেয়ারম্যান রবার্ট মেয়ার্স্ক উগলা বলেন, ‘লালদিয়ায় হচ্ছে ইউরোপের কোনো দেশের একক বৃহৎ বিনিয়োগ। লালদিয়া হবে অত্যাধুনিক গ্রিনফিল্ড টার্মিনাল। সেখানে নিরাপত্তা, অটোমেশন ও স্থায়িত্বের সর্বোচ্চ মান থাকবে। এতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। সেই সঙ্গে লজিস্টিকস খাতের অগ্রযাত্রায় এটি বিশেষ মুহূর্ত হয়ে থাকবে।’

চুক্তির শর্তসমূহ

বিডার পক্ষ থেকে বলা হয়, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল একটি ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ প্রকল্প। এর সম্পূর্ণ বিনিয়োগ হবে এপিএমের পক্ষ থেকে। ‘সাইনিং মানি’ হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা এবং নির্মাণকালে সবমিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে এপিএম। সরকার থেকে কোনো অর্থায়ন বা গ্যারান্টি দেয়া হচ্ছে না।

* নির্মাণের পর চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছর। এ সময়ে সব বাণিজ্যিক, সামাজিক ও পরিবেশগত শর্ত মেনে চললে মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে।

* যত কনটেইনার হ্যান্ডেল করা হবে, প্রত্যেকটির জন্য নির্দিষ্ট ফি পাবে সরকার। যত বেশি ভলিউম করবে তত বেশি আয় হবে। কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বন্ধ থাকলেও সরকার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ পাবে।

* নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে থাকবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বিডা চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক বলেন, বন্দর নির্মাণ হলে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৮ লাখ টিইইউ ধারণক্ষমতা যুক্ত হবে, যা বর্তমান সক্ষমতার তুলনায় প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। প্রতি ইউনিটে পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে। এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ বড় কনটেইনার জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারবে। এছাড়া ৫০০-৭০০ সরাসরি স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি হবে নির্মাণ ও পরিচালনা পর্যায়ে। হাজারের বেশি পরোক্ষ স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে পরিবহন, লজিস্টিকস ও বৃহত্তর সাপ্লাই চেইনে। এপিএম টার্মিনালের নিজস্ব ট্রেনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্থানীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকরা বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ পাবেন।

লালদিয়া বাংলাদেশের জন্য নতুন যুগের সূচনা : প্রধান উপদেষ্টা

চুক্তি সই অনুষ্ঠান শেষে বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ডেনিশ প্রতিনিধি দল। সোমবার, যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মায়ের্স্ক গ্রুপ ও ডেনিশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, লালদিয়া টার্মিনালে ডেনমার্কের কোম্পানি এপিএম টার্মিনালসের বিনিয়োগ বাংলাদেশের বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করেছে। তিনি বলেন, এটি দেশের জন্য একটি নতুন সূচনা। এটি ডেনমার্ক ও ইউরোপ থেকে বৃহত্তর ও বহুমুখী বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচন করছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানায়।

এপিএম (এপি মোলার-মায়ের্স্ক) টার্মিনালসের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মায়ের্স্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান রবার্ট মায়ের্স্ক উগলা প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দেন। ডেনমার্কের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক স্টেট সেক্রেটারি লিনা গান্দলোসে হ্যানসেনও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

রবার্ট মায়ের্স্ক উগলা বলেন, ২০৩০ সালে লালদিয়া টার্মিনাল চালু হলে এটি চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ আগমনের সুযোগ তৈরি করবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতি সঞ্চার করবে।

মায়ের্স্ক গ্রুপ চেয়ারম্যান আরও জানান, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিপিং লাইন মালিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা বাংলাদেশের লজিস্টিকস ও সাপ্লাই চেইন খাতে আরও বিনিয়োগের সুযোগ অন্বেষণ করবে।

গত জানুয়ারিতে দাভোসে বৈঠকের পর বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য উগলাকে ধন্যবাদ জানান প্রধান উপদেষ্টা।

ডেনিশ কোম্পানির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত। অধ্যাপক ইউনূস এপিএম টার্মিনালসকে লালদিয়া টার্মিনালের নির্মাণ দ্রুত সম্পন্ন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এটি হবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবেশদ্বার। এটি ভবিষ্যতের দ্বার উন্মোচন করবে।