alt

নগর-মহানগর

এখনও কৈশোর পেরোয়নি, সরাচ্ছে সমাজের জঞ্জাল

জাহিদা পারভেজ ছন্দা : শনিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় এই কিশোর-কিশোরীরা আনন্দ-উল্লাসে, করছে কর্মে সহযোগিতা -সংবাদ

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার একদল কিশোর-কিশোরী। বয়স এদের ১২ থেকে ১৮ বছর। কিন্তু এরাই পণ করেছে সরাবে সমাজের আবর্জনা। শুরু করেছিল একটি স্কুলে বহু বছর ধরে জমা হয়ে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পাঠদানের উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়ে। এরপর শিশু বয়সে বিয়ে বন্ধ করা থেকে শুরু করে মহামারীর মতো দুর্যোগে এই কিশোরের দল তাদের ছোট হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এলাকার অসহায় দুস্থদের জন্য। লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক নানা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আজ তারা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এখন এলাকার সমস্যায়, নালিশে-সালিশে তাদের রীতিমত ডাকা হয়।

চল্লিশ বছর ধরে আবর্জনা ফেলা হচ্ছিল গেন্ডারিয়া কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিশোর-কিশোরীদের এই দল সিটি করপোরেশনকে জবাবদিহিতার মধ্যে এনে এলাকাবাসীকে বাধ্য করেছে নির্দিষ্ট জায়গায় বাসা-বাড়ির আবর্জনা ফেলতে। আর এভাবেই শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়েছে তারা।

শুধু তাই নয়, করোনা মহামারী শুরুর সময় যখন বিশ্ব ঘরবন্দী, এই কিশোর বাহিনীর দল ছুটে বেরিয়েছে অলি-গলি থেকে রাজপথে। সে সময় গেন্ডারিয়া এলাকা ছেড়ে তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর অন্য এলাকায়। আর এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই দলের সদস্য আমেনা আক্তার বৃষ্টি জিতে নেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ‘নির্ভয়া’ পুরস্কার।

এই কিশোর বাহিনীর কয়েকজন নিপা তালুকদার, ঝুমা আক্তার আনিশা, মো. সিফাত, রানা তালুকদার, আমেনা আক্তার বৃষ্টি। তারাসহ বেশ কয়েকজন সংবাদকে বললেন তাদের এই উদ্যোগের পেছনের গল্প।

তাদের এই দলটির নাম তারা রেখেছে ‘আজকের যুব প্রজন্ম’। দলটির সদস্য এখন প্রায় ২০০ জন।

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের রাস্তা সরু, আশপাশে কিছু দালানবাড়ি থাকলেও জীর্ণদশা আর নিম্নআয়ের মানুষের বসবাসের ছাপ স্পষ্ট। রাজধানীর উন্নয়নের ছোঁয়া এখানে এখনো পৌঁছায়নি। কুসংস্কার থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারেনি বলে জানায় রানা তালুকদার।

রানার কথার জের ধরে ঝুমা আক্তার আনিশা বলেন, ‘কুসংস্কারে ছিল আমার বাবা-মাও। আমরা তিন বোন, তিন ভাই। আমার বড় বোনদের ১২ বছর না হতেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। যতটা না অভাব ছিল তারচেয়ে বেশি ছিল কুসংস্কার। তারা ভাবেন মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়াটাই সব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। দিয়েছেও তাই।’

আনিশা এখন একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বয়স ১৭। তবে তাকে তার বড় বোনদের ভাগ্য মেনে নিতে হয়নি। আনিশা সংবাদকে বলেন, ‘আমারও বিয়ে হয়ে যেত যদি না আমরা একত্রিত হতাম, এই দল গঠন না করতাম। আমরা সবাই মিলে আব্বু-আম্মুকে বুঝাতে পেরেছি, বাল্যবিয়ের সমস্যা সম্পর্কে। শুধু তাই নয়, আমাদের এলাকায় কোথাও এখন আমাদের জানা মতে বাল্যবিয়ে হয় না।’

এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট চুপচাপ বসে থাকা মো. সিফাত, দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই কিশোর-কিশোরীদের এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি ধাপ।

তুমি এত ছোট বয়সে এখানে কি করো- জানতে চাইলে এক গাল হেসে সিফাত বলে ‘আমি যখন ৭ম শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকেই ভাইয়া আপুদের সঙ্গে, এখন তো আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারী মৈত্রী আামাদের এই এলাকার বাচ্চাদের নিয়ে তিন দিনের একটা প্রশিক্ষণ দেয়। আমি অংশগ্রহণ করি। প্রশিক্ষণটা ছিল শিশুদের যৌনশিক্ষা। প্রথম দিন অনেক লজ্জা পেয়েছি, কোনো কথা বলিনি। দ্বিতীয় দিন বুঝতে পেরেছি এবং তৃতীয় দিন জানলাম এই শিক্ষা আমাদের জন্য কতটা দরকার।’

‘এরপর তাদের আরেকটা প্রশিক্ষণে গিয়ে আমি কথা বলেছি, আরও বিস্তারিত জেনেছি। তখন রানা ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। জানলাম তারা এলাকায় সচেতনতামূলক অনেক কাজ করছেন। সেই থেকে আমি ‘আজকের যুব প্রজন্মের’ সদস্য।

নীপা তালুকদার নদী সোহরাওয়ার্দী কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্র্থী। নীপা বলেন, ‘আজ থেকে ৫-৭ বছর আগে এই এলাকায় ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে কথা বলতে পারত না। মেয়েরা বেশি বাইরে বের হতে পারত না। এখন আমরা যদি রাত ১০টাতেও এক সঙ্গে কোথাও বসি, কেউ কিছু বলে না বা অন্য দৃষ্টিতে দেখে না।’

গেন্ডারিয়া কলোনি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের পাশে গত ৪০ বছর ধরেই আশ-পাশের বাসা-বাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলা হতো। কেউ কিছু বলতে পারতো না। ময়লার দুর্গন্ধে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয় বাচ্চারা। এই কিশোর-কিশোরীরা যখন এই ‘আজকের যুব প্রজন্ম’ গঠন করল, তখন প্রথম মিশন ছিল সেই ময়লা দূর করা।

নীপা বলছে, ‘প্রথমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসি ময়লা না ফেলতে। একটা নির্দিষ্ট স্থান দেখানোর পরও কেউ শোনে না। এরপর বলে আসলাম আপনাদের ময়লা ঘরে রাখেন সিটি করপোরেশন এসে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখানকার সিটি করপোরেশনের অবস্থা খুবই নাজুক।’

‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী দীর্ঘদিনের হওয়ায় উনি ইচ্ছেমতো কোনদিন ময়লা নেন, কোনদিন নেন না। গৃহস্থালির ময়লা তো বেশিদিন রাখাও যায় না। এবার আমরা গেলাম সিটি করপোরেশনে। তারা আশ্বাস দিলেন কিন্তু কাজ হয় না। এরপর খোদ মেয়রের কাছে চিঠি। এরপর কাউন্সিলর বিয়য়টি আমলে নিলেন কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারলেন না।’

কী করা যায় এই ভাবনায় এরা খুঁজে বের করলেন এক উপায়, বলছে নীপা। ‘তখন আমরা পাহারা বসাই। রাত জেগে পাহারা দেই, কে এখানে ময়লা ফেলেন তা দেখার জন্য। অনেকেই মাঝ রাতে, ভোর রাতে ময়লা ফেলে চলে যান। আমরা তাদের নাম লিখে রাখি। পরদিন কাউন্সিলরের হাতে তালিকা দিয়ে আসলে কাউন্সিলর তাদের ডেকে সতর্ক করে দেন। এভাবে এই স্কুলের পাশ থেকে ময়লা ফেলা বন্ধ করা হয়েছে।’

‘আমাদের এখন ভালো লাগে যখন দেখি এখন নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থী আসছে। অভিভাবকরা আমাদের খুব প্রশংসা করেছেন। এখন তারা তাদের সন্তানদের আমাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য বলেন,’ নীপার চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাসী বিজয়ীর ছাপ।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ‘নির্ভয়া’ পুরস্কার পাওয়া আমেনা আক্তার বৃষ্টি বললেন ‘কোভিডের সময় সবাই যখন ঘরে তখন তারা ছিলেন বাইরে। ‘ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, যেসব পরিবার উপার্জন হারিয়েছে, যে পরিবারে নারী একমাত্র আয়ের সঙ্গে জড়িত এমন এক হাজার ৫০০ পরিবারকে এক মাসের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছি। চাল, ডাল, তেল, সাবানের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে মিনিস্ট্রুয়াল কিটও ছিল।’ কিভাবে এত কাজ করেছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বৃষ্টি বলেন, আমরা কয়েকজনের দল তৈরি করি। একেক দল একেকটা কাজ করতাম। এমন একটা দল ঘরে ঘরে গিয়ে তালিকা করে আনে। বৃষ্টি বলেন, মজার বিষয় হলো এই তালিকা করতে গিয়ে প্রথমে যারা আমাদের ব্যঙ্গ করেছে পরবর্তীতে এই সামগ্রী নেয়ার জন্য তারাই এসে ধর্ণা দিয়েছে; রাগারাগি থেকে হুমকি পর্যন্ত এসেছিল।’

বৃষ্টি বলতে থাকেন, ‘করোনায় যখন সবাই ভীত সন্ত্রস্ত তখন রাজধানীর ২০টি স্থানে এক মাস হাত ধোয়া কর্মসূচি পালন করি, যেখানে প্রতিটি পয়েন্টে গড়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ হাত ধুয়েছে।’ তার মানে এক মাসে প্রায় ১২ লাখ পথচারী হাত ধুতে পেরেছে।

নিজেরা পিঠে ফগার মেশিন চাপিয়ে জীবাণুনাশক ওষুধও ছিটিয়েছে এরা। কোভিড যখন উচ্চ মাত্রায় তখন প্রায় প্রতিদিনই এই জীবাণুনাশক ছিটানো হতো ১০টি স্প্রে মেশিন দিয়ে। বৃষ্টি বলেন, ‘আমাদের এই দরিদ্র এলাকার প্রায় ২৫ হাজার পরিবার জীবাণুমুক্ত পরিবেশে বাস করার সুযোগ পেয়েছে। ওষুধ কিংবা চিকিৎসকের ব্যবস্থা করেছি আমরা। রক্ত সংগ্রহ করেছি।’ মানুষের জন্য এমন কাজ আরও কাজ করতে চায় বলেও জানায় বৃষ্টি।

এতসব কিভাবে সম্ভব হলো জানতে চাইলে বৃষ্টি বলেন, ‘প্রথমে আমরা অর্থ ছাড়া যে কাজ করা যায় তাই করছিলাম। এরপর বিত্তবানদের সঙ্গে কথা বলি এবং সব শেষে নারী মৈত্রীর সঙ্গে কথা বলি। আসলে বেসরকারি সংস্থা নারী মৈত্রী আমাদের নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করেছে। তাই তাদের কাছে গিয়ে আমাদের কাজ করার কথা বলি। তারা কাজের বিবরণ শুনে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারী মৈত্রীর প্রকল্প ব্যবস্থাপক (প্রজেক্ট ম্যানেজার) তাসলিমা হুদা। তাকে প্রায় আট বছর আগে যখন ওই গেন্ডারিয়া এলাকায় তার প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠানো হয়েছিল কাজ করতে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না।

‘আমি প্রায় সময় হতাশ হয়ে যেতাম। কিভাবে করবো কাজ। অধিকাংশ মানুষই নিম্নবিত্ত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বাচ্চারা লেখাপড়া করে না, নেশা করে, আড্ডা দেয়, বড়দের অবস্থা আরও খারাপ। তখন আমি আমার হেড অফিসে বিষয়টা জানাই। বয়সীদের কতটা মূল স্রোতে আনা যাবে এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেই,’ বলছিলেন তাসলিমা।

‘আমি জানি এলাকায় কিছু করতে হলে এই বাচ্চাদের আগে পথে আনতে হবে। দিতে হবে প্রশিক্ষণ। একদম ছোট শিশু থেকে কিশোর যুবক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি। অনেক ধৈর্য আর পরিশ্রমের ফল ‘আজকের যুব প্রজন্ম’।

‘সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা হলো, যে কিশোর-কিশোরীরা ‘আজকের যুব প্রজন্ম’ গঠন করেছে তারা সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা নিজেরাই এখন নিজেদের গঠন করছে। নিজেদের মানসিক পরিচর্যা করছে।’

‘এলাকায় নেশা, যৌতুক. বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক জঞ্জালমুক্ত করতে এরাই এগিয়ে আসছে। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই বাচ্চারাই জবাবদিহিতার জায়গাও তৈরি করছে’ বলেন তাসলিমা।

ছবি

আনু মুহাম্মদের ক্ষতিগ্রস্ত পায়ে অস্ত্রোপচার করা হবে

ছবি

সদরঘাটে যাত্রীবাহী লঞ্চের আগুন নিয়ন্ত্রণে

ছবি

সদরঘাটে যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন

ছবি

এবার এডিসের লার্ভা পেলেই জেল-জরিমানা: মেয়র আতিক

ছবি

রিহ্যাবের মতামত ছাড়া ইমারত নির্মাণ বিধিমালা চূড়ান্ত না করার দাবি

ছবি

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের স্ত্রী গ্রেপ্তার

নিত্যপণ্যের তুলনায় তামাকপণ্য সস্তা, দাম বাড়ানোর দাবি

ছবি

ট্রেনে পায়ের আঙুল কাটা পড়েছে আনু মুহাম্মদের

ছবি

রেকি করে ফাঁকা ঢাকায় চুরি করতেন তারা

ছবি

প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে আইনজীবীদের গাউন পড়নে শিথিলতা

ছবি

হাতিরঝিলে ভাসছিল যুবকের মরদেহ

ছবি

শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস

ছবি

শিশু হাসপাতালে আগুন, ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

ছবি

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাইদা বাস থার্ড টার্মিনালে, প্রকৌশলী নিহত

ছবি

ঢাকা শিশু হাসপাতালের কার্ডিয়াক বিভাগে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট

ছবি

ভাষানটেকে বাবা-মা-দাদির পরে চলে গেল লামিয়াও

ছবি

যমুনা এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত বগি উদ্ধার, ঢাকামুখী পথ সচল

ছবি

রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি

ছবি

ভাসানটেকে গ্যাসের আগুন: শাশুড়ি ও স্ত্রীর পর স্বামীও মারা গেছে

ছবি

পহেলা বৈশাখে জাহানারা জাদুঘরের বিশেষ প্রদর্শনী

ছবি

চট্টগ্রামে বস্তিতে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৯ ইউনিট

ছবি

ঢাকায় পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ৮

ঢাবি চারুকলার বকুলতলায় গান-নাচ-আবৃত্তিতে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্‌যাপন

ছবি

ঢাকায় এসেছে ইসরায়েলের ফ্লাইট, বেবিচকের ব্যাখা

ছবি

বর্ষবরণের অপেক্ষায় রমনা

ছবি

যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর গাড়িতে আগুন লাগে জানান পুলিশ

লঞ্চের দড়ি ছিঁড়ে ৫ জনের মৃত্যু : আসামিদের তিন দিনের রিমান্ড

ছবি

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর প্রাইভেট কারে আগুন

রাজধানীর শাহজাদপুরে বুথের নিরাপত্তা প্রহরীকে হত্যা

ছবি

যাত্রীদের পিটুনিতে হয়নি চালক-সহকারীর মৃত্যু, হেলপার গল্প সাজিয়েছে বলছে পুলিশ

ছবি

ঈদের দিন বন্ধ থাকবে মেট্রোরেল

ছবি

মেট্রোরেলের পিলারে বাসের ধাক্কা

ছবি

কেএনএফের তৎপরতা নিয়ে ঢাকায় কোনো শঙ্কা নেই: ডিএমপি কমিশনার

ছবি

আবাসিক হোটেল থেকে নির্মাতা সোহানুর রহমানের মেয়ের মরদেহ উদ্ধার

কেটলির শর্টসার্কিট থেকে লিকেজের গ্যাসে বিস্তার

ছবি

জনগণের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে পুলিশের সব ইউনিট একযোগে কাজ করছে : আইজিপি

tab

নগর-মহানগর

এখনও কৈশোর পেরোয়নি, সরাচ্ছে সমাজের জঞ্জাল

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় এই কিশোর-কিশোরীরা আনন্দ-উল্লাসে, করছে কর্মে সহযোগিতা -সংবাদ

শনিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার একদল কিশোর-কিশোরী। বয়স এদের ১২ থেকে ১৮ বছর। কিন্তু এরাই পণ করেছে সরাবে সমাজের আবর্জনা। শুরু করেছিল একটি স্কুলে বহু বছর ধরে জমা হয়ে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পাঠদানের উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়ে। এরপর শিশু বয়সে বিয়ে বন্ধ করা থেকে শুরু করে মহামারীর মতো দুর্যোগে এই কিশোরের দল তাদের ছোট হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এলাকার অসহায় দুস্থদের জন্য। লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক নানা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আজ তারা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এখন এলাকার সমস্যায়, নালিশে-সালিশে তাদের রীতিমত ডাকা হয়।

চল্লিশ বছর ধরে আবর্জনা ফেলা হচ্ছিল গেন্ডারিয়া কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিশোর-কিশোরীদের এই দল সিটি করপোরেশনকে জবাবদিহিতার মধ্যে এনে এলাকাবাসীকে বাধ্য করেছে নির্দিষ্ট জায়গায় বাসা-বাড়ির আবর্জনা ফেলতে। আর এভাবেই শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়েছে তারা।

শুধু তাই নয়, করোনা মহামারী শুরুর সময় যখন বিশ্ব ঘরবন্দী, এই কিশোর বাহিনীর দল ছুটে বেরিয়েছে অলি-গলি থেকে রাজপথে। সে সময় গেন্ডারিয়া এলাকা ছেড়ে তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর অন্য এলাকায়। আর এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই দলের সদস্য আমেনা আক্তার বৃষ্টি জিতে নেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ‘নির্ভয়া’ পুরস্কার।

এই কিশোর বাহিনীর কয়েকজন নিপা তালুকদার, ঝুমা আক্তার আনিশা, মো. সিফাত, রানা তালুকদার, আমেনা আক্তার বৃষ্টি। তারাসহ বেশ কয়েকজন সংবাদকে বললেন তাদের এই উদ্যোগের পেছনের গল্প।

তাদের এই দলটির নাম তারা রেখেছে ‘আজকের যুব প্রজন্ম’। দলটির সদস্য এখন প্রায় ২০০ জন।

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের রাস্তা সরু, আশপাশে কিছু দালানবাড়ি থাকলেও জীর্ণদশা আর নিম্নআয়ের মানুষের বসবাসের ছাপ স্পষ্ট। রাজধানীর উন্নয়নের ছোঁয়া এখানে এখনো পৌঁছায়নি। কুসংস্কার থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারেনি বলে জানায় রানা তালুকদার।

রানার কথার জের ধরে ঝুমা আক্তার আনিশা বলেন, ‘কুসংস্কারে ছিল আমার বাবা-মাও। আমরা তিন বোন, তিন ভাই। আমার বড় বোনদের ১২ বছর না হতেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। যতটা না অভাব ছিল তারচেয়ে বেশি ছিল কুসংস্কার। তারা ভাবেন মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়াটাই সব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। দিয়েছেও তাই।’

আনিশা এখন একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বয়স ১৭। তবে তাকে তার বড় বোনদের ভাগ্য মেনে নিতে হয়নি। আনিশা সংবাদকে বলেন, ‘আমারও বিয়ে হয়ে যেত যদি না আমরা একত্রিত হতাম, এই দল গঠন না করতাম। আমরা সবাই মিলে আব্বু-আম্মুকে বুঝাতে পেরেছি, বাল্যবিয়ের সমস্যা সম্পর্কে। শুধু তাই নয়, আমাদের এলাকায় কোথাও এখন আমাদের জানা মতে বাল্যবিয়ে হয় না।’

এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট চুপচাপ বসে থাকা মো. সিফাত, দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই কিশোর-কিশোরীদের এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি ধাপ।

তুমি এত ছোট বয়সে এখানে কি করো- জানতে চাইলে এক গাল হেসে সিফাত বলে ‘আমি যখন ৭ম শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকেই ভাইয়া আপুদের সঙ্গে, এখন তো আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারী মৈত্রী আামাদের এই এলাকার বাচ্চাদের নিয়ে তিন দিনের একটা প্রশিক্ষণ দেয়। আমি অংশগ্রহণ করি। প্রশিক্ষণটা ছিল শিশুদের যৌনশিক্ষা। প্রথম দিন অনেক লজ্জা পেয়েছি, কোনো কথা বলিনি। দ্বিতীয় দিন বুঝতে পেরেছি এবং তৃতীয় দিন জানলাম এই শিক্ষা আমাদের জন্য কতটা দরকার।’

‘এরপর তাদের আরেকটা প্রশিক্ষণে গিয়ে আমি কথা বলেছি, আরও বিস্তারিত জেনেছি। তখন রানা ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। জানলাম তারা এলাকায় সচেতনতামূলক অনেক কাজ করছেন। সেই থেকে আমি ‘আজকের যুব প্রজন্মের’ সদস্য।

নীপা তালুকদার নদী সোহরাওয়ার্দী কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্র্থী। নীপা বলেন, ‘আজ থেকে ৫-৭ বছর আগে এই এলাকায় ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে কথা বলতে পারত না। মেয়েরা বেশি বাইরে বের হতে পারত না। এখন আমরা যদি রাত ১০টাতেও এক সঙ্গে কোথাও বসি, কেউ কিছু বলে না বা অন্য দৃষ্টিতে দেখে না।’

গেন্ডারিয়া কলোনি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের পাশে গত ৪০ বছর ধরেই আশ-পাশের বাসা-বাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলা হতো। কেউ কিছু বলতে পারতো না। ময়লার দুর্গন্ধে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয় বাচ্চারা। এই কিশোর-কিশোরীরা যখন এই ‘আজকের যুব প্রজন্ম’ গঠন করল, তখন প্রথম মিশন ছিল সেই ময়লা দূর করা।

নীপা বলছে, ‘প্রথমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসি ময়লা না ফেলতে। একটা নির্দিষ্ট স্থান দেখানোর পরও কেউ শোনে না। এরপর বলে আসলাম আপনাদের ময়লা ঘরে রাখেন সিটি করপোরেশন এসে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখানকার সিটি করপোরেশনের অবস্থা খুবই নাজুক।’

‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী দীর্ঘদিনের হওয়ায় উনি ইচ্ছেমতো কোনদিন ময়লা নেন, কোনদিন নেন না। গৃহস্থালির ময়লা তো বেশিদিন রাখাও যায় না। এবার আমরা গেলাম সিটি করপোরেশনে। তারা আশ্বাস দিলেন কিন্তু কাজ হয় না। এরপর খোদ মেয়রের কাছে চিঠি। এরপর কাউন্সিলর বিয়য়টি আমলে নিলেন কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারলেন না।’

কী করা যায় এই ভাবনায় এরা খুঁজে বের করলেন এক উপায়, বলছে নীপা। ‘তখন আমরা পাহারা বসাই। রাত জেগে পাহারা দেই, কে এখানে ময়লা ফেলেন তা দেখার জন্য। অনেকেই মাঝ রাতে, ভোর রাতে ময়লা ফেলে চলে যান। আমরা তাদের নাম লিখে রাখি। পরদিন কাউন্সিলরের হাতে তালিকা দিয়ে আসলে কাউন্সিলর তাদের ডেকে সতর্ক করে দেন। এভাবে এই স্কুলের পাশ থেকে ময়লা ফেলা বন্ধ করা হয়েছে।’

‘আমাদের এখন ভালো লাগে যখন দেখি এখন নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থী আসছে। অভিভাবকরা আমাদের খুব প্রশংসা করেছেন। এখন তারা তাদের সন্তানদের আমাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য বলেন,’ নীপার চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাসী বিজয়ীর ছাপ।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ‘নির্ভয়া’ পুরস্কার পাওয়া আমেনা আক্তার বৃষ্টি বললেন ‘কোভিডের সময় সবাই যখন ঘরে তখন তারা ছিলেন বাইরে। ‘ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, যেসব পরিবার উপার্জন হারিয়েছে, যে পরিবারে নারী একমাত্র আয়ের সঙ্গে জড়িত এমন এক হাজার ৫০০ পরিবারকে এক মাসের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছি। চাল, ডাল, তেল, সাবানের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে মিনিস্ট্রুয়াল কিটও ছিল।’ কিভাবে এত কাজ করেছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বৃষ্টি বলেন, আমরা কয়েকজনের দল তৈরি করি। একেক দল একেকটা কাজ করতাম। এমন একটা দল ঘরে ঘরে গিয়ে তালিকা করে আনে। বৃষ্টি বলেন, মজার বিষয় হলো এই তালিকা করতে গিয়ে প্রথমে যারা আমাদের ব্যঙ্গ করেছে পরবর্তীতে এই সামগ্রী নেয়ার জন্য তারাই এসে ধর্ণা দিয়েছে; রাগারাগি থেকে হুমকি পর্যন্ত এসেছিল।’

বৃষ্টি বলতে থাকেন, ‘করোনায় যখন সবাই ভীত সন্ত্রস্ত তখন রাজধানীর ২০টি স্থানে এক মাস হাত ধোয়া কর্মসূচি পালন করি, যেখানে প্রতিটি পয়েন্টে গড়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ হাত ধুয়েছে।’ তার মানে এক মাসে প্রায় ১২ লাখ পথচারী হাত ধুতে পেরেছে।

নিজেরা পিঠে ফগার মেশিন চাপিয়ে জীবাণুনাশক ওষুধও ছিটিয়েছে এরা। কোভিড যখন উচ্চ মাত্রায় তখন প্রায় প্রতিদিনই এই জীবাণুনাশক ছিটানো হতো ১০টি স্প্রে মেশিন দিয়ে। বৃষ্টি বলেন, ‘আমাদের এই দরিদ্র এলাকার প্রায় ২৫ হাজার পরিবার জীবাণুমুক্ত পরিবেশে বাস করার সুযোগ পেয়েছে। ওষুধ কিংবা চিকিৎসকের ব্যবস্থা করেছি আমরা। রক্ত সংগ্রহ করেছি।’ মানুষের জন্য এমন কাজ আরও কাজ করতে চায় বলেও জানায় বৃষ্টি।

এতসব কিভাবে সম্ভব হলো জানতে চাইলে বৃষ্টি বলেন, ‘প্রথমে আমরা অর্থ ছাড়া যে কাজ করা যায় তাই করছিলাম। এরপর বিত্তবানদের সঙ্গে কথা বলি এবং সব শেষে নারী মৈত্রীর সঙ্গে কথা বলি। আসলে বেসরকারি সংস্থা নারী মৈত্রী আমাদের নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করেছে। তাই তাদের কাছে গিয়ে আমাদের কাজ করার কথা বলি। তারা কাজের বিবরণ শুনে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারী মৈত্রীর প্রকল্প ব্যবস্থাপক (প্রজেক্ট ম্যানেজার) তাসলিমা হুদা। তাকে প্রায় আট বছর আগে যখন ওই গেন্ডারিয়া এলাকায় তার প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠানো হয়েছিল কাজ করতে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না।

‘আমি প্রায় সময় হতাশ হয়ে যেতাম। কিভাবে করবো কাজ। অধিকাংশ মানুষই নিম্নবিত্ত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বাচ্চারা লেখাপড়া করে না, নেশা করে, আড্ডা দেয়, বড়দের অবস্থা আরও খারাপ। তখন আমি আমার হেড অফিসে বিষয়টা জানাই। বয়সীদের কতটা মূল স্রোতে আনা যাবে এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেই,’ বলছিলেন তাসলিমা।

‘আমি জানি এলাকায় কিছু করতে হলে এই বাচ্চাদের আগে পথে আনতে হবে। দিতে হবে প্রশিক্ষণ। একদম ছোট শিশু থেকে কিশোর যুবক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি। অনেক ধৈর্য আর পরিশ্রমের ফল ‘আজকের যুব প্রজন্ম’।

‘সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা হলো, যে কিশোর-কিশোরীরা ‘আজকের যুব প্রজন্ম’ গঠন করেছে তারা সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা নিজেরাই এখন নিজেদের গঠন করছে। নিজেদের মানসিক পরিচর্যা করছে।’

‘এলাকায় নেশা, যৌতুক. বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক জঞ্জালমুক্ত করতে এরাই এগিয়ে আসছে। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই বাচ্চারাই জবাবদিহিতার জায়গাও তৈরি করছে’ বলেন তাসলিমা।

back to top