অপারেশন হিলসাইড
উগ্র মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘নতুন জঙ্গি’ সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলায়’ ৫০ পরিবার ও তরুণ-তরুণী হিজরত করেছে। এসব পরিবার ও তরুণ-তরুণীরা মৌলভীবাজারের আস্তানায় গত ২ মাস ধরে যাতায়াত ছিল। এদের মধ্যে অনেকই নিজের বাড়িঘর, জমিসহ সবকিছু বিক্রি করে সংগঠনের ফান্ডে বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেছেন।
সিটিটিসি বলছে, গত শনিবার মৌলভীবাজারের কুলাউরা উপজেলার পাহাড়ঘেঁষা কর্দমা ইউনিয়নের টাট্টউলি গ্রামের ‘জঙ্গিদের’ যে ‘আস্তানায়’ সিটিটিসি অভিযান চালিয়েছে সেখানে গত ২ মাসে অর্ধশত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের যাতায়াত ছিল। বড় কোন নাশকতার উদ্দেশ্যে ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামের ওই ‘জঙ্গি’ সংগঠন পাহাড় ঘেরা নির্জন এলাকা বেছে নিয়েছে। সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ছিল। এ ধরনের আরো একাধিক আস্তানা থাকতে পারে। গোয়েন্দারা মনে করছেন পুরনো জঙ্গি সংগঠনের আত্মগোপনে থাকা নেতারাই এ সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে থাকতে পারেন।
গত শনিবার ভোরে কুলাউরা উপজেলার কর্দমা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামের নির্জন পাহারঘেরা এলাকায় জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা সন্দেহে একটি ছাপড়া বাড়িতে অভিযান চালায় ডিএমপির জঙ্গি বিরোধী ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। ওই অভিযানে ৬টি পরিবারের ১০ নারী ও পুরুষকে আটকের পাশাপাশি ১ কিশোরী ও ৩ শিশুকেও উদ্ধার করা হয় অভিযানে। রক্তপাতহীন এ অভিযাান শেষ করে টিনের ছাপড়া দেয়া ঘর থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেয়ার নানা উপকরণ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে সিটিটিসি। সিটিটিসির দাবি আগে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের দেয়া তথ্যে এ সংগঠনের আস্তানা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ওই অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই সংগঠনের শীর্ষ নেতাদেরও ইতোমধ্যে নজরদারিতে আনা হয়েছে। শীঘ্রই তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সিটিটিসি।
ওই অভিযানের ফলোআপ জানাতে গিয়ে রোববার (১৩ আগস্ট) এক সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির প্রধান বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকের নিরুদ্দেশ হওয়ার কিছু তথ্য তাদের কাছে আসে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জের এক চিকিৎসক দম্পতি, যশোরের বাসিন্দা নটরডেম কলেজেছাত্র ফাহিম এবং জামালপুরের এরশাদুজ্জামান শাহিন নামের ৩ জনের নিখোঁজ সংক্রান্ত ডিজির ঘটনায় তারা অনুসন্ধান শুরু করে। তাদের কাছে তথ্য ছিল দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, যশোর, সাতক্ষীরা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ জেলায় বেশ কিছু পরিবার হিজরতে গিয়েছে। এ সংক্রান্তে থানায় কোন জিডিও হয়নি।
অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, গত ৭ আগস্ট মিরপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসি। তারা মূলত নতুন ‘জঙ্গি’ সংগঠন ইমাম মাহামুদের কাফেলার কর্দমা ইউনিয়নের ওই পাহাড়ঘেরা আস্তানায় যাওয়ার জন্য তাদের একজন রিসিভারের (যে আস্তানায় নিয়ে যাবে) জন্য অপেক্ষায় ছিল। সেখানে ৪ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী এবং ৮ জন শিশু ছিল। অন্য অভিযানে ব্যস্থতার কারণে আমরা ওই গ্রেপ্তারের খবর মিডিয়ায় আনিনি। এরপর গত বৃহস্পতিবার ফরহাদ নামের আরো একজনকে আমরা গ্রেপ্তার করি। মূলত ফরহাদ কর্দমা ইউনিয়নের পাহাড়ঘেরা ‘জঙ্গি আস্তনায়’ যাতায়াত ছিল। সে ঢাকায় এসেছে তার পুরো পরিবারকে ওই আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সিটিটিসির প্রধান জানান, মূলত ওই ১১ জনকে আমরা রিমান্ড হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তখন জানতে পেরেছি মেহেরপুর, পাবনা ও ঝিনাইদহ থেকে পুরো ৭ টি পরিবার একযোগে নিরুদ্দেশ হয়েছে উগ্রবাগে যোগদানের জন্য হিজরত করার উদ্দেশ্যে। মূলত গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে আমরা কুলাউড়া উপজেলার কর্দমা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামের আস্তানা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। আমরা সহকারী কমিশনার শফিকের নেতৃত্বে একটি সার্ভিলেন্স টিম সেখানে পাঠাই। সেখানে নানাভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে, গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্যের সঙ্গে মিল পেয়ে আমরা আস্তানাটি সম্পর্কে নিশ্চিত হয় । এরপর আমরা অভিযান পারিচালনা করে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করি।
ইমাম মাহমুদের কাফেলার কার্যক্রম আরো আগ থেকে
সম্প্রতি নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকার। কয়েক বছর আগেই এ সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হলেও সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণদের নিখোঁজ হওয়র রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে এ সংগঠনের অস্তিত্ব পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সিটিটিসি বলছে, ইমাম মাহমুদের কাফেলও তেমন একটি সংগঠন। মূলত কয়েকটি পরিবারের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনার সূত্র ধরে আমরা তদন্ত করতে গিয়ে ইমাম মাহমুদের কাফেলা সম্পর্কে অবগত হই। গত ৭ আগস্ট মিরপুর থেকে ৬ পরিবারের ১০ নারী-পুরুষকে আটকের পাশাপাশি ৮ জন শিশু উদ্ধার হয়। এরপর আরো একজনকে আটক করি যার নাম ছিল ফরহাদ। পরে তাদের রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মৌলভীবাজারের আস্তানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়।
সিটিটিসর প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেছেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে ২ থেকে ৩ ইমাম মাহমুদের কাফেলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ সংগঠনে যারা জড়িত অনেকেই তাদের পুরো পরিবার নিয়ে ইমামা মাহমুদের কাফেলায় জড়িয়ে পড়েছে।
অভিযানে অংশ নেয়া সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ওই সংগঠনটির মূলে রয়েছেন হাবিবুল্লাহ বিন আবদুল কাদের। আবদুল কাদের বাড়ি বাগাটিপাড়া এলাকায়। সে নিজেকে ‘ইমাম মাহমুদ’ বলে দাবি করেন। মূলত তার ডাকে ২০-৩০ জন তরুণ-তরুণী ও গৃহিণী বাড়ি ছেড়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে গাজওয়াাতুল হিন্দের (পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যে ধর্মযুদ্ধ হবে সেটাই হলো ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’) জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ শেষে দেশে অতর্কিত হামলার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার পরিকল্পনা ছিল সংগঠনটির।
অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে সংগঠনটির কার্যক্রম কথিত ‘ইমাম মাহমুদ’ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে উগ্রবাদী ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে এক শ্রেণীর মানুষদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন। অনুসারীদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কথিত ‘ইমাম মাহমুদ’ বলতেন, ‘২০২৩ সাল থেকে পৃথিবীজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। আধুনিক সভ্যতা ধ্বংস হয়ে প্রাচীনযুগ শুরু হবে। তখন মানুষ আবার ঘোড়া নিয়ে চলাচল করবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হবে ২০২৩ সাল থেকেই। আর এই সময়টাই গাজওয়াতুল হিন্দের সময়’।
জমিজমা বিক্রি করে পুরো পরিবার ‘জঙ্গি’ সংগঠনে
সিটিটিসি জানিয়েছে, ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামের নতুন ‘জঙ্গি’ সংগঠনে এমন অনেক সদস্য আছে তারা পুরো পরিবার নিয়ে যোগাদন করেছে। সেখানে গ্রেপ্তার হওয়া ফরহাদ তার পুরো পরিবারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছে। আরো এমন অনেক পরিবার আছে যারা তাদের সহায় সম্পদ বিক্রি করে এলাকা থেকে চলে এসেছে ইমাম মাহমুদের কাফেলায় যুক্ত হওয়ার জন্য।
সিটিসির প্রধান বলেন, মোলভীবাজারের অভিযানের আগে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ফরহাদ তার পুরো পরিবারকে ই সংগঠনে যুক্ত করেছেন। এ সংগঠনের উদ্দেশ্যে হিজরত করতে তাদের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন। ফরহাদও মৌলভীবাজারের আস্তানায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সে মূলতে ঢাকায় এসেছিল তার পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। স্ত্রী, সন্তান এমনকি বৃদ্ধ বাবা-মাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল মৌলভীবাজারের আস্তানায়।
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ইমাম মাহমুদের কাফেলায় যেসব পরিবার হিজরত করেছে তারা প্রত্যেকেই ২০ লাখ টাকা করে অনুদান হিসেবে সংগঠরের ফান্ডে জমা দেয়ার নির্দেশনা ছিল। সংগঠনের ফান্ডে টাকার জোগান দিতে অনেক পরিবার তাদের বাড়িঘরসহ যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে এ কাফেলার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছে।
এনক্রিপ্টেড অ্যাপে যোগাযোগ করে মৌলভীবাজারে আস্তানায় জঙ্গিরা
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, সংগঠনটিতে যুক্ত হওয়ার পর থেকে সদস্যরা এনক্রিপ্টেড অ্যাপের মাধ্যমে সাংগঠনিক নির্দেশনা আদান-প্রদান করতো। সর্বশেষ সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক করার পর হিজরতের সিদ্ধান্ত নেয় এ সংগঠনের সদস্যরা। মাস চারেক আগে থেকে এনক্রিপ্টেড অ্যাপে যোগাযোগের মাধ্যমে গত দুই মাস আগে মৌলভীবাজারে আস্তানা তৈরি করে তারা। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
কমান্ডো ট্রেনিং শেষে করেই ছিল হামলার পরিকিল্পনা
মৌলভীবাজারে জঙ্গি আস্তানায় অংশ নেয়া পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রেপ্তার জঙ্গিরা সাংগঠনিক নির্দেশে প্রশিক্ষণের জন্য ক্যাম্প নির্মাণ থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। তারা সেখানে কমান্ডো ধাঁচে প্রশিক্ষণ নিতে সমবেত হয়েছিল। অভিযানে প্রশিক্ষণের জন্য আনা কমান্ডো বুটও জব্দ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত অস্ত্র সংগ্রহের পর তারা পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তাসহ সরকারি স্থাপনায় হামলা করার পরিকল্পনা করেছিল। প্রতিদিন তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেসে আসতো।
‘ইমাম মাহমুদের কাফেলার’ আরও ২০-২৫ সদস্য নিখোঁজ
সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হওয়া নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটির আরও ২০-২৫ সদস্য নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজদের মধ্যে নামিদামি কলেজের শিক্ষার্থীও রয়েছে।
অভিযানে অংশ নেয়া সিটিটিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন আস্তানা থেকে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও সংগঠনটির আরও ২০-২৫ জন সদস্য নিখোঁজ রয়েছে। এদের মধ্যে নটরডেম কলেজের একজন শিক্ষার্থীও রয়েছে। ওই শিক্ষার্থীর নাম ফাহিম। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। গ্রেপ্তার ও নিখোঁজ সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে সাংগঠনিক নির্দেশে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। নিখোঁজ সদস্যদের সন্ধানে সিটিটিসির অভিযান চলছে।
অপারেশন হিলসাইড
রোববার, ১৩ আগস্ট ২০২৩
উগ্র মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘নতুন জঙ্গি’ সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলায়’ ৫০ পরিবার ও তরুণ-তরুণী হিজরত করেছে। এসব পরিবার ও তরুণ-তরুণীরা মৌলভীবাজারের আস্তানায় গত ২ মাস ধরে যাতায়াত ছিল। এদের মধ্যে অনেকই নিজের বাড়িঘর, জমিসহ সবকিছু বিক্রি করে সংগঠনের ফান্ডে বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেছেন।
সিটিটিসি বলছে, গত শনিবার মৌলভীবাজারের কুলাউরা উপজেলার পাহাড়ঘেঁষা কর্দমা ইউনিয়নের টাট্টউলি গ্রামের ‘জঙ্গিদের’ যে ‘আস্তানায়’ সিটিটিসি অভিযান চালিয়েছে সেখানে গত ২ মাসে অর্ধশত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের যাতায়াত ছিল। বড় কোন নাশকতার উদ্দেশ্যে ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামের ওই ‘জঙ্গি’ সংগঠন পাহাড় ঘেরা নির্জন এলাকা বেছে নিয়েছে। সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ছিল। এ ধরনের আরো একাধিক আস্তানা থাকতে পারে। গোয়েন্দারা মনে করছেন পুরনো জঙ্গি সংগঠনের আত্মগোপনে থাকা নেতারাই এ সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে থাকতে পারেন।
গত শনিবার ভোরে কুলাউরা উপজেলার কর্দমা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামের নির্জন পাহারঘেরা এলাকায় জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা সন্দেহে একটি ছাপড়া বাড়িতে অভিযান চালায় ডিএমপির জঙ্গি বিরোধী ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। ওই অভিযানে ৬টি পরিবারের ১০ নারী ও পুরুষকে আটকের পাশাপাশি ১ কিশোরী ও ৩ শিশুকেও উদ্ধার করা হয় অভিযানে। রক্তপাতহীন এ অভিযাান শেষ করে টিনের ছাপড়া দেয়া ঘর থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেয়ার নানা উপকরণ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে সিটিটিসি। সিটিটিসির দাবি আগে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের দেয়া তথ্যে এ সংগঠনের আস্তানা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ওই অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই সংগঠনের শীর্ষ নেতাদেরও ইতোমধ্যে নজরদারিতে আনা হয়েছে। শীঘ্রই তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সিটিটিসি।
ওই অভিযানের ফলোআপ জানাতে গিয়ে রোববার (১৩ আগস্ট) এক সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির প্রধান বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকের নিরুদ্দেশ হওয়ার কিছু তথ্য তাদের কাছে আসে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জের এক চিকিৎসক দম্পতি, যশোরের বাসিন্দা নটরডেম কলেজেছাত্র ফাহিম এবং জামালপুরের এরশাদুজ্জামান শাহিন নামের ৩ জনের নিখোঁজ সংক্রান্ত ডিজির ঘটনায় তারা অনুসন্ধান শুরু করে। তাদের কাছে তথ্য ছিল দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, যশোর, সাতক্ষীরা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ জেলায় বেশ কিছু পরিবার হিজরতে গিয়েছে। এ সংক্রান্তে থানায় কোন জিডিও হয়নি।
অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, গত ৭ আগস্ট মিরপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসি। তারা মূলত নতুন ‘জঙ্গি’ সংগঠন ইমাম মাহামুদের কাফেলার কর্দমা ইউনিয়নের ওই পাহাড়ঘেরা আস্তানায় যাওয়ার জন্য তাদের একজন রিসিভারের (যে আস্তানায় নিয়ে যাবে) জন্য অপেক্ষায় ছিল। সেখানে ৪ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী এবং ৮ জন শিশু ছিল। অন্য অভিযানে ব্যস্থতার কারণে আমরা ওই গ্রেপ্তারের খবর মিডিয়ায় আনিনি। এরপর গত বৃহস্পতিবার ফরহাদ নামের আরো একজনকে আমরা গ্রেপ্তার করি। মূলত ফরহাদ কর্দমা ইউনিয়নের পাহাড়ঘেরা ‘জঙ্গি আস্তনায়’ যাতায়াত ছিল। সে ঢাকায় এসেছে তার পুরো পরিবারকে ওই আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সিটিটিসির প্রধান জানান, মূলত ওই ১১ জনকে আমরা রিমান্ড হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তখন জানতে পেরেছি মেহেরপুর, পাবনা ও ঝিনাইদহ থেকে পুরো ৭ টি পরিবার একযোগে নিরুদ্দেশ হয়েছে উগ্রবাগে যোগদানের জন্য হিজরত করার উদ্দেশ্যে। মূলত গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে আমরা কুলাউড়া উপজেলার কর্দমা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামের আস্তানা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। আমরা সহকারী কমিশনার শফিকের নেতৃত্বে একটি সার্ভিলেন্স টিম সেখানে পাঠাই। সেখানে নানাভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে, গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্যের সঙ্গে মিল পেয়ে আমরা আস্তানাটি সম্পর্কে নিশ্চিত হয় । এরপর আমরা অভিযান পারিচালনা করে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করি।
ইমাম মাহমুদের কাফেলার কার্যক্রম আরো আগ থেকে
সম্প্রতি নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকার। কয়েক বছর আগেই এ সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হলেও সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণদের নিখোঁজ হওয়র রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে এ সংগঠনের অস্তিত্ব পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সিটিটিসি বলছে, ইমাম মাহমুদের কাফেলও তেমন একটি সংগঠন। মূলত কয়েকটি পরিবারের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনার সূত্র ধরে আমরা তদন্ত করতে গিয়ে ইমাম মাহমুদের কাফেলা সম্পর্কে অবগত হই। গত ৭ আগস্ট মিরপুর থেকে ৬ পরিবারের ১০ নারী-পুরুষকে আটকের পাশাপাশি ৮ জন শিশু উদ্ধার হয়। এরপর আরো একজনকে আটক করি যার নাম ছিল ফরহাদ। পরে তাদের রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মৌলভীবাজারের আস্তানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়।
সিটিটিসর প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেছেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে ২ থেকে ৩ ইমাম মাহমুদের কাফেলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ সংগঠনে যারা জড়িত অনেকেই তাদের পুরো পরিবার নিয়ে ইমামা মাহমুদের কাফেলায় জড়িয়ে পড়েছে।
অভিযানে অংশ নেয়া সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ওই সংগঠনটির মূলে রয়েছেন হাবিবুল্লাহ বিন আবদুল কাদের। আবদুল কাদের বাড়ি বাগাটিপাড়া এলাকায়। সে নিজেকে ‘ইমাম মাহমুদ’ বলে দাবি করেন। মূলত তার ডাকে ২০-৩০ জন তরুণ-তরুণী ও গৃহিণী বাড়ি ছেড়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে গাজওয়াাতুল হিন্দের (পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যে ধর্মযুদ্ধ হবে সেটাই হলো ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’) জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ শেষে দেশে অতর্কিত হামলার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার পরিকল্পনা ছিল সংগঠনটির।
অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে সংগঠনটির কার্যক্রম কথিত ‘ইমাম মাহমুদ’ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে উগ্রবাদী ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে এক শ্রেণীর মানুষদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন। অনুসারীদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কথিত ‘ইমাম মাহমুদ’ বলতেন, ‘২০২৩ সাল থেকে পৃথিবীজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। আধুনিক সভ্যতা ধ্বংস হয়ে প্রাচীনযুগ শুরু হবে। তখন মানুষ আবার ঘোড়া নিয়ে চলাচল করবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হবে ২০২৩ সাল থেকেই। আর এই সময়টাই গাজওয়াতুল হিন্দের সময়’।
জমিজমা বিক্রি করে পুরো পরিবার ‘জঙ্গি’ সংগঠনে
সিটিটিসি জানিয়েছে, ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামের নতুন ‘জঙ্গি’ সংগঠনে এমন অনেক সদস্য আছে তারা পুরো পরিবার নিয়ে যোগাদন করেছে। সেখানে গ্রেপ্তার হওয়া ফরহাদ তার পুরো পরিবারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছে। আরো এমন অনেক পরিবার আছে যারা তাদের সহায় সম্পদ বিক্রি করে এলাকা থেকে চলে এসেছে ইমাম মাহমুদের কাফেলায় যুক্ত হওয়ার জন্য।
সিটিসির প্রধান বলেন, মোলভীবাজারের অভিযানের আগে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ফরহাদ তার পুরো পরিবারকে ই সংগঠনে যুক্ত করেছেন। এ সংগঠনের উদ্দেশ্যে হিজরত করতে তাদের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন। ফরহাদও মৌলভীবাজারের আস্তানায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সে মূলতে ঢাকায় এসেছিল তার পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। স্ত্রী, সন্তান এমনকি বৃদ্ধ বাবা-মাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল মৌলভীবাজারের আস্তানায়।
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ইমাম মাহমুদের কাফেলায় যেসব পরিবার হিজরত করেছে তারা প্রত্যেকেই ২০ লাখ টাকা করে অনুদান হিসেবে সংগঠরের ফান্ডে জমা দেয়ার নির্দেশনা ছিল। সংগঠনের ফান্ডে টাকার জোগান দিতে অনেক পরিবার তাদের বাড়িঘরসহ যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে এ কাফেলার উদ্দেশ্যে হিজরত করেছে।
এনক্রিপ্টেড অ্যাপে যোগাযোগ করে মৌলভীবাজারে আস্তানায় জঙ্গিরা
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, সংগঠনটিতে যুক্ত হওয়ার পর থেকে সদস্যরা এনক্রিপ্টেড অ্যাপের মাধ্যমে সাংগঠনিক নির্দেশনা আদান-প্রদান করতো। সর্বশেষ সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক করার পর হিজরতের সিদ্ধান্ত নেয় এ সংগঠনের সদস্যরা। মাস চারেক আগে থেকে এনক্রিপ্টেড অ্যাপে যোগাযোগের মাধ্যমে গত দুই মাস আগে মৌলভীবাজারে আস্তানা তৈরি করে তারা। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
কমান্ডো ট্রেনিং শেষে করেই ছিল হামলার পরিকিল্পনা
মৌলভীবাজারে জঙ্গি আস্তানায় অংশ নেয়া পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রেপ্তার জঙ্গিরা সাংগঠনিক নির্দেশে প্রশিক্ষণের জন্য ক্যাম্প নির্মাণ থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। তারা সেখানে কমান্ডো ধাঁচে প্রশিক্ষণ নিতে সমবেত হয়েছিল। অভিযানে প্রশিক্ষণের জন্য আনা কমান্ডো বুটও জব্দ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত অস্ত্র সংগ্রহের পর তারা পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তাসহ সরকারি স্থাপনায় হামলা করার পরিকল্পনা করেছিল। প্রতিদিন তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেসে আসতো।
‘ইমাম মাহমুদের কাফেলার’ আরও ২০-২৫ সদস্য নিখোঁজ
সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হওয়া নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটির আরও ২০-২৫ সদস্য নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজদের মধ্যে নামিদামি কলেজের শিক্ষার্থীও রয়েছে।
অভিযানে অংশ নেয়া সিটিটিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন আস্তানা থেকে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও সংগঠনটির আরও ২০-২৫ জন সদস্য নিখোঁজ রয়েছে। এদের মধ্যে নটরডেম কলেজের একজন শিক্ষার্থীও রয়েছে। ওই শিক্ষার্থীর নাম ফাহিম। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। গ্রেপ্তার ও নিখোঁজ সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে সাংগঠনিক নির্দেশে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। নিখোঁজ সদস্যদের সন্ধানে সিটিটিসির অভিযান চলছে।