ছাগলকাণ্ডে ফেঁসে গেলেন মতিউর
‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত এনবিআরের রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ‘অবৈধ সম্পদের’ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। সেজন্য দুদকের উপ-পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান ও উপসহকারী পরিচালক সাবিকুন নাহার।
দুদকের এই কমিটিকে মতিউর রহমানের ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত’ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রোববার (২৩ জুন) সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের’ অভিযোগ অনুসন্ধানে গত ৪ জুন এই কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছেন।
অন্যদিকে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানকে রোববারই এনবিআর থেকে সরিয়ে রোববারই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একাদশ বিসিএসের (শুল্ক ও আবগারি) কর্মকর্তা মতিউর রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে সরকার মনোনিত পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ওই পদ থেকেও তাকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী জানিয়েছেন।
গত কোরবানির ঈদের জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুক পোস্টকে ঘিরে গত কয়েক দিন ধরেই রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা চলছে।
ছাগল কিনতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন ইফাত। ধানমন্ডির বাসায় ঈদের দিন ছাগলটি কোরবানি দেয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তখন ছাগলসহ ইফাতের ছবিজুড়ে দিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন- ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার অর্থের উৎস কী?
এ প্রশ্ন ঘিরে সামনে আসতে থাকে ইফাতের পরিচয়। ইফাত নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে ও সংবাদমাধ্যমে বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমান। ইফাতের বাবার পরিচয় ধরে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল ব্যয়ে কোরবানির পশু কেনার সামর্থ হলো কী করে?
অবশ্য ছাগলটি ইফাত শেষ পর্যন্ত কেনেননি বলে দাবি সাদিক এগ্রোর কর্ণধার মোহাম্মদ ইমরান হোসাইনের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ইফাত শুধু ১ লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটির বুকিং করেছিলেন। তবে অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ছাগলটির তিনি আর নিয়ে যাননি।
বিষয়টি নিয়ে ইফাতের বক্তব্যও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। তার দাবি, ইমরান হোসাইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তার ‘অনুরোধে’ ছাগলটি নিয়ে প্রচারের জন্য এতটা দামের কথা বলে পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। মতিউর রহমান এ আলোচনায় ‘ঘি ঢেলেছেন’ ছেলের পরিচয় ‘অস্বীকার’ করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান।
এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেইসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা।
এ সংসদ সদস্য বলেন, ইফাত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের (স্ত্রীর) ছেলে। মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি নাম লেখান রাজনীতিতে। তিনি এখন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। মতিউর রহমান এর আগে ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলের, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনারসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৯৪ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়া এ কর্মকর্তা পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সেসব দুদক তদন্তও করেছে। দুদিন আগে বেসরকারি এক টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘চারবার দুদক তদন্ত করে দেখেছে, আমি কোনো দুর্নীতি করিনি।’ মতিউর সরকারি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসায় জড়িয়েছেন, বিনিয়োগ করেছেন পুঁজিবাজারেও। বিপুল আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মতিউর ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘একটা গ্রুপ অব কোম্পানির ৩০০ একরের জমিতে আমার একটা অংশ আছে। কোনো কারখানায় আমার বিনিয়োগ আছে। কিন্তু ৩০০ একর জমি বা কারখানার পুরোটা আমার না। আমাদের পরিবারের বিনিয়োগ আছে মাত্র।’
সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে মতিউর বাদ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পদ হারানোর পর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ থেকেও বাদ পড়ছেন ‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান। কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে সরকার মনোনীত পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আলোচনার মধ্যে রোববার তাকে এনবিআরের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এদিন সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সভা হলেও মতিউর রহমান তাতে যোগ দেননি বলে জানান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম। ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী পর্ষদ সভা শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাকে (মতিউর রহমান) ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্ষদ।’
২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের জন্য সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে দায়িত্ব পেয়েছিলেন মতিউর রহমান। তাকে যে ওই দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে, সে ইঙ্গিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ রোববার সকালেই দিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দিয়ে থাকে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তা বাস্তবায়ন করে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের (সংশোধিত-২০২৩) এর ১৫(৪) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিশেষায়িত ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানিকে উহার পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্ত, পুনঃনিযুক্ত বা পদায়নের পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ করিতে হইবে এবং এরূপ নিযুক্ত কর্মকর্তাগণকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে তাহার পদ হইতে অব্যাহতি দেওয়া, বরখাস্ত করা বা অপসরাণ করা যাইবে না।’
২০১৩ সালের আগে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরাসরি পরিচালক নিয়োগ দিতে পারত সরকার। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশ নিয়ে মতিউর রহমানকে পরিচালক পদ থেকে বাদ দেয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করলো সোনালী ব্যাংক। বতর্মানে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী।
পরিচালক পদে আছেন বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক দৌলতুন্নাহার খানম, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোল্লা আবদুল ওয়াদুদ ও হিসাববিদ (সিএ) প্রতিষ্ঠান বসু ব্যানার্জি নাথ অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা অংশীদার গোপাল চন্দ্র ঘোষ। আর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম পদাধিকার বলে পরিচালক।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে ‘ছাগলকাণ্ডের মতিউর রহমান’ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘পত্র-পত্রিকায় যেভাবে খবরটি এসেছে, সেটি সত্যি অনভিপ্রেত এবং এটি যদি সত্য হয়, তাহলে সেটি খুবই দুঃখজনক।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি, তাকে এনবিআরের সদস্যপদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে’। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গেও কথা বলেছি, তিনিও জানিয়েছেন, তাকে (মতিউর) সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে সরানোর জন্যও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’ পরে বাদও দেয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘এরপর তদন্ত হবে, যে অভিযোগগুলো উপস্থাপিত হয়েছে, সেটা সত্য কিনা সেটা তদন্তের পর বেরিয়ে আসবে। তারপর ভবিষ্যতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ হাছান মাহমুদ বলেন, ‘দুর্নীতির মাধ্যমে এভাবে কারো সম্পদ অর্জন করা কখনোই সমীচীন নয় এবং আমাদের সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে আছে।’
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এনবিআরের এই কর্মকর্তার অনিয়ম তদন্ত করলেও আরও অনেক দুনীতিবাজ বেরিয়ে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যারা দুর্নীতির টাকা বিদেশে বাড়ি করছেন। ঢাকায় গোপনে ফ্ল্যাট, জমি কিনেছে, ছোট খাট অসুস্থতায় বিদেশ ভ্রমণ করছে। এমন অনেক রাঘব বোয়ালও বেরিয়ে আসতে পারে বলে বলে ধারণা করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, দুনীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে সৎ ও মেধাবী সরকারি কর্মকর্তারা কোণঠাসা। পরিবারেও তাদের কদর নেই। সৎ অফিসারদের বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে ভাগে কোরবানি দেয়াও কষ্টকর। অথচ এনবিআরের এই কর্মকর্তার মতো আরো সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুসন্ধান চালালে আরও কাহিনী বেরিয়ে আসতে পাারে। আর কেউ কেউ মনে করছেন চাকরিজীবীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। চাকরিতে যোগ দেয়ার সময় টাকা ও সম্পদের হিসাব জমা দিবে। আর চাকরিকালে কত টাকা বেতন পেয়েছে তার জবাবদিহিতা থাকলে কমবে দুর্নীতি। উন্নতি হবে দেশের।
ছাগলকাণ্ডে ফেঁসে গেলেন মতিউর
রোববার, ২৩ জুন ২০২৪
‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত এনবিআরের রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ‘অবৈধ সম্পদের’ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। সেজন্য দুদকের উপ-পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান ও উপসহকারী পরিচালক সাবিকুন নাহার।
দুদকের এই কমিটিকে মতিউর রহমানের ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত’ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রোববার (২৩ জুন) সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের’ অভিযোগ অনুসন্ধানে গত ৪ জুন এই কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছেন।
অন্যদিকে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানকে রোববারই এনবিআর থেকে সরিয়ে রোববারই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একাদশ বিসিএসের (শুল্ক ও আবগারি) কর্মকর্তা মতিউর রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে সরকার মনোনিত পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ওই পদ থেকেও তাকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী জানিয়েছেন।
গত কোরবানির ঈদের জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুক পোস্টকে ঘিরে গত কয়েক দিন ধরেই রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা চলছে।
ছাগল কিনতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন ইফাত। ধানমন্ডির বাসায় ঈদের দিন ছাগলটি কোরবানি দেয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তখন ছাগলসহ ইফাতের ছবিজুড়ে দিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন- ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার অর্থের উৎস কী?
এ প্রশ্ন ঘিরে সামনে আসতে থাকে ইফাতের পরিচয়। ইফাত নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে ও সংবাদমাধ্যমে বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমান। ইফাতের বাবার পরিচয় ধরে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল ব্যয়ে কোরবানির পশু কেনার সামর্থ হলো কী করে?
অবশ্য ছাগলটি ইফাত শেষ পর্যন্ত কেনেননি বলে দাবি সাদিক এগ্রোর কর্ণধার মোহাম্মদ ইমরান হোসাইনের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ইফাত শুধু ১ লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটির বুকিং করেছিলেন। তবে অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ছাগলটির তিনি আর নিয়ে যাননি।
বিষয়টি নিয়ে ইফাতের বক্তব্যও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। তার দাবি, ইমরান হোসাইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তার ‘অনুরোধে’ ছাগলটি নিয়ে প্রচারের জন্য এতটা দামের কথা বলে পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। মতিউর রহমান এ আলোচনায় ‘ঘি ঢেলেছেন’ ছেলের পরিচয় ‘অস্বীকার’ করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান।
এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেইসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা।
এ সংসদ সদস্য বলেন, ইফাত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের (স্ত্রীর) ছেলে। মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি নাম লেখান রাজনীতিতে। তিনি এখন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। মতিউর রহমান এর আগে ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলের, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনারসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৯৪ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়া এ কর্মকর্তা পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সেসব দুদক তদন্তও করেছে। দুদিন আগে বেসরকারি এক টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘চারবার দুদক তদন্ত করে দেখেছে, আমি কোনো দুর্নীতি করিনি।’ মতিউর সরকারি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসায় জড়িয়েছেন, বিনিয়োগ করেছেন পুঁজিবাজারেও। বিপুল আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মতিউর ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘একটা গ্রুপ অব কোম্পানির ৩০০ একরের জমিতে আমার একটা অংশ আছে। কোনো কারখানায় আমার বিনিয়োগ আছে। কিন্তু ৩০০ একর জমি বা কারখানার পুরোটা আমার না। আমাদের পরিবারের বিনিয়োগ আছে মাত্র।’
সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে মতিউর বাদ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পদ হারানোর পর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ থেকেও বাদ পড়ছেন ‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান। কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে সরকার মনোনীত পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আলোচনার মধ্যে রোববার তাকে এনবিআরের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এদিন সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সভা হলেও মতিউর রহমান তাতে যোগ দেননি বলে জানান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম। ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী পর্ষদ সভা শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাকে (মতিউর রহমান) ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্ষদ।’
২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের জন্য সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে দায়িত্ব পেয়েছিলেন মতিউর রহমান। তাকে যে ওই দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে, সে ইঙ্গিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ রোববার সকালেই দিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দিয়ে থাকে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তা বাস্তবায়ন করে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের (সংশোধিত-২০২৩) এর ১৫(৪) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিশেষায়িত ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানিকে উহার পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্ত, পুনঃনিযুক্ত বা পদায়নের পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ করিতে হইবে এবং এরূপ নিযুক্ত কর্মকর্তাগণকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে তাহার পদ হইতে অব্যাহতি দেওয়া, বরখাস্ত করা বা অপসরাণ করা যাইবে না।’
২০১৩ সালের আগে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরাসরি পরিচালক নিয়োগ দিতে পারত সরকার। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশ নিয়ে মতিউর রহমানকে পরিচালক পদ থেকে বাদ দেয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করলো সোনালী ব্যাংক। বতর্মানে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী।
পরিচালক পদে আছেন বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক দৌলতুন্নাহার খানম, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোল্লা আবদুল ওয়াদুদ ও হিসাববিদ (সিএ) প্রতিষ্ঠান বসু ব্যানার্জি নাথ অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা অংশীদার গোপাল চন্দ্র ঘোষ। আর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম পদাধিকার বলে পরিচালক।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে ‘ছাগলকাণ্ডের মতিউর রহমান’ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘পত্র-পত্রিকায় যেভাবে খবরটি এসেছে, সেটি সত্যি অনভিপ্রেত এবং এটি যদি সত্য হয়, তাহলে সেটি খুবই দুঃখজনক।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি, তাকে এনবিআরের সদস্যপদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে’। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গেও কথা বলেছি, তিনিও জানিয়েছেন, তাকে (মতিউর) সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে সরানোর জন্যও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’ পরে বাদও দেয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘এরপর তদন্ত হবে, যে অভিযোগগুলো উপস্থাপিত হয়েছে, সেটা সত্য কিনা সেটা তদন্তের পর বেরিয়ে আসবে। তারপর ভবিষ্যতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ হাছান মাহমুদ বলেন, ‘দুর্নীতির মাধ্যমে এভাবে কারো সম্পদ অর্জন করা কখনোই সমীচীন নয় এবং আমাদের সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে আছে।’
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এনবিআরের এই কর্মকর্তার অনিয়ম তদন্ত করলেও আরও অনেক দুনীতিবাজ বেরিয়ে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যারা দুর্নীতির টাকা বিদেশে বাড়ি করছেন। ঢাকায় গোপনে ফ্ল্যাট, জমি কিনেছে, ছোট খাট অসুস্থতায় বিদেশ ভ্রমণ করছে। এমন অনেক রাঘব বোয়ালও বেরিয়ে আসতে পারে বলে বলে ধারণা করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, দুনীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে সৎ ও মেধাবী সরকারি কর্মকর্তারা কোণঠাসা। পরিবারেও তাদের কদর নেই। সৎ অফিসারদের বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে ভাগে কোরবানি দেয়াও কষ্টকর। অথচ এনবিআরের এই কর্মকর্তার মতো আরো সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুসন্ধান চালালে আরও কাহিনী বেরিয়ে আসতে পাারে। আর কেউ কেউ মনে করছেন চাকরিজীবীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। চাকরিতে যোগ দেয়ার সময় টাকা ও সম্পদের হিসাব জমা দিবে। আর চাকরিকালে কত টাকা বেতন পেয়েছে তার জবাবদিহিতা থাকলে কমবে দুর্নীতি। উন্নতি হবে দেশের।