গাজা অভিমুখে ত্রাণবাহী নৌবহরে বাধা দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসে ইসরায়েলি কূটনৈতিক অফিসের সামনে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ
গাজায় ত্রাণ বহনকারী নৌবহর আটকের পর সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ শত শত কর্মীকে আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় (জিএসএফ) যারা ছিলেন তাদের একটি ইসরায়েলি বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং সেখান থেকে তাদের নিজ দেশে ফেরানো হবে।
প্রথম নৌকাটিকে গাজার উপকূল থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় থামানো হয়, অন্যগুলোকে আরও কাছাকাছি জায়গায় আটকানো হয়।
ইসরায়েল সে এলাকায় নজরদারি চালাচ্ছে, যদিও সেখানে তাদের এখতিয়ার নেই।
ইসরায়েল জানিয়েছে, তাদের নৌবাহিনী নৌযানগুলোকে সতর্ক করেছিল যে তারা ‘সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে প্রবেশ করছে এবং বৈধ নৌ অবরোধ লঙ্ঘন করছে।’
তবে জিএসএফ-এর দাবি, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ ‘প্রতিরক্ষামূলক নয়, বরং মরিয়া হয়ে নেয়া আগ্রাসী পদক্ষেপ।’
তাদের হিসেবে, মোট ৪৪৩ জনকে আটক করা হয়েছে। অনেকের ওপর জলকামান দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। তবে ইসরায়েলের দাবি, সবাই ‘নিরাপদ ও সুস্থ’ আছেন।
গাজায় ত্রাণ বহনকারী নৌবহরে হামলার ঘটনায় বিভিন্ন দেশে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে অনেক দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাধা দেয়ার জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক ইসরায়েলকে ‘দ্রুত গাজার অবরোধ তুলে নিতে এবং সব সম্ভাব্য উপায়ে জীবন রক্ষাকারী উপকরণের প্রবেশাধিকার দেয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
এক বিবৃতিতে তিনি যোগ করেছেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই নিরপেক্ষ মানবিক সহায়তার যে প্রকল্প রয়েছে সেগুলো ‘কোনো বাধা ছাড়াই’ সহজতর করতে সম্মত হতে হবে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তারা নৌকায় থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে যে ‘আমরা আশা করি পরিস্থিতি নিরাপদভাবে সমাধান হবে’।
আইরিশ ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস এই প্রতিবেদনগুলোকে ‘উদ্বেগজনক’ বলেছেন এবং জানিয়েছেন, তিনি আশা করেন ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলবে। আটক হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত সাতজন আইরিশ নাগরিক আছেন, তাদের মধ্যে সিন ফেইন সিনেটর ক্রিস অ্যান্ড্রুজও রয়েছেন।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো তার দেশে থাকা সব ইসরায়েলি কূটনীতিককে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছেন। তিনি এই বাধা দেয়াকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ‘বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আন্তর্জাতিক অপরাধ’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধ ‘অবৈধ’ এবং ‘বহু দশক ধরে ইসরায়েল যেভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়মুক্তি পাচ্ছে তার শেষ হতে হবে।’
প্যালেস্টাইনের সমর্থনে লন্ডনে বিক্ষোভ
সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে শত শত মানুষকে আটকের ঘটনার প্রতিবাদে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে প্যালেস্টাইনপন্থি বিক্ষোভকারীরা পথে নেমে আসেন।
নিন্দা জানাতে ডাবলিন, প্যারিস, বার্লিন এবং জেনেভার রাস্তায় হাজারো বিক্ষোভকারী সমবেত হন। বুয়েনস আইরেস, মেক্সিকো সিটি এবং করাচিতেও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ইতালির ইউনিয়নগুলো শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এবং দেশটিতে ১০০শ’রও বেশি মিছিল বা গণসমাবেশের সম্ভাবনা রয়েছে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি অবশ্য গাজায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি এখনও বিশ্বাস করি, এসব কিছুই প্যালেস্টাইনি জনগণের কোনো উপকারে আসে না।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তায়েপ এরদোয়ান ইসরায়েলি আগ্রাসনের সমালোচনা করে বলেছেন, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে ইসরায়েল সরকারের শান্তির আশা তৈরি হতে দেয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা অবিলম্বে নৌবহরে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকানদের মুক্তি দেয়, যার মধ্যে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি নকোসি জুয়েলেভেলিল ম্যান্ডেলাও রয়েছেন।
গাজাগামী ত্রাণবহর আটকের পর স্পেন ইসরায়েলি চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্সকে তলব করেছে।
স্টেডফাস্টনেস ফ্লোটিলা জাহাজে থাকা সাত বেলজিয়ান নাগরিককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বেলজিয়াম ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকেও তলব করেছে।
পাকিস্তান, বলিভিয়া এবং মালয়েশিয়াও ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখা গেছে।
শেষ জাহাজ ‘ম্যারিনেট’
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, গাজার অবরোধের এলাকায় ঢোকার আগেই ফ্লোটিলার জাহাজগুলো আটকানো হয়েছে।
তবে ম্যারিনেট নামে একটি জাহাজ কিছুটা দূরে ছিল যেটি এগিয়ে যাচ্ছিল। এতে ছয়জন যাত্রী ছিলেন।
তবে ত্রাণবহরের সেই শেষ নৌযানটিও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আটক করেছে জানাচ্ছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ট্র্যাকিংয়ে এর আগে দেখা যাচ্ছিল এটি আন্তর্জাতিক পানিসীমায় গাজার উপকূল থেকে অনেকটা দূরে। ফ্লোটিলা আয়োজকরা বলছিলেন ম্যারিনেট নৌযানটি ‘এখনো শক্তিশালীভাবে চলছে’।
ম্যারিনেটে থাকা ওমানি কর্মী আমামা আল লাওয়াতি বিবিসি অ্যারাবিককে বলেছিল যে তার নৌকা শুক্রবার দুপুরে গাজা উপকূলে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে এখন গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, শুক্রবার সকালে গাজা থেকে প্রায় ৪২.৫ নটিক্যাল মাইল (৭৯ কিলোমিটার) দূরে ম্যারিনেট নামের জাহাজটিকে আটক করা হয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রেডিও জানিয়েছে যে, নৌবাহিনী ফ্লোটিলার শেষ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ও আরোহীদের আটক করেছে এবং জাহাজটিকে ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ইসরায়েল জানিয়েছে, কোনো নৌকাই অবরোধ এলাকায় প্রবেশ করেনি। ইসরায়েল অবশ্য আগেই বলছিল সেটি অবরোধের কাছে এলে আটক করা হবে।
জিএসএফ-এর সঙ্গে কাজ করা আইনি দলের একজন সদস্য বলেছেন, ‘আগামী দিনে’ অবরোধ ভাঙার আরও প্রচেষ্টা হবে।
জিএসএফ-এর আইনি সহায়তা প্রদান ও পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করা কাইভা বাটারলি (যিনি একটি জাহাজে ছিলেন) বলেছেন, ‘আশা করা হচ্ছে এটি সর্বোচ্চ ১৩টি নৌযান, জাহাজ ও নৌকা হতে পারে এবং এটি গাজায় পৌঁছানোর জন্য একই পথ অনুসরণ করবে।’
এটি আয়োজন করবে আলাদা একটি দল, ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন, যারা আগের দুটি প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু দুটোই আটক হয়েছিল।
ইতালিতে গত বুধবার সন্ধ্যায় কিছু শহরে স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ হয়। প্রধান শ্রমিক ইউনিয়ন সিজিআইএল শুক্রবার একটি সাধারণ ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়, যা গাজার সঙ্গে সংহতি জানাতে এবং ইতালির সরকার ‘আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইতালীয় শ্রমিকদের পরিত্যাগ করেছে’- এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আয়োজন করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে যে ড্রোন হামলা এবং অস্পষ্ট উৎস থেকে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটানোর কারণে ফ্লোটিলার সঙ্গে ইতালীয় ও স্প্যানিশ নৌযান ছিল, তবে আটক অভিযান শুরু হওয়ার অনেক আগেই তারা সরে যায়।
ফ্লোটিলা এক মাস আগে স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে, যেখানে ৪০টিরও বেশি নৌযান এবং প্রায় ৫০০ মানুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য, আইনজীবী ও কর্মী ছিলেন। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সরাসরি গাজায় সহায়তা পৌঁছে দেয়া।
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই জুন ও জুলাই মাসে জাহাজে করে সহায়তা পৌঁছানোর দুটি প্রচেষ্টায় বাধা দিয়েছে।
যেখানে ইসরায়েলি সরকার ফ্লোটিলাকে ‘সেলফি ইয়ট’ বলে বর্ণনা করেছে, সেখানে থুনবার্গ সেই সমালোচনার জবাব দিয়ে গত রোববার বিবিসিকে বলেছেন, আমি মনে করি না কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেবল প্রচারের জন্য এমন কাজ করবে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলো গাজায় খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, তবে তারা বলছে ইসরায়েল সরবরাহ প্রবাহ সীমিত করছে।
ইসরায়েল দাবি করছে, তারা হামাসের হাতে সেই সরবরাহ যাওয়া বন্ধ করার চেষ্টা করছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একটি বিকল্প খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার সমর্থন করে আসছে, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ), যাকে জাতিসংঘ ‘অনৈতিক’ ও ‘অন্তর্নিহিতভাবে অনিরাপদ’ বলে উল্লেখ করেছে।
আইপিসি (ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন), যা জাতিসংঘ সমর্থিত এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ সংস্থা হিসেবে বিবেচিত, গত মাসে নিশ্চিত করেছে যে গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে।
জাতিসংঘের মানবিক প্রধান বলেছেন, এটি ইসরায়েলের ‘পদ্ধতিগতভাবে সহায়তা বাধাগ্রস্ত করার’ সরাসরি ফলাফল।
নেতানিয়াহু এটিকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেছেন এবং আইপিসির তুলে ধরা প্রমাণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গাজা অভিমুখে যাচ্ছে আরও ১১ জাহাজ
ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে গাজা অভিমুখে নতুন করে আরও ১১টি জাহাজ যাত্রা করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) জানিয়েছে, এসব নৌকায় প্রায় ১০০ জন অধিকারকর্মী আছেন।
১৫ বছরের সমুদ্র অভিযানের অভিজ্ঞতা আছে এফএফসির। এর আগে এফএফসি মাদলিন ও হান্দালা ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছিল। এবার অবরোধ ভাঙতে এফএফসি ব্যবহারিক পরামর্শ, দিকনির্দেশনা ও প্রক্রিয়াগত সহায়তা দিচ্ছে।
এক বিবৃতিতে এফএফসি জানিয়েছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজ আরও ৮টি নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে ইতালি ও ফ্রান্সের পতাকাবাহী নৌবহর ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা’ যোগ দিয়েছে। এই বহরে রয়েছে দুটি নৌকা। একসঙ্গে এ দুটি দল ১১টি জাহাজের বহর নিয়ে গাজা অভিমুখে ছুটে চলছে।
বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয়া দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এই বহরে থাকা ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটিতে আছেন।
শুক্রবার দুপুরে ফেইসবুকে দেয়া এক ভিডিও বার্তায় শহিদুল আলম বলেছেন, তাদেরটা সবচেয়ে বড় জাহাজ। তাদের সঙ্গে আরও আটটি ছোট নৌকা আছে। আজ তারা প্যালেস্টাইনি টাইম জোনে পৌঁছেছেন। তবে এখনও দূরত্ব আছে।
কোয়ালিশনের তথ্য অনুযায়ী, নৌযানগুলো বর্তমানে ক্রিট দ্বীপের (পূর্ব ভূমধ্যসাগর) উপকূলে অবস্থান করছে এবং এতে প্রায় ১০০ যাত্রী আছেন।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো ও সেখানে চলমান অবরোধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকবার মিশন চালিয়েছে।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটিতে ২৫টি দেশের সাংবাদিক ও স্বাস্থ্যকর্মী আছেন। এফএফসির সর্বশেষ এই মিশন গত বুধবার যাত্রা শুরু করে। ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গাজা অভিমুখে রওনা হয়েছে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও চিকিৎসকবাহী এই জাহাজ।
প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েল বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশে বাধা দিয়ে আসছে। এ সময়ে ইসরায়েলি বাহিনী প্যালেস্টাইনি সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে আসছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ২৭০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, অনেকে আটক ও কারাগারে বন্দী আছেন।
একইসঙ্গে ধারাবাহিক অবরোধ ও বোমাবর্ষণে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যত ধ্বংস হয়ে পড়েছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। প্যালেস্টাইনি চিকিৎসকদের অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ ওঠেছে। আন্তর্জাতিক চিকিৎসক দলগুলোকেও গাজায় প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। যারা অনুমতি পান, তাদেরও জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বা সরঞ্জাম আনার অনুমতি দেয়া হয় না।
জাহাজে থাকা এফএফসির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হুয়াইদা আরাফ বলেন, ‘কনসায়েন্স’ শুধু ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধের প্রতীক নয়, বরং বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার ডাক।
ইতালির চিকিৎসক রিকার্ডো কোররাদিনি বলেন, ‘সাংবাদিক ও চিকিৎসক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সত্য বলা ও জীবন রক্ষা করা। এই মিশন আমাদের সহকর্মীদের প্রতি এক আহ্বান, আর সেই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও, যাতে তারা নীরবতা ভাঙে, নীতিনৈতিকতা বজায় রাখে এবং ইতিহাসের পাশে দাঁড়ায়।’
ইসরায়েল প্রায় ১৮ বছর ধরে গাজায় অবরোধ চালিয়ে আসছে। প্রায় ২৪ লাখ মানুষের বাস এই উপত্যকায়। চলতি বছরের মার্চে সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া হয় এবং খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহে অবরোধ আরও কড়াকড়ি করা হয়। এতে ভূখণ্ডটি চরম খাদ্যসংকটে পড়ে।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার সতর্ক করছে, এই অবরুদ্ধ অঞ্চলে অনাহার ও রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, আর গাজা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজার ২০০ এর বেশি প্যালেস্টাইনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
গাজা অভিমুখে ত্রাণবাহী নৌবহরে বাধা দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসে ইসরায়েলি কূটনৈতিক অফিসের সামনে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ
শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫
গাজায় ত্রাণ বহনকারী নৌবহর আটকের পর সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ শত শত কর্মীকে আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় (জিএসএফ) যারা ছিলেন তাদের একটি ইসরায়েলি বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং সেখান থেকে তাদের নিজ দেশে ফেরানো হবে।
প্রথম নৌকাটিকে গাজার উপকূল থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় থামানো হয়, অন্যগুলোকে আরও কাছাকাছি জায়গায় আটকানো হয়।
ইসরায়েল সে এলাকায় নজরদারি চালাচ্ছে, যদিও সেখানে তাদের এখতিয়ার নেই।
ইসরায়েল জানিয়েছে, তাদের নৌবাহিনী নৌযানগুলোকে সতর্ক করেছিল যে তারা ‘সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে প্রবেশ করছে এবং বৈধ নৌ অবরোধ লঙ্ঘন করছে।’
তবে জিএসএফ-এর দাবি, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ ‘প্রতিরক্ষামূলক নয়, বরং মরিয়া হয়ে নেয়া আগ্রাসী পদক্ষেপ।’
তাদের হিসেবে, মোট ৪৪৩ জনকে আটক করা হয়েছে। অনেকের ওপর জলকামান দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। তবে ইসরায়েলের দাবি, সবাই ‘নিরাপদ ও সুস্থ’ আছেন।
গাজায় ত্রাণ বহনকারী নৌবহরে হামলার ঘটনায় বিভিন্ন দেশে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে অনেক দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাধা দেয়ার জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক ইসরায়েলকে ‘দ্রুত গাজার অবরোধ তুলে নিতে এবং সব সম্ভাব্য উপায়ে জীবন রক্ষাকারী উপকরণের প্রবেশাধিকার দেয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
এক বিবৃতিতে তিনি যোগ করেছেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই নিরপেক্ষ মানবিক সহায়তার যে প্রকল্প রয়েছে সেগুলো ‘কোনো বাধা ছাড়াই’ সহজতর করতে সম্মত হতে হবে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তারা নৌকায় থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে যে ‘আমরা আশা করি পরিস্থিতি নিরাপদভাবে সমাধান হবে’।
আইরিশ ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস এই প্রতিবেদনগুলোকে ‘উদ্বেগজনক’ বলেছেন এবং জানিয়েছেন, তিনি আশা করেন ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলবে। আটক হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত সাতজন আইরিশ নাগরিক আছেন, তাদের মধ্যে সিন ফেইন সিনেটর ক্রিস অ্যান্ড্রুজও রয়েছেন।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো তার দেশে থাকা সব ইসরায়েলি কূটনীতিককে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছেন। তিনি এই বাধা দেয়াকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ‘বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আন্তর্জাতিক অপরাধ’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধ ‘অবৈধ’ এবং ‘বহু দশক ধরে ইসরায়েল যেভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়মুক্তি পাচ্ছে তার শেষ হতে হবে।’
প্যালেস্টাইনের সমর্থনে লন্ডনে বিক্ষোভ
সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে শত শত মানুষকে আটকের ঘটনার প্রতিবাদে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে প্যালেস্টাইনপন্থি বিক্ষোভকারীরা পথে নেমে আসেন।
নিন্দা জানাতে ডাবলিন, প্যারিস, বার্লিন এবং জেনেভার রাস্তায় হাজারো বিক্ষোভকারী সমবেত হন। বুয়েনস আইরেস, মেক্সিকো সিটি এবং করাচিতেও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ইতালির ইউনিয়নগুলো শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এবং দেশটিতে ১০০শ’রও বেশি মিছিল বা গণসমাবেশের সম্ভাবনা রয়েছে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি অবশ্য গাজায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি এখনও বিশ্বাস করি, এসব কিছুই প্যালেস্টাইনি জনগণের কোনো উপকারে আসে না।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তায়েপ এরদোয়ান ইসরায়েলি আগ্রাসনের সমালোচনা করে বলেছেন, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে ইসরায়েল সরকারের শান্তির আশা তৈরি হতে দেয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা অবিলম্বে নৌবহরে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকানদের মুক্তি দেয়, যার মধ্যে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি নকোসি জুয়েলেভেলিল ম্যান্ডেলাও রয়েছেন।
গাজাগামী ত্রাণবহর আটকের পর স্পেন ইসরায়েলি চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্সকে তলব করেছে।
স্টেডফাস্টনেস ফ্লোটিলা জাহাজে থাকা সাত বেলজিয়ান নাগরিককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বেলজিয়াম ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকেও তলব করেছে।
পাকিস্তান, বলিভিয়া এবং মালয়েশিয়াও ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখা গেছে।
শেষ জাহাজ ‘ম্যারিনেট’
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, গাজার অবরোধের এলাকায় ঢোকার আগেই ফ্লোটিলার জাহাজগুলো আটকানো হয়েছে।
তবে ম্যারিনেট নামে একটি জাহাজ কিছুটা দূরে ছিল যেটি এগিয়ে যাচ্ছিল। এতে ছয়জন যাত্রী ছিলেন।
তবে ত্রাণবহরের সেই শেষ নৌযানটিও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আটক করেছে জানাচ্ছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ট্র্যাকিংয়ে এর আগে দেখা যাচ্ছিল এটি আন্তর্জাতিক পানিসীমায় গাজার উপকূল থেকে অনেকটা দূরে। ফ্লোটিলা আয়োজকরা বলছিলেন ম্যারিনেট নৌযানটি ‘এখনো শক্তিশালীভাবে চলছে’।
ম্যারিনেটে থাকা ওমানি কর্মী আমামা আল লাওয়াতি বিবিসি অ্যারাবিককে বলেছিল যে তার নৌকা শুক্রবার দুপুরে গাজা উপকূলে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে এখন গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, শুক্রবার সকালে গাজা থেকে প্রায় ৪২.৫ নটিক্যাল মাইল (৭৯ কিলোমিটার) দূরে ম্যারিনেট নামের জাহাজটিকে আটক করা হয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রেডিও জানিয়েছে যে, নৌবাহিনী ফ্লোটিলার শেষ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ও আরোহীদের আটক করেছে এবং জাহাজটিকে ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ইসরায়েল জানিয়েছে, কোনো নৌকাই অবরোধ এলাকায় প্রবেশ করেনি। ইসরায়েল অবশ্য আগেই বলছিল সেটি অবরোধের কাছে এলে আটক করা হবে।
জিএসএফ-এর সঙ্গে কাজ করা আইনি দলের একজন সদস্য বলেছেন, ‘আগামী দিনে’ অবরোধ ভাঙার আরও প্রচেষ্টা হবে।
জিএসএফ-এর আইনি সহায়তা প্রদান ও পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করা কাইভা বাটারলি (যিনি একটি জাহাজে ছিলেন) বলেছেন, ‘আশা করা হচ্ছে এটি সর্বোচ্চ ১৩টি নৌযান, জাহাজ ও নৌকা হতে পারে এবং এটি গাজায় পৌঁছানোর জন্য একই পথ অনুসরণ করবে।’
এটি আয়োজন করবে আলাদা একটি দল, ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন, যারা আগের দুটি প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু দুটোই আটক হয়েছিল।
ইতালিতে গত বুধবার সন্ধ্যায় কিছু শহরে স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ হয়। প্রধান শ্রমিক ইউনিয়ন সিজিআইএল শুক্রবার একটি সাধারণ ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়, যা গাজার সঙ্গে সংহতি জানাতে এবং ইতালির সরকার ‘আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইতালীয় শ্রমিকদের পরিত্যাগ করেছে’- এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আয়োজন করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে যে ড্রোন হামলা এবং অস্পষ্ট উৎস থেকে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটানোর কারণে ফ্লোটিলার সঙ্গে ইতালীয় ও স্প্যানিশ নৌযান ছিল, তবে আটক অভিযান শুরু হওয়ার অনেক আগেই তারা সরে যায়।
ফ্লোটিলা এক মাস আগে স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে, যেখানে ৪০টিরও বেশি নৌযান এবং প্রায় ৫০০ মানুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য, আইনজীবী ও কর্মী ছিলেন। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সরাসরি গাজায় সহায়তা পৌঁছে দেয়া।
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই জুন ও জুলাই মাসে জাহাজে করে সহায়তা পৌঁছানোর দুটি প্রচেষ্টায় বাধা দিয়েছে।
যেখানে ইসরায়েলি সরকার ফ্লোটিলাকে ‘সেলফি ইয়ট’ বলে বর্ণনা করেছে, সেখানে থুনবার্গ সেই সমালোচনার জবাব দিয়ে গত রোববার বিবিসিকে বলেছেন, আমি মনে করি না কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেবল প্রচারের জন্য এমন কাজ করবে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলো গাজায় খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, তবে তারা বলছে ইসরায়েল সরবরাহ প্রবাহ সীমিত করছে।
ইসরায়েল দাবি করছে, তারা হামাসের হাতে সেই সরবরাহ যাওয়া বন্ধ করার চেষ্টা করছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একটি বিকল্প খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার সমর্থন করে আসছে, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ), যাকে জাতিসংঘ ‘অনৈতিক’ ও ‘অন্তর্নিহিতভাবে অনিরাপদ’ বলে উল্লেখ করেছে।
আইপিসি (ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন), যা জাতিসংঘ সমর্থিত এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ সংস্থা হিসেবে বিবেচিত, গত মাসে নিশ্চিত করেছে যে গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে।
জাতিসংঘের মানবিক প্রধান বলেছেন, এটি ইসরায়েলের ‘পদ্ধতিগতভাবে সহায়তা বাধাগ্রস্ত করার’ সরাসরি ফলাফল।
নেতানিয়াহু এটিকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেছেন এবং আইপিসির তুলে ধরা প্রমাণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গাজা অভিমুখে যাচ্ছে আরও ১১ জাহাজ
ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে গাজা অভিমুখে নতুন করে আরও ১১টি জাহাজ যাত্রা করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) জানিয়েছে, এসব নৌকায় প্রায় ১০০ জন অধিকারকর্মী আছেন।
১৫ বছরের সমুদ্র অভিযানের অভিজ্ঞতা আছে এফএফসির। এর আগে এফএফসি মাদলিন ও হান্দালা ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছিল। এবার অবরোধ ভাঙতে এফএফসি ব্যবহারিক পরামর্শ, দিকনির্দেশনা ও প্রক্রিয়াগত সহায়তা দিচ্ছে।
এক বিবৃতিতে এফএফসি জানিয়েছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজ আরও ৮টি নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে ইতালি ও ফ্রান্সের পতাকাবাহী নৌবহর ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা’ যোগ দিয়েছে। এই বহরে রয়েছে দুটি নৌকা। একসঙ্গে এ দুটি দল ১১টি জাহাজের বহর নিয়ে গাজা অভিমুখে ছুটে চলছে।
বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয়া দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এই বহরে থাকা ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটিতে আছেন।
শুক্রবার দুপুরে ফেইসবুকে দেয়া এক ভিডিও বার্তায় শহিদুল আলম বলেছেন, তাদেরটা সবচেয়ে বড় জাহাজ। তাদের সঙ্গে আরও আটটি ছোট নৌকা আছে। আজ তারা প্যালেস্টাইনি টাইম জোনে পৌঁছেছেন। তবে এখনও দূরত্ব আছে।
কোয়ালিশনের তথ্য অনুযায়ী, নৌযানগুলো বর্তমানে ক্রিট দ্বীপের (পূর্ব ভূমধ্যসাগর) উপকূলে অবস্থান করছে এবং এতে প্রায় ১০০ যাত্রী আছেন।
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো ও সেখানে চলমান অবরোধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকবার মিশন চালিয়েছে।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটিতে ২৫টি দেশের সাংবাদিক ও স্বাস্থ্যকর্মী আছেন। এফএফসির সর্বশেষ এই মিশন গত বুধবার যাত্রা শুরু করে। ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গাজা অভিমুখে রওনা হয়েছে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও চিকিৎসকবাহী এই জাহাজ।
প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েল বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশে বাধা দিয়ে আসছে। এ সময়ে ইসরায়েলি বাহিনী প্যালেস্টাইনি সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে আসছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ২৭০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, অনেকে আটক ও কারাগারে বন্দী আছেন।
একইসঙ্গে ধারাবাহিক অবরোধ ও বোমাবর্ষণে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যত ধ্বংস হয়ে পড়েছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। প্যালেস্টাইনি চিকিৎসকদের অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ ওঠেছে। আন্তর্জাতিক চিকিৎসক দলগুলোকেও গাজায় প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। যারা অনুমতি পান, তাদেরও জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বা সরঞ্জাম আনার অনুমতি দেয়া হয় না।
জাহাজে থাকা এফএফসির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হুয়াইদা আরাফ বলেন, ‘কনসায়েন্স’ শুধু ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধের প্রতীক নয়, বরং বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার ডাক।
ইতালির চিকিৎসক রিকার্ডো কোররাদিনি বলেন, ‘সাংবাদিক ও চিকিৎসক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সত্য বলা ও জীবন রক্ষা করা। এই মিশন আমাদের সহকর্মীদের প্রতি এক আহ্বান, আর সেই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও, যাতে তারা নীরবতা ভাঙে, নীতিনৈতিকতা বজায় রাখে এবং ইতিহাসের পাশে দাঁড়ায়।’
ইসরায়েল প্রায় ১৮ বছর ধরে গাজায় অবরোধ চালিয়ে আসছে। প্রায় ২৪ লাখ মানুষের বাস এই উপত্যকায়। চলতি বছরের মার্চে সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া হয় এবং খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহে অবরোধ আরও কড়াকড়ি করা হয়। এতে ভূখণ্ডটি চরম খাদ্যসংকটে পড়ে।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার সতর্ক করছে, এই অবরুদ্ধ অঞ্চলে অনাহার ও রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, আর গাজা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজার ২০০ এর বেশি প্যালেস্টাইনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।