আইনসভায় ভারত থেকে আসা শরণার্থীদের কোটা বাতিলসহ ৩৮ দাবি আন্দোলনকারীদের
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে বিক্ষোভে নিরাপত্তাবাহিনী কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে আবারও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। অঞ্চলজুড়ে চলছে টানা চতুর্থ দিনের হরতাল ও অবরোধ। এখন পর্যন্ত সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত নয়জন, যাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা কর্মী। এই উত্তাল পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষ, যার বিস্ফোরণ ঘটেছে “জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি” বা জেএএসি নামে একটি জোটের নেতৃত্বে। এই সংগঠনটি ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অ্যাকটিভিস্ট শওকত নওয়াজ মীর।
২৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন পুরো আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মুজাফফরাবাদসহ একাধিক জেলার বাজারঘাট, দোকানপাট, গণপরিবহন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট পরিষেবা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে, ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন অঞ্চলটির প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ।
এই বিক্ষোভ নতুন নয়। ২০২৩ সালের মে মাসে বিদ্যুৎ বিল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রথমবার ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। সেসময় সরকার বিল কমানো ও ময়দার ভর্তুকির ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন কিছুটা শান্ত করলেও, মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। পরবর্তীতে আন্দোলন আরও সংঘবদ্ধ হয়ে জেএএসি গঠিত হয়। ২০২৪ সালের মে মাসে মুজাফফরাবাদ অভিমুখে ‘লং মার্চ’ চলাকালে আবারও সংঘর্ষে প্রাণ হারান পাঁচজন, যার মধ্যে এক পুলিশ সদস্যও ছিলেন। তখনও প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ জরুরি ভর্তুকি ও মূল্য হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু জেএএসির দাবি অনুসারে, সেসব প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয়নি।
বর্তমান আন্দোলনের ভিত্তি শুধুই অর্থনৈতিক নয়। এবার ওই জোট ৩৮ দফা দাবি পেশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়তি সুবিধা বাতিল, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার উন্নয়ন, কর ছাড়, বেকারত্ব হ্রাস, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন টানেল, সেতু ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের দাবি। বিশেষভাবে আলোচিত দুটি দাবি হলো: আইনসভায় শরণার্থীদের জন্য সংরক্ষিত ১২টি আসন বাতিল এবং “রুলিং এলিট”-এর অপ্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করা। জেএএসির দাবি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারতীয় কাশ্মীর থেকে আগত শরণার্থীরা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে এবং উন্নয়ন বাজেটের একটি বিশাল অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
এই অঞ্চলের অর্থমন্ত্রী আবদুল মাজিদ খান জানিয়েছেন, জেএএসির বেশিরভাগ দাবি নিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে, তবে দু’টি দাবি নিয়ে এখনো মতানৈক্য রয়েছে। তিনি বলেন, “এই শরণার্থীরা যখন ভারতে জমিদার ছিল, তখন তারা সবকিছু ফেলে পাকিস্তানে এসে নিঃস্ব হয়েছে। আজ তাদের যদি প্রতিনিধি আসন না দেই, তবে তারা এই ত্যাগ করলো কেন?” তিনি আরও জানান, সরকার ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ ও ময়দার মূল্য কমিয়েছে, অথচ আন্দোলনকারীরা সেটা মানতে নারাজ।এদিকে, আন্দোলনকারীরা সরকারকে বিশ্বাস করছে না। আগের আন্দোলনের পর বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় তারা মনে করছে এবারও সরকার সময়ক্ষেপণ করছে। পরিস্থিতি শান্ত করতে ইসলামাবাদ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল মুজাফফরাবাদ পাঠানো হয়েছে, তবে প্রথম দফার বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। পরবর্তী বৈঠক শুক্রবার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এই সংকটের মধ্যে এলাকাবাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। একদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি, অন্যদিকে ইন্টারনেট বন্ধ – উভয়ের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে এক গভীর বিচ্ছিন্নতা। সরকার বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেই ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক পুনরায় চালু করা হবে। তবে কবে নাগাদ এই সংকটের সমাধান হবে, তা এখনও অনিশ্চিত।
জেএএসির এবং সরকারের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং একটি টেকসই সমাধানে পৌঁছানো এখন সময়ের দাবি। না হলে এই অসন্তোষ আরও বড় সংকটে পরিণত হতে পারে – যা শুধু আজাদ কাশ্মীর নয়, পুরো পাকিস্তানের জন্যই এক অশনি সংকেত।
আইনসভায় ভারত থেকে আসা শরণার্থীদের কোটা বাতিলসহ ৩৮ দাবি আন্দোলনকারীদের
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে বিক্ষোভে নিরাপত্তাবাহিনী কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে
শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে আবারও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। অঞ্চলজুড়ে চলছে টানা চতুর্থ দিনের হরতাল ও অবরোধ। এখন পর্যন্ত সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত নয়জন, যাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা কর্মী। এই উত্তাল পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষ, যার বিস্ফোরণ ঘটেছে “জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি” বা জেএএসি নামে একটি জোটের নেতৃত্বে। এই সংগঠনটি ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অ্যাকটিভিস্ট শওকত নওয়াজ মীর।
২৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন পুরো আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মুজাফফরাবাদসহ একাধিক জেলার বাজারঘাট, দোকানপাট, গণপরিবহন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট পরিষেবা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে, ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন অঞ্চলটির প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ।
এই বিক্ষোভ নতুন নয়। ২০২৩ সালের মে মাসে বিদ্যুৎ বিল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রথমবার ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। সেসময় সরকার বিল কমানো ও ময়দার ভর্তুকির ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন কিছুটা শান্ত করলেও, মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। পরবর্তীতে আন্দোলন আরও সংঘবদ্ধ হয়ে জেএএসি গঠিত হয়। ২০২৪ সালের মে মাসে মুজাফফরাবাদ অভিমুখে ‘লং মার্চ’ চলাকালে আবারও সংঘর্ষে প্রাণ হারান পাঁচজন, যার মধ্যে এক পুলিশ সদস্যও ছিলেন। তখনও প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ জরুরি ভর্তুকি ও মূল্য হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু জেএএসির দাবি অনুসারে, সেসব প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয়নি।
বর্তমান আন্দোলনের ভিত্তি শুধুই অর্থনৈতিক নয়। এবার ওই জোট ৩৮ দফা দাবি পেশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়তি সুবিধা বাতিল, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার উন্নয়ন, কর ছাড়, বেকারত্ব হ্রাস, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন টানেল, সেতু ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের দাবি। বিশেষভাবে আলোচিত দুটি দাবি হলো: আইনসভায় শরণার্থীদের জন্য সংরক্ষিত ১২টি আসন বাতিল এবং “রুলিং এলিট”-এর অপ্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করা। জেএএসির দাবি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারতীয় কাশ্মীর থেকে আগত শরণার্থীরা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে এবং উন্নয়ন বাজেটের একটি বিশাল অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
এই অঞ্চলের অর্থমন্ত্রী আবদুল মাজিদ খান জানিয়েছেন, জেএএসির বেশিরভাগ দাবি নিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে, তবে দু’টি দাবি নিয়ে এখনো মতানৈক্য রয়েছে। তিনি বলেন, “এই শরণার্থীরা যখন ভারতে জমিদার ছিল, তখন তারা সবকিছু ফেলে পাকিস্তানে এসে নিঃস্ব হয়েছে। আজ তাদের যদি প্রতিনিধি আসন না দেই, তবে তারা এই ত্যাগ করলো কেন?” তিনি আরও জানান, সরকার ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ ও ময়দার মূল্য কমিয়েছে, অথচ আন্দোলনকারীরা সেটা মানতে নারাজ।এদিকে, আন্দোলনকারীরা সরকারকে বিশ্বাস করছে না। আগের আন্দোলনের পর বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় তারা মনে করছে এবারও সরকার সময়ক্ষেপণ করছে। পরিস্থিতি শান্ত করতে ইসলামাবাদ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল মুজাফফরাবাদ পাঠানো হয়েছে, তবে প্রথম দফার বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। পরবর্তী বৈঠক শুক্রবার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এই সংকটের মধ্যে এলাকাবাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। একদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি, অন্যদিকে ইন্টারনেট বন্ধ – উভয়ের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে এক গভীর বিচ্ছিন্নতা। সরকার বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেই ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক পুনরায় চালু করা হবে। তবে কবে নাগাদ এই সংকটের সমাধান হবে, তা এখনও অনিশ্চিত।
জেএএসির এবং সরকারের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং একটি টেকসই সমাধানে পৌঁছানো এখন সময়ের দাবি। না হলে এই অসন্তোষ আরও বড় সংকটে পরিণত হতে পারে – যা শুধু আজাদ কাশ্মীর নয়, পুরো পাকিস্তানের জন্যই এক অশনি সংকেত।