সরকারের নির্বাহী আদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের দেশব্যাপী লককাউন চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তায় বৃহস্পতিবার,(১৩ নভেম্বর ২০২৫) জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আগামী সোমবার মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম কোনো মামলার রায় ঘোষণা হবে।
অঙ্গীকার করেছিলাম, যত শক্তিশালী হোক না কেন, প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া হবে: চিফ প্রসিকিউটর
শেখ হাসিনার মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় ‘অস্বচ্ছতা’ দেখেননি দাবি রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবীর
আসামির সর্বোচ্চ সাজা প্রাপ্য হলে তাই দেয়া উচিত, বিচারকদের কোনো অবিচার করা উচিত নয়: জামায়াত
বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায়ের এই দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী নামে পরিচিত) হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
রায়ের তারিখ ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিংয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘আশা করছি, ১৭ নভেম্বর আদালত তার সুবিবেচনা, তার প্রজ্ঞা প্রয়োগ করবেন। একটি সঠিক রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটা ইতি ঘটাবেন।’
আইন অনুযায়ী যা প্রাপ্য সেটা তাদের বুঝিয়ে দেয়া হবে মন্তব্য করে তাজুল বলেন, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, যারাই বাংলাদেশে যত শক্তিশালী হোক না কেন, যদি কেউ অপরাধ করে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, তাদের সঠিক পন্থায় বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সেই প্রক্রিয়ায় আমরা একটা দীর্ঘ যাত্রা শেষ করেছি।’
ট্রাইব্যুনাল এখন চূড়ান্ত পর্বে উপনীত হয়েছে বলে জানান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। ‘এই জাতির যে বিচারের জন্য আকাক্সক্ষা, যে তৃষ্ণা, সেটার প্রতি তারা সুবিচার করবেন এবং ভবিষ্যতের জন্য এই রায় ইনশাআল্লাহ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, তেমন একটি রায় আমরা প্রত্যাশা করছি’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে সংঘটিত যে ম্যাসাকার (হত্যাকা-) ও মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেই অপরাধের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছিল। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে, সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে, উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে, সেই মামলা এখন রায়ের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। আদালত এই মামলার রায় ঘোষণার জন্য ১৭ নভেম্বর দিন নির্ধারিত করেছেন।’
অন্যদিকে এই মামলায় ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন শুনানী শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা দেখেননি বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা দেখেননি তিনি। কারণ তাকে কেউ কোনো রকমের ইন্টারাপ্ট করেনি (বাধা দেয়নি)।’ এর বাইরে কোনো অস্বচ্ছতা আছে কিনা, তা তার জানা নেই বলেও জানান তিনি।
সাক্ষ্য গ্রহণসহ সবকিছু সমাপ্ত করে রায়ের দিন ধার্য করায় ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ও বিচারকদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে মামলা লড়াইয়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা সাক্ষীদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আনতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা দালিলিক সাক্ষ্যে বিতর্ক (কন্ট্রোভার্সি) তৈরি করার চেষ্টা করেছেন এবং বিভিন্ন সময় দালিলিক সাক্ষীর ওপর বিতর্ক তৈরি হয়েছে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন।’ তিনি বিশ্বাস করেন, তার মক্কেলদ্বয় (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) খালাস পাবেন।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যেসব কাগজপত্র ও দলিলাদি পাওয়া গেছে, তার আলোকে এই মামলা পরিচালনা করেছেন জানিয়ে আমির হোসেন বলেন, সে জায়গায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তাকে কোনো বাধা দেয়া হয়নি। কাগজপত্র যা যা দরকার, যা যা রাষ্ট্রপক্ষের কাছে ছিল, আইন অনুযায়ী যেসব নথিপত্র তার পাওয়া উচিত, সেসবই তাকে দেয়া হয়েছে বলেও জানান শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
শুধু রাষ্ট্রপক্ষের নথিপত্র দিয়ে মামলা যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পেরেছেন কিনা এমন প্রশ্নে এই রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী তার সীমাবদ্ধতা থেকে তিনি চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেছেন। তার তরফ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না এবং তার চেষ্টায় কেউ কোনো বাধাও দেয়নি বলেও দাবি করেন আমির হোসেন।
‘আসামিরা উপস্থিত থাকলে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, যেসব ডকুমেন্টারি এভিডেন্স (প্রামাণ্য নথিপত্র) হয়তো তাকে তারা (আসামিরা) দিতে পারতেন, সেসব নিয়ে তিনি লড়াই করতে পারতেন। সেসব তিনি পাচ্ছেন না’ জানিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ এক জায়গায় কোনো একটা ঘটনার যেভাবে বর্ণনা দিয়েছে, সেই বর্ণনার বাইরেও হয়তো কোনো বর্ণনা থাকতে পারে। সেসব তিনি পাননি। এই জায়গায় তার কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল।’ সেই সীমাবদ্ধতা তার মক্কেলরা অনুপস্থিত থাকার কারণে বলেও দাবি তার।
এ মামলার আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন নিজে বাঁচার জন্য অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন আমির হোসেন। তিনি বলেন, ‘তার মক্কেলদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) ওপর ভর করে সাবেক আইজিপি এটি করেছেন।’
মানবতাবিরোধী এই মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ দাবি করে বলেন, ‘চার্জ গঠন থেকে সাক্ষ্য সবকিছু মিডিয়ার মাধ্যমে জাতি দেখতে পাচ্ছে। বিদ্যমান আইনে অপরাধ বিবেচনায় আসামিদের যদি সর্বোচ্চ সাজা প্রাপ্য হয়, তাহলে তা-ই দেয়া উচিত। ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কোনো অবিচার করা উচিত নয়।’ জামায়াত এই বিষয়টি আইন ও বিচারকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নে মিয়া গোলাম পরওয়ার এ কথা বলেন।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে দেশের মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে দাবি করে পরওয়ার বলেন ‘জনগণ এসব হত্যার বিচার চায়। সরকার বিচারকাজকে হাজারো চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ট্রাইব্যুনাল এগিয়ে নিয়ে গেছে। এজন্য জামায়াত সরকার ও ট্রাইব্যুনালকে ধন্যবাদ জানায়। জামায়াত আশা করে, সব হুমকি ও রক্তচক্ষুকে এড়িয়ে আদালত তার রায় ঘোষণা করবেন। পর্যায়ক্রমে সব মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রথম দিকে এ মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ এই তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে এই তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগগুলো হলো- গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পোড়ানোর অভিযোগ। এই পাঁচ অভিযোগে তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের দিন সাবেক আইজিপি মামুন গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার কওে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। গত ১২ অক্টোবর এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। জুলাই আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদ- চান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। অন্যদিকে দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন যুক্তিতর্কে এ মামলা থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের খালাস আবেদন করেন। রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুনেরও খালাস আবেদন করেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সেদিন (২৩ অক্টোবর) ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই মামলার রায় কবে দেয়া হবে, তা ১৩ নভেম্বর জানানো হবে। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করেছে।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
সরকারের নির্বাহী আদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের দেশব্যাপী লককাউন চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তায় বৃহস্পতিবার,(১৩ নভেম্বর ২০২৫) জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আগামী সোমবার মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম কোনো মামলার রায় ঘোষণা হবে।
অঙ্গীকার করেছিলাম, যত শক্তিশালী হোক না কেন, প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া হবে: চিফ প্রসিকিউটর
শেখ হাসিনার মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় ‘অস্বচ্ছতা’ দেখেননি দাবি রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবীর
আসামির সর্বোচ্চ সাজা প্রাপ্য হলে তাই দেয়া উচিত, বিচারকদের কোনো অবিচার করা উচিত নয়: জামায়াত
বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায়ের এই দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী নামে পরিচিত) হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
রায়ের তারিখ ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিংয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘আশা করছি, ১৭ নভেম্বর আদালত তার সুবিবেচনা, তার প্রজ্ঞা প্রয়োগ করবেন। একটি সঠিক রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটা ইতি ঘটাবেন।’
আইন অনুযায়ী যা প্রাপ্য সেটা তাদের বুঝিয়ে দেয়া হবে মন্তব্য করে তাজুল বলেন, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, যারাই বাংলাদেশে যত শক্তিশালী হোক না কেন, যদি কেউ অপরাধ করে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, তাদের সঠিক পন্থায় বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সেই প্রক্রিয়ায় আমরা একটা দীর্ঘ যাত্রা শেষ করেছি।’
ট্রাইব্যুনাল এখন চূড়ান্ত পর্বে উপনীত হয়েছে বলে জানান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। ‘এই জাতির যে বিচারের জন্য আকাক্সক্ষা, যে তৃষ্ণা, সেটার প্রতি তারা সুবিচার করবেন এবং ভবিষ্যতের জন্য এই রায় ইনশাআল্লাহ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, তেমন একটি রায় আমরা প্রত্যাশা করছি’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে সংঘটিত যে ম্যাসাকার (হত্যাকা-) ও মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেই অপরাধের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছিল। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে, সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে, উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে, সেই মামলা এখন রায়ের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। আদালত এই মামলার রায় ঘোষণার জন্য ১৭ নভেম্বর দিন নির্ধারিত করেছেন।’
অন্যদিকে এই মামলায় ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন শুনানী শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা দেখেননি বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা দেখেননি তিনি। কারণ তাকে কেউ কোনো রকমের ইন্টারাপ্ট করেনি (বাধা দেয়নি)।’ এর বাইরে কোনো অস্বচ্ছতা আছে কিনা, তা তার জানা নেই বলেও জানান তিনি।
সাক্ষ্য গ্রহণসহ সবকিছু সমাপ্ত করে রায়ের দিন ধার্য করায় ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ও বিচারকদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে মামলা লড়াইয়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা সাক্ষীদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আনতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা দালিলিক সাক্ষ্যে বিতর্ক (কন্ট্রোভার্সি) তৈরি করার চেষ্টা করেছেন এবং বিভিন্ন সময় দালিলিক সাক্ষীর ওপর বিতর্ক তৈরি হয়েছে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন।’ তিনি বিশ্বাস করেন, তার মক্কেলদ্বয় (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) খালাস পাবেন।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যেসব কাগজপত্র ও দলিলাদি পাওয়া গেছে, তার আলোকে এই মামলা পরিচালনা করেছেন জানিয়ে আমির হোসেন বলেন, সে জায়গায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তাকে কোনো বাধা দেয়া হয়নি। কাগজপত্র যা যা দরকার, যা যা রাষ্ট্রপক্ষের কাছে ছিল, আইন অনুযায়ী যেসব নথিপত্র তার পাওয়া উচিত, সেসবই তাকে দেয়া হয়েছে বলেও জানান শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
শুধু রাষ্ট্রপক্ষের নথিপত্র দিয়ে মামলা যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পেরেছেন কিনা এমন প্রশ্নে এই রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী তার সীমাবদ্ধতা থেকে তিনি চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেছেন। তার তরফ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না এবং তার চেষ্টায় কেউ কোনো বাধাও দেয়নি বলেও দাবি করেন আমির হোসেন।
‘আসামিরা উপস্থিত থাকলে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, যেসব ডকুমেন্টারি এভিডেন্স (প্রামাণ্য নথিপত্র) হয়তো তাকে তারা (আসামিরা) দিতে পারতেন, সেসব নিয়ে তিনি লড়াই করতে পারতেন। সেসব তিনি পাচ্ছেন না’ জানিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ এক জায়গায় কোনো একটা ঘটনার যেভাবে বর্ণনা দিয়েছে, সেই বর্ণনার বাইরেও হয়তো কোনো বর্ণনা থাকতে পারে। সেসব তিনি পাননি। এই জায়গায় তার কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল।’ সেই সীমাবদ্ধতা তার মক্কেলরা অনুপস্থিত থাকার কারণে বলেও দাবি তার।
এ মামলার আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন নিজে বাঁচার জন্য অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন আমির হোসেন। তিনি বলেন, ‘তার মক্কেলদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) ওপর ভর করে সাবেক আইজিপি এটি করেছেন।’
মানবতাবিরোধী এই মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ দাবি করে বলেন, ‘চার্জ গঠন থেকে সাক্ষ্য সবকিছু মিডিয়ার মাধ্যমে জাতি দেখতে পাচ্ছে। বিদ্যমান আইনে অপরাধ বিবেচনায় আসামিদের যদি সর্বোচ্চ সাজা প্রাপ্য হয়, তাহলে তা-ই দেয়া উচিত। ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কোনো অবিচার করা উচিত নয়।’ জামায়াত এই বিষয়টি আইন ও বিচারকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নে মিয়া গোলাম পরওয়ার এ কথা বলেন।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে দেশের মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে দাবি করে পরওয়ার বলেন ‘জনগণ এসব হত্যার বিচার চায়। সরকার বিচারকাজকে হাজারো চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ট্রাইব্যুনাল এগিয়ে নিয়ে গেছে। এজন্য জামায়াত সরকার ও ট্রাইব্যুনালকে ধন্যবাদ জানায়। জামায়াত আশা করে, সব হুমকি ও রক্তচক্ষুকে এড়িয়ে আদালত তার রায় ঘোষণা করবেন। পর্যায়ক্রমে সব মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রথম দিকে এ মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ এই তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে এই তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগগুলো হলো- গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পোড়ানোর অভিযোগ। এই পাঁচ অভিযোগে তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের দিন সাবেক আইজিপি মামুন গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার কওে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। গত ১২ অক্টোবর এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। জুলাই আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদ- চান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। অন্যদিকে দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন যুক্তিতর্কে এ মামলা থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের খালাস আবেদন করেন। রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুনেরও খালাস আবেদন করেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সেদিন (২৩ অক্টোবর) ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই মামলার রায় কবে দেয়া হবে, তা ১৩ নভেম্বর জানানো হবে। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করেছে।