অসীম বিকাশ বড়ুয়া
বিভুরঞ্জন সরকার
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’ এবং তার আকস্মিক মৃত্যু বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতের এক করুণ ও কঠিন বাস্তবতাকে উন্মোচন করেছে। তার লেখাটি কেবল একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত হতাশার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের সেই অন্ধকার দিকটি তুলে ধরে, যেখানে সততা ও আদর্শের মূল্য প্রায় শূন্য। তার জীবন ও মৃত্যু আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে এবং নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে, যেখানে পেশাদারিত্বের সংজ্ঞা যেন ক্রমশ আপস ও সুবিধাবাদের জালে আটকা পড়ছে। এই চিঠিটি কেবল তার জীবনের শেষ কথা নয়, এটি যেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এক প্রচলিত ধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে: সাংবাদিকতা কি এখন শুধুই টিকে থাকার সংগ্রাম, নাকি আদর্শের চর্চা?
একজন সাংবাদিকের সংগ্রাম ও আদর্শের প্রতি অবিচলতা
বিভুরঞ্জন সরকার তার জীবনের প্রায় পাঁচ দশক সাংবাদিকতার মতো একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি কোনোদিন আপস করেননি, বরং সবসময় সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন তিনি শিখেছিলেন, সত্য প্রকাশ করতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ধারণ করে তিনি সবসময় মানুষের পক্ষে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন ছদ্মনামে, কিন্তু তার লেখায় কোনোদিন সত্যকে আড়াল করেননি। এই আদর্শিক অবস্থানই তাকে বাকিদের থেকে আলাদা করে রেখেছিল। তার দীর্ঘ পেশাগত জীবনে তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক রূপালী এবং শেষ পর্যন্ত ‘আজকের পত্রিকা’। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার মধ্য দিয়ে তিনি সাংবাদিকতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
তার লেখায় আমরা দেখতে পাই, তার সমসাময়িক অনেক সাংবাদিক যখন রাজনৈতিক সুবিধা, মুক্তিযোদ্ধার সনদ বা প্লট পাওয়ার জন্য অন্যায্য পথ অবলম্বন করেছেন, তিনি সে পথে হাঁটেননি। তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, তার এলাকায় অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান না রেখেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাগিয়েছেন, কিন্তু তিনি এই পথে হাঁটেননি। এমনকি নিজের দুর্দশার সময়েও তিনি শেখ হাসিনার সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যেখানে তার পরিচিত অনেক সাংবাদিকই নানা ধরনের সুবিধা পেয়েছেন। তার এই ত্যাগ এবং সততা তাকে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করেছে। এটি যেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এক প্রচলিত ধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে: সাংবাদিকতা কি এখন শুধুই টিকে থাকার সংগ্রাম, নাকি আদর্শের চর্চা?
বিভুরঞ্জন সরকার তার চিঠিতে তার পেশাগত জীবনের কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, তার মতো সাংবাদিকরা যখন ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন, তা ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, বরং নিরাপত্তার জন্য। এই বিষয়টি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে সত্য প্রকাশ করা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি তার লেখালেখির জন্য অনেক খ্যাতিমান মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছেন, যার মধ্যে ছিলেন অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, এবং এমনকি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসব প্রশংসাপত্র তার লেখার মান এবং তার পেশাদারিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। তবুও, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তার লেখা ‘পাঠক খায় না’—এই ধরনের মন্তব্য তাকে আরও হতাশ করেছে।
আর্থিক দুর্দশা ও এক পরিবারের অসহায়ত্ব
বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’টি কেবল পেশাগত হতাশার কথা বলে না, বরং তার ব্যক্তিগত জীবনের আর্থিক দুর্দশার এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরে। দীর্ঘ পাঁচ দশক সাংবাদিকতা করেও তিনি সম্মানজনক বেতন পাননি। তিনি তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, তার বেতন এতটাই কম ছিল যে তা প্রকাশ করতে তিনি বিব্রত বোধ করেন। এর বিপরীতে তার বিভাগীয় প্রধানের বেতন ছিল প্রায় তার দ্বিগুণ। এই ধরনের বৈষম্য তাকে মানসিকভাবে আরও ভেঙে দিয়েছিল।
তার স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল অপরিসীম। তিনি লিখেছেন, তার আর্থরাইটিস, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ ছিল। প্রতি মাসে কেবল ওষুধের জন্যই ২০-২২ হাজার টাকা খরচ হতো। একজন সাংবাদিক, যিনি দেশের জন্য, মানুষের জন্য নিরন্তর লিখেছেন, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাকে চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর জন্য নিয়মিত ধার-দেনা করতে হয়েছে—এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে? তার এই আর্থিক দুর্দশা তার পরিবারকেও প্রভাবিত করেছিল। তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানের ভরণপোষণ ও চিকিৎসার ব্যয় মেটানো তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
তার পারিবারিক যন্ত্রণা কেবল আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার মেধাবী মেয়ে, যে জীবনের কোনো পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়নি, রাজনৈতিক কোপানলে পড়ে তার চাকরি জীবনে পিছিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, বুয়েট থেকে পাশ করা ছেলেটিও বারবার চেষ্টা করেও চাকরি নিশ্চিত করতে পারেনি। এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দেয়, আমাদের সমাজে মেধা, দক্ষতা বা সততার চেয়েও রাজনৈতিক পরিচয় বা সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিভুরঞ্জন সরকার এই বাস্তবতার শিকার হয়েছেন, এবং তার এই অসহায়ত্ব তাকে ক্রমশ হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি তার চিঠিতে তার বন্ধু মাহবুব কামালের সঙ্গে নিজের জীবনের তুলনা করেছেন, যিনি আর্থিক এবং পেশাগতভাবে সফল। এই তুলনাটি কেবল তাদের জীবনের ভিন্নতা প্রকাশ করে না, বরং দেখিয়ে দেয় যে, কীভাবে একই পেশায় থেকেও একজন মানুষ আদর্শের কারণে পিছিয়ে পড়তে পারেন।
একটি মর্মান্তিক সমাপ্তি: প্রশ্নবিদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র
বিভুরঞ্জন সরকারের আকস্মিক মৃত্যু এবং তার লেখা ‘খোলা চিঠি’ অনেকের কাছে একটি ‘সুইসাইড নোট’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যদিও তার মৃত্যুর পেছনের প্রকৃত কারণ এখনো তদন্তাধীন, তবে তার চিঠিটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি সামাজিক, পেশাগত ও পারিবারিক চাপ সইতে না পেরে এই চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি তার চিঠিতে লিখেছেন, “আমি এখন কী করি? কোন পথে হাঁটি?”—এই বাক্যগুলো তার মানসিক যন্ত্রণার গভীরতা তুলে ধরে।
তার মৃত্যু নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে শোক ও হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, এই রাষ্ট্র এবং সমাজ পরোক্ষভাবে একজন সৎ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। যখন তিনি বেঁচে ছিলেন, তখন তার যন্ত্রণা বোঝার বা শোনার সময় কারও ছিল না। অথচ তার মৃত্যুর পর সবাই তার সততার কথা বলছে, তার জন্য শোক প্রকাশ করছে। এটি আমাদের সমাজের এক নির্মম চিত্র, যেখানে মানুষের মূল্য কেবল তার মৃত্যুর পরেই বোঝা যায়।
বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু কেবল একজন ব্যক্তির ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সমাজের একটি কঠিন বাস্তবতা। এটি দেখিয়ে দেয়, কীভাবে একজন সৎ ও আদর্শবান মানুষ দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে কাজ করেও আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন। তার জীবন ও মৃত্যু আমাদের জন্য একটি বেদনাদায়ক সতর্কবার্তা। এটি আমাদের বিদ্যমান সমাজ, রাষ্ট্র এবং পেশাগত পরিবেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা যেন আর না ঘটে, তার জন্য আমাদের সবারই দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। আমাদের উচিত এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে মেধা, সততা এবং আদর্শের মূল্যায়ন হবে, এবং কোনো পেশাজীবীকে তার নীতি ও আদর্শের জন্য মূল্য দিতে হবে না।
[লেখক: দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী; ভাইস-চেয়ারম্যান, কোরিয়া বাংলা প্রেসক্লাব]
অসীম বিকাশ বড়ুয়া
বিভুরঞ্জন সরকার
রোববার, ২৪ আগস্ট ২০২৫
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’ এবং তার আকস্মিক মৃত্যু বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতের এক করুণ ও কঠিন বাস্তবতাকে উন্মোচন করেছে। তার লেখাটি কেবল একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত হতাশার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের সেই অন্ধকার দিকটি তুলে ধরে, যেখানে সততা ও আদর্শের মূল্য প্রায় শূন্য। তার জীবন ও মৃত্যু আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে এবং নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে, যেখানে পেশাদারিত্বের সংজ্ঞা যেন ক্রমশ আপস ও সুবিধাবাদের জালে আটকা পড়ছে। এই চিঠিটি কেবল তার জীবনের শেষ কথা নয়, এটি যেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এক প্রচলিত ধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে: সাংবাদিকতা কি এখন শুধুই টিকে থাকার সংগ্রাম, নাকি আদর্শের চর্চা?
একজন সাংবাদিকের সংগ্রাম ও আদর্শের প্রতি অবিচলতা
বিভুরঞ্জন সরকার তার জীবনের প্রায় পাঁচ দশক সাংবাদিকতার মতো একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি কোনোদিন আপস করেননি, বরং সবসময় সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন তিনি শিখেছিলেন, সত্য প্রকাশ করতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ধারণ করে তিনি সবসময় মানুষের পক্ষে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন ছদ্মনামে, কিন্তু তার লেখায় কোনোদিন সত্যকে আড়াল করেননি। এই আদর্শিক অবস্থানই তাকে বাকিদের থেকে আলাদা করে রেখেছিল। তার দীর্ঘ পেশাগত জীবনে তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক রূপালী এবং শেষ পর্যন্ত ‘আজকের পত্রিকা’। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার মধ্য দিয়ে তিনি সাংবাদিকতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
তার লেখায় আমরা দেখতে পাই, তার সমসাময়িক অনেক সাংবাদিক যখন রাজনৈতিক সুবিধা, মুক্তিযোদ্ধার সনদ বা প্লট পাওয়ার জন্য অন্যায্য পথ অবলম্বন করেছেন, তিনি সে পথে হাঁটেননি। তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, তার এলাকায় অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান না রেখেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাগিয়েছেন, কিন্তু তিনি এই পথে হাঁটেননি। এমনকি নিজের দুর্দশার সময়েও তিনি শেখ হাসিনার সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যেখানে তার পরিচিত অনেক সাংবাদিকই নানা ধরনের সুবিধা পেয়েছেন। তার এই ত্যাগ এবং সততা তাকে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করেছে। এটি যেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এক প্রচলিত ধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে: সাংবাদিকতা কি এখন শুধুই টিকে থাকার সংগ্রাম, নাকি আদর্শের চর্চা?
বিভুরঞ্জন সরকার তার চিঠিতে তার পেশাগত জীবনের কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, তার মতো সাংবাদিকরা যখন ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন, তা ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, বরং নিরাপত্তার জন্য। এই বিষয়টি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে সত্য প্রকাশ করা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি তার লেখালেখির জন্য অনেক খ্যাতিমান মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছেন, যার মধ্যে ছিলেন অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, এবং এমনকি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসব প্রশংসাপত্র তার লেখার মান এবং তার পেশাদারিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। তবুও, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তার লেখা ‘পাঠক খায় না’—এই ধরনের মন্তব্য তাকে আরও হতাশ করেছে।
আর্থিক দুর্দশা ও এক পরিবারের অসহায়ত্ব
বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’টি কেবল পেশাগত হতাশার কথা বলে না, বরং তার ব্যক্তিগত জীবনের আর্থিক দুর্দশার এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরে। দীর্ঘ পাঁচ দশক সাংবাদিকতা করেও তিনি সম্মানজনক বেতন পাননি। তিনি তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, তার বেতন এতটাই কম ছিল যে তা প্রকাশ করতে তিনি বিব্রত বোধ করেন। এর বিপরীতে তার বিভাগীয় প্রধানের বেতন ছিল প্রায় তার দ্বিগুণ। এই ধরনের বৈষম্য তাকে মানসিকভাবে আরও ভেঙে দিয়েছিল।
তার স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল অপরিসীম। তিনি লিখেছেন, তার আর্থরাইটিস, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ ছিল। প্রতি মাসে কেবল ওষুধের জন্যই ২০-২২ হাজার টাকা খরচ হতো। একজন সাংবাদিক, যিনি দেশের জন্য, মানুষের জন্য নিরন্তর লিখেছেন, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাকে চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর জন্য নিয়মিত ধার-দেনা করতে হয়েছে—এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে? তার এই আর্থিক দুর্দশা তার পরিবারকেও প্রভাবিত করেছিল। তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানের ভরণপোষণ ও চিকিৎসার ব্যয় মেটানো তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
তার পারিবারিক যন্ত্রণা কেবল আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার মেধাবী মেয়ে, যে জীবনের কোনো পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়নি, রাজনৈতিক কোপানলে পড়ে তার চাকরি জীবনে পিছিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, বুয়েট থেকে পাশ করা ছেলেটিও বারবার চেষ্টা করেও চাকরি নিশ্চিত করতে পারেনি। এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দেয়, আমাদের সমাজে মেধা, দক্ষতা বা সততার চেয়েও রাজনৈতিক পরিচয় বা সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিভুরঞ্জন সরকার এই বাস্তবতার শিকার হয়েছেন, এবং তার এই অসহায়ত্ব তাকে ক্রমশ হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি তার চিঠিতে তার বন্ধু মাহবুব কামালের সঙ্গে নিজের জীবনের তুলনা করেছেন, যিনি আর্থিক এবং পেশাগতভাবে সফল। এই তুলনাটি কেবল তাদের জীবনের ভিন্নতা প্রকাশ করে না, বরং দেখিয়ে দেয় যে, কীভাবে একই পেশায় থেকেও একজন মানুষ আদর্শের কারণে পিছিয়ে পড়তে পারেন।
একটি মর্মান্তিক সমাপ্তি: প্রশ্নবিদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র
বিভুরঞ্জন সরকারের আকস্মিক মৃত্যু এবং তার লেখা ‘খোলা চিঠি’ অনেকের কাছে একটি ‘সুইসাইড নোট’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যদিও তার মৃত্যুর পেছনের প্রকৃত কারণ এখনো তদন্তাধীন, তবে তার চিঠিটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি সামাজিক, পেশাগত ও পারিবারিক চাপ সইতে না পেরে এই চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি তার চিঠিতে লিখেছেন, “আমি এখন কী করি? কোন পথে হাঁটি?”—এই বাক্যগুলো তার মানসিক যন্ত্রণার গভীরতা তুলে ধরে।
তার মৃত্যু নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে শোক ও হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, এই রাষ্ট্র এবং সমাজ পরোক্ষভাবে একজন সৎ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। যখন তিনি বেঁচে ছিলেন, তখন তার যন্ত্রণা বোঝার বা শোনার সময় কারও ছিল না। অথচ তার মৃত্যুর পর সবাই তার সততার কথা বলছে, তার জন্য শোক প্রকাশ করছে। এটি আমাদের সমাজের এক নির্মম চিত্র, যেখানে মানুষের মূল্য কেবল তার মৃত্যুর পরেই বোঝা যায়।
বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু কেবল একজন ব্যক্তির ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সমাজের একটি কঠিন বাস্তবতা। এটি দেখিয়ে দেয়, কীভাবে একজন সৎ ও আদর্শবান মানুষ দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে কাজ করেও আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন। তার জীবন ও মৃত্যু আমাদের জন্য একটি বেদনাদায়ক সতর্কবার্তা। এটি আমাদের বিদ্যমান সমাজ, রাষ্ট্র এবং পেশাগত পরিবেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা যেন আর না ঘটে, তার জন্য আমাদের সবারই দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। আমাদের উচিত এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে মেধা, সততা এবং আদর্শের মূল্যায়ন হবে, এবং কোনো পেশাজীবীকে তার নীতি ও আদর্শের জন্য মূল্য দিতে হবে না।
[লেখক: দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী; ভাইস-চেয়ারম্যান, কোরিয়া বাংলা প্রেসক্লাব]