alt

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

আনোয়ারুল হক

: বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫

সজ্জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েকদিন যাবত ‘অযথা হৈচৈ করছেন’ এই বলে যে, দেশে নাকি প্রচার চলছে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিলে বেহেশতের বুকিং নিশ্চিত হয়ে যাবে।

কী সেই পুরানো দিনের কথা? সে কথাটি এই যে, জামায়াত ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই জামায়াত এবং জেনোসাইড এই উপমহাদেশে একসাথে জড়িয়ে আছে

তিনি সম্ভবত জামায়াত ইসলামের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যের পুরোটা শোনেননি। শাহজাহান চৌধুরী জামায়াতের নির্বাচনে দায়িত্বশীলদের এক সম্মেলনে বলেছেন “যে, সুযোগ এসেছে তা আর আসবে না। শুধু জনগণ দিয়ে নির্বাচন হয় না। যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রশাসনের যারা আছে, তাদের সবাইকে আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে। আমাদের কথায় মামলা করবে। আমাদের কথায় গ্রেপ্তার করবে। সমস্ত স্কুল শিক্ষককে দাঁড়িপাল্লার পক্ষে প্রচার করতে হবে। আর আমাদের প্রার্থীদের পিছনে পিছনে ওসি পুলিশকে হাঁটতে হবে। এবার আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জামায়তকে ক্ষমতায় আনার”।

শেষ লাইনটা সম্ভবত মীর্জা ফখরুলের চোখ এড়িয়ে গেছে। একমাত্র নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেই আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানা ও প্রকাশ করা সম্ভব। নিশ্চয়ই শাহজাহান চৌধুরীর মতো ‘পরহেজগার’ ব্যক্তি ‘নবুওয়াত’ লাভ না করে এসব কথা প্রচারে নামেননি। এই নবুওয়াত লাভকারীদের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে মীর্জা ফখরুল শিরক করলেন কিনা - সে অভিযোগ কিন্তু উঠতে পারে! জামায়াত ইসলাম ১৯৭১ সনে এ ধরনের ‘নবুওয়াত’ লাভ করেই ‘ইসলামের পাকিস্তান’ রক্ষার নামে উগ্র ধর্মীয় জোশে নেমে পড়েছিল বাঙালি নিধনযজ্ঞে, সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞে, গনিমতের মাল লুন্ঠনে ও নারী নির্যাতনে। দুঃখের বিষয় এই ‘নবুওয়াত’ প্রাপ্তদের বহুকাল দুধ-কলা দিয়ে মীর্জা সাহেবরা পুষেছেন এবং আজ সেই পোষ্যরা তাদের দিকেও ফনা উত্তোলন করছে।

জামায়াত-শিবির রাজনীতির মাঠে বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনো শিক্ষকের সামনে যে চেহারা প্রদর্শন করছে তা তাদের বাইরের কৌশলী চেহারা, ভেতরের উগ্র ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট চেহারাটা শাহজাহান চৌধুরী উন্মোচন করে দিয়েছেন। যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তা নিয়ে এতো কিছু হয়ে গেলো, যার জন্য ফাঁসির রজ্জু অপেক্ষা করছে, তিনিও কোনোদিন এই ভাষায় কথা বলেননি।

জামায়াত ইসলাম অবশ্য ছেলে ভোলানো যুক্তি দিয়ে বলছে বক্তব্যটি শাহজাহান চৌধুরীর ব্যক্তিগত মত। বার বার না করা সত্ত্বেও কেনো তিনি কৌশলী খোলস উন্মোচন করে জামায়াতের আদি ও প্রকৃত চেহারা প্রদশর্ন করলেন - সে জন্য তাকে কারণ দর্শানোর চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য যদি ব্যক্তিগত মত হয়ে থাকে, তবে জামায়াত ইসলামের আমীরের বক্তব্য শুনি। মুহতারাম আমীর শফিকুর রহমানও গত ২২মে, শনিবার চট্টগ্রামে যেয়ে রীতিমতো ভয় পাওয়ার মতো কথা বলেছেন। শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম সফরকালে নগরের চকবাজার প্যারেড মাঠে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের দিন গণভোট হলে জেনোসাইড হওয়ার সম্ভাবনা আছে। জামায়াত আমীরের কণ্ঠে জেনোসাইডের কথা শুনে সত্যজিৎ রায় নির্মিত জনপ্রিয় সিনেমা ‘হীরক রাজার দেশে’-র বহুল প্রচারিত গানের দুটি লাইন স্মরণে এলো - ‘মনে পুরানো দিনের কথা আসে / মনে আসে, ফিরে আসে .....’।

কী সেই পুরানো দিনের কথা? সে কথাটি এই যে, জামায়াত ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই জামায়াত এবং জেনোসাইড এই উপমহাদেশে একসাথে জড়িয়ে আছে। ১৯৪১ সালে আবুল আলা মওদুদীর উদ্যোগে পাকিস্তানের লাহোরে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে জামায়াতই একমাত্র দল যারা গণহত্যা সংগঠিত করেছিলো। আহমদীয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে ১৯৫৩ সালে সারা পশ্চিম পাকিস্তান জুড়েই তারা আহমদীয়া নিধনে দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল। পাঞ্জাবেই দাঙ্গার ভয়াবহতা ছিল বেশি। দাঙ্গায় হাজারের বেশি কাদিয়ানির মৃত্যু ঘটে। এই ধরনের ভয়াবহ দাঙ্গার পরিকল্পনাকারী ও উষ্কানীদাতা হিসেবে মওদুদীকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে মওদুদীর ফাঁসির আদেশ হয়। পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের দুতিয়ালীতে মৃত্যুদণ্ড রদ করে কারাদণ্ড এবং পরে ছেড়েই দেয়া হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে মওদুদীবাদীরা কাউকে অমুসলিম ঘোষণার কে? নিজেকে মুসলিম ঘোষণা করা যায়, ঈমান- আকিদা ও ইসলামকে কোরআন হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু কাউকে তাকফির করা তথা কাফের ঘোষণা করা যায় না। ঈমান এবং কুফরী অন্তরের ব্যাপার। আর অন্তর্যামী একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। কোনো মানুষের অন্য কোনো মানুষকে কাফের আখ্যা দেয়া চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য। সেই ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে, জেনোসাইড করে জামাতী ও তাদের সহযোগীরা পাকিস্তানের বুকে সেই ১৯৫৩ সালে নিজেদের হাত রক্তে রঞ্জিত করেছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশেও তা করতে চাইছে। আজ এক পক্ষ কাদিয়ানী বিদ্বেষে নামবে, কাল আরেক পক্ষ শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নামবে। আর মাজারপন্থীদের তো মোটামুটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের বাউলদের ও সুফি সাধকদের উপর চলছে হামলা- মামলা- গ্রেপ্তারী। এই উগ্রবাদীরা দেশটাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? তা স্পষ্ট করেছেন স্বয়ং উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার নিজের দেয়া স্ট্যাটাসে। তিনি বলেছেন, “... যারা নতুন মাত্রার জুলুম ও সহিংসতা করে বেড়াচ্ছেন, তারা ফ্যসিবাদের পুনর্জাগরণের জন্য দায়ী থাকবেন। সমাজে রাষ্ট্রে চিন্তা ও আচারের বৈচিত্র্যকে বাধাগ্রস্ত করলে ফ্যসিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং জুলাই বিপ্লব ব্যর্থ হবে।” জুলাই জাগরণের আকাক্সক্ষার উল্টো পথে প্রথম দিন থেকেই হাঁটছে জুলাইযোদ্ধাদের একাংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু তাদেরকেই তার নিয়োগকর্তা ভাবেন, তাই তিনিও উল্টো পথে হাঁটতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।

সাম্প্রতিক সময়ের কথা না-হয় বাদই দিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত এবং জেনোসাইড তো জড়াজড়ি করে আছে। দুটিকে পৃথক করা মুশকিল। তাই তো রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা হলো- “... দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ”।

সকল অন্যায়-অপরাধের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দানকারী মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার, দল হিসেবে সেই জামায়াতী অপরাধের বিচার না করে বরং তাদের সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছেন সশস্ত্র বাহিনী দিবসে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর আত্মত্যাগ আর বীরত্বগাথার অনুষ্ঠানে, যাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ সেই যুদ্ধাপরাধী দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ও বরণ করে মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অবমাননা করা হলো। সশস্ত্র বাহিনী দিবসে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সেই দলের আমীরের সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধানের ছবি বিশেষত প্রধান উপদেষ্টার বিগলিত ছবি দেখে দেশবাসী হতবাক হয়েছেন, আর শাহজাহান চৌধুরীরা ঐ ছবি দেখে ‘নবুওয়াত প্রাপ্তি’ লাভ করে কেমন নির্বাচন হবে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। সশস্ত্র বাহিনী দিবসের ঐ বিশেষ ছবিটি দেখে মনে হলো “কত শোভা চারিপাশে / আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!” দেশে কি হীরক রাজার জয়গান চলবে আর ‘ঘোষিত সর্বসেরা এবং সবচেয়ে চমৎকার’ নির্বাচনের আয়োজন পর্ব ‘শাহজাহান স্টাইলে’ অগ্রসর হবে?

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে থাকলেও প্রধান উপদেষ্টার বক্তৃতা শুনে বোঝা গেলো তিনি অনেক কিছুই জানেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে কে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন, স্বাধীন বাংলা অস্থায়ী সরকার পরিচালিত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাথা সবকিছুই তিনি জানেন। শুধু জানেন না স্বাধীনতার সেই বেতার ঘোষণাটি কার নামে বা কার পক্ষ থেকে পাঠ করা হয়েছিলো। যদিও সে সময়ের তরুণ ইউনূস পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ওয়াশিংটন সমাবেশে নিউইয়র্কস্থ বাঙালি পড়–য়াদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি অনেক কিছুই জানেন, কিন্তু জানেন না তৎকালীন জামায়াতে ইসলামের আমীরের ঘোষণা, “জামায়াত কর্মীরা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশ কোনো স্থান হতে পারে না”। তিনি জানেন না, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জারিকৃত অর্ডিন্যান্স অনুসারে যুদ্ধকালীন অভিন্ন সামরিক কমান্ডে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং জামায়াতের বাহিনীগুলো (রাজাকার, আলবদর, আলশামস) পরিচালিত হতো - যারা ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার সাথে জড়িত।

এসব ইতিহাস যদি তিনি ভুলেও যেয়ে থাকেন, তার নিয়োগকৃত নতুন বিশেষ সহকারী মার্কিনি বিশেষজ্ঞের তো অজানা নয় যে, ধর্মীয় চরমপন্থা হলো সমকালীন সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা। আমাদের উপমহাদেশেও এ সমস্যার বাইরে নয়। হঠাৎ করে আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে ওঠা পাকিস্তানের বুকে প্রতিদিন রক্ত ঝরছে পাকিস্তানের সেনাদের এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদেরসহ সাধারণ নাগরিকদের। পাকিস্তানের অখণ্ডতা হুমকির সম্মুখীন। মোদি-যোগীর হিন্দুত্ববাদ শেষ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্রকে কোথায় নিয়ে যায় তা নিয়ে সেদেশের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল মহল বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। বিশ্ব মোড়ল বাংলাদেশে এই ধর্মীয় উগ্রবাদীদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নেমেছে। ধর্মীয় উগ্রবাদী জামায়াত পশ্চিমাদের খুশি রাখতে মধ্যপন্থার লেবাস পরতে চাইছে। সে কাজে মদত দেয়ার নেশায় পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের ‘মনে পুরানো দিনের কথা আর আসে না, ফিরে ফিরে আসে না’!

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

নভেম্বর বিপ্লবের ১০৮ বছর: শ্রেণিসংগ্রামের উজ্জ্বলতম আলোকবর্তিকা

ছবি

তামাকের ক্ষতি হ্রাস: বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হতে পারে যে নীতি

ছবি

ডায়াবেটিস: ঝুঁকি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

ছবি

শিক্ষার হাল-হাকিকত : পরীক্ষার ফলই কি মূল উদ্দেশ্য?

নতুন বাংলাদেশে নারীর পথচলা : অগ্রগতি নাকি পশ্চাদপদতা?

ছবি

কপ-৩০ কেন গুরুত্বপূর্ণ : বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

কপ-৩০ কেন গুরুত্বপূর্ণ: বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং : বুদ্ধিমানরাও প্রতারিত হন!

ছবি

আশা ছিল সরকার আলোচনার জায়গা তৈরি করবে: মাহিন সুলতান

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস

মানুষের অমরত্বের সন্ধানে

বইমেলা ফেব্রুয়ারিতেই চাই

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক আমাদের জীবন: আত্মশুদ্ধি, মৈত্রী ও ত্যাগের মহিমা

ছবি

অশুভ শক্তির বিনাশ, শুভশক্তির জাগরণ

রামু ট্র্যাজেডি: এক যুগ পরেও বিচারের দেখা মেলেনি

ছবি

নারীবিরোধী সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে: ফওজিয়া মোসলেম

ছবি

বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’: সততার এক মর্মান্তিক দলিল

নারীর নিরাপত্তা : সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব

নারীর নিরাপত্তা : সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব

প্রাথমিক শিক্ষা : এবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে

ছবি

বদরুদ্দীন উমর : কণ্ঠহীন সময়ের অনিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর

চীনের তিব্বত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প : আচরণগত অর্থনীতির আলোকে ভারত ও বাংলাদেশের উদ্বেগ

বর্ষায় সাপের উপদ্রব ও আমাদের করণীয়

মুল্যস্ফীতি: বাংলাদেশের বাজারে কি একে বশে আনা সম্ভব?

মানসিক স্বাস্থ্য : একটি মানবিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন

এ অবহেলার শেষ কোথায়?

কালো জাদুর কুসংস্কার : এক অন্ধকার হত্যাযজ্ঞের মুখোশ

ভোক্তা সচেতনতাই নিরাপদ খাদ্যের মূল চাবিকাঠি

ছবি

মোগল আমলের স্থাপত্য মির্জাপুর শাহী মসজিদ

পলিথিনের পাপ, প্রকৃতির প্রতিশোধ

হারিয়ে যাওয়া অভিযোগকৃত চেকের মামলা

জার্মানীতে এসবি ৬২ সম্মেলন : বাংলাদেশের নজর অর্থায়নের ন্যায্যতায়

ছবি

শতবর্ষ পরেও যার প্রয়োজন ফুরোয় না : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

আদিবাসী মুণ্ডা ভাষার বাঁচার আর্তনাদ

মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

tab

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

আনোয়ারুল হক

বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫

সজ্জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েকদিন যাবত ‘অযথা হৈচৈ করছেন’ এই বলে যে, দেশে নাকি প্রচার চলছে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিলে বেহেশতের বুকিং নিশ্চিত হয়ে যাবে।

কী সেই পুরানো দিনের কথা? সে কথাটি এই যে, জামায়াত ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই জামায়াত এবং জেনোসাইড এই উপমহাদেশে একসাথে জড়িয়ে আছে

তিনি সম্ভবত জামায়াত ইসলামের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যের পুরোটা শোনেননি। শাহজাহান চৌধুরী জামায়াতের নির্বাচনে দায়িত্বশীলদের এক সম্মেলনে বলেছেন “যে, সুযোগ এসেছে তা আর আসবে না। শুধু জনগণ দিয়ে নির্বাচন হয় না। যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রশাসনের যারা আছে, তাদের সবাইকে আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে। আমাদের কথায় মামলা করবে। আমাদের কথায় গ্রেপ্তার করবে। সমস্ত স্কুল শিক্ষককে দাঁড়িপাল্লার পক্ষে প্রচার করতে হবে। আর আমাদের প্রার্থীদের পিছনে পিছনে ওসি পুলিশকে হাঁটতে হবে। এবার আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জামায়তকে ক্ষমতায় আনার”।

শেষ লাইনটা সম্ভবত মীর্জা ফখরুলের চোখ এড়িয়ে গেছে। একমাত্র নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেই আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানা ও প্রকাশ করা সম্ভব। নিশ্চয়ই শাহজাহান চৌধুরীর মতো ‘পরহেজগার’ ব্যক্তি ‘নবুওয়াত’ লাভ না করে এসব কথা প্রচারে নামেননি। এই নবুওয়াত লাভকারীদের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে মীর্জা ফখরুল শিরক করলেন কিনা - সে অভিযোগ কিন্তু উঠতে পারে! জামায়াত ইসলাম ১৯৭১ সনে এ ধরনের ‘নবুওয়াত’ লাভ করেই ‘ইসলামের পাকিস্তান’ রক্ষার নামে উগ্র ধর্মীয় জোশে নেমে পড়েছিল বাঙালি নিধনযজ্ঞে, সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞে, গনিমতের মাল লুন্ঠনে ও নারী নির্যাতনে। দুঃখের বিষয় এই ‘নবুওয়াত’ প্রাপ্তদের বহুকাল দুধ-কলা দিয়ে মীর্জা সাহেবরা পুষেছেন এবং আজ সেই পোষ্যরা তাদের দিকেও ফনা উত্তোলন করছে।

জামায়াত-শিবির রাজনীতির মাঠে বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনো শিক্ষকের সামনে যে চেহারা প্রদর্শন করছে তা তাদের বাইরের কৌশলী চেহারা, ভেতরের উগ্র ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট চেহারাটা শাহজাহান চৌধুরী উন্মোচন করে দিয়েছেন। যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তা নিয়ে এতো কিছু হয়ে গেলো, যার জন্য ফাঁসির রজ্জু অপেক্ষা করছে, তিনিও কোনোদিন এই ভাষায় কথা বলেননি।

জামায়াত ইসলাম অবশ্য ছেলে ভোলানো যুক্তি দিয়ে বলছে বক্তব্যটি শাহজাহান চৌধুরীর ব্যক্তিগত মত। বার বার না করা সত্ত্বেও কেনো তিনি কৌশলী খোলস উন্মোচন করে জামায়াতের আদি ও প্রকৃত চেহারা প্রদশর্ন করলেন - সে জন্য তাকে কারণ দর্শানোর চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য যদি ব্যক্তিগত মত হয়ে থাকে, তবে জামায়াত ইসলামের আমীরের বক্তব্য শুনি। মুহতারাম আমীর শফিকুর রহমানও গত ২২মে, শনিবার চট্টগ্রামে যেয়ে রীতিমতো ভয় পাওয়ার মতো কথা বলেছেন। শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম সফরকালে নগরের চকবাজার প্যারেড মাঠে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের দিন গণভোট হলে জেনোসাইড হওয়ার সম্ভাবনা আছে। জামায়াত আমীরের কণ্ঠে জেনোসাইডের কথা শুনে সত্যজিৎ রায় নির্মিত জনপ্রিয় সিনেমা ‘হীরক রাজার দেশে’-র বহুল প্রচারিত গানের দুটি লাইন স্মরণে এলো - ‘মনে পুরানো দিনের কথা আসে / মনে আসে, ফিরে আসে .....’।

কী সেই পুরানো দিনের কথা? সে কথাটি এই যে, জামায়াত ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই জামায়াত এবং জেনোসাইড এই উপমহাদেশে একসাথে জড়িয়ে আছে। ১৯৪১ সালে আবুল আলা মওদুদীর উদ্যোগে পাকিস্তানের লাহোরে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে জামায়াতই একমাত্র দল যারা গণহত্যা সংগঠিত করেছিলো। আহমদীয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে ১৯৫৩ সালে সারা পশ্চিম পাকিস্তান জুড়েই তারা আহমদীয়া নিধনে দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল। পাঞ্জাবেই দাঙ্গার ভয়াবহতা ছিল বেশি। দাঙ্গায় হাজারের বেশি কাদিয়ানির মৃত্যু ঘটে। এই ধরনের ভয়াবহ দাঙ্গার পরিকল্পনাকারী ও উষ্কানীদাতা হিসেবে মওদুদীকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে মওদুদীর ফাঁসির আদেশ হয়। পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের দুতিয়ালীতে মৃত্যুদণ্ড রদ করে কারাদণ্ড এবং পরে ছেড়েই দেয়া হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে মওদুদীবাদীরা কাউকে অমুসলিম ঘোষণার কে? নিজেকে মুসলিম ঘোষণা করা যায়, ঈমান- আকিদা ও ইসলামকে কোরআন হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু কাউকে তাকফির করা তথা কাফের ঘোষণা করা যায় না। ঈমান এবং কুফরী অন্তরের ব্যাপার। আর অন্তর্যামী একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। কোনো মানুষের অন্য কোনো মানুষকে কাফের আখ্যা দেয়া চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য। সেই ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে, জেনোসাইড করে জামাতী ও তাদের সহযোগীরা পাকিস্তানের বুকে সেই ১৯৫৩ সালে নিজেদের হাত রক্তে রঞ্জিত করেছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশেও তা করতে চাইছে। আজ এক পক্ষ কাদিয়ানী বিদ্বেষে নামবে, কাল আরেক পক্ষ শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নামবে। আর মাজারপন্থীদের তো মোটামুটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের বাউলদের ও সুফি সাধকদের উপর চলছে হামলা- মামলা- গ্রেপ্তারী। এই উগ্রবাদীরা দেশটাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? তা স্পষ্ট করেছেন স্বয়ং উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার নিজের দেয়া স্ট্যাটাসে। তিনি বলেছেন, “... যারা নতুন মাত্রার জুলুম ও সহিংসতা করে বেড়াচ্ছেন, তারা ফ্যসিবাদের পুনর্জাগরণের জন্য দায়ী থাকবেন। সমাজে রাষ্ট্রে চিন্তা ও আচারের বৈচিত্র্যকে বাধাগ্রস্ত করলে ফ্যসিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং জুলাই বিপ্লব ব্যর্থ হবে।” জুলাই জাগরণের আকাক্সক্ষার উল্টো পথে প্রথম দিন থেকেই হাঁটছে জুলাইযোদ্ধাদের একাংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু তাদেরকেই তার নিয়োগকর্তা ভাবেন, তাই তিনিও উল্টো পথে হাঁটতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।

সাম্প্রতিক সময়ের কথা না-হয় বাদই দিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত এবং জেনোসাইড তো জড়াজড়ি করে আছে। দুটিকে পৃথক করা মুশকিল। তাই তো রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা হলো- “... দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ”।

সকল অন্যায়-অপরাধের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দানকারী মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার, দল হিসেবে সেই জামায়াতী অপরাধের বিচার না করে বরং তাদের সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছেন সশস্ত্র বাহিনী দিবসে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর আত্মত্যাগ আর বীরত্বগাথার অনুষ্ঠানে, যাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ সেই যুদ্ধাপরাধী দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ও বরণ করে মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অবমাননা করা হলো। সশস্ত্র বাহিনী দিবসে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সেই দলের আমীরের সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধানের ছবি বিশেষত প্রধান উপদেষ্টার বিগলিত ছবি দেখে দেশবাসী হতবাক হয়েছেন, আর শাহজাহান চৌধুরীরা ঐ ছবি দেখে ‘নবুওয়াত প্রাপ্তি’ লাভ করে কেমন নির্বাচন হবে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। সশস্ত্র বাহিনী দিবসের ঐ বিশেষ ছবিটি দেখে মনে হলো “কত শোভা চারিপাশে / আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!” দেশে কি হীরক রাজার জয়গান চলবে আর ‘ঘোষিত সর্বসেরা এবং সবচেয়ে চমৎকার’ নির্বাচনের আয়োজন পর্ব ‘শাহজাহান স্টাইলে’ অগ্রসর হবে?

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে থাকলেও প্রধান উপদেষ্টার বক্তৃতা শুনে বোঝা গেলো তিনি অনেক কিছুই জানেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে কে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন, স্বাধীন বাংলা অস্থায়ী সরকার পরিচালিত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাথা সবকিছুই তিনি জানেন। শুধু জানেন না স্বাধীনতার সেই বেতার ঘোষণাটি কার নামে বা কার পক্ষ থেকে পাঠ করা হয়েছিলো। যদিও সে সময়ের তরুণ ইউনূস পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ওয়াশিংটন সমাবেশে নিউইয়র্কস্থ বাঙালি পড়–য়াদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি অনেক কিছুই জানেন, কিন্তু জানেন না তৎকালীন জামায়াতে ইসলামের আমীরের ঘোষণা, “জামায়াত কর্মীরা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশ কোনো স্থান হতে পারে না”। তিনি জানেন না, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জারিকৃত অর্ডিন্যান্স অনুসারে যুদ্ধকালীন অভিন্ন সামরিক কমান্ডে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং জামায়াতের বাহিনীগুলো (রাজাকার, আলবদর, আলশামস) পরিচালিত হতো - যারা ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার সাথে জড়িত।

এসব ইতিহাস যদি তিনি ভুলেও যেয়ে থাকেন, তার নিয়োগকৃত নতুন বিশেষ সহকারী মার্কিনি বিশেষজ্ঞের তো অজানা নয় যে, ধর্মীয় চরমপন্থা হলো সমকালীন সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা। আমাদের উপমহাদেশেও এ সমস্যার বাইরে নয়। হঠাৎ করে আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে ওঠা পাকিস্তানের বুকে প্রতিদিন রক্ত ঝরছে পাকিস্তানের সেনাদের এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদেরসহ সাধারণ নাগরিকদের। পাকিস্তানের অখণ্ডতা হুমকির সম্মুখীন। মোদি-যোগীর হিন্দুত্ববাদ শেষ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্রকে কোথায় নিয়ে যায় তা নিয়ে সেদেশের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল মহল বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। বিশ্ব মোড়ল বাংলাদেশে এই ধর্মীয় উগ্রবাদীদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নেমেছে। ধর্মীয় উগ্রবাদী জামায়াত পশ্চিমাদের খুশি রাখতে মধ্যপন্থার লেবাস পরতে চাইছে। সে কাজে মদত দেয়ার নেশায় পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের ‘মনে পুরানো দিনের কথা আর আসে না, ফিরে ফিরে আসে না’!

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

back to top