alt

মুক্ত আলোচনা

উপাচার্য ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়

সুধীর বরণ মাঝি

: বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২

একজন উপাচার্য যিনি শ্রদ্ধাভাজন একজন অভিভাবক একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবাবের তথা সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমগ্র জাতির। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক হিসেবে যার কাছে শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষার পরিবেশ এবং প্রশাসনের সুযোগ সুবিধা সর্বাধিক গুরুত্ববহন করে। তিনি এম কোন কাজ করবেনা না যেখানে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের পিতা-মাতা, অভিভাবকদের ছেড়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য উপাচার্য এবং শিক্ষকদের কাছে ছুটে যায় শিক্ষার অভিভাবক হিসেবে।

সেই শিক্ষক , উপাচাযের্র নিকট থেকে ভৎর্সনা কোন ভাবেই কাম্য নয়। আমাদের শিক্ষক, উপাচার্য মহোদয়রা নিশ্চয় আমাদের ছেলেমেয়েদের সাথে আচরণ করবেন যা তিনি তার নিজের সন্তানদের সাথে করে থাকেন। আমাদের সন্তানদেরকেও তাদের সন্তানসমতুল্য মনে করতে হবে। তাদের যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবী-দাওয়াকে নিজেদের সন্তানদের যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবী-দাওয়া মনে করে আলোচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। অন্যথায় উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য ব্যহত হবে। একজন শিক্ষার্থী শুধু বইপুস্তক থেকেই শিখে না তা শিক্ষকদের আচরণ এবং দর্শণ থেকেও শিক্ষা লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুধু প্রজ্ঞা- সংজ্ঞার ফেরিওয়ালা নন, তিনি মনুষ্যত্বের বাতিঘর। তার প্রণোদনায় শিক্ষার্থী শুধু বিদ্বান হবে না, আলোকিত মানুষও হবে। আমি আমার সন্তানদের সাথে যে আচারণ করতে সংকোচবোধ করবো একজন উপাচার্য হিসেবে , একজন শিক্ষক হিসেবে আমি কেন সেই একই আচরণ শিক্ষার্থীদের সাথে খুব অবলিলায় করে ফেলবো ? বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবনার প্রয়োজন আছে বৈকি।

একজন শিক্ষকের কাজ শুধু শ্রেণিকক্ষে বই পড়নোই নয়, তিনি একজন গবেষক, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, একটি আদর্শ , আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগড়ও এবং তিনি ছাত্রদেরকে দায়বদ্ধতা শেখান দেশ, মানুষ ও সমাজের প্রতি। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে মোট আটান্নটি, অর্থাৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের অর্থে পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান বিতরণ ও চর্চার কেন্দ্র। এখানে শিক্ষক,কর্মকর্তা ও ছাত্রদের বিষয় জড়িত। উপাচার্য পদটিকে শুধু প্রশাসনিক পদ ভাবলেই হবে না। জ্ঞান চর্চার বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত। প্রতিনিয়ত ছাত্রদের নানা বিষয় দেখভাল করা একজন শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব। উপাচার্য পদটি শুধু প্রশাসনিক পদই নয় এখানে তিনি একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ অভিভাবকও বটে। একজন অভিভাবক কি করে তার সন্তানদের যৌক্তিক দাবীকে মেনে না নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতে পারেন। এখানেই আমরা দেখি একজন অভিভাবকের অভিভাবকত্বের ঘাটতি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবর্মূর্তি নির্ভর করে উপাচার্যের গুণ-মান-দক্ষতার ওপর। আচার্য মানে প্রভুত জ্ঞানের অধিকারী; উপাচার্য তার কাছাকাছি। উপাচার্য জ্ঞানী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। প্রশ্নবিদ্ধ প্রজ্ঞা-সংজ্ঞার মানুষের দ্বারাই অবিমৃশ্যকারিতা সম্ভব। জানি না কি এমন অমৃত আছে বা যাদু আছে উপচার্য পদে যার কারণে সন্তানদের জীবন বিপন্ন করে হলেও এই পদ আকঁড়ে ধরে রাখতে হবে। কাল মার্ক্সের একটি কথা এখানে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। তিন বলেছিলেন, পূঁজিবাদী অর্থনীতি এমন এক দর্শন যেখানে শতভাগ লাভ দেখে সেখানে সে তার নিজের সন্তানকেও খুন করতে দ্বিধাবোধ করে না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য এবং প্রশাসকদের ক্ষেত্রে তাই দেখছি।

বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধির মুক্তির কেন্দ্র। আর উপাচার্য, শিক্ষক, প্রশাসান তার সহায়ক শক্তি। উল্লেখ্য, চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধর মুক্তি না হলে আলোকিত মানুষ তৈরি হয় না। সব মানুষের মধ্যে আলো আছে ; কিন্তু তাদের সে আলোয় আলোকিত করতে হলে প্রয়োজন চর্চা, প্রশিক্ষণ, আর সে কাজটি করেন আলোকিত-প্রাণিত শিক্ষক। শিক্ষক নিজে আলোকিত হবেন, শিক্ষার্থীকে আলেকিত - প্রাণীত করবেন। এ কারণে স্বামী বিবেকনন্দ বলেছিলেন, “Education is bringing out the good already is man” আর এই কারণেই জন নিউম্যানের ভাষায় শিক্ষকেদর থাকতে হবে, “Philosophical habit of maind” দর্শন-অভ্যস্ত মন। অন্যদিকে প্রজ্ঞা ও সংজ্ঞার মিথস্ক্রিয়ার তৈরি শিক্ষকের চিত্ত হবে হিমাদ্রিসম উন্নত; এবং এযওয়ার্ড সাঈদের ভাষায় তিনি সদাসাহসী হবেন, কারও রুষ্টতা ও তুষ্টতার তোয়াক্কা না করে তার কাজ হবে দদ ঝঢ়বধশ “Speak truth to power” নোয়াম চমস্কির ভাষ্যও অভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয় হবে ভিন্ন মতের চারণক্ষেত্রে। স্বাধীন চিন্তা বিকাশে ভিন্ন মতের পোষকতার বিকল্প নেই।

ভলতেয়ারের ভাষায় ‘‘ তুমি যা বল আমি তা ঘৃণা করি; কিন্তু তোমার যা বলার অধিকার আমি প্রাণ দিয়ে সংরক্ষণ করবো।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো মুক্তির প্রণোদনা সৃষ্টি করা। আর উপাচার্যের কাজ হলো ক্যাম্পাসে মুক্তির প্রণোদনার পরিবেশ সৃষ্টি করা। কাউকে অপমানিত করা, লাঞ্চিত করা, হামলা-মামলা করে বা অনৈতিক বল প্রয়োগ করে কার্য হাসিল করা নয়। বাংলাদেশের উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজনীতিদুষ্ট এবং ত্রুটিপূর্ণ; আর সেই কারণে প্রায় ত্রুটিপূর্ণ উপাচার্যের সুবাদে নিয়োগকারী সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ই বিপন্ন হয়। উপাচার্য নিয়োগ হতে হবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে , দলীয় সরকারের ইচ্ছা – অনিচ্ছায় নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান সৃজন এবং সঞ্চালনের প্রতিষ্ঠান; যার কর্মী শিক্ষককে হতে হবে বিদ্বানও জ্ঞানী। আহরিত বিদ্যা ও চিন্তা উৎসারিত ভাবনা শিক্ষকের চিত্তে প্রজ্ঞা সংজ্ঞার সৃজন করবে। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রজ্ঞা ও সংজ্ঞার স্পর্শ পাবে। আর এটা না হলে এর ব্যর্থতার দায় শিক্ষকের, শিক্ষা প্রশাসনের। রবীন্দ্রনাথ ষোলো বছর বয়সে ১৮৭৭ সালে লিখেছিলেন,‘আমাদের দেশে সৃষ্টি ছাড়া এক শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত রয়েছে যাহাতে শিক্ষার্থীর রুচির পরিবর্তন হয় না, তাহারা স্বাধীনভাবে চিন্তাও করিতে পারে না। (শিক্ষার হেরফের)। আজ এতো দিন পরে আমাদের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মধ্যে এ দুটো বৈশিষ্ট্য কি পাওয়া যায় ? নির্দ্বধায় উত্তর: না। আর তার জন্য ব্যথতার দায়ভায় নিতে হবে শিক্ষক ও শিক্ষা-প্রশাসকদের এবং কোন অজুহাতেই এই দায় এড়ানো যাবে না। সর্বোপরি শিক্ষকের কর্তব্য হলো শিক্ষার্থীকে আচরণ,বচন,বসন ও বিচরণে মানুষ করে তোলা। চিন্তাহীন বিদ্যা শিক্ষার্থী বা সমাজ কারও হিত করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যানের আসন চিরপ্রসিদ্ধ; এবং বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের। মেয়েদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার দায়িত্বও উপাচার্যের ওপরই বর্তায়।

একজন উপাচার্যের কথায় প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করবে, দ্যুতি ছাড়াবে সমাজে কোন অন্ধকারকে ডেকে আনবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য আমাদের উপাচার্যদের মধ্যে সেই দ্যুতি ছড়ানো প্রজ্ঞা খুব কমই দেখতে পাই। নিজেদের দুর্ভাগ্যকে সহজে আমরাঅস্বীকার করতে পারবো না। শুনতে যেমনই শোনা যাক না কেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শিক্ষা ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি-অব্যবস্থা-দুর্নীতির ফলে সৃষ্ট মাত্রাতিরিক্ত সংশয়-সন্দেহ-অবিশ্বাস-অনাস্থা ও অস্বস্থির মধ্য দিয়ে আমরা পথ হেঁটে চলছি। সামনের দিকে, নাকি পেছনের দিকে সে কথা প্রথমেই খোলাসা করে বলার দায় বোধ করছি না। দুঃখজনক হলেও সত্য, যে কোন পরিস্থিতিতে মাথা উঁচু ও মেরুদন্ড শক্ত করে দাঁড়ানোর মতো ব্যক্তিত্বের খুবই অভাব আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। এ যেন অনেকটা ‘পত্রপাঠ বিদায়!’ সবার জন্য লজ্জাকর কথা। ভিসি প্রফেসর সত্যেন সেন, প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, প্রফেসর মতিন চৌধুরী, প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী প্রমুখ তারা শিক্ষকতা পেশা বা ভিসি পদটিকে একেকজন যার যার ব্যক্তিত্ব ও পান্ডিত্য দিয়ে কতই না উপরে তুলে ধরেছেন। যে করেই হোক, সবকিছু সামাল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাকে সবসময় সবার ওপরে তুলে ধরেছেন। কিন্ত আজ বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে আমরা চারিদিকে এসব কি দেখছি ? একেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সবের পদধ্বনি শোনা যায়!

আমরা আর এসব দেখে দেখে অভস্ত হতে চাই না। আমরা চাই দেশের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা প্রসারের লক্ষ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠুক জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা, সাহিত্য-সংস্কৃতি আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার কেন্দ্র। আর উপাচার্য, শিক্ষক ও প্রশাসকরা হবেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার আলোর বাতিঘর, ফেরিওয়ালা, ধারক-বাহক।

[লেখক: শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, চাঁদপুর]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

উপাচার্য ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়

সুধীর বরণ মাঝি

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২

একজন উপাচার্য যিনি শ্রদ্ধাভাজন একজন অভিভাবক একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবাবের তথা সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমগ্র জাতির। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক হিসেবে যার কাছে শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষার পরিবেশ এবং প্রশাসনের সুযোগ সুবিধা সর্বাধিক গুরুত্ববহন করে। তিনি এম কোন কাজ করবেনা না যেখানে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের পিতা-মাতা, অভিভাবকদের ছেড়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য উপাচার্য এবং শিক্ষকদের কাছে ছুটে যায় শিক্ষার অভিভাবক হিসেবে।

সেই শিক্ষক , উপাচাযের্র নিকট থেকে ভৎর্সনা কোন ভাবেই কাম্য নয়। আমাদের শিক্ষক, উপাচার্য মহোদয়রা নিশ্চয় আমাদের ছেলেমেয়েদের সাথে আচরণ করবেন যা তিনি তার নিজের সন্তানদের সাথে করে থাকেন। আমাদের সন্তানদেরকেও তাদের সন্তানসমতুল্য মনে করতে হবে। তাদের যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবী-দাওয়াকে নিজেদের সন্তানদের যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবী-দাওয়া মনে করে আলোচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। অন্যথায় উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য ব্যহত হবে। একজন শিক্ষার্থী শুধু বইপুস্তক থেকেই শিখে না তা শিক্ষকদের আচরণ এবং দর্শণ থেকেও শিক্ষা লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুধু প্রজ্ঞা- সংজ্ঞার ফেরিওয়ালা নন, তিনি মনুষ্যত্বের বাতিঘর। তার প্রণোদনায় শিক্ষার্থী শুধু বিদ্বান হবে না, আলোকিত মানুষও হবে। আমি আমার সন্তানদের সাথে যে আচারণ করতে সংকোচবোধ করবো একজন উপাচার্য হিসেবে , একজন শিক্ষক হিসেবে আমি কেন সেই একই আচরণ শিক্ষার্থীদের সাথে খুব অবলিলায় করে ফেলবো ? বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবনার প্রয়োজন আছে বৈকি।

একজন শিক্ষকের কাজ শুধু শ্রেণিকক্ষে বই পড়নোই নয়, তিনি একজন গবেষক, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, একটি আদর্শ , আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগড়ও এবং তিনি ছাত্রদেরকে দায়বদ্ধতা শেখান দেশ, মানুষ ও সমাজের প্রতি। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে মোট আটান্নটি, অর্থাৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের অর্থে পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান বিতরণ ও চর্চার কেন্দ্র। এখানে শিক্ষক,কর্মকর্তা ও ছাত্রদের বিষয় জড়িত। উপাচার্য পদটিকে শুধু প্রশাসনিক পদ ভাবলেই হবে না। জ্ঞান চর্চার বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত। প্রতিনিয়ত ছাত্রদের নানা বিষয় দেখভাল করা একজন শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব। উপাচার্য পদটি শুধু প্রশাসনিক পদই নয় এখানে তিনি একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ অভিভাবকও বটে। একজন অভিভাবক কি করে তার সন্তানদের যৌক্তিক দাবীকে মেনে না নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতে পারেন। এখানেই আমরা দেখি একজন অভিভাবকের অভিভাবকত্বের ঘাটতি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবর্মূর্তি নির্ভর করে উপাচার্যের গুণ-মান-দক্ষতার ওপর। আচার্য মানে প্রভুত জ্ঞানের অধিকারী; উপাচার্য তার কাছাকাছি। উপাচার্য জ্ঞানী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। প্রশ্নবিদ্ধ প্রজ্ঞা-সংজ্ঞার মানুষের দ্বারাই অবিমৃশ্যকারিতা সম্ভব। জানি না কি এমন অমৃত আছে বা যাদু আছে উপচার্য পদে যার কারণে সন্তানদের জীবন বিপন্ন করে হলেও এই পদ আকঁড়ে ধরে রাখতে হবে। কাল মার্ক্সের একটি কথা এখানে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। তিন বলেছিলেন, পূঁজিবাদী অর্থনীতি এমন এক দর্শন যেখানে শতভাগ লাভ দেখে সেখানে সে তার নিজের সন্তানকেও খুন করতে দ্বিধাবোধ করে না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য এবং প্রশাসকদের ক্ষেত্রে তাই দেখছি।

বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধির মুক্তির কেন্দ্র। আর উপাচার্য, শিক্ষক, প্রশাসান তার সহায়ক শক্তি। উল্লেখ্য, চিন্তার স্বাধীনতা আর বুদ্ধর মুক্তি না হলে আলোকিত মানুষ তৈরি হয় না। সব মানুষের মধ্যে আলো আছে ; কিন্তু তাদের সে আলোয় আলোকিত করতে হলে প্রয়োজন চর্চা, প্রশিক্ষণ, আর সে কাজটি করেন আলোকিত-প্রাণিত শিক্ষক। শিক্ষক নিজে আলোকিত হবেন, শিক্ষার্থীকে আলেকিত - প্রাণীত করবেন। এ কারণে স্বামী বিবেকনন্দ বলেছিলেন, “Education is bringing out the good already is man” আর এই কারণেই জন নিউম্যানের ভাষায় শিক্ষকেদর থাকতে হবে, “Philosophical habit of maind” দর্শন-অভ্যস্ত মন। অন্যদিকে প্রজ্ঞা ও সংজ্ঞার মিথস্ক্রিয়ার তৈরি শিক্ষকের চিত্ত হবে হিমাদ্রিসম উন্নত; এবং এযওয়ার্ড সাঈদের ভাষায় তিনি সদাসাহসী হবেন, কারও রুষ্টতা ও তুষ্টতার তোয়াক্কা না করে তার কাজ হবে দদ ঝঢ়বধশ “Speak truth to power” নোয়াম চমস্কির ভাষ্যও অভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয় হবে ভিন্ন মতের চারণক্ষেত্রে। স্বাধীন চিন্তা বিকাশে ভিন্ন মতের পোষকতার বিকল্প নেই।

ভলতেয়ারের ভাষায় ‘‘ তুমি যা বল আমি তা ঘৃণা করি; কিন্তু তোমার যা বলার অধিকার আমি প্রাণ দিয়ে সংরক্ষণ করবো।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো মুক্তির প্রণোদনা সৃষ্টি করা। আর উপাচার্যের কাজ হলো ক্যাম্পাসে মুক্তির প্রণোদনার পরিবেশ সৃষ্টি করা। কাউকে অপমানিত করা, লাঞ্চিত করা, হামলা-মামলা করে বা অনৈতিক বল প্রয়োগ করে কার্য হাসিল করা নয়। বাংলাদেশের উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজনীতিদুষ্ট এবং ত্রুটিপূর্ণ; আর সেই কারণে প্রায় ত্রুটিপূর্ণ উপাচার্যের সুবাদে নিয়োগকারী সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ই বিপন্ন হয়। উপাচার্য নিয়োগ হতে হবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে , দলীয় সরকারের ইচ্ছা – অনিচ্ছায় নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান সৃজন এবং সঞ্চালনের প্রতিষ্ঠান; যার কর্মী শিক্ষককে হতে হবে বিদ্বানও জ্ঞানী। আহরিত বিদ্যা ও চিন্তা উৎসারিত ভাবনা শিক্ষকের চিত্তে প্রজ্ঞা সংজ্ঞার সৃজন করবে। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রজ্ঞা ও সংজ্ঞার স্পর্শ পাবে। আর এটা না হলে এর ব্যর্থতার দায় শিক্ষকের, শিক্ষা প্রশাসনের। রবীন্দ্রনাথ ষোলো বছর বয়সে ১৮৭৭ সালে লিখেছিলেন,‘আমাদের দেশে সৃষ্টি ছাড়া এক শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত রয়েছে যাহাতে শিক্ষার্থীর রুচির পরিবর্তন হয় না, তাহারা স্বাধীনভাবে চিন্তাও করিতে পারে না। (শিক্ষার হেরফের)। আজ এতো দিন পরে আমাদের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মধ্যে এ দুটো বৈশিষ্ট্য কি পাওয়া যায় ? নির্দ্বধায় উত্তর: না। আর তার জন্য ব্যথতার দায়ভায় নিতে হবে শিক্ষক ও শিক্ষা-প্রশাসকদের এবং কোন অজুহাতেই এই দায় এড়ানো যাবে না। সর্বোপরি শিক্ষকের কর্তব্য হলো শিক্ষার্থীকে আচরণ,বচন,বসন ও বিচরণে মানুষ করে তোলা। চিন্তাহীন বিদ্যা শিক্ষার্থী বা সমাজ কারও হিত করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যানের আসন চিরপ্রসিদ্ধ; এবং বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের। মেয়েদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার দায়িত্বও উপাচার্যের ওপরই বর্তায়।

একজন উপাচার্যের কথায় প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করবে, দ্যুতি ছাড়াবে সমাজে কোন অন্ধকারকে ডেকে আনবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য আমাদের উপাচার্যদের মধ্যে সেই দ্যুতি ছড়ানো প্রজ্ঞা খুব কমই দেখতে পাই। নিজেদের দুর্ভাগ্যকে সহজে আমরাঅস্বীকার করতে পারবো না। শুনতে যেমনই শোনা যাক না কেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শিক্ষা ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি-অব্যবস্থা-দুর্নীতির ফলে সৃষ্ট মাত্রাতিরিক্ত সংশয়-সন্দেহ-অবিশ্বাস-অনাস্থা ও অস্বস্থির মধ্য দিয়ে আমরা পথ হেঁটে চলছি। সামনের দিকে, নাকি পেছনের দিকে সে কথা প্রথমেই খোলাসা করে বলার দায় বোধ করছি না। দুঃখজনক হলেও সত্য, যে কোন পরিস্থিতিতে মাথা উঁচু ও মেরুদন্ড শক্ত করে দাঁড়ানোর মতো ব্যক্তিত্বের খুবই অভাব আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। এ যেন অনেকটা ‘পত্রপাঠ বিদায়!’ সবার জন্য লজ্জাকর কথা। ভিসি প্রফেসর সত্যেন সেন, প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, প্রফেসর মতিন চৌধুরী, প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরী প্রমুখ তারা শিক্ষকতা পেশা বা ভিসি পদটিকে একেকজন যার যার ব্যক্তিত্ব ও পান্ডিত্য দিয়ে কতই না উপরে তুলে ধরেছেন। যে করেই হোক, সবকিছু সামাল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাকে সবসময় সবার ওপরে তুলে ধরেছেন। কিন্ত আজ বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে আমরা চারিদিকে এসব কি দেখছি ? একেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সবের পদধ্বনি শোনা যায়!

আমরা আর এসব দেখে দেখে অভস্ত হতে চাই না। আমরা চাই দেশের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা প্রসারের লক্ষ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠুক জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা, সাহিত্য-সংস্কৃতি আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার কেন্দ্র। আর উপাচার্য, শিক্ষক ও প্রশাসকরা হবেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার আলোর বাতিঘর, ফেরিওয়ালা, ধারক-বাহক।

[লেখক: শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, চাঁদপুর]

back to top