alt

মুক্ত আলোচনা

কান্ট্রিরোড

আসফাক বীন রহমান

: শনিবার, ২১ মে ২০২২

রাত তিনটা । পাশের রুমের মুতাসিম দরজা ঠেলে ভেতরে আসলো । হাতে দুটি বিশাল মগ ।

“সিমন বাই , কফি নেন ” বাহরাইনী ছোটভাই মুতাসিম কফি এগিয়ে দিলো । আমি গাইগুঁই করে বললাম ,“ তুমি কি কফি বলে কাউয়া ( kahwah)চালিয়ে দিচ্ছো না তো ? জঘণ্য স্বাদ ! কিভাবে মজা করে খাও ?” হো হো করে হেসে মুতাসিম বললো, “ না ,এটা নেসলে কফি । তবে আপনার রুমমেট চিলি (শেলী) বাইকে কাওয়া কাওয়াবো ! ” মুতাসিম থার্ড ইয়ারে পড়ে ,আমি ফিফথ ইয়ার । সে প্রায়ই রাত চারটা পর্যন্ত জেগে থাকে । মাঝে মাঝে আমাদের রুমে এসে খোঁজ-খবর করে ,কথা বলে । বিশালদেহী বাহরাইনী তরুণটি নিঃসঙ্গ । সেই তাদের ব্যাচে একমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের ছাত্র ।

আরবী- ভাষী ছাত্র হিসেবে প্রথম দিকে সে না বাংলা না ইংরেজি কোন কিছুই বুঝতো না । আর এজন্য সহপাঠী ও সিনিয়র ছাত্ররা তাকে নিয়ে মজা করতো- এমনকি ডাইনিংয়ের বন্দে আলী, হক মিয়ারাও সুযোগ নিতো । পড়াশোনার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে থাকে । কোনরকম ঠেলেঠুলে সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর পড়াশোনা প্রায় ছেড়ে যাবার দশা । এদিক দিয়ে নেপালী- ইন্ডিয়ান- পাকিস্তানী ছাত্ররা ব্যতিক্রম । তারা এসেই তাঁদের দেশী ভাই-বোনদের পেয়ে যায় এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের কাছাকাছি হবার কারণে দ্রুত এডাপটেশন করতে পারে ।

“আপনাদের প্রফের ডেট দিছে । জানেন ?”:মুতাসিম । “এ জন্যই আজকে ঢাকা থেকে চলে এলাম, অবস্থা টাইট !” :আমি বললাম । হাতে ৩৫ দিনের মতো সময় আছে । আব্বা -আম্মার দোয়া নিতে ঢাকায় গিয়েছিলাম ।এক বন্ধু ফোন করে জানালো পরীক্ষার রাফ ডেট দিয়েছে - জোর কদমে ক্লাস শুরু হয়েছে, বেতালা হলেই ডাব্বা !

কাউয়া ওদের মধ্যপ্রাচ্য- ইরান -কাশ্মীরের মানুষের প্রিয় পানীয় । দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের পান খাওয়ার সাদা পাতার মতো । চায়ের বিকল্প হিসেবে গরম পানিতে দিয়ে দুধ-চিনি ছাড়াই পান করে । গন্ধ ভালো না , খেতেও ভালো না । বেশ কিছুদিন আগে আমাদের তিন রুমমেটকে কাওয়া পানের দাওয়াত দেয়ায় এর রং- গন্ধ দেখে আমার দুই রুমমেট কাজ আছে বলে পালায় । আমি ভদ্রতা করে আধা কাপ খাই । এরপর থেকে ‘কাওয়া’ খাওয়া নিষেধ !

আজকে এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দশটা বেজে গেছে । তিস্তা সকাল সাড়ে সাতটায় ছেড়েছে । সময়মতো ময়মনসিংহ, জামালপুর পার হয়ে দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছেছি । সম্ভবতঃ এই রুটটি আর বেশী হলে ১ বছর থাকবে । ইন ফুল সুইংয়ে যমুনা ব্রীজের কাজ চলছে । আমার অনেক বন্ধু প্রায় সম্পন্ন হওয়া যমুনা ব্রীজ দেখে এসেছে । সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত একটানা ট্রেনে কিভাবে সময় কাটাই এটা আমার ছোট ভাই ইমন প্রায়ই জানতে চায় । এই পথের বৈচিত্রের জন্য বোরিং লাগে না । সাথে ক্লাসমেটদের অনেকেই থাকে । জয়দেবপুর পার হবার পর আস্তে আস্তে শালবন শুরু হয় । খুব সুন্দর । আবার ময়মনসিংহের কাছাকাছি প্রকৃতি অন্যরকম । এখানে রেললাইন ঠিক ভূমির সমতলে একটানা চলে গেছে ; মাঝে মাঝে ডোবা নালা থাকলেও রেললাইনের উচ্চতা বাড়ে না ।

কিন্তু, আমাদের কালীগঞ্জ -নরসিংদী- ভৈরব- ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে রেল লাইন ভূমি থেকে বেশ উঁচুতে । জামালপুরের কাছাকাছি থেকে শুরু হয় আখ ক্ষেত , পান ক্ষেত । পানের বরজ সম্বন্ধে আইডিয়া না থাকলে যে কেউ বলবে ক্ষেতের মাঝখানে মাঝে মাঝে শোলা (পাটশলাকা) দিয়ে বিশাল বিশাল ঘর কেন বানিয়ে রেখেছে ? পান চাষে অতিরিক্ত রোদ ক্ষতিকর । জামালপুর পার হলেই মাটির পরিবর্তে চারপাশে শুধু বালু আর বালু । ট্রেনের গতিও খুব কম। আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের অনেকে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে দৌঁড়ে আখ ক্ষেত থেকে আখ ভেঙে আবার ট্রেনে উঠে যেতো । আশেপাশের জলাভূমিতে পানিফল চাষ হয় ।

দেওয়ানগঞ্জের কাছাকাছি জিলবাংলা সুগার মিল । এই মিলটি সম্বন্ধে স্কুলের বইয়ে পড়া থাকায় প্রতিবারই রেলের বামদিকে তাকিয়ে থাকতাম । তখনই এরপর পড়ণ্ত দশা । দেওয়ানগঞ্জের পর বাহাদুরাবাদ ঘাট । এটাও ভূগোল বই এর বিখ্যাত একটি স্থান । ব্রহ্মপুত্র -যমুনা নদী এখানে বিশাল ।খুবই ভাঙ্গন- প্রবণ এলাকা ।প্রতিবারই দেখি ঢাকা থেকে আসার সময় বা যাবার সময় রেল লাইনগুলো উঠানো-নামানো হচ্ছে , বসানো হচ্ছে । ঘাট প্রায়ই চেঞ্জ করতে হয় । এই স্মৃতিকাতর এলাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর দেড়টা থেকে পৌনে দুইটা বেজে যেতো । ঘাটে অসংখ্য বেড়ার হোটেল । প্রধান আইটেম মসলার গম্বুজের উপর আস্ত ডিমের ভুনা বা বিরাট চিংড়ির ভাজি । ডাল ও অন্যান্য মাছের ব্যবস্থাও ছিলো । গরম গরম ভাতের সাথে দোকানিরা চাইতো খদ্দের চিংড়ি ভাজা বা ডিমের ভুনা নিক । যাত্রী মসলাগুলো ভাতের সাথে মাখিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়া শুরু করতো । রেল পৌঁছার পর যাত্রীরা ঘাটে দাঁড়ানো ষ্টীমারে উঠবে । ষ্টীমার এখান থেকে ছেড়ে বর্ষায় প্রায় দেড় ঘণ্টা আর শীতে প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টায় যমুনা পাড়ি দিয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়ি বা বালাসীঘাটে পৌঁছাবে ।

ট্রেন পৌঁছানোর পর প্রায় আধা ঘন্টা সময় ব্যবধানে স্টীমারটি ছাড়ে । কিন্তু এর মাঝেই কিছুক্ষণ পরপর হুইসেল দেয়। আর হুইসেল দিলেই হোটেল কর্মচারীরা যাত্রীদের তাগাদা দেয় - ‘স্টীমার দিলো ছাইড়া ’ ! যাত্রী ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে দৌঁড় । পাতে পড়ে থাকা বড় চিংড়ি বা ডিমের ভুনা ধুয়ে আবার মশলার গম্বুজে আশ্রয় নেয় । যাত্রীদের কাছ থেকে আগেই বিল নিয়ে নেওয়া হতো ।

ব্রিটিশ রেলওয়ে ১৯৩৮ সালে ময়মনসিংহের সাথে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য এই লাইন ও স্টীমারের ব্যবস্থা করে । স্টীমারে উঠলে গাইবান্ধার বালাসী ফুলছড়ি ঘাট পৌঁছার আগেই দেখা যায় আরেকটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে । সিটের নাম্বার মিলিয়ে যে যার আসনে বসে যেতো । স্টীমারগুলো ছিল দুই তলা । একতলায় আম-জনতা আর দুই তলায় প্রথম শ্রেণি ,শোভন চেয়ারের যাত্রীরা বসতো। ইঞ্জিনের একটানা আওয়াজে কান ঝালাপালা । উপরে ডেক বা ছাদে আমরা বন্ধুরা বসে আশেপাশের বিশাল নদী আর বালুচরের বিষন্নতা অনুভব করতাম । স্টীমারের ভেতর বসার যো ছিলো না টোকাইদের যন্ত্রনায় । এরা ফট করে এসে দুই পা চেপে ধরে বসে থাকে । কতোদিন গোসল করে না কে জানে ! এদেরকে বাড়ি কই জিজ্ঞেস করলে কথা বলেনা , করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে ।বলে , ‘মোক খিলাও’ ।

প্রায় সবগুলোই অতিশয় বদ । যতক্ষণ না পয়সা পাবে ,ছাড়বে না । আমাদের বান্ধবীরা তাদের দেখার সাথে সাথেই পয়সা বের করে বিদায় জানায় । দুই তলার ডেকের পাশে কেবিন , ডাইনিং রুম । খাবারের এতো সুগন্ধ চলন্ত কোন ভেহিকেলে বা পথে কখনই পাইনি । নদীর টাটকা মাছ ,মুরগি আর সবজি- তরকারি প্রতিটি সুপার । সমস্যা , এখানে সীমিত সীট । ভাগ্য ভালো থাকলে বেশ কয়েকটি ব্যাচ পার করে টেবিলে বসতে পারা যায় । অনেক সময় খাদ্যের মজুদ শেষ হয়ে যায় বা ঘাট চলে আসায় খাবারের আশা বাদ দিয়ে রেল ধরতে হয় ।

প্রতিবারই নদীতে পানি কমে গেলে ফুলছড়ির কালাসোনা চ্যানেলে ড্রেজিং দেখতাম । বিশাল ব্যাপার । ড্রেজিং করে নৌপথ চালু রাখা হতো । মাঝে মাঝে দূরে একটা দুইটা চর দেখা যেতো । চরে টিন ও বাঁশের বেড়ার ঘর । কিভাবে এই নির্জন এলাকায় পরিবার নিয়ে মানুষ থাকে ? স্টিমারের সহযাত্রী কোন কোন স্থানীয় মানুষদের এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারা প্রায় প্রত্যেকেই বলতো চরে যারা এভাবে থাকে তাদের প্রায় সবাই দুরন্ত প্রকৃতির মানুষ; সুযোগ বুঝে নৌকায় হানা দেয় । আবার ,দেবদারু গাছের মতো ছোট ছোট গাছ দেখে বলতো এগুলো গাঁজার গাছ -চাষ করে । শীতের দিনে প্রায় রাতে এই চ্যানেলের আশেপাশে নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে স্টীমার আটকে যেতো । থার্ড ইয়ারে থাকার সময় একবার ঢাকায় পৌঁছাতে ৩১ ঘন্টা লেগে ছিলো । চিন্তায় আব্বা-আম্মার হার্টফেল করার দশা । বিরাট ইতিহাস ।

আজকের পর পরীক্ষার কারণে আরো হয়তো তিন থেকে চার মাস পর বাসায় যাবো । ফাইনাল প্রফ পাশ করতে পারলে হয়তো ইন্টার্নী করার সময় আরো দুই-তিন বার এই রুটে আসবো । আস্তে আস্তে ভুলে যাবো পাট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ফুলছড়ি নৌবন্দর, উত্তরাঞ্চলের বড় তেলের ডিপো বালাসীঘাট, কামারজানি নৌবন্দর ,ফুটানি বাজার , চর -আমখাওয়া আরো কতো নাম । আর হয়তো শুনতে পাবো না টিনের চর মাথা , হাবরা বাড়ী, খাটিয়ামারী ,কোচখালীর নাম । এক সময় এই নামগুলো নিয়ে স্থানীয় বন্ধুদের খেপাতাম, এখন কষ্ট হচ্ছে ।

পড়ন্ত বিকালে ঘাটে ষ্টীমার পৌঁছার পর তিস্তামুখ ঘাটে বিশাল বিশাল টাটকা বোয়াল, আইর, কাতলা মাছ দেখলে মনটা আকুপাকু করে উঠে আব্বা-আম্মা -ইমনের জন্য । বোয়াল-আইর আব্বার খুব পছন্দের মাছ । ইশ্ এই টাটকা মাছগুলো যদি ওদের জন্য নিতে পারতাম !

বোনারপাড়া - কাউনিয়ায় দুইবার ট্রেনের ইঞ্জিন বদলানোর জন্য অনেকটা সময় চলে যায় । আমরা সারা দিনের ক্লান্তি চা দোকানে বসে পিয়াজু- পুরীর মাধ্যমে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি । এই বিখ্যাত জংশনে ব্রিটিশ আমলের সাইনবোর্ড তখনও ছিলো -‘ চা পান করার উপকারিতা ’নিয়ে । ট্রেনের গতি খুব কম ,আস্তে আস্তে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাই ।

আমাকে আনমনা দেখে মুতাসিম বললো, “সীমন বাই মন কারাপ ? কালা -কালু বালু আসেন ?” এই সহজ ছেলেটিকে কন্টিনিউয়াস বুলিংয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে । মাঝে মাঝে অশ্রাব্য দুই-তিনটি গালির ব্যাপারে জানতে চাইতো । বলতাম এটা কোথায় শিখেছো ? সে বলতো ওমুক বন্ধু বলেছে , ‘এর মানে চলো বন্ধু নাস্তা করতে যাই বা কেমন আছো ’ ইত্যাদি । আমার রুমমেট হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় । মুতাসিম বলে , “কি হইছে বাই-ই ”? তাকে বোঝানোর পর সে মন খারাপ করে বসে থাকে । রুমমেট তাকে পরামর্শ দেয় , ‘যে তোমাকে এই ধরনের ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ শেখাবে তাকে পাঁচবার করে বলে আসবে’। থার্ড ইয়ারে উঠতে উঠতে মুতাসিম ‘ টেটন দ্য গ্রেট ’ হয়ে যায় ।

আবারো জানতে চাইলো,“ কালা-কালুর জন্য খারাপ লাগছে ? ” আমাকে বোঝায় ,আপনারতো বাবা-মা- ভাই এ দেশেই আছে; আত্মীয়-স্বজন আছে, মন খারাপ হলে দেখতে যেতে পারেন । আমি তো গত ৩৫ মাস ধরে বাড়ি যাই না । এজন্য মুতাসিম ছুটির সময় ঢাকা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যায় । আমাদের বাসায়ও বেশ কয়বার আসায় আব্বার সাথে খুব হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে যায় । আব্বা প্রতিবারই বলতেন ,তুমি আমাদের এখানে উঠো। মুতাসিম বলতো ‘উত্রায় উঠছি ’ । উত্তরায় তাদের দেশের বেশ কয়েকজন মানুষ থাকতেন । আব্বা আমার মেডিকেল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বলতেন , “ওই যে ছেলেটা, উত্রায় উঠতো, কেমন আছে ?”

মুতাসিম বলল আসেন দাবা খেলি আপনার মন ভালো হবে । আমি নাকচ করে দেই । ওর সাথে দাবা খেললে এক দানের বেশী খেলা যাবে না । আর ‘ টাচ এন্ড মুভ ’ যেটা ধরবে সেটাই চালতে হবে । ও প্রায়ই দুই-তিনবার দান চেঞ্জ করে - মাঝে মাঝে “আমিতো মেহমান , আপনার ছোট ভাই, আমার এই পনটা কাটবেন না বলে মানসিকভাবে ব্ল্যাকমেইলিং করে । “ছোট ভাই কালকে খেলবো ”, বলি । ব্যাগের জিনিসপত্র এখনো বের করি নাই ।

মুতাসিমের বিদায়ের পর ব্যাগ খুলতে গিয়ে চোখ ফেটে পানি চলে আসে । গতরাতে ইমন আমার জন্য বিরাট দুটি বিস্কুট- চানাচুরের প্যাকেট সাগর-সম্ভার কনফেকশনারী থেকে নিয়ে আসে । আমি ব্যাগ ভারী হওয়ার অজুহাতে আমার ভাইয়ের প্রিয় চানাচুর -বিস্কিট আগের রাতে লুকিয়ে বের করে মীটসেফে রেখে আসি ।ইমন হয়তো ভোররাতে ওভারট্রাম করে আবার ব্যাগে পুশব্যাক করেছে ।

চোখের পানি মুছতে বেসিনে যেতেই শুনি মুতাসিম জন ডেনভারের - “ কান্ট্রিরোড টেইক মী হোম ” গানটি ছেড়েছে । এটি আমার প্রিয় গানের একটি । এরপর ববি বারের , “ আই এম ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস এওয়ে ফ্রম হোম ” শুনে চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়তে লাগলো ইমন- আম্মা আর দেশ ছেড়ে হাজার মাইল দূরে মেডিকেল কলেজে পড়তে আসা মুতাসিমের জন্য ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

কান্ট্রিরোড

আসফাক বীন রহমান

শনিবার, ২১ মে ২০২২

রাত তিনটা । পাশের রুমের মুতাসিম দরজা ঠেলে ভেতরে আসলো । হাতে দুটি বিশাল মগ ।

“সিমন বাই , কফি নেন ” বাহরাইনী ছোটভাই মুতাসিম কফি এগিয়ে দিলো । আমি গাইগুঁই করে বললাম ,“ তুমি কি কফি বলে কাউয়া ( kahwah)চালিয়ে দিচ্ছো না তো ? জঘণ্য স্বাদ ! কিভাবে মজা করে খাও ?” হো হো করে হেসে মুতাসিম বললো, “ না ,এটা নেসলে কফি । তবে আপনার রুমমেট চিলি (শেলী) বাইকে কাওয়া কাওয়াবো ! ” মুতাসিম থার্ড ইয়ারে পড়ে ,আমি ফিফথ ইয়ার । সে প্রায়ই রাত চারটা পর্যন্ত জেগে থাকে । মাঝে মাঝে আমাদের রুমে এসে খোঁজ-খবর করে ,কথা বলে । বিশালদেহী বাহরাইনী তরুণটি নিঃসঙ্গ । সেই তাদের ব্যাচে একমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের ছাত্র ।

আরবী- ভাষী ছাত্র হিসেবে প্রথম দিকে সে না বাংলা না ইংরেজি কোন কিছুই বুঝতো না । আর এজন্য সহপাঠী ও সিনিয়র ছাত্ররা তাকে নিয়ে মজা করতো- এমনকি ডাইনিংয়ের বন্দে আলী, হক মিয়ারাও সুযোগ নিতো । পড়াশোনার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে থাকে । কোনরকম ঠেলেঠুলে সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর পড়াশোনা প্রায় ছেড়ে যাবার দশা । এদিক দিয়ে নেপালী- ইন্ডিয়ান- পাকিস্তানী ছাত্ররা ব্যতিক্রম । তারা এসেই তাঁদের দেশী ভাই-বোনদের পেয়ে যায় এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের কাছাকাছি হবার কারণে দ্রুত এডাপটেশন করতে পারে ।

“আপনাদের প্রফের ডেট দিছে । জানেন ?”:মুতাসিম । “এ জন্যই আজকে ঢাকা থেকে চলে এলাম, অবস্থা টাইট !” :আমি বললাম । হাতে ৩৫ দিনের মতো সময় আছে । আব্বা -আম্মার দোয়া নিতে ঢাকায় গিয়েছিলাম ।এক বন্ধু ফোন করে জানালো পরীক্ষার রাফ ডেট দিয়েছে - জোর কদমে ক্লাস শুরু হয়েছে, বেতালা হলেই ডাব্বা !

কাউয়া ওদের মধ্যপ্রাচ্য- ইরান -কাশ্মীরের মানুষের প্রিয় পানীয় । দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের পান খাওয়ার সাদা পাতার মতো । চায়ের বিকল্প হিসেবে গরম পানিতে দিয়ে দুধ-চিনি ছাড়াই পান করে । গন্ধ ভালো না , খেতেও ভালো না । বেশ কিছুদিন আগে আমাদের তিন রুমমেটকে কাওয়া পানের দাওয়াত দেয়ায় এর রং- গন্ধ দেখে আমার দুই রুমমেট কাজ আছে বলে পালায় । আমি ভদ্রতা করে আধা কাপ খাই । এরপর থেকে ‘কাওয়া’ খাওয়া নিষেধ !

আজকে এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দশটা বেজে গেছে । তিস্তা সকাল সাড়ে সাতটায় ছেড়েছে । সময়মতো ময়মনসিংহ, জামালপুর পার হয়ে দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছেছি । সম্ভবতঃ এই রুটটি আর বেশী হলে ১ বছর থাকবে । ইন ফুল সুইংয়ে যমুনা ব্রীজের কাজ চলছে । আমার অনেক বন্ধু প্রায় সম্পন্ন হওয়া যমুনা ব্রীজ দেখে এসেছে । সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত একটানা ট্রেনে কিভাবে সময় কাটাই এটা আমার ছোট ভাই ইমন প্রায়ই জানতে চায় । এই পথের বৈচিত্রের জন্য বোরিং লাগে না । সাথে ক্লাসমেটদের অনেকেই থাকে । জয়দেবপুর পার হবার পর আস্তে আস্তে শালবন শুরু হয় । খুব সুন্দর । আবার ময়মনসিংহের কাছাকাছি প্রকৃতি অন্যরকম । এখানে রেললাইন ঠিক ভূমির সমতলে একটানা চলে গেছে ; মাঝে মাঝে ডোবা নালা থাকলেও রেললাইনের উচ্চতা বাড়ে না ।

কিন্তু, আমাদের কালীগঞ্জ -নরসিংদী- ভৈরব- ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে রেল লাইন ভূমি থেকে বেশ উঁচুতে । জামালপুরের কাছাকাছি থেকে শুরু হয় আখ ক্ষেত , পান ক্ষেত । পানের বরজ সম্বন্ধে আইডিয়া না থাকলে যে কেউ বলবে ক্ষেতের মাঝখানে মাঝে মাঝে শোলা (পাটশলাকা) দিয়ে বিশাল বিশাল ঘর কেন বানিয়ে রেখেছে ? পান চাষে অতিরিক্ত রোদ ক্ষতিকর । জামালপুর পার হলেই মাটির পরিবর্তে চারপাশে শুধু বালু আর বালু । ট্রেনের গতিও খুব কম। আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের অনেকে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে দৌঁড়ে আখ ক্ষেত থেকে আখ ভেঙে আবার ট্রেনে উঠে যেতো । আশেপাশের জলাভূমিতে পানিফল চাষ হয় ।

দেওয়ানগঞ্জের কাছাকাছি জিলবাংলা সুগার মিল । এই মিলটি সম্বন্ধে স্কুলের বইয়ে পড়া থাকায় প্রতিবারই রেলের বামদিকে তাকিয়ে থাকতাম । তখনই এরপর পড়ণ্ত দশা । দেওয়ানগঞ্জের পর বাহাদুরাবাদ ঘাট । এটাও ভূগোল বই এর বিখ্যাত একটি স্থান । ব্রহ্মপুত্র -যমুনা নদী এখানে বিশাল ।খুবই ভাঙ্গন- প্রবণ এলাকা ।প্রতিবারই দেখি ঢাকা থেকে আসার সময় বা যাবার সময় রেল লাইনগুলো উঠানো-নামানো হচ্ছে , বসানো হচ্ছে । ঘাট প্রায়ই চেঞ্জ করতে হয় । এই স্মৃতিকাতর এলাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর দেড়টা থেকে পৌনে দুইটা বেজে যেতো । ঘাটে অসংখ্য বেড়ার হোটেল । প্রধান আইটেম মসলার গম্বুজের উপর আস্ত ডিমের ভুনা বা বিরাট চিংড়ির ভাজি । ডাল ও অন্যান্য মাছের ব্যবস্থাও ছিলো । গরম গরম ভাতের সাথে দোকানিরা চাইতো খদ্দের চিংড়ি ভাজা বা ডিমের ভুনা নিক । যাত্রী মসলাগুলো ভাতের সাথে মাখিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়া শুরু করতো । রেল পৌঁছার পর যাত্রীরা ঘাটে দাঁড়ানো ষ্টীমারে উঠবে । ষ্টীমার এখান থেকে ছেড়ে বর্ষায় প্রায় দেড় ঘণ্টা আর শীতে প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টায় যমুনা পাড়ি দিয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়ি বা বালাসীঘাটে পৌঁছাবে ।

ট্রেন পৌঁছানোর পর প্রায় আধা ঘন্টা সময় ব্যবধানে স্টীমারটি ছাড়ে । কিন্তু এর মাঝেই কিছুক্ষণ পরপর হুইসেল দেয়। আর হুইসেল দিলেই হোটেল কর্মচারীরা যাত্রীদের তাগাদা দেয় - ‘স্টীমার দিলো ছাইড়া ’ ! যাত্রী ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে দৌঁড় । পাতে পড়ে থাকা বড় চিংড়ি বা ডিমের ভুনা ধুয়ে আবার মশলার গম্বুজে আশ্রয় নেয় । যাত্রীদের কাছ থেকে আগেই বিল নিয়ে নেওয়া হতো ।

ব্রিটিশ রেলওয়ে ১৯৩৮ সালে ময়মনসিংহের সাথে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য এই লাইন ও স্টীমারের ব্যবস্থা করে । স্টীমারে উঠলে গাইবান্ধার বালাসী ফুলছড়ি ঘাট পৌঁছার আগেই দেখা যায় আরেকটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে । সিটের নাম্বার মিলিয়ে যে যার আসনে বসে যেতো । স্টীমারগুলো ছিল দুই তলা । একতলায় আম-জনতা আর দুই তলায় প্রথম শ্রেণি ,শোভন চেয়ারের যাত্রীরা বসতো। ইঞ্জিনের একটানা আওয়াজে কান ঝালাপালা । উপরে ডেক বা ছাদে আমরা বন্ধুরা বসে আশেপাশের বিশাল নদী আর বালুচরের বিষন্নতা অনুভব করতাম । স্টীমারের ভেতর বসার যো ছিলো না টোকাইদের যন্ত্রনায় । এরা ফট করে এসে দুই পা চেপে ধরে বসে থাকে । কতোদিন গোসল করে না কে জানে ! এদেরকে বাড়ি কই জিজ্ঞেস করলে কথা বলেনা , করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে ।বলে , ‘মোক খিলাও’ ।

প্রায় সবগুলোই অতিশয় বদ । যতক্ষণ না পয়সা পাবে ,ছাড়বে না । আমাদের বান্ধবীরা তাদের দেখার সাথে সাথেই পয়সা বের করে বিদায় জানায় । দুই তলার ডেকের পাশে কেবিন , ডাইনিং রুম । খাবারের এতো সুগন্ধ চলন্ত কোন ভেহিকেলে বা পথে কখনই পাইনি । নদীর টাটকা মাছ ,মুরগি আর সবজি- তরকারি প্রতিটি সুপার । সমস্যা , এখানে সীমিত সীট । ভাগ্য ভালো থাকলে বেশ কয়েকটি ব্যাচ পার করে টেবিলে বসতে পারা যায় । অনেক সময় খাদ্যের মজুদ শেষ হয়ে যায় বা ঘাট চলে আসায় খাবারের আশা বাদ দিয়ে রেল ধরতে হয় ।

প্রতিবারই নদীতে পানি কমে গেলে ফুলছড়ির কালাসোনা চ্যানেলে ড্রেজিং দেখতাম । বিশাল ব্যাপার । ড্রেজিং করে নৌপথ চালু রাখা হতো । মাঝে মাঝে দূরে একটা দুইটা চর দেখা যেতো । চরে টিন ও বাঁশের বেড়ার ঘর । কিভাবে এই নির্জন এলাকায় পরিবার নিয়ে মানুষ থাকে ? স্টিমারের সহযাত্রী কোন কোন স্থানীয় মানুষদের এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারা প্রায় প্রত্যেকেই বলতো চরে যারা এভাবে থাকে তাদের প্রায় সবাই দুরন্ত প্রকৃতির মানুষ; সুযোগ বুঝে নৌকায় হানা দেয় । আবার ,দেবদারু গাছের মতো ছোট ছোট গাছ দেখে বলতো এগুলো গাঁজার গাছ -চাষ করে । শীতের দিনে প্রায় রাতে এই চ্যানেলের আশেপাশে নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে স্টীমার আটকে যেতো । থার্ড ইয়ারে থাকার সময় একবার ঢাকায় পৌঁছাতে ৩১ ঘন্টা লেগে ছিলো । চিন্তায় আব্বা-আম্মার হার্টফেল করার দশা । বিরাট ইতিহাস ।

আজকের পর পরীক্ষার কারণে আরো হয়তো তিন থেকে চার মাস পর বাসায় যাবো । ফাইনাল প্রফ পাশ করতে পারলে হয়তো ইন্টার্নী করার সময় আরো দুই-তিন বার এই রুটে আসবো । আস্তে আস্তে ভুলে যাবো পাট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ফুলছড়ি নৌবন্দর, উত্তরাঞ্চলের বড় তেলের ডিপো বালাসীঘাট, কামারজানি নৌবন্দর ,ফুটানি বাজার , চর -আমখাওয়া আরো কতো নাম । আর হয়তো শুনতে পাবো না টিনের চর মাথা , হাবরা বাড়ী, খাটিয়ামারী ,কোচখালীর নাম । এক সময় এই নামগুলো নিয়ে স্থানীয় বন্ধুদের খেপাতাম, এখন কষ্ট হচ্ছে ।

পড়ন্ত বিকালে ঘাটে ষ্টীমার পৌঁছার পর তিস্তামুখ ঘাটে বিশাল বিশাল টাটকা বোয়াল, আইর, কাতলা মাছ দেখলে মনটা আকুপাকু করে উঠে আব্বা-আম্মা -ইমনের জন্য । বোয়াল-আইর আব্বার খুব পছন্দের মাছ । ইশ্ এই টাটকা মাছগুলো যদি ওদের জন্য নিতে পারতাম !

বোনারপাড়া - কাউনিয়ায় দুইবার ট্রেনের ইঞ্জিন বদলানোর জন্য অনেকটা সময় চলে যায় । আমরা সারা দিনের ক্লান্তি চা দোকানে বসে পিয়াজু- পুরীর মাধ্যমে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি । এই বিখ্যাত জংশনে ব্রিটিশ আমলের সাইনবোর্ড তখনও ছিলো -‘ চা পান করার উপকারিতা ’নিয়ে । ট্রেনের গতি খুব কম ,আস্তে আস্তে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাই ।

আমাকে আনমনা দেখে মুতাসিম বললো, “সীমন বাই মন কারাপ ? কালা -কালু বালু আসেন ?” এই সহজ ছেলেটিকে কন্টিনিউয়াস বুলিংয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে । মাঝে মাঝে অশ্রাব্য দুই-তিনটি গালির ব্যাপারে জানতে চাইতো । বলতাম এটা কোথায় শিখেছো ? সে বলতো ওমুক বন্ধু বলেছে , ‘এর মানে চলো বন্ধু নাস্তা করতে যাই বা কেমন আছো ’ ইত্যাদি । আমার রুমমেট হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় । মুতাসিম বলে , “কি হইছে বাই-ই ”? তাকে বোঝানোর পর সে মন খারাপ করে বসে থাকে । রুমমেট তাকে পরামর্শ দেয় , ‘যে তোমাকে এই ধরনের ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ শেখাবে তাকে পাঁচবার করে বলে আসবে’। থার্ড ইয়ারে উঠতে উঠতে মুতাসিম ‘ টেটন দ্য গ্রেট ’ হয়ে যায় ।

আবারো জানতে চাইলো,“ কালা-কালুর জন্য খারাপ লাগছে ? ” আমাকে বোঝায় ,আপনারতো বাবা-মা- ভাই এ দেশেই আছে; আত্মীয়-স্বজন আছে, মন খারাপ হলে দেখতে যেতে পারেন । আমি তো গত ৩৫ মাস ধরে বাড়ি যাই না । এজন্য মুতাসিম ছুটির সময় ঢাকা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যায় । আমাদের বাসায়ও বেশ কয়বার আসায় আব্বার সাথে খুব হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে যায় । আব্বা প্রতিবারই বলতেন ,তুমি আমাদের এখানে উঠো। মুতাসিম বলতো ‘উত্রায় উঠছি ’ । উত্তরায় তাদের দেশের বেশ কয়েকজন মানুষ থাকতেন । আব্বা আমার মেডিকেল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বলতেন , “ওই যে ছেলেটা, উত্রায় উঠতো, কেমন আছে ?”

মুতাসিম বলল আসেন দাবা খেলি আপনার মন ভালো হবে । আমি নাকচ করে দেই । ওর সাথে দাবা খেললে এক দানের বেশী খেলা যাবে না । আর ‘ টাচ এন্ড মুভ ’ যেটা ধরবে সেটাই চালতে হবে । ও প্রায়ই দুই-তিনবার দান চেঞ্জ করে - মাঝে মাঝে “আমিতো মেহমান , আপনার ছোট ভাই, আমার এই পনটা কাটবেন না বলে মানসিকভাবে ব্ল্যাকমেইলিং করে । “ছোট ভাই কালকে খেলবো ”, বলি । ব্যাগের জিনিসপত্র এখনো বের করি নাই ।

মুতাসিমের বিদায়ের পর ব্যাগ খুলতে গিয়ে চোখ ফেটে পানি চলে আসে । গতরাতে ইমন আমার জন্য বিরাট দুটি বিস্কুট- চানাচুরের প্যাকেট সাগর-সম্ভার কনফেকশনারী থেকে নিয়ে আসে । আমি ব্যাগ ভারী হওয়ার অজুহাতে আমার ভাইয়ের প্রিয় চানাচুর -বিস্কিট আগের রাতে লুকিয়ে বের করে মীটসেফে রেখে আসি ।ইমন হয়তো ভোররাতে ওভারট্রাম করে আবার ব্যাগে পুশব্যাক করেছে ।

চোখের পানি মুছতে বেসিনে যেতেই শুনি মুতাসিম জন ডেনভারের - “ কান্ট্রিরোড টেইক মী হোম ” গানটি ছেড়েছে । এটি আমার প্রিয় গানের একটি । এরপর ববি বারের , “ আই এম ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস এওয়ে ফ্রম হোম ” শুনে চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়তে লাগলো ইমন- আম্মা আর দেশ ছেড়ে হাজার মাইল দূরে মেডিকেল কলেজে পড়তে আসা মুতাসিমের জন্য ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]

back to top