alt

উপ-সম্পাদকীয়

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

: শুক্রবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

(গতকালের পর)

স্থানীয় পিডিপি (পাকিস্তান গণতান্ত্রিক পার্টি) নেতা মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন ও কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ মেনু মিয়ার নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের হানাদার বাহিনী নৌকায় করে এসে হামলা চালিয়ে অসংখ্য গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকার আলবদর বাহিনী তখন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুরেশ চন্দ্র সরকার, তার দুই ভাই জ্ঞানচন্দ্র নন্দী, জয়চন্দ্র নন্দী, ভাতিজা মধুসূদন নন্দী, দুই নাতি হর্ষবর্ধন সরকার ও বিশ্ববর্ধন সরকারকে ধরে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ধুলদিয়া রেলসেতুর কাছে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে হত্যা করা হয় কানকাটি গ্রামের কৃষক আব্দুল জব্বারকে। নারকীয় ও বর্বরোচিত এ হত্যাকান্ডের সময় অনেকে বেঁচে যান সৌভাগ্যক্রমে। তাদেরকে এখনো তাড়িত করে সেদিনের দুঃসহ ভয়াল স্মৃতি।

সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সুধীর চন্দ্র সরকার বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়, এমনকি অনেক রাজাকারের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় উঠেছে; অথচ পরিবারের এতগুলো লোক জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পেলাম না।

পোমরা হত্যাকান্ড : ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পোমরা ইউনিয়নের নিরস্ত্র বাঙালি হিন্দুদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পোমরা সংরক্ষিত বনে ১৩ বাঙালি হিন্দুকে জীবন্ত কবর দেয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘পোমরা গণহত্যা’ নামে পরিচিত। পোমরা ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন। গণহত্যাস্থানটি গোচরা চৌমোহনী রেলস্টেশন থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে এবং চট্টগ্রাম থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি পোমরা সংরক্ষিত বনের ঠিক পাশেই পোমরা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে অবস্থিত।

সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ৫০-৬০ শক্তিশালী দল মধুরাম তালুকদারপাড়া আক্রমণ করে এবং আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাদের উপর বর্বর হামলা চালায়। এর মধ্যে ১৮ জন পুরুষকে দড়ির সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয়েছিল এবং পরে তাদেরকে পিটিয়ে মেরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পোমারা সংরক্ষিত বনের কাছে সেনা শিবিরে। সেনা অফিসারদের কাছ থেকে মুক্তি পেতে শত শত গ্রামবাসী তাদের সঙ্গে শিবিরে এসেছিলেন।

সেনাদের হাত-পা ধরে অনেক কান্নাকাটি করায় বন্দিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়ষ্ক পাঁচজনকে অর্ধমৃত অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তারা হচ্ছেন - অশ্বিনী দাশ, হরে কৃষ্ণ দাশ, মনমোহন দাশ, মনীন্দ্র দাশ ও হরিকিষ্ট দাশ। তাদের কেউ আজ বেঁচে নেই। বাকি ১৩ জনকে দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে ওই গর্তেই তাদের জীবন্ত কবর দিয়ে উল্লাস করে হানাদারেরা। এই ১৩ জনের মধ্যে ১০ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন - মন্টু আইচ, গান্ধী দাশ, বাবুল দাশ (১), বাবুল দাশ (২), বীরাজ দে, বোঁচা দে, ফকির চাঁদ দাশ, খোকা দাশ, দুলাল দাশ ও শচীন দাশ। সেদিনের স্মৃতি এখনো ভুলতে পারছেন না প্রত্যক্ষদর্শীরা।

কয়েক দিন পরে স্থানীয়রা লাশ উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রকট দুর্গন্ধের কারণে সে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। শীঘ্রই গণকবরটি ঝোপঝাড় দিয়ে একাকার হয়ে যায় এবং অঞ্চলটি গবাদিপশুদের জন্য চারণভূমিতে পরিণত হয়। বর্তমানে গণহত্যার জায়গায় মৌসুমী সবজির চাষ হয়।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পোমরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের নেতা জহির আহমদ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা পোমরা-বেতাগীতে একে একে সফল অপারেশনের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের পর্যুদস্ত করে চলছিলেন।

পোমরা গণহত্যার দুদিন আগে শান্তিরহাটের উত্তরে ৩৩ হাজার কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস করে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এতে পাকিস্তানি বাহিনী ভীষণ বোকায়দার পড়ে। এর প্রতিশোধ নিতেই মূলত এ গণহত্যা চালানো হয়।

কৃষ্ণপুর গণহত্যা : একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার লাখাই সদর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল পৈশাচিক কায়দায় গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যার শিকার হন ১২৭ নিরীহ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আহত হয়েছিল শতাধিক মানুষ। এত লাশ একসঙ্গে সৎকারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পাশের নদী দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় নারীরা।

কৃষ্ণপুর গ্রামটি বলভদ্রা নদীর পাশে সিলেট জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম ছিল। বর্তমানে গ্রামটি হবিগঞ্জ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একদম শেষমাথায় লাখাই উপজেলার অধীনে পড়েছে। লাখাই থানা থেকে কৃষ্ণপুর গ্রামের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে। গ্রামের দক্ষিণ দিকে বলভদ্রা নদী বয়ে গেছে, যা হবিগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পৃথক করেছে। কৃষ্ণপুর এবং পার্শ্ববর্তী চন্ডীপুর গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত।

গণহত্যার দুদিন আগে ১৬ সেপ্টেম্বর, রাজাকারেরা গভীর রাতে নৌকায় এসে কৃষ্ণপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর চারটা-পাঁচটার দিকে পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ক্যাম্প থেকে হানাদার বাহিনীর দুটি দল দুটি স্পিডবোটে করে কৃষ্ণপুরে আসে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় লাখাই উপজেলার মুড়াকরি গ্রামের লিয়াকত আলী, বাদশা মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউকের আহাদ মিয়া, বল্টু মিয়া, কিশোরগঞ্জের লাল খাঁ, রজব আলী, সন্তোষপুরের মোর্শেদ কামাল ওরফে শিশু মিয়ার নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের একদল রাজাকার-আল বদর।

স্পিডবোটগুলো থেকে হানাদারেরা নেমে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামে ঢুকেই নির্বিচারে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এ সময়ে রাজাকারেরাও গ্রামের চারপাশ থেকে গুলি চালাতে থাকে এবং গ্রামে লুটপাট শুরু করে। লুটপাটের পর হানাদার ও রাজাকারেরা ১৩০ জন নিরীহ মানুষকে স্থানীয় কমলাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।

রাজাকারেরা শহীদদের লাশ পার্শ্ববর্তী বলভদ্রা নদীতে ভাসিয়ে দেয় এবং গান পাউডার দিয়ে গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেন। এছাড়া গ্রামের নিরীহ নারীদের সম্ভ্রমহানি করে তারা। এ সময় হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ মজাপুকুরে কচুরিপানার নিচে আশ্রয় নেন। হানাদাররা চলে গেলে তারা হত্যাকান্ডস্থল থেকে লাশগুলো উদ্ধার করে স্থানীয় বলভদ্রা নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে গ্রাম ত্যাগ করেন।

এদিন হানাদারদের গুলি খেয়েও মৃতের ভান করে মাটিতে পড়ে থেকে প্রাণে রক্ষা পান প্রমোদ রায়, নবদ্বীপ রায়, হরিদাস রায় ও মন্টু রায়।

কৃষ্ণপুর গণহত্যায় নিহত ১২৭ জনের মধ্যে ৪৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। ওই ৪৫ জনের নামে স্থানীয় একটি হাই স্কুলের পাশে নিজেদের অর্থায়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে স্থানীয়রা।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যা রানী চক্রবর্তী বলেন, ‘একসঙ্গে এতো লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করতে না পারায় ওই গ্রামের পাশের নদী দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এ কথা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে। আমি মরার আগেই এ হত্যাকান্ডের বিচার দেখতে চাই।’

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ আলী পাঠান বলেন, ‘দিনটি পালনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া এলাকার কোনও মানুষের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা ইতোমধ্যে একটি তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি।’

চন্ডীপুর গণহত্যা : হবিগঞ্জে ১৮ সেপ্টেম্বর হানাদারেরা রাজাকারদের সহযোগিতায় কৃষ্ণপুরে পৈশাচিক গণহত্যা চালানোর পর পার্শ্ববর্তী চন্ডীপুর গ্রামে যায়। এ গ্রামে মাত্র ১৬ টি পরিবারের বাস ছিল। গ্রামের সবাই বাসিন্দাদের একই লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। ৪৫ জন হিন্দু এতে মারা যায়। এই গণহত্যায় মাত্র দুজন ব্যক্তি বেঁচে যায়।

লালচাঁদপুর গণহত্যা : একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জে আরেকটি নৃশংস গণহত্যা চালানো হয় লালচাঁদপুর এলাকায়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদারেরা মধু নমঃশূদ্রের বাড়িতে প্রবেশ করে ৪০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বেঁধে রেখে গোটা বাড়িতে লুটপাট চালায়। এরপর তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। গোকুলনগরেও একই কায়দায় হিন্দুদের হত্যা করা হয়।

বান্দাইখাড়া গণহত্যা : একাত্তরের ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল রাজাকারদের সহযোগিতায় নওগাঁর আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়ায় গণহত্যা চালায়। এসময় শতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। এদিন ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল রাজাকারদের সহযোগিতায় নৌকায় করে আত্রাই নদী পথে এসে বান্দাইখাড়া বাজারে নামে। এরপর বাজারে থাকা প্রায় ৩৫০ মানুষকে আটক করে বান্দাইখাড়া বাজারের পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় এনে হাত পিছমোড়া অবস্থায় বেঁধে লাইন করে দাঁড় করায়। এরপর নারীদের পাশবিক নির্যাতন করে, ঘরবাড়ি লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে শতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। এসময় ভাগ্যক্রমে গুরুতর আহত অবস্থায় ৮ জন গ্রামবাসী প্রাণে বেঁচে যান।

ডুমুুরিয়া হাইস্কুল গণহত্যা : ১৯৭১ সালে খুলানার ডুমুরিয়া থানা সদরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ দিয়ে ভদ্রা নামক একটি খরস্রোতা নদী ছিল। নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে ছিল ডুমুরিয়া সদরের এনজিসি অ্যান্ড এনসি হাই স্কুলের অবস্থান। স্কুল সংলগ্ন এ নদীর চরেই ১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর স্থানীয় রাজাকাররা একটি গণহত্যা চালায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘ডুমুুরিয়া হাইস্কুল গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

ডুমুরিয়া থানা ভবনের পূর্ব পাশে ছিল এনজিসি অ্যান্ড এনসি হাই স্কুলের ছাত্রাবাস। মুক্তিযুদ্ধকালে স্থানীয় রাজাকাররা এ ছাত্রাবাসটি দখলে নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। ডুমুরিয়ার রাজাকারদের আরেকটি ক্যাম্প ছিল থানা ভবনের পশ্চিম পাশে জনৈক মজিদ মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন একটি ভবনে। একই ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে ছিল ভদ্রা নদী। আর ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে ছিল শোভনা ইউনিয়নের চিংড়া গ্রাম। ডুমুরিয়া সদর এলাকায় রাজাকারদের প্রভাব থাকলেও চিংড়া তথা শোভনা ইউনিয়ন ছিল মজিদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এই বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সপক্ষে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল।

চারটি লঞ্চ ও গানবোটে টহলরত পাকিস্তানি বাহিনী ১০ সেপ্টেম্বর গ্রামে নেমে ব্যাপক গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগ করে। এই ঘটনায় এলাকায় বেশ আতংক ছড়িয়ে পড়ে। মজিদ বাহিনী তখন এলাকা ছেড়ে কিছুদিনের জন্য পার্শ্ববর্তী মাগুরখালী ইউনিয়ন ও অন্যান্য এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। এই বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন চিংড়া গ্রামের শেখ আমজাদ হোসেন। চিংড়া গ্রামের লোকেরা তার কাছে করণীয় জানতে চায়। এই সময়ে ডুমুরিয়ার রাজাকাররাও চিংড়াবাসীদের আশ্বাস দিয়েছিল যে, তারা গ্রামে আক্রমণ করবে না। তবে মজিদ বাহিনীর কেউ থাকলে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় শেখ আমজাদ হোসেনও সম্মতি দিয়ে বলেন যে, কেউ কাউকে আর আক্রমণ করবে না, এই প্রস্তাবে রাজি হলে চিংড়া গ্রামের অধিবাসীরা রাজাকারদের প্রস্তাব মেনে নিবে।

পরদিন সকালে ডুমুরিয়া সদরের রাজাকারা নৌকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে নদী পার হয়ে চিংড়া গ্রামে এসে হাজির হয়। আগের দিন পরস্পরকে আক্রমণ না করার ব্যাপারে সমঝোতা হওয়ায় ঐ গ্রামের মজিদ বাহিনীর সক্রিয় সদস্য মোহর আলী ফকির, আবদুল গফুর, জাফর আলী প্রমুখ গ্রামেই ছিলেন। রাজাকাররা গ্রামে এলে সবাইকে উত্তর চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এই খবর পেয়ে গ্রামের অনেকে সেদিন সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। তারা ভেবেছিল, রাজাকাররা হয়তো গ্রামবাসীদের কোন নির্দেশনা দিতে চায়।

উত্তর চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার পরে গ্রামবাসীদের মধ্যে জনা বিশেককে অস্ত্রের মুখে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরে তাদেরকে নৌকাযোগে নদীর পর করিয়ে থানা সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে সপ্তাহ খানেক রেখে তাদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। এর মধ্যে কয়েকজনকে নির্যাতনের পর রাজাকাররা ছেড়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৭ জন রাজাকারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তারা হলেন- চিংড়া গ্রামের মোহর আলী ফকির, আবদুর রহিম জোদ্দার, আবদুল গফুর জোদ্দার, সফেদ আলী সরদার, আবদুল গাজী, জফর আলী শেখ ও শিবপুর গ্রামের হারান ঋষি। ২০ সেপ্টেম্বর রাতে রাজাকাররা তাদের বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে চরে নিয়ে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই ৫ জন মারা যান। মুমূর্ষু অবস্থায় আবদুর রহিম ও আবদুল গাজী কোনরকমে নদীতে ভাসতে ভাসতে চিংড়া গ্রামে পৌছায়। পরের দিনই এই খবর রাজাকার বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। রাজাকাররা ২১ সেপ্টেম্বর আবদুর রহিম জোদ্দারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অপর আহত আবদুল গাজী বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যান।

রাজগঞ্জ গণহত্যা : নোয়াখালীতে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে আক্রমণের জন্য ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘সি’ জোনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছয়টি দল বেগমগঞ্জ থানার রাজগঞ্জের চতুর্দিকে অবস্থান নেয়। রাজগঞ্জ বাজার থেকে মাইজদীতে অবস্থানরত শত্রুসেনাদেরকে এই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি অব্যাহত থাকলেও অন্য অপারেশনের জন্য পাঁচটি দল প্রত্যাহার করে ঐদিন রাত ১১টায় জরুরি প্রয়োজনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। পাকিস্তানি বাহিনী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রত্যাহারের সংবাদ পেয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে (অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর) চারদিক থেকে আক্রমণ করে। তাদের প্রধান দলটি মাইজদী বাজার থেকে ছয়ানি রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়ে নোয়াখালী কলেজ (পুরান) সংলগ্ন এলাকা থেকে ২ ইঞ্চি মর্টারগান দিয়ে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে এবং বাকি চারটি দলও বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ শুরু করে। এদিকে কমান্ডার হাবিলদার হাসেমের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ়তার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে ছয়ানি থেকে একটি দল কমান্ডার হাসেমের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসেম ও তার দল ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে সাতা পর্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে হানাদার বাহিনীর ২৩ জন সৈন্যকে হত্যা করে। সম্মুখ যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে হাসেমের সাহায্যকারীরা যথাসময়ে গোলাবারুদ সরবরাহ করতে না পারায় হাসেমের বাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। এরপরও কমান্ডার হাসেম যুদ্ধস্থলে ৩০ মিনিট অবস্থান করেন; কিন্তু শত্রুসেনারা বিষয়টি অনুধাবন করে চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে।

(চলবে)

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

শুক্রবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

(গতকালের পর)

স্থানীয় পিডিপি (পাকিস্তান গণতান্ত্রিক পার্টি) নেতা মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন ও কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ মেনু মিয়ার নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের হানাদার বাহিনী নৌকায় করে এসে হামলা চালিয়ে অসংখ্য গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকার আলবদর বাহিনী তখন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুরেশ চন্দ্র সরকার, তার দুই ভাই জ্ঞানচন্দ্র নন্দী, জয়চন্দ্র নন্দী, ভাতিজা মধুসূদন নন্দী, দুই নাতি হর্ষবর্ধন সরকার ও বিশ্ববর্ধন সরকারকে ধরে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ধুলদিয়া রেলসেতুর কাছে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে হত্যা করা হয় কানকাটি গ্রামের কৃষক আব্দুল জব্বারকে। নারকীয় ও বর্বরোচিত এ হত্যাকান্ডের সময় অনেকে বেঁচে যান সৌভাগ্যক্রমে। তাদেরকে এখনো তাড়িত করে সেদিনের দুঃসহ ভয়াল স্মৃতি।

সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সুধীর চন্দ্র সরকার বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়, এমনকি অনেক রাজাকারের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় উঠেছে; অথচ পরিবারের এতগুলো লোক জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পেলাম না।

পোমরা হত্যাকান্ড : ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পোমরা ইউনিয়নের নিরস্ত্র বাঙালি হিন্দুদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পোমরা সংরক্ষিত বনে ১৩ বাঙালি হিন্দুকে জীবন্ত কবর দেয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘পোমরা গণহত্যা’ নামে পরিচিত। পোমরা ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন। গণহত্যাস্থানটি গোচরা চৌমোহনী রেলস্টেশন থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে এবং চট্টগ্রাম থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি পোমরা সংরক্ষিত বনের ঠিক পাশেই পোমরা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে অবস্থিত।

সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ৫০-৬০ শক্তিশালী দল মধুরাম তালুকদারপাড়া আক্রমণ করে এবং আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাদের উপর বর্বর হামলা চালায়। এর মধ্যে ১৮ জন পুরুষকে দড়ির সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয়েছিল এবং পরে তাদেরকে পিটিয়ে মেরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পোমারা সংরক্ষিত বনের কাছে সেনা শিবিরে। সেনা অফিসারদের কাছ থেকে মুক্তি পেতে শত শত গ্রামবাসী তাদের সঙ্গে শিবিরে এসেছিলেন।

সেনাদের হাত-পা ধরে অনেক কান্নাকাটি করায় বন্দিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়ষ্ক পাঁচজনকে অর্ধমৃত অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তারা হচ্ছেন - অশ্বিনী দাশ, হরে কৃষ্ণ দাশ, মনমোহন দাশ, মনীন্দ্র দাশ ও হরিকিষ্ট দাশ। তাদের কেউ আজ বেঁচে নেই। বাকি ১৩ জনকে দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে ওই গর্তেই তাদের জীবন্ত কবর দিয়ে উল্লাস করে হানাদারেরা। এই ১৩ জনের মধ্যে ১০ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন - মন্টু আইচ, গান্ধী দাশ, বাবুল দাশ (১), বাবুল দাশ (২), বীরাজ দে, বোঁচা দে, ফকির চাঁদ দাশ, খোকা দাশ, দুলাল দাশ ও শচীন দাশ। সেদিনের স্মৃতি এখনো ভুলতে পারছেন না প্রত্যক্ষদর্শীরা।

কয়েক দিন পরে স্থানীয়রা লাশ উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রকট দুর্গন্ধের কারণে সে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। শীঘ্রই গণকবরটি ঝোপঝাড় দিয়ে একাকার হয়ে যায় এবং অঞ্চলটি গবাদিপশুদের জন্য চারণভূমিতে পরিণত হয়। বর্তমানে গণহত্যার জায়গায় মৌসুমী সবজির চাষ হয়।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পোমরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের নেতা জহির আহমদ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা পোমরা-বেতাগীতে একে একে সফল অপারেশনের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের পর্যুদস্ত করে চলছিলেন।

পোমরা গণহত্যার দুদিন আগে শান্তিরহাটের উত্তরে ৩৩ হাজার কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস করে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এতে পাকিস্তানি বাহিনী ভীষণ বোকায়দার পড়ে। এর প্রতিশোধ নিতেই মূলত এ গণহত্যা চালানো হয়।

কৃষ্ণপুর গণহত্যা : একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার লাখাই সদর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল পৈশাচিক কায়দায় গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যার শিকার হন ১২৭ নিরীহ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আহত হয়েছিল শতাধিক মানুষ। এত লাশ একসঙ্গে সৎকারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পাশের নদী দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় নারীরা।

কৃষ্ণপুর গ্রামটি বলভদ্রা নদীর পাশে সিলেট জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম ছিল। বর্তমানে গ্রামটি হবিগঞ্জ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একদম শেষমাথায় লাখাই উপজেলার অধীনে পড়েছে। লাখাই থানা থেকে কৃষ্ণপুর গ্রামের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে। গ্রামের দক্ষিণ দিকে বলভদ্রা নদী বয়ে গেছে, যা হবিগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পৃথক করেছে। কৃষ্ণপুর এবং পার্শ্ববর্তী চন্ডীপুর গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত।

গণহত্যার দুদিন আগে ১৬ সেপ্টেম্বর, রাজাকারেরা গভীর রাতে নৌকায় এসে কৃষ্ণপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর চারটা-পাঁচটার দিকে পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ক্যাম্প থেকে হানাদার বাহিনীর দুটি দল দুটি স্পিডবোটে করে কৃষ্ণপুরে আসে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় লাখাই উপজেলার মুড়াকরি গ্রামের লিয়াকত আলী, বাদশা মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউকের আহাদ মিয়া, বল্টু মিয়া, কিশোরগঞ্জের লাল খাঁ, রজব আলী, সন্তোষপুরের মোর্শেদ কামাল ওরফে শিশু মিয়ার নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের একদল রাজাকার-আল বদর।

স্পিডবোটগুলো থেকে হানাদারেরা নেমে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামে ঢুকেই নির্বিচারে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এ সময়ে রাজাকারেরাও গ্রামের চারপাশ থেকে গুলি চালাতে থাকে এবং গ্রামে লুটপাট শুরু করে। লুটপাটের পর হানাদার ও রাজাকারেরা ১৩০ জন নিরীহ মানুষকে স্থানীয় কমলাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।

রাজাকারেরা শহীদদের লাশ পার্শ্ববর্তী বলভদ্রা নদীতে ভাসিয়ে দেয় এবং গান পাউডার দিয়ে গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেন। এছাড়া গ্রামের নিরীহ নারীদের সম্ভ্রমহানি করে তারা। এ সময় হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ মজাপুকুরে কচুরিপানার নিচে আশ্রয় নেন। হানাদাররা চলে গেলে তারা হত্যাকান্ডস্থল থেকে লাশগুলো উদ্ধার করে স্থানীয় বলভদ্রা নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে গ্রাম ত্যাগ করেন।

এদিন হানাদারদের গুলি খেয়েও মৃতের ভান করে মাটিতে পড়ে থেকে প্রাণে রক্ষা পান প্রমোদ রায়, নবদ্বীপ রায়, হরিদাস রায় ও মন্টু রায়।

কৃষ্ণপুর গণহত্যায় নিহত ১২৭ জনের মধ্যে ৪৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। ওই ৪৫ জনের নামে স্থানীয় একটি হাই স্কুলের পাশে নিজেদের অর্থায়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে স্থানীয়রা।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যা রানী চক্রবর্তী বলেন, ‘একসঙ্গে এতো লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করতে না পারায় ওই গ্রামের পাশের নদী দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এ কথা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে। আমি মরার আগেই এ হত্যাকান্ডের বিচার দেখতে চাই।’

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার মোহাম্মদ আলী পাঠান বলেন, ‘দিনটি পালনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া এলাকার কোনও মানুষের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা ইতোমধ্যে একটি তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি।’

চন্ডীপুর গণহত্যা : হবিগঞ্জে ১৮ সেপ্টেম্বর হানাদারেরা রাজাকারদের সহযোগিতায় কৃষ্ণপুরে পৈশাচিক গণহত্যা চালানোর পর পার্শ্ববর্তী চন্ডীপুর গ্রামে যায়। এ গ্রামে মাত্র ১৬ টি পরিবারের বাস ছিল। গ্রামের সবাই বাসিন্দাদের একই লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। ৪৫ জন হিন্দু এতে মারা যায়। এই গণহত্যায় মাত্র দুজন ব্যক্তি বেঁচে যায়।

লালচাঁদপুর গণহত্যা : একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জে আরেকটি নৃশংস গণহত্যা চালানো হয় লালচাঁদপুর এলাকায়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদারেরা মধু নমঃশূদ্রের বাড়িতে প্রবেশ করে ৪০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বেঁধে রেখে গোটা বাড়িতে লুটপাট চালায়। এরপর তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। গোকুলনগরেও একই কায়দায় হিন্দুদের হত্যা করা হয়।

বান্দাইখাড়া গণহত্যা : একাত্তরের ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল রাজাকারদের সহযোগিতায় নওগাঁর আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়ায় গণহত্যা চালায়। এসময় শতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। এদিন ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল রাজাকারদের সহযোগিতায় নৌকায় করে আত্রাই নদী পথে এসে বান্দাইখাড়া বাজারে নামে। এরপর বাজারে থাকা প্রায় ৩৫০ মানুষকে আটক করে বান্দাইখাড়া বাজারের পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় এনে হাত পিছমোড়া অবস্থায় বেঁধে লাইন করে দাঁড় করায়। এরপর নারীদের পাশবিক নির্যাতন করে, ঘরবাড়ি লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে শতাধিক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। এসময় ভাগ্যক্রমে গুরুতর আহত অবস্থায় ৮ জন গ্রামবাসী প্রাণে বেঁচে যান।

ডুমুুরিয়া হাইস্কুল গণহত্যা : ১৯৭১ সালে খুলানার ডুমুরিয়া থানা সদরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ দিয়ে ভদ্রা নামক একটি খরস্রোতা নদী ছিল। নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে ছিল ডুমুরিয়া সদরের এনজিসি অ্যান্ড এনসি হাই স্কুলের অবস্থান। স্কুল সংলগ্ন এ নদীর চরেই ১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর স্থানীয় রাজাকাররা একটি গণহত্যা চালায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘ডুমুুরিয়া হাইস্কুল গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

ডুমুরিয়া থানা ভবনের পূর্ব পাশে ছিল এনজিসি অ্যান্ড এনসি হাই স্কুলের ছাত্রাবাস। মুক্তিযুদ্ধকালে স্থানীয় রাজাকাররা এ ছাত্রাবাসটি দখলে নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। ডুমুরিয়ার রাজাকারদের আরেকটি ক্যাম্প ছিল থানা ভবনের পশ্চিম পাশে জনৈক মজিদ মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন একটি ভবনে। একই ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে ছিল ভদ্রা নদী। আর ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে ছিল শোভনা ইউনিয়নের চিংড়া গ্রাম। ডুমুরিয়া সদর এলাকায় রাজাকারদের প্রভাব থাকলেও চিংড়া তথা শোভনা ইউনিয়ন ছিল মজিদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এই বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সপক্ষে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল।

চারটি লঞ্চ ও গানবোটে টহলরত পাকিস্তানি বাহিনী ১০ সেপ্টেম্বর গ্রামে নেমে ব্যাপক গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগ করে। এই ঘটনায় এলাকায় বেশ আতংক ছড়িয়ে পড়ে। মজিদ বাহিনী তখন এলাকা ছেড়ে কিছুদিনের জন্য পার্শ্ববর্তী মাগুরখালী ইউনিয়ন ও অন্যান্য এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। এই বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন চিংড়া গ্রামের শেখ আমজাদ হোসেন। চিংড়া গ্রামের লোকেরা তার কাছে করণীয় জানতে চায়। এই সময়ে ডুমুরিয়ার রাজাকাররাও চিংড়াবাসীদের আশ্বাস দিয়েছিল যে, তারা গ্রামে আক্রমণ করবে না। তবে মজিদ বাহিনীর কেউ থাকলে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় শেখ আমজাদ হোসেনও সম্মতি দিয়ে বলেন যে, কেউ কাউকে আর আক্রমণ করবে না, এই প্রস্তাবে রাজি হলে চিংড়া গ্রামের অধিবাসীরা রাজাকারদের প্রস্তাব মেনে নিবে।

পরদিন সকালে ডুমুরিয়া সদরের রাজাকারা নৌকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে নদী পার হয়ে চিংড়া গ্রামে এসে হাজির হয়। আগের দিন পরস্পরকে আক্রমণ না করার ব্যাপারে সমঝোতা হওয়ায় ঐ গ্রামের মজিদ বাহিনীর সক্রিয় সদস্য মোহর আলী ফকির, আবদুল গফুর, জাফর আলী প্রমুখ গ্রামেই ছিলেন। রাজাকাররা গ্রামে এলে সবাইকে উত্তর চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এই খবর পেয়ে গ্রামের অনেকে সেদিন সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। তারা ভেবেছিল, রাজাকাররা হয়তো গ্রামবাসীদের কোন নির্দেশনা দিতে চায়।

উত্তর চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার পরে গ্রামবাসীদের মধ্যে জনা বিশেককে অস্ত্রের মুখে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরে তাদেরকে নৌকাযোগে নদীর পর করিয়ে থানা সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে সপ্তাহ খানেক রেখে তাদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। এর মধ্যে কয়েকজনকে নির্যাতনের পর রাজাকাররা ছেড়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৭ জন রাজাকারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তারা হলেন- চিংড়া গ্রামের মোহর আলী ফকির, আবদুর রহিম জোদ্দার, আবদুল গফুর জোদ্দার, সফেদ আলী সরদার, আবদুল গাজী, জফর আলী শেখ ও শিবপুর গ্রামের হারান ঋষি। ২০ সেপ্টেম্বর রাতে রাজাকাররা তাদের বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে চরে নিয়ে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই ৫ জন মারা যান। মুমূর্ষু অবস্থায় আবদুর রহিম ও আবদুল গাজী কোনরকমে নদীতে ভাসতে ভাসতে চিংড়া গ্রামে পৌছায়। পরের দিনই এই খবর রাজাকার বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। রাজাকাররা ২১ সেপ্টেম্বর আবদুর রহিম জোদ্দারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অপর আহত আবদুল গাজী বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যান।

রাজগঞ্জ গণহত্যা : নোয়াখালীতে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে আক্রমণের জন্য ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘সি’ জোনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছয়টি দল বেগমগঞ্জ থানার রাজগঞ্জের চতুর্দিকে অবস্থান নেয়। রাজগঞ্জ বাজার থেকে মাইজদীতে অবস্থানরত শত্রুসেনাদেরকে এই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি অব্যাহত থাকলেও অন্য অপারেশনের জন্য পাঁচটি দল প্রত্যাহার করে ঐদিন রাত ১১টায় জরুরি প্রয়োজনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। পাকিস্তানি বাহিনী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রত্যাহারের সংবাদ পেয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে (অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর) চারদিক থেকে আক্রমণ করে। তাদের প্রধান দলটি মাইজদী বাজার থেকে ছয়ানি রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়ে নোয়াখালী কলেজ (পুরান) সংলগ্ন এলাকা থেকে ২ ইঞ্চি মর্টারগান দিয়ে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে এবং বাকি চারটি দলও বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ শুরু করে। এদিকে কমান্ডার হাবিলদার হাসেমের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ়তার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে ছয়ানি থেকে একটি দল কমান্ডার হাসেমের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসেম ও তার দল ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে সাতা পর্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে হানাদার বাহিনীর ২৩ জন সৈন্যকে হত্যা করে। সম্মুখ যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে হাসেমের সাহায্যকারীরা যথাসময়ে গোলাবারুদ সরবরাহ করতে না পারায় হাসেমের বাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। এরপরও কমান্ডার হাসেম যুদ্ধস্থলে ৩০ মিনিট অবস্থান করেন; কিন্তু শত্রুসেনারা বিষয়টি অনুধাবন করে চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে।

(চলবে)

back to top