alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

দেশীয় গাছ কি গুরুত্ব হারাচ্ছে

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

: শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত আমাদের গ্রামবাংলা। এখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষ, গুল্ম, লতাপাতা। তবে সময়ের পরিক্রমায় আমাদের বৃক্ষ সম্পদ ধ্বংসের পথে। নানা কারণে দেশের বৃক্ষ সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আয়তনের ২৫ শতাংশ জমিতে গাছপালা বা বন জঙ্গল থাকার কথা থাকলেও এর অর্ধেক জমিতেও নেই বৃক্ষসম্পদ। আবাসন নির্মাণের পাশাপাশি জ্বালানির কাজে ব্যবহারের জন্য অবাধে কর্তন করা হচ্ছে বৃক্ষ সম্পদ। আর এ সুযোগেই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে দ্রুত বর্ধনশীল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। এগুলো জ্বালানি সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখে ঠিকই, তবে ক্রমাগত মাটি ও পরিবেশের সর্বনাশ করে চলেছে।

বিদেশি বৃক্ষগুলো বাংলাদেশের মানুষই যেমন এনেছে, আবার কিছু উদ্ভিদ নিজেই বাংলাদেশে ইকোসিস্টেমে বা বাস্তুসংস্থানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বিদেশি প্রজাতির রেইনট্রি, সেগুন, আকাশমণি, আকাশি, শিশু, বাবলা, ইউক্যালিপটাস জাতীয় গাছের জন্য প্রচুর জায়গার দরকার হয়। এগুলো দেশি গাছের তুলনায় অনেক দ্রুততার সঙ্গে বেশি পরিমাণে পুষ্টি ও পানি শোষণ করে। তাই এসব বৃক্ষের আশপাশে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ বাঁচতে পারে না। ব্রিটিশ আমলে বৈধভাবেই দেশে আসে রেইনট্রি, মেহগনি, চাম্বুল ইত্যাদি। আশির দশকে আসে আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস, শিশু, ইপিলইপিল, বাবলা ও খয়ের জাতীয় গাছ। আর বিভিন্ন সময় অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করেছে- রিফুজিলতা, স্বর্ণলতা, মটমটিয়া, পিসাইস, পার্থোনিয়াম, কচুরিপানা ইত্যাদি।

গবেষকদের মতে, অতীতে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এক হাজারের বেশি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- বিদেশি এসব আগ্রাসী বৃক্ষ। আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশীয় বট, কদম, হিজল, জারুল, তমাল আর বাংলা মানেই বট, পাকুড়, ডুমুর, আম, জাম, শিমুল, পলাশ, হিজল, ছাতিম, কদম, শাল, তাল, তেঁতুলসহ অজগ্র দেশি বৃক্ষে আচ্ছাদিত। বাংলা মানেই জুঁই, চামেলি, মালতি, গন্ধরাজ, ভাঁট ফুলসহ অজগ্র লতাগুল্মের বাহার।

বাংলার এসব গাছগাছালিকে কেন্দ্র করেই বাস করে বহু প্রজাতির পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ। মানুষ বেড়েছে ভারসাম্যহীনভাবে। চাহিদা বেড়েছে খাদ্য, বস্ত্র ও আবাসের। সেই সঙ্গে বেড়েছে ভোগ-বিলাস, বিত্ত-বৈভব, লালসা ও নগদ প্রাপ্তির অসীম চাহিদা। তাই চলছে প্রকৃতি লুণ্ঠনের অজগ্র আয়োজন। কলকারখানার জন্য উন্নয়নের নামে গাছগাছালি সাবাড় করে উজাড় হচ্ছে বন। তা আবার উদ্ধারের নামে রাষ্ট্রের লাখো কোটি টাকায় শত শত প্রকল্পে চলছে সবুজায়নের এক অদ্ভুত আয়োজন। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি সর্বস্তরে চলছে বাংলার বৃক্ষ-প্রকৃতি বিনাশের কাজ।

ইউক্যালিপটাস বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে আনার পর থেকে সরকারি উদ্যোগেও সামাজিক বনায়নের আওতায় লাগানো হয়েছে সর্বত্র। সারা দেশে রাস্তার পাশে, পুকুরপাড়ে, ক্ষেতের আইলে এখন চোখে পড়ে এসব পরিবেশ হানিকর গাছ। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছ শুধু কাঠের বিবেচনায় রোপণ করা হয়; কিন্তু একটি গাছ মানে তো শুধু কয়েক ঘনফুট কাঠ নয়। গাছের সঙ্গে প্রধান বিবেচ্য বিষয় বাস্তুতন্ত্র তথা পরিবেশ-প্রকৃতি। বিবেচনায় নিতে হবে সেসব গাছ বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ। একটি গাছের সঙ্গে থাকে অনেক প্রজাতির পশু-পাখি, অজগ্র অনুজীবের জীবনচক্র ও জীবনপ্রবাহ। মানুষ বুদ্ধি, কৌশল ও বাহুবলে গাছের সর্বাঙ্গ লুণ্ঠন করছে যেন প্রকৃতিতে একমাত্র মানুষ প্রজাতিই একক স্বত্বভোগী! কিন্তু প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণীরও অধিকার রয়েছে।

মানুষ এখন ভোগ-বিলাসে ও বিত্ত-বৈভব অর্জনে আত্মকেন্দ্রিকতায় অন্ধ। এদিকে বিদেশি ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছের গড়ন ও আচরণও অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক। এসব গাছ রাত-দিন প্রচুর পানি শোষণ করে। ইউক্যালিপটাস গাছের পানি শোষণসংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণার তথ্য জানা না থাকলেও আমি প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখেছি যে আমাদের দুটি পাশাপাশি ছোট্ট পুকুরের একটির পাড়ে কিছু ইউক্যালিপটাস গাছের প্রচুর পানি শোষণ। খরা মৌসুমে এ পুকুরের পানি তলানিতে ঠেকত। অন্য পুকুরপাড়ে সাধারণ দেশি গাছ ছিল, যার পানি তুলনামূলক অনেক বেশি থাকত। আবার আমাদের একটি জমির যে পাশে কিছু ইউক্যালিপটাস ছিল, সে পাশের মাটি বর্ষাকালেও দু-চারদিন বৃষ্টি না হলে জল শুকিয়ে ঝরঝরে হতো। আর যে পাশে আম-কদম গাছ ছিল, সে পাশের মাটি থাকত অনেক আর্দ্র। সেসব ইউক্যালিপটাস গাছ কাটার পর এ সমস্যা আর দেখা দেয় না। এ রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রত্যেক ভুক্তভোগী কৃষকেরই আছে। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছের শাখার গড়ন হলো খাড়া ও ছড়ানো। ফলে এসব গাছের ডালে কোনো পশু-পাখিই বাসা বাঁধতে পারে না। এমনকি বসে বিশ্রামও নিতে পারে না। এদের ফুল-ফল খেতে পারে না কোনো প্রাণী। পাতা গরু-ছাগলেরও খাবার উপযোগী নয়। এমনকি এদের ওপর কোনো মাইক্রো ফ্লোরা-ফোনা (ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী) জন্মাতে পারে না। যাকে এককথায় বলা যায় একেবারেই আগ্রাসী আত্মকেন্দ্রিক!

মানুষ বুদ্ধি, কৌশল ও বাহুবলে গাছের সর্বাঙ্গ লুণ্ঠন করছে যেন প্রকৃতিতে একমাত্র মানুষ প্রজাতিই একক স্বত্বভোগী! কিন্তু প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণীরও অধিকার রয়েছে

এর সঙ্গে বাংলার পরিবেশবান্ধব বটজাতীয় বৃক্ষের তুলনা করা যাক। মায়ামাখা ছায়াঘন বটবৃক্ষের শাখার আনুভূমিক গড়ন যেন বাহু প্রসারিত করে পাখিদের আহ্বান করছে- ‘এসো আমার শাখায় বাসা বেঁধে ফল সেবন করো! প্রশস্ত পাতার সুনিবিড় ছায়ায় শান্তির নীড়ে প্রাণ জুড়াও!’ শুধু পাখি নয়, অজগ্র অনুজীব, মৌমাছি, বাদুড়-বানরের নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয়স্থল বটগাছ। আবার বটের নিকট গোত্রীয় ডুমুর বা খোকসা গাছ পশু-পাখির সারা বছর খাদ্য জোগানদাতা।

বাংলায় উৎপত্তি বেশির ভাগ বৃক্ষের ফুল ও ফল সাধারণত সরস ও শোভাপূর্ণ। এসব বৃক্ষ ঘিরে অসংখ্য পশু-পাখির আবাস গড়ে ওঠে। গাছের গড়নবিশেষে পশু-পাখি তাদের আবাস বা আশ্রয় নির্বাচন করে। হরেক প্রজাতির শালিক, শ্যামা, টিয়া, ঘুঘু, বুলবুলি, বক, বাজপাখি, চিল বাদুড়সহ অসংখ্য পাখি সাধারণত আম, জাম, কাঁঠাল, বট, অশ্বত্থ, খেজুর গাছে বাসা বাঁধে। বাবুই পাখি তাল, নারকেল, খেজুর গাছের পাতায় অসাধারণ নৈপুণ্যে বাসা বাঁধে এটা সবারই জানা। বক সাধারণত উচু তেঁতুল গাছে বাসা বাঁধতে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

বহু বছর ধরে বাংলায় জন্মানো বৃক্ষ অভিযোজনে উপযোগী করেছে নিজস্ব পরিবেশ-প্রকৃতিকে। এ দেশে পরিবেশ দূষণ ও প্রকৃতি বিপর্যয় রোধে বাংলার বৃক্ষগুলোর গুরুত্ব অপরিহার্য।

[লেখক : পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটি]

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

দেশীয় গাছ কি গুরুত্ব হারাচ্ছে

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত আমাদের গ্রামবাংলা। এখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষ, গুল্ম, লতাপাতা। তবে সময়ের পরিক্রমায় আমাদের বৃক্ষ সম্পদ ধ্বংসের পথে। নানা কারণে দেশের বৃক্ষ সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আয়তনের ২৫ শতাংশ জমিতে গাছপালা বা বন জঙ্গল থাকার কথা থাকলেও এর অর্ধেক জমিতেও নেই বৃক্ষসম্পদ। আবাসন নির্মাণের পাশাপাশি জ্বালানির কাজে ব্যবহারের জন্য অবাধে কর্তন করা হচ্ছে বৃক্ষ সম্পদ। আর এ সুযোগেই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে দ্রুত বর্ধনশীল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। এগুলো জ্বালানি সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখে ঠিকই, তবে ক্রমাগত মাটি ও পরিবেশের সর্বনাশ করে চলেছে।

বিদেশি বৃক্ষগুলো বাংলাদেশের মানুষই যেমন এনেছে, আবার কিছু উদ্ভিদ নিজেই বাংলাদেশে ইকোসিস্টেমে বা বাস্তুসংস্থানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বিদেশি প্রজাতির রেইনট্রি, সেগুন, আকাশমণি, আকাশি, শিশু, বাবলা, ইউক্যালিপটাস জাতীয় গাছের জন্য প্রচুর জায়গার দরকার হয়। এগুলো দেশি গাছের তুলনায় অনেক দ্রুততার সঙ্গে বেশি পরিমাণে পুষ্টি ও পানি শোষণ করে। তাই এসব বৃক্ষের আশপাশে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ বাঁচতে পারে না। ব্রিটিশ আমলে বৈধভাবেই দেশে আসে রেইনট্রি, মেহগনি, চাম্বুল ইত্যাদি। আশির দশকে আসে আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস, শিশু, ইপিলইপিল, বাবলা ও খয়ের জাতীয় গাছ। আর বিভিন্ন সময় অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করেছে- রিফুজিলতা, স্বর্ণলতা, মটমটিয়া, পিসাইস, পার্থোনিয়াম, কচুরিপানা ইত্যাদি।

গবেষকদের মতে, অতীতে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এক হাজারের বেশি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- বিদেশি এসব আগ্রাসী বৃক্ষ। আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশীয় বট, কদম, হিজল, জারুল, তমাল আর বাংলা মানেই বট, পাকুড়, ডুমুর, আম, জাম, শিমুল, পলাশ, হিজল, ছাতিম, কদম, শাল, তাল, তেঁতুলসহ অজগ্র দেশি বৃক্ষে আচ্ছাদিত। বাংলা মানেই জুঁই, চামেলি, মালতি, গন্ধরাজ, ভাঁট ফুলসহ অজগ্র লতাগুল্মের বাহার।

বাংলার এসব গাছগাছালিকে কেন্দ্র করেই বাস করে বহু প্রজাতির পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ। মানুষ বেড়েছে ভারসাম্যহীনভাবে। চাহিদা বেড়েছে খাদ্য, বস্ত্র ও আবাসের। সেই সঙ্গে বেড়েছে ভোগ-বিলাস, বিত্ত-বৈভব, লালসা ও নগদ প্রাপ্তির অসীম চাহিদা। তাই চলছে প্রকৃতি লুণ্ঠনের অজগ্র আয়োজন। কলকারখানার জন্য উন্নয়নের নামে গাছগাছালি সাবাড় করে উজাড় হচ্ছে বন। তা আবার উদ্ধারের নামে রাষ্ট্রের লাখো কোটি টাকায় শত শত প্রকল্পে চলছে সবুজায়নের এক অদ্ভুত আয়োজন। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি সর্বস্তরে চলছে বাংলার বৃক্ষ-প্রকৃতি বিনাশের কাজ।

ইউক্যালিপটাস বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে আনার পর থেকে সরকারি উদ্যোগেও সামাজিক বনায়নের আওতায় লাগানো হয়েছে সর্বত্র। সারা দেশে রাস্তার পাশে, পুকুরপাড়ে, ক্ষেতের আইলে এখন চোখে পড়ে এসব পরিবেশ হানিকর গাছ। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছ শুধু কাঠের বিবেচনায় রোপণ করা হয়; কিন্তু একটি গাছ মানে তো শুধু কয়েক ঘনফুট কাঠ নয়। গাছের সঙ্গে প্রধান বিবেচ্য বিষয় বাস্তুতন্ত্র তথা পরিবেশ-প্রকৃতি। বিবেচনায় নিতে হবে সেসব গাছ বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ। একটি গাছের সঙ্গে থাকে অনেক প্রজাতির পশু-পাখি, অজগ্র অনুজীবের জীবনচক্র ও জীবনপ্রবাহ। মানুষ বুদ্ধি, কৌশল ও বাহুবলে গাছের সর্বাঙ্গ লুণ্ঠন করছে যেন প্রকৃতিতে একমাত্র মানুষ প্রজাতিই একক স্বত্বভোগী! কিন্তু প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণীরও অধিকার রয়েছে।

মানুষ এখন ভোগ-বিলাসে ও বিত্ত-বৈভব অর্জনে আত্মকেন্দ্রিকতায় অন্ধ। এদিকে বিদেশি ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছের গড়ন ও আচরণও অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক। এসব গাছ রাত-দিন প্রচুর পানি শোষণ করে। ইউক্যালিপটাস গাছের পানি শোষণসংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণার তথ্য জানা না থাকলেও আমি প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখেছি যে আমাদের দুটি পাশাপাশি ছোট্ট পুকুরের একটির পাড়ে কিছু ইউক্যালিপটাস গাছের প্রচুর পানি শোষণ। খরা মৌসুমে এ পুকুরের পানি তলানিতে ঠেকত। অন্য পুকুরপাড়ে সাধারণ দেশি গাছ ছিল, যার পানি তুলনামূলক অনেক বেশি থাকত। আবার আমাদের একটি জমির যে পাশে কিছু ইউক্যালিপটাস ছিল, সে পাশের মাটি বর্ষাকালেও দু-চারদিন বৃষ্টি না হলে জল শুকিয়ে ঝরঝরে হতো। আর যে পাশে আম-কদম গাছ ছিল, সে পাশের মাটি থাকত অনেক আর্দ্র। সেসব ইউক্যালিপটাস গাছ কাটার পর এ সমস্যা আর দেখা দেয় না। এ রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রত্যেক ভুক্তভোগী কৃষকেরই আছে। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছের শাখার গড়ন হলো খাড়া ও ছড়ানো। ফলে এসব গাছের ডালে কোনো পশু-পাখিই বাসা বাঁধতে পারে না। এমনকি বসে বিশ্রামও নিতে পারে না। এদের ফুল-ফল খেতে পারে না কোনো প্রাণী। পাতা গরু-ছাগলেরও খাবার উপযোগী নয়। এমনকি এদের ওপর কোনো মাইক্রো ফ্লোরা-ফোনা (ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী) জন্মাতে পারে না। যাকে এককথায় বলা যায় একেবারেই আগ্রাসী আত্মকেন্দ্রিক!

মানুষ বুদ্ধি, কৌশল ও বাহুবলে গাছের সর্বাঙ্গ লুণ্ঠন করছে যেন প্রকৃতিতে একমাত্র মানুষ প্রজাতিই একক স্বত্বভোগী! কিন্তু প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণীরও অধিকার রয়েছে

এর সঙ্গে বাংলার পরিবেশবান্ধব বটজাতীয় বৃক্ষের তুলনা করা যাক। মায়ামাখা ছায়াঘন বটবৃক্ষের শাখার আনুভূমিক গড়ন যেন বাহু প্রসারিত করে পাখিদের আহ্বান করছে- ‘এসো আমার শাখায় বাসা বেঁধে ফল সেবন করো! প্রশস্ত পাতার সুনিবিড় ছায়ায় শান্তির নীড়ে প্রাণ জুড়াও!’ শুধু পাখি নয়, অজগ্র অনুজীব, মৌমাছি, বাদুড়-বানরের নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয়স্থল বটগাছ। আবার বটের নিকট গোত্রীয় ডুমুর বা খোকসা গাছ পশু-পাখির সারা বছর খাদ্য জোগানদাতা।

বাংলায় উৎপত্তি বেশির ভাগ বৃক্ষের ফুল ও ফল সাধারণত সরস ও শোভাপূর্ণ। এসব বৃক্ষ ঘিরে অসংখ্য পশু-পাখির আবাস গড়ে ওঠে। গাছের গড়নবিশেষে পশু-পাখি তাদের আবাস বা আশ্রয় নির্বাচন করে। হরেক প্রজাতির শালিক, শ্যামা, টিয়া, ঘুঘু, বুলবুলি, বক, বাজপাখি, চিল বাদুড়সহ অসংখ্য পাখি সাধারণত আম, জাম, কাঁঠাল, বট, অশ্বত্থ, খেজুর গাছে বাসা বাঁধে। বাবুই পাখি তাল, নারকেল, খেজুর গাছের পাতায় অসাধারণ নৈপুণ্যে বাসা বাঁধে এটা সবারই জানা। বক সাধারণত উচু তেঁতুল গাছে বাসা বাঁধতে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

বহু বছর ধরে বাংলায় জন্মানো বৃক্ষ অভিযোজনে উপযোগী করেছে নিজস্ব পরিবেশ-প্রকৃতিকে। এ দেশে পরিবেশ দূষণ ও প্রকৃতি বিপর্যয় রোধে বাংলার বৃক্ষগুলোর গুরুত্ব অপরিহার্য।

[লেখক : পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটি]

back to top