alt

উপ-সম্পাদকীয়

ই-বর্জ্য: সমস্যা ও সম্ভাবনা

অমৃত চিছাম

: বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩
image

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন দিন মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত থেকে আরও উন্নততর হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রতিনিয়তই বাড়ছে নানা ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যে কয়েকটি বিষয় বিশ্ববাসীর মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ইলেকট্রনিক ডিভাইস। বর্তমান বিশ্বে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যে কোনো প্রকার ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে না। ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ব্যবহার প্রতটি মানুষের প্রতিদিনকার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। আর যা না হলে বর্তমানে একদিনও কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। ওই ডিভাইস আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়, ইলেকক্ট্রনিক ডিভাইসও এর বাইরে নয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ডিভাইসের কর্মক্ষমতা বিরাজমান থাকে। এরপর কর্মক্ষমতা হারিয়ে অকার্যকর হয়ে পড়লে তার জায়গা হয় ঘরের কোণায়, আবর্জনার স্তূপে, ভাঙারি দোকানে কিংবা পরিবেশের আনাচে কানাচে। অনেক ব্যবহারকারীই হয়তো জানেন না যে, ফেলে দেয়া এসব ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশে নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ সুপ্তাবস্থায় থাকে। তাই কর্মক্ষমতা শেষ হলে বা নষ্ট হয়ে গেলে এগুলোকে খুব সাবধানতার সঙ্গে সামলাতে হবে। প্রথমেই জানা যাক, ই-বর্জ্য বিষয়টা আসলে কী? ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য সাধারণ অর্থে বলতে গেলে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বা পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতিকে বোঝায়। এগুলো মূলত ভোক্তার বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, যেমন- ফ্রিজ, ক্যামেরা, মাইক্রোওয়েভ, কাপড় ধোয়ার ও শুকানোর যন্ত্র, টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইত্যাদি। ই-বর্জ্য শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়, বরং গত কয়েক বছর ধরে সারা বিশ্বেই মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে চলছে। ই-বর্জ্যরে উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্বর্ণ, রুপা, সিসা, ক্যাডমিয়াম, প্লাটিনাম, নিকেল, টিন, দস্তা, সালফার, ফসফরাস, প্যালাডিয়াম, নিডোমিয়ামসহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতু থাকায় ই-বর্জ্যকে ‘আরবান মাইন’ বলা হয়। এর মধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সীসার মতো ধাতুও রয়েছে। পরিবেশসম্মত কার্যকর উপায়ে এসব ধাতু সংগ্রহ করা গেলে ই-বর্জ্য পরিণত হবে এক মূল্যবান সম্পদে। বর্তমানে ই-বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইলেকট্রিক পণ্য ব্যবহারের পর কর্মক্ষমতা শেষ হলে তা ফেলে দেয়া হচ্ছে পরিবেশে। এর ফলে সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে সৃষ্টি করছে মাটিদূষণ। তাই ই-বর্জ্যকে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম একটি নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও উক্ত বর্জ্যকে অটিজম ও মানসিক বিকাশ না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। ই-বর্জ্য বাচ্চাদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। লেড, পারদ ও সীসার মতো ভারী ধাতুসমূহ অতি সহজে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের বিষক্রিয়া প্রদর্শন করে। পরিবেশে এর তীব্রতা দীর্ঘদিন পর্যন্ত টিকে থাকে। যা পরবর্তীতে মাটিদূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ ঘটায় এবং শুধুমাত্র দূষণ ঘটিয়েই শান্ত থাকে না পরবর্তীতে তা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে। এর ফলাফল কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। উন্মুক্ত জায়গায় ই-বর্জ্য পোড়ানো কিংবা অনিরাপদ ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বুয়েটের একটি গবেষণা বলছে, মোবাইল টাওয়ার থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনাসহ, দেশে ই-বর্জ্যরে উৎস কমপক্ষে ১৫টি। সবশেষ জনশুমারি অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। ১ জুন, ২০২৩ (বাসস): এর দেয়া তথ্যমতে, দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ কোটি। দেশে গত ২১ বছরে মোবাইল ফোন থেকে ১০,৫০৪ মেট্রিক টন বিষাক্ত ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। যা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা জীবজগতের জন্য একটা বড় রকমের হুমকি। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণের অগ্রযাত্রায় দিন দিন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আর এই যাত্রাপথে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার উল্লেখ্যযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বিশেষ করে স্মার্টফোন, কম্পিউটার এবং গৃহস্থলিতে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক পণ্য। গত দশ বছরে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ গুণ। আর এসব পণ্য হতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টন। তবে আশার কথা এই যে, উক্ত সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ এত সুবর্ণসুযোগ থাকার পরও সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে না করতে পারায় ই-বর্জ্যের সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি সেভাবে। এছাড়াও ই-বর্জ্য হ্যান্ডলিং ও রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ বছরে ৮০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। এক প্রতিবেদন হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাতিল একটি সাধারণ সিআরটি টিভিতে গড়ে ৪৫০ গ্রাম তামা, ২২৫ গ্রাম অ্যালুমিনিয়াম ও ৫ দশমিক ৬ গ্রাম স্বর্ণ থাকে। তবে অবাক করার মতো বিষয় এই যে প্রতিটি মোবাইল ফোনে প্রায় ৩৪ থেকে ৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ থাকে। তাহলে খুব সহজে অনুমেয় যে, এ খাত থেকে কী পরিমাণ অর্থ জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ করা সম্ভব। বুয়েট ও পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালিত যৌ গবেষণা হতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক মেট্রিক টন প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড ও র‌্যাম থেকে পাওয়া যেতে পারে ২৮ হাজার ডলার বা ২৪ লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণ, রুপা, তামা ও টিন। ই-বর্জ্য বিষয়টি প্রায় এমন যে, দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তাহলে দাগই ভালো। দেশে এ খাতের অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে অদূর ভবিষ্যতে। কেবল পর্যাপ্ত জ্ঞান ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা এই সম্পদের সুফল যথাযথ ভাবে ভোগ করতে পাচ্ছি না। তাই এখন সময় এসেছে ইলেকট্রনিক পণ্য বা ডিজিটাল পণ্যের ব্যবহারে সৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যথাযথ জ্ঞানকে কাজে লাগানোর। যা বর্তমানে সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’ প্রণয়ন করেছে। বিধিমালার আওতায় একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য বা ই-বর্জ্য উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানকেই আবার তাদের উৎপাদিত বর্জ্য ফেরত নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যবহারের পর নষ্ট বা বাতিল মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ অন্যান্য ই-বর্জ্য ফেরত দেয়ার বিনিময়ে অর্থ পাবেন ব্যবহারকারীরা, এই মর্ম বিধিমালায় নির্দিষ্ট করে বলা আছে। বিধিমালায় আরো বলা হয়েছে, এখন থেকে চাইলেই কেউ আর বিদেশ হতে পুরনো বা ব্যবহৃত মোবাইল বা ল্যাপটপ আনতে পারবেন না। বিধিমালার কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত, ২০১০)’-এর ১৫ (১) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। পুনরায় একই রকম অপরাধ করলে সাজার মেয়াদ বেড়ে দুই থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড বা দুই থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রদানের বিষয়ে বিধিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। বিধিমালায় উল্লেখ্য প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী ও বড় আমদানিকারকের ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিধিমালা তৈরি হওয়ায় ই-বর্জ্যরে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নেয়ার পথটা আরও সুগম হল। যা আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা তথা অর্থনীতিকে আরও বেগবান করতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাস্তবায়নের প্রথম বছর প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী ও বড় আমদানিকারককে উৎপাদিত ই-বর্জ্যরে ১০ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয় বছরে ২০ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ৩০ শতাংশ, চতুর্থ বছরে ৪০ শতাংশ ও পঞ্চম বছরে ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিষয়টা প্রায় এমন, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভার বহনের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় আর কী! ই-বর্জ্যরে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রিসাইকেল করার মাধ্যমে মাটিদূষণ, পানিদূষণ তথা পরিবেশ দূষণ বহুলাংশে হ্রাস করতে পারি। এর ফলে এক দিকে যেমন পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে, অন্যদিকে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিও কিছুটা সমৃদ্ধ হবে। প্রাথমিক এক তথ্য অনুসারে, এই ব্যবসায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতির গতিও কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া দেশে ই-বর্জ্য রিসাইকেল শিল্পের প্রসারের ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃটি হবে, বেকারত্ব দূর হবে, লিঙ্গ বৈষম্য পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে, সর্বোপরি পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে সম্ভব হবে। পরিশেষে বলা যায় ভবিষ্যতে ই-বর্জ্য, পরিবর্তন হতে পারে হাজারো মানুষের ভাগ্যের চাকা। সর্বোপরি ২০৩০ সালে এসডিজি বাস্তবায়ন ও রূপকল্প ২০৪১ বা বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ই-বর্জ্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।

[লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ই-বর্জ্য: সমস্যা ও সম্ভাবনা

অমৃত চিছাম

image

বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন দিন মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত থেকে আরও উন্নততর হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রতিনিয়তই বাড়ছে নানা ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যে কয়েকটি বিষয় বিশ্ববাসীর মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ইলেকট্রনিক ডিভাইস। বর্তমান বিশ্বে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যে কোনো প্রকার ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে না। ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ব্যবহার প্রতটি মানুষের প্রতিদিনকার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। আর যা না হলে বর্তমানে একদিনও কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। ওই ডিভাইস আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়, ইলেকক্ট্রনিক ডিভাইসও এর বাইরে নয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ডিভাইসের কর্মক্ষমতা বিরাজমান থাকে। এরপর কর্মক্ষমতা হারিয়ে অকার্যকর হয়ে পড়লে তার জায়গা হয় ঘরের কোণায়, আবর্জনার স্তূপে, ভাঙারি দোকানে কিংবা পরিবেশের আনাচে কানাচে। অনেক ব্যবহারকারীই হয়তো জানেন না যে, ফেলে দেয়া এসব ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশে নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ সুপ্তাবস্থায় থাকে। তাই কর্মক্ষমতা শেষ হলে বা নষ্ট হয়ে গেলে এগুলোকে খুব সাবধানতার সঙ্গে সামলাতে হবে। প্রথমেই জানা যাক, ই-বর্জ্য বিষয়টা আসলে কী? ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য সাধারণ অর্থে বলতে গেলে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বা পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতিকে বোঝায়। এগুলো মূলত ভোক্তার বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, যেমন- ফ্রিজ, ক্যামেরা, মাইক্রোওয়েভ, কাপড় ধোয়ার ও শুকানোর যন্ত্র, টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইত্যাদি। ই-বর্জ্য শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়, বরং গত কয়েক বছর ধরে সারা বিশ্বেই মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে চলছে। ই-বর্জ্যরে উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্বর্ণ, রুপা, সিসা, ক্যাডমিয়াম, প্লাটিনাম, নিকেল, টিন, দস্তা, সালফার, ফসফরাস, প্যালাডিয়াম, নিডোমিয়ামসহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতু থাকায় ই-বর্জ্যকে ‘আরবান মাইন’ বলা হয়। এর মধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সীসার মতো ধাতুও রয়েছে। পরিবেশসম্মত কার্যকর উপায়ে এসব ধাতু সংগ্রহ করা গেলে ই-বর্জ্য পরিণত হবে এক মূল্যবান সম্পদে। বর্তমানে ই-বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইলেকট্রিক পণ্য ব্যবহারের পর কর্মক্ষমতা শেষ হলে তা ফেলে দেয়া হচ্ছে পরিবেশে। এর ফলে সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে সৃষ্টি করছে মাটিদূষণ। তাই ই-বর্জ্যকে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম একটি নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও উক্ত বর্জ্যকে অটিজম ও মানসিক বিকাশ না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। ই-বর্জ্য বাচ্চাদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। লেড, পারদ ও সীসার মতো ভারী ধাতুসমূহ অতি সহজে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের বিষক্রিয়া প্রদর্শন করে। পরিবেশে এর তীব্রতা দীর্ঘদিন পর্যন্ত টিকে থাকে। যা পরবর্তীতে মাটিদূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ ঘটায় এবং শুধুমাত্র দূষণ ঘটিয়েই শান্ত থাকে না পরবর্তীতে তা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে। এর ফলাফল কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। উন্মুক্ত জায়গায় ই-বর্জ্য পোড়ানো কিংবা অনিরাপদ ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বুয়েটের একটি গবেষণা বলছে, মোবাইল টাওয়ার থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনাসহ, দেশে ই-বর্জ্যরে উৎস কমপক্ষে ১৫টি। সবশেষ জনশুমারি অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। ১ জুন, ২০২৩ (বাসস): এর দেয়া তথ্যমতে, দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮ কোটি। দেশে গত ২১ বছরে মোবাইল ফোন থেকে ১০,৫০৪ মেট্রিক টন বিষাক্ত ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। যা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা জীবজগতের জন্য একটা বড় রকমের হুমকি। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণের অগ্রযাত্রায় দিন দিন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আর এই যাত্রাপথে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার উল্লেখ্যযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বিশেষ করে স্মার্টফোন, কম্পিউটার এবং গৃহস্থলিতে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক পণ্য। গত দশ বছরে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ গুণ। আর এসব পণ্য হতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টন। তবে আশার কথা এই যে, উক্ত সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ এত সুবর্ণসুযোগ থাকার পরও সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে না করতে পারায় ই-বর্জ্যের সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি সেভাবে। এছাড়াও ই-বর্জ্য হ্যান্ডলিং ও রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ বছরে ৮০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। এক প্রতিবেদন হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাতিল একটি সাধারণ সিআরটি টিভিতে গড়ে ৪৫০ গ্রাম তামা, ২২৫ গ্রাম অ্যালুমিনিয়াম ও ৫ দশমিক ৬ গ্রাম স্বর্ণ থাকে। তবে অবাক করার মতো বিষয় এই যে প্রতিটি মোবাইল ফোনে প্রায় ৩৪ থেকে ৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ থাকে। তাহলে খুব সহজে অনুমেয় যে, এ খাত থেকে কী পরিমাণ অর্থ জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ করা সম্ভব। বুয়েট ও পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালিত যৌ গবেষণা হতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক মেট্রিক টন প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড ও র‌্যাম থেকে পাওয়া যেতে পারে ২৮ হাজার ডলার বা ২৪ লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণ, রুপা, তামা ও টিন। ই-বর্জ্য বিষয়টি প্রায় এমন যে, দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তাহলে দাগই ভালো। দেশে এ খাতের অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে অদূর ভবিষ্যতে। কেবল পর্যাপ্ত জ্ঞান ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা এই সম্পদের সুফল যথাযথ ভাবে ভোগ করতে পাচ্ছি না। তাই এখন সময় এসেছে ইলেকট্রনিক পণ্য বা ডিজিটাল পণ্যের ব্যবহারে সৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যথাযথ জ্ঞানকে কাজে লাগানোর। যা বর্তমানে সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’ প্রণয়ন করেছে। বিধিমালার আওতায় একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য বা ই-বর্জ্য উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানকেই আবার তাদের উৎপাদিত বর্জ্য ফেরত নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যবহারের পর নষ্ট বা বাতিল মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ অন্যান্য ই-বর্জ্য ফেরত দেয়ার বিনিময়ে অর্থ পাবেন ব্যবহারকারীরা, এই মর্ম বিধিমালায় নির্দিষ্ট করে বলা আছে। বিধিমালায় আরো বলা হয়েছে, এখন থেকে চাইলেই কেউ আর বিদেশ হতে পুরনো বা ব্যবহৃত মোবাইল বা ল্যাপটপ আনতে পারবেন না। বিধিমালার কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত, ২০১০)’-এর ১৫ (১) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। পুনরায় একই রকম অপরাধ করলে সাজার মেয়াদ বেড়ে দুই থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড বা দুই থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রদানের বিষয়ে বিধিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। বিধিমালায় উল্লেখ্য প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী ও বড় আমদানিকারকের ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিধিমালা তৈরি হওয়ায় ই-বর্জ্যরে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নেয়ার পথটা আরও সুগম হল। যা আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা তথা অর্থনীতিকে আরও বেগবান করতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাস্তবায়নের প্রথম বছর প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী ও বড় আমদানিকারককে উৎপাদিত ই-বর্জ্যরে ১০ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয় বছরে ২০ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ৩০ শতাংশ, চতুর্থ বছরে ৪০ শতাংশ ও পঞ্চম বছরে ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিষয়টা প্রায় এমন, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভার বহনের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় আর কী! ই-বর্জ্যরে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রিসাইকেল করার মাধ্যমে মাটিদূষণ, পানিদূষণ তথা পরিবেশ দূষণ বহুলাংশে হ্রাস করতে পারি। এর ফলে এক দিকে যেমন পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে, অন্যদিকে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিও কিছুটা সমৃদ্ধ হবে। প্রাথমিক এক তথ্য অনুসারে, এই ব্যবসায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতির গতিও কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া দেশে ই-বর্জ্য রিসাইকেল শিল্পের প্রসারের ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃটি হবে, বেকারত্ব দূর হবে, লিঙ্গ বৈষম্য পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে, সর্বোপরি পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে সম্ভব হবে। পরিশেষে বলা যায় ভবিষ্যতে ই-বর্জ্য, পরিবর্তন হতে পারে হাজারো মানুষের ভাগ্যের চাকা। সর্বোপরি ২০৩০ সালে এসডিজি বাস্তবায়ন ও রূপকল্প ২০৪১ বা বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ই-বর্জ্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।

[লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top