মাছুম বিল্লাহ
চট্টগ্রাম সিটির একটি কলেজের বিদায় শিক্ষার্থীরা একটি রুমে চারটি ফ্যানের পাখা মুচড়ে উল্টো করে রেখেছে। ফ্যানগুলোকে তারা নিচ থেকে বাঁকা করে ব্যবহারের অনুপযোগী করে দেয়। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম কুলগাঁও সিটি করপোরেশন কলেজে। ২০২৩ সালে বিদায়ী পরীক্ষার্থীরা এ কাজটি করেছে। কলেজের অধ্যক্ষ মনের দুঃখে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের দোয়া করেছেন, তারা যেন ভবিষ্যতে ভালো মানুষ হতে পারে, উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে যাতে তারা ভালো মানুষের মতো আচরণ শিখতে পারে। শেষে তিনি লিখেছেন যে, এটি ছিল শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কলেজের উপহার। ফেসবুকে দেয়ার পর সেটি ২৬ হাজার মানুষ রিঅ্যাক্ট করেছেন এবং দুই হাজার জন কমেন্ট করেছেন। অধ্যক্ষ বলেছেন মনের ক্ষোভে ও দুঃখে পোস্টটি করেছিলাম যাতে আমার শিক্ষার্থী তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং জীবনে সংশোধিত হতে পারে। যারা কমেন্ট করেছেন তারা শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলেছেন। এসব শিক্ষার্থী যারা নিজ কলেজের ফ্যানগুলোর অবস্থা ইচ্ছে করেই এভাবে করতে পারে তারা উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে অবদান রাখা তো দূরের কথা বরং কতটা ক্ষতি করবে সেটি মানসচক্ষে যে কেউ আমরা দেখতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সহপাঠী, সিনিয়র ও জুনিয়র যারা অনেকেই এখন দেশে, বিদেশে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত তাদের অনেককেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনেক ধ্বংসাত্মক কাজ করতে দেখেছি। আমাদের পুরো সময়টাই ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলন। সময় অসময়, কথায় কথায় হলো রেইড এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। ওই সময় জাতীয় আন্দোলন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ছোট-বড় সব কারণেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করত। অনেক আন্দোলনেই আমাদের সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। তখন অবাক হয়ে দেখেছি অনেক তথাকথিত ভালো ছাত্র এবং এখন অনেকেই অনেক কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন তারা কিভাবে অযথা গাড়ি ভাঙচুর করত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ অযথা নষ্ট করত। হলে রুমের পর রুম মহাউৎসাহে সমস্ত জানালা মড় মড় করে রড দিয়ে দিয়ে ভেঙে ফেলত। যেন বাদামের ঠোঙ্গার মতো সস্তা বিষয়। তখন অবাক হয়ে ভাবতাম এসব বন্ধুরাই একদিন বড় বড় পদে বসবেন, শিক্ষার্থীদের, অধীনস্থদের এবং জাতিকে অনেক উপদেশ দেবেন এবং সেবার কথা বলবেন। সেগুলো তাদের মুখে বেমানান হবে। নিজেদের মূল্যাবোধ ও দেশের প্রতি যাদের প্রকৃত অর্থে ভালোবাসা নেই তাদের কোন কথা কি আসলেই কোন কাজে লাগে? প্রকৃত অর্থেই কোন কাজে আসে না। আর তাই সমাজের এই অবস্থা। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে আমাদের সহপাঠী নিজ হাতে হকিস্টিক নিয়ে মারামারি, ভাঙচুর সব কিছুই করেছে। একদিন আমার রুমমেট (বর্তমানে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন) আমাকে বলল এরা এত বড় বড় কর্মকর্তার ছেলে অথচ হাতে হকিস্টিক। দেখতে কতটা বেমানান। তার মানে সমাজে পচন ধরা অনেক আগেই শুরু হয়েছে এখন তার চরম রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। অধ্যক্ষের হৃদয়টাকে যদি দেখানোর মতো অবস্থা থাকত এবং আমাদের দেখার চোখ থাকত তাহলে বোঝা যেত কত অসহায়, কত দুঃখ, কত মানসিক যন্ত্রণা এবং কতটা অভিমান নিয়ে তিন ফেসবুকের আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি (বরিশাল সরকারি বি এম কলেজে) গ্যালারি সমেত বিশাল রুম। সমস্ত দেয়াল উল্টা-পাল্টা এবং আজেবাজে লেখা দিয়ে ভর্তি। প্রথমদিনই দেখলাম শুধু মেয়েদের উদ্দেশ করে বহু ধরনের আজেবাজে লেখা। সম্ভবত কলেজ জীবনে প্রথমদিনের উপহার। ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, পবিত্র স্থান, জ্ঞানের আধার আর জ্ঞানী-গুণীদের জায়গা। অবাক করা বিষয় কলেজে শুধু কবিতা দেখে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলাম নোংরা ছবিসহ কবিতা, লেখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল, বাথরুম সর্বত্র। কী রুচি নিয়ে ছেলেপেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে আর কিভাবে তারা এখানে এসব কাজ করে। অবাক বিস্ময়ে দেখতাম নোংরামি কতটা। যৎকিঞ্চিৎ রাজনৈতিক ফায়দার জন্য নিজ ক্লাসমেটকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়ে হাসাপাতালে পাঠানো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে যেসব শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করবে তাদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখে আসা যেসব কৃত্তির কথা বললাম, এসব ছেলেপেলে তো তা-ই করবে। অধ্যক্ষ মহোদয়, দোয়া করেছেন, আশীর্বাদ করেছেন যেন তারা জীবনে ভালো হয়ে যায়। তারা ভালো না হলে এ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে থেকে তারা দেশের কতটা ক্ষতি করবে সেটি সহজেই অনুমেয়। অথচ স্কুল জীবনে দেখেছি আমাদের বড় ভাইয়েরা চাঁদা তুলে বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য এক এক বছর এক এক ব্যাচ বিভিন্ন উপহারসামগ্রী দিয়ে যেতেন, আমরাও তাই করেছি। কিন্তু কলেজে উঠে যেন বেয়াদবি এবং মনুষত্ব আস্তে আস্তে হারানোর প্রথম দীক্ষা শুরু হয় এবং উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে এসে সেটি পূর্ণতা পায়। সমাজের এই চরম অবক্ষয় নিয়ে কেউ কোন কথা বলছি না, অন্য বিষয় নিয়ে যেন সবাই ব্যস্ত। কিন্তু কিসের জন্য আমরা এইসব সামাজিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছি সেটি একবারও কেউ ভেবে দেখি না। মানুষ তৈরি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠান কিন্তু তৈরি করছি। শুধুমাত্র শিক্ষক বা একজন অধ্যক্ষ এতবড় কাজটি একা কিংবা এককভাবে করতে পারবেন না, পারেন না। সবার সহযোগিতা দরকার। ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা। তা নাহলে সমাজের যে অধঃপতন শুরু হয়েছে এবং ইতোমধ্যে অনেক গভীরে চলে গেছে এর ফল সবাই কমবেশি ভুগতে শুরু করেছি। একসময় সমাজে ভালো কাজের কোন অস্তিত্বই থাকবে না, শুধুই পশুত্ব বিরাজ করবে সর্বত্র। কাজেই সবাইকে এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। ইদানীং পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, ফেসবুক খুললেই দেখা যায় অমুক স্কুলের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, কলেজের অধ্যাপক কিংবা অধ্যক্ষকে এলাকার কোন এক পাতি নেতা কিংবা মাস্তান শারীরিকভাবে হেনস্তা করছে এমনকি নারী শিক্ষকদেরও হেনস্তা করছে সবার সামনে। কারণ কিছুই না হয়তো তার অভদ্র কোন ছেলেকে কোন উপদেশ দিয়েছেন কিংবা একটু গালমন্দ করেছেন। আর তাই তার বা তাদের এই পরিণতি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে সমাজ এসব ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করছে। সমাজপতিরাও বিষয়গুলোকে সায় দিয়ে যাচ্ছে কারণ শক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যা তাদের পক্ষে যাচ্ছে এই ভেবে। বাকিরা ভাগে আমাদের তো কিছু করেনি। শিক্ষককে করেছে মানে সমাজকেই অপদস্থ করা হয়েছে সেটি কেউ ভাবে না। এখানে তো নীরব থাকার কথা নয়। যেসব শিক্ষার্থীরা কলেজের ফ্যান নষ্ট করে ফেলেছ অর্থাৎ তাদের নিজ কলেজের সম্পদ নষ্ট করেছে তারা যে কোন সময় যে কোন কিছু নষ্ট করতে পারে। কাজেই এটিকে প্রশাসন, এলাকার নেতৃবৃন্দ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সহজভাবে না নিয়ে তাদের ডেকে উচিত শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন।
সমাজে পচন ধরা অনেক আগেই শুরু হয়েছে এখন তার চরম রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি
তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, তাদের মানবিকতা, দেশপ্রেম, মমত্ববোধ এবং সততা শিখতে হবে, শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমাজের জন্য রাষ্ট্রের জন্য এবং তার চারপাশের মানুষের জন্য। এ বিষয়টিতে থেকে কাউকে ছাড় দেয়া ঠিক হবে না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের বাস কন্ডাকটরদের সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করতে। সামান্য কারণে তারা এসব ঘটায়। তারা মনেই করে না যে, তাদের প্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তাটুকুতেই তারা চলতে পারবে না। তাদের এর বাইরে অবশ্যই যেতে হবে। অথচ কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে চলাচল করা ট্রান্সপোর্টগুলোকে ঘন ঘন সামান্য কারণে কিংবা কোন উল্লেখযোগ্য কারণ ছাড়াই আক্রমণ করে, হেল্পার, কন্ডাকটরদের মারধর করে, গাড়ি ভেঙে ফেলে। তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এটি বোঝানোর জন্য শক্তি প্রদর্শন করে, কখনও তারা উদারতা কিংব উদাহরণ দেয়ার মতো কোন আচরণ করে না। এ ধরনের কাজ তারা হরহামেশাই করছে। বাসের ড্রাইভার-হেল্পারদের সঙ্গে মারমারি করে এসে অধ্যক্ষ কিংবা ভিসিদের আক্রমণ করে তাদের পক্ষে কাজ করার জন্য, কথা বলার জন্য সহিংসপথে আন্দোলন শুরু করে। এই যেন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিরচেনা চিত্র। এ চিত্রকে পাল্টাতে হবে তা না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যকারিতা পুরোটাই হারিয়ে ফেলবে এবং সমাজ আরও গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবে। এই দায়িত্বটুকু আমাদের সবাইকে পালন করতে হবে।
[লেখক : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স
অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ]
মাছুম বিল্লাহ
রোববার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
চট্টগ্রাম সিটির একটি কলেজের বিদায় শিক্ষার্থীরা একটি রুমে চারটি ফ্যানের পাখা মুচড়ে উল্টো করে রেখেছে। ফ্যানগুলোকে তারা নিচ থেকে বাঁকা করে ব্যবহারের অনুপযোগী করে দেয়। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম কুলগাঁও সিটি করপোরেশন কলেজে। ২০২৩ সালে বিদায়ী পরীক্ষার্থীরা এ কাজটি করেছে। কলেজের অধ্যক্ষ মনের দুঃখে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের দোয়া করেছেন, তারা যেন ভবিষ্যতে ভালো মানুষ হতে পারে, উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে যাতে তারা ভালো মানুষের মতো আচরণ শিখতে পারে। শেষে তিনি লিখেছেন যে, এটি ছিল শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কলেজের উপহার। ফেসবুকে দেয়ার পর সেটি ২৬ হাজার মানুষ রিঅ্যাক্ট করেছেন এবং দুই হাজার জন কমেন্ট করেছেন। অধ্যক্ষ বলেছেন মনের ক্ষোভে ও দুঃখে পোস্টটি করেছিলাম যাতে আমার শিক্ষার্থী তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং জীবনে সংশোধিত হতে পারে। যারা কমেন্ট করেছেন তারা শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলেছেন। এসব শিক্ষার্থী যারা নিজ কলেজের ফ্যানগুলোর অবস্থা ইচ্ছে করেই এভাবে করতে পারে তারা উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে অবদান রাখা তো দূরের কথা বরং কতটা ক্ষতি করবে সেটি মানসচক্ষে যে কেউ আমরা দেখতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সহপাঠী, সিনিয়র ও জুনিয়র যারা অনেকেই এখন দেশে, বিদেশে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত তাদের অনেককেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনেক ধ্বংসাত্মক কাজ করতে দেখেছি। আমাদের পুরো সময়টাই ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলন। সময় অসময়, কথায় কথায় হলো রেইড এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। ওই সময় জাতীয় আন্দোলন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ছোট-বড় সব কারণেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করত। অনেক আন্দোলনেই আমাদের সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। তখন অবাক হয়ে দেখেছি অনেক তথাকথিত ভালো ছাত্র এবং এখন অনেকেই অনেক কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন তারা কিভাবে অযথা গাড়ি ভাঙচুর করত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ অযথা নষ্ট করত। হলে রুমের পর রুম মহাউৎসাহে সমস্ত জানালা মড় মড় করে রড দিয়ে দিয়ে ভেঙে ফেলত। যেন বাদামের ঠোঙ্গার মতো সস্তা বিষয়। তখন অবাক হয়ে ভাবতাম এসব বন্ধুরাই একদিন বড় বড় পদে বসবেন, শিক্ষার্থীদের, অধীনস্থদের এবং জাতিকে অনেক উপদেশ দেবেন এবং সেবার কথা বলবেন। সেগুলো তাদের মুখে বেমানান হবে। নিজেদের মূল্যাবোধ ও দেশের প্রতি যাদের প্রকৃত অর্থে ভালোবাসা নেই তাদের কোন কথা কি আসলেই কোন কাজে লাগে? প্রকৃত অর্থেই কোন কাজে আসে না। আর তাই সমাজের এই অবস্থা। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে আমাদের সহপাঠী নিজ হাতে হকিস্টিক নিয়ে মারামারি, ভাঙচুর সব কিছুই করেছে। একদিন আমার রুমমেট (বর্তমানে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন) আমাকে বলল এরা এত বড় বড় কর্মকর্তার ছেলে অথচ হাতে হকিস্টিক। দেখতে কতটা বেমানান। তার মানে সমাজে পচন ধরা অনেক আগেই শুরু হয়েছে এখন তার চরম রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। অধ্যক্ষের হৃদয়টাকে যদি দেখানোর মতো অবস্থা থাকত এবং আমাদের দেখার চোখ থাকত তাহলে বোঝা যেত কত অসহায়, কত দুঃখ, কত মানসিক যন্ত্রণা এবং কতটা অভিমান নিয়ে তিন ফেসবুকের আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি (বরিশাল সরকারি বি এম কলেজে) গ্যালারি সমেত বিশাল রুম। সমস্ত দেয়াল উল্টা-পাল্টা এবং আজেবাজে লেখা দিয়ে ভর্তি। প্রথমদিনই দেখলাম শুধু মেয়েদের উদ্দেশ করে বহু ধরনের আজেবাজে লেখা। সম্ভবত কলেজ জীবনে প্রথমদিনের উপহার। ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, পবিত্র স্থান, জ্ঞানের আধার আর জ্ঞানী-গুণীদের জায়গা। অবাক করা বিষয় কলেজে শুধু কবিতা দেখে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলাম নোংরা ছবিসহ কবিতা, লেখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল, বাথরুম সর্বত্র। কী রুচি নিয়ে ছেলেপেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে আর কিভাবে তারা এখানে এসব কাজ করে। অবাক বিস্ময়ে দেখতাম নোংরামি কতটা। যৎকিঞ্চিৎ রাজনৈতিক ফায়দার জন্য নিজ ক্লাসমেটকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়ে হাসাপাতালে পাঠানো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে যেসব শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করবে তাদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখে আসা যেসব কৃত্তির কথা বললাম, এসব ছেলেপেলে তো তা-ই করবে। অধ্যক্ষ মহোদয়, দোয়া করেছেন, আশীর্বাদ করেছেন যেন তারা জীবনে ভালো হয়ে যায়। তারা ভালো না হলে এ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে থেকে তারা দেশের কতটা ক্ষতি করবে সেটি সহজেই অনুমেয়। অথচ স্কুল জীবনে দেখেছি আমাদের বড় ভাইয়েরা চাঁদা তুলে বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য এক এক বছর এক এক ব্যাচ বিভিন্ন উপহারসামগ্রী দিয়ে যেতেন, আমরাও তাই করেছি। কিন্তু কলেজে উঠে যেন বেয়াদবি এবং মনুষত্ব আস্তে আস্তে হারানোর প্রথম দীক্ষা শুরু হয় এবং উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে এসে সেটি পূর্ণতা পায়। সমাজের এই চরম অবক্ষয় নিয়ে কেউ কোন কথা বলছি না, অন্য বিষয় নিয়ে যেন সবাই ব্যস্ত। কিন্তু কিসের জন্য আমরা এইসব সামাজিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছি সেটি একবারও কেউ ভেবে দেখি না। মানুষ তৈরি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠান কিন্তু তৈরি করছি। শুধুমাত্র শিক্ষক বা একজন অধ্যক্ষ এতবড় কাজটি একা কিংবা এককভাবে করতে পারবেন না, পারেন না। সবার সহযোগিতা দরকার। ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা। তা নাহলে সমাজের যে অধঃপতন শুরু হয়েছে এবং ইতোমধ্যে অনেক গভীরে চলে গেছে এর ফল সবাই কমবেশি ভুগতে শুরু করেছি। একসময় সমাজে ভালো কাজের কোন অস্তিত্বই থাকবে না, শুধুই পশুত্ব বিরাজ করবে সর্বত্র। কাজেই সবাইকে এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। ইদানীং পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, ফেসবুক খুললেই দেখা যায় অমুক স্কুলের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, কলেজের অধ্যাপক কিংবা অধ্যক্ষকে এলাকার কোন এক পাতি নেতা কিংবা মাস্তান শারীরিকভাবে হেনস্তা করছে এমনকি নারী শিক্ষকদেরও হেনস্তা করছে সবার সামনে। কারণ কিছুই না হয়তো তার অভদ্র কোন ছেলেকে কোন উপদেশ দিয়েছেন কিংবা একটু গালমন্দ করেছেন। আর তাই তার বা তাদের এই পরিণতি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে সমাজ এসব ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করছে। সমাজপতিরাও বিষয়গুলোকে সায় দিয়ে যাচ্ছে কারণ শক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যা তাদের পক্ষে যাচ্ছে এই ভেবে। বাকিরা ভাগে আমাদের তো কিছু করেনি। শিক্ষককে করেছে মানে সমাজকেই অপদস্থ করা হয়েছে সেটি কেউ ভাবে না। এখানে তো নীরব থাকার কথা নয়। যেসব শিক্ষার্থীরা কলেজের ফ্যান নষ্ট করে ফেলেছ অর্থাৎ তাদের নিজ কলেজের সম্পদ নষ্ট করেছে তারা যে কোন সময় যে কোন কিছু নষ্ট করতে পারে। কাজেই এটিকে প্রশাসন, এলাকার নেতৃবৃন্দ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সহজভাবে না নিয়ে তাদের ডেকে উচিত শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন।
সমাজে পচন ধরা অনেক আগেই শুরু হয়েছে এখন তার চরম রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি
তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, তাদের মানবিকতা, দেশপ্রেম, মমত্ববোধ এবং সততা শিখতে হবে, শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমাজের জন্য রাষ্ট্রের জন্য এবং তার চারপাশের মানুষের জন্য। এ বিষয়টিতে থেকে কাউকে ছাড় দেয়া ঠিক হবে না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের বাস কন্ডাকটরদের সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করতে। সামান্য কারণে তারা এসব ঘটায়। তারা মনেই করে না যে, তাদের প্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তাটুকুতেই তারা চলতে পারবে না। তাদের এর বাইরে অবশ্যই যেতে হবে। অথচ কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে চলাচল করা ট্রান্সপোর্টগুলোকে ঘন ঘন সামান্য কারণে কিংবা কোন উল্লেখযোগ্য কারণ ছাড়াই আক্রমণ করে, হেল্পার, কন্ডাকটরদের মারধর করে, গাড়ি ভেঙে ফেলে। তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এটি বোঝানোর জন্য শক্তি প্রদর্শন করে, কখনও তারা উদারতা কিংব উদাহরণ দেয়ার মতো কোন আচরণ করে না। এ ধরনের কাজ তারা হরহামেশাই করছে। বাসের ড্রাইভার-হেল্পারদের সঙ্গে মারমারি করে এসে অধ্যক্ষ কিংবা ভিসিদের আক্রমণ করে তাদের পক্ষে কাজ করার জন্য, কথা বলার জন্য সহিংসপথে আন্দোলন শুরু করে। এই যেন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিরচেনা চিত্র। এ চিত্রকে পাল্টাতে হবে তা না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যকারিতা পুরোটাই হারিয়ে ফেলবে এবং সমাজ আরও গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবে। এই দায়িত্বটুকু আমাদের সবাইকে পালন করতে হবে।
[লেখক : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স
অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ]