alt

উপ-সম্পাদকীয়

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিতর্ক কেন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩

আগামী বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কয়েকটি শ্রেণীতে একটি নতুন কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসছে বিধায় তা নিয়ে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আমার এককালের সহকর্মী শেখ আজিজুল হক এবং জহুরুল ইসলামের অনুরোধে এই বিষয়ে লেখার গরজ বোধ করছি। মুখস্থনির্ভর শিক্ষাপদ্ধতির স্থলে সৃজনশীল শিক্ষাক্রম চালু করার অভিপ্রায়ে নতুন কারিকুলামের প্রবর্তন। ক্লাসে ভয়ভীতি দূর করে আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করাও এই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য।

নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত বার্ষিক পরীক্ষার চেয়ে শিখনকালীন ব্যবহারিক জ্ঞান ও ক্লাসে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।নতুন শিক্ষাক্রমে নার্সারি ও প্লে শ্রেণীতে কোন বই থাকবে না, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা তাদের সরাসরি শেখাবেন। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে থাকবে তিনটি করে বই, কিন্তু কোন বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তে হবে আটটি করে বই এবং ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত থাকবে দশটি করে সাবজেক্ট। চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখতে শিখতে ক্লাসে মূল্যায়ন করা হবে ৬০ শতাংশ, বাকি ৪০ শতাংশ হবে আগের মতো বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যেমে। ওই ৪টি সাবজেক্ট ব্যতীত বাকি সাবজেক্টগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা হবে না, হবে ক্লাসে ধারাবাহিক মূল্যায়ন, প্রতিদিন ক্লাসে যাচাই করা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা অভিন্ন সিলেবাসে পড়বে। অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগ থাকবে না। এই বিভাজন থাকবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে, একাদশ শ্রেণীতে শিক্ষার্থী তাদের পছন্দ অনুযায়ী বিজ্ঞান, বাণিজ্য বা মানবিকের যে কোন একটি বিভাগে পড়ার সুযোগ পাবে। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায়ও পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী নবম ও দশম শ্রেণীর জন্য আলাদা আলাদা বই থাকবে, নবম শ্রেণীর পাঠ্যসূচি নবম শ্রেণীতে পরীক্ষা নিয়ে পরিসমাপ্তি টানা হবে এবং শুধু দশম শ্রেণীর বই ও পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হবে, বর্তমানের মতো নবম শ্রেণীর পাঠ্যসূচি এসএসসি পরীক্ষায় আর থাকবে না।

এইচএসসিতেও দুই বছরের একটি পাবলিক পরীক্ষার পরিবর্তে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে এবং এই দুই পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হবে। বর্তমানে শিক্ষার্থীর চেয়ে বইয়ের ওজন বেশি। নার্সারি ও প্লেতে বই উঠিয়ে দেয়া সঠিক হয়েছে, তিন-চার বছরের শিশুকে বই পড়তে হবে কেন, তারা স্কুলে আসবে, খেলবে, খেলতে খেলতে বর্ণমালা শিখবে। বর্তমান পদ্ধতিতে স্কুলে আসার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনা ও পরীক্ষার ভীতি সৃষ্টি করা হয় যা যথার্থ নয়। তাই তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা বাদ দেয়াতে শিশুদের স্কুলে আসার আগ্রহ নষ্ট হবে না। তবে বার্ষিক পরীক্ষা বাদ দেয়া হলেও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে বছরব্যাপী ধারাবাহিকভাবে। পরবর্তী শ্রেণীগুলোতেও বার্ষিক পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব কমানো সঠিক হয়েছে, মুখস্থ করে বছরের শেষে একবার পরীক্ষা দেয়ার চেয়ে সারা বছর ক্লাসে ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষা নেয়া হলে তাতে শিক্ষার গুণগত মান বাড়বে।

মুখস্থবিদ্যায় নতুন সৃষ্টির সুযোগ না থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীরা চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, তাই আমাদের কোন উদ্ভাবন নেই, নেই কোন আবিষ্কার। পনের বছর আগে লন্ডনে গিয়ে আমি অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক পড়াশোনার নজির দেখেছি। আমার নাতি আজমাইন জারিফ নির্ঝর তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তার অ্যাসাইনমেন্টের বিষয় ছিল, ‘জেরুজালেম কেন ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলামানদের পবিত্র ভূমি’। তার পাঠ্যবইতে এই বিষয়টি ছিল না, তাকে ইন্টারনেট থেকে তথ্য খুঁজে নিয়ে উত্তর তৈরি করতে হয়েছে। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার পর ক্লাসে তা নির্ঝরকে শিক্ষকের মতো উপস্থাপন করতে হয়েছে, তার উপস্থাপিত অ্যাসাইনমেন্টের ওপর বাকি শিক্ষার্থী ও ক্লাস শিক্ষক প্রশ্ন করেছেন। নির্ঝর লন্ডনের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক্তার হয়েছে।

আমাদের দেশে থিসিস লিখতে হয় পিএইচডি করতে, অন্যথায় নতুন কোন বিষয়ে ১০ পৃষ্ঠার একটি থিসিসধর্মী বিশ্লেষণ কোন শিক্ষার্থীকে করতে হয় না। নতুন কারিকুলামে সব শিক্ষার্থীকে নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট লিখে তা ক্লাসে উপস্থাপন করতে হবে। নতুন কারিকুলামে এমন আরও কী আছে যার বাস্তবায়ন রোধে কিছু অভিভাবক রাস্তায় নেমে এসেছেন? বার্ষিক পরীক্ষার গুরুত্ব কমে যাওয়াতে অভিভাবকেরা শঙ্কিত। তাদের ধারণা, নতুন শিক্ষাক্রমে ছাত্র-ছাত্রীরা অজ্ঞ থেকে যাবে, কিছুই শিখন হবে না। তারা দেখছেন, এইচএসসি পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বা চাকরি পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের কয়েক লাখ এমসিকিউ প্রশ্ন মুখস্থ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই বিসিএসর জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়, সব মুখস্থ। অভিভাবকদের তাই শঙ্কা কাটে না।

এছাড়া আরও সমস্যা আছে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের হাতে বেশি নম্বর থাকায় শিক্ষার্থীদের পরাধীনতা বেড়ে যাবে। অসৎ শিক্ষকদের নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য প্রাইভেট পড়ার হিড়িক পড়ে যাবে। আমি শুধু শিক্ষক ছিলাম না, কয়েকটি স্কুল পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তও ছিলাম। কিছু শিক্ষক আছেন যারা স্টেজে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে বই থেকে পড়া শুনিয়ে পাঠদান শেষ করেন। কিছু শিক্ষক আছেন যাদের জ্ঞান খুবই সীমিত, প্রশ্ন করলে রেগে যান। আবার কিছু শিক্ষক আছেন যাদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে নম্বর কম দেন।

কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্য শিক্ষার্থীরা অনেক শিক্ষককে যমের মতো ভয় করে, কিছু শিক্ষক তা আবার উপভোগও করেন। শিক্ষকের স্বৈরাচারী আচরণ রোধে নতুন কারিকুলামে কোন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব উদ্ভট ভিডিও দেখছি তাতে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মশারি টাঙানো, বিছানায় চাদর পাতা, রান্না করার জন্য বাসা থেকে শিক্ষার্থীদের মশারি, বিছানা চাদর, বালিশ আর হান্ডিপাতিল নিয়ে স্কুলে প্রবেশের দৃশ্য দৃষ্টিকটু। তবে সর্বাধিক প্রচারিত ‘টিলিং টিলিং সাইক্লিং’ ভিডিওটি নাকি ভারতের আসাম প্রদেশের। হাঁসের ডাক, ব্যাঙের লাফ ইত্যাদি নাকি ‘কাব স্কাউট ইউনিট লিডার বেসিক কোর্স’-এর প্রশিক্ষণের অংশ। গানের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের নাচের ভিডিওটি নাকি একজন শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠানের মহড়ার দৃশ্য।

ধর্মকেও নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, এমন একটি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের যা শেখানো হয়নি, যেগুলো নতুন কারিকুলামের অংশ নয়, ক্লাসের অংশ নয়, তেমন বিষয় নিয়ে নতুন ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, প্রশিক্ষণ চলাকালীন ব্রেকের সময় প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকেরা নিজেদের বিনোদনে যেসব অভিনয় করেছেন তা নতুন কারিকুলামের অংশ বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

ভালো এবং অধিকতর উপযোগী হলেও বেশির ভাগ মানুষ পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পছন্দ করে। পৃথিবীর বদল হলেও তারা বদলান না, তাদের এক কথা, আগেরটা ভালো ছিল। শিশুশিক্ষার পূর্বশর্তই হচ্ছে শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের মিশে যাওয়া, তার সমান হওয়া। রাশভারী শিক্ষকের যে ভাবমূর্তি আমাদের মনে গেঁথে আছে তাতে আঘাত হেনেছে নতুন কারিকুলাম। তোতাপাখির মতো মুখস্থ করে গৎবাঁধা কিছু বুলি পরীক্ষার খাতায় উগলে দেয়ার বাইরে আমরা আর কিছু চিন্তা করতে পারছি না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কোচিং সেন্টার এবং গাইড বইয়ের প্রকাশকরা- তারা নিজেদের স্বার্থে অভিভাবকদের প্ররোচিত করেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া কোচিং সেন্টারের কয়েকজন মালিক তাদের অপকর্মের কথা স্বীকারও করেছেন।

নতুন কারিকুলামে এমন আরও কী আছে যার বাস্তবায়ন রোধে কিছু অভিভাবক রাস্তায় নেমে এসেছেন?

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য মাঠ প্রস্তুত নেই বলে অনেকে অভিযোগ করছেন। মাঠ প্রস্তুত করে নামার পরিকল্পনা করা হলে শিক্ষাক্ষেত্রে ইহকালেও পরিবর্তন আসবে না। কারণ সাঁতার শেখানোর জন্য প্রতিটি স্কুলে একটি করে সুইমিংপুল তৈরি করা বা সব শিক্ষককে নতুন কারিকুলামের উপযোগী করে গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। নতুন কারিকুলামের ওপর ইতোমধ্যে বহু শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যে কোন কিছুর শুরুতে কিছু সমস্যা থাকে, সমস্যার অজুহাত দিয়ে শুরু করা না হলে আমাদের গতি হবে লাটিমের মতো বৃত্তাকার।

নতুন শিক্ষাক্রম ধাপে ধাপে প্রবর্তন করা হবে বিধায় মাঠ পর্যায়ে ঘাটতি থাকলে তা ক্রমান্বয়ে পূর্ণ হয়ে যাবে। ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণী; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণী, অষ্টম ও নবম শ্রেণী। ২০২৫ সনে পঞ্চম ও দশম শ্রেণী, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণী নতুন কারিকুলামে যুক্ত হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে আটশ বিশেষজ্ঞের সংশ্লিষ্টতায় এই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক একটি শিক্ষা কারিকুলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলাতে না পারলে আমাদের অগ্রগতি এক সময় রুদ্ধ হয়ে যাবে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল]

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন

ধনিক শ্রেণীর চলমান সংকট

ছবি

বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য এবং আমাদের প্রান্তিক মানুষ

বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে ওষুধের ব্যবহার

শুভ বড়দিন

উগান্ডায় নতুন ভাইরাস ডিঙ্গা ডিঙ্গা

পরিবেশবান্ধব ঢাকা চাই

বনভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন

ছবি

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা : ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সৃষ্টির প্রথম ভ্রুণ

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভূমিকা

প্রগতিতে অগ্রগতি

পরিবারতন্ত্র ও পরিবারতত্ত্ব : উত্তরণের উপায়

উপেক্ষিত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা

সরিষার তেল গবেষণায় সাফল্য

সিরিয়ায় রাজনৈতিক পালাবদল : কার লাভ, কার ক্ষতি?

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিতর্ক কেন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩

আগামী বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কয়েকটি শ্রেণীতে একটি নতুন কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসছে বিধায় তা নিয়ে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আমার এককালের সহকর্মী শেখ আজিজুল হক এবং জহুরুল ইসলামের অনুরোধে এই বিষয়ে লেখার গরজ বোধ করছি। মুখস্থনির্ভর শিক্ষাপদ্ধতির স্থলে সৃজনশীল শিক্ষাক্রম চালু করার অভিপ্রায়ে নতুন কারিকুলামের প্রবর্তন। ক্লাসে ভয়ভীতি দূর করে আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করাও এই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য।

নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত বার্ষিক পরীক্ষার চেয়ে শিখনকালীন ব্যবহারিক জ্ঞান ও ক্লাসে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।নতুন শিক্ষাক্রমে নার্সারি ও প্লে শ্রেণীতে কোন বই থাকবে না, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা তাদের সরাসরি শেখাবেন। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে থাকবে তিনটি করে বই, কিন্তু কোন বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তে হবে আটটি করে বই এবং ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত থাকবে দশটি করে সাবজেক্ট। চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখতে শিখতে ক্লাসে মূল্যায়ন করা হবে ৬০ শতাংশ, বাকি ৪০ শতাংশ হবে আগের মতো বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যেমে। ওই ৪টি সাবজেক্ট ব্যতীত বাকি সাবজেক্টগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা হবে না, হবে ক্লাসে ধারাবাহিক মূল্যায়ন, প্রতিদিন ক্লাসে যাচাই করা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা অভিন্ন সিলেবাসে পড়বে। অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগ থাকবে না। এই বিভাজন থাকবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে, একাদশ শ্রেণীতে শিক্ষার্থী তাদের পছন্দ অনুযায়ী বিজ্ঞান, বাণিজ্য বা মানবিকের যে কোন একটি বিভাগে পড়ার সুযোগ পাবে। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায়ও পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী নবম ও দশম শ্রেণীর জন্য আলাদা আলাদা বই থাকবে, নবম শ্রেণীর পাঠ্যসূচি নবম শ্রেণীতে পরীক্ষা নিয়ে পরিসমাপ্তি টানা হবে এবং শুধু দশম শ্রেণীর বই ও পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হবে, বর্তমানের মতো নবম শ্রেণীর পাঠ্যসূচি এসএসসি পরীক্ষায় আর থাকবে না।

এইচএসসিতেও দুই বছরের একটি পাবলিক পরীক্ষার পরিবর্তে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে এবং এই দুই পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হবে। বর্তমানে শিক্ষার্থীর চেয়ে বইয়ের ওজন বেশি। নার্সারি ও প্লেতে বই উঠিয়ে দেয়া সঠিক হয়েছে, তিন-চার বছরের শিশুকে বই পড়তে হবে কেন, তারা স্কুলে আসবে, খেলবে, খেলতে খেলতে বর্ণমালা শিখবে। বর্তমান পদ্ধতিতে স্কুলে আসার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনা ও পরীক্ষার ভীতি সৃষ্টি করা হয় যা যথার্থ নয়। তাই তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা বাদ দেয়াতে শিশুদের স্কুলে আসার আগ্রহ নষ্ট হবে না। তবে বার্ষিক পরীক্ষা বাদ দেয়া হলেও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে বছরব্যাপী ধারাবাহিকভাবে। পরবর্তী শ্রেণীগুলোতেও বার্ষিক পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব কমানো সঠিক হয়েছে, মুখস্থ করে বছরের শেষে একবার পরীক্ষা দেয়ার চেয়ে সারা বছর ক্লাসে ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষা নেয়া হলে তাতে শিক্ষার গুণগত মান বাড়বে।

মুখস্থবিদ্যায় নতুন সৃষ্টির সুযোগ না থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীরা চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, তাই আমাদের কোন উদ্ভাবন নেই, নেই কোন আবিষ্কার। পনের বছর আগে লন্ডনে গিয়ে আমি অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক পড়াশোনার নজির দেখেছি। আমার নাতি আজমাইন জারিফ নির্ঝর তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তার অ্যাসাইনমেন্টের বিষয় ছিল, ‘জেরুজালেম কেন ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলামানদের পবিত্র ভূমি’। তার পাঠ্যবইতে এই বিষয়টি ছিল না, তাকে ইন্টারনেট থেকে তথ্য খুঁজে নিয়ে উত্তর তৈরি করতে হয়েছে। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার পর ক্লাসে তা নির্ঝরকে শিক্ষকের মতো উপস্থাপন করতে হয়েছে, তার উপস্থাপিত অ্যাসাইনমেন্টের ওপর বাকি শিক্ষার্থী ও ক্লাস শিক্ষক প্রশ্ন করেছেন। নির্ঝর লন্ডনের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক্তার হয়েছে।

আমাদের দেশে থিসিস লিখতে হয় পিএইচডি করতে, অন্যথায় নতুন কোন বিষয়ে ১০ পৃষ্ঠার একটি থিসিসধর্মী বিশ্লেষণ কোন শিক্ষার্থীকে করতে হয় না। নতুন কারিকুলামে সব শিক্ষার্থীকে নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট লিখে তা ক্লাসে উপস্থাপন করতে হবে। নতুন কারিকুলামে এমন আরও কী আছে যার বাস্তবায়ন রোধে কিছু অভিভাবক রাস্তায় নেমে এসেছেন? বার্ষিক পরীক্ষার গুরুত্ব কমে যাওয়াতে অভিভাবকেরা শঙ্কিত। তাদের ধারণা, নতুন শিক্ষাক্রমে ছাত্র-ছাত্রীরা অজ্ঞ থেকে যাবে, কিছুই শিখন হবে না। তারা দেখছেন, এইচএসসি পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বা চাকরি পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের কয়েক লাখ এমসিকিউ প্রশ্ন মুখস্থ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই বিসিএসর জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়, সব মুখস্থ। অভিভাবকদের তাই শঙ্কা কাটে না।

এছাড়া আরও সমস্যা আছে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের হাতে বেশি নম্বর থাকায় শিক্ষার্থীদের পরাধীনতা বেড়ে যাবে। অসৎ শিক্ষকদের নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য প্রাইভেট পড়ার হিড়িক পড়ে যাবে। আমি শুধু শিক্ষক ছিলাম না, কয়েকটি স্কুল পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তও ছিলাম। কিছু শিক্ষক আছেন যারা স্টেজে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে বই থেকে পড়া শুনিয়ে পাঠদান শেষ করেন। কিছু শিক্ষক আছেন যাদের জ্ঞান খুবই সীমিত, প্রশ্ন করলে রেগে যান। আবার কিছু শিক্ষক আছেন যাদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে নম্বর কম দেন।

কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্য শিক্ষার্থীরা অনেক শিক্ষককে যমের মতো ভয় করে, কিছু শিক্ষক তা আবার উপভোগও করেন। শিক্ষকের স্বৈরাচারী আচরণ রোধে নতুন কারিকুলামে কোন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব উদ্ভট ভিডিও দেখছি তাতে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মশারি টাঙানো, বিছানায় চাদর পাতা, রান্না করার জন্য বাসা থেকে শিক্ষার্থীদের মশারি, বিছানা চাদর, বালিশ আর হান্ডিপাতিল নিয়ে স্কুলে প্রবেশের দৃশ্য দৃষ্টিকটু। তবে সর্বাধিক প্রচারিত ‘টিলিং টিলিং সাইক্লিং’ ভিডিওটি নাকি ভারতের আসাম প্রদেশের। হাঁসের ডাক, ব্যাঙের লাফ ইত্যাদি নাকি ‘কাব স্কাউট ইউনিট লিডার বেসিক কোর্স’-এর প্রশিক্ষণের অংশ। গানের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের নাচের ভিডিওটি নাকি একজন শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠানের মহড়ার দৃশ্য।

ধর্মকেও নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, এমন একটি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের যা শেখানো হয়নি, যেগুলো নতুন কারিকুলামের অংশ নয়, ক্লাসের অংশ নয়, তেমন বিষয় নিয়ে নতুন ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, প্রশিক্ষণ চলাকালীন ব্রেকের সময় প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকেরা নিজেদের বিনোদনে যেসব অভিনয় করেছেন তা নতুন কারিকুলামের অংশ বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

ভালো এবং অধিকতর উপযোগী হলেও বেশির ভাগ মানুষ পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পছন্দ করে। পৃথিবীর বদল হলেও তারা বদলান না, তাদের এক কথা, আগেরটা ভালো ছিল। শিশুশিক্ষার পূর্বশর্তই হচ্ছে শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের মিশে যাওয়া, তার সমান হওয়া। রাশভারী শিক্ষকের যে ভাবমূর্তি আমাদের মনে গেঁথে আছে তাতে আঘাত হেনেছে নতুন কারিকুলাম। তোতাপাখির মতো মুখস্থ করে গৎবাঁধা কিছু বুলি পরীক্ষার খাতায় উগলে দেয়ার বাইরে আমরা আর কিছু চিন্তা করতে পারছি না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কোচিং সেন্টার এবং গাইড বইয়ের প্রকাশকরা- তারা নিজেদের স্বার্থে অভিভাবকদের প্ররোচিত করেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া কোচিং সেন্টারের কয়েকজন মালিক তাদের অপকর্মের কথা স্বীকারও করেছেন।

নতুন কারিকুলামে এমন আরও কী আছে যার বাস্তবায়ন রোধে কিছু অভিভাবক রাস্তায় নেমে এসেছেন?

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য মাঠ প্রস্তুত নেই বলে অনেকে অভিযোগ করছেন। মাঠ প্রস্তুত করে নামার পরিকল্পনা করা হলে শিক্ষাক্ষেত্রে ইহকালেও পরিবর্তন আসবে না। কারণ সাঁতার শেখানোর জন্য প্রতিটি স্কুলে একটি করে সুইমিংপুল তৈরি করা বা সব শিক্ষককে নতুন কারিকুলামের উপযোগী করে গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। নতুন কারিকুলামের ওপর ইতোমধ্যে বহু শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যে কোন কিছুর শুরুতে কিছু সমস্যা থাকে, সমস্যার অজুহাত দিয়ে শুরু করা না হলে আমাদের গতি হবে লাটিমের মতো বৃত্তাকার।

নতুন শিক্ষাক্রম ধাপে ধাপে প্রবর্তন করা হবে বিধায় মাঠ পর্যায়ে ঘাটতি থাকলে তা ক্রমান্বয়ে পূর্ণ হয়ে যাবে। ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণী; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণী, অষ্টম ও নবম শ্রেণী। ২০২৫ সনে পঞ্চম ও দশম শ্রেণী, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণী নতুন কারিকুলামে যুক্ত হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে আটশ বিশেষজ্ঞের সংশ্লিষ্টতায় এই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক একটি শিক্ষা কারিকুলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলাতে না পারলে আমাদের অগ্রগতি এক সময় রুদ্ধ হয়ে যাবে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল]

back to top