alt

উপ-সম্পাদকীয়

দুর্নীতিবাজদের খতম করা যাবে কি?

হাবিবুর রহমান স্বপন

: রোববার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

দুর্নীতিই যে আমাদের দুঃখের কারণ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য যখন তিনি আপ্রাণ চেষ্টারতÑ তখন কিছু ব্যক্তি দুর্নীতি করে অর্থ-বিত্তবান হচ্ছিল। স্বাধীনতার পর পল্টনে এক জনসভায় ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারি তা হলে শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ বাংলার মানুষের চলে যাবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও বলেছিলেন, ‘জনগণের সাহায্য ছাড়া সরকারি আইন করে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়’। তিনি ওই ভাষণে আরও বলেছিলেন, ‘এক নম্বর কাজ হবে দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। আইন চালাব, ক্ষমা করব না, যাকে পাব ছাড়ব না। যে ঘুষখোর, মুনাফাখোর, যে আমার দেশের সম্পদ বিদেশে চালান দেয়, তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। গ্রামে গ্রামে আন্দোলন করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি রোধ করতে কে পারে? পারে যুবকরা, ছাত্র ভাইরা, বুদ্ধিজীবীরা পারে, পারে কে? জনগণ পারে, দুর্নীতিবাজদের খতম করো। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করো।’ স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য যখন বঙ্গবন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রম করছিলেন, তখন একদল সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্ত অবৈধ সম্পদ অর্জনের নোংরা প্রতিযোগিতায় লেগে পড়ে। এই সুযোগসন্ধানীদের দলে ছিল নানা পেশার লোক। ছিল ব্যবসায়ী, চাকরীজীবীসহ রাজনীতিবিদরাও। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতি রোধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু কথায় বলে, ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।’ দুর্নীতি চলতে থাকে। তখনই শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারসহ চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। আইনশৃঙ্খলা যখন ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিক হচ্ছিল এবং দ্রব্য মূল্যও নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল এমন সময় ষড়যন্ত্রকারী চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপিরবারে হত্যা করে। হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে। দুর্নীতির রকম-ফের আছে। বলা হয় সহনীয় ও অসহনীয় বা ভয়াবহ দুর্নীতি (যেমন গরম পানি বা ঠা-া পানি, সহনীয় ও অসহনীয় আছে)। বর্তমানে দুর্নীতি চলছে অসহনীয় পর্যায়ে। লাগামহীন দুর্নীতির ঘোড়া। চলছে তো চলছেই। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি! বঙ্গবন্ধুর কথাটি এখনও পুরোপুরি সত্য পথেই চলছে। দুর্নীতি করছে শিক্ষিতজনরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে অফিসের কেরানি পর্যন্ত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, রেজিস্ট্রার; সচিব, বন কর্মকর্তা, ভূমি অফিসার, ব্যাংক কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার সবাইই দুর্নীতির দায়ে মামলার আসামি। সর্ষের মধ্যেই ভূত! দুর্নীতি দমন বিভাগের বড় কর্তা দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত, তার বিরুদ্ধে চলছে দুর্নীতির মামলা! রক্ষক পুলিশ-র‌্যাব, ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, মেয়র, চেয়ারম্যানরা দুর্নীতির দায়ে জেলে! বহু রাজনীতিবিদ দুর্নীতি করে অর্থ-বিত্তবান হয়েছেন। শুধু কি তাই! দুর্নীতি করে আয় করা কোটি কেটি অবৈধ টাকা তারা বিদেশে পাচার করছেন। বিদেশে বাড়ি-ঘর করছেন। সন্তানদের বিদেশে পড়াচ্ছেন। দুর্নীতিবাজরা এখন এই দেশে ‘ভি আই পি’! প্রায় সতেরো কোটি মানুষের বাংলাদেশ। প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করেন। এর বেশির ভাগই শ্রমিক। এই খেটে খাওয়া শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে। যখন সমগ্র বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি চরমে, তখন বাংলাদেশের রিজার্ভ তহবিল মজবুত ছিল। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা ডলার, পাউন্ড, ইউরো, দিনার, রিয়াল, রিংগিত ইত্যাদি পাঠাচ্ছেন। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল স্ফিত হচ্ছিল, কিন্তু এখন তাতে ধস নামছে। পাশাপাশি অসৎ রাজনীতিবিদ, বড় অফিসার বা শিক্ষিতজনদের নিজস্ব তহবিল স্ফিত হচ্ছে, তারা বিদেশে অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) করছেন। আমাদের প্রবৃদ্ধি যেখানে হওয়ার কথা নয় শতাংশেরও উপরে সেখানে হচ্ছে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। কষ্টার্জিত ফসল বা সাফল্য ইঁদুরে খাচ্ছে! জনগণের টাকায় তৈরি সড়ক মহাসড়ক, ইমারত তৈরি করা হচ্ছে; তার মান খুবই খারাপ। সড়ক তৈরি বা সংস্কার করার কিছুদিনের মধ্যেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। স্কুল-কলেজের ইমারত থেকে শুরু করে সব সরকারি উন্নয়ন হচ্ছে নি¤œমানের। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযের নির্মাণাধীন একটি ইমারতের বিরাট অংশ ভেঙে পড়েছে। সরকারি অর্থ বা জনগণের অর্থের সিংহভাগ যাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার ও ঠিকাদারের পকেটে। সেই চুরির টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। জনদুর্ভোগ সর্বত্র। দেশ-জাতি গোল্লায় যাক তাতে কী, চোর অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের তো বাড়ি-গাড়ি হচ্ছে! চোর এবং চুরিই বাংলার মানুষের দুঃখের কারণ। এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তিনি বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পাই চোরের খনি’। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে পারে যুবকরা, ছাত্ররা, বুদ্ধিজীবীরা এবং জনগণ। তিনি সবাইকে দুর্নীতি প্রতিরোধে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সময়ে যুবক, ছাত্র ও এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর ভরসা করেছিলেন, সেখানেও এখন ভয়াবহ হতাশাজনক অবস্থা। দোর্দ- প্রতাপ এখন দুর্নীতিবাজ মুনাফাখোরদের। রাতারাতি চাল-ডাল, চিনি-তেলসহ সব প্রকার পণ্য মূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফ লুটছে মজুতদার-মুনাফাখোররা। বঙ্গবন্ধুর সময়েও ছাত্ররা, যুবকরা এবং বুদ্ধিজীবীরা বেশ সৎ ছিলেন। যেহেতু তারা সৎ ছিলেন তাই তাদের সাহসও ছিল (নৈতিক বল)। এখন এই শ্রেণীসমূহের মধ্যে সততার বেশ সংকট চলছে। জনতা নিরীহ। তারা সৎ নেতৃত্বের সংকটে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। তাই জনতার প্রতিও ভরসা করা যায় না। নেতারা বেশির ভাগই নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। রাষ্ট্রীয় বা জনগণের সম্পদ লুটে-পুটে একেকজন নেতা রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। তাদের প্রতি জনগণ ভরসা করতে ভয় পায়। হায়রে অভাগা দেশ! আরও অভাগা এই দেশের জনগণ। যে দেশ স্বাধীন হলো কোটি মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে। লাখ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম ও লাখ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশে চলছে দুর্নীতির হোলি খেলা! এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করা যায় তাহলে বাংলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে যাবে। এখনও বঙ্গবন্ধুর উক্তিটি সমভাবে সত্য। কিন্তু কে বাঁধবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা? কম্বলের লোম বছতে গেলে যে কম্বলটাই নাই হয়ে যাবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ঘুষ নিয়ে শিক্ষক কর্মচারীকে চাকরি দেন। কলেজের অধ্যক্ষ দুর্নীতির দায়ে জেলহাজতে! পুলিশের সিপাহির চাকরি নিতে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ গুণতে হয়। ঘুষ ছাড়া পিওন-কেরানি-অফিসারের চাকরি হয় না। সরকারি খাসজমি, অর্পিত-অনাগরিক সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে যায়, নদী-খাল-বিল সবই দখল করে নেয় প্রভাবশালীরা। নদীর পাথর, বালু উঠিয়ে বিক্রি করে নেতারা! ব্যাংকের টাকা নিমিষে লুট হয়ে যায়। শেয়ারবাজার লুটেরা দিব্বি দাপটে চলে। দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য যে কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় সে নিজেই দুর্নীতি করে কোটিপতি হয়! শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, আইনশৃঙ্খলা সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির মহচ্ছপ। এই হচ্ছে যখন দেশের চিত্র তখন আমরা কি করতে পারি? আমাদের করণীয় কি? কে দেখাবেন আমাদের আদর্শের পথ? কিভাবে দেশ ও জাতীর কল্যাণ হবে? দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ এর ডাক দিয়ে সামরিক জান্তারা দুর্নীতি নামক বৃক্ষটির শাখা বিস্তার করেছেন। এখন সেই বৃক্ষ আরও প্রশাখা বিস্তার করে মহিরুহে পরিণত হয়েছে। বিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করা দুর্নীতি নামক বৃক্ষের তলায় এখন আর ফসল ফলে না। অনুর্বর! সব রস শোষণ করে নিচ্ছে দুর্নীতি বৃক্ষ। এখন আর দুনীতিগ্রস্ত সমাজে ভালো যুবক জন্মে না, আদর্শ ছাত্র নেতা জন্মে না, ভালো বুদ্ধিজীবী জন্ম নেয় না। ভালো জনতাও আর মাথা উঠিয়ে দাঁড়াতে পারে না। বট তলায় যেমন অন্য কোন গাছ জন্ম নেয় না। এমনকি ঘাসও হয় না। তেমনই অবস্থা! ভালো বা আদর্শ শিক্ষক নেই তাই আদর্শ ছাত্র নেই, ভালো রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, মেয়র, চেয়ারম্যান বা জনপ্রতিনিধি নেই তাই আদর্শ ছাত্র ও যুবক-জনতা নেই। ভালো পিতার অভাব তাই আদর্শ সন্তান বা ভালো মানুষের অভাব। যারা ভালো আছেন, তারা এখন সংখ্যালঘু। আগে খারাপ নেতার চেয়ে ভালো নেতার পরিমাণ ছিল বেশি, এখন হয়েছে উল্টোটা, অর্থাৎ এখন খারাপ নেতা বেশি, ভালো নেতার পরিমাণ কম। ছাত্রনেতা নাই বললেই চলে। বছরের পর বছর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। অতএব ছাত্রনেতা তৈরি হয় না। পথ রুদ্ধ। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী সবার মধ্যেই বাণিজ্যিক ভাবনা। সবকিছুতেই বাণিজ্য। রাজনীতিবিদ পুঁজি বিনিয়োগ করছেন ভোটের জন্য, নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুঁজিসহ লাভ বহুগুণ উঠিয়ে নিতে তিনি তৎপর। শিক্ষক শিক্ষা প্রদানের চেয়ে শিক্ষা বিক্রির দোকান খুলে বসেছেন। ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট পড়াতে বেশি মনোযোগী, চিকিৎসক জনসেবার ব্রত নিয়ে পড়ার অঙ্গীকার করে কসাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ। বুদ্ধিজীবীরা তো বুদ্ধির দোকান খুলে বসেছেন। সাধারণ নাগরিক এক অটোরিকশা চালক আব্দুল কদ্দুস কদিন আগে আফসোস করে বললেন, ‘সবচেয়ে ভালো ছাত্ররা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা হয়ে কর্মজীবনে সব চেয়ে নিকৃষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম করে সম্পদ করছেন। রাষ্ট্র বা জনগণের টাকা লুটপাটে মত্ত হচ্ছেন! আর আমরা তাদের অভিভাবক, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা বলছি ‘অমুকের ছেলে-মেয়ে মানুষ হয়ে গেছে’। প্রকৃত পক্ষে সে মানুষ চেহারার পশু হয়েছে।’ রাজশাহী শহরের বড় বাজারের (সাহেব বাজার) এক দোকানির সঙ্গে কথা বলছিলাম, দোকানদার আজাদ হোসেন বললেন, ‘স্যার, জঙ্গলে সুন্দর প্রাণী হরিণ, নিরীহ প্রাণী মহিষ, নিকৃষ্ট শুকর, হিং¯্র বাঘ বসবাস করে। সেখানে সবাইই বনের পশু। ভালো-মন্দ সবই সমান। পশু নামে পরিচিত। আমাদের এই সমাজে বর্তমানে একই অবস্থা, সবাইই মানুষ নামে পরিচিত। কিন্তু সবই পশু তুল্য। পশু যেমন একে অপরকে ঘাড় মটকে ক্ষুধা নিবারণ করে এই সমাজেও একইভাবে মানুষ মানুষের ঘাড় মটকে খাচ্ছে।’ সাধারণ মানুষ এখনও অনেক সহজ-সরল বা ভালো। বঙ্গবন্ধু এজন্যই বোধকরি বলেছিলেন, ‘আমার কৃষক দুর্নীতি করে না, আমার শ্রমিক দুর্নীতি করে না’। আসলেই তাই এখনও কৃষক তার মাথার ঘাম পায়ে দলে ফসল ফলায়, শ্রমিক তার শ্রমে-ঘামে সংসার চালায়। আর জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দামি গাড়িতে চড়ে সাহেবেরা অবৈধ পন্থায় নিজের সম্পদ বাড়ায়! এই উপমহাদেশে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘চোরের মার বড় গলা’। এখন এই কথাটি পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন হয়েছে, ‘চোরের বড় গলা’। যে যত বড় দুর্নীতিবাজ সে তত বড় সমাজপতি। দুর্নীতি করে দুর্নীতিবাজ নেতা এদেশে বুক ফুলিয়ে চলে। দুর্নীতিবাজ অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, বিত্তবান ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু ও বালুমহাল লুটেরাকে সবাইই সমীহ করে। মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুলিশ ঘুষ নেয়। লুটের টাকা বিলিয়ে দুষ্কর্মকারীরা প্রশাসনের সাহেবদের কাছে প্রিয়ভাজন হয়। গরিব নিরীহ মানুষকে ঠকিয়ে, দরিদ্র কৃষককে বেকায়দায় ফেলে অর্থ-সম্পদ করে সুখের ঠিকানা খোঁজে অসৎ রাজনীতিবিদ! বুদ্ধিজীবী নামের সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক-অধ্যাপকরা হয়তো চুপচাপ, নয়তো দুর্নীতিবাজের দোসর! চলছে দুর্নীতির লাগামহীন ঘোড়া। এই পাগলা ঘোড়াকে থামাতে না পারলে আমাদের পরিণতি যে মন্দ হতে হতে রসাতলে যাবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। দেশ-জাতি ও সমাজের অধঃপতন রোধে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে অন্যথায় সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন কোন দিনও বাস্তবায়ন হবে না। এই দেশ অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তখন আর কারও রক্ষা পাওয়ার পথ থাকবে না। আমরা প্রায় সবাইই হয় দুর্নীতি করছি অথবা দুর্নীতিবাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছি। অন্যায়কারীর দলভুক্ত হচ্ছি আমরা যারা অন্যায় সয়ে চুপচাপ আছি। সবাইই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হচ্ছি। বাঁচতে হলে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সবাইকে দুর্নীতি প্রতিরোধে একাট্টা হতে হবে। তবেই রক্ষা, তাতেই শান্তি এবং উন্নতি।

[লেখক: সাংবাদিক]

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস : জোর দিতে হবে প্রতিরোধে

ঋণ ব্যবস্থা : তেলা মাথায় ঢালো তেল, ন্যাড়া মাথায় ভাঙো বেল

বিচারকের ওপর হামলা কেন

বৈশ্বিক নিষ্ক্রিয়তার কবলে রোহিঙ্গা ইস্যু

আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস

বৈষম্য ঘোচাতে চাই একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়

রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ

সমস্যার সূতিকাগার

ছবি

বাংলাদেশে আলু চাষে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতি

দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের পথ কী?

ব্যাংক সংস্কার : কাটবে কি অন্ধকার?

ছবি

নিত্যপণ্যের দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

রম্যগদ্য: ম্যাড় ম্যাড়ে সোনা-কাহিনী

রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগার

কেন এত ধ্বংস, কেন এত মৃত্যু

জলবায়ু সম্মেলন থেকে আমরা কী পেলাম

উচ্চশিক্ষায় মান বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ

ছবি

যানজট আর্থ-সামাজিক বিড়ম্বনাকে প্রকট করে তুলছে

যাচ্ছে দিন, বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা

ছবি

স্বপ্ন দেখতে তো ভুল নেই

ছবি

আহমদুল কবির : সাংবাদিকতা এবং রাজনীতিতে

ইতিহাসের কাছে মানুষ কী চায়?

আর্থিক সংকট কতটা গভীর

আদিবাসী নেতাদের দেখে নেয়ার হুমকি

সম্পত্তিতে এতিম নাতি-নাতনির অংশ ও বাস্তবতা

দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন তত্ত্বের শতবর্ষ

প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো বাঁচানো জরুরি

রঙ্গব্যঙ্গ : শাব্বাশ বিটিভি, জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ

নবজাগরণ : সত্যিই কি জাতি জেগেছে?

গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে

ছবি

কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া

লটারিতে ভর্তি : কবে দূর হবে সরকারি স্কুলগুলোর ‘করোনা মহামারী’?

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি খুব একটা পরিবর্তন হবে কি

অবমূল্যায়ন, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি এবং প্রাসঙ্গিক কিছু চিন্তা

মুজিব কি কেবলই ছবি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

দুর্নীতিবাজদের খতম করা যাবে কি?

হাবিবুর রহমান স্বপন

রোববার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

দুর্নীতিই যে আমাদের দুঃখের কারণ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য যখন তিনি আপ্রাণ চেষ্টারতÑ তখন কিছু ব্যক্তি দুর্নীতি করে অর্থ-বিত্তবান হচ্ছিল। স্বাধীনতার পর পল্টনে এক জনসভায় ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারি তা হলে শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ বাংলার মানুষের চলে যাবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও বলেছিলেন, ‘জনগণের সাহায্য ছাড়া সরকারি আইন করে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়’। তিনি ওই ভাষণে আরও বলেছিলেন, ‘এক নম্বর কাজ হবে দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। আইন চালাব, ক্ষমা করব না, যাকে পাব ছাড়ব না। যে ঘুষখোর, মুনাফাখোর, যে আমার দেশের সম্পদ বিদেশে চালান দেয়, তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। গ্রামে গ্রামে আন্দোলন করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি রোধ করতে কে পারে? পারে যুবকরা, ছাত্র ভাইরা, বুদ্ধিজীবীরা পারে, পারে কে? জনগণ পারে, দুর্নীতিবাজদের খতম করো। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করো।’ স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য যখন বঙ্গবন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রম করছিলেন, তখন একদল সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্ত অবৈধ সম্পদ অর্জনের নোংরা প্রতিযোগিতায় লেগে পড়ে। এই সুযোগসন্ধানীদের দলে ছিল নানা পেশার লোক। ছিল ব্যবসায়ী, চাকরীজীবীসহ রাজনীতিবিদরাও। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতি রোধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু কথায় বলে, ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।’ দুর্নীতি চলতে থাকে। তখনই শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারসহ চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। আইনশৃঙ্খলা যখন ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিক হচ্ছিল এবং দ্রব্য মূল্যও নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল এমন সময় ষড়যন্ত্রকারী চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপিরবারে হত্যা করে। হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে। দুর্নীতির রকম-ফের আছে। বলা হয় সহনীয় ও অসহনীয় বা ভয়াবহ দুর্নীতি (যেমন গরম পানি বা ঠা-া পানি, সহনীয় ও অসহনীয় আছে)। বর্তমানে দুর্নীতি চলছে অসহনীয় পর্যায়ে। লাগামহীন দুর্নীতির ঘোড়া। চলছে তো চলছেই। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি! বঙ্গবন্ধুর কথাটি এখনও পুরোপুরি সত্য পথেই চলছে। দুর্নীতি করছে শিক্ষিতজনরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে অফিসের কেরানি পর্যন্ত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, রেজিস্ট্রার; সচিব, বন কর্মকর্তা, ভূমি অফিসার, ব্যাংক কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার সবাইই দুর্নীতির দায়ে মামলার আসামি। সর্ষের মধ্যেই ভূত! দুর্নীতি দমন বিভাগের বড় কর্তা দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত, তার বিরুদ্ধে চলছে দুর্নীতির মামলা! রক্ষক পুলিশ-র‌্যাব, ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, মেয়র, চেয়ারম্যানরা দুর্নীতির দায়ে জেলে! বহু রাজনীতিবিদ দুর্নীতি করে অর্থ-বিত্তবান হয়েছেন। শুধু কি তাই! দুর্নীতি করে আয় করা কোটি কেটি অবৈধ টাকা তারা বিদেশে পাচার করছেন। বিদেশে বাড়ি-ঘর করছেন। সন্তানদের বিদেশে পড়াচ্ছেন। দুর্নীতিবাজরা এখন এই দেশে ‘ভি আই পি’! প্রায় সতেরো কোটি মানুষের বাংলাদেশ। প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করেন। এর বেশির ভাগই শ্রমিক। এই খেটে খাওয়া শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে। যখন সমগ্র বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি চরমে, তখন বাংলাদেশের রিজার্ভ তহবিল মজবুত ছিল। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা ডলার, পাউন্ড, ইউরো, দিনার, রিয়াল, রিংগিত ইত্যাদি পাঠাচ্ছেন। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল স্ফিত হচ্ছিল, কিন্তু এখন তাতে ধস নামছে। পাশাপাশি অসৎ রাজনীতিবিদ, বড় অফিসার বা শিক্ষিতজনদের নিজস্ব তহবিল স্ফিত হচ্ছে, তারা বিদেশে অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) করছেন। আমাদের প্রবৃদ্ধি যেখানে হওয়ার কথা নয় শতাংশেরও উপরে সেখানে হচ্ছে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। কষ্টার্জিত ফসল বা সাফল্য ইঁদুরে খাচ্ছে! জনগণের টাকায় তৈরি সড়ক মহাসড়ক, ইমারত তৈরি করা হচ্ছে; তার মান খুবই খারাপ। সড়ক তৈরি বা সংস্কার করার কিছুদিনের মধ্যেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। স্কুল-কলেজের ইমারত থেকে শুরু করে সব সরকারি উন্নয়ন হচ্ছে নি¤œমানের। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযের নির্মাণাধীন একটি ইমারতের বিরাট অংশ ভেঙে পড়েছে। সরকারি অর্থ বা জনগণের অর্থের সিংহভাগ যাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার ও ঠিকাদারের পকেটে। সেই চুরির টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। জনদুর্ভোগ সর্বত্র। দেশ-জাতি গোল্লায় যাক তাতে কী, চোর অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের তো বাড়ি-গাড়ি হচ্ছে! চোর এবং চুরিই বাংলার মানুষের দুঃখের কারণ। এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তিনি বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পাই চোরের খনি’। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে পারে যুবকরা, ছাত্ররা, বুদ্ধিজীবীরা এবং জনগণ। তিনি সবাইকে দুর্নীতি প্রতিরোধে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সময়ে যুবক, ছাত্র ও এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর ভরসা করেছিলেন, সেখানেও এখন ভয়াবহ হতাশাজনক অবস্থা। দোর্দ- প্রতাপ এখন দুর্নীতিবাজ মুনাফাখোরদের। রাতারাতি চাল-ডাল, চিনি-তেলসহ সব প্রকার পণ্য মূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফ লুটছে মজুতদার-মুনাফাখোররা। বঙ্গবন্ধুর সময়েও ছাত্ররা, যুবকরা এবং বুদ্ধিজীবীরা বেশ সৎ ছিলেন। যেহেতু তারা সৎ ছিলেন তাই তাদের সাহসও ছিল (নৈতিক বল)। এখন এই শ্রেণীসমূহের মধ্যে সততার বেশ সংকট চলছে। জনতা নিরীহ। তারা সৎ নেতৃত্বের সংকটে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। তাই জনতার প্রতিও ভরসা করা যায় না। নেতারা বেশির ভাগই নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। রাষ্ট্রীয় বা জনগণের সম্পদ লুটে-পুটে একেকজন নেতা রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। তাদের প্রতি জনগণ ভরসা করতে ভয় পায়। হায়রে অভাগা দেশ! আরও অভাগা এই দেশের জনগণ। যে দেশ স্বাধীন হলো কোটি মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে। লাখ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম ও লাখ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশে চলছে দুর্নীতির হোলি খেলা! এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করা যায় তাহলে বাংলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে যাবে। এখনও বঙ্গবন্ধুর উক্তিটি সমভাবে সত্য। কিন্তু কে বাঁধবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা? কম্বলের লোম বছতে গেলে যে কম্বলটাই নাই হয়ে যাবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ঘুষ নিয়ে শিক্ষক কর্মচারীকে চাকরি দেন। কলেজের অধ্যক্ষ দুর্নীতির দায়ে জেলহাজতে! পুলিশের সিপাহির চাকরি নিতে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ গুণতে হয়। ঘুষ ছাড়া পিওন-কেরানি-অফিসারের চাকরি হয় না। সরকারি খাসজমি, অর্পিত-অনাগরিক সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে যায়, নদী-খাল-বিল সবই দখল করে নেয় প্রভাবশালীরা। নদীর পাথর, বালু উঠিয়ে বিক্রি করে নেতারা! ব্যাংকের টাকা নিমিষে লুট হয়ে যায়। শেয়ারবাজার লুটেরা দিব্বি দাপটে চলে। দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য যে কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় সে নিজেই দুর্নীতি করে কোটিপতি হয়! শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, আইনশৃঙ্খলা সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির মহচ্ছপ। এই হচ্ছে যখন দেশের চিত্র তখন আমরা কি করতে পারি? আমাদের করণীয় কি? কে দেখাবেন আমাদের আদর্শের পথ? কিভাবে দেশ ও জাতীর কল্যাণ হবে? দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ এর ডাক দিয়ে সামরিক জান্তারা দুর্নীতি নামক বৃক্ষটির শাখা বিস্তার করেছেন। এখন সেই বৃক্ষ আরও প্রশাখা বিস্তার করে মহিরুহে পরিণত হয়েছে। বিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করা দুর্নীতি নামক বৃক্ষের তলায় এখন আর ফসল ফলে না। অনুর্বর! সব রস শোষণ করে নিচ্ছে দুর্নীতি বৃক্ষ। এখন আর দুনীতিগ্রস্ত সমাজে ভালো যুবক জন্মে না, আদর্শ ছাত্র নেতা জন্মে না, ভালো বুদ্ধিজীবী জন্ম নেয় না। ভালো জনতাও আর মাথা উঠিয়ে দাঁড়াতে পারে না। বট তলায় যেমন অন্য কোন গাছ জন্ম নেয় না। এমনকি ঘাসও হয় না। তেমনই অবস্থা! ভালো বা আদর্শ শিক্ষক নেই তাই আদর্শ ছাত্র নেই, ভালো রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, মেয়র, চেয়ারম্যান বা জনপ্রতিনিধি নেই তাই আদর্শ ছাত্র ও যুবক-জনতা নেই। ভালো পিতার অভাব তাই আদর্শ সন্তান বা ভালো মানুষের অভাব। যারা ভালো আছেন, তারা এখন সংখ্যালঘু। আগে খারাপ নেতার চেয়ে ভালো নেতার পরিমাণ ছিল বেশি, এখন হয়েছে উল্টোটা, অর্থাৎ এখন খারাপ নেতা বেশি, ভালো নেতার পরিমাণ কম। ছাত্রনেতা নাই বললেই চলে। বছরের পর বছর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। অতএব ছাত্রনেতা তৈরি হয় না। পথ রুদ্ধ। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী সবার মধ্যেই বাণিজ্যিক ভাবনা। সবকিছুতেই বাণিজ্য। রাজনীতিবিদ পুঁজি বিনিয়োগ করছেন ভোটের জন্য, নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুঁজিসহ লাভ বহুগুণ উঠিয়ে নিতে তিনি তৎপর। শিক্ষক শিক্ষা প্রদানের চেয়ে শিক্ষা বিক্রির দোকান খুলে বসেছেন। ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট পড়াতে বেশি মনোযোগী, চিকিৎসক জনসেবার ব্রত নিয়ে পড়ার অঙ্গীকার করে কসাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ। বুদ্ধিজীবীরা তো বুদ্ধির দোকান খুলে বসেছেন। সাধারণ নাগরিক এক অটোরিকশা চালক আব্দুল কদ্দুস কদিন আগে আফসোস করে বললেন, ‘সবচেয়ে ভালো ছাত্ররা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা হয়ে কর্মজীবনে সব চেয়ে নিকৃষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম করে সম্পদ করছেন। রাষ্ট্র বা জনগণের টাকা লুটপাটে মত্ত হচ্ছেন! আর আমরা তাদের অভিভাবক, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা বলছি ‘অমুকের ছেলে-মেয়ে মানুষ হয়ে গেছে’। প্রকৃত পক্ষে সে মানুষ চেহারার পশু হয়েছে।’ রাজশাহী শহরের বড় বাজারের (সাহেব বাজার) এক দোকানির সঙ্গে কথা বলছিলাম, দোকানদার আজাদ হোসেন বললেন, ‘স্যার, জঙ্গলে সুন্দর প্রাণী হরিণ, নিরীহ প্রাণী মহিষ, নিকৃষ্ট শুকর, হিং¯্র বাঘ বসবাস করে। সেখানে সবাইই বনের পশু। ভালো-মন্দ সবই সমান। পশু নামে পরিচিত। আমাদের এই সমাজে বর্তমানে একই অবস্থা, সবাইই মানুষ নামে পরিচিত। কিন্তু সবই পশু তুল্য। পশু যেমন একে অপরকে ঘাড় মটকে ক্ষুধা নিবারণ করে এই সমাজেও একইভাবে মানুষ মানুষের ঘাড় মটকে খাচ্ছে।’ সাধারণ মানুষ এখনও অনেক সহজ-সরল বা ভালো। বঙ্গবন্ধু এজন্যই বোধকরি বলেছিলেন, ‘আমার কৃষক দুর্নীতি করে না, আমার শ্রমিক দুর্নীতি করে না’। আসলেই তাই এখনও কৃষক তার মাথার ঘাম পায়ে দলে ফসল ফলায়, শ্রমিক তার শ্রমে-ঘামে সংসার চালায়। আর জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দামি গাড়িতে চড়ে সাহেবেরা অবৈধ পন্থায় নিজের সম্পদ বাড়ায়! এই উপমহাদেশে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘চোরের মার বড় গলা’। এখন এই কথাটি পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন হয়েছে, ‘চোরের বড় গলা’। যে যত বড় দুর্নীতিবাজ সে তত বড় সমাজপতি। দুর্নীতি করে দুর্নীতিবাজ নেতা এদেশে বুক ফুলিয়ে চলে। দুর্নীতিবাজ অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, বিত্তবান ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু ও বালুমহাল লুটেরাকে সবাইই সমীহ করে। মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুলিশ ঘুষ নেয়। লুটের টাকা বিলিয়ে দুষ্কর্মকারীরা প্রশাসনের সাহেবদের কাছে প্রিয়ভাজন হয়। গরিব নিরীহ মানুষকে ঠকিয়ে, দরিদ্র কৃষককে বেকায়দায় ফেলে অর্থ-সম্পদ করে সুখের ঠিকানা খোঁজে অসৎ রাজনীতিবিদ! বুদ্ধিজীবী নামের সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক-অধ্যাপকরা হয়তো চুপচাপ, নয়তো দুর্নীতিবাজের দোসর! চলছে দুর্নীতির লাগামহীন ঘোড়া। এই পাগলা ঘোড়াকে থামাতে না পারলে আমাদের পরিণতি যে মন্দ হতে হতে রসাতলে যাবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। দেশ-জাতি ও সমাজের অধঃপতন রোধে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে অন্যথায় সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন কোন দিনও বাস্তবায়ন হবে না। এই দেশ অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তখন আর কারও রক্ষা পাওয়ার পথ থাকবে না। আমরা প্রায় সবাইই হয় দুর্নীতি করছি অথবা দুর্নীতিবাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছি। অন্যায়কারীর দলভুক্ত হচ্ছি আমরা যারা অন্যায় সয়ে চুপচাপ আছি। সবাইই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হচ্ছি। বাঁচতে হলে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সবাইকে দুর্নীতি প্রতিরোধে একাট্টা হতে হবে। তবেই রক্ষা, তাতেই শান্তি এবং উন্নতি।

[লেখক: সাংবাদিক]

back to top