alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

কাজী মাসুদুর রহমান

: শনিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৪

নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, কলেজ, কারিগরি ও মাদ্রাসা সমেত দেশে মোট ৩৫ হাজারেরও বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছেÑ যার মধ্যে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। এগুলোতে পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক কর্মচারী কর্মরত আছেন। এর মধ্যে চার লক্ষাধিক রয়েছেন শিক্ষক। বলা যায়, নিম্নমাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষাস্তরের সিংহভাগই এই বেসরকারি শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত। অর্থাৎ দেশের তাবত শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বৃহৎ অংশ এই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাস্তর যার প্রায় ৯৭ ভাগেই সেবা দিচ্ছেন বেসরকারি শিক্ষকরা। এই স্তরদ্বয়ের ওপরই নির্ভর করে উচ্চতর শিক্ষাস্তর। এই বাস্তবতার নিরিখে একটি উৎপাদনশীল শিক্ষিত জাতি গঠনে কার্যত এই বেসরকারি শিক্ষকরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।

রাষ্ট্রীয় সেবায় ন্যাস্ত প্রতিটি পেশারই উৎসমূল শিক্ষা; আর এই শিক্ষার নিয়ামক হলো শিক্ষক। এই চিরন্তন ধারায় শিক্ষকতা হলো সবচেয়ে মহান পেশা এবং শিক্ষক হলো সেই পেশার মহান ধারক ও বাহক। এই বাস্তবতা বিবেচনায় পৃথিবীর প্রতিটি দেশই শিক্ষকদের বিশেষ পেশাজীবী গোষ্ঠী হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এই চিত্রটা বেদনাদায়ক। উল্লেখ্য, ১৯৮০ সাল থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) চালু হয়। শুরুতেই তাদের জাতীয় বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ দেয়া হতো। দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সাল থেকে মূল বেতনের শতভাগ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে মাধ্যমিক ও কলেজ স্তরের একজন এন্ট্রিলেভেল শিক্ষক মূল বেতন হিসেবে যথাক্রমেÑ ১২৫০০ টাকা ও ২২০০০ টাকা পান। সঙ্গে ১০০০ টাকা আবাসন ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা বাবদ দেয়া হচ্ছে যা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় শুধু অবাস্তবই নয়, লজ্জাকরও বটে। অথচ এখানে সরকারি শিক্ষকরা ২০১৫ সালের সর্বশেষ বেতনস্কেলের ৪০%, ৫০% ও ৬০% (উপজেলাভিত্তিক) হারে আবাসন এবং ১৫০০ টাকা চিকিৎসা বাবদ পাচ্ছেন। বর্তমানে যেখানে সরকারি শিক্ষকদের উৎসব ভাতা মূল বেতনের শতভাগ দেয়া হচ্ছে সেখানে বেসরকারি শিক্ষকদের দেয়া হচ্ছে মাত্র ২৫%। একই বৈশিষ্ট্যের পেশায় একই পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির আওতায় আবাসন, চিকিৎসা ও উৎসবের মতো মৌলিক ইস্যুতে এমন বৈষম্য শিক্ষকতা পেশার ক্ষেত্রে শুভকর হতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি শিক্ষকরা আর্থসামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন যা শিক্ষকতার মতো পরম সংবেদনশীল পেশাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিতে পারে। কেননা, এতে বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে হীনমন্যতা জন্ম নিচ্ছে যার নেতিবাচক প্রভাব নীরবে পাঠদান কার্যক্রমের ওপর পড়ছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ক্রমশ অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কখনো কখনো দেখা যায়, বেসরকারি শিক্ষকরা কোনো দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে নিরুপায় হয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সহযোগিতার হাত বাড়ান; অনেকে নীরবে নিভৃতে মারাও যাচ্ছে।

মূল্যস্ফীতির কোপানলে পরে সংসার চালাতে ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছেন না অনেকে। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন এনজিওগুলোতে চড়া সুদে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। আর্থসামাজিক বৈষম্য, আর্থিক অনটন এবং ঋণগ্রস্ততায় সৃষ্ট বিষণœতা তাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং পেশাভিত্তিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।

২০১৬ সাল থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা পেয়ে আসছেন। অথচ একমাত্র শিক্ষকরাই সশরীরে প্রাতিষ্ঠানিক অফিসিয়ালভাবে বাঙালি জাতির এই ঐতিহ্যময় সাংস্কৃতিক দিবসকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিয়ে পালন করে থাকেন। অথচ শিক্ষকদেরই এই বিরাট অংশকে (বেসরকারি) এই ভাতা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। আন্দোলনে সরব হওয়ার পর অবশেষে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪২৬ বঙ্গাব্দ হতে তাদের দেয়া শুরু হয়। ২০১৫ সালে ঘোষিত জাতীয় বেতন স্কেলের ৫% ইনক্রিমেন্ট সরকারি চাকরিজীবীরা প্রাপ্য হলেও এই শিক্ষকদের বাইরে রাখা হয়েছিল। পরে এভাবে বহু কাকুতি-মিনতির পর ২০১৯ সাল হতে তাদের দেয়া হচ্ছে। এমনকি ২০২৩ সালে হতে ৫% প্রণোদনা প্রদানের ক্ষেত্রেও আমলাতান্ত্রিক গড়িমসি করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি থেকে বিরত রাখার কৌশল হিসেবে ২০১৫ সালে হ্যান্ডসাম পেস্কেলসহ ৫% ইনক্রিমেন্ট চালু করা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, দুর্নীতি তো কমেইনি বরং এর প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। খোদ তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত (প্রয়াত) দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘যাদের স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে তারা বদলাবে না।’

শিক্ষকতা পেশায় সাধারণত দুর্নীতির সুযোগ নেই। কালেভাদ্রে দু-চারজন প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা কমিটির যোগসাজশে আর্থিক অনিয়ম ঘটলেও তা তাবত শিক্ষকতা পেশার মহত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। আমাদের ভাবা উচিত যে, বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক দাবিগুলো কোনো বিলাসী চাওয়া নয়। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এগুলো নিতান্তই মৌলিক। মানুষের পরম মৌলিক অধিকার হিসেবে বিশ্ব সভ্যতায় শিক্ষা স্বীকৃত; একইভাবে আমাদের জাতীয় সংবিধানেও। তবে কেন এই পরম গুরুত্বপূর্ণ খাতকে অবহেলিত রাখা হচ্ছে?

ইউনেস্কো বলছে-দেশের জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই চিত্রটা খুবই হতাশাজনক। সর্বশেষ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা যা একই অর্থবছরে সামগ্রিক জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত মোট জিডিপির মাত্র ১.৭৬ শতাংশ। শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা সংগঠন ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’-এর তথ্যমতে বিগত আট বছরে শিক্ষা খাতে বাজেট সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল যা গভীর উদ্বেগের বটে! যতটুকু বরাদ্দ হয় তারও আবার অনেক কম বরাদ্দ হয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ভরণ-পোষণে। দেশের তাবত শিক্ষা সেক্টরের বৃহত্তম এই শাখাটি সবসময়ই উপেক্ষিত হয়ে আসছে। এই উপেক্ষতা শুধু আর্থিক বিষয়েই নয়, শিক্ষা-প্রশাসনিক বিষয়েও পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষা প্রশাসনে তাদের যথেষ্ট নাজেহাল হতে হয়।

শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদ- তবে শিক্ষক হলো সেই মেরুদ-ের প্রাণ-মজ্জা। তাহলে, কেন এই শিক্ষক সমাজকে তার মৌলিক অধিকারের জন্য রাজপথে দাঁড়াতে হবে? কেন তাকে এভাবে সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্যের শিকার হতে হবে? কেন তার মেধা-মননকে বিষণœতার আগুনে পোড়াতে হবে? রাষ্ট্র ও সরকার এভাবে কেন তার সৃষ্টিশীল সুকুমার বৃত্তিকে সৃজনশীল শিক্ষা সেবার কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে? দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই এই প্রশ্নগুলোর জবাব ও সমাধান দ্রুততম সময়েই খুঁজতে হবে।

জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই স্বপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্র ও সরকারকে তাদের প্রতি অধিকতর যতœশীল হতে হবে। অন্যথায় এর সুদুরপ্রসারি খেসারত সবাইকেই ভোগ করতে হবে! স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছরে দেশ বিষ্ময়কর উন্নয়নের সোপানে ধাবমান যার নেপথ্যের কারিগর এই শিক্ষকরাই। উন্নয়নের রূপকল্প অভিযাত্রায় আগামী চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইতোমধ্যে শিক্ষা কারিকুলামকে যুগোপযোগী করা হয়েছে। সেই কারিকুলামের আওতায় একটি সুশিক্ষিত-সুদক্ষ জাতিশক্তি গঠনের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে এই শিক্ষকদেরই সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু শিক্ষকদের জীবন-মান আঁধারে রেখে তা কখনোই সম্ভব নয়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

কাজী মাসুদুর রহমান

শনিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৪

নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, কলেজ, কারিগরি ও মাদ্রাসা সমেত দেশে মোট ৩৫ হাজারেরও বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছেÑ যার মধ্যে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। এগুলোতে পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক কর্মচারী কর্মরত আছেন। এর মধ্যে চার লক্ষাধিক রয়েছেন শিক্ষক। বলা যায়, নিম্নমাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষাস্তরের সিংহভাগই এই বেসরকারি শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত। অর্থাৎ দেশের তাবত শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বৃহৎ অংশ এই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাস্তর যার প্রায় ৯৭ ভাগেই সেবা দিচ্ছেন বেসরকারি শিক্ষকরা। এই স্তরদ্বয়ের ওপরই নির্ভর করে উচ্চতর শিক্ষাস্তর। এই বাস্তবতার নিরিখে একটি উৎপাদনশীল শিক্ষিত জাতি গঠনে কার্যত এই বেসরকারি শিক্ষকরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।

রাষ্ট্রীয় সেবায় ন্যাস্ত প্রতিটি পেশারই উৎসমূল শিক্ষা; আর এই শিক্ষার নিয়ামক হলো শিক্ষক। এই চিরন্তন ধারায় শিক্ষকতা হলো সবচেয়ে মহান পেশা এবং শিক্ষক হলো সেই পেশার মহান ধারক ও বাহক। এই বাস্তবতা বিবেচনায় পৃথিবীর প্রতিটি দেশই শিক্ষকদের বিশেষ পেশাজীবী গোষ্ঠী হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এই চিত্রটা বেদনাদায়ক। উল্লেখ্য, ১৯৮০ সাল থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) চালু হয়। শুরুতেই তাদের জাতীয় বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ দেয়া হতো। দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সাল থেকে মূল বেতনের শতভাগ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে মাধ্যমিক ও কলেজ স্তরের একজন এন্ট্রিলেভেল শিক্ষক মূল বেতন হিসেবে যথাক্রমেÑ ১২৫০০ টাকা ও ২২০০০ টাকা পান। সঙ্গে ১০০০ টাকা আবাসন ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা বাবদ দেয়া হচ্ছে যা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় শুধু অবাস্তবই নয়, লজ্জাকরও বটে। অথচ এখানে সরকারি শিক্ষকরা ২০১৫ সালের সর্বশেষ বেতনস্কেলের ৪০%, ৫০% ও ৬০% (উপজেলাভিত্তিক) হারে আবাসন এবং ১৫০০ টাকা চিকিৎসা বাবদ পাচ্ছেন। বর্তমানে যেখানে সরকারি শিক্ষকদের উৎসব ভাতা মূল বেতনের শতভাগ দেয়া হচ্ছে সেখানে বেসরকারি শিক্ষকদের দেয়া হচ্ছে মাত্র ২৫%। একই বৈশিষ্ট্যের পেশায় একই পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির আওতায় আবাসন, চিকিৎসা ও উৎসবের মতো মৌলিক ইস্যুতে এমন বৈষম্য শিক্ষকতা পেশার ক্ষেত্রে শুভকর হতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি শিক্ষকরা আর্থসামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন যা শিক্ষকতার মতো পরম সংবেদনশীল পেশাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিতে পারে। কেননা, এতে বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে হীনমন্যতা জন্ম নিচ্ছে যার নেতিবাচক প্রভাব নীরবে পাঠদান কার্যক্রমের ওপর পড়ছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ক্রমশ অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কখনো কখনো দেখা যায়, বেসরকারি শিক্ষকরা কোনো দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে নিরুপায় হয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সহযোগিতার হাত বাড়ান; অনেকে নীরবে নিভৃতে মারাও যাচ্ছে।

মূল্যস্ফীতির কোপানলে পরে সংসার চালাতে ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছেন না অনেকে। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন এনজিওগুলোতে চড়া সুদে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। আর্থসামাজিক বৈষম্য, আর্থিক অনটন এবং ঋণগ্রস্ততায় সৃষ্ট বিষণœতা তাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং পেশাভিত্তিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।

২০১৬ সাল থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা পেয়ে আসছেন। অথচ একমাত্র শিক্ষকরাই সশরীরে প্রাতিষ্ঠানিক অফিসিয়ালভাবে বাঙালি জাতির এই ঐতিহ্যময় সাংস্কৃতিক দিবসকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিয়ে পালন করে থাকেন। অথচ শিক্ষকদেরই এই বিরাট অংশকে (বেসরকারি) এই ভাতা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। আন্দোলনে সরব হওয়ার পর অবশেষে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪২৬ বঙ্গাব্দ হতে তাদের দেয়া শুরু হয়। ২০১৫ সালে ঘোষিত জাতীয় বেতন স্কেলের ৫% ইনক্রিমেন্ট সরকারি চাকরিজীবীরা প্রাপ্য হলেও এই শিক্ষকদের বাইরে রাখা হয়েছিল। পরে এভাবে বহু কাকুতি-মিনতির পর ২০১৯ সাল হতে তাদের দেয়া হচ্ছে। এমনকি ২০২৩ সালে হতে ৫% প্রণোদনা প্রদানের ক্ষেত্রেও আমলাতান্ত্রিক গড়িমসি করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি থেকে বিরত রাখার কৌশল হিসেবে ২০১৫ সালে হ্যান্ডসাম পেস্কেলসহ ৫% ইনক্রিমেন্ট চালু করা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, দুর্নীতি তো কমেইনি বরং এর প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। খোদ তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত (প্রয়াত) দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘যাদের স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে তারা বদলাবে না।’

শিক্ষকতা পেশায় সাধারণত দুর্নীতির সুযোগ নেই। কালেভাদ্রে দু-চারজন প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা কমিটির যোগসাজশে আর্থিক অনিয়ম ঘটলেও তা তাবত শিক্ষকতা পেশার মহত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। আমাদের ভাবা উচিত যে, বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক দাবিগুলো কোনো বিলাসী চাওয়া নয়। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এগুলো নিতান্তই মৌলিক। মানুষের পরম মৌলিক অধিকার হিসেবে বিশ্ব সভ্যতায় শিক্ষা স্বীকৃত; একইভাবে আমাদের জাতীয় সংবিধানেও। তবে কেন এই পরম গুরুত্বপূর্ণ খাতকে অবহেলিত রাখা হচ্ছে?

ইউনেস্কো বলছে-দেশের জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই চিত্রটা খুবই হতাশাজনক। সর্বশেষ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা যা একই অর্থবছরে সামগ্রিক জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত মোট জিডিপির মাত্র ১.৭৬ শতাংশ। শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা সংগঠন ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’-এর তথ্যমতে বিগত আট বছরে শিক্ষা খাতে বাজেট সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল যা গভীর উদ্বেগের বটে! যতটুকু বরাদ্দ হয় তারও আবার অনেক কম বরাদ্দ হয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ভরণ-পোষণে। দেশের তাবত শিক্ষা সেক্টরের বৃহত্তম এই শাখাটি সবসময়ই উপেক্ষিত হয়ে আসছে। এই উপেক্ষতা শুধু আর্থিক বিষয়েই নয়, শিক্ষা-প্রশাসনিক বিষয়েও পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষা প্রশাসনে তাদের যথেষ্ট নাজেহাল হতে হয়।

শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদ- তবে শিক্ষক হলো সেই মেরুদ-ের প্রাণ-মজ্জা। তাহলে, কেন এই শিক্ষক সমাজকে তার মৌলিক অধিকারের জন্য রাজপথে দাঁড়াতে হবে? কেন তাকে এভাবে সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্যের শিকার হতে হবে? কেন তার মেধা-মননকে বিষণœতার আগুনে পোড়াতে হবে? রাষ্ট্র ও সরকার এভাবে কেন তার সৃষ্টিশীল সুকুমার বৃত্তিকে সৃজনশীল শিক্ষা সেবার কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে? দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই এই প্রশ্নগুলোর জবাব ও সমাধান দ্রুততম সময়েই খুঁজতে হবে।

জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই স্বপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্র ও সরকারকে তাদের প্রতি অধিকতর যতœশীল হতে হবে। অন্যথায় এর সুদুরপ্রসারি খেসারত সবাইকেই ভোগ করতে হবে! স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছরে দেশ বিষ্ময়কর উন্নয়নের সোপানে ধাবমান যার নেপথ্যের কারিগর এই শিক্ষকরাই। উন্নয়নের রূপকল্প অভিযাত্রায় আগামী চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইতোমধ্যে শিক্ষা কারিকুলামকে যুগোপযোগী করা হয়েছে। সেই কারিকুলামের আওতায় একটি সুশিক্ষিত-সুদক্ষ জাতিশক্তি গঠনের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে এই শিক্ষকদেরই সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু শিক্ষকদের জীবন-মান আঁধারে রেখে তা কখনোই সম্ভব নয়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top