alt

উপ-সম্পাদকীয়

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪

জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি। এটি ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি। জাকাত আরবি শব্দ। যার প্রধান দুটি অর্থÑ পবিত্রকরণ এবং বৃদ্ধিকরণ। জাকাত আদায় করা হলে মানুষের ধন-সম্পদ থেকে গরিবের হক আদায় হয়। ফলে তা হালাল ও পবিত্র হয়। আবার জাকাতের মাধ্যমে শ্রেণীবৈষম্য দূর হয়, সমাজে দারিদ্র্যের হার কমতে থাকে এবং সচ্ছল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সে অর্থেই জাকাত অর্থ বৃদ্ধি করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, নিজের ও পরিবারের সারা বছরের যাবতীয় প্রয়োজন ও ঋণনির্বাহের পর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রোপ্য অথবা সমপরিমাণ জাকাতযোগ্য সম্পদ কারো নিকট যদি পূর্ণ এক বছর পর্যন্ত সঞ্চিত থাকে, তবে তার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই টাকা হারে আল্লাহর নির্দেশিত পথে গরিব-মিসকিনদের মাঝে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যয় করার বিধানকেই জাকাত বলা হয়। ইসলামী বিধানমতে, ধনী ব্যক্তিদের জাকাত আদায় করা অবশ্য কর্তব্য বা ফরজ। ইসলামে নামাজকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তেমনি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাকাতকে। পবিত্র কুরআনের ৮২ জায়গায় নামাজের এবং ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। আর ২৭ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একত্রে বলা হয়েছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তি জাকাত আদায় না করলে তার পরিণাম বা ফলাফল সম্পর্কেও পবিত্র কুরআনে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।

ইসলামে জাকাতব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে মূলত একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করার জন্য। সমাজে ধনীদের হাতেই যাতে সম্পদ কুক্ষিগত না থাকে, যাতে একটি অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, কেউ পাঁচতলায় আর কেউ গাছতলায় থাকার মনোবৃত্তি যাতে তৈরি না হয়, সে লক্ষ্যেই জাকাত প্রদানের হুকুম জারি হয়েছে। কারণ যদি সমাজের মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে যায়, তবে সেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, বৃদ্ধি পাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অস্থিরতা। ফলে সমাজে সৃষ্টি হবে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থা। সে কারণে ধনীদের ওপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। এটি ধনীদের কোন দয়া বা অনুগ্রহ নয় বরং ধনীদের থেকে গরিবদের প্রাপ্য অধিকার। সূরা আয-যারিয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের অর্থাৎ ধনীদের ধন-সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (আয়াত-১৯) কোন কোন সম্পদের জাকাত দিতে হবে, সে-সম্পর্কেও ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট। যদি কোন সম্পদশালী ব্যক্তির কাছে খাদ্যশস্য, গৃহপালিত গবাদিপশু, স্বর্ণ বা রৌপ্য জাতীয় মূল্যবান ধাতু, বাণিজ্যিক দ্রব্য, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকে, তবে তা থেকে নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট খাতে অবশ্যই জাকাত দিতে হবে।

জাকাতব্যবস্থাই হলো বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সমাজের অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত ও পিছিয়ে পড়া জনগণকে অভাব ও অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তি দিয়ে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী করার জন্য ইসলামে জাকাতের বিধান করা হয়েছে। তাই জাকাত হলো গরিবের সামাজিক নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি ও তাদের অর্থনৈতিক রক্ষাকবচ। সামাজিক সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথই হচ্ছে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। এ পৃথিবীর সবকিছুর মালিক মহান আল্লাহ। মানুষ তার প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর সব ধন-সম্পদ ভোগ করে মাত্র। কাউকে তিনি ধন-সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কাউকে দারিদ্র্য দিয়ে। ধনীদের পরীক্ষা করার জন্য জাকাত আল্লাহর একটি উপলক্ষ মাত্র। এর মাধ্যমে সম্পদশালী ব্যক্তির আত্মার যেমন পরিশুদ্ধি আসে, তেমনি তার ধন-সম্পদ পবিত্র ও হালাল হয়। আর সমাজের অসহায়, ফকির, মিসকিন, দরিদ্ররা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পায়।

জাকাতের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু গরিব-দুঃখীদের অভাব দূরীকরণের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করা, তাই জাকাত যেনতেনভাবে দিলে হবে না। দিলে সেটা হবে শুধু লোক দেখানো মাত্র। জাকাত এমনভাবে দিতে হবে, যেন গ্রহীতার অভাব দূর হয়, সে স্বাবলম্বী হতে পারে। পরেরবার যাতে তাকে আবার সাহায্যের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে না হয়। এজন্য জাকাতের অর্থ শত শত, হাজার হাজার মানুষের মাঝে অল্প অল্প করে না দিয়ে নিজের বা পার্শ্ববর্তী এলাকার জাকাত পাওয়ার যোগ্য মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে টার্গেট করে বিতরণ করতে হবে। তাহলে সেটা হবে ফলপ্রসূ ও কার্যকর। বর্তমান পৃথিবীর অশান্তির অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। বিস্ময়কর বিষয় হলো, সম্পদের স্বল্পতা নয় বরং দেশের কিছু শ্রেণীর মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত থাকাই দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

ইসলামে সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় ধনীরা তাদের সম্পদের কিছু অংশ জাকাত দিলে গরিবদের সম্পদ কিছুটা বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়। জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা মহানবী (সা.)-এর আদর্শ মদিনা রাষ্ট্র, খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্যবিমোচন করে মুসলিম উম্মাহকে সমকালীন বিশ্বে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিতে পরিণত করেছিল। এভাবে জাকাত ফান্ডের অর্থ দিয়ে যদি অভাবীদের একটি তালিকা তৈরি করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশটি পরিবারকে বাছাই করে প্রতিটি পরিবারকে ৫,০০০ টাকার মধ্যে উপার্জনযোগ্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয় এবং যে পরিবারের কর্তা একজন শক্তিমান পুরুষ তাকে একটি ভ্যান বা মাঝারি নৌকা কিনে দেয়া হয়, যে পরিবারের কর্তা একজন বয়োবৃদ্ধ পুরুষ তাকে একটি ছোট পান-চায়ের দোকান করে দেয়া হয়, আর যে পরিবারের প্রধান একজন বিধবা মহিলা তাকে একটা ভালো সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হয়, তাহলে এর সুষ্ঠু ও সঠিক ব্যবহার করে তারা দৈনন্দিন রোজগার করে সংসার চালাতে পারবে। এভাবে প্রতি বছর যদি বিশটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করা যায়, তাহলে মদিনায় যেমন খোলাফায়ে রাশেদিনের শেষ দিকে জাকাত নেয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি, তেমনি ২০ বছর পর হয়তো ওই মহল্লায়ও জাকাত নেয়ার মতো কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজন হবে সম্মিলিত সামাজিক অঙ্গীকার। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আর্থসামাজিক উন্নয়নে জাকাত এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাকাতব্যবস্থায় সমাজের অথনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় হয়। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য নিরসনে এটি এক উত্তম ব্যবস্থা। সাম্য ও সমতার বিধান ছাড়া সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা সুরক্ষা হয় না। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণ হলেই সমাজ স্থিতিশীল হয়। অপরাধ কমে আসে। তাই এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, জাকাত সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈষম্য নিরসনে এক অপরিসীম ভূমিকা পালন করে থাকে। মোটকথা ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জাকাত একদিকে যেমন গরিব অসহায়তা অবসানের গ্যারান্টি রাখে তেমনি অর্থনৈতিক চাকাকে গতিশীলও রাখে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও সুদৃঢ় ও সমুন্নত করে। এসব কারণে জাকাতের আর্থসামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪

জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি। এটি ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি। জাকাত আরবি শব্দ। যার প্রধান দুটি অর্থÑ পবিত্রকরণ এবং বৃদ্ধিকরণ। জাকাত আদায় করা হলে মানুষের ধন-সম্পদ থেকে গরিবের হক আদায় হয়। ফলে তা হালাল ও পবিত্র হয়। আবার জাকাতের মাধ্যমে শ্রেণীবৈষম্য দূর হয়, সমাজে দারিদ্র্যের হার কমতে থাকে এবং সচ্ছল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সে অর্থেই জাকাত অর্থ বৃদ্ধি করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, নিজের ও পরিবারের সারা বছরের যাবতীয় প্রয়োজন ও ঋণনির্বাহের পর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রোপ্য অথবা সমপরিমাণ জাকাতযোগ্য সম্পদ কারো নিকট যদি পূর্ণ এক বছর পর্যন্ত সঞ্চিত থাকে, তবে তার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই টাকা হারে আল্লাহর নির্দেশিত পথে গরিব-মিসকিনদের মাঝে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যয় করার বিধানকেই জাকাত বলা হয়। ইসলামী বিধানমতে, ধনী ব্যক্তিদের জাকাত আদায় করা অবশ্য কর্তব্য বা ফরজ। ইসলামে নামাজকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তেমনি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাকাতকে। পবিত্র কুরআনের ৮২ জায়গায় নামাজের এবং ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। আর ২৭ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একত্রে বলা হয়েছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তি জাকাত আদায় না করলে তার পরিণাম বা ফলাফল সম্পর্কেও পবিত্র কুরআনে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।

ইসলামে জাকাতব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে মূলত একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করার জন্য। সমাজে ধনীদের হাতেই যাতে সম্পদ কুক্ষিগত না থাকে, যাতে একটি অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, কেউ পাঁচতলায় আর কেউ গাছতলায় থাকার মনোবৃত্তি যাতে তৈরি না হয়, সে লক্ষ্যেই জাকাত প্রদানের হুকুম জারি হয়েছে। কারণ যদি সমাজের মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে যায়, তবে সেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, বৃদ্ধি পাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অস্থিরতা। ফলে সমাজে সৃষ্টি হবে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থা। সে কারণে ধনীদের ওপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। এটি ধনীদের কোন দয়া বা অনুগ্রহ নয় বরং ধনীদের থেকে গরিবদের প্রাপ্য অধিকার। সূরা আয-যারিয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের অর্থাৎ ধনীদের ধন-সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (আয়াত-১৯) কোন কোন সম্পদের জাকাত দিতে হবে, সে-সম্পর্কেও ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট। যদি কোন সম্পদশালী ব্যক্তির কাছে খাদ্যশস্য, গৃহপালিত গবাদিপশু, স্বর্ণ বা রৌপ্য জাতীয় মূল্যবান ধাতু, বাণিজ্যিক দ্রব্য, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকে, তবে তা থেকে নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট খাতে অবশ্যই জাকাত দিতে হবে।

জাকাতব্যবস্থাই হলো বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সমাজের অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত ও পিছিয়ে পড়া জনগণকে অভাব ও অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তি দিয়ে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী করার জন্য ইসলামে জাকাতের বিধান করা হয়েছে। তাই জাকাত হলো গরিবের সামাজিক নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি ও তাদের অর্থনৈতিক রক্ষাকবচ। সামাজিক সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথই হচ্ছে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। এ পৃথিবীর সবকিছুর মালিক মহান আল্লাহ। মানুষ তার প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর সব ধন-সম্পদ ভোগ করে মাত্র। কাউকে তিনি ধন-সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কাউকে দারিদ্র্য দিয়ে। ধনীদের পরীক্ষা করার জন্য জাকাত আল্লাহর একটি উপলক্ষ মাত্র। এর মাধ্যমে সম্পদশালী ব্যক্তির আত্মার যেমন পরিশুদ্ধি আসে, তেমনি তার ধন-সম্পদ পবিত্র ও হালাল হয়। আর সমাজের অসহায়, ফকির, মিসকিন, দরিদ্ররা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পায়।

জাকাতের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু গরিব-দুঃখীদের অভাব দূরীকরণের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করা, তাই জাকাত যেনতেনভাবে দিলে হবে না। দিলে সেটা হবে শুধু লোক দেখানো মাত্র। জাকাত এমনভাবে দিতে হবে, যেন গ্রহীতার অভাব দূর হয়, সে স্বাবলম্বী হতে পারে। পরেরবার যাতে তাকে আবার সাহায্যের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে না হয়। এজন্য জাকাতের অর্থ শত শত, হাজার হাজার মানুষের মাঝে অল্প অল্প করে না দিয়ে নিজের বা পার্শ্ববর্তী এলাকার জাকাত পাওয়ার যোগ্য মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে টার্গেট করে বিতরণ করতে হবে। তাহলে সেটা হবে ফলপ্রসূ ও কার্যকর। বর্তমান পৃথিবীর অশান্তির অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। বিস্ময়কর বিষয় হলো, সম্পদের স্বল্পতা নয় বরং দেশের কিছু শ্রেণীর মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত থাকাই দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

ইসলামে সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় ধনীরা তাদের সম্পদের কিছু অংশ জাকাত দিলে গরিবদের সম্পদ কিছুটা বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়। জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা মহানবী (সা.)-এর আদর্শ মদিনা রাষ্ট্র, খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্যবিমোচন করে মুসলিম উম্মাহকে সমকালীন বিশ্বে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিতে পরিণত করেছিল। এভাবে জাকাত ফান্ডের অর্থ দিয়ে যদি অভাবীদের একটি তালিকা তৈরি করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশটি পরিবারকে বাছাই করে প্রতিটি পরিবারকে ৫,০০০ টাকার মধ্যে উপার্জনযোগ্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয় এবং যে পরিবারের কর্তা একজন শক্তিমান পুরুষ তাকে একটি ভ্যান বা মাঝারি নৌকা কিনে দেয়া হয়, যে পরিবারের কর্তা একজন বয়োবৃদ্ধ পুরুষ তাকে একটি ছোট পান-চায়ের দোকান করে দেয়া হয়, আর যে পরিবারের প্রধান একজন বিধবা মহিলা তাকে একটা ভালো সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হয়, তাহলে এর সুষ্ঠু ও সঠিক ব্যবহার করে তারা দৈনন্দিন রোজগার করে সংসার চালাতে পারবে। এভাবে প্রতি বছর যদি বিশটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করা যায়, তাহলে মদিনায় যেমন খোলাফায়ে রাশেদিনের শেষ দিকে জাকাত নেয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি, তেমনি ২০ বছর পর হয়তো ওই মহল্লায়ও জাকাত নেয়ার মতো কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজন হবে সম্মিলিত সামাজিক অঙ্গীকার। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আর্থসামাজিক উন্নয়নে জাকাত এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাকাতব্যবস্থায় সমাজের অথনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় হয়। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য নিরসনে এটি এক উত্তম ব্যবস্থা। সাম্য ও সমতার বিধান ছাড়া সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা সুরক্ষা হয় না। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণ হলেই সমাজ স্থিতিশীল হয়। অপরাধ কমে আসে। তাই এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, জাকাত সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈষম্য নিরসনে এক অপরিসীম ভূমিকা পালন করে থাকে। মোটকথা ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জাকাত একদিকে যেমন গরিব অসহায়তা অবসানের গ্যারান্টি রাখে তেমনি অর্থনৈতিক চাকাকে গতিশীলও রাখে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও সুদৃঢ় ও সমুন্নত করে। এসব কারণে জাকাতের আর্থসামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top