alt

উপ-সম্পাদকীয়

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

শেখর ভট্টাচার্য

: শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
image

আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির আরেকটি অনুষঙ্গ বিয়ের গীত, যেটা ইতোমধ্যে প্রায় উবে গেছে বাংলা সংস্কৃতির পরিম-ল থেকে

সাহিত্য, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয় পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া কিংবা আদান-প্রদানের মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশের শাশ্বত ভাব সম্পদ অন্য দেশ গ্রহণ করে নিজেদের সাহিত্য, সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধতর করে তুলে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও চিরায়ত মানব সংস্কৃতি যা সত্য, সুন্দরে পরিপূর্ণ তা এক দেশ কিংবা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবে গৃহীত হয়। ইংরেজ কবি কিটস তার বিখ্যাত ‘অড অন অ্যা গ্রেসান আর্ন’ কবিতায় ‘সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য’ এই চিরায়ত দর্শন ব্যবহার করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কথাটি কোন নির্দিষ্ট স্থান-কালের জন্য নয়, বরং তা হলো বিশ্ব সংসারের সম্পদ। বিশ্ব সাহিত্যের মহৎ কর্ম সম্পর্কে জেনে নিজেদের ঋদ্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি জাতি উদগ্রীব থাকে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শনের এ বিনিময় সাধারণত ঘটে থাকে শাশ্বত-সুন্দর, মানবতার জন্য মঙ্গলজনক সাহিত্য, সংস্কৃতি আত্মীকরণের মাধ্যমে। তবে একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করা আবশ্যক তা হলোÑ নিজেদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে অন্যদেশ বা অঞ্চলের সংস্কৃতি গ্রহণ না করা। তা করা হলে জাতীয় সংস্কৃতির দৈন্যতার প্রকাশ ঘটে। কথাগুলো মনের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো বেশ কয়েক বছর থেকে। কেন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো? বেশ কয়েক বছর থেকে লক্ষ্য করছি আমাদের কিছু সংখ্যক মানুষ নিজেদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে ক্রমাগত অন্য অঞ্চলের সংস্কৃতিকে অনাকাক্সিক্ষতভাবে গ্রহণ করে আনন্দ ও গর্ব অনুভব করছেন। এসব কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করলে মন বিষন্নতায় ছেয়ে যায়।

বাঙালির রঙের উৎসব দোল পূর্ণিমা। মূলত বসন্ত ঋতুকে উদযাপনের উৎসব হলো দোল। দোল পূর্ণিমা এখন রীতিমতো ‘হোলি’ হয়ে গেছে। দুই-এক দশক আগেও বাঙালিরা দোল পূর্ণিমাই পালন করতো। সম্প্রতি বাজার সংস্কৃতির ফাঁদে পড়ে কেনাকাটা করতে হয় হোলি উৎসবের। নব-প্রজন্ম দোল পূর্ণিমাকে ‘হোলি’ মনে করে উদযাপন করে যাচ্ছে পুরোদস্তুর। ‘হোলি‘ উৎসবটি হিন্দি বলয় থেকে এমনভাবে বাজারজাত করা হয়েছে যে বিশ্বজুড়ে মানুষ জানে ‘হোলি’ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। হোলির সব চেয়ে বড় আয়োজক ও ভোক্তা ভারত। বাঙালি সংস্কৃতির সাথে বেমানান এ উৎসব পালনের মাধ্যমে ভারতীয় পুঁজিপতিরা তাদের উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। শুধু ভারত নয় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিরা এখন হোলি নামক এই উৎসবটি মহানন্দে পালন করে যাচ্ছেন। আমরা জানি হোলির সাথে সনাতন ধর্মীয় মিথের কিছু সংযোগ আছে। এই মিথকে কেন্দ্র করে বাঙালিরা কখনই হোলি উৎসব পালন করেনি বরঞ্চ শত শত বছর ধরে বাসন্তী পূর্ণিমায় দোল উৎসব উদযাপন করে আসছে। উৎসব উপলক্ষ্যে যে বাজার সৃষ্টি হয়েছে, বাজারটি ইতোমধ্যে ক্রমাগত বড় হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বাজার যতো বড় হচ্ছে, উৎসবও তত রঙে-রূপে বিস্তৃত হচ্ছে। চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতিকে আমরা বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করছি না। আমরা বড়ই উদার। নিজেরা নিঃস্ব হয়ে অন্য সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তুলছি। হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসনের কাছে আমরা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছি। হিন্দি সিনেমা, হিন্দি সিরিয়াল আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে গলধঃকরণ করতে হচ্ছে দ্রুত। হোলির বাজারকে সম্প্রসারিত করতে সহায়তা করছে প্রথমত হিন্দি সিনেমা, হিন্দি ধারাবাহিক নাটক এবং পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা নাটক ও সিনেমা।

বাঙালির অধিকাংশ উৎসব মূলত সংস্কৃতি সংলগ্ন। যতটুকু ধর্মীয় তার থেকে বেশি উৎসব। ধর্ম এবং সংস্কৃতি বিষয়টি এক নয়। অনেকেই ধর্মের সাথে উৎসব বা সংস্কৃতিকে গুলিয়ে ফেলেন। বাঙালির উৎসবগুলো প্রধানত ঋতুভিত্তিক। ঋতুর প্রভাব বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবার ওপর সমানভাবে প্রতিফলিত হয়। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে সব শ্রেণী-ধর্মের মানুষ ছিলেন অংশীজন। ধান কাটা শেষ হলে নতুন ধানের চাল দিয়ে নবান্ন হয়।

অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হওয়ার কারণে আনন্দ উদযাপন ছিলো সীমিত। তাই ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ ঋতুভিত্তিক এরকম উৎসব পালন করতো এবং এখনও করে থাকে। নববর্ষ, নবান্ন, দোল পূর্ণিমা, বসন্তবরণ, শারদোৎসব, বর্ষাবন্দনা এগুলো হলো বাঙালির একান্ত ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। বসন্তে প্রকৃতির বিচিত্র রঙের সাজ বাঙালির মনকে উন্মন করে তোলে। বাঙালি উদ্বুদ্ধ হয় রঙের উৎসব আয়োজনে। রবীন্দ্রনাথের বড় পছন্দের উৎসব ছিলো দোল। বাংলাতে তখনও হোলি ‘বাজারজাত’ হয়নি। হোলি উদযাপন করে মানুষ মেকি ‘স্মার্ট’ হয়ে ওঠেনি তখনও। বসন্তে প্রকৃতির উজ্জ্বল রঙ, রূপ রবীন্দ্রনাথকে উন্মন করে তুলতো। ওরে গৃহবাসী গানের কিছু পঙ্ক্তি পড়লে বা শুনলে আমাদের মনেও রঙের ছোপ এসে স্পর্শ করে। ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল। /স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল। ....../রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে/রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে/নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল/দ্বার খোল্, দ্বার খোল্।

এরকম গীতি কবিতা যখন সুরের খেয়ায় ভাসে তখন উৎসবের রঙ এসে মর্মে লাগে। এই মর্মে এসে যে রঙ লাগে তা নিয়েও রবিঠাকুর গান লিখেছেনÑ ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে/ সন্ধ্যা দীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে’। এ রকম রঙের খেলা বাংলার প্রকৃতি ছাড়া আর কোথাও আছে কী-না আমার জানা নেই। রবীন্দ্র যুগে তো আমরা হোলির নাম শুনতে পাইনি। ঋতুভিত্তিক নবান্নের মতো অন্য উৎসবও যেনো আবার হিন্দি বলয়ের বাজার কেড়ে না নেয়, এ বিষয়ে আমাদের কতোটুকু সচেতনতা আছে আমারা জানি না। যেমন ইংরেজি সংস্কৃতি কেড়ে নিয়েছে আমাদের অনেক কিছু। আমাদের উৎসব, ইতিহাস, মূল্যবোধ। তারাপদ রায় এই সর্বনাশের কথা খুব সুন্দর করে বলেছিলেনÑ

‘আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম

যার উদ্দেশ্যে ধ্রুপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশস্তি লিখেছিলাম

গতকাল বলাই বাবু বললেন, ‘ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ’...

আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন

আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।

আমরা বুঝতে পারিনি

আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।’

সর্বনাশের কতোটুকু অবশিষ্ট আছে জানা নেই। বাংলা ও বাঙালির সাথে সামঞ্জস্যহীন সংস্কৃতি প্রথমত বাজারজাত করা হয় ভারতের হিন্দি বলয় থেকে। পশ্চিমবঙ্গের কিছু উদার বাংলাভাষী নিজেদের মেকি ভদ্রলোক সাজাবার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে চটকদার, কৃত্রিম সংস্কৃতির চর্চা করে নিজেরা পরিতৃপ্ত হন। (ক্ষমা চাচ্ছি তাদের কাছে যারা ওপারে বাংলা সংস্কৃতির জাগরণ নিয়ে কাজ করছেন এবং বাংলা সংস্কৃতিকে ভালোবাসেন)। গঙ্গা পেরিয়ে পদ্মা, তিস্তা দিয়ে এসব সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এখানেও ‘তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে’ জাতীয় কিছু মানুষ আছেন; যারা নির্দ্বিধায় বোনের জামাইকে ‘জামাইবাবু’ ‘দুলাভাই’ ‘দাদা’, ‘ভাই’ সম্বোধন না করে নির্লজ্জের মতো ‘জিজু’ বলে সম্বোধন করে পরম আনন্দ ও সম্মান লাভ করেন। আমাদের গায়েহলুদ ইতোমধ্যে ‘হলদে নাইট’ বা কেমন জানি বিকৃত উচ্চারণে ‘হালদে’ হয়ে গেছে। দীপান্বিতা ‘দিওয়ালি’ হয়ে গেছে রাতারাতি। ‘দিওয়ালি’ হলো বাজার সংস্কৃতির সব চেয়ে বড় ক্ষেত্র। হোলি এবং ‘দিওয়ালি’ কোনটার বাজার বড় সেটি মার্কেটিং নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা ভালো বলতে পারবেন। আমাদের আপাত নিরীহ অনিন্দ্য সুন্দর দ্বীপান্বিতা আজ ভূপতিত ‘দিওয়ালির’ কাছে। আমরা দ্বীপান্বিতাকে হারিয়ে ফেলেছি নির্দ্বিধায় যেমন হারিয়েছি দোল পূর্ণিমাকে।

আমরা কী জানি আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির আর একটি অনুষঙ্গ বিয়ের গীত ইতোমধ্যে প্রায় উবে গেছে বাংলা সংস্কৃতির পরিম-ল থেকে। গ্রামে-গঞ্জে গীত গাওয়ার মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া ভার। স্যাটেলাইট সংস্কৃতির প্রবল চাপে পড়ে নিরীহ গীত প্রায় মৃত। গ্রামীণ গীতি কবি কেনো লিখবেন বিয়ের গীত, কে সুরারোপ করবেন, কাদের দ্বারা গীত হবে। বাঙালির বিয়ের গান ‘হলুদ বাটো, মরিচ বাটো...’ ছাড়া একসময় পূর্ব এবং পশ্চিম বঙ্গের বিয়ের অনুষ্ঠান পরিপূর্ণ হতো না। সেই গানগুলোকে আমরা ‘সঙ্গতের’ গানের কাছে সমর্পিত করেছি। এখন হিন্দি গানের চাপে, ইংলিশ র‌্যাপ মিউজিকের ভাপে, বাংলা মেটাল সঙ্গীতের নিচে পড়ে ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গানকে বলতে হচ্ছে ‘...দিনতো গেলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে।’ আহা, বাঙালি, আর কতো উদারতা প্রদর্শন করবে! রাজার গায়ের কাপড়ের মতো দুর্দশা হয়ে গেছে। রাজা ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে পারছেন না রাজা বস্ত্র পরিধান করে আছেন।

নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে, এর উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। বাজার সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করতে পারে কেবল উৎকৃষ্ট সাহিত্য, সংস্কৃতি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন না করলে এটি কোনভাবেই সম্ভব নয়। ঐতিহ্যবাহী গৌরবময় সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে দেশে বিদেশে আমাদের অনিন্দ্য সুন্দর সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে পারি। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের বাইরেও এখন বাংলাদেশ আছে। সারা বিশ্বের কোণে কোণে বাঙালিরা ছোট ছোট বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে। এখন শুধু লন্ডন নয়, প্যারিস, নিউইয়র্ক, টরন্টোর মতো অসংখ্য শহর আছে যেখানে বাঙালিরা স্থায়ী আবাস গড়ে তুলছেন। দেশে বিদেশে নিরন্তর সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন করতে পারি এবং এর মধ্য দিয়ে ভিন্ন রূপে তৈরি হওয়া ভাষা, সংস্কৃতির ওপর হুমকি রোধ করতে পারি। প্রয়োজন আমাদের আন্তরিক প্রয়াস।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

শেখর ভট্টাচার্য

image

আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির আরেকটি অনুষঙ্গ বিয়ের গীত, যেটা ইতোমধ্যে প্রায় উবে গেছে বাংলা সংস্কৃতির পরিম-ল থেকে

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

সাহিত্য, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয় পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া কিংবা আদান-প্রদানের মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশের শাশ্বত ভাব সম্পদ অন্য দেশ গ্রহণ করে নিজেদের সাহিত্য, সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধতর করে তুলে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও চিরায়ত মানব সংস্কৃতি যা সত্য, সুন্দরে পরিপূর্ণ তা এক দেশ কিংবা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবে গৃহীত হয়। ইংরেজ কবি কিটস তার বিখ্যাত ‘অড অন অ্যা গ্রেসান আর্ন’ কবিতায় ‘সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য’ এই চিরায়ত দর্শন ব্যবহার করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কথাটি কোন নির্দিষ্ট স্থান-কালের জন্য নয়, বরং তা হলো বিশ্ব সংসারের সম্পদ। বিশ্ব সাহিত্যের মহৎ কর্ম সম্পর্কে জেনে নিজেদের ঋদ্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি জাতি উদগ্রীব থাকে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শনের এ বিনিময় সাধারণত ঘটে থাকে শাশ্বত-সুন্দর, মানবতার জন্য মঙ্গলজনক সাহিত্য, সংস্কৃতি আত্মীকরণের মাধ্যমে। তবে একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করা আবশ্যক তা হলোÑ নিজেদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে অন্যদেশ বা অঞ্চলের সংস্কৃতি গ্রহণ না করা। তা করা হলে জাতীয় সংস্কৃতির দৈন্যতার প্রকাশ ঘটে। কথাগুলো মনের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো বেশ কয়েক বছর থেকে। কেন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো? বেশ কয়েক বছর থেকে লক্ষ্য করছি আমাদের কিছু সংখ্যক মানুষ নিজেদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে ক্রমাগত অন্য অঞ্চলের সংস্কৃতিকে অনাকাক্সিক্ষতভাবে গ্রহণ করে আনন্দ ও গর্ব অনুভব করছেন। এসব কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করলে মন বিষন্নতায় ছেয়ে যায়।

বাঙালির রঙের উৎসব দোল পূর্ণিমা। মূলত বসন্ত ঋতুকে উদযাপনের উৎসব হলো দোল। দোল পূর্ণিমা এখন রীতিমতো ‘হোলি’ হয়ে গেছে। দুই-এক দশক আগেও বাঙালিরা দোল পূর্ণিমাই পালন করতো। সম্প্রতি বাজার সংস্কৃতির ফাঁদে পড়ে কেনাকাটা করতে হয় হোলি উৎসবের। নব-প্রজন্ম দোল পূর্ণিমাকে ‘হোলি’ মনে করে উদযাপন করে যাচ্ছে পুরোদস্তুর। ‘হোলি‘ উৎসবটি হিন্দি বলয় থেকে এমনভাবে বাজারজাত করা হয়েছে যে বিশ্বজুড়ে মানুষ জানে ‘হোলি’ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। হোলির সব চেয়ে বড় আয়োজক ও ভোক্তা ভারত। বাঙালি সংস্কৃতির সাথে বেমানান এ উৎসব পালনের মাধ্যমে ভারতীয় পুঁজিপতিরা তাদের উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। শুধু ভারত নয় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিরা এখন হোলি নামক এই উৎসবটি মহানন্দে পালন করে যাচ্ছেন। আমরা জানি হোলির সাথে সনাতন ধর্মীয় মিথের কিছু সংযোগ আছে। এই মিথকে কেন্দ্র করে বাঙালিরা কখনই হোলি উৎসব পালন করেনি বরঞ্চ শত শত বছর ধরে বাসন্তী পূর্ণিমায় দোল উৎসব উদযাপন করে আসছে। উৎসব উপলক্ষ্যে যে বাজার সৃষ্টি হয়েছে, বাজারটি ইতোমধ্যে ক্রমাগত বড় হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বাজার যতো বড় হচ্ছে, উৎসবও তত রঙে-রূপে বিস্তৃত হচ্ছে। চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতিকে আমরা বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করছি না। আমরা বড়ই উদার। নিজেরা নিঃস্ব হয়ে অন্য সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তুলছি। হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসনের কাছে আমরা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছি। হিন্দি সিনেমা, হিন্দি সিরিয়াল আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে গলধঃকরণ করতে হচ্ছে দ্রুত। হোলির বাজারকে সম্প্রসারিত করতে সহায়তা করছে প্রথমত হিন্দি সিনেমা, হিন্দি ধারাবাহিক নাটক এবং পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা নাটক ও সিনেমা।

বাঙালির অধিকাংশ উৎসব মূলত সংস্কৃতি সংলগ্ন। যতটুকু ধর্মীয় তার থেকে বেশি উৎসব। ধর্ম এবং সংস্কৃতি বিষয়টি এক নয়। অনেকেই ধর্মের সাথে উৎসব বা সংস্কৃতিকে গুলিয়ে ফেলেন। বাঙালির উৎসবগুলো প্রধানত ঋতুভিত্তিক। ঋতুর প্রভাব বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবার ওপর সমানভাবে প্রতিফলিত হয়। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে সব শ্রেণী-ধর্মের মানুষ ছিলেন অংশীজন। ধান কাটা শেষ হলে নতুন ধানের চাল দিয়ে নবান্ন হয়।

অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হওয়ার কারণে আনন্দ উদযাপন ছিলো সীমিত। তাই ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ ঋতুভিত্তিক এরকম উৎসব পালন করতো এবং এখনও করে থাকে। নববর্ষ, নবান্ন, দোল পূর্ণিমা, বসন্তবরণ, শারদোৎসব, বর্ষাবন্দনা এগুলো হলো বাঙালির একান্ত ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। বসন্তে প্রকৃতির বিচিত্র রঙের সাজ বাঙালির মনকে উন্মন করে তোলে। বাঙালি উদ্বুদ্ধ হয় রঙের উৎসব আয়োজনে। রবীন্দ্রনাথের বড় পছন্দের উৎসব ছিলো দোল। বাংলাতে তখনও হোলি ‘বাজারজাত’ হয়নি। হোলি উদযাপন করে মানুষ মেকি ‘স্মার্ট’ হয়ে ওঠেনি তখনও। বসন্তে প্রকৃতির উজ্জ্বল রঙ, রূপ রবীন্দ্রনাথকে উন্মন করে তুলতো। ওরে গৃহবাসী গানের কিছু পঙ্ক্তি পড়লে বা শুনলে আমাদের মনেও রঙের ছোপ এসে স্পর্শ করে। ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল। /স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল। ....../রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে/রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে/নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল/দ্বার খোল্, দ্বার খোল্।

এরকম গীতি কবিতা যখন সুরের খেয়ায় ভাসে তখন উৎসবের রঙ এসে মর্মে লাগে। এই মর্মে এসে যে রঙ লাগে তা নিয়েও রবিঠাকুর গান লিখেছেনÑ ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে/ সন্ধ্যা দীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে’। এ রকম রঙের খেলা বাংলার প্রকৃতি ছাড়া আর কোথাও আছে কী-না আমার জানা নেই। রবীন্দ্র যুগে তো আমরা হোলির নাম শুনতে পাইনি। ঋতুভিত্তিক নবান্নের মতো অন্য উৎসবও যেনো আবার হিন্দি বলয়ের বাজার কেড়ে না নেয়, এ বিষয়ে আমাদের কতোটুকু সচেতনতা আছে আমারা জানি না। যেমন ইংরেজি সংস্কৃতি কেড়ে নিয়েছে আমাদের অনেক কিছু। আমাদের উৎসব, ইতিহাস, মূল্যবোধ। তারাপদ রায় এই সর্বনাশের কথা খুব সুন্দর করে বলেছিলেনÑ

‘আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম

যার উদ্দেশ্যে ধ্রুপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশস্তি লিখেছিলাম

গতকাল বলাই বাবু বললেন, ‘ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ’...

আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন

আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।

আমরা বুঝতে পারিনি

আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।’

সর্বনাশের কতোটুকু অবশিষ্ট আছে জানা নেই। বাংলা ও বাঙালির সাথে সামঞ্জস্যহীন সংস্কৃতি প্রথমত বাজারজাত করা হয় ভারতের হিন্দি বলয় থেকে। পশ্চিমবঙ্গের কিছু উদার বাংলাভাষী নিজেদের মেকি ভদ্রলোক সাজাবার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে চটকদার, কৃত্রিম সংস্কৃতির চর্চা করে নিজেরা পরিতৃপ্ত হন। (ক্ষমা চাচ্ছি তাদের কাছে যারা ওপারে বাংলা সংস্কৃতির জাগরণ নিয়ে কাজ করছেন এবং বাংলা সংস্কৃতিকে ভালোবাসেন)। গঙ্গা পেরিয়ে পদ্মা, তিস্তা দিয়ে এসব সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এখানেও ‘তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে’ জাতীয় কিছু মানুষ আছেন; যারা নির্দ্বিধায় বোনের জামাইকে ‘জামাইবাবু’ ‘দুলাভাই’ ‘দাদা’, ‘ভাই’ সম্বোধন না করে নির্লজ্জের মতো ‘জিজু’ বলে সম্বোধন করে পরম আনন্দ ও সম্মান লাভ করেন। আমাদের গায়েহলুদ ইতোমধ্যে ‘হলদে নাইট’ বা কেমন জানি বিকৃত উচ্চারণে ‘হালদে’ হয়ে গেছে। দীপান্বিতা ‘দিওয়ালি’ হয়ে গেছে রাতারাতি। ‘দিওয়ালি’ হলো বাজার সংস্কৃতির সব চেয়ে বড় ক্ষেত্র। হোলি এবং ‘দিওয়ালি’ কোনটার বাজার বড় সেটি মার্কেটিং নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা ভালো বলতে পারবেন। আমাদের আপাত নিরীহ অনিন্দ্য সুন্দর দ্বীপান্বিতা আজ ভূপতিত ‘দিওয়ালির’ কাছে। আমরা দ্বীপান্বিতাকে হারিয়ে ফেলেছি নির্দ্বিধায় যেমন হারিয়েছি দোল পূর্ণিমাকে।

আমরা কী জানি আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির আর একটি অনুষঙ্গ বিয়ের গীত ইতোমধ্যে প্রায় উবে গেছে বাংলা সংস্কৃতির পরিম-ল থেকে। গ্রামে-গঞ্জে গীত গাওয়ার মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া ভার। স্যাটেলাইট সংস্কৃতির প্রবল চাপে পড়ে নিরীহ গীত প্রায় মৃত। গ্রামীণ গীতি কবি কেনো লিখবেন বিয়ের গীত, কে সুরারোপ করবেন, কাদের দ্বারা গীত হবে। বাঙালির বিয়ের গান ‘হলুদ বাটো, মরিচ বাটো...’ ছাড়া একসময় পূর্ব এবং পশ্চিম বঙ্গের বিয়ের অনুষ্ঠান পরিপূর্ণ হতো না। সেই গানগুলোকে আমরা ‘সঙ্গতের’ গানের কাছে সমর্পিত করেছি। এখন হিন্দি গানের চাপে, ইংলিশ র‌্যাপ মিউজিকের ভাপে, বাংলা মেটাল সঙ্গীতের নিচে পড়ে ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গানকে বলতে হচ্ছে ‘...দিনতো গেলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে।’ আহা, বাঙালি, আর কতো উদারতা প্রদর্শন করবে! রাজার গায়ের কাপড়ের মতো দুর্দশা হয়ে গেছে। রাজা ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে পারছেন না রাজা বস্ত্র পরিধান করে আছেন।

নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে, এর উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। বাজার সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করতে পারে কেবল উৎকৃষ্ট সাহিত্য, সংস্কৃতি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন না করলে এটি কোনভাবেই সম্ভব নয়। ঐতিহ্যবাহী গৌরবময় সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে দেশে বিদেশে আমাদের অনিন্দ্য সুন্দর সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে পারি। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের বাইরেও এখন বাংলাদেশ আছে। সারা বিশ্বের কোণে কোণে বাঙালিরা ছোট ছোট বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে। এখন শুধু লন্ডন নয়, প্যারিস, নিউইয়র্ক, টরন্টোর মতো অসংখ্য শহর আছে যেখানে বাঙালিরা স্থায়ী আবাস গড়ে তুলছেন। দেশে বিদেশে নিরন্তর সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন করতে পারি এবং এর মধ্য দিয়ে ভিন্ন রূপে তৈরি হওয়া ভাষা, সংস্কৃতির ওপর হুমকি রোধ করতে পারি। প্রয়োজন আমাদের আন্তরিক প্রয়াস।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top