বাবুল রবিদাস
ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ভারতে দলিত জাগরণের অগ্রদূত। নিম্নবর্গের মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি বর্ণ বৈষম্য, অস্পৃশ্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। দীর্ঘ সময় একাই লড়াই করে গেছেন তিনি। মননশীল রাজনৈতিক সাহিত্যেও তার অবদান বিপুল। ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল তার জন্ম। ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর মৃত্যু।
আম্বেদকর নিজেও অস্পৃশ্য সমাজের একজন ছিলেন। তার জন্ম মধ্য প্রদেশের (বোম্বে প্রভিন্স) মাহার সম্প্রদায়ে। পূর্ব পুরুষরা ছিলেন মহারাষ্ট্রের। মাহার হয়ে ঘোড়ারগাড়িতে চড়ায় গাড়োয়ান তাকে নামিয়ে দিয়েছিলো এবং গাড়িকে অপবিত্র করায় গালিগালাজ করেছিলো। স্থানীয় এক পুকুরে তাকে গোসল করতে দেয়া হতো না, কারণ জল অপবিত্র হয়ে যাবে বলে। স্কুলে শিক্ষকরা আম্বেদকরের বই-খাতা স্পর্শ করতেন না। মাহারদের সেই সময় ঘণ্টা বাজিয়ে রাস্তায় চলতে হতো, যাতে তথাকথিত ‘উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অপবিত্র হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পূর্বাহ্নে দূরে সরে যেতে পারে।’
তাতেও কিন্তু থামেননি আম্বেদকর। তিনিই প্রথম উপমহাদেশের দলিতদের মেরুদ- শক্ত করে দাঁড়ানোর প্রেরণা জুগিয়েছেন। রাজনৈতিক পরিম-লের বাইরে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের যে ধারা আজকে আমরা দেখি এ অঞ্চলে তার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আম্বেদকর।
ভারতে প্রথম দলিত গ্র্যাজুয়েট তিনি। পরবর্তীকালে পড়েছেন এবং গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংল্যান্ডের লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকসে। আজ ভারতে তার নামে অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আম্বেদকর ছিলেন একই সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবীদ। ভারতে ১৬ খ-ে আম্বেদকরের রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে। এসব রচনার একটি প্রধান বৈশিষ্ট হলো- তিনি কখনো বিমূর্ত কোন আলোচনা করেননি। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এ অঞ্চল থেকে বর্ণ বৈষম্য, অস্পৃশ্য ও শোষণ নির্মূল করা দরকার। এই ছিল তার মৌলিক বক্তব্য। এই বক্তব্য যে কত যথার্থ ছিল আজকের দেশে ও বিদেশে তার প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়।
ভারতে আম্বেদকর প্রথম গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। আম্বেদকর বলতেন, দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজ বিকাশের শত্রু হলো ব্রাহ্মণ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ। এই বক্তব্যের মাধ্যমে একদিকে বুর্জোয়া উদারপন্থি চিন্তাবিদদের চেয়েও তিনি নিজেকে অগ্রসর প্রমাণ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় বুর্জোয়া উদারপন্থিরা সামন্তবাদের বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে ততটা নন। আবার পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের পাশাপাশি ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদের কুফল সম্পর্কে সতর্কভাবনার কারণে মার্কসবাদীদের চেয়েও আম্বেদকরের ভাবনার স্বচ্ছতার প্রমাণ মেলে। ভারতীয় সমাজে কেবল পুঁজিবাদই সমস্যা নয়, এখানে পুঁজিবাদ-ব্রাহ্মণ্যবাদ যৌথভাবে মানবমুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আম্বেদকর ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’ বলতে বুঝিয়েছেন যারা ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব’কে ভয় পায়, অস্বীকার করে।
প্রাচ্যের সমাজে জাত ব্যবস্থার অন্যতম প্রতিকার হিসেবে আম্বেদকর ইন্টার-কাস্ট ম্যারেজের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আজকের সমাজ বিশ্লেষকরাও মনে করেন এটা একা বড় সমাধান। তবে পাশাপাশি আম্বেদকর এটাও মনে করতেন, আমাদের শাস্ত্র শাসিত মন যতদিন না পাল্টাবে, ততদিন না আমরা যুক্তি ও নীতিরোধ দ্বারা চালিত হবো- ততদিন সামাজিক দুষ্টব্যাধি যাবে না। আম্বেদকরের এই ‘যুক্তি ও নীতিবোধ’ তত্ত্বের ওপরই গড়ে উঠেছে দলিত সাহিত্য; যা আজ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে একটি প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ নিতে চলেছে।
আমাদের দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদেরও আম্বেদকরের ভাবনার প্রতি মনযোগ দেয়া জরুরি। কারণ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দলিতরা যে একটি পৃথক সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তা এটা গান্ধীবাদ ও মার্কসবাদের চেয়েও অগ্রসরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে আম্বেদকরের মতবাদে।
[লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ভারতে দলিত জাগরণের অগ্রদূত। নিম্নবর্গের মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি বর্ণ বৈষম্য, অস্পৃশ্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। দীর্ঘ সময় একাই লড়াই করে গেছেন তিনি। মননশীল রাজনৈতিক সাহিত্যেও তার অবদান বিপুল। ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল তার জন্ম। ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর মৃত্যু।
আম্বেদকর নিজেও অস্পৃশ্য সমাজের একজন ছিলেন। তার জন্ম মধ্য প্রদেশের (বোম্বে প্রভিন্স) মাহার সম্প্রদায়ে। পূর্ব পুরুষরা ছিলেন মহারাষ্ট্রের। মাহার হয়ে ঘোড়ারগাড়িতে চড়ায় গাড়োয়ান তাকে নামিয়ে দিয়েছিলো এবং গাড়িকে অপবিত্র করায় গালিগালাজ করেছিলো। স্থানীয় এক পুকুরে তাকে গোসল করতে দেয়া হতো না, কারণ জল অপবিত্র হয়ে যাবে বলে। স্কুলে শিক্ষকরা আম্বেদকরের বই-খাতা স্পর্শ করতেন না। মাহারদের সেই সময় ঘণ্টা বাজিয়ে রাস্তায় চলতে হতো, যাতে তথাকথিত ‘উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অপবিত্র হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পূর্বাহ্নে দূরে সরে যেতে পারে।’
তাতেও কিন্তু থামেননি আম্বেদকর। তিনিই প্রথম উপমহাদেশের দলিতদের মেরুদ- শক্ত করে দাঁড়ানোর প্রেরণা জুগিয়েছেন। রাজনৈতিক পরিম-লের বাইরে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের যে ধারা আজকে আমরা দেখি এ অঞ্চলে তার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আম্বেদকর।
ভারতে প্রথম দলিত গ্র্যাজুয়েট তিনি। পরবর্তীকালে পড়েছেন এবং গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংল্যান্ডের লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকসে। আজ ভারতে তার নামে অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আম্বেদকর ছিলেন একই সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবীদ। ভারতে ১৬ খ-ে আম্বেদকরের রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে। এসব রচনার একটি প্রধান বৈশিষ্ট হলো- তিনি কখনো বিমূর্ত কোন আলোচনা করেননি। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এ অঞ্চল থেকে বর্ণ বৈষম্য, অস্পৃশ্য ও শোষণ নির্মূল করা দরকার। এই ছিল তার মৌলিক বক্তব্য। এই বক্তব্য যে কত যথার্থ ছিল আজকের দেশে ও বিদেশে তার প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়।
ভারতে আম্বেদকর প্রথম গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। আম্বেদকর বলতেন, দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজ বিকাশের শত্রু হলো ব্রাহ্মণ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ। এই বক্তব্যের মাধ্যমে একদিকে বুর্জোয়া উদারপন্থি চিন্তাবিদদের চেয়েও তিনি নিজেকে অগ্রসর প্রমাণ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় বুর্জোয়া উদারপন্থিরা সামন্তবাদের বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে ততটা নন। আবার পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের পাশাপাশি ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদের কুফল সম্পর্কে সতর্কভাবনার কারণে মার্কসবাদীদের চেয়েও আম্বেদকরের ভাবনার স্বচ্ছতার প্রমাণ মেলে। ভারতীয় সমাজে কেবল পুঁজিবাদই সমস্যা নয়, এখানে পুঁজিবাদ-ব্রাহ্মণ্যবাদ যৌথভাবে মানবমুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আম্বেদকর ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’ বলতে বুঝিয়েছেন যারা ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব’কে ভয় পায়, অস্বীকার করে।
প্রাচ্যের সমাজে জাত ব্যবস্থার অন্যতম প্রতিকার হিসেবে আম্বেদকর ইন্টার-কাস্ট ম্যারেজের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আজকের সমাজ বিশ্লেষকরাও মনে করেন এটা একা বড় সমাধান। তবে পাশাপাশি আম্বেদকর এটাও মনে করতেন, আমাদের শাস্ত্র শাসিত মন যতদিন না পাল্টাবে, ততদিন না আমরা যুক্তি ও নীতিরোধ দ্বারা চালিত হবো- ততদিন সামাজিক দুষ্টব্যাধি যাবে না। আম্বেদকরের এই ‘যুক্তি ও নীতিবোধ’ তত্ত্বের ওপরই গড়ে উঠেছে দলিত সাহিত্য; যা আজ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে একটি প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ নিতে চলেছে।
আমাদের দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদেরও আম্বেদকরের ভাবনার প্রতি মনযোগ দেয়া জরুরি। কারণ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দলিতরা যে একটি পৃথক সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তা এটা গান্ধীবাদ ও মার্কসবাদের চেয়েও অগ্রসরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে আম্বেদকরের মতবাদে।
[লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, জয়পুরহাট]