alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

শঙ্কর প্রসাদ দে

: সোমবার, ১৫ জুলাই ২০২৪

বিবর্তনবাদ এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা সর্বপ্রথম ডারউইন উত্থাপন করেছেন এমনটি নয়। খ্রিস্টপূর্ব সময়ে দুটো মতবাদের একটি ছিল (১) এসেন্সিয়ালিজম অর্থাৎ প্রতিটি প্রজাতির কিছু অপরিহার্য্য বৈশিষ্ট্য থাকে যা অপরিবর্তনীয়। এই মতবাদ ধর্মীয় বক্তব্যের অনুরূপ (২) প্রজাতির উৎপত্তি নিতান্ত প্রাকৃতিক। ঠিক পদার্থবিদ্যা ও অ্যানাক্সিমান্দ্রোসের অসীম বিশ^তত্ত্বের মতো। লামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯) উত্থাপন করলেন ট্রান্সমিউটেশন অব স্পিসিস বা প্রাণের ‘রূপান্তরবাদ’। অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়মে বিবর্তন ঘটেই চলেছে।

১৭৯৮ সালে ম্যালথাস বললেন, জন্ম-মৃত্যুতে ঈশ^রের হাত নেই বরং খাদ্য ও জনসংখ্যার মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হলে প্রকৃতিই দুর্ভিক্ষ খরা জলোচ্ছ্বাসের মাধ্যমে জনসংখ্যা কত থাকবে তা ঠিক করে দেয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা ডারউইন, লামার্ক ও ম্যালথাস দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। বিশেষ করে ম্যালথাসের বক্তব্যের প্রাকৃতির নির্বাচন পদ্ধতি তাকে ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে সুযোগ করে দিয়েছে।

ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে নমুনা সংখ্যা ৩৫ মিলিয়ন- (১) গাছপালা, (২) প্রাণী, (৩) ছত্রাক, (৪) জীবাশ্ম, (৫) খনিজ পদার্থ, (৬) শিলা, (৭) উল্কাপি-, (৮) মানব দেহাবশেষ, (৯) মানব সাংস্কৃতিক নিদর্শন, (১০) হিমায়িত টিস্যুর সামান্য কতেক প্রকার মাত্র। দ্বিতীয়তলার আফ্রিকান স্তন্যপায়ী হলের সাথে আফ্রিকান পিপলস হলটি সংযুক্ত। রেপ্লিকা দেখে বুঝলাম, আঙ্গোলার দৈত্যাকার সাবল হরিণ, কঙ্গোর ওকাপি, লিবিয়ান অ্যাডাক্স এখন আর দেখা যায় না। আফ্রিকা মহাদেশে বহু প্রাণী প্রকৃতির নির্বাচনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিভু পর্বতের পাহাড়ি গরিলা, ইয়েল নদীর সাদা গ-ার, ভিক্টোরিয়ান সিংহ চরম বিপন্ন প্রজাতি। প্রকৃতির নির্বাচনে এরা যে কোন মুহূর্তে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে পারে।

সুমাত্রার গ-ার, এশিয়াটিক সিংহ একসময় বিলুপ্তির মুখোমুখি হয়েছিল। বাংলাদেশের গভীর অরণ্যে একসময় সিংহ ছিল অথচ আজ নেই। প্রাচীন বঙ্গে গাধা ছিল, আজ আর নেই। আমাদের বাড়ির আশপাশে চিতাবাঘ ছোটবেলায় নিজে দেখেছি। দ্রুত বসতি গড়ে উঠায় সীতাকুন্ড পাহাড় থেকে নেকড়ে, চিতাবাঘ ও হায়েনা আজ বিলুপ্ত। বনভূমি উজাড় হওয়ায় কেনিয়ান হরিণও আজ বিলুপ্তির পথে। প্রকৃতিকে আমরা এমনভাবে ধ্বংস করেছি, এদের খাদ্যে অভাব বংশবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। খাদ্যের অভাবে হায়েনা, চিতাবাঘের মতো প্রাণী সীতাকুন্ড পাহাড় থেকে বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। এশিয়ান হলে প্রদর্শিত হুলক গিবন, বড় সিংহ, মানস নদীর বন্য জল মহিষ, সুমাত্রান গ-ার, হগ হরিণ, এশিয়াটিক সিংহ হারিয়ে গেছে অনেক আগে।

এশিয়ান হলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম হারিয়ে যাওয়া এসব প্রাণীসহ কতই না ভরপুর ছিল এশিয়ান বনজঙ্গল। বন্য শূকর, বন মোরগ, হরিণ, শেয়ালসহ অনেক প্রাণী টিকে আছে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে জিতেছে বলে। আবার প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে অনেক প্রাণী হারিয়ে গেছে চিরতরে। সিংহের মতো বিপন্ন প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। কারণ ওদের খাদ্যাভাব প্রকৃতির সর্বশেষ পরিস্থিতির সাথে যায় না। ওরা বিলুপ্ত হতে বাধ্য। এটাই ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন।

ডারউইনের অন্যতম বক্তব্য হলো ন্যাচারাল সিলেকশনে টিকতে গিয়ে অনেক প্রজাতি নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়। তার এই বক্তব্যই সবচেয়ে বেশি হৈচৈয়ের জন্ম দিয়েছে। যদিও কোন প্রজাতি বিবর্তনের ফলে উন্নত বা অধো (নিম্ন) প্রজাতিতে পরিবর্তিত হওয়ার পরিষ্কার বক্তব্য দিয়েছেন মুসলিম মনীষী আল জাহিজ। তিনি জন্মেছেন ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বসরা শহরে। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য বুক অফ অ্যানিমেলসে’ বলেছেনÑ ‘নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবেশের নানা কারণে প্রাণীরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এভাবেই তারা নতুন নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।’ বিজ্ঞানীরা একমত আল-জাহিজের সার্থক উত্তরসুরি হলেন লামার্ক-ডারউইন-ওয়ালেস। অবশ্য আল-জাহিজের এই বৈপ্লবিক মতবাদের স্বীকৃতির জন্য মানবজাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১০০০ বছর।

ছোটবেলায় মুখে মুখে শুনতাম, বানর থেকে মানুষ হয়েছে। উত্তর আমেরিকান স্তন্যপায়ী হলে অপেক্ষাকৃত কম প্রাণীর ফসিল। আমেরিকান স্যাম্পল বা স্মারকগুলোর বেশিরভাগ বরফ যুগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমেরিকায় এখনো বছরের ৯ মাস শীত। ডিসেম্বরে মাইনাস ডিগ্রি দেখে এসেছি। শুনেছি এপ্রিল মে মাসে আমাদের মাঘ মাসের মতো ১০-১২ ডিগ্রির শীত। সামার বড় জোর বছরে ৪ মাস। বিরূপ প্রকৃতির কারণে দুই আমেরিকা মহাদেশে এশিয়া আফ্রিকার মতো করে প্রাণীজগতের বিচিত্র বিকাশ সম্ভব হয়নি।

প্রথমতলার হল অব হিউম্যান অরিজিনস না দেখলে আল জাহিজ-লামার্ক-ডারউইন-ওয়ালেস প্রস্তাবিত মানব বিবর্তন বুঝতে পারতাম না। মানব বর্তমান অবস্থার ইতিহাস নিম্নরূপÑ (১) অস্ট্রালোপিথেকাস, (২) হোমো এর গাস্টার, (৩) নিয়ান্ডারথান, (৪) ক্রোম্যাগনন এবং অতঃপর হোমো যুগ। হোমো সেপিয়েন্সের অনেক শাখাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। টিকে আছি শুধু আজকের মানব প্রজাতি। ইথিওপিয়ায় পাওয়া খুলিটি ১ লাখ ৬০ হাজার বছর আগের। এই খুলিতে আধুনিক মানুষ বা নিয়ান্ডারথানের কোন উপাদান পাওয়া যায়নি।

সুতরাং এটি হোমো সেপিয়েন্সের একটি বিলুপ্ত শাখা। নিয়ান্ডারথালের আগে ছিল হোমো ইরেক্টাস। এদের জীবাশ্ম এখনো পাওয়া যায় এবং মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে। ক্রান্তীয় অঞ্চল ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় ইরেক্টাসরা থাকলেও আনুমানিক ২ লাখ বছর পূর্বে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ইরেক্টাসদের সমসাময়িক আরেকটি হোমো গ্রুপের নাম হোমো হ্যাবিলিস। জার্মানির সেনকেনবার্গের জাদুঘরে রক্ষিত হ্যাবিলিসের একটি খুলি থেকে বুঝা গেছে ১.৬৫ বিলিয়ন বছর আগে এই হোমো প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অস্ট্রালোপিথেকাসরা ২০ লাখ বছর পূর্বে আফ্রিকায় বাস করত। এই প্রজাতির অনেক খন্ড জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। এই গ্যালারিতেও রেপ্লিকা প্রদর্শিত হচ্ছে। দুই ধরনের আর্ডিপিথেকাসের জীবাশ্ম থেকে ধারণা করা হচ্ছে এরাই হোমো গ্রুপের, একেবারে প্রাথমিক মানবসদৃশ প্রজাতি ছিল। ৪৪ লাখ বছর আগে এই প্রজাতি বিলুপ্তি হয়ে গেছে।

স্তন্যপায়ী প্রদর্শনী, পাখি, সরীসৃপ এবং উভচর প্রদর্শনী, জীববৈচিত্র্য প্রদর্শনী ও মানুষের উৎপত্তির সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী দেখতে দেখতে যে কেউ ভাবতে পারেন একদিনে যে সবকিছু দেখা হলো না। আসলে বাস্তবতাও তাই। নিজেও ভেবেছি আরেক দিন আসতে পারলে ভালো হতো। সময়ের স্বল্পতায় অনেকের জন্য এটা সম্ভব হবে না। আবার এটাও তো ঠিক জীবনভর বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে কত ভুল বক্তব্যই না শুনে এসেছি। ভুল ভাঙলো শেষ বয়সে এসে। বিবর্তনের মাধ্যমে বানর বা শিম্পাঞ্জি বা গরিলা থেকে মানুষের উৎপত্তি সঠিক নয়। বুঝলাম, টিকে থাকতে গিয়ে বাঘ প্রজাতি বহু ভাগে বিভক্ত হয়েছে। ঘুঘু বা বক বা অন্য পাখি বিভক্ত হয়েছে সর্বত্র। এদের অনেক হারিয়ে গেছে মহাকালের গভীর অন্ধকারে। হাতির কথাই বলুন। এতো বিশাল দেহ নিয়ে খাদ্যের অভাবে কতদিন টিকে থাকতে পারবে বুঝা মুশকিল। ইউরোপে ইতোমধ্যে হাতি বিলুপ্তির দোরগোড়ায়।

আমরা মানুষ, হোমো সেপিয়েন্স গ্রুপের সর্বশেষ প্রজাতি। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে টিকে গেছি। হয়তো দূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আমরাও গণবিলুপ্তির শিকার হবো। শুরু হবে প্রাণের নতুন বিকাশ। নতুন প্রতিযোগিতা, নতুন নতুন প্রজাতির সৃষ্টি। ইহারই নাম বিবর্তনবাদ ও প্রাকৃতিক নির্বাচন। সভ্যতার সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের শ্রেষ্ঠতম একটি হলো আল জাহিজ-লামার্ক-ডারউইন-ওয়ালেসের বিবর্তনবাদ।

[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

মব সংস্কৃতি, ন্যায়বিচারের সংকট ও সমাজের আত্মক্ষয়

শীতকালীন জীবন: সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও সহমর্মিতা

অ্যালগরিদমের রাজনীতি

চারদিকে আতঙ্ক আর শঙ্কা

অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই

দিপু দাস হত্যাকাণ্ড ও মব সন্ত্রাস

ভোগের দৃশ্যপট: ঢাকায় আধুনিকতা কেন কেবল অল্প কিছু মানুষের জন্য?

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

বিনা-ভাড়ার ট্রেনযাত্রা

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

শঙ্কর প্রসাদ দে

সোমবার, ১৫ জুলাই ২০২৪

বিবর্তনবাদ এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা সর্বপ্রথম ডারউইন উত্থাপন করেছেন এমনটি নয়। খ্রিস্টপূর্ব সময়ে দুটো মতবাদের একটি ছিল (১) এসেন্সিয়ালিজম অর্থাৎ প্রতিটি প্রজাতির কিছু অপরিহার্য্য বৈশিষ্ট্য থাকে যা অপরিবর্তনীয়। এই মতবাদ ধর্মীয় বক্তব্যের অনুরূপ (২) প্রজাতির উৎপত্তি নিতান্ত প্রাকৃতিক। ঠিক পদার্থবিদ্যা ও অ্যানাক্সিমান্দ্রোসের অসীম বিশ^তত্ত্বের মতো। লামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯) উত্থাপন করলেন ট্রান্সমিউটেশন অব স্পিসিস বা প্রাণের ‘রূপান্তরবাদ’। অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়মে বিবর্তন ঘটেই চলেছে।

১৭৯৮ সালে ম্যালথাস বললেন, জন্ম-মৃত্যুতে ঈশ^রের হাত নেই বরং খাদ্য ও জনসংখ্যার মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হলে প্রকৃতিই দুর্ভিক্ষ খরা জলোচ্ছ্বাসের মাধ্যমে জনসংখ্যা কত থাকবে তা ঠিক করে দেয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা ডারউইন, লামার্ক ও ম্যালথাস দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। বিশেষ করে ম্যালথাসের বক্তব্যের প্রাকৃতির নির্বাচন পদ্ধতি তাকে ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে সুযোগ করে দিয়েছে।

ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে নমুনা সংখ্যা ৩৫ মিলিয়ন- (১) গাছপালা, (২) প্রাণী, (৩) ছত্রাক, (৪) জীবাশ্ম, (৫) খনিজ পদার্থ, (৬) শিলা, (৭) উল্কাপি-, (৮) মানব দেহাবশেষ, (৯) মানব সাংস্কৃতিক নিদর্শন, (১০) হিমায়িত টিস্যুর সামান্য কতেক প্রকার মাত্র। দ্বিতীয়তলার আফ্রিকান স্তন্যপায়ী হলের সাথে আফ্রিকান পিপলস হলটি সংযুক্ত। রেপ্লিকা দেখে বুঝলাম, আঙ্গোলার দৈত্যাকার সাবল হরিণ, কঙ্গোর ওকাপি, লিবিয়ান অ্যাডাক্স এখন আর দেখা যায় না। আফ্রিকা মহাদেশে বহু প্রাণী প্রকৃতির নির্বাচনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিভু পর্বতের পাহাড়ি গরিলা, ইয়েল নদীর সাদা গ-ার, ভিক্টোরিয়ান সিংহ চরম বিপন্ন প্রজাতি। প্রকৃতির নির্বাচনে এরা যে কোন মুহূর্তে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে পারে।

সুমাত্রার গ-ার, এশিয়াটিক সিংহ একসময় বিলুপ্তির মুখোমুখি হয়েছিল। বাংলাদেশের গভীর অরণ্যে একসময় সিংহ ছিল অথচ আজ নেই। প্রাচীন বঙ্গে গাধা ছিল, আজ আর নেই। আমাদের বাড়ির আশপাশে চিতাবাঘ ছোটবেলায় নিজে দেখেছি। দ্রুত বসতি গড়ে উঠায় সীতাকুন্ড পাহাড় থেকে নেকড়ে, চিতাবাঘ ও হায়েনা আজ বিলুপ্ত। বনভূমি উজাড় হওয়ায় কেনিয়ান হরিণও আজ বিলুপ্তির পথে। প্রকৃতিকে আমরা এমনভাবে ধ্বংস করেছি, এদের খাদ্যে অভাব বংশবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। খাদ্যের অভাবে হায়েনা, চিতাবাঘের মতো প্রাণী সীতাকুন্ড পাহাড় থেকে বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। এশিয়ান হলে প্রদর্শিত হুলক গিবন, বড় সিংহ, মানস নদীর বন্য জল মহিষ, সুমাত্রান গ-ার, হগ হরিণ, এশিয়াটিক সিংহ হারিয়ে গেছে অনেক আগে।

এশিয়ান হলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম হারিয়ে যাওয়া এসব প্রাণীসহ কতই না ভরপুর ছিল এশিয়ান বনজঙ্গল। বন্য শূকর, বন মোরগ, হরিণ, শেয়ালসহ অনেক প্রাণী টিকে আছে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে জিতেছে বলে। আবার প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে অনেক প্রাণী হারিয়ে গেছে চিরতরে। সিংহের মতো বিপন্ন প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। কারণ ওদের খাদ্যাভাব প্রকৃতির সর্বশেষ পরিস্থিতির সাথে যায় না। ওরা বিলুপ্ত হতে বাধ্য। এটাই ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন।

ডারউইনের অন্যতম বক্তব্য হলো ন্যাচারাল সিলেকশনে টিকতে গিয়ে অনেক প্রজাতি নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়। তার এই বক্তব্যই সবচেয়ে বেশি হৈচৈয়ের জন্ম দিয়েছে। যদিও কোন প্রজাতি বিবর্তনের ফলে উন্নত বা অধো (নিম্ন) প্রজাতিতে পরিবর্তিত হওয়ার পরিষ্কার বক্তব্য দিয়েছেন মুসলিম মনীষী আল জাহিজ। তিনি জন্মেছেন ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বসরা শহরে। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য বুক অফ অ্যানিমেলসে’ বলেছেনÑ ‘নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবেশের নানা কারণে প্রাণীরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এভাবেই তারা নতুন নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।’ বিজ্ঞানীরা একমত আল-জাহিজের সার্থক উত্তরসুরি হলেন লামার্ক-ডারউইন-ওয়ালেস। অবশ্য আল-জাহিজের এই বৈপ্লবিক মতবাদের স্বীকৃতির জন্য মানবজাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১০০০ বছর।

ছোটবেলায় মুখে মুখে শুনতাম, বানর থেকে মানুষ হয়েছে। উত্তর আমেরিকান স্তন্যপায়ী হলে অপেক্ষাকৃত কম প্রাণীর ফসিল। আমেরিকান স্যাম্পল বা স্মারকগুলোর বেশিরভাগ বরফ যুগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমেরিকায় এখনো বছরের ৯ মাস শীত। ডিসেম্বরে মাইনাস ডিগ্রি দেখে এসেছি। শুনেছি এপ্রিল মে মাসে আমাদের মাঘ মাসের মতো ১০-১২ ডিগ্রির শীত। সামার বড় জোর বছরে ৪ মাস। বিরূপ প্রকৃতির কারণে দুই আমেরিকা মহাদেশে এশিয়া আফ্রিকার মতো করে প্রাণীজগতের বিচিত্র বিকাশ সম্ভব হয়নি।

প্রথমতলার হল অব হিউম্যান অরিজিনস না দেখলে আল জাহিজ-লামার্ক-ডারউইন-ওয়ালেস প্রস্তাবিত মানব বিবর্তন বুঝতে পারতাম না। মানব বর্তমান অবস্থার ইতিহাস নিম্নরূপÑ (১) অস্ট্রালোপিথেকাস, (২) হোমো এর গাস্টার, (৩) নিয়ান্ডারথান, (৪) ক্রোম্যাগনন এবং অতঃপর হোমো যুগ। হোমো সেপিয়েন্সের অনেক শাখাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। টিকে আছি শুধু আজকের মানব প্রজাতি। ইথিওপিয়ায় পাওয়া খুলিটি ১ লাখ ৬০ হাজার বছর আগের। এই খুলিতে আধুনিক মানুষ বা নিয়ান্ডারথানের কোন উপাদান পাওয়া যায়নি।

সুতরাং এটি হোমো সেপিয়েন্সের একটি বিলুপ্ত শাখা। নিয়ান্ডারথালের আগে ছিল হোমো ইরেক্টাস। এদের জীবাশ্ম এখনো পাওয়া যায় এবং মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে। ক্রান্তীয় অঞ্চল ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় ইরেক্টাসরা থাকলেও আনুমানিক ২ লাখ বছর পূর্বে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ইরেক্টাসদের সমসাময়িক আরেকটি হোমো গ্রুপের নাম হোমো হ্যাবিলিস। জার্মানির সেনকেনবার্গের জাদুঘরে রক্ষিত হ্যাবিলিসের একটি খুলি থেকে বুঝা গেছে ১.৬৫ বিলিয়ন বছর আগে এই হোমো প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অস্ট্রালোপিথেকাসরা ২০ লাখ বছর পূর্বে আফ্রিকায় বাস করত। এই প্রজাতির অনেক খন্ড জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। এই গ্যালারিতেও রেপ্লিকা প্রদর্শিত হচ্ছে। দুই ধরনের আর্ডিপিথেকাসের জীবাশ্ম থেকে ধারণা করা হচ্ছে এরাই হোমো গ্রুপের, একেবারে প্রাথমিক মানবসদৃশ প্রজাতি ছিল। ৪৪ লাখ বছর আগে এই প্রজাতি বিলুপ্তি হয়ে গেছে।

স্তন্যপায়ী প্রদর্শনী, পাখি, সরীসৃপ এবং উভচর প্রদর্শনী, জীববৈচিত্র্য প্রদর্শনী ও মানুষের উৎপত্তির সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী দেখতে দেখতে যে কেউ ভাবতে পারেন একদিনে যে সবকিছু দেখা হলো না। আসলে বাস্তবতাও তাই। নিজেও ভেবেছি আরেক দিন আসতে পারলে ভালো হতো। সময়ের স্বল্পতায় অনেকের জন্য এটা সম্ভব হবে না। আবার এটাও তো ঠিক জীবনভর বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে কত ভুল বক্তব্যই না শুনে এসেছি। ভুল ভাঙলো শেষ বয়সে এসে। বিবর্তনের মাধ্যমে বানর বা শিম্পাঞ্জি বা গরিলা থেকে মানুষের উৎপত্তি সঠিক নয়। বুঝলাম, টিকে থাকতে গিয়ে বাঘ প্রজাতি বহু ভাগে বিভক্ত হয়েছে। ঘুঘু বা বক বা অন্য পাখি বিভক্ত হয়েছে সর্বত্র। এদের অনেক হারিয়ে গেছে মহাকালের গভীর অন্ধকারে। হাতির কথাই বলুন। এতো বিশাল দেহ নিয়ে খাদ্যের অভাবে কতদিন টিকে থাকতে পারবে বুঝা মুশকিল। ইউরোপে ইতোমধ্যে হাতি বিলুপ্তির দোরগোড়ায়।

আমরা মানুষ, হোমো সেপিয়েন্স গ্রুপের সর্বশেষ প্রজাতি। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে টিকে গেছি। হয়তো দূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আমরাও গণবিলুপ্তির শিকার হবো। শুরু হবে প্রাণের নতুন বিকাশ। নতুন প্রতিযোগিতা, নতুন নতুন প্রজাতির সৃষ্টি। ইহারই নাম বিবর্তনবাদ ও প্রাকৃতিক নির্বাচন। সভ্যতার সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের শ্রেষ্ঠতম একটি হলো আল জাহিজ-লামার্ক-ডারউইন-ওয়ালেসের বিবর্তনবাদ।

[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

back to top