alt

উপ-সম্পাদকীয়

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

: শনিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৪

১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশের জনগণ তাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আইনের শাসনের প্রসঙ্গটি সংযোজন করেছিল এক বুক আশা নিয়ে। ‘রুল অব ল’―এ কথাগুলোর সঙ্গে অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজের ভিনেরিয়ান প্রফেসর অ্যালবার্ট ভেন ডাইসির নাম স্বত:ই উচ্চারিত হয়। আমরা জানি ডাইসি রুল অব ল কথাটির প্রথম উদ্গাতা নন। ১৮৬৭ সালে উইলিয়াম ই হার্ন প্রথমবারের মতো রুল অব ল কথাটি সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। আমরা অনেকেই জানি, ডাইসি আইনের শাসনকে ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধানের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। আইনের শাসন―এ কথার মাধ্যমে তিনি একই নীতির তিনটি দিকে আলোকপাত করেন। প্রথমত, ডাইসি আইনের পরম সার্বভৌমত্বে বা নিয়মিত আইনের প্রাধান্যে বিশ্বাস করেন। দ্বিতীয়ত, ডাইসি মনে করেন, ব্রিটেনের সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান। আইনের প্রতি আনুগত্য থেকে রাষ্ট্রের কর্মচারী বা কেউই কোনো রেয়াত বা অব্যাহতি পাবে না। তৃতীয়ত, ডাইসি মনে করেন, দেশের প্রজার অধিকারের সাধারণ আইনের ফলশ্রুতি হচ্ছে সংবিধান। সহজ করে বললে বলা যেতে পারে, সংবিধান ব্যক্তি অধিকারের উৎস নয়, বরং তার ফল। প্রফেসর ডাইসির কারণেই বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্রই আইনের শাসনের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে।

আইনের শাসন সম্পর্কে ডাইসির যে উপলব্ধি ছিল সেটির পরিবর্তন ঘটেছে। আধুনিক মূল্যবোধে আইনের শাসন আজ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের এক অবিচ্ছেদ্য ভিত্তিরূপে পরিগণিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘আইনের শাসন’-এর সংজ্ঞার্থে এক ব্যাপ্তি দেখা যায়। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বলবৎ করতে এবং সফল করে তুলতে হলে সরকারের সব কর্মকা-ে নিয়মানুবর্তিতা ও সামঞ্জস্য রক্ষাকল্পে আইনি বৈধতার প্রয়োজন। আইনের শাসনের মূল আদর্শগুলো ভেঙেচুরে, পেশাকি বৈধতা আশ্রয় করে, শুধু মুখরক্ষা নয়, সদর্পে স্বৈরতন্ত্র টিকে থাকতে পারে। রুল অব ল আনুষ্ঠানিক দলিলের চেয়ে বড়, অতিশয় সরকারি ক্ষমতার বিরুদ্ধে সমাজের সকল সদস্যের জন্য এটি হচ্ছে ন্যায়বিচার ও আশ্রয়লাভের আইন। অন্য কথায়, সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগ ও ব্যবহার আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে এবং সাধারণ জনগণকে শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার সম্মুখীন হতে হবে না। যে রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষ আইন সম্পর্কে সচেতন নয়, স্বত:প্রণোদিত হয়ে আইন মান্য করে না বা যেখানে হুমকি, ভয় প্রদর্শন, সন্ত্রাস বিদ্যমান, সে রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন কাজ। শাসক ও শাসিতের মধ্যে এক ন্যূনতম সহিষ্ণুতা ও সমঝোতা না থাকলে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। প্রচ- কর্মকা- চ-নীতির জন্ম দেবে এবং এক বিষময় বৃত্তের সৃষ্টি করবে, যার চারপাশে ঘুরে ঘুরে সরকার ও জনসাধারণ উভয়েই হয়রান হবে, জনস্বার্থ বিঘিœত হবে এবং দেশে কোনো শান্তি আসবে না।

আইনের শাসন গণতন্ত্রের এক অনিবার্য উৎস এবং পূর্বশর্ত। আইনের শাসন বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিচার বিভাগীয় কর্মকা-ের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, উভয় পক্ষকে প্রকাশ্যে শুনে এবং তাদের বক্তব্য ও অজুহাত পর্যালোচনা করে কারণ ও যুক্তিসহকারে আদালত একটা সিদ্ধান্ত দেয়। রাষ্ট্র আদিতে বহিরাক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এবং দেশের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো কিছু কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের এবং জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের অনেক দাবি। রাষ্ট্রীয় কর্মের ব্যাপক বিস্তারের ফলে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্র নিজে মামলা দায়ের করছে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অনেক মামলা দায়ের হচ্ছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগ যে কেবল বৃদ্ধি পেয়েছে তা-ই নয়, কাজকর্মে নানা ভুলভ্রান্তির জন্য বহু অভিযোগ আদালতে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিরোধগুলোতে যেখানে রাষ্ট্র একটা পক্ষ সেখানে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যাকে মোটেও অবহেলা করা যায় না। আইনের শাসনের জন্য একান্ত প্রয়োজন দেশে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা।

নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণে ও রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গ কখনোই পৃথকভাবে কাজ করতে পারে না। কাজ করার জন্য প্রয়োজন হয় তিনটি বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়ের। এই সমন্বয় করার মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এই সমন্বয়ের প্রধান শর্তই হলো রাষ্ট্রের এক বিভাগ আরেক বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। স্বাধীন বিচার বিভাগ একটি গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিচারপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা বিচারকদের দায়িত্ব। সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।’ অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে। আইনের ওপর বিশেষায়িত জ্ঞান ছাড়া ন্যায়বিচার করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বিচার করা জটিল ও বুদ্ধিবৃত্তিক একটি কাজও বটে। বিচারের মতো একটি সংবেদনশীল কাজ তাই বিচারকদের দিয়েই পরিচালিত হওয়া উচিত। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাদের প্রধান কাজ হলো নির্বাচিত সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। মুখ্যত তারা সরকারের ওপর নির্ভরশীল। আমলাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কম।

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ সংবিধানে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিয়ে এ রকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের জন্য ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তবে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের মতো এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কাজটি বাংলাদেশে কোনো নির্বাচিত সরকার করেনি। একটি সেনা সমর্থিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার মাসদার হোসেন মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে বিচার বিভাগের পৃথকীকণের কাজটি বাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ১৭ বছর পার হলেও মাসদার হোসেন মামলায় দেওয়া আদালতের সব নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এই বাস্তবায়িত না হওয়ার একটি কারণ হলো আমলাতন্ত্র। ২০০৯ সালে ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮-এর ১৯০ ধারায় ৪ উপধারা সংযোজন করা হয়। উক্ত বিধান অনুসারে, সরকার চাইলেই যেকোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবে। এটা স্পষ্টতই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮-এর ১৪৫ ধারায় জমি বা পানি বা এগুলোর সীমানা সম্পর্কে কোনো বিরোধ থাকলে বা কেউ দখলচ্যুত হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দরখাস্ত করার সুযোগ পেতে পারেন। দৃশ্যত বাংলাদেশে আমলারা প্রশাসনিক ক্ষমতার পাশাপাশি যতটুকু বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সেটি সম্ভব নয়।

মৌলিক অধিকার রক্ষণাবেক্ষণের গুরুদায়িত্ব আদালতের ওপর সংবিধান অর্পণ করেছে। নির্বাহী বিভাগের সব প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে ও স্বস্তির সঙ্গে আদালত তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করুন, এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। যে দেশে সেই সামান্য প্রত্যাশা পূরণ হয় না সেখানে অশান্তি ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাসের নানা মোড় ফিরে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তা আমাদের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। আমরা যদি বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারি, তবে আমাদের কে বিচার করবে? সে বিচার আইনজীবীদের কাজ নয়। হয়তো আমাদের সমাজবিজ্ঞারীদেও দ্বারস্থ হতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের এক নির্মম আত্মসমালোচনার প্রয়োজন। কেন আমরা বারবার সুযোগ পেয়েও সুযোগ নষ্ট করছি। কাজেই, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা―এ কথাগুলো স্বপ্নই রয়ে যাবে।

[লেখক: আইনজীবী; পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ

বন্যাপরবর্তী কৃষি উৎপাদনে সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

বিশেষ শিশু ও বিশেষ শিক্ষালয়

বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি

প্রসঙ্গ : আনসার বাহিনী

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মব লিঞ্চিং আইনের শাসনের পরিপন্থি

মব জাস্টিসের মতো বর্বরতা বন্ধ হোক

বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে রাজনীতি

জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক

জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক

ভূমি অধিগ্রহণে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে কী করবেন?

ছবি

নিবেদিত প্রাণ এক কৃষিবিজ্ঞানী

জনমনে স্বস্তি ফিরুক

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

শনিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৪

১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশের জনগণ তাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আইনের শাসনের প্রসঙ্গটি সংযোজন করেছিল এক বুক আশা নিয়ে। ‘রুল অব ল’―এ কথাগুলোর সঙ্গে অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজের ভিনেরিয়ান প্রফেসর অ্যালবার্ট ভেন ডাইসির নাম স্বত:ই উচ্চারিত হয়। আমরা জানি ডাইসি রুল অব ল কথাটির প্রথম উদ্গাতা নন। ১৮৬৭ সালে উইলিয়াম ই হার্ন প্রথমবারের মতো রুল অব ল কথাটি সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। আমরা অনেকেই জানি, ডাইসি আইনের শাসনকে ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধানের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। আইনের শাসন―এ কথার মাধ্যমে তিনি একই নীতির তিনটি দিকে আলোকপাত করেন। প্রথমত, ডাইসি আইনের পরম সার্বভৌমত্বে বা নিয়মিত আইনের প্রাধান্যে বিশ্বাস করেন। দ্বিতীয়ত, ডাইসি মনে করেন, ব্রিটেনের সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান। আইনের প্রতি আনুগত্য থেকে রাষ্ট্রের কর্মচারী বা কেউই কোনো রেয়াত বা অব্যাহতি পাবে না। তৃতীয়ত, ডাইসি মনে করেন, দেশের প্রজার অধিকারের সাধারণ আইনের ফলশ্রুতি হচ্ছে সংবিধান। সহজ করে বললে বলা যেতে পারে, সংবিধান ব্যক্তি অধিকারের উৎস নয়, বরং তার ফল। প্রফেসর ডাইসির কারণেই বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্রই আইনের শাসনের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে।

আইনের শাসন সম্পর্কে ডাইসির যে উপলব্ধি ছিল সেটির পরিবর্তন ঘটেছে। আধুনিক মূল্যবোধে আইনের শাসন আজ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের এক অবিচ্ছেদ্য ভিত্তিরূপে পরিগণিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘আইনের শাসন’-এর সংজ্ঞার্থে এক ব্যাপ্তি দেখা যায়। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বলবৎ করতে এবং সফল করে তুলতে হলে সরকারের সব কর্মকা-ে নিয়মানুবর্তিতা ও সামঞ্জস্য রক্ষাকল্পে আইনি বৈধতার প্রয়োজন। আইনের শাসনের মূল আদর্শগুলো ভেঙেচুরে, পেশাকি বৈধতা আশ্রয় করে, শুধু মুখরক্ষা নয়, সদর্পে স্বৈরতন্ত্র টিকে থাকতে পারে। রুল অব ল আনুষ্ঠানিক দলিলের চেয়ে বড়, অতিশয় সরকারি ক্ষমতার বিরুদ্ধে সমাজের সকল সদস্যের জন্য এটি হচ্ছে ন্যায়বিচার ও আশ্রয়লাভের আইন। অন্য কথায়, সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগ ও ব্যবহার আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে এবং সাধারণ জনগণকে শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার সম্মুখীন হতে হবে না। যে রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষ আইন সম্পর্কে সচেতন নয়, স্বত:প্রণোদিত হয়ে আইন মান্য করে না বা যেখানে হুমকি, ভয় প্রদর্শন, সন্ত্রাস বিদ্যমান, সে রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন কাজ। শাসক ও শাসিতের মধ্যে এক ন্যূনতম সহিষ্ণুতা ও সমঝোতা না থাকলে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। প্রচ- কর্মকা- চ-নীতির জন্ম দেবে এবং এক বিষময় বৃত্তের সৃষ্টি করবে, যার চারপাশে ঘুরে ঘুরে সরকার ও জনসাধারণ উভয়েই হয়রান হবে, জনস্বার্থ বিঘিœত হবে এবং দেশে কোনো শান্তি আসবে না।

আইনের শাসন গণতন্ত্রের এক অনিবার্য উৎস এবং পূর্বশর্ত। আইনের শাসন বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিচার বিভাগীয় কর্মকা-ের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, উভয় পক্ষকে প্রকাশ্যে শুনে এবং তাদের বক্তব্য ও অজুহাত পর্যালোচনা করে কারণ ও যুক্তিসহকারে আদালত একটা সিদ্ধান্ত দেয়। রাষ্ট্র আদিতে বহিরাক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এবং দেশের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো কিছু কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের এবং জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের অনেক দাবি। রাষ্ট্রীয় কর্মের ব্যাপক বিস্তারের ফলে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্র নিজে মামলা দায়ের করছে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অনেক মামলা দায়ের হচ্ছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগ যে কেবল বৃদ্ধি পেয়েছে তা-ই নয়, কাজকর্মে নানা ভুলভ্রান্তির জন্য বহু অভিযোগ আদালতে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিরোধগুলোতে যেখানে রাষ্ট্র একটা পক্ষ সেখানে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যাকে মোটেও অবহেলা করা যায় না। আইনের শাসনের জন্য একান্ত প্রয়োজন দেশে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা।

নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণে ও রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গ কখনোই পৃথকভাবে কাজ করতে পারে না। কাজ করার জন্য প্রয়োজন হয় তিনটি বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়ের। এই সমন্বয় করার মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এই সমন্বয়ের প্রধান শর্তই হলো রাষ্ট্রের এক বিভাগ আরেক বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। স্বাধীন বিচার বিভাগ একটি গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিচারপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা বিচারকদের দায়িত্ব। সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।’ অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে। আইনের ওপর বিশেষায়িত জ্ঞান ছাড়া ন্যায়বিচার করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বিচার করা জটিল ও বুদ্ধিবৃত্তিক একটি কাজও বটে। বিচারের মতো একটি সংবেদনশীল কাজ তাই বিচারকদের দিয়েই পরিচালিত হওয়া উচিত। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাদের প্রধান কাজ হলো নির্বাচিত সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। মুখ্যত তারা সরকারের ওপর নির্ভরশীল। আমলাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কম।

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ সংবিধানে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিয়ে এ রকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের জন্য ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তবে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের মতো এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কাজটি বাংলাদেশে কোনো নির্বাচিত সরকার করেনি। একটি সেনা সমর্থিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার মাসদার হোসেন মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে বিচার বিভাগের পৃথকীকণের কাজটি বাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ১৭ বছর পার হলেও মাসদার হোসেন মামলায় দেওয়া আদালতের সব নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এই বাস্তবায়িত না হওয়ার একটি কারণ হলো আমলাতন্ত্র। ২০০৯ সালে ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮-এর ১৯০ ধারায় ৪ উপধারা সংযোজন করা হয়। উক্ত বিধান অনুসারে, সরকার চাইলেই যেকোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবে। এটা স্পষ্টতই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮-এর ১৪৫ ধারায় জমি বা পানি বা এগুলোর সীমানা সম্পর্কে কোনো বিরোধ থাকলে বা কেউ দখলচ্যুত হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দরখাস্ত করার সুযোগ পেতে পারেন। দৃশ্যত বাংলাদেশে আমলারা প্রশাসনিক ক্ষমতার পাশাপাশি যতটুকু বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সেটি সম্ভব নয়।

মৌলিক অধিকার রক্ষণাবেক্ষণের গুরুদায়িত্ব আদালতের ওপর সংবিধান অর্পণ করেছে। নির্বাহী বিভাগের সব প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে ও স্বস্তির সঙ্গে আদালত তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করুন, এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। যে দেশে সেই সামান্য প্রত্যাশা পূরণ হয় না সেখানে অশান্তি ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাসের নানা মোড় ফিরে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তা আমাদের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। আমরা যদি বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারি, তবে আমাদের কে বিচার করবে? সে বিচার আইনজীবীদের কাজ নয়। হয়তো আমাদের সমাজবিজ্ঞারীদেও দ্বারস্থ হতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের এক নির্মম আত্মসমালোচনার প্রয়োজন। কেন আমরা বারবার সুযোগ পেয়েও সুযোগ নষ্ট করছি। কাজেই, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা―এ কথাগুলো স্বপ্নই রয়ে যাবে।

[লেখক: আইনজীবী; পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top