জিয়াউদ্দীন আহমেদ
২০২৪ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা প্রত্যক্ষ করল ফেনীবাসী। আকস্মিক আবির্ভূত এই বন্যা ফেনীবাসীর কাছে ছিল অকল্পনীয়। বন্যার এই আগ্রাসী রূপ শুধু ফেনী নয়, ফেনীর আশপাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় বন্যার পানি ঘরের চাল ছুয়েছে। বিদ্যুৎসহ সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এসব এলাকার মানুষ সারাদেশ থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিল। পানির তীব্র স্রোতের কারণে বন্যাকবলিত যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে উদ্ধারকারী দল পৌঁছাতে পারেনি, সেসব অঞ্চলের মানুষ গাছের ডাল, টিনের ছাল, বাড়ির ছাদ, গাছপালা, কলাগাছের ভেলার উপরে বসে বাঁচার চেষ্টা করেছে। বয়স্ক, শিশু, নারী, রোগী এবং গর্ভবর্তী মহিলাদের ছিল অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। আমার গ্রামের বাড়ি ফেনীর জিএমহাট এলাকায়। আমাদের এলাকা তুলনামূলক বিচারে কিছুটা উন্নত। জিএমহাট-এ ১৯২৬ সালে একটি মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, বর্তমানে এখানে একটি কলেজও আছে। বন্যার কারণে বিদ্যুৎ না থাকায় অচল হয়ে পড়েছিল ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। মানুষের ঘরে শুকনো খাবার ছিল না, ছিল না খাবার পানি, আগুন, চুলা, মোমবাতি। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে কবরের অন্ধকার নেমে আসত। এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ছিল একমাত্র আশ্রয়শিবির; শুধু রাস্তাঘাট, বসতঘর ডুবে যাওয়ার কারণে নয়, অনেক ক্ষেত্রে তীব্র স্রোতে বানভাসিদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়াও সম্ভব হয়নি। ফেনী শহর পানিতে ডুবে থাকায় ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে গ্রামে গিয়ে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেয়াও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
আমাদের চেয়ে বেশি চিন্তিত ছিল প্রবাসীরা, মিনিটে মিনিটে তারা বন্যাকবলিত আত্মীয়স্বজনদের খবর জানতে চেয়েছেন। আমাদের বাপ-দাদারা তাদের আমলের কোন একটি ‘গোর্কি’র উল্লেখ করে আমাদের বড় ভাইবোনদের জন্মদিন নির্ধারণ করেন; ২০২৪ সালের আগস্টের এই বন্যাও তেমন একটি মাইলফলক, যা নতুন প্রজন্মের লোকজন আমৃত্যু রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করবে। বন্যার এই দুর্যোগে মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে এবার। তুমুল বৃষ্টি আর তীব্র স্রোতের মধ্যেও দুর্গত মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের ছাত্র-জনতা। বন্যাকবলিত বিভিন্ন জেলায় উদ্ধার ও ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চালিয়েছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিস।
মানুষের মধ্যে এমন একতাবদ্ধ সংগ্রাম আগের দুর্যোগ মোকাবিলায়ও দেখা গেছে; কিন্তু আগের দুর্যোগ মোকাবিলায় ছাত্র-ছাত্রীদের এত ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল না। এবার যে যেভাবে পেরেছেÑ অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, আশ্রয় দিয়ে ত্রাণকাজে সহায়তা করছে। ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি, গ্রুপ, সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বানভাসিদের সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করেছে। দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ তাতে সাড়াও দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ত্রাণকেন্দ্র খোলার পর সেখানে মানুষের ঢল নেমেছে, সবাই সেখানে জড় হয়েছে ত্রাণসামগ্রী হাতে নিয়ে। ১৯৮৮ সালেও বন্যার শিকার লাখ লাখ মানুষকে বাঁচাতেও টিএসসিতে রাত-দিন ছাত্ররা রুটি ও খাবার স্যালাইন তৈরি করেছিল। কত মানুষ কতভাবে যে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার ইয়েত্তা নেই। বন্যার্তদের সহযোগিতায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মীরা তাদের একদিনের বেতন দান করেছেন। অনেকে নামমাত্র দরে লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করেছেন, ত্রাণসামগ্রী পরিবহনের জন্য অনেকে বিনা পয়সায় ট্রাক দিয়েছেন, নৌকা দিয়েছেন, ট্রাক্টর দিয়েছেন, ত্রাণকাজে ব্যবহৃত যানবাহনের জন্য অনেকে বিনামূল্যে জ্বালানি তেলের জোগানও দিয়েছেন।
এই দুর্যোগে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের সব শ্রেণী, পেশা ও ধর্মের মানুষ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানÑ সব ধর্মের লোকজন তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বরাদ্দ থেকে অর্থ প্রদান করেছেন বন্যার্তদের জন্য। অনেকে ওমরাহের জন্য জমানো টাকা খরচ করেছেন বানভাসির জন্য। এক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুককেও তার ভিক্ষার থালা থেকে দানবাক্সে টাকা ফেলতে দেখা গেছে। সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত হচ্ছে মানুষ নামের যৌনকর্মী, শরীর বেচে তারা জীবনধারণ করে। ময়মনসিংহের অচ্যুত সেই যৌনকর্মীরাই এবার জমানো দেড় লক্ষ টাকা তুলে দিলেন বন্যার্তদের ত্রাণ তহবিলে। ফেনী এলাকায় সেনাবাহিনী অহর্নিশ কাজ করেছে, তাদের বোট দিয়ে জনগণকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে তুলে দিয়েছে; কিন্তু অল্পসংখ্যক সেনার পক্ষে তাদের সীমিত সরঞ্জাম দিয়ে এলাকার অগণিত লোককে সেবা দেয়ার কাজটি ছিল দুরূহ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা থেকে বন্যাদুর্গত এলাকায় ট্রাকে ট্রাকে ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে। এলাকার ছাত্র-যুবকরা নিজেরা উপোস করে বন্যাদুর্গতদের নিরলস সেবা দিয়ে গেছে।
স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্যাদুর্গত এলাকায় ছুটে গিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দের নৌকা দেখে ঘরের জানালা দিয়ে একটি শিশু চিৎকার করে বলেছে, ‘আমাদেরও পানি আর খাবার লাগবে’। বন্যার মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যস্ত প্রজাতি হচ্ছে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি; আর সবচেয়ে নিগৃহীত প্রজাতি হচ্ছে কুকুর-বিড়াল, বেজি, শিয়াল, ইঁদুর। যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা ছিল না, সেখানে গরু-ছাগল বাঁচানোর সুক্ষ্ম অনুভূতি কারো থাকার কথা নয়। তারাশঙ্কর তার ‘তারিণী মাঝি’ গল্পে এই বোধটি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পের নায়ক অথৈই বন্যায় বউকে পিঠে নিয়ে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটার পর ক্লান্ত হয়ে পড়লে বউকে নিয়ে হঠাৎ ডুবে যায়। এই অবস্থায় স্বামী যতবার বউয়ের হাত আলগা করে উপরে ওঠার চেষ্টা করেছে, বউ ততবার বাঁচার তাগিদে স্বামীকে আরও শক্ত করে ধরছে; শেষ পর্যন্ত গলা টিপে বউকে মেরে স্বামী পানির উপর ভেসে ওঠে। যে মাঝি সাগরের তীব্র ঢেউয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করতে পছন্দ করে সেই মাঝিই বন্যায় হেরে গেছে, নিজের জীবন বাঁচাতে বউকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে।
কিন্তু এই প্রলঙ্করী বন্যায় অনেকে নিজের মৃত্যুর বিনিময়ে অন্যকে বাঁচিয়েছে। পানিতে ভাসমান একটি মৃত (সম্ভবত) শিশুকে ৬-৭ বছরের আরেকটি শিশু দুই হাতে টেনে তুলে বুক পানি ভেঙে বাড়ির দিকে যেতে দেখা গেছে। কবর দেয়ার শুকনো জায়গা না থাকায় কয়েকটি লাশ পানিতে ভাসিয়েও দেয়া হয়েছে। বন্যার এমন বিপর্যয়কর অবস্থায়ও মানুষ প্রজাতির হাতে নিগৃহীত হয়েছে কুকুর-শিয়াল, ইঁদুর-বেজি। বন্যাকবলিত এলাকায় একটি ইঁদুর বাঁচার এক বুক আশা নিয়ে একটি ঘরের মেঝেতে উঠতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি গৃহকর্ত্রী ইঁদুরটিকে ঝাটা দিয়ে সরিয়ে দিল, উঠতে দিল না। আরেকটি কুকুর সাঁতার কেটে ঘরে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে গৃহকর্ত্রী দরজা বন্ধ করে দিল, কুকুরটি আর বাঁচতে পারল না। অগণিত কুকুরকে অথৈ পানিতে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে, কোন স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ এদের বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করেনি; অবশ্য উদ্ধার করে রাখার স্থানও ছিল না।
তারপরও এক কিশোর একটি গরুর গলা পানির উপরে তুলে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল, কিন্তু পারেনি, কারণ কিশোরের পায়ের নিচে মাটি ছিল না। সহ্য হচ্ছিল না বলে শেষ পর্যন্ত ভিডিওটি দেখিনি। আরেকটি ভিডিওতে দেখলাম একজন কিশোর তার গরুর বাছুরটিকে কাঁধে নিয়ে এক কোমর পানি মাড়াচ্ছে, হাঁটতে পারছে না, তবুও বাছুরটিকে ছাড়েনি, বাছুরটিকেও নিশ্চিন্ত হয়ে কিশোরের পিঠে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। একটি কুকুরকে পানি থেকে টেনে গাড়িতে তুলেছে এক স্বেচ্ছাসেবক। সোনাগাজীর একজন বুকপানি ঠেলে তার কুকুরের জন্য রুটি নিয়ে যেতেও দেখেছি। সবাই হয়তো ইতোমধ্যে ভেবে নিয়েছেন, আমি মানসিক রোগী, মতিভ্রম হয়েছে; যেখানে মানুষ আশ্রয় পায়নি সেখানে ‘ইতর’ প্রাণীর জন্য এত দরদ কেন?
স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে সবাই বেজি, ইঁদুর ইত্যাদি পিটিয়ে মেরে ফেলে সেখানে বন্যায় বিপর্যয়কর অবস্থায় তাদের প্রতি দরদ প্রত্যাশা করা বায়ুরোগের লক্ষণ। পশু-পাখির প্রতি আমার দরদ একটু বেশি, এজন্য প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রতিদিন কটুক্তি শুনতে হয়। ঘরে ইঁদুর মারার জন্য সবাই ফাঁদ পেতে রাখে, আর আমি প্রতিদিন গভীর রাতে রাস্তার কুকুরদের খাবার দিতে গেলে আমার বাসার নিচের ইঁদুরদেরও খাবার দেই। বন্যার পানি বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট থেকে সরে গেছে; বন্যার্তদের জীবন স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মানবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা দরকার। দুর্গত এলাকার রোগ-ব্যাধি মোকাবিলা করা সরকারের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পানি নেমে যাওয়ার পর বন্যার্তদের পুনর্বাসনের কাজটি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। জীবন বাঁচাতেই বানভাসিদের বন্যার দূষিত পানি ব্যবহার করতে হয়েছে এবং এর ফলে এখন ডায়রিয়া, কলেরাসহ পানিবাহিত নানা রোগ দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ইতোমধ্যে প্রায় আটশ মেডিকেল টিম দুর্গত এলাকায় কাজ শুরু করেছে। তারপরও করোনার মতো হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো জরুরি, হাসপাতালে ডাক্তার ও ওষুধের পর্যাপ্ত জোগানের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। বিনে পয়সায় সার, বীজ সরবরাহ করেও কৃষি কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না, কারণ চাষের সব গরু বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। অন্যদিকে বসতঘরকে বাসোপযোগী করাও ঝুঁকিপূর্ণ। বন্যার সময় গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা সব সাপ আশ্রয় নিয়েছে ঘরের আনাচেকানাচে। সাপের কামড়ে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। প্রতিটি ঘরের বিদ্যুতের মিটার, সংযোগ, সুইচ পানিতে ডুবে গেছে; এই অবস্থায় বিদ্যুৎ সংযোগে জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে, সুইচ দিতে গিয়ে ইতোমধ্যে কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। শুধু বানভাসিদের মৃত্যুর ইতিহাস নয়, এবার ইতিহাস রচিত হয়েছে অকুতোভয় ছাত্র-যুবকের দিয়ে, যারা নিজেরা মরে অন্যদের বাঁচিয়েছে। এভাবে বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখার এক গৌরবময় কাহিনী রচিত হয়েছে এবার বাংলাদেশে। এই কাহিনীতে রয়েছে বন্যার প্রকোপে মানুষের জীবন ও আশা হারানোর হৃদয়বিদারক মুহূর্তও। এই ইতিহাসে লেখা থাকবে বানভাসিদের মনুষ্যত্ব, যে মনুষ্যত্বের গুণে ফেনীর সর্বত্র নিজের চেয়ে প্রতিবেশীর ত্রাণের প্রয়োজনীয়তার কথা উচ্চারিত হয়েছে বেশি।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ৩১ আগস্ট ২০২৪
২০২৪ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা প্রত্যক্ষ করল ফেনীবাসী। আকস্মিক আবির্ভূত এই বন্যা ফেনীবাসীর কাছে ছিল অকল্পনীয়। বন্যার এই আগ্রাসী রূপ শুধু ফেনী নয়, ফেনীর আশপাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় বন্যার পানি ঘরের চাল ছুয়েছে। বিদ্যুৎসহ সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এসব এলাকার মানুষ সারাদেশ থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিল। পানির তীব্র স্রোতের কারণে বন্যাকবলিত যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে উদ্ধারকারী দল পৌঁছাতে পারেনি, সেসব অঞ্চলের মানুষ গাছের ডাল, টিনের ছাল, বাড়ির ছাদ, গাছপালা, কলাগাছের ভেলার উপরে বসে বাঁচার চেষ্টা করেছে। বয়স্ক, শিশু, নারী, রোগী এবং গর্ভবর্তী মহিলাদের ছিল অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। আমার গ্রামের বাড়ি ফেনীর জিএমহাট এলাকায়। আমাদের এলাকা তুলনামূলক বিচারে কিছুটা উন্নত। জিএমহাট-এ ১৯২৬ সালে একটি মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, বর্তমানে এখানে একটি কলেজও আছে। বন্যার কারণে বিদ্যুৎ না থাকায় অচল হয়ে পড়েছিল ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। মানুষের ঘরে শুকনো খাবার ছিল না, ছিল না খাবার পানি, আগুন, চুলা, মোমবাতি। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে কবরের অন্ধকার নেমে আসত। এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ছিল একমাত্র আশ্রয়শিবির; শুধু রাস্তাঘাট, বসতঘর ডুবে যাওয়ার কারণে নয়, অনেক ক্ষেত্রে তীব্র স্রোতে বানভাসিদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়াও সম্ভব হয়নি। ফেনী শহর পানিতে ডুবে থাকায় ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে গ্রামে গিয়ে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেয়াও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
আমাদের চেয়ে বেশি চিন্তিত ছিল প্রবাসীরা, মিনিটে মিনিটে তারা বন্যাকবলিত আত্মীয়স্বজনদের খবর জানতে চেয়েছেন। আমাদের বাপ-দাদারা তাদের আমলের কোন একটি ‘গোর্কি’র উল্লেখ করে আমাদের বড় ভাইবোনদের জন্মদিন নির্ধারণ করেন; ২০২৪ সালের আগস্টের এই বন্যাও তেমন একটি মাইলফলক, যা নতুন প্রজন্মের লোকজন আমৃত্যু রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করবে। বন্যার এই দুর্যোগে মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে এবার। তুমুল বৃষ্টি আর তীব্র স্রোতের মধ্যেও দুর্গত মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের ছাত্র-জনতা। বন্যাকবলিত বিভিন্ন জেলায় উদ্ধার ও ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চালিয়েছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিস।
মানুষের মধ্যে এমন একতাবদ্ধ সংগ্রাম আগের দুর্যোগ মোকাবিলায়ও দেখা গেছে; কিন্তু আগের দুর্যোগ মোকাবিলায় ছাত্র-ছাত্রীদের এত ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল না। এবার যে যেভাবে পেরেছেÑ অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, আশ্রয় দিয়ে ত্রাণকাজে সহায়তা করছে। ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি, গ্রুপ, সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বানভাসিদের সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করেছে। দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ তাতে সাড়াও দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ত্রাণকেন্দ্র খোলার পর সেখানে মানুষের ঢল নেমেছে, সবাই সেখানে জড় হয়েছে ত্রাণসামগ্রী হাতে নিয়ে। ১৯৮৮ সালেও বন্যার শিকার লাখ লাখ মানুষকে বাঁচাতেও টিএসসিতে রাত-দিন ছাত্ররা রুটি ও খাবার স্যালাইন তৈরি করেছিল। কত মানুষ কতভাবে যে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার ইয়েত্তা নেই। বন্যার্তদের সহযোগিতায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মীরা তাদের একদিনের বেতন দান করেছেন। অনেকে নামমাত্র দরে লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করেছেন, ত্রাণসামগ্রী পরিবহনের জন্য অনেকে বিনা পয়সায় ট্রাক দিয়েছেন, নৌকা দিয়েছেন, ট্রাক্টর দিয়েছেন, ত্রাণকাজে ব্যবহৃত যানবাহনের জন্য অনেকে বিনামূল্যে জ্বালানি তেলের জোগানও দিয়েছেন।
এই দুর্যোগে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের সব শ্রেণী, পেশা ও ধর্মের মানুষ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানÑ সব ধর্মের লোকজন তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বরাদ্দ থেকে অর্থ প্রদান করেছেন বন্যার্তদের জন্য। অনেকে ওমরাহের জন্য জমানো টাকা খরচ করেছেন বানভাসির জন্য। এক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুককেও তার ভিক্ষার থালা থেকে দানবাক্সে টাকা ফেলতে দেখা গেছে। সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত হচ্ছে মানুষ নামের যৌনকর্মী, শরীর বেচে তারা জীবনধারণ করে। ময়মনসিংহের অচ্যুত সেই যৌনকর্মীরাই এবার জমানো দেড় লক্ষ টাকা তুলে দিলেন বন্যার্তদের ত্রাণ তহবিলে। ফেনী এলাকায় সেনাবাহিনী অহর্নিশ কাজ করেছে, তাদের বোট দিয়ে জনগণকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে তুলে দিয়েছে; কিন্তু অল্পসংখ্যক সেনার পক্ষে তাদের সীমিত সরঞ্জাম দিয়ে এলাকার অগণিত লোককে সেবা দেয়ার কাজটি ছিল দুরূহ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা থেকে বন্যাদুর্গত এলাকায় ট্রাকে ট্রাকে ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে। এলাকার ছাত্র-যুবকরা নিজেরা উপোস করে বন্যাদুর্গতদের নিরলস সেবা দিয়ে গেছে।
স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্যাদুর্গত এলাকায় ছুটে গিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দের নৌকা দেখে ঘরের জানালা দিয়ে একটি শিশু চিৎকার করে বলেছে, ‘আমাদেরও পানি আর খাবার লাগবে’। বন্যার মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যস্ত প্রজাতি হচ্ছে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি; আর সবচেয়ে নিগৃহীত প্রজাতি হচ্ছে কুকুর-বিড়াল, বেজি, শিয়াল, ইঁদুর। যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা ছিল না, সেখানে গরু-ছাগল বাঁচানোর সুক্ষ্ম অনুভূতি কারো থাকার কথা নয়। তারাশঙ্কর তার ‘তারিণী মাঝি’ গল্পে এই বোধটি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পের নায়ক অথৈই বন্যায় বউকে পিঠে নিয়ে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটার পর ক্লান্ত হয়ে পড়লে বউকে নিয়ে হঠাৎ ডুবে যায়। এই অবস্থায় স্বামী যতবার বউয়ের হাত আলগা করে উপরে ওঠার চেষ্টা করেছে, বউ ততবার বাঁচার তাগিদে স্বামীকে আরও শক্ত করে ধরছে; শেষ পর্যন্ত গলা টিপে বউকে মেরে স্বামী পানির উপর ভেসে ওঠে। যে মাঝি সাগরের তীব্র ঢেউয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করতে পছন্দ করে সেই মাঝিই বন্যায় হেরে গেছে, নিজের জীবন বাঁচাতে বউকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে।
কিন্তু এই প্রলঙ্করী বন্যায় অনেকে নিজের মৃত্যুর বিনিময়ে অন্যকে বাঁচিয়েছে। পানিতে ভাসমান একটি মৃত (সম্ভবত) শিশুকে ৬-৭ বছরের আরেকটি শিশু দুই হাতে টেনে তুলে বুক পানি ভেঙে বাড়ির দিকে যেতে দেখা গেছে। কবর দেয়ার শুকনো জায়গা না থাকায় কয়েকটি লাশ পানিতে ভাসিয়েও দেয়া হয়েছে। বন্যার এমন বিপর্যয়কর অবস্থায়ও মানুষ প্রজাতির হাতে নিগৃহীত হয়েছে কুকুর-শিয়াল, ইঁদুর-বেজি। বন্যাকবলিত এলাকায় একটি ইঁদুর বাঁচার এক বুক আশা নিয়ে একটি ঘরের মেঝেতে উঠতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি গৃহকর্ত্রী ইঁদুরটিকে ঝাটা দিয়ে সরিয়ে দিল, উঠতে দিল না। আরেকটি কুকুর সাঁতার কেটে ঘরে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে গৃহকর্ত্রী দরজা বন্ধ করে দিল, কুকুরটি আর বাঁচতে পারল না। অগণিত কুকুরকে অথৈ পানিতে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে, কোন স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ এদের বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করেনি; অবশ্য উদ্ধার করে রাখার স্থানও ছিল না।
তারপরও এক কিশোর একটি গরুর গলা পানির উপরে তুলে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল, কিন্তু পারেনি, কারণ কিশোরের পায়ের নিচে মাটি ছিল না। সহ্য হচ্ছিল না বলে শেষ পর্যন্ত ভিডিওটি দেখিনি। আরেকটি ভিডিওতে দেখলাম একজন কিশোর তার গরুর বাছুরটিকে কাঁধে নিয়ে এক কোমর পানি মাড়াচ্ছে, হাঁটতে পারছে না, তবুও বাছুরটিকে ছাড়েনি, বাছুরটিকেও নিশ্চিন্ত হয়ে কিশোরের পিঠে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। একটি কুকুরকে পানি থেকে টেনে গাড়িতে তুলেছে এক স্বেচ্ছাসেবক। সোনাগাজীর একজন বুকপানি ঠেলে তার কুকুরের জন্য রুটি নিয়ে যেতেও দেখেছি। সবাই হয়তো ইতোমধ্যে ভেবে নিয়েছেন, আমি মানসিক রোগী, মতিভ্রম হয়েছে; যেখানে মানুষ আশ্রয় পায়নি সেখানে ‘ইতর’ প্রাণীর জন্য এত দরদ কেন?
স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে সবাই বেজি, ইঁদুর ইত্যাদি পিটিয়ে মেরে ফেলে সেখানে বন্যায় বিপর্যয়কর অবস্থায় তাদের প্রতি দরদ প্রত্যাশা করা বায়ুরোগের লক্ষণ। পশু-পাখির প্রতি আমার দরদ একটু বেশি, এজন্য প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রতিদিন কটুক্তি শুনতে হয়। ঘরে ইঁদুর মারার জন্য সবাই ফাঁদ পেতে রাখে, আর আমি প্রতিদিন গভীর রাতে রাস্তার কুকুরদের খাবার দিতে গেলে আমার বাসার নিচের ইঁদুরদেরও খাবার দেই। বন্যার পানি বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট থেকে সরে গেছে; বন্যার্তদের জীবন স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মানবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা দরকার। দুর্গত এলাকার রোগ-ব্যাধি মোকাবিলা করা সরকারের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পানি নেমে যাওয়ার পর বন্যার্তদের পুনর্বাসনের কাজটি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। জীবন বাঁচাতেই বানভাসিদের বন্যার দূষিত পানি ব্যবহার করতে হয়েছে এবং এর ফলে এখন ডায়রিয়া, কলেরাসহ পানিবাহিত নানা রোগ দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ইতোমধ্যে প্রায় আটশ মেডিকেল টিম দুর্গত এলাকায় কাজ শুরু করেছে। তারপরও করোনার মতো হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো জরুরি, হাসপাতালে ডাক্তার ও ওষুধের পর্যাপ্ত জোগানের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। বিনে পয়সায় সার, বীজ সরবরাহ করেও কৃষি কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না, কারণ চাষের সব গরু বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। অন্যদিকে বসতঘরকে বাসোপযোগী করাও ঝুঁকিপূর্ণ। বন্যার সময় গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা সব সাপ আশ্রয় নিয়েছে ঘরের আনাচেকানাচে। সাপের কামড়ে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। প্রতিটি ঘরের বিদ্যুতের মিটার, সংযোগ, সুইচ পানিতে ডুবে গেছে; এই অবস্থায় বিদ্যুৎ সংযোগে জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে, সুইচ দিতে গিয়ে ইতোমধ্যে কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। শুধু বানভাসিদের মৃত্যুর ইতিহাস নয়, এবার ইতিহাস রচিত হয়েছে অকুতোভয় ছাত্র-যুবকের দিয়ে, যারা নিজেরা মরে অন্যদের বাঁচিয়েছে। এভাবে বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখার এক গৌরবময় কাহিনী রচিত হয়েছে এবার বাংলাদেশে। এই কাহিনীতে রয়েছে বন্যার প্রকোপে মানুষের জীবন ও আশা হারানোর হৃদয়বিদারক মুহূর্তও। এই ইতিহাসে লেখা থাকবে বানভাসিদের মনুষ্যত্ব, যে মনুষ্যত্বের গুণে ফেনীর সর্বত্র নিজের চেয়ে প্রতিবেশীর ত্রাণের প্রয়োজনীয়তার কথা উচ্চারিত হয়েছে বেশি।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি]