alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

মিথুশিলাক মুরমু

: রোববার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তীকালে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি সহজেই চোখে পড়ছে রাস্তার ডিভাইডার, মেট্রোরেলের পিলার, রাস্তার আশপাশ ও গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালগুলোতে। ছবি ও লেখাসংবলিত গ্রাফিতিতে আন্দোলনের চেতনা, স্বপ্ন, প্রত্যাশা, সম্প্রীতির বাণী এবং নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির আকাক্সক্ষা পরিস্ফুটিত হয়েছে। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের কথা নয়, আপামর জনসাধারণেরÑ জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবারই। দেশের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতিও রাজধানীসহ জেলাশহরগুলোর দেয়ালে দেয়ালে নিজেদের বঞ্চনা, বেদনা, অবহেলার কথাগুলো দৃষ্টিনন্দন তবে হৃদয়ের অব্যক্ত কথাগুলো শোভা পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা ‘কল্পনা চাকমা ১৯৯৬?’ আঁকতেই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তাহলে কি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতাও আদিবাসীদের স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারে নাই! আদিবাসীদের তথা সমগ্র ভারতবর্ষের অধিকার আন্দোলনের অগ্রপথিক হিসেবে স্বীকার করা হয় সাঁওতাল নেতা সিধু-কানু, চাঁদ-ভাইরো, জানো-ফুলমণিকে।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, সহোদরদের শিকার হতে হয়েছিল মর্মভেদি মৃত্যুদ-ে। সেই বীর যোদ্ধাদের স্মরণে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তনগর মন্দিরের প্রবেশপথে তীর-ধনুক সমেত সিধু-কানু ভাস্কর্যটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা, সঙ্গে সঙ্গেই লাল ইটের উপরে কালো কালিতে লিখে ফেলল ‘কালেমা চত্বর’। সিধু-কানু, তীর-ধনুক ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয়া হৃদয় ভাঙার সমরূপ। এবার ঐতিহাসিক তীর-ধনুকের গ্রাফিতি চোখে পড়েছে ঢাকার রাজপথে। আদিবাসীদের জীবনের সংগ্রামের অপরিহার্য অধ্যায় হচ্ছে তীর-ধনুক। সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভীমপুর থেকে বাগদা ফার্মÑ সর্বত্রই অধিকার আদায়ের অন্যতম সঙ্গী হিসেবেই তীর-ধনুক জড়িয়ে আছে। সঙ্গত কারণেই ভাস্কর্য ভেঙে দেয়ার পরই গ্রাফিতির মধ্যে দিয়ে চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে। কয়েক দশক থেকে আদিবাসীরা বরাংবার দাবি উত্থাপন করে চলেছে, আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির; স্বীকৃতি মিলেছে কিন্তু সেটি ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ হিসেবে।

আদিবাসী ছেলেমেয়েরা ঢাকার রাজপথে গ্রাফিতিতে সেই আবেদনই রেখেছে, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শব্দটির সামনে ক্রস চিহ্ন এঁকে। ‘আদিবাসী’ শব্দটির পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে নিচে সারিতে লেখা রয়েছে, ‘আমরা সবাই এক’। এছাড়া মেট্রোরেলের পিলারগুলোতে শোভা পাচ্ছে, বাংলাদেশ বৃক্ষের শাখাস্বরূপÑ ‘বৌদ্ধ, হিন্দু, আদিবাসী, মুসলিম, খ্রিস্টান’, গাছের একপাশে সবুজ-লাল রংয়ে লিপিবদ্ধ, ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। বোধকরি, একজন ওরাঁও শিক্ষার্থীই দেয়ালে এঁকেছেন, ‘আমি ওরাঁও, আমিই আদিবাসী, আমি বাংলাদেশি, সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই’। “আদিবাসী ওরাঁও’ সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই”। অন্যত্র শোভা পাচ্ছেÑ আমরা বাংলাদেশি, বাঙালি না! গ্রাফিতিতে জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখপূর্বক লেখা হয়েছেÑ ‘আমি সাঁওতাল’, ‘আমি খাসিয়া’ ‘ আমি ¤্রাে’; এভাবেই প্রায় ২৩টি জাতিগোষ্ঠীর নাম স্থান পেয়েছে। এরূপ আরেকটি গ্রাফিতি নজর কেড়েছে, চতুর্কোণে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নামগুলো রয়েছে, আর মাঝখানে লেখা রয়েছেÑ ‘এক জাতির দেশ নয়, বহু জাতির বাংলাদেশ’।

অব্যক্ত কথাগুলো লেখার মধ্যে দিয়ে স্বাধীন মতামত পুনর্বার প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ^াস করি, আদিবাসী শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতির সাহায্যে দেশবাসীর দৃষ্টি ও মনোজগতকে আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। আদিবাসীদের প্রাণের দাবি ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতিকে তোয়াক্কা না করেই পঞ্চদশ সংশোধনীতে যুক্ত করা হয়েছিল ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ শব্দগুচ্ছটি। যে শব্দটিতে জাতিগোষ্ঠীগুলো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, সেই নামেই তাদের ডাকা হোক, অচিরেই আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয় কিন্তু পরবর্তীকালে চিত্রটি আমাদের আহত করেছে। যে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নসারথী, সেই আদিবাসী সমাজই এখন ভাঙচুর, সহায়-সম্পত্তি ও উচ্ছেদ আতঙ্কে নিদ্রাহীন রাত অতিক্রান্ত করছে। আমার পৈতৃক ভিটা রাজশাহীর, গোদাগাড়ী থানার সাঁওতাল পল্লী শিমলা দিঘীপাড়া তার একটি উদহারণ। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি গ্রামের নিরাপত্তাহীনতায় শিকার আদিবাসীর সঙ্গে কথোপকথন হয়েছে, কেউই আক্রমণের চিন্তায় প্রাণের ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেন না। ক্ষুব্ধতায় উচ্চারণ করেছেন, ‘বাঘে মহিষে লড়াই হয়, নলখাগড়ার জীবন যায়’।

আদিবাসীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাঠের জমিতে, শহরের রেস্তোরাঁয়, সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের জালে ধৃত হয়ে থাকেন; আবারও বৈশি^ক রাজনীতি কিংবা দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির পটপরিবর্তনে টার্গেটে পরিণত হন। কেন এই নিরাপত্তাহীনতা, কেন এই নির্ঘুম রাত; শিক্ষার্থীদের বৈষম্য আন্দোলনও আমাদের স্বস্তি দিতে পারে নাই। আমাদের নতুন প্রজন্মের বহিঃপ্রকাশ দেয়াল গ্রাফিতিতে চোখে পড়ে। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পথ দীর্ঘ হলেও অজেয় নয়। বিশ^াস করি, আমাদের প্রজন্মের সেই চেতনা, স্বপ্ন, শক্তি ও মনোবল রয়েছে। রেভা. মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বক্তব্যটি আমাদেরকেও আবেশিত করে। বর্ণবৈষম্যের সেই বিখ্যাত পংক্তিÑ ‘আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়!/আমরা করবো জয় নিশ্চয়ই!/আহা বুকের গভীরে, আছে প্রত্যয়/ আমরা করবো জয় নিশ্চয়ই’।

[লেখক : কলামিস্ট]

শীতকালীন জীবন: সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও সহমর্মিতা

অ্যালগরিদমের রাজনীতি

চারদিকে আতঙ্ক আর শঙ্কা

অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই

দিপু দাস হত্যাকাণ্ড ও মব সন্ত্রাস

ভোগের দৃশ্যপট: ঢাকায় আধুনিকতা কেন কেবল অল্প কিছু মানুষের জন্য?

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

বিনা-ভাড়ার ট্রেনযাত্রা

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

মিথুশিলাক মুরমু

রোববার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তীকালে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি সহজেই চোখে পড়ছে রাস্তার ডিভাইডার, মেট্রোরেলের পিলার, রাস্তার আশপাশ ও গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালগুলোতে। ছবি ও লেখাসংবলিত গ্রাফিতিতে আন্দোলনের চেতনা, স্বপ্ন, প্রত্যাশা, সম্প্রীতির বাণী এবং নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির আকাক্সক্ষা পরিস্ফুটিত হয়েছে। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের কথা নয়, আপামর জনসাধারণেরÑ জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবারই। দেশের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতিও রাজধানীসহ জেলাশহরগুলোর দেয়ালে দেয়ালে নিজেদের বঞ্চনা, বেদনা, অবহেলার কথাগুলো দৃষ্টিনন্দন তবে হৃদয়ের অব্যক্ত কথাগুলো শোভা পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা ‘কল্পনা চাকমা ১৯৯৬?’ আঁকতেই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তাহলে কি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতাও আদিবাসীদের স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারে নাই! আদিবাসীদের তথা সমগ্র ভারতবর্ষের অধিকার আন্দোলনের অগ্রপথিক হিসেবে স্বীকার করা হয় সাঁওতাল নেতা সিধু-কানু, চাঁদ-ভাইরো, জানো-ফুলমণিকে।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, সহোদরদের শিকার হতে হয়েছিল মর্মভেদি মৃত্যুদ-ে। সেই বীর যোদ্ধাদের স্মরণে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তনগর মন্দিরের প্রবেশপথে তীর-ধনুক সমেত সিধু-কানু ভাস্কর্যটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা, সঙ্গে সঙ্গেই লাল ইটের উপরে কালো কালিতে লিখে ফেলল ‘কালেমা চত্বর’। সিধু-কানু, তীর-ধনুক ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয়া হৃদয় ভাঙার সমরূপ। এবার ঐতিহাসিক তীর-ধনুকের গ্রাফিতি চোখে পড়েছে ঢাকার রাজপথে। আদিবাসীদের জীবনের সংগ্রামের অপরিহার্য অধ্যায় হচ্ছে তীর-ধনুক। সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভীমপুর থেকে বাগদা ফার্মÑ সর্বত্রই অধিকার আদায়ের অন্যতম সঙ্গী হিসেবেই তীর-ধনুক জড়িয়ে আছে। সঙ্গত কারণেই ভাস্কর্য ভেঙে দেয়ার পরই গ্রাফিতির মধ্যে দিয়ে চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে। কয়েক দশক থেকে আদিবাসীরা বরাংবার দাবি উত্থাপন করে চলেছে, আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির; স্বীকৃতি মিলেছে কিন্তু সেটি ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ হিসেবে।

আদিবাসী ছেলেমেয়েরা ঢাকার রাজপথে গ্রাফিতিতে সেই আবেদনই রেখেছে, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শব্দটির সামনে ক্রস চিহ্ন এঁকে। ‘আদিবাসী’ শব্দটির পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে নিচে সারিতে লেখা রয়েছে, ‘আমরা সবাই এক’। এছাড়া মেট্রোরেলের পিলারগুলোতে শোভা পাচ্ছে, বাংলাদেশ বৃক্ষের শাখাস্বরূপÑ ‘বৌদ্ধ, হিন্দু, আদিবাসী, মুসলিম, খ্রিস্টান’, গাছের একপাশে সবুজ-লাল রংয়ে লিপিবদ্ধ, ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। বোধকরি, একজন ওরাঁও শিক্ষার্থীই দেয়ালে এঁকেছেন, ‘আমি ওরাঁও, আমিই আদিবাসী, আমি বাংলাদেশি, সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই’। “আদিবাসী ওরাঁও’ সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই”। অন্যত্র শোভা পাচ্ছেÑ আমরা বাংলাদেশি, বাঙালি না! গ্রাফিতিতে জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখপূর্বক লেখা হয়েছেÑ ‘আমি সাঁওতাল’, ‘আমি খাসিয়া’ ‘ আমি ¤্রাে’; এভাবেই প্রায় ২৩টি জাতিগোষ্ঠীর নাম স্থান পেয়েছে। এরূপ আরেকটি গ্রাফিতি নজর কেড়েছে, চতুর্কোণে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নামগুলো রয়েছে, আর মাঝখানে লেখা রয়েছেÑ ‘এক জাতির দেশ নয়, বহু জাতির বাংলাদেশ’।

অব্যক্ত কথাগুলো লেখার মধ্যে দিয়ে স্বাধীন মতামত পুনর্বার প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ^াস করি, আদিবাসী শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতির সাহায্যে দেশবাসীর দৃষ্টি ও মনোজগতকে আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। আদিবাসীদের প্রাণের দাবি ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতিকে তোয়াক্কা না করেই পঞ্চদশ সংশোধনীতে যুক্ত করা হয়েছিল ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ শব্দগুচ্ছটি। যে শব্দটিতে জাতিগোষ্ঠীগুলো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, সেই নামেই তাদের ডাকা হোক, অচিরেই আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয় কিন্তু পরবর্তীকালে চিত্রটি আমাদের আহত করেছে। যে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নসারথী, সেই আদিবাসী সমাজই এখন ভাঙচুর, সহায়-সম্পত্তি ও উচ্ছেদ আতঙ্কে নিদ্রাহীন রাত অতিক্রান্ত করছে। আমার পৈতৃক ভিটা রাজশাহীর, গোদাগাড়ী থানার সাঁওতাল পল্লী শিমলা দিঘীপাড়া তার একটি উদহারণ। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি গ্রামের নিরাপত্তাহীনতায় শিকার আদিবাসীর সঙ্গে কথোপকথন হয়েছে, কেউই আক্রমণের চিন্তায় প্রাণের ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেন না। ক্ষুব্ধতায় উচ্চারণ করেছেন, ‘বাঘে মহিষে লড়াই হয়, নলখাগড়ার জীবন যায়’।

আদিবাসীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাঠের জমিতে, শহরের রেস্তোরাঁয়, সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের জালে ধৃত হয়ে থাকেন; আবারও বৈশি^ক রাজনীতি কিংবা দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির পটপরিবর্তনে টার্গেটে পরিণত হন। কেন এই নিরাপত্তাহীনতা, কেন এই নির্ঘুম রাত; শিক্ষার্থীদের বৈষম্য আন্দোলনও আমাদের স্বস্তি দিতে পারে নাই। আমাদের নতুন প্রজন্মের বহিঃপ্রকাশ দেয়াল গ্রাফিতিতে চোখে পড়ে। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পথ দীর্ঘ হলেও অজেয় নয়। বিশ^াস করি, আমাদের প্রজন্মের সেই চেতনা, স্বপ্ন, শক্তি ও মনোবল রয়েছে। রেভা. মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বক্তব্যটি আমাদেরকেও আবেশিত করে। বর্ণবৈষম্যের সেই বিখ্যাত পংক্তিÑ ‘আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়!/আমরা করবো জয় নিশ্চয়ই!/আহা বুকের গভীরে, আছে প্রত্যয়/ আমরা করবো জয় নিশ্চয়ই’।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top