alt

উপ-সম্পাদকীয়

হুন্ডি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না

রেজাউল করিম খোকন

: বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো আর্থিক খাতে শুরু হয়েছে বড় ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া। পুরো আর্থিক খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। এখন অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে কোন সংস্কার এখনই শুরু করা দরকার। আর্থিক খাত সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে যেটা করা দরকার, তা এখনই শুরু করতে হবে। না হলে বড় বিপদ আসবে পুরো আর্থিক খাতে।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধপথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টি। আর এ কর্মকা-ের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে হুন্ডির নাম। বলা হচ্ছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স ঢুকছে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে সরকার একদিকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা যোগ হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভা-ারে। সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্য। বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার।

হুন্ডিচক্রে বন্দি হয়ে পড়েছে বৈধপথের রেমিট্যান্স। এর ফলে অর্থ পাচারও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে প্রতি ডলারে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে, যা হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। হুন্ডিচক্র বিদেশে ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা রেখে দেয় এবং তাদের এজেন্টরা দেশে সুবিধাভোগীদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনছে। সাধারণত বাডুজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। মূলত শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারের জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় কম মূল্য বা বেশি মূল্য দেখানো হয়। অর্থ পাচারের জন্য দেশের বাইরে যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে, তা হুন্ডিচক্র মেটায়।

উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মুঘল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিলো অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মুঘল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ছিল ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে, যাকে তুলনা করা যায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের চেকের সঙ্গে। এই দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি। ভারতের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা মহাজনদের এই নেটওয়ার্ক আবার বজায় থাকতো তাদের পরিচিতি, দীর্ঘদিনের লেনদেন এবং পারস্পরিক বিশ্বস্ততার মধ্য দিয়ে।

মুঘল প্রশাসকরা দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর জন্য এই মহাজনদের ওপর নির্ভর করতেন। এই মহাজনরাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দিতেন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্র্যাজেডির অন্যতম কুশীলব জগৎ শেঠও ছিলেন একজন হুন্ডির মহাজন। পুরো ভারতজুড়ে ছিল তার হুন্ডির কারবার। মুঘল আমলের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। এর কার্যকারিতার জন্য ব্রিটিশরাও একে অর্থ লেনদেনের দেশীয় ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়। এমনকি একে বৈধতা দেবার জন্য রানীর সিলসহ স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচলন করে।

হুন্ডি একটি বৈশ্বিক চক্র। ফলে সারাবিশ্ব থেকে প্রবাসীদের পাঠানোর অর্থ দেশে পরিজনদের পৌঁছে দেন। হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন অনেক সময় তারা ব্যাংকে যেতে পারেননা। আবার প্রবাসের সব শ্রমিকের বৈধ কাগজ নেই। যে কারণে চাইলেও অনেকে ব্যাংকে অর্থ পাঠাতে পারেন না। হুন্ডি হলো প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়।

বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয়না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যযুগে ভারতে সম্পদ লেনদেনের জন্য প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা হয়। বর্তমানে বৈধ পদ্ধতি এড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা আনার কাজে হুন্ডি পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো ও দেশ থেকে অর্থ পাচার এই দুটো বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে।

প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার আনলে বা ডলার এনে ঘোষণা দিলে সেটা বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে যোগ হয় কিন্তু অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ আসলে সেটা রিজার্ভে জমা হয় না। আবার অবৈধ আয়, চাঁদাবাজি-তদবিরে আয় করা অর্থ, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সাধারণত দেশ থেকে পাচার হয়েছে। এছাড়া রফতানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের জন্য দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের মানি এক্সচেঞ্জ, বিদেশি ব্যাংক ও হুন্ডির রেট ভিন্ন ভিন্ন।

ব্যাংকের বিনিময় হারের তুলনায় হুন্ডিতে ভালো বিনিময়মূল্য পান বলেই প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর দিকে আগ্রহী হন। এমনকি সরকার ঘোষিত প্রণোদনার পরও হুন্ডিতে অনেক বেশি বিনিময় মূল্য পান প্রবাসীরা। এজন্যই ব্যাংকের বদলে হুন্ডির দিকে ঝুঁকেছেন তারা। বিদেশগামী ছাত্র, ব্যবসায়ী, রোগী কিংবা পর্যটক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ডলার কিনতে গেলে নানা হয়রানির শিকার হন। বিদেশ থেকে আনা মুদ্রা বিক্রি করতে গেলে ব্যাংকে অনেক সময়ই বিনিময় মূল্য কম পাওয়া যায়। তাছাড়া ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়। এতে ডলার কিনতে আগ্রহী গ্রাহকদের সময় ও কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়।

হুন্ডি এজেন্টদের গ্রাহকরা ফোন দিলে তারা গ্রাহকের বাসায় টাকা ও বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসে, পাশাপাশি তাদের দেয়া রেটও ব্যাংকের থেকে ভালো। গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের থেকে হুন্ডির সেবা তাই সহজ, দ্রুত এবং নিরাপদ।বিদেশের কর্মস্থল থেকে এজেন্টকে ফোন দিয়ে পরিমাণ বলে দিলেই তারা সমপরিমাণ টাকা পৌঁছে দিয়ে আসেন গ্রাহকের স্বজনের কাছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেন বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির সেবা। এছাড়া গ্রামে বা শহরে একেবারে গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়েও হাতে হাতে টাকা পৌঁছে দেন হুন্ডির কারবারিরা।

বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় দেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে চান, হুন্ডির কারবারিরা তা হাতে হাতে সংগ্রহ করে। কিন্তু ওই অর্থ দেশে আসে না। বিদেশে ঐ অর্থ তুলে দেয়া হয় দেশের টাকা পাচারকারীদের প্রতিনিধিদের হাতে। দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করেন তারা হুন্ডি চক্রের কাছে অর্থ দিয়ে দেন। আর হুন্ডি চক্র সমপরিমাণ টাকা তুলে দেয় বিদেশে টাকা পাচারকারীদের প্রতিনিধির কাছে। যে টাকা আবার তারা সংগ্রহ করেন দেশে টাকা পাঠাতে চাওয়া প্রবাসীদের থেকে। পক্ষান্তরে ব্যাংকে প্রবাসী আয়ের অর্থ ভাঙাতে গেলে গ্রাহকদের পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। অনেক সময় বৈধ পরিচয়পত্র-এনআইডি না থাকা, পরিচয়পত্র বহনের সচেতনতার অভাবও ব্যাংক থেকে প্রবাসী আয় ওঠানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা।

হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কোনো ফি নেই, বিপরীতে ব্যাংকে চার্জ কাটা হয় না। সামগ্রিকভাবে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রতি উৎসাহী। আরব আমিরাতের দুবাই, শারজাহ ও আবুধাবিতে কর্মরত আছেন হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক। তাঁরা দেশে টাকা পাঠাতে আলাদা কোনো ছুটি পান না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে নিজের অ্যাকাউন্ট প্রবাসে বসেই পরিচালনা করতে পারেন। প্রবাসী শ্রমিকেরা অ্যাপস ব্যবহারে এখনো অনেক পিছিয়ে আছেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ভয়ও কাজ করে। এজন্য তাঁরা এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেননা।

বাসার পাশেই হুন্ডি করার সুযোগ আছে, এটাই সহজ পথ। অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীরা হুন্ডি ছাড়া দেশে টাকা পাঠাতে পারেননা। বিদেশে বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী শ্রমিকেরই বৈধ কাগজ নেই। ফলে তারা নিজেদের ডকুমেন্ট দিয়ে ব্যাংকে লেনদেন করতে পারেননা। সেক্ষেত্রে দেশে টাকা পাঠাতে তাদের সহজ সমাধান হুন্ডি। বিমানবন্দরগুলোতে প্রবাসীদের সঙ্গে মার্জিত ব্যবহার করা হয়নি এতদিন।

হয়রানির কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের প্রতি প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের ঘৃণা ও আতঙ্ক বিরাজ করেছে। অনেক প্রবাসীই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছেন, এর নীরব প্রতিবাদ জানান। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করছে হুন্ডি। কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধ পথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচও কমাতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের একের পর এক ভুল নীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক খাতের নানা অস্থিরতা। ফলে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি কেবল নাজুকই হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে আর্থিক খাতকে বের করে আনতে হলে সবার আগে বিদেশে অর্থ পাচার ও হুন্ডি তৎপরতা ঠেকাতে হবে কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে এবং এ কাজ করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নাই

সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার

পুলিশ কবে পুলিশ হবে

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

ছবি

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মা তোর বদনখানি মলিন হলে

ব্যবসায়ী নেতৃত্বশূন্য ই-ক্যাব

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে নতুন পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

হুন্ডি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না

রেজাউল করিম খোকন

বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো আর্থিক খাতে শুরু হয়েছে বড় ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া। পুরো আর্থিক খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। এখন অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে কোন সংস্কার এখনই শুরু করা দরকার। আর্থিক খাত সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে যেটা করা দরকার, তা এখনই শুরু করতে হবে। না হলে বড় বিপদ আসবে পুরো আর্থিক খাতে।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধপথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টি। আর এ কর্মকা-ের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে হুন্ডির নাম। বলা হচ্ছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স ঢুকছে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে সরকার একদিকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা যোগ হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভা-ারে। সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্য। বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার।

হুন্ডিচক্রে বন্দি হয়ে পড়েছে বৈধপথের রেমিট্যান্স। এর ফলে অর্থ পাচারও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে প্রতি ডলারে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে, যা হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। হুন্ডিচক্র বিদেশে ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা রেখে দেয় এবং তাদের এজেন্টরা দেশে সুবিধাভোগীদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনছে। সাধারণত বাডুজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। মূলত শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারের জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় কম মূল্য বা বেশি মূল্য দেখানো হয়। অর্থ পাচারের জন্য দেশের বাইরে যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে, তা হুন্ডিচক্র মেটায়।

উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মুঘল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিলো অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মুঘল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ছিল ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে, যাকে তুলনা করা যায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের চেকের সঙ্গে। এই দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি। ভারতের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা মহাজনদের এই নেটওয়ার্ক আবার বজায় থাকতো তাদের পরিচিতি, দীর্ঘদিনের লেনদেন এবং পারস্পরিক বিশ্বস্ততার মধ্য দিয়ে।

মুঘল প্রশাসকরা দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর জন্য এই মহাজনদের ওপর নির্ভর করতেন। এই মহাজনরাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দিতেন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্র্যাজেডির অন্যতম কুশীলব জগৎ শেঠও ছিলেন একজন হুন্ডির মহাজন। পুরো ভারতজুড়ে ছিল তার হুন্ডির কারবার। মুঘল আমলের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। এর কার্যকারিতার জন্য ব্রিটিশরাও একে অর্থ লেনদেনের দেশীয় ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়। এমনকি একে বৈধতা দেবার জন্য রানীর সিলসহ স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচলন করে।

হুন্ডি একটি বৈশ্বিক চক্র। ফলে সারাবিশ্ব থেকে প্রবাসীদের পাঠানোর অর্থ দেশে পরিজনদের পৌঁছে দেন। হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন অনেক সময় তারা ব্যাংকে যেতে পারেননা। আবার প্রবাসের সব শ্রমিকের বৈধ কাগজ নেই। যে কারণে চাইলেও অনেকে ব্যাংকে অর্থ পাঠাতে পারেন না। হুন্ডি হলো প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়।

বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয়না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যযুগে ভারতে সম্পদ লেনদেনের জন্য প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা হয়। বর্তমানে বৈধ পদ্ধতি এড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা আনার কাজে হুন্ডি পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো ও দেশ থেকে অর্থ পাচার এই দুটো বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে।

প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার আনলে বা ডলার এনে ঘোষণা দিলে সেটা বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে যোগ হয় কিন্তু অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ আসলে সেটা রিজার্ভে জমা হয় না। আবার অবৈধ আয়, চাঁদাবাজি-তদবিরে আয় করা অর্থ, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সাধারণত দেশ থেকে পাচার হয়েছে। এছাড়া রফতানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের জন্য দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের মানি এক্সচেঞ্জ, বিদেশি ব্যাংক ও হুন্ডির রেট ভিন্ন ভিন্ন।

ব্যাংকের বিনিময় হারের তুলনায় হুন্ডিতে ভালো বিনিময়মূল্য পান বলেই প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর দিকে আগ্রহী হন। এমনকি সরকার ঘোষিত প্রণোদনার পরও হুন্ডিতে অনেক বেশি বিনিময় মূল্য পান প্রবাসীরা। এজন্যই ব্যাংকের বদলে হুন্ডির দিকে ঝুঁকেছেন তারা। বিদেশগামী ছাত্র, ব্যবসায়ী, রোগী কিংবা পর্যটক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ডলার কিনতে গেলে নানা হয়রানির শিকার হন। বিদেশ থেকে আনা মুদ্রা বিক্রি করতে গেলে ব্যাংকে অনেক সময়ই বিনিময় মূল্য কম পাওয়া যায়। তাছাড়া ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়। এতে ডলার কিনতে আগ্রহী গ্রাহকদের সময় ও কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়।

হুন্ডি এজেন্টদের গ্রাহকরা ফোন দিলে তারা গ্রাহকের বাসায় টাকা ও বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসে, পাশাপাশি তাদের দেয়া রেটও ব্যাংকের থেকে ভালো। গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের থেকে হুন্ডির সেবা তাই সহজ, দ্রুত এবং নিরাপদ।বিদেশের কর্মস্থল থেকে এজেন্টকে ফোন দিয়ে পরিমাণ বলে দিলেই তারা সমপরিমাণ টাকা পৌঁছে দিয়ে আসেন গ্রাহকের স্বজনের কাছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেন বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির সেবা। এছাড়া গ্রামে বা শহরে একেবারে গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়েও হাতে হাতে টাকা পৌঁছে দেন হুন্ডির কারবারিরা।

বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় দেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে চান, হুন্ডির কারবারিরা তা হাতে হাতে সংগ্রহ করে। কিন্তু ওই অর্থ দেশে আসে না। বিদেশে ঐ অর্থ তুলে দেয়া হয় দেশের টাকা পাচারকারীদের প্রতিনিধিদের হাতে। দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করেন তারা হুন্ডি চক্রের কাছে অর্থ দিয়ে দেন। আর হুন্ডি চক্র সমপরিমাণ টাকা তুলে দেয় বিদেশে টাকা পাচারকারীদের প্রতিনিধির কাছে। যে টাকা আবার তারা সংগ্রহ করেন দেশে টাকা পাঠাতে চাওয়া প্রবাসীদের থেকে। পক্ষান্তরে ব্যাংকে প্রবাসী আয়ের অর্থ ভাঙাতে গেলে গ্রাহকদের পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। অনেক সময় বৈধ পরিচয়পত্র-এনআইডি না থাকা, পরিচয়পত্র বহনের সচেতনতার অভাবও ব্যাংক থেকে প্রবাসী আয় ওঠানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা।

হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কোনো ফি নেই, বিপরীতে ব্যাংকে চার্জ কাটা হয় না। সামগ্রিকভাবে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রতি উৎসাহী। আরব আমিরাতের দুবাই, শারজাহ ও আবুধাবিতে কর্মরত আছেন হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক। তাঁরা দেশে টাকা পাঠাতে আলাদা কোনো ছুটি পান না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে নিজের অ্যাকাউন্ট প্রবাসে বসেই পরিচালনা করতে পারেন। প্রবাসী শ্রমিকেরা অ্যাপস ব্যবহারে এখনো অনেক পিছিয়ে আছেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ভয়ও কাজ করে। এজন্য তাঁরা এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেননা।

বাসার পাশেই হুন্ডি করার সুযোগ আছে, এটাই সহজ পথ। অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীরা হুন্ডি ছাড়া দেশে টাকা পাঠাতে পারেননা। বিদেশে বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী শ্রমিকেরই বৈধ কাগজ নেই। ফলে তারা নিজেদের ডকুমেন্ট দিয়ে ব্যাংকে লেনদেন করতে পারেননা। সেক্ষেত্রে দেশে টাকা পাঠাতে তাদের সহজ সমাধান হুন্ডি। বিমানবন্দরগুলোতে প্রবাসীদের সঙ্গে মার্জিত ব্যবহার করা হয়নি এতদিন।

হয়রানির কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের প্রতি প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের ঘৃণা ও আতঙ্ক বিরাজ করেছে। অনেক প্রবাসীই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছেন, এর নীরব প্রতিবাদ জানান। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করছে হুন্ডি। কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধ পথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচও কমাতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের একের পর এক ভুল নীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক খাতের নানা অস্থিরতা। ফলে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি কেবল নাজুকই হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে আর্থিক খাতকে বের করে আনতে হলে সবার আগে বিদেশে অর্থ পাচার ও হুন্ডি তৎপরতা ঠেকাতে হবে কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে এবং এ কাজ করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top